নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

\'আমাদের চাওয়া আর পাওয়ার মাঝখানে একটা দেয়াল আছে, এর একদিকে থাকে চাওয়া,আর একদিকে পাওয়া। মুখ্য সমস্যা হল দেয়ালটা স্বচ্ছ কাঁচের\'

যাযাবর জোনাকি

‘আমাদের চাওয়া আর পাওয়ার মাঝখানে একটা দেয়াল আছে, এর একদিকে থাকে চাওয়া,আর একদিকে পাওয়া। মুখ্য সমস্যা হল দেয়ালটা স্বচ্ছ কাঁচের’

যাযাবর জোনাকি › বিস্তারিত পোস্টঃ

পরশ (গল্প)

৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১০:২৫


[ এই গল্পের সকল চরিত্র কাল্পনিক। এই গল্পের সাথে বাস্তবিক কোন ব্যক্তি বা ঘটনার কোন প্রকার মিল পাওয়া গেল, তা কেবল কাকতালীয় ব্যাপার মাত্র। এই গল্পে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে কোন প্রকার রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক বা বিশেষ কোন গোষ্ঠীর মূল্যবোধে আঘাত করা হয়নি। গল্প বলার খাতিরে যদিওবা তা হয়ে থাকে তবে ক্ষমাপ্রার্থনা করছি। এই গল্পে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন সামাজিক বিষয় গুলি নিয়ে যেসব মন্তব্য করা হয়েছে, তা কেবল মাত্র নিরপেক্ষভাবে গল্পের চরিত্রগুলির স্বকীয়তা ফুটিয়ে তোলবার জন্যই। এইক্ষেত্রে গল্পের মাধ্যমে ব্যক্তিগত কোন মতামত বা মতাদর্শ আরোপিত করার ধৃষ্টতা করা হয়নি। এটি আর দশটা গল্পের মতই নিছক একটা গল্প মাত্র, এর মধ্যে কোন নৈতিকতা নেই।
- যাযাবর জোনাকি ]
শীতের রাত, আকাশ পরিষ্কার থাকে। পরশ একা ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের তারা দেখতে পরশের ভাল লাগে। এক মানুষের বুক সমান উঁচু পাচিল দিয়ে ছাদটা ঘেরা। শেওলা শুকানো কালো ছাদটা পরশের অনেক প্রিয় একটা যায়গা।পরশের রাতে ঘুম হয় না, মেডিকেলের ছাত্র থাকা অবস্থায় রাত জেগে পড়াশোনা করতে করতে এই বদ অভ্যাস তার হয়েছে। এখন আর পড়াশোনা করতে ভাল লাগেনা তাই সে সারারাত আকাশের তারা দেখে কাটায়। রাতের পরিবেশ তার ভাল লাগে।কিছুকিছু ব্যাপার যেমন এখন, রাত সাড়ে তিনটার দিকে ৫-৬ টা কাকের একটা দল পুকুরপাড়ের বেল গাছটা থেকে উড়ে যায় দক্ষিনের দিকে। পরশের বেশ মজা লাগে, মনেহয় যেন এরা অনেক দূরে কোথাও চাকরি করে, তাই শেষরাতেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। আবার পাশের বাড়ির ছাদে একটা হুলো আর মেনি মারামারি করে, গাছের পাতার আড়ালে সঙ্গম করে, এই ব্যাপারটাও সে উপভোগ করে। ফজরের আযানের কিছুক্ষণ আগে যখন পরশের দাদাজী ঘুম থেকে উঠে চিৎকার করে, "পিউ কাহা, পিউ কাহা" পরশের ভালো লাগে।

অনেকক্ষণ আকাশ দেখার পর পরশের একটা কবিতার লাইন মনে পড়ল,"মানুষ কি পাখি , পাখায় লেখা এক যাযাবর পথ? " কবিতাটি দ্রোহ ও প্রেমের কবি রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর লেখা। মানুষ কি যাযাবর শ্রেণী থেকে আজ ঘরসংসার করে থিতু হয়েছে, অনেকটা কুকুরের মত, কুকুর যেমন নেকড়ের দল থেকে বের হয়ে এসে জঙ্গলি থেকে গৃহপালিত হয়েছে। হয়তো মানুষের মাঝেও একটা বড় দল ঘরসংসার করে থিতু হয়ে গেছে, আর বাকি ছোট দলটি যাযাবর হয়ে পথেপথে ঘুরতে ঘুরতে একসময় হারিয়ে গিয়েছে। পরশ কখনো ঢাকার বাইরে যায়নি।আর কোনদিন যাওয়া হবে বলে মনেও হয় না তার। তার কাছে মনেহয় তার জীবন সেই বইয়ে পড়া ক্ষুদ্র কীটগুলির মত যাদের জন্ম হয় ঘোড়া একটা লাদির মধ্যে, আর লাদি শুকিয়ে গেলে তাদের মৃত্যুও হয় ওরই মধ্যে। পরশ একটু ভালোভাবে চিন্তা করে দেখে, আসলে তার আশেপাশে সবার জীবনই তো তাই, বস্তুত সারা পৃথিবীকে যদি একটা ঘোড়ার লাদি কল্পনা করা হয় তাহলে সকল প্রানিই সেইসব কীট। বাহ, পরশ নিজের চিন্তায় নিজেই মুগ্ধ হয়ে যায়। সে এই চিন্তার নাম দেয় "ঘোড়ার লাদি থিওরি ",আচ্ছা ঘোড়ার লাদির ইংরেজি কি হতে পারে? পরশ ব্যাপারটা মাথায় রাখে, পরে এক সময় সে ডিকশনারি দেখে নেবে।হঠাৎ দোতালার ঘর থেকে চিৎকার ভেসে এল আর রাতের নিস্তব্ধতাটা কে ভেঙে খানখান করে দিল।
"পিউ কাহা, পিউ কাহা! পিউ কাহা, পিউ কাহা "
পরশের দাদাজির ঘুম ভেঙেছে।

পরশের দাদাজির নাম ডা.এলাহি বক্স। তাঁর বয়স ১০৮-৯ হবে। তিনি একা একা হাটা চলা করতে পারেননা,তাকে দেখাশোনা করার জন্য একজন লোক রাখা আছে। দাদাজি কথাবার্তাও বলেন না। কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করলে ঘড়ঘড়ে গলায় শুধু বলেন, "রাঞ্চি, মুজাফফারা বাদ, মুর্শিদাবাদ, বেহরাম পুর.."। তিনি ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার মেডিকেল অফিসার ছিলেন,ইন্ডিয়ার এই যায়গা গুলিতে তার পোস্টিং ছিলো বলে পরশ শুনেছে তার মা'য়ের কাছে। পরশের মা তার দাদাজিকে বেশ শ্রদ্ধা করতেন। তিনি সবসময়ই চাইতেন পরশ তার দাদাজির মত ডাক্তার হোক। এলাহি বক্সের তিন ছেলে এক মেয়ে। দেশভাগের সময় তাঁর বড়ছেলে মওলা বক্স দাঙ্গায় মারা যায়। তখনো পরশের বাবা জন্মনেননি।এই ঘটনার পর দুই ছেলে-মেয়ে আলী বক্স, জুলেখা আর স্ত্রী সুফিয়া বেগম কে নিয়ে তিনি রাজশাহী চলে আসেন। এলাহি বক্সের ইন্ডিয়াতে বেশ যশ ছিলো। সরকারি চাকুরীর পাশাপাশি তিনি প্রাইভেট প্রাকটিসও করতেন। তাঁর টাকাপয়সা ছিলো প্রচুর। মুর্শিদাবাদে হুগলী নদীর ধারে তার দোতালা বাড়ি ছিলো। ১৯২৫ সালের একটা সেভরোলে কার তিনি নগদ ৩০০০টাকায় কিনে ছিলেন। সব বিক্রি করে দিয়ে, দেশভাগের সময় এক্সচেঞ্জ প্রোগামের মাধ্যমে বাড়ি বদল করে রাজশাহী এসে তিনি দেখেন এদেশে তাকে কোলনীর একটা সস্তা টিনের বাড়ি দেয়া হয়েছে। তিনি রাগে দুঃখে কোলনীর বাড়ি নাম মাত্র দামে বিক্রি করে দিয়ে ঢাকা চলে আসেন। তার সব নগদ টাকা দিয়ে তিনি ঢাকায় গোয়াল গুন্নি রাস্তার এই দোতলা বাড়িটা একজন হিন্দুর কাছে থেকে কিনে নেন। তিনি ভেবেছিলেন ঢাকায় এসেও তিনি টাকাপয়সা করতে পারবেন, আগের মত যশ পাবেন,কিন্তু তা আর হয়নি। ঢাকায় আসার পর মৌলবি সাহেব অর্থাৎ পরশের বাবা খোদা বক্সের জন্ম হয়।স্ত্রী তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে তিনি অতি কষ্টে জীবন ধারন করতেন। তাঁর স্ত্রীর যক্ষা হলে, বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। পরবর্তীতে অনেক অর্থকষ্টের মধ্যেদিয়ে তিনি ছেলেদের লেখাপড়া শিখান। যখন তার মেজো ছেলে আলী বক্স ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য লন্ডন যান, তখন এলাহি বক্স অনেক ধার-কর্জ করে সেই টাকা যোগাড় করেন। তাঁর আশা ছিলো ছেলে বিদেশি ডিগ্রী নিয়ে দেশে এসে অনেক টাকা আর যশ কামাবে তাঁর মত। কিন্তু আলী বক্স আর দেশে ফেরেননি, পরিবারের সাথে আর কোনরকম যোগাযোগও রাখেননি। পরবর্তীতে মৌলবি সাহেব মানে খোদা বক্স, তাঁর বাবার সব ঋণ শোধ করে দেন। এই সবই পরশ শুনেছে তার বুয়াজি-জুলেখার কাছে। এলাহি বক্স এমনিতে অনেক সৌখিন মানুষ। এত কষ্টের মাঝেও তার কেনা বাড়িটি তিনি বিক্রি করেননি বা ভাড়া দেননি। সদরদরজায় অতীতে টাঙানো তার কাঠের নাম ফলকটি আজ মলিন বর্তমান।
Dr.Elahi Bakhsh
LMS (Licentiate in Medicine and Surgery),1937,
Medical Officer, British India.

এলাহি বক্সের গান শোনার শখ,তিনি ইন্ডিয়া থেকে আসার সময় অযথা জিনিষ সব বিক্রি করে দিয়ে ছিলেন, কিন্তু তার শখের 'হিজ মাস্টার'স ভয়েজ' এর পোর্টেবল গ্রামোফোনটা, কলম্বিয়া রেকর্ডসের তিনটি বেগম আখতারি বাই ফয়জাবাদির গান আর জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামীর কিছু নজরুল গীতির রেকর্ড সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন। সেগুলি আজও চলছে। দোতালা থেকে আবার চিৎকার ভেসে এল,
"পিউ কাহা, পিউ কাহা! পিউ কাহা, পিউ কাহা! "
প্রথম প্রথম পরশ বুঝতে পারতো না এই 'পিউকাহা মানে' কি। পরে সে একটা বই থেকে জেনেছে, পাপিয়া জাতের পাখির ডাক কে পিউ কাহা বলে। আসলে "বউ কথা কও" হিন্দীতে কি "পিউ কাহা"? কবি নজরুলের নাকি প্রিয় শব্দ ছিলো এই 'পিউ কাঁহা'। পরশের দাদাজি যখন "পিউ কাহা" বলে চিৎকার করবে তখন বুঝতে হবে তিনি গান শুনতে চাইছেন। দিনে তিনবার তিনি পিউ কাহা বলে চিৎকার করেন, এই শেষরাতে, দুপুরবেলা খাবার পর আর সন্ধ্যাবেলা।তাঁর দেখা শোনার যে লোক আছে সে তাঁর সামনে সব রেকর্ড গুলি ধরে, তার মধ্য থেকে তিনি একটা বাছাই করে দেন। ভোর হতে আর বেশি বাকি নেই, পরশ ছাদ থেকে নিচে নেমে যাচ্ছে। দোতালা থেকে গ্রামোফোনের আওয়াজ ভেসে আসছে, জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামীর কন্ঠে,
"...কুহু আজি ডাকে মুহুমুহু
পিউ কাহা কাঁদে উহু উহু ,
পাখায় পাখায় দোহে দুহু
বাধে চঞ্চর চঞ্চরী ।।"

পরশ নিচে নেমে এসে নিজের ঘরে গিয়ে কম্বল মুরি দিয়ে শুয়ে পড়ল, কিন্তু ঘুমাল না। আযানের সময়,এখন মৌলবি সাহেব ঘুম থেকে উঠবেন । আযানের সময় বাড়িতে গান বাজছে শুনে তিনি চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করবেন। এটা এই বাড়িতে রোজ দুইবেলা হয়, ভোরে আর সন্ধ্যাবেলা। পরশের ভাল লাগে। মৌলবি সাহেবের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল,
" আসতাগফিরুল্লাহ! ফযরের আজানের সময় এই সব গানা বাজানা বন্ধ করেন। আল্লাহ্‌র গজব পড়বে এই বাড়িতে। মরনের ভয় নাই। কবর আজাবের ভয় নাই। আল্লাহ্‌র ত্রিশটা দিন দুইবেলা এই হারাম কাজ। এই সব হারাম কাজ বন্ধ করেন। বাড়িটাকে জাহান্নাম বানায়ে রাখছে। আল্লাহ্‌র ওয়াস্তে এইসব নাচা গানা বন্ধ করেন।"
সদরদরজা খোলা,বন্ধের আওয়াজ পাওয়া গেল। মৌলবি সাহেব নামাজ পড়তে মসজিদে গেলেন।

খোদা বক্সকে বাড়ি, পাড়ার সবাই মৌলবি সাহেব বলে ডাকেন। তিনি হুজুর মানুষ। যতনা বেশি সবাই তাকে সম্মান করে তারচেয়ে বেশি ভয় পায়। তিনি নাকি আগে এমন ছিলেন না। পরশ জুলেখা বুয়াজির কাছে শুনেছে, মৌলবি সাহেব আগে অনেক মেধাবী ছাত্র ছিলেন, তার বড় ভাইয়ের চেয়েও মেধাবী ছিলেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে স্কুলের হেড মাস্টার নিজে বাড়ি বয়ে এসে তাঁর জন্য খাবার, ফলমূল দিয়ে খোঁজ খবর নিয়ে যেতেন। কি হল হঠাৎ তিনটা পরীক্ষার পর মৌলবি সাহেব কঠিন টাইফয়েডে পড়লেন। বাদবাকি পরিক্ষা তিনি আর দিতে পারলেন না। সেই সময় স্কুলের হেডমাস্টার এক পীরের কাছে নিয়ে গেলেন মৌলবি সাহেব কে। সেই পীর প্রতি সাত দিনে একদিন দোয়া পড়ে মৌলবি সাহেব কে ঝেড়ে দিতেন। এভাবে একদিন মৌলবি সাহেব পুরোপুরিভাবে সুস্থ হয়ে গেলেন এবং সেই পীর সাহেবের মুরিদ হয়ে গেলেন। এরপর অল্পবয়সে তিনি পাচ ওয়াক্ত নামাজ ধরলেন, মুখ ভরা দাঁড়ি রাখলেন,দুনিয়াবি পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে, কোরআনের হাফেজ হলেন। সেই সময় নাকি এলাহি বক্স খুব আঘাত পেয়েছিলেন, কিন্তু কিছুই বলেননি। কারন এলাহি বক্স ছেলের চিকিৎসার খরচও দিতে পারেননি। মৌলবি সাহেবে তার সম্পূর্ণ মেধাকে কাজে লাগিয়ে, বন্ধু বান্ধবের কাছে ধার করে টিপু সুলতান রোডে একটা লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ খোলেন। নিজের দক্ষতা আর সততা দিয়ে তিনি বছরঘুরেই লাভের মুখ দেখেন। বুয়াজির বিয়ে দেন। দাদাজির সব ধারদেনা শোধ করেন।নিজে একটু অল্পবয়সেই বিয়ে করেন। পরশের নানাজি মৌলবি সাহেবের ব্যাবসায় আরও কিছু টাকা দেন। সেই টাকা দিয়ে তিনি নতুন নতুন মেশিন কিনে তার ব্যাবসা বড় করেন। মৌলবি সাহেবের সব গুন একটা দোষে ঢাকা পড়ে সেটা হল তাঁর রাগ। তিনি প্রচণ্ড জেদি আর বদরাগী মানুষ। পরশরা তিন ভাইবোন। পরশের বড় দুইবোন অদিতি আর অন্তরা। অদিতি বয়সে পরশের অনেক বড়। পরশের যখন ১৫বছর বয়স,তখন অদিতি বুয়েটের ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। একদিন অদিতির জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে তারই একজন শিক্ষক। প্রথমে মৌলবি সাহেব রাজি ছিলেন বিয়ে দিতে,কিন্তু ছেলে সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে তিনি জানতে পারলেন, এই শিক্ষকের সাথে অদিতির আগে থেকেই প্রেমের সম্পর্ক ছিল।মৌলবি সাহেব বিয়ে বাতিল করে দিলেন। বাড়িতে এসে অদিতি কে ইচ্ছামত বেত্রাঘাত করলেন।তারপর দোতালার একটা ঘরে অদিতিকে তালা বন্ধ করে রাখলেন।বাথরুম করার জন্য ঘরে একটা বড় লোহার বালতি দিলেন আর তিনবেলা খাবার তিনি নিজে হাতে তালা খুলে দিয়ে যেতেন । এভাবে যখন অদিতি আর সেমিস্টার ফাইনাল দিতে পারলো না তখন সে বাড়ি থেকে পালাল । মৌলবি সাহেব পুরা ব্যাপারটার জন্য দায়ী করলেন পরশের মা কে। তিনি পরশের মা কেও অহেতুক বেত্রাঘাত করলেন। তখন থেকে অদিতির জন্য এ বাড়ির দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।মাঝখানে কপাল পুড়ল অন্তরার। অন্তরা তখন কলেজে পড়ে, অন্তরার লেখাপড়া বন্ধ করে দিলেন মৌলবি সাহেব।তিনমাসের মধ্যে মাঝবয়েসী এক ব্যবসায়ীর সাথে বিয়ে দিয়েদিলেন অন্তরার।এর অনেকদিন পর যখন এ বছরের শুরুতে পরশের মা হঠাৎ ক্যান্সারে মারা গেলেন তখন অদিতি এসেছিল মা'কে শেষবারের মত দেখতে। মৌলবি সাহেব তাকে বাড়িতে ঢুকতে দেননি। বাড়ি থেকে লাশ বের হওয়া পর্যন্ত অদিতি, তার জামাই, ছেলেমেয়ে নিয়ে সদরদরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল।

পরশের তার মা'র কথা খুব মনে পড়ে। ছোটবেলা থেকে সে খুবই মা নেওটা। পরশের মা বোকাসোকা মানুষ ছিলেন।খুবই কম কথা বলতেন। পরশকে সবসময় আগলে রাখতেন। পরশ মা'কে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। মায়ের কাছে পরশ কখনো কিছু লুকোয়নি। সবসময় মা যা যা বলেছে পরশ সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। আসলে মায়ের কথার বাইরে যে কোন কাজ করা যায় এইরকম ধরনাই পরশের ছিলো না বহু বছর। পরশের মা'র হাতের রান্না খুবই ভাল ছিলো। মা পরশকে নিজে হাতে খাইয়ে দিতেন সব সময়।পরশের নিজেস্ব পৃথিবীর বিশাল একটা অংশ তার মা আর মায়ের স্মৃতি দখল করে আছে। মায়ের প্রতি ভালোবাসার চেয়ে মায়ের প্রতি অগাধ বিশ্বাস কথাটা পরশের ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য। কেননা আগে মৌলবি সাহেবও পরশকে অনেক স্নেহ করতো,কিন্তু একদিনের ঘটনার পর থেকে সব বদলে গেল। সেদিন কি হল,তখন পরশ অনেক ছোট,কত আর বয়েস হবে এই ৫-৬ বছর।পরশ তার বোনদের কাছে গিয়ে আবদার করল,তাকে তার প্রিয় নাইকা শ্রীদেবির মত করে সাজিয়ে দিতে হবে।অদিতি আর অন্তরা মজা করে পরশের ঠোটে লাল লিপস্টিক দিয়ে দিলো,চোখে কাজল লাগিয়ে দিলো, কপালে একটা লাল বড় টিপ পরিয়ে দিলো, গলায় পুথির মালা, কানে টিপওয়ালা দুল,হাতে কাচের চুড়ি আর মা'র বিয়ের জরি দেয়া লাল বড় ওড়নাটা শাড়ির মত করে পরিয়ে দিলো। পরশ খুশিতে আত্মহারা হয়ে টিভির সামনে গিয়ে শ্রীদেবির গানের তালে তালে কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে নাচতে লাগলো।পরশের নাচ দেখে অদিতি, অন্তরা হাততালি দিচ্ছিলো। ঠিক সে সময় মৌলবি সাহেব বাড়িতে উপস্থিত হলেন। হাত তালি, গান আর হৈচৈ শুনে তিনি টিভির ঘরে গেলেন । পরশ তখনো আপন মনে নেচেই চলেছে। মৌলবি সাহেব কে আচমকা দেখে অদিতি, অন্তরা ভুত দেখার মত দৌড়ে পালিয়ে গেল। মৌলবি সাহেব পরশকে একটা কোষে চড় মারলেন। পরশ চড় খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল।মৌলবি সাহেব ক্ষান্ত হলেন না, এরপর বেত দিয়ে পরশকে পশুপেটা করলেন। পরশ তখন ভয়ে কান্নাকাটিও করতে পারছিল না, শুধু অবলার মত গোগো আওয়াজ করছিলো। পরশের মা দৌড়ে এসে মৌলবি সাহেব কে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেন না। শুধু পরশকে আগলে ধরে নিজের পিঠ পেতে দিলেন। মৌলবি সাহেব ক্লান্ত হয়ে যাওয়া পর্যন্ত বেত চালিয়ে গেলেন। সে বছর থেকে ঈদের দিন নামাজ পড়তে যাবার সময় পরশের হাত আর ধরতেন না মৌলবি সাহেব, পরশ তাঁর পিছে পিছে যেতো। পরশ তখন থেকেই বেশ বুঝতে পেরেছিল কোন একটা সমস্যা সে তৈরি করেছে,যেটার সমাধান নেই।সে মৌলবি সাহেবের স্নেহ, ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে গেছে চিরতরে।মৌলবি সাহেব তখন থেকে পরশকে শুধুই অবজ্ঞা করে চলে।সেদিন থেকেই পরশের মা তাকে সব সময়ের জন্য আগলে আগলে রাখতো। পরশও মাকে ছাড়া আর কাউকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারতোনা। সৌরজগৎ সম্পর্কে জ্ঞান হওয়ার সাথে সাথে পরশের কাছে মনে হয়েছে তার আশেপাশের মানুষগুলি বিভিন্ন বলয়ে পরশকে কেন্দ্রকরে ঘুরছে। প্রথম বলয়ে মা আর সজল, দ্বিতীয় বলয়ে জুলেখা বুয়াজি, অন্তরা, অন্তরার ছেলেমেয়ে, আগে অদিতিও এই বলয়ে ছিল, কিন্তু মৌলবি সাহেবের কারনে সে অনেক দূরে কোথাও হারিয়ে গেছে। ৩য় বলয়ে আছে নানাজি,অলোপা, আর শায়েরা । ৪র্থ বলয়ে কোথাও আছে মৌলবি সাহেব, তিনি আগে প্রথম বলয়েই ছিলেন, নিজে থেকে ৪র্থ বলয়ে চলে এসেছেন। ৫ম এবং শেষ বলয়ে আছে ভৌমিক সরকার, তিনি পরশের বাবার ওয়ার্কশপের ক্যাশিয়ার। লোকটি পরশকে অনেক স্নেহ করেন। পরশের এই নাতিদীর্ঘ জগৎ এ তার দাদাজি কেমন যেন ইতিহাস হয়ে আছেন। বাসাবাড়ির এন্টিক কোন জিনিষের মত।
ছোটবেলায় পরশ বুয়াজির কাছে শুনেছিলো প্রজাপতির কথা। প্রজাপতির জীবনচক্রে চারটি ধাপ থাকে, ডিম, শুঁয়োপোকা, গুটিপোকা এবং প্রজাপতি।প্রজাপতি গাছের পাতার ওপরে ডিম পাড়ে। ডিম থেকে শুঁয়োপোকাতে পরিণত হতে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগে।শুঁয়োপোকা থেকে গুটিপোকাতে পরিণত হতে কমপক্ষে পাঁচদিন সময় লাগে। এসময় এরা একটা ককুনের মধ্যে থাকে।এর দুই সপ্তাহ পর গুটিপোকা হতে ককুন কেটে বের হয় পরিণত প্রজাপতি।
পরশ দেখতে অনেক সুন্দর, সুপুরুষ। অনেকটা পাঞ্জাবী শিখদের মত চেহারার, তার নানাজির মত। তার চেহারায় মেয়েদের আকর্ষণ করার একটা ক্ষমতা আছে। এটা পরশ জানে অনেক আগে থেকেই।তখন পরশ ক্লাশ এইটে পড়ে, ঠোঁটের ওপর হালকা গোঁফের রেখা গজিয়েছে। পরশের ককুন কেটে বের হওয়ার সময়। অদিতির এক বান্ধবী হেলেন এসেছিল পরশদের বাড়িতে। দুপুরবেলা যখন সবাই ঘুমে তখন পরশ বসে বসে নিজের ঘরে অংক কষছে, হঠাৎ করে হেলেন ঘরে ঢুকে পরশকে জড়িয়ে ধরে। পরশ ভয় পেয়ে যায়। হেলেন জোর করে পরশের গালে, গলায়, ঠোঁটে চুমু খায়। পরশের তখন মনে হচ্ছিলো কেউ যেন তার বুকের ভেতর হাতুরি পেটাচ্ছে, ধড়াস, ধড়াস!পরশের ঘৃণায় গা রিরি করে ওঠে। পরশ গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে হেলেন কে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দেয়, তারপর এক দৌড়ে কলতলায় গিয়ে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ভালো করে সাবান দিয়ে গাল, গলা,ঠোঁট পরিষ্কার করে। পেছন থেকে হেলেন এসে মাফ চেয়ে বলে,
"পরশ, ভাইয়া আসলে আমার ভুল হয়ে গেছে, আমি বুঝতে পারিনি... "
পরশ এক দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।বিছানায় শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে পরশ তার তৈরি সমস্যা টের পায়। এই সবকিছুর জন্য সে ঈশ্বর কে না নিজেকে, কাকে দোষী সাব্যস্ত করবে ঠিক বুঝতে পারেনা।

সকালে আটটার দিকে পরশের ঘুম ভাঙল মৌলবি সাহেবের চিৎকার চেঁচামেচিতে। আওয়াজ আসছে বারান্দার খাবার টেবিল থেকে। মৌলবি সাহেব টেবিলে বসেন না, তিনি বসেন টেবিলের পাশে জলচৌকিতে। এখন তিনি বকাবকি করছেন রান্নার বুয়াকে।
" প্রতিদিন এক কাদার মত রুটি, আর ডিম পোচ! আর কাচাকাচা সবজি! এই খেতে রুচি হয়? তেল কি তোমাদের কম কিনে দেয়া হয়। শীতের সময় খিচুড়ি, ঘুগনি পোলাও, আলুভাজি করতে পারো না। "
ঝনঝন করে থালা ফেলে দেয়ার আওয়াজ পাওয়া গেল। পরশের চোখ আবার ঘুমে বন্ধ হয়ে গেল।

মৌলবি সাহেব রাগ করে না খেয়েই বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন। ওয়ার্কশপে ঢুকেই তিনি তার একজন কর্মচারী কে হোটেল থেকে নাশতা আনতে পাঠালেন। ভৌমিক বাবু বসে বসে খাতায় হিসেব দেখছিলেন। খাতা থেকে চোখ না তুলে তিনি বললেন,
"মৌলবি সাহেব, এই বয়সে বাইরের খাওয়াটা ঠিক হবে না। "
"আপনাকে কত বললাম একটা রান্নার লোক খুঁজে দেন। এই কাজের লোকের রান্না মুখে তোলা যায় না! "
নাশতা এল, খিচুড়ি গরুর মাংস। মৌলবি সাহেব হাত ধুয়ে খেতে আরম্ভ করলেন। ভৌমিক বাবু কর্মচারীকে চা আনতে পাঠালেন।
"মৌলবি সাহেব, পরশবাবু এসেছিলেন দোকানে। বললেন চাকরি নাকি ছেড়ে দিবে,এই ব্যাবসার দেখাশোনা করবে।আপনাকে কিছু বলেছেন? "
"কই না তো, ব্যাবসার দেখাশোনা করবে, বললেই হল! এটা কি দোকান না ওয়ার্কশপ। এখানে কাজ হয়, টেকনিক্যাল কাজ, কলা বিজ্ঞানের ছাত্রর কাজ না। এখানে আমি এখনো নিজে হাতে কাজ করি,কাজ তদারকি করি, এরপর বললে, বলে দিবেন এটা মুদিখানার ব্যাবসা না। ব্যাবসা দেখাশোনা করবে,আসছে, আবদার! " খাওয়া শেষ করে মৌলবি সাহেব কাজে লেগে পড়লেন।

বেলা এগারোটার দিকে পরশের ঘুম পুরাপুরি ভেঙে গেলে, মোবাইল ফোনের আওয়াজে। সজল ফোন করেছে। মোবাইল ফোনটা কানে ধরতে ধরতে পরশের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল।
"কি রে, তুই নাকি চাকরি ছেড়ে দিচ্ছিস? জয়েন না করতেই! হারামজাদা তোমার তেল হইসে না! মানুষ চাকরি পাইতেসে না । এই দেশে কাকের চেয়ে ডাক্তারের সংখ্যা বেশি। আর তুই? "
"না, নিয়োগপত্র আসচে ১৫ তারিখে,কালকে,২২ তারিখের মধ্যে যোগদান করতে হবে, আক্কেলপুর পোষ্টিং। তাই চিন্তা করছি করবো না। বাবার ব্যাবসা দেখাশোনা করবো। "
"সরকারি চাকরি,এসব কথা বাদ দিয়ে, চাকরীতে জয়েন কর। রাখি, বাসায় আসিস।"
"আচ্ছা। "
সজল ছোটবেলা থেকে পরশের বন্ধু। পরশের প্রথম বলয়ের মানুষ।সজলের বাড়ি শাঁখারী বাজার। সজলকে পরশের ভালো লাগে, সজলের বড় ভাইকেও পরশের ভালো লাগে, বস্তুত পরশ তো ছোট বেলায় চাইতো যে, সজলের বড় ভাই সবুজের সাথে অন্তরার বিয়ে হোক, তাহলে পারিবারিক ভাবে সজল, সবুজ ভাই তার কাছে কাছে থাকবে। পরশ চায় তার কাছের মানুষগুলি সবসময় কাছেকাছে থাকুক। এই জন্য পরশ তার কাছের আরেকটি মানুষের সাথে অনেক যোগবিয়োগ করে সজলের বিয়ে দিয়েছে। সেই কাছের মানুষটির নাম অলোপা। অলোপা পরশের কলেজের বান্ধবী। শুরুতে সে যদিওবা পরশের প্রতি খুবই দুর্বল ছিলো, কিন্তু পরে তারা ভালো বন্ধু হয়ে গেছে। অলোপা ৩য় বলয়ের মানুষ। অলোপা সবসময় কোথাও, কোন চিন্তায় হারিয়ে থাকে, খুবই কম কথা বলে।অলোপার এই দিকটা পরশের খুব ভালো লাগে। এখন সজলের বাড়ি গেলে অলোপা আর সজল দুইজনকে একসাথে কাছে পায় পরশ। পরশের ভালো লাগে। সজলকে কাছে পেতে পরশের ভালো লাগে।কিছুদিন আগে ইন্টার্ন শেষ হয়ে গেলে সজল তাদের এক বন্ধুর ব্যাচেলার পার্টিতে যায়। পরশও ছিলো সেখানে, জীবনে প্রথম বার মদ খেয়ে প্রচুর বমি করে মাতাল হয়ে ছিলো পরশ। সারারাত সে সজলের কোলে মাথা রেখে পড়েছিল। সেইরাতের কথা পরশ কোনদিন ভুলবে না।

শায়েরা আমেরিকা থেকে এসেছে তিনদিন হল। তার সাথে আর মেয়ে এসেছে,তার মেয়ের বয়স একবছর। তার স্বামী আমেরিকায় পিএইচডির ছাত্র, সে আসেনি। শায়েরার ইচ্ছা ছিলো, মায়ের বাড়িতে কিছুদিন থাকার কিন্তু তার স্বামী বারবার ফোন করে তার শ্বশুর বাড়ি রংপুর যেতে বলছে। শায়েরা পরশের ৩য় বলয়ের মানুষ। শায়রার সাথে পরশের পরিচয় হয় কলেজে। কলেজের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে ছিলো শায়েরা, এই অহংকারে শায়রার মাটিতে পা পড়তো না। কিন্তু যে দিন সে পরশকে প্রথম দেখেছে, সেদিন থেকে সে বুঝতে পেরেছে সে অতটা সুন্দরীও নয়। কলেজে শায়রার লক্ষ ছিল যেকরেই হোক পরশের প্রেমিকা হতে হবে। সবাই যেন বলে কলেজের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটা কলেজের সবচেয়ে সুন্দর ছেলেটার সাথে প্রেম করে। কিন্তু পরশকে কিছুতেই বাগে আনতে পারছিল না। শেষমেশ অলোপার মাধ্যমে সে পরশের সাথে পরিচিত হয়। আস্তে আস্তে তাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়। পরশের কাছে অতটুকুই, শায়েরা তার খুব ভাল বন্ধু, ৩য় বলয়ের মানুষ,এর বেশি সে শায়রাকে কাছে আসতে দেয়নি কখনো। কিন্তু শায়রা পরশের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে সকলকে বলে বেড়াত সে পরশের প্রেমিকা। কলেজে শেষ হয়ে গেলে শায়রা ধীরেধীরে বুঝতে পারে পরশ তার জন্য বিন্ধু মাত্র প্রেম অনুভব করে না। পরশ অন্য কাউকে ভালোবাসে। একদিন সে এই প্রশ্ন সরাসরি পরশকে জিজ্ঞেস করে, পরশ মুচকি হেসে বলেছিল, "বন্ধুদের মধ্যেই কেউ একজন "। শায়েরা সন্দেহ করে অলোপা কে। শায়রা প্রেমে ছ্যাঁক খেয়ে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় ফেল করে। তারপর তার বিয়ে হয়ে যায় তার গৃহশিক্ষকের সাথে । বিয়ের পর তার স্বামী স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকা চলে যায়। সেখানে শায়েরার বাচ্চা হয়। আমেরিকা যাওয়ার পর পরশের সাথে শায়রার ফেসবুকে কথা হত। কিছু কিছু কথা এতটাই মেয়েলী যেটা কেবল একজন মেয়ে আরেকজন মেয়ে কে বলতে পারে। শায়রা লজ্জায় পরশের সাথে কথা বন্ধ রাখে কিছুদিন। শায়রার স্বামী পরশ আর শায়রার সম্পর্কটা এমনেই ভালো চোখে দেখেনা, তারওপর একদিন সে শায়রার মোবাইল চেক করে ফেসবুকে পরশের ম্যাসেজ গুলি দেখে। সে শায়রাকে এই জন্যে অনেক মারধর করে। আসলে শায়রার স্বামী প্রায়ই তাকে মারধর করে এটাওটা না পারার জন্য। শায়রা তার স্বামী কে ভয় পায়। বাংলাদেশে আসার পর সে পরশের সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছিল, কিন্তু স্বামীর ভয়ে সে আর আগায় নি। আর এখন অনিচ্ছা স্বত্বেও শশুড়বাড়ি যেতে হবে। কেন জানেনা শায়রা এইসব কিছুর জন্য শুধু পরশকে দায়ী করে। পরশকে দায়ী করে সে আনন্দ পায়।

দুপুরবেলা পরশ খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে আছে। ম্যাপে সে আক্কেলপুর দেখছে। সে কোনদিন ঢাকার বাইরে যায়নি, আক্কেলপুরে ট্রেনে করে যাওয়া যায়। পরশ কোনদিন ট্রেনেও চড়েনি। ম্যাপে সে দেখল এই আক্কেলপুরে একটা নদী আছে, তার নাম তুলসী গঙ্গা। তুলসী গঙ্গা নামটা অনেক মিষ্টি, এই নদীটা কেমন হবে এই ভেবে, পরশের চাকরিতে জয়েন করতে ইচ্ছা করে। কিন্তু প্রিয়জনদের রেখে একা একা সে কিভাবে থাকবে এই চিন্তাও তার মাথায় আসে।দোতালায় দাদাজির ঘর থেকে বেগম আখতারি বাই ফয়জাবাদির কন্ঠে মির্জা গালিবের একটা গজল ভেসে আসছে,

"দিল হি তো হ্যায় না সাং-ও-খিশত দার্দ সে ভার না আয়ে কিউ?
রোয়েংগে হাম হাজার বার কই হামে সাতায়ে কিউ? "
অর্থাৎ,
হৃদয়ইতো, না পাথর না ইট, ব্যাথায় ভরে আসবে না কেন?
কাঁদবো আমি হাজার বার, কেউ কেন আমাকে হয়রান করবে?

"দায়ের নেহি, হারাম নেহি, দার নেহি আস্তান নেহি
বাইঠে হে রেহগুজার পে হাম, গেইর হামে উঠায়ে কিউ? "
অর্থাৎ,
মন্দির নয়, মসজিদ নয়, দরজা নয়, দোরগোড়া নয়
বসে আছি রাস্তায় আমি, অন্যকেউ কেন আমায় উঠিয়ে দেবে?

"কায়েদ-ই-হায়াৎ-ও-বন্দ-ই-গাম আসল মে দোনো এক হে
মউৎ সে পেহলে আদমি গাম সে নাজাত পায়ে কিউ? "
অর্থাৎ
জীবনের কয়েদখানা ও দুঃখের শিকল আসলে দুইই এক
মৃত্যুর আগে মানুষ দুঃখ থেকে মুক্তি পাবে কেন?

"হা ভো নাহি খুদাপারাস্ত, যাও ভো বেভাফা সাহি
জিসকো হো দিন-ও-দিল আজিজ, উস্কি গালি মে যায় কিউ?"
অর্থাৎ
না ওঁ খোদা ভক্ত, যাও ওঁ অকৃতজ্ঞই না হয় হল,
যাঁর বিশ্বাস ও হৃদয় আছে প্রিয়,তাঁর গলিতে যায় কেন?

"গালিব-ই-খাস্তা কে বাগেয়ের কোন সে কাম বন্দ হে
রইয়ে জারজার ক্যায়া, কি জিয়ে হায় হায় কিউ? "
অর্থাৎ
হতভাগ্য গালিবকে ছাড়া কোন কাজটা বন্দ আছে?
তবে কান্নার আহাজারি কি, এই হায় হায় করেন কেন ?

গানের কথাগুলি নিয়ে চিন্তা করতে করতে পরশের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। মনটা মোচড় দিয়ে ওঠে তার, গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসে। পরশ মোবাইলে ঘড়ি দেখল, সাড়েতিনটা বাজে। সে বাথরুমে গেল শেভ করল, খয়েরী রঙের একটা পাঞ্জাবী পরে সে তৈরি হয়ে নিল। আজকে বিকালে তার শায়েরার বাসায় যাওয়ার কথা। পরশ বেরিয়ে যাচ্ছিলো বুয়াজির ঘরের সামনে দিয়ে, বুয়াজি জায়নামাযে বসে পরশ কে ডাক দিলো।
"পরশ আব্বু, কোথায় যাচ্ছো, একটু শুনে যাও তো।" পরশ বুয়াজির ঘরে ঢুকে বুয়াজির পাশে বসলো। বুয়াজি পরশের মাথায় হাত বুলিয়ে, বালিশের তলা থেকে একটা ছবি বের করে বলল ,
"আব্বু মৌলবি সাহেব আমাকে এটা দিসে, তোমাকে বিয়ের কথা বলার জন্য।আমি তোমাকে তোমার মার মতই ভালোবাসি আব্বু, আমি তোমাকে এ সব কিছুই বলতে পারব না, তবে একটু চিন্তা কর সোনা, আমাদের কথা, সমাজের কথা, নিজের কথা। কোন মানুষই একা থাকতে পারে না আব্বু।জীবনে অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়।"
পরশ বুয়াজির কথা মনদিয়ে শোনে, কিছু বলে না।
"এই ছবিটা নিয়ে যাও আব্বু, না হলে আবার মৌলবি সাহেব তুলকালাম করে ছাড়বে। "

পরশ ছবিটা নিয়ে পকেটে রাখে। রাস্তায় বের হয়ে পরশ ফোন দিল শায়রা কে,
"হ্যালো, শায়রা? "
"জ্বী কে বলছেন? হ্যালো?"
"শায়রা, আমি পরশ "
"ও আচ্ছা,এ নাম্বার কে দিলো তোরে? "
"অলোপা দিসে, তুই কি বাসায় আসিশ? আমি দেখা করতে চাচ্ছিলাম। "
"ও, সরি রে। আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন আসবে বেড়াইতে। একদম সময় দিতে পারবো না। আমি ফেরত যাওয়ার আগে আসিস, দেখা করব নে। "
"কেন তুই কালকে থাকবি না? কালকে আসি? "
"না রে কালকে আমি রংপুর যাচ্ছি, পরে কথা হবে রাখি রে মেয়েটা বিরক্ত করতেছে।"
"আচ্ছা "
পরশ সেজেগুজে কি করবে বুঝতে পারছেনা। সজল, অলোপা এখন বাড়িতে থাকবে না দুজনাই ডিউটিতে। অন্তরার বাড়ি সে যেতে পারে, অন্তরার স্বামী এমনিতে খুবই ভালো মনের মানুষ ,কিন্তু তাবলীগ জামাতের লোক,দেখা হয়ে গেলেই ঈমানি দাওয়াত দিয়ে তাবলীগে নিয়ে যাবে। সেই ভয়ে পরশ অন্তরার বাড়ি খুব কম যায়।
"পরশ ভাইয়া!"
পরশে পিছনে ঘুরে তাকালো, রাস্তার ওপারের একটা ফাকা প্লটে পাড়ার ছেলেরা ব্যাডমিন্টন খেলছিলো, সেখান থেকে একজন পরশকে ডাকছে।
"এইযে ভাইয়া, এইদিকে! ভাইয়া ম্যাচ হচ্ছে, আমাদের হয়ে একটু খেলবেন?"
পরশ খুবভালো ব্যাডমিন্টন খেলে, সে এ পাড়ার চ্যাম্পিয়ন সেটা সবাই জানে। ক্যাম্পাসেও সবাই ব্যাডমিন্টন খেলতে পরশকে ডেকে নিয়ে যেত। পরশের হাত নিশপিশ করে উঠলো। সে খেলতে গেল। খেলা চলল সন্ধ্যা পর্যন্ত, মাগরিবের আজান দিলো।পরশকে পেছন থেকে মৌলবি সাহেব ডাকলেন,
"পরশ! খেলা বন্ধ করে নামাজে আসো "
খেলার তালে পরশ খেয়ালই করেনি যে মৌলবি সাহেব পিছনে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ তার খেলা দেখছিলেন।পরশ প্যান্ট হাটুর ওপর থেকে নামিয়ে টাকনুর ওপরে রেখে, পাঞ্জাবিটা পরে নিয়ে মৌলবি সাহেবের সাথে জামে মসজিদের দিকে রওনা হল। হাটতে হাটতে মৌলবি সাহেব পরশকে বললেন,
"তুমি নাকি কি দোকানে বসতে চাও? সরকারি চাকরি ছেড়ে দিবা?"
"জ্বী, আক্কেলপুর পোষ্টিং...."
"তাতে কি, তোমার মা'র এত শখ ছিলো তুমি তোমার দাদাজির মত ডাক্তার হও।শোন, নিজের জীবনের শুরু যেকোনো জায়গা থেকেই হতে পারে।আল্লাহ্‌পাক যার রিজিক যেখানে লেখে রাখছে, সেখানেই তার রিজিক হবে। এতে আমাদের কারো হাত নাই। বিয়ে-শাদীর ব্যাপারেও ঠিক তাই, সবার মত স্বাভাবিক জীবন যাপন কর। এই জীবন তো একটা পরীক্ষা। ফলাফল আখেরাতে। আল্লাহ্‌র রাস্তায় সময় দাও। যৌবন কাল ইবাদতের উৎকৃষ্ট সময়। জীবনের প্রতিটা কাজ কোরান হাদিসের তরিকায় করাই ইবাদত। "
তারা দুইজন মসজিদে পৌছালে, পরশ অজু করতে গেল, আর কোন কথা হল না তাদের।

সন্ধ্যাবেলায় কারেন্ট চলে গেল। হঠাৎ খেলার কারনে পরশের গা হাতপা ব্যাথা করছে। পরশ বিছানায় কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। শীতকাল হওয়া সত্ত্বেও শীত কম, তাই পরশ তার ঘরের পুকুরের দিকের জানালাটা খোলা রেখেছে, পুকুরটা একেবারে নোংরা ডোবার মত। জানালা দিয়ে একটা বাজে গন্ধ আর সাথে ভনভন করে মশা ঢুকছে। পরশ মশার হাত থেকে বাঁচতে মাথা পর্যন্ত কম্বল মুড়ি দিয়ে রেখেছে। দোতালা থেকে আবার দাদাজির চিৎকার শোনা যাচ্ছে,
"পিউ কাহা, পিউ কাহা! পিউ কাহা, পিউ কাহা! "
পাশের কোন একবাড়িতে দুটি বাচ্চা পাল্লা দিয়ে ১৩’র ঘরের নামতা মুখস্থ করছে। শীতকালে কারেন্ট যাওয়ার কারনে তাদের পড়া স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পড়ে বুয়াজি জলন্ত ধুপের শলাকা নিয়ে পরশের ঘরে ঢুকলেন। কোন রকম শব্দ না করে তিনি ঢুপ টি রেখে চলে গেলেন। শায়রা আজ পরশের সাথে কাজটা ভালো করে নি, পরশ অপমানবোধ করেছে, তার মন খারাপ। দোতালা থেকে গ্রামোফোনের আওয়াজ ভেসে এলো, বেগম আখতারি বাই ফায়জাবাদির কন্ঠে,

"জোছনা করেছে আড়ি

আসেনা আমার বাড়ি

গলি দিয়ে চলে যায়

লুটিয়ে রুপোলি শাড়ী

চেয়ে চেয়ে পথ তারি

হিয়া মোর হয় ভারী

রূপের মধুর মহুয়া

বলো না কি করে ছাড়ি.... "

পরশ লাফ দিয়ে বিছানা থেকে ওঠে, বাইরে তাকায়। রুপালী জোছনায় চারিদিক থইথই করছে, পরশ একটু অবাক হয়, তাহলে কি দাদাজি বাইরের জোছনা দেখে এই গান ছেড়েছেন। এই রেকর্ডটা দাদাজির খুবই প্রিয় রেকর্ড, বুয়াজি বলেছিলেন। ৭১ সালে কলকাতায় রিলিজ হয়, তখন দেশে যুদ্ধ চলছে। ৭২ সালে কলকাতা থেকে একটা পার্সেল আসে, মধুবন্তি বাগচী নামে কারও কাছ থেকে। সেই পার্সেল এ নাকি এই রেকর্ডটা ছিলো আর একটা চিঠি, তাতে লেখা চার লাইন ,


"জানালার বাইরে তোমার দু'হাত রাখ,
দুহাত ভরে তুমি আজ জোছনা মাখ,
আমি আবার ফিরে আসবো।
তোমায় আবার ভালবাসবো। "

পরশ একটু লক্ষ করে দেখলো জোছনার আলো তার জানালার চৌকাঠ পর্যন্ত এসেছে। পরশ জানালা দিয়ে দুইহাত বের করে দিয়ে, হাতে জোছনা মাখে।হঠাৎ পরশের মনে পড়ে, ক্লাস নাইনে একটা মেয়ে তাকে প্রথম প্রেম পত্র দেয়,তার নাম ছিল জোছনা। কিছুক্ষণের জন্য পরশের কাছে তার চারপাশের বাতাবরণটা কে মায়া বলে মনে হয়।

মৌলবি সাহেব রাতে খেতে বসেছেন টেবিলের পাশে রাখা জলচৌকিতে। হাত ধুয়ে তিনি একবার টেবিলের দিকে তাকালেন। পরশ আর জুলেখা সেখানে মাথা নিচু করে খাচ্ছে। তিনি গলা খেঁকারি দিয়ে বললেন,
"মাটিতে বসে খাওয়া সুন্নাত।"
"আমার কোমর ব্যাথা, পায়ে ব্যাথা, নিচে বসবো কিভাবে, আর পরশ নিচে বসে খেলে ওকে তুলে তুলে দেবে কে? "
খাবার থালায় লেবু দেখে মৌলবি সাহেব, রান্নার বুয়া কে ধমক দিয়ে ডাকলেন,
"শরবতি লেবু কেনা হয়, শরবত খাওয়ার জন্য। ভাতের থালে পাতিলেবু না দিয়ে শরবতি লেবু দিসো কেন? আর থর ভাজির সাথে পিয়াজের ফুলকা কে খায়। " বলে তিনি থালা ছুড়ে ফেলে দিলেন।
"কাল থেকে তুমি আর কাজে আসবা না, মাস গেলে বেতন নিয়ে নিবা। না খায়ে থাকবো তাও তোমার রান্না খাবো না। "
মৌলবি সাহেব উঠে গেলেন। পরশ আর জুলেখা বুয়াজি মাথা নিচু করে খেতে থাকলেন, যেন কিছুই হয়নি।

রাতের বেলা খাবার পর পরশ একটা বই নিয়ে শুয়ে শুয়ে পড়ছে । Bruce Bagemihlp এর লেখা Biological Exuberance: Animal Homosexuality and Natural Diversity। এই বইয়ে লেখক দেখিয়েছেন সমকামিতা একটি প্রাকৃতিক ব্যাপার, প্রকৃতির বিভিন্ন প্রানিদের মধ্যে এই আচরণ দেখা যায়। অথচ সমাজে বেশিরভাগ মানুষ ব্যাপারটাকে বিকৃত রুচি, অনৈতিক আচারন বলে মনে করে। অনেকে যারা ব্যাপারটা কে সমর্থন করে, তাঁরা আবার সহানুভূতি দেখাবার চেষ্টা করে। পরশ আরও চিন্তা করে। Gay তিনটি অক্ষরে কত বাজে আর ঘৃণ্যভাবে এ সমাজের লোকজন এই ব্যাপারটাকে উপস্থাপন করে,ভাবতেই গা রিরি করে ওঠে পরশের। অথচ সম্পূর্ণ ব্যাপারটা কতটা প্রাকৃতিক, কতটা ব্যাক্তিগত, কতটা চেপে রাখা উচ্ছ্বাসের, অবাধ্য এক তাড়নার,কতখানি উদ্দীপক, কতখানি পূর্ণতা পাবার বুনো আকাঙ্ক্ষা তা কেউ বুঝতে চেষ্টা করে না। সবাই শুধু জানে সম্পর্কের লেবেলিং করতে হাসবেন্ড,ওয়াইফ, লাইফ পার্টনার, বয় ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড, ফ্রেন্ড, ক্লোজ ফ্রেন্ড, এক্স বয় ফ্রেন্ড, এক্স গার্ল ফ্রেন্ড। সব সম্পর্কের একটা লেবেল দেয়া চাই।অথচ কেউ সম্পর্কটাকেই বুঝতে চেষ্টা করেনা। বাংলাদেশে অবশ্য সমকামিতা নিষিদ্ধ। পরশ ইন্টারনেটে একবার পড়েছিল এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। স্পষ্ট আইন আছে,
"৩৭৭. প্রকৃতিবিরুদ্ধ অপরাধ:
৩৭৭ ধারা মোতাবেক সমকামিতা ও পায়ুমৈথুন শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ, যার শাস্তি দশ বছর থেকে শুরু করে আজীবন কারাদণ্ড এবং সাথে জরিমানাও হতে পারে। কোন ব্যক্তি যদি স্বেচ্ছায় কোন পুরুষ, নারী বা পশুর সাথে প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে যৌন সঙ্গম করে, তবে তাকে আজীবন কারাদণ্ড দেয়া হবে, অথবা বর্ণনা অনুযায়ী নির্দিষ্টকালের কারাদণ্ড প্রদান করা হবে যা দশ বছর পর্যন্ত বর্ধিত হতে পারে, এবং এর সাথে নির্দিষ্ট অঙ্কের আর্থিক জরিমানাও দিতে হবে।"
পরশ ভাবে প্রকৃতিবিরুদ্ধ অপরাধ? কিভাবে একজনের প্রাকৃতিক অনুভূতি প্রকৃতিবিরুদ্ধ অপরাধ হয়ে থাকে? সে নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে, কি বিশ্রীভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে বিষয়টাকে, ছিঃ, ছিঃ, ভাবতেই পরশের গা গুলিয়ে আসে। সে বইটা টেবিলে রেখে ছাদে চলে যায়, রাত আড়াইটা বাজে। ছাদে গিয়ে প্রতিদিনের মত সে আকাশের দিকে তাকায়, বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়, নিজেকে নিজেই বলে, "আমি ভালো আছি, আমি বেঁচে আছি " তারপর সে দ্রোহ ও প্রেমের কবি রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর লেখা একটা কবিতা আবৃতি করতে থাকে,
"প্রতিদিন কিছু কিছু ইচ্ছা মরে যায়
অনিচ্ছাকৃত মরে যেতে হয়
অযত্নে মরে যায়।
প্রতিদিনই কিছু কিছু ইচ্ছারা
নির্বাসিত হতে বাধ্য হয়
নির্বাসিত হয়।
কিছু কিছু ইচ্ছা স্বইচ্ছায় হত্যা করি
ইচ্ছার হননে বিবর্ন হই বারবার
তবু হত্যা করতেই হয়।..........."
হঠাৎ পরশ থেমে যায়, তার আক্কেলপুরের নদীর নামটি মনে পড়ে, তুলসী গঙ্গা নদী, কি সুন্দর নাম! পরশের নদীটা দেখতে খুব ইচ্ছা করে।নদীর পানি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখবার যেন অবাধ্য এক তাড়না,উদ্দীপনা পরশকে আষ্টেপৃষ্ঠে জরিয়ে ধরে।

পরদিন ভোরে ফজরের নামাজের পর মৌলবি সাহেব পরশের ঘরের সামনে এসে ডাকাডাকি শুরু করলো। পরশ বের হয়ে আসতেই মৌলবি সাহেব বললেন,
"ফজরের নামাজ পড়সো? " পরশ ঘাড় কাত করে উত্তর দেয়।
" আমি আজকে কাকরাইলে যাব, জোড় আসে। সারাদিন, মানে ইশার নামাজ পর্যন্ত সেখানেই থাকবো। তুমি আজকে দোকানে বসবা। আগ বাড়ায়ে কিছু করবা না, এইসব টেকনিক্যাল কাজ! শুধু বসে থাকবা, বাড়িতে বাজার করে দিবা, আর বিকাল পাঁচটায় ক্যাশ বুঝে নিয়ে দোকান বন্ধ করবা। ক্যাশ খুব বেশি হয়না, এখন সব পেমেন্ট ব্যাংকেই হয়,শুধু কিছু পুরানো পার্টির খুচরো কাজের পেমেন্ট ক্যাশে হয়। আর..." মৌলবি সাহেব একটু থামলেন,
"তুমি চাকরিতে কবে জয়েন করবা? তোমার তো আপার সাথে কথা হইসেই, সে ব্যাপারে কি চিন্তা করলা, সেটা আমাকে চাকরিতে জয়েন করার আগেই জানাবা। বিদেশ বিভূঁই জায়গায় একা থাকা ঠিক না।শয়তান নানান রকমফের করে।ফি আমানিল্লাহ। আল্লাহ তোমাদের হেফাজত করুন। " মৌলবি সাহেব পরশের জবাবের জন্য অপেক্ষা না করেই বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন। পরশ চিন্তায় পড়ে গেল, মৌলবি সাহেব ধরেই নিয়েছেন পরশ সরকারি চাকরিতে জয়েন করছে। আজব! আসলে তিনিই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন পরশ সরকারি চাকরি করবেই, "সুফিয়া লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ" মৌলবি সাহেবের নিজের হাতে তৈরি, তার সন্তানের মত, সেটা এখন বড় হয়েছে, নিজে নিজে চলতে শিখেছে, এই সন্তান কে তিনি জীবিত অবস্থায় অন্য কাউকে দিতে রাজি না। শুধু তাইনা, মৌলবি সাহেব এটাও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন যে পরশ বিয়ে করবেই, তিনি শুধু মেয়ে পছন্দের অধিকারটুকু বুয়াজি আর পরশকে দিয়েছে। এই ধরনের লোকেদের পরশ সহ্য করতে পারে না, যারা অন্যরা কি করবে তার সবটুকু নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে ঠিক করে দেন। এরা আলোচনা করে ঠিকই কিন্তু সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় অন্যের মতামতের কোন মূল্য দেননা। এমনকি যার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে তারও। দুশ্চিন্তায় পরশের আর ঘুম হলো না। এখন যদি সে মেয়ে পছন্দ হয়নি বলে, তাহলে মৌলবি সাহেব আরেকটি মেয়ের ছবি নিয়ে আসবেন। তবু তিনি পরশের বিয়ে দিয়েই ছাড়বেন।এই সমস্যার কোন সমাধান নেই। এইভাবে দুই, তিনবার মেয়ে বাতিল করলে, আরাও কঠিন শাস্তির ব্যাবস্থা আছে। পুরপুরি তাবলিগী ব্যাবস্থায় মেয়েকে না দেখিয়েই তিনি একটি সমন্ধ ঠিক করবেন, পরশকে বলবেন দুইরাকাত নফল নামাজ পড়ে সম্পূর্ণ আল্লাহ্‌র ভরসায় বিয়ে করে ফেলতে। পরশ রাজি না হলে তিনি বাড়িতে সবার টেকা মুশকিল করে দেবেন। পরশ চিন্তিত হয়ে নাশতা করে, বুয়াজি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়,
"কি আর করবা আব্বু, মৌলবি সাহেব অনেক জেদি!" পরশ প্রসঙ্গ পাল্টে বুয়াজিকে বলল,
"বাজার কি কি করতে হবে, অনেকদিন চিংড়ির মালাইকারি খাইনি! "
"তোমার মার মত কি আর হবে? নিয়ে আসো।তোমার দাদাজির কিছু ঔষধ লাগবে। "
পরশ আজকে কাওরানবাজার বাজারে গেল। বড় বড় গলদা চিংড়ি, নারকেল,গরুর মাংস, বেগুন, পোলাউয়ের চাল কিনে বাসায় ফিরে এলো। বাজার নতুন বুয়ার হাতে দিয়ে সে বুয়াজির ঘরে গেল,
"বুয়াজি আজকে দুপুরে সজল আর অলোপাকে খেতে ডাকি? আর দাদাজির ঔষধ আমি ওয়ার্কশপ থেকে কারো হাতে পাঠায়ে দেব। "
"আচ্ছা, দুপুরে একটু আগেই আসো।"
"জ্বী বুয়াজি, মালাইকারিটা আমিই রান্না করবো, অনেকদিন রান্নাও করিনা "
বুয়াজির মুখে একটু প্রশান্তির হাসি ফোটে। পরশের রান্নার হাত তার মায়ের মত, ভালো কিছু রান্না করতে গেলেই তার মা তাকে ডেকে শিখাতেন। পরশ প্রায়শই এটা ওটা ভালোমন্দ রান্না করে সজলকে ডেকে খাওয়াত।রান্না করতে পরশের ভালই লাগে। কিন্তু তার মা হঠাৎ ক্যান্সারে মারা যাওয়ার পর থেকে পরশের আর রান্না করতে মন চাইতো না। আজকে কেন জানেনা তার রান্না করতে ইচ্ছা করছে।

বেলা এগারোটার দিকে পরশ ওয়ার্কশপে গেল। ভৌমিক বাবু হাসিহাসি মুখ করে পরশের দিকে তাকালেন।
"কি খবর ডাক্তার বাবু? আবার এই লোহালক্কড়ের মধ্যে কেন?"
"আপনারা সুস্থভাবে আছেন কি না দেখতে আসলাম। " পরশ হাসিমুখে উত্তর দেয়। তারপর পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে ঔষধের কোম্পানির একজন রিপ্রেজেন্টিটিভ কে ফোন দেয়। ভৌমিক বাবু আড়চোখে লক্ষ করে পরশ মৌলবি সাহেবের চেয়ারে বসলো না, সে টেবিলের সামনের একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।
"হ্যা সমন ভাই, আমি পরশ বলছি। আপনাকে কিছু ঔষধের নাম ম্যাসেজ করসি, পাইছেন? ও আচ্ছা, সব গুলাই তিনবেলা, তিনমাসের হিসাবে , আজকে একটু বাসায় পৌছে দিয়েন। হ্যা, আক্কেলপুর। ২২ তারিখের মধ্যেই। হ্যা, দেখাতো হবেই ইনশাল্লাহ। আমি না হলে সজল আপনাকে টাকাটা দিয়ে দেবে। জ্বী আচ্ছা রাখি সমন ভাই। ধন্যবাদ। "
"রিপ্রেজেন্টিটিভ? "
"জ্বী, ওরা ১৮% কমিশন দেয়, তাই.. "
"তা কি খবর বলেন, নতুন সরকারি চাকরি! "
"এই তো..."
" মৌলবি সাহেব তো আপনার বিয়ে নিয়ে খুব ব্যাস্ত। মেয়ের বাবার নবাবপুরে দোকান আছে। পুরানো লোক। "
পরশ হাসে কিছু বলেনা।
"ইদানীং মৌলবি সাহেবের প্রেশার হাই থাকে। বাইরের পোড়া তেলের রান্না খায়। শরীরটা খারাপ করছেন। তবে জানেন কি পরশ বাবু, আমার মতে বিয়ে একটু দেরীতে করাই ভালো, পুরুষ মানুষ জীবনটাকে একটু উপভোগ না করেই সংসারে ঢোকা ঠিক না। আমাদের ধর্মে বলে, আঠারো হাজার বার জন্ম নেয়ার পর একবার পুরুষ হয়ে জন্ম হয়। তাহলে বোঝেন ব্যাপারটা! "
"মানে? "
" মানে আমরা তো পুনর্জন্মে বিশ্বাসী, এক আত্মা আঠেরো হাজার বার বিভিন্ন প্রানি দেহ ভ্রমণ করে, তবেই একবার পুরুষ মানুষের দেহ পায়। তারপর আবার আঠেরো হাজার জন্মের অপেক্ষা, তারপর আবার পুরুষ, হাহাহা হাহাহা...."
পরশও হেসে ওঠে, সে মনে মনে ভাবে, এক আত্মা আঠেরো হাজার বার বিভিন্ন প্রানি দেহ ভ্রমণ করে, মানুষ কি পাখি , পাখায় লেখা এক যাযাবর পথ? । পরশ ঘড়ি দেখে,
" আমি বাড়ি যাচ্ছি, বন্ধুদের দাওয়াত করসি দুপুরে।আবার সন্ধ্যার সময় আসবো। "
"পাঁচটার আগেই আসবেন কিন্তু!"
"আচ্ছা "
পরশ ওয়ার্কশপ থেকে বের হয়ে রিক্সা নেয় বাড়ির উদ্দেশ্যে। রিক্সায় বসে সে ফোন দেয় সজল কে,
"হ্যালো সজল, দুপুরে বাসায় আয়। "
" আমি ওটিতে রে, পরে ফোন দিচ্ছি, তুই অলোপা কে ফোন দে।"
পরশ এবার অলোপাকে ফোন দেয়,
"হ্যালো, কি রে ব্যাস্ত দম্পতি, ফ্রী আছিস? "
" হ্যা বল"
" দুপুরবেলা বাসায় আয়, দাওয়াত "
" তোর বিয়ে উপলক্ষে না চাকরি উপলক্ষে? "
"আমার বিয়ে তোকে কে বলল"
" বুয়াজিকে ফোন দিসলাম"
"আচ্ছা শোন, আসার সময় দৈ নিয়ে আসিস, মিষ্টি সাদা দৈ।"
" রান্না কি তুই করছিস? তাহলে নিয়ে যাব। "
" হ্যা আমিই রান্না করছি, সজল কে নিয়ে চলে আয়।"
" আমি আসতেসি, সজল মনেহয় ওটিতে, ও পরে আসবে "
"আচ্ছা,রাখি। "

পরশ বাড়ি পৌঁছে বুয়াজি কে রান্নাঘরে দেখতে পেল, বুয়াজি আজ অনেকদিন পর রান্নাঘরে ঢুকেছে। পরশকে দেখতেই বুয়াজি বলল,
"গরুর মাংস মাখায়ে চড়াই দিসি, তুমি শুধু ঠিকমত কষায়ে নামায় নিও। আর ওইযে চিংড়ির সব তৈরি, তুমি রান্না শুরু করে দাও। পোলাউ আমি গোসল করে এসে তুলে দিব।বেগুন মাখায়ে রাখছি, খাওয়ার আগে ভাজলেই হবে। "
"আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি গোসলে যাও। "
"পরশ, পোলাউ কি মটরশুঁটি দিয়ে খাবা? তোমার দাদাজি খুবই পছন্দ করে। "
"ডিপ ফ্রিজে আছে মনেহয়, থাকলে দাও। আচ্ছা দাদাজির ঔষধ কি কেউ দিয়ে গেসে? "
"হ্যা দিয়ে গেসে,ছেলেটা এক কাপ চাও খেলো না! "
"সমস্যা নাই। "
চিংড়ির মালাইকারি সাধারণত সবাই নারকেলের দুধ দিয়ে করে, পরশের মা মালাইকারি রান্না করতো, নারকেল মিহি করে পিষে সম্পূর্ণ টুকুই দিয়ে। পরশও তাই করে। আর চিংড়ির ঠাঙ গুলি আস্তা রেখে দেয়। চিংড়ির মালাইকারি একেবারে টকটকে লাল হয়। মালাইকারি নামানোর সময় সামান্য চিনি দিয়ে নামানো হয়। গরুর মাংস কষিয়ে খয়েরী হয়ে গেলে পরশ সেটা একটু চেখে নামিয়ে নিলো। দেখতে দেখতে চিংড়ির মালাইকারিও হয়ে গেল। পরশ চিনি দিয়ে মালাইকারিটা নামিয়ে রেখে নিজের ঘরে গেল।

বেলা তিনটা বাজে, অলোপা এসেছে দেড়টার দিকে। সজল এখনো আসেনি। পরশ, বুয়াজি, অলোপা বসে বসে গল্প করছে। একটু পর সজল এলে সবাই একসাথে খেতে বসলো। সজল টেবিলে বসেই প্রথমে মাফ চেয়ে নিল সবার কাছে,
"আরে আর বলিস না, লাঞ্চ টাইমে বের হতে যাব এইসময় সজীবের ফোন, ওর মা'র পা ভাঙসে। কি আর করবো গেলাম, প্লাস্টার করে এই আসলাম।"
"কোন সজীব? "
" আমাদের জুনিয়ার ছেলেটা, ব্যাডমিন্টন খেলত যে.."
"ও আচ্ছা "
"সজল তোমার পছন্দের রান্না হইসে আজকে "
"জ্বী বুয়াজি, মালাইকারির চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে পরশের হাতের পরশ পাওয়া রান্না। "
"হ্যা, আমি রান্না করলে ও বলে কি, তোরটা পরশের মত হয় নাই!"
পরশ হাসে, চারজনের খাওয়াদাওয়া, হাসিঠাট্টা চলতে থাকে। সজলের সিগারেট খাওয়া অভ্যাস। খাওয়াদাওয়ার পর অলোপা, সজল, পরশ তিন জনে মিলে পরশের ঘরে আড্ডা দিচ্ছে। সজল আয়েশ করে সিগারেট টানছে।
" পরশ তুই বিয়াটা করেই ফেল। খামখা মৌলবি সাহেবের সাথে ক্যাচালে যাইস না, পাড়বি না রে। "
"তাই বলে একটা মেয়েকে শুধু ছবি দেখে আজকাল কেউ বিয়ে করে? বুয়াজির কাছে শুনলাম মেয়ে এবছর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিসে কেবল! পরশ তোর কি ইচ্ছা? "
"হেহ, আসছে , পরশের ইচ্ছা, আজ ২০ বছর হল ওরে চিনি,ওর নেংটি বন্ধু, আজ পর্যন্ত বুঝতে পারলাম না বেটা কি চায়... আর তুই ওরে জিজ্ঞাস করিস ওর কি ইচ্ছা। হালা মাকুন্দা নিজেও জানে না ওই কি করবো! "
পরশ হাসে, সজলের কথায় সে মজা পায়। হাসতে হাসতে বলে,
" না বিয়া তো করবো মামু, চাকরি তে জয়েন করি আগে... তারপর একটু মজা করলাম, ব্যাচেলর জীবনের মজা....."
"তুমি এত বছর ব্যাচেলর থাইকা কি এমন করলা, যে এই দুইদিনে ব্যাচেলরের মজা করবা। তুই এক কাজ কর, তুই বাথরুমে যা, শালার স্পাইনলেস। "
" তুই চাকরিতে জয়েন করবি তো নাকি? না একা থাকতে ভয় লাগে? "
অলোপা খিলখিল করে হাসতে থাকে। পরশ মুচকি হেসে বলে,
"আমার কথা বাদ দে, তোদের কথা বল, বাচ্চাকাচ্চা নিবি কবে? অলোপা তো ধুমসি হয়ে যাচ্ছে দিনদিন! "
অলোপা কিছুটা লজ্জা পেয়ে বলে,
" তোকে আসলে ওল্ড হোমে রেখে আসা উচিৎ।"
"ওরে ওর দাদার সাথে একঘরে রাখলেই হইবো। দুইজন মিইলা পিউকাঁহা পিউকাঁহা খেলবো!......হাহাহহাহাহা" সজল হাসিতে লুটিয়ে পড়ে। দাদাজির কথা বলতেই পরশের খেয়াল করে, দোতালা থেকে গান ভেসে আসছে , বেগম আখতারী বাই ফাইজাবাদির কন্ঠে,

"বাবুল মোরা নাইহার ছুটো হি যায়
চার কাহার মিলে, মোরি ডোলিয়া সাজাবে
মোরা আপনা বেগানা ছুটো হি যায়
নাইহার ছুটো হি যায়
আঙ্গানা তোহ পার্বাত ভাইয়ো অউর দেহারী বাইয়ি বিদেস
যায় বাবুল ঘার আপনো মাই চালি পিয়া কে দেস..."


পরশ একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে।

চারাটার দিকে পরশ ওয়ার্কশপে গেল। ভৌমিক বাবু বসে হিসেব করছিলেন নিজের টেবিলে, রুপালি ফ্রেমের রিডিং গ্লাসের ওপর দিয়ে তিনি পরশকে দেখলেন।
" এখানে বসুন।" বলেই তিনি আবার হিসেবে মন দিলেন। বাইরে আজ বেশ শীত। ভৌমিক বাবুর পেরনের পোশাকটা আজব, একটা টেরেলিনের পাঞ্জাবির ওপর ভি নেকের নেভি ব্লু হাফ সোয়েটার, তার ওপরে একটা সস্তা কালো কোট, সাদা সুতির ধুতি, পায়ে খয়েরি রঙের একটা পশমি মোজা, প্লাস্টিকের একটা কালো পামসু। পরশ চুপচাপ বসে পেপার পড়তে লাগলো। হিসেব শেষ করে ভৌমিক বাবু খাতা বন্ধ করলেন।
"বলুন কি খাবেন? "
" না দুপুরের খাবার দেরিতে খাইসি, এখন কিছু খাবো না, চা হতে পারে। "
" এখানে ডিসেন্ট এর ভালো চিকেন প্যাটিস পাওয়া যায়, খেয়ে দেখেন, সাথে চা দিতে বলি। এই রফিক, ডিসেন্ট থেকে গরম গরম চিকেন প্যাটিস আর চা নিয়ে এসো তো।"
" দোকান কি পাঁচটাই বন্ধ হয়? "
"ঠিক নেই, কাজের চাপের ওপর নির্ভর করে। আপনার হাত টা দেখি একটু? "
"আপনি হাত দেখতে পারেন? "
" ওই আর কি, এটা আমার নেশা, অল্পবয়েসে কিরোর বই হাতে পড়েছিল তাই... আপনি এসবে বিশ্বাস করেন তো? "
" নাহ, একেবারেই না "
" শোনেন পরশ বাবু, ভাগ্য হলো মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মত, মানা না মানা আপনার ব্যাপার, কিন্তু প্রভাব সবার ওপর খাটে, ওই যে টেবিলটা দেখছেন তারও কিন্তু ভাগ্য আছে। মজার ঘটনা বলি, মৌলবি সাহেবের সাথে আমার পরিচয় যুদ্ধের বছরে, ওই বছরে আমি প্রথম কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় আসি। এখানে নবাবপুরে আমার এক দূরসম্পর্কের মামার দোকানে সেলসম্যানের চাকরি নেই, ওই দোকানেই অলরেডি তখন মৌলবি সাহেব চার বছর সেলসম্যানের কাজ করে চাকরি ছেড়েছেন, নিজের ওয়ার্কশপটা চালু করেছেন এর ওর কাছে থেকে ধার করে। আমার সাথে দেখা হলে উনি জিজ্ঞেস করলেন আমার লেখাপড়া সম্পর্কে, আমি তখন ইন্টারমিডিয়েট পাস। উনি আমাকে বললেন হিসাবের কাজ কেমন পারি, আমি শুধু বললাম মেট্রিকে আমার অংকে লেটার ছিলো। উনি আমাকে তখন বেশ ভালো বেতনে ক্যাশিয়ারের চাকরি দিলেন। প্রথম দিন আমি বললাম আমি তো আগে মামার বাড়িতেই থাকতাম, এখন কি ওখানে থাকাটা ঠিক হবে? উনি বললেন দোকানে থাকতে। একদিন কাজের চাপ বেশি ছিলো,মৌলবি সাহেব একাই কাজ করলেন রাত পর্যন্ত। তখন সন্ধার পর কার্ফু চলে শহরে, উনি আর বাড়ি ফিরতে পারলেন না, আমার সাথেই থেকে গেলেন। রাতে আমি অভ্যাস মত কিরোর বই পড়ছি আর নিজের হাত দেখছি, এমন সময় দেখি উনি এশার নামাজ শেষে জায়নামাযে বসে আমাকে দেখছেন। চোখে চোখ পড়াতে উনি বললেন, এই সব কি সত্যি হয়? আমি বললাম, হ্যা অবশ্যই, এটা বিজ্ঞান। তারপর অনেক পিড়াপিড়ি করে উনার হাত দেখলাম। বললাম, সামনের বছর আপনার অর্থযোগ এবং বিবাহ যোগ আছে। স্ত্রীর ভাগ্যে নগদ অর্থ প্রাপ্তি। ব্যাবসায় সুনিশ্চিত উন্নতি, কারন আপনার বংশীয় যশ আছে। পুত্র ভাগ্য আছে। তখন যুদ্ধ চলছে দেশে, দেশের ভবিষ্যৎই অনিশ্চিত। সেই পরিস্থিতি তে আমার এই কথাগুলি ছিলো একেবারে হাস্যকর। মৌলবি সাহেবও হেসেছিলেন, কিন্তু সব কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয়েছিল। এরপর পরিচিত বন্ধু বা বড় ক্লায়েন্ট এলে তিনি আমাকে বলতেন হাত দেখেদেবার জন্য। "
পরশ হাসল শুধু কিছু বলল না। ডিসেন্টের চিকেন প্যাটিসটা আসলেও মজাদার। পরশ চা খাচ্ছিলো, ভৌমিক বাবু পরশের বাম হাতটা টেনে নিয়ে দেখতে শুরু করলেন।
" হুম, যা ভেবে ছিলাম তাই, যশের ব্যাপারটা আপনাদের বংশীয়। উচ্চশিক্ষা হবে, কর্মক্ষেত্রে উন্নতি নিশ্চিত, বিবাহ যোগ সন্নিকটে, মানে মৌলবি সাহেব জয়ী " বলেই ভৌমিক বাবু গা দুলিয়ে হাসতে থাকলেন।
" বার্ধক্যে অর্থযোগ আছে। পুত্রভাগ্য নেই। আপনি সাঁতার জানেন? পানি থেকে সাবধান। প্রেমের রেখা তো দেখি জাজ্বল্যমান। কে বলুন তো? "
" নাহ কেউ নাই, এতদিন হয়নি যখন হবে বলে মনেও হয়না "
"পরশ বাবু, মিথ্যা কথা বলতে হয় খরগোশের মত, দেখতে হবে মাসুম, কিন্তু ধরাও যাবে না। আমাকে বললে আপনার উপকারই করতাম। "
" আজকে উঠি "
" উঠবেন, চলুন, এই ব্যাগে টাকাটা আছে, নয় হাজার সাতশ টাকা। "
ওয়ার্কশপ বন্ধ করে পরশ বাড়ি চলে গেল। ভৌমিক বাবু একটা কানটুপি মাথায় দিয়ে হাটতে বের হলেন।

রাতে খেয়ে দেয়ে পরশ একটা বই নিয়ে বসলো, Zen Stories Collection। বইটাতে একটা গল্প বেশ মনে ধরলো পরশের, গল্পটা অনেকটা এরকম,একদা বিখ্যাত তাওবাদী গুরু Chuang Tzu স্বপ্ন দেখলেন যে, তিনি প্রজাপতি হয়ে গেছেন। প্রজাপতি হয়ে ইতিউতি উড়ে বেড়াচ্ছেন। তাঁর মানবিক স্বত্বার পুরাপুরি বিলুপ্তি হয়েছে।তিনি পূর্নাঙ্গ একটা প্রজাপতি। এরপর হঠাৎ ঘুম ভেঙে তিনি নিজেকে আবিষ্কার করলেন তাঁর বিছানায়, মানুষ রুপে। তখন তার মনেহল, তিনি কি এতক্ষণ প্রজাপতি হয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন, নাকি তিনি একটা প্রজাপতি, এখন মানুষ হয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন? কোনটা সত্যি? কোনটা স্বপ্ন?চিন্তার বিষয়! আরেকটা গল্প আছে, একজন পদব্রজক অনেক দূর যাত্রার পর এসে উপস্থিত হল একটা বিশাল নদীর পাড়ে। নদী পারাপারের কোন ব্যাবস্থা না থাকায় সে হতাশ হয়ে নদীর পাড়েই বসে রইল। এমন সময় সে লক্ষ করলো একজন ধ্যানগুরু নদীর ওপার দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। পদব্রজক ব্যাস্ত হয়ে চিৎকার করে ধ্যানগুরুকে বলল,
"গুরুজ্বী! আপনি কি বলতে পারেন, আমি নদীর ওপারে কিভাবে যাব?"
ধ্যানগুরু চিন্তিত হয়ে এদিক ওদিক তাকালেন, তারপর তিনি চিৎকার করে উত্তর দিলেন,
"বৎস! তুমি তো নদীর ওপারেই আছো! "
আরেকটি গল্প আছে, একজন বড় ধ্যানগুরু মৃত্যুশয্যায় পড়ে আছেন। এমন সময় আরেকজন ধ্যানগুরু তার পাশে এসে বললেন,
"আপনাকে আমি পথপ্রদর্শন করতে এসেছি "
মৃত্যুশয্যায় ধ্যানগুরু বললেন,
"আমি এই পৃথিবীতে এসেছি একা, চলে যাবো ও একা!"
তখন অন্য ধ্যানগুরুটি মৃদু হেসে বললেন,
"তবে আমি আপনাকে একটা পথ দেখাবো,পৃথিবীর পথ, যেখানে আসলে কোন আসাযাওয়া নেই, আছে শুধুই পথ চলা।"
বইটি পড়ে পরশের খুবই ভালো লাগলো। বইটির শেষের পাতায় লেখা আছে,
“We gain enlightenment like the moon reflecting in the water. The moon does not get wet, nor is the water broken. Although its light is wide and great, the moon is reflected even in a puddle an inch wide. The whole moon and the whole sky are reflected in a drop of dew in the grass.”
– Dōgen Zenji
পরশ ছাদে উঠে গেল। আজকে আকাশে কুয়াশার কারনে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। পরশ মাথায় চিন্তা ঘুরতে থাকলো,একটা পথ ,পৃথিবীর পথ, যেখানে আসলে কোন আসাযাওয়া নেই, আছে শুধুই পথ চলা। আঠারো হাজার বার বিভিন্ন প্রানী দেহ ভ্রমণ, আসাযাওয়া নেই, আছে শুধুই পথ চলা, হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি, পৃথিবীর পথে....

পরশের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। মৌলবি সাহেব পাকা কথা দিয়ে এসেছেন গতকাল বৃহস্পতিবার কাকরাইল মসজিদে। মৌলবি সাহেবের বিশ্বাস পরশ এ বিয়েতে রাজি হবেই। মেয়ের বাবা ইয়াকুব আলী, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন,মৌলবি সাহেবের তাবলীগের সাথী, চার ভাই বোনের মধ্যে মেয়েই ছোট, বড় তিন ভাই আছে,মেয়ের নাম জান্নাতুল নেসা, মেয়ে গত বছর ইন্টারমিডিয়েট পরিক্ষায় জিপিএ ৩.৮৪ পেয়েছে। দেখতে সুন্দর, রান্না ভালো পারে, এছাড়া ঘরের কাজকর্ম সব কিছু সেই দেখাশোনা করে। এক কথায় মৌলবি সাহেব যেমন চেয়েছিলেন সেইরকম। আগামি রবিবার পরশের আক্দ হবে। সামনে মাসে আয়োজন করে মেয়েকে ঘরে তুলে নেয়া হবে। সবশোনার পরে পরশ স্তব্ধ হয়ে ঘরে বসে আছে। সজল, অলোপা দুইজন বাসায় উপস্থিত,বুয়াজি তাদের ডেকে পাঠিয়েছেন। সজল পরশের ঘরে ঢুকে পরশের বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। বুক ভর্তি করে ধুয়া নিয়ে, আস্তে আস্তে একটা করে রিং ছাড়তে থাকলো। তারপর গম্ভীর হয়ে বলল,
"কি করবি এখন? "
পরশ চুপচাপ বসেই রইল।কোন উত্তর দিলো না।
"তোর কোন পছন্দ থাকলে বল, আজকেই বিয়া দিয়ে দিব!"
" সম্ভব না।"
"ক্যান? ওই জানে তুই তারে পছন্দ করিস? "
"নাহ, এতদিন যখন বুঝতে পারেনি.... "
" এই বিয়াই তুই রাজি আছিস? "
পরশ ছলছল চোখে সজলের দিকে তাকায় কিছু বলে না।
এমন সময় অলোপা ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকলো,
"পরশ, তুই কিছুই বলবি না? এখন এটলিস্ট? "
পরশ মাথা নিচু করে বসে থাকে কিছুই বলে না।
"আচ্ছা, তোরে কিছুই বলা লাগবেনা। আমি আর বুয়াজি মেয়ের বাড়ির সাথে কথা বলসি, আমরা বলসি আমরা মেয়ে দেখবো, এইভাবে মেয়ে না দেখে আজকাল বিয়া হয় না, ওরা রাজি হইছে। দুপুরে খাবার দাওয়াত দিসে। আমি আর বুয়াজি যাচ্ছি,অন্তোরা আপুকে ও ফোন দিসি,উনি আসবেন বলসে।পরশ তুইও যাবি, সজল থাকবে সমস্যা নাই। যদিও ওরা পরশকে মেয়ে দেখাতে রাজি না, তারপরও আমরা চেষ্টা করবো, জোর করবো। "
এমন সময় অলোপার হাতের মোবাইল ফোন বেজে উঠলো।
" আল্লাহ্‌ রে! এই মেয়ে তো আচ্ছা পাজি! "
সজল জিজ্ঞাস করে,
"কে রে?"
" আরে শায়রা! কই থিইকা শুনসে পরশের বিয়া, আমারে জ্বালাইয়া মারতেছে। বার বার ফোন করে খালি, আমি জানি কি না, মেয়ে দেখতে কেমন, পরশের ইচ্ছা আসে কি না, তার বিভিন্ন রকম প্রশ্ন! "
" আমারে দে, ওরে দেখাইতেছি, ওই পরশ তুই ওঠ, রেডি হো"
অলোপা মোবাইল টা সজলের হাতে দিলো,
"হ্যালো, কে? "
" আমি শায়রা! আপনি কে বলছেন? "
" ও শায়রা! আমি সজল, তা কেমন আছো, বারবার ফোন করতেছ যে, কিছু হইছে?"
" না কি হবে কিছুই হয়নাই। পরশের নাকি বিয়া ঠিক হইছে? কোথায়? "
" হ্যা, পরশের তো গতকাল বিয়া হয়ে গেছে, মেয়ের নাম জান্নাতুল নেসা, বাড়ি মোহাম্মদ পুর, তাজমহল রোড। আমরা সবাই সেখানেই আসচি, দুপুরের দাওয়াত, মেয়ে ইন্টার পাশ, দেখতে মাশাল্লাহ! কেন তুমি কি আসবা? ঠিকানা দিব?কোন সমস্যা নাই। আসতে পারো। "
" না আমি কেন যাব? অলোপা আমাকে তাহলে মিথ্যা কথা বলল ক্যান, যে ও কিছুই জানে না? "
"ও, পরশ বলতে নিষেধ করছে তাই, ব্যাপার না এখন জানলা আসো, ভালো লাগবে, কতদিন তোমারেও দেখিনা! "
পাশ থেকে অলোপা সজলের মাথায় টোকা দেয়।
" নাহ, আমি রংপুরে। পরশের সাথে কি একটু কথা বলা যাবে? "
" পরশ তো ওর শ্বশুর বাড়ির লোকজনের সাথে আলাপ পরিচয়ে ব্যাস্ত,এখন কথা বলতে পারবেনা। "
"ও! পরশের নাম্বার টা দিতে পারবা? "
"পরশ মনেহয় তোমাকে একদিন ফোন দিসলো, দেখ তোমার ফোনেই আছে, না হলে আমি এসএমএস করে দিচ্ছি।"
" আচ্ছা। "
সজল একটা শয়তানি হাসি দিয়ে ফোন রেখে দিলো। এতক্ষণে পরশের ঠোঁটের কোনায় একটু হাসি দেখা গেল। অলোপা পরশের ঘাড়ে হাত রেখে অভয় দিয়ে বলল,
" পরশ চল,তোর মেয়ে পছন্দ না হলে, আমরা সাথেসাথে চলে আসবো, তোর বিয়ে করতে হবে না।"

দুপুরের আগ দিয়ে মৌলবি সাহেব বাড়িতে আসলেন। এসেই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলেন,
" আমার কথার একটা দাম নাই, পরশ আমার ছেলে আমি যা বলবো সে তাই করবে! আমি ইয়াকুব সাহেব কে পাকা কথা দিয়ে দিয়েছি তারপর আবার দেখাদেখি কিসের? "
সজল এসে মৌলবি সাহেব কে স্থির করে বসাল।
" চাচা আপনি খামোখা উত্তেজিত হচ্ছেন, বুয়াজি পরশের মায়ের মত। তিনি আবদার করেছেন মেয়ে দেখবেন। তাছাড়া মেয়ের বাড়ি থেকে কেউতো আপত্তি করেনি। "
"মায়ের মত! পরশের মা বেঁচে থাকলে আমাকে এইভাবে অপমান হতে হত না।পরশের মা আমার কথার ওপরে কোনদিন কথা বলে নাই। বড় বোন হয়ে মাথা কিনে নিসে! পরশ কি বলে, তার কি আল্লাহ্‌র ওপর বিশ্বাস নাই? "
"থাকবেনা কেন, আল্লাহ্‌র ওপর বিশ্বাস অবশ্যই আছে। কিন্তু চাচা পরশের মতের বিরুদ্ধে তো আপনি জোর করে তাকে বিয়ে দেতে পারেননা, এইটাও ইসলামে নাই"
"পরশ আমার সামনে এসে বলুক, ও রাজি না!"
"হ্যা সেটাও পরশ বলেনি। যেহেতু তাঁরা দাওয়াত দিয়েছেন, যেতে অসুবিধা কোথায়? ওখানে যেয়েই না হয়... "
"ওখানে যেয়ে মানে? আমি যাবো না আজকে জুম্মাবার, তোমরা গেলে যাও! "

পরশ আর সজল পাশাপাশি বসে আছে ইয়াকুব আলী সাহেবের বাড়ির ড্রয়িংরুমে। বাসায় এখন পুরুষ মানুষ কেউ নাই। সবাই জুম্মার নামাজে গেছেন। বুয়াজি আর অলোপা অন্দরমহলে গেছেন প্রায় ১ ঘন্টা হল। ভেতর থেকে কোন শব্দ আসছে না। শুধু কিছুক্ষণ পরপর একটা বাচ্চা মেয়ে ভারি পর্দার আড়াল থেকে টুকি দিয়ে যাচ্ছে। সজল দুইবার তাকে ডাকেছে, কিন্তু সে আসেনি। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সজল অলোপা কে ফোন দিলো,
"কি রে, কোন সাড়াশব্দ নাই, মনে হচ্ছে আফগানিস্তান চলে আসছি!তোরাও চেহারা দেখাইতেছিস না, কি ব্যাপার? খিদাও তো লাগছে... "
" বাড়ির ছেলেরা সবাই নামাজে গেসে আসলেই খাবার পাবি, আমরা আছি ভেতরে, অন্তরা আপু আসচে, পরশকে চিন্তা করতে মানা কর।"
" আসল কথা ক, মেয়ে দেখতে কেমন? একটা ছবি তুলে সেন্ড কর, দেখি!"
" পরে কথা বলতেছি। "
অলোপা ফোন রেখে দিলো। পরশ জিজ্ঞাসু মুখ নিয়ে সজলের দিকে তাকাল,
সজল শুধু বলল,
" অন্তরা আপু আসচে।"
দুপুর দুইটার দিকে ড্রয়িংরুমে আলখাল্লা পরা,হোমড়াচোমড়া চার পাঁচজন হুজুর গোছের লোক লম্বা সালাম দিয়ে ঢুকল। ঘরে ঢুকেই তারা পরশ আর সজলের সাথে হ্যান্ডসেক, কোলাকুলি করলো। দলের কমবয়েসি ছেলেরা সোফা টানাটানি করে, মেঝেতে দস্তরখানা পেতে দিলো। সজল খাবারের গন্ধ পেল। এরপর এক এক করে সেই কম বয়েসি ছেলেগুলিই পর্দার আড়াল থেকে খাবারের গামলা নিয়ে হাজির হলো। দস্তরখানা তে বড় বড় দুইটা থালা দেয়া হল। চিলিমচী দেয়া হল হাত ধোয়ার জন্য। একজন মাঝবয়েসী দাড়িওয়ালা লোক অতি আদবের সাথে পরশের হাত ধরে দস্তরখানায় বসালেন। সজল পরশের পাশেই বসলো।
" আমার নাম মাজহার আলী, আমি কন্যার বড় ভাই। আমি ডেসার এক্সইন। উনি আমার মেজভাই মাহতাব আলী, উনি এডি, ফিসারিজ। আমার ছোট ভাই মোফাজ্জল আলী, ও নবাবপুরে ইলেকট্রিক জিনিষের ব্যাবসা করে। আর এই দুইজন আমার ছেলে ইয়াসিন আলী, ইব্রাহিম আলী। ওরা দুইজনাই মাশাল্লাহ কোরানের হাফেজ। ইয়াসিন আব্বু খাবার তুলে দাও। আমার আব্বা নফল নামাজে আছেন, আপনারা খাওয়া দাওয়া শুরু করেন। "
কমবয়সী ছেলেগুলি বড় বড় থালায় খাবার দিতে শুরু করলো। খাবারের আয়োজন ভালো। পাকা বিরিয়ানি, কোরমা, বোরহানি, টিকিয়া কাবাব।একটা থালায় পরশ, সজল আর মেয়ের বড় ভাই বসেছেন। আরেকটা থালায় বাকি চারজন। খেতে খেতে সজল পরশের কানে কানে বলল,
"দোস্ত পুরাই তালেবান ফ্যামিলি! এখন চিন্তা করে দেখ। " ব্যাপারটা লক্ষ করে মেয়ের ছোটভাই হাসিমুখে বললেন,
" আপনাদের কি এভাবে খেতে সমস্যা হচ্ছে? আলাদা প্লেট দিব? ভাইজান উনাদেরকে আরেকটু কোরমা কাবাব দেন, আসলে অল্প সময়ের আয়োজন তো।"
সজল লজ্জা পেয়ে বলল,
"জ্বী না ঠিক আছে, রান্না অনেক সুস্বাদু হয়েছে। "
" আলহামদুলিল্লাহ্‌! "
পরশ খেয়াল করে দেখলো ঘরে শুধুমাত্র সে আর সজল ছাড়া সবার লম্বা চাপ দাড়ি, মাথায় টুপি। সবচেয়ে ছোটজনেরও থুতনির কাছে হালকা দাড়ি। পরশ আবার খাওয়ায় মন দিলো,সকাল থেকে সে কিছুই খায়নি।

চারটা দিকে আসরের আজানের সময় ড্রয়িংরুমে জায়নামাজ বিছানো হল। ছেলেরা সবাই একসাথে জামাতে নামাজ পড়লেন। নামাজ শেষে সবাই বসে পরশ আর সজলের সাথে আলাপসালাপ করছিল। এমন সময় পরশের ফোন বেজে উঠলো।
"হ্যালো অলোপা, হ্যা বল। "
"খাওয়াদাওয়া করছিস? "
"হ্যা"
" শোন আমরা মেয়ে দেখলাম, আমি একা মেয়ের সাথে কথা বলছি, আমার তো বেশ ভালোই লাগসে, বুয়াজি আর অন্তরা আপু দেখছে, কথা বলছে, তাদেরও মেয়ে পছন্দ হইছে। এখন আমরা চেস্টা করছি তোর সাথে মেয়ের দেখা করানোর। আমরা বলে দিসি তুই যেটা বলবি সেটাই ফাইনাল। এদিকে এই শুনে তো মেয়ের মা কান্নাকাটি শুরু করে দিসে, তিনি কিছুতেই মেয়ে দেখাতে রাজি না। বুয়াজি মেয়ের বাবাকে ডাকছেন বুঝায়ে বলার জন্য। নে অন্তরা আপুর সাথে কথা বল.."
" হ্যালো পরশ, কেমন আছিস ভাইয়া? বাসায় আসিস না কেন,তোর দুলাভাই মাঝেমাঝেই তোকে খোঁজেন। আমার কোন মোবাইল নাই, আমি কোন খোঁজখবর নিতে পারিনা তোদের। আমিতো কিছুই জানতাম না। মৌলবি সাহেব তোর দুলাভাইকেও কিছুই বলে নাই। আজকে সকালে তোর দুলাভাই ফোনে বুয়াজির সাথে কথা বলাই দিসে, তাই জানতে পারছি। "
" দুলাভাই তো আসে নাই।"
" কেন আসবে? এভাবে কি হুট করে কারও বাসায় আসা যায় নাকি? উনি বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বাড়িতে আছেন। শোন তুই খবরদার মৌলবি সাহেবের ভয়ে হ্যা বলবি না,মেয়ে দেখবি, কথা বলবি, যদি পছন্দ না হয় তাহলে সরাসরি না বলে দিবি, এইবার মৌলবি সাহেব কে একটা উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে। আমার মা সব সহ্য করে.... "
অন্তরা ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। অলোপা ফোনটা নিয়ে বলল,
"শোন তুই টেনশন করিস না, বুয়াজি মেয়ের বাবার সাথে কথা বলছে, সব ঠিক হয়ে যাবে।"
" আচ্ছা "
সজল পাশ থেকে পরশকে পাশ থেকে জিজ্ঞাস করে,
" কি বলে? কে? "
পরশ চুপচাপ মোবাইলটা পকেটে ঢুকায়। এমন সময় একজন মুরুব্বী ঘরে ঢোকলেন । দেখতে দরবেশের মত, লম্বা সাদা দাড়ি,মাথায় পাগড়ী, পরনে সাদা আলখাল্লা। তিনি সোজা পরশের কাছে গিয়ে বসলেন। পরশের হাত ধরে তিনি বললেন,
" বাবাজি, আমি ইয়াকুব আলী, কন্যার পিতা। সাওমে দাউদ পালন করার জন্য আমি আপনাদের সাথে দুপুরবেলা খানা খেতে পারিনি। আমি একদিন পর পর রোজা রাখি। গতকাল আপনার আব্বার সাথে আমার পাকা কথা হয়েছিলো। আজকে একটু আগে আপনার বুয়াজির সাথে আমার কথা হইছে, দেখেন বাবাজি আমাদের ঘরে মেয়েদের বেগানা পুরুষের সামনে আসার রেওয়াজ নাই। কন্যার মা একেবারে এই প্রস্তাবের ঘোর বিরোধী, তাঁর সাফ কথা, আমাদের মেয়ে বাজারের জিনিষ নয় যে দেখেশুনে কিনতে হবে। আমি এখন পর্যন্ত কন্যাকে বিবাহের জন্য কাউকে দেখাইনি। মৌলবি সাহেব আমার বহুদিনের তাবলীগের সাথী। তিনি আমার এক কথায় রাজি হয়ে গেছিলেন। কিন্তু আল্লাহপাকের পরীক্ষা। তিনি কোরান মাজিদে বলেছেন, তোমাদের সন্তানসন্ততি তোমাদের জন্য পরীক্ষা। আপনাদের আসার কথা শুনেই আমি বুঝছি। আপনার বুয়াজি মুরুব্বী মানুষ,তাঁর কথা আমি ফেলে দিতে পারিনা। আপনারা আজকালকার ছেলেমেয়ে, পাত্রী না দেখে বিয়ে করবেন না এইটা আমিও বুঝি। বাবাজি মেয়ে দেখাতে আমার কোনই আপত্তি নাই। তবে একটা ব্যাপার কি, আমার একটা মাত্র আদরের মেয়ে, মানছি আমার মেয়ে এই যুগের সাথে চলনসই না, সেভাবে আমরা তাকে বড় করিনি। আপনি যদি মেয়ে দেখে বিয়ে করতে রাজি না হন, তাহলে আমার মেয়ে মনে অনেক কষ্ট পাবে। এইজন্য আমি মসজিদে নফল নামাজ পড়িতেছিলাম যে, যাইহোক আমার মেয়েটা যেন মনে কষ্ট না পায়। বাবাজি, আমি আপনাকে জোর করতেছি না। দেখেন সংসার কঠিন জায়গা, সংসার বহুবছরের পরিচিত মানুষকে পরিস্থিতিভেদে বদলায় দেয়, আবার অজানা অচেনা মানুষকে কয়েকদিনে আপন করে দেয়। আল্লাহপাকের কাছে দোয়াকরি, তিনি আপনাকে সিদ্ধান্ত নেবার হিম্মত দিন। আপনি চাইলে আমার মেয়ের সাথে দেখা করতে পারেন,কথাও বলতে পারেন। আমার আর কিছুই বলার নাই, এখন আমার উপরে আল্লাহ্‌ আর নিচে আপনি...। "
পরশ টের পেলো ইয়াকুব সাহেবের চোখ ছলছল করছে।

ইয়াকুব সাহেবের বাড়ির সব পুরুষরা মাগরিবের নামাজ মসজিদে পড়ে এখন সেখানেই অবস্থান করছেন।পরশ আর সজলও আছে মসজিদে।তবে এখন সজল বাইরের দোকানে গেছে সিগারেট খেতে,সে অনেক্ষন সিগারেট খায় না।ইয়াকুব সাহেব মসজিদেই ইফতার করছেন,খেজুর আর পানি দিয়ে,তার সামনে পরশ বসে আছে। ইয়াকুব সাহেবের ছোট ছেলেকে দেখা গেল তিনটা বড় বাঁশপাতা কাগজের প্যাকেটে কি যেন নিয়ে এসে মসজিদের এককোনায় রাখছেন।মসজিদের মেইন গেটে ভৌমিক বাবুকে দেখতে পাচ্ছে পরশ, আলগা কবুতরের মত ইতিউতি তাকাচ্ছেন,তাঁর ডান হাতে একটা খয়েরী চামড়ার হাত ব্যাগ।ভৌমিক বাবু আজকে তার প্রতিদিনের পোশাক পরেননি। আজকে তিনি একটা চকচকে কালো চায়না কোট,সাদা ধুতি পড়েছেন, পায়ে বাদামী রঙের একজোড়া মোজা, বাম হাতের কালো চামড়ার পামসুটি তিনি কোথায় রাখবেন বুঝতে পারছেন না। মসজিদে চকচকে সাদা ধুতি পরা একজন ফুলবাবু সেজে ঘোরাঘুরি করছেন এটা দেখে সকলের চোখ সেইদিকে। বাঘ আসার আগে নাকি ফেউ ডাকে।ভৌমিক বাবু মসজিদে এসেছেন মানেই বুঝতে হবে মৌলবি সাহেবও শীগগির উপস্থিত হবে এখানে। মাগরিবের নামাজের পর সবাই বসে অপেক্ষা করছে মৌলবি সাহেবের জন্য। মৌলবি সাহেব আসলেই বিয়ে আরম্ভ হবে। কাজীও ডেকে আনা হয়েছে।পরশ বিয়েতে রাজি হয়েছে। সে মেয়েকে না দেখেই বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। ইয়াকুব সাহেব এরপর প্রস্তাব করেন, যেহেতু ছেলে রাজি হয়েছে তাই দুইদিন পরে বিয়ে না পড়িয়ে আজকেই বিয়ে পড়িয়ে দেয়া হোক। পরশ সে প্রস্তাবেও রাজি হয়েছে। মৌলবি সাহেবকে খবর দেয়া হয়েছে। পরশের দুলাভাইও খবর পেয়ে রওনা হয়েছে, তাঁর সরাসরি ছেলেমেয়ে নিয়ে মসজিদে আসার কথা। বিয়ে একেবারে অনাড়ম্বর ভাবে সুন্নতি কায়দায় করা হচ্ছে। মসজিদে পরুষরা সবাই সমাবেত হবেন,কাজি থাকবেন, বিয়ে পড়ানোর পর বাদ এশা মসজিদেই রাতের খাবারের ব্যাবস্থা করা হবে। মহিলাদের ব্যাবস্থা বাড়িতে। এই সব কিছুর তদারকি করছেন পাত্রীর ছোট ভাই মোফাজ্জল আলী এবং তাঁর দুই ভাতিজা ইয়াসিন আলী, ইব্রাহিম আলী। ভৌমিক বাবু পরশের দিকে এগিয়ে এলেন,
"কি পরশ বাবু, বিবাহযোগ যে এত তাড়াতাড়ি তা তো বুঝতে পারিনি!"
পরশ কিছুই না বলে শুধু ভৌমিক বাবুর দিকে তাকিয়ে রইল।
"মৌলবি সাহেব, বাড়ি থেকে আসছেন। একটু দেরি হচ্ছে এই আরকি!"
" আপনি বসেন এখানে, আমার পাশে বসেন ভৌমিক বাবু। খেজুর খান! "
ইয়াকুব সাহেব ভৌমিক বাবুর হাতে কিছু খেজুর তুলেদিলেন। কিছুক্ষণ পর পরশের দুলাভাই রফিকুল আলম এসে উপস্থিত হলেন তার দুই ছেলেমেয়ে সহ। বড় মেয়ে আয়েশা আর ছেলে জাফরউল্লাহ বয়সে ৭-৫। তারা দুইজনে মামার কাছে ছুটে এল।
" আসসালামু আলাইকুম! জ্বী আমি পরশের মেজোদুলাভাই রফিকুল আলম। আপনার ছোট ছেলে মোফাজ্জল আলীর দোকানের পাশাপাশি আমার দোকান। উনি আমার পরিচিত। "
" ওলাইকুমস সালাম ওয়া রমাতুল্লাহে ওয়া বারাকাতু হু! জ্বী বসেন বসেন। "
" জ্বী বসতেছি, পরশের সাথে ওর বড় বোন, দুলাভাই কথা বলতে চায় একটু, শাদির মোবারক বাদ দিবে আরকি! তাঁরা মুরুব্বী,তাদের দোয়া তো লাগবেই! "
" তাঁরা আসেন নাই? "
"জ্বী না, তাঁরা দুইজনায় আয়ারল্যান্ডে থাকেন, ওইখানে ভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন। আসতে পারেন নাই। পরে ইনশাআল্লাহ আসবেন। পরশ তুমি একটু আমার সাথে বাইরে আসো, মসজিদের ভিতর ভিডিও করা ঠিক হবে না। "পরশ আর তার দুলাভাই মসজিদের বাইরে এলো।
"আসো আসো, মৌলবি সাহেব তো আমারেও কিছু কয় নাই, তোমার বোনরেও কিছু কয় নাই। হুট করে সব ঠিক হয়ে গেল। যাইহোক আল্লাহতালা যেটা চান সেটাই হইছে। মাশআল্লাহ্‌! আরে বড় আপাকে ফোন দিসি, উনি তোমার সাথে কথা বলার জন্য কাইনদা কাইটা অস্থির। আর আমি ভয়ে আছি মৌলবি সাহবে থাকলে, কি বলে তোমার লগে তাঁদের কথা বলায়ে দিব। যাইহোক আল্লাহ্‌ বাচাইছে তিনি এখানে নাই।"
" আপনি ওদের সাথে যোগাযোগ রাখছেন! "
"কওকি মিয়া! তোমাদের আপন বড় বোন! আমরা তো বিয়ার পর থেইকাই যোগাযোগ করি। আগে উনারা দেশে আসলে আম্মা তো আমাদের বাড়িতেই দেখা করতে যেতেন। মৌলবি সাহেবের যত বাড়াবাড়ি! মহান আল্লাহপাক রক্তের সম্পর্ক ছিন্নকারীকে জান্নাতে প্রবেশ করতে দিবে না। লও কথা কও!"

পরশের বিয়ে শুরু হতে যাচ্ছে। মৌলবি সাহেব উপস্থিত। মোটামুটি মসজিদে এশার জামাতের মুসল্লিরা সমাবেত হলেন। মসজিদের অতিরিক্ত বাতিগুলি জ্বালান হল। কাজী সাহেব প্রস্তুত। পরশের পক্ষের সাক্ষী পরশের দুলাভাই রফিকুল আলম। কনে পক্ষ থেকে সাক্ষী কনের মেজো ভাই মাহতাব আলী। আর উকিল ঠিক করা হল কনের বড়ভাই মাজহার আলীকে। কাজি সাহেব উশখুশ করছিলেন কিছু বলার জন্য, সবঠিক হয়ে যাওয়ার পর তিনি বললেন,
" জ্বী দেনমহর কত ধরা হবে এই কথাটা আগেই ঠিক করে নেওয়া ভাল হয়।"
" মৌলবি সাহেব, আমার মেয়ের বা আমার এই ব্যাপারে কোন রকমের দাবি নাই, শুধু খেয়াল রাখবেন দেনমহর যেটাই ধরা হোক না কেন তা যেন বাসরশয্যার পূর্বেই পরিশোধ করা হয়। ইসলামিক আইনে এইটাই জরুরী! "
"জ্বী দেনমোহর নগদ নয় হাজার সাতশো টাকা এবং চার ভরি স্বর্ণালংকার, আজকেই পরিশোধ করা হবে। " ভৌমিক বাবু তার হাতের খয়েরী চামড়ার ব্যাগ উঁচু করে দেখালেন। তার কথা ধরে কাজী সাহেব বললেন,
"আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের প্রজ্ঞাপন ২০১১ অনুযায়ী বিয়ে রেজিস্টারের জন্য ৪ লক্ষ টাকা পর্যন্ত দেনমোহরের ক্ষেত্রে প্রতি হাজার টাকা বা এর অংশ বিশেষের জন্য ১২ টাকা ৫০ পয়সা হারে কাজী কে নিবন্ধন ফি দিতে হবে।"
" জ্বী সে ব্যাপারে কোন চিন্তা করবেননা। "
কাজী সাহেব কনে এবং পরশের জীবন বৃত্তান্ত রেজিস্ট্রি খাতায় তুলে নিলেন। তারপর উকিল, সাক্ষী,দেনমহর সমেত রওনা হলেন কনের বাড়ির দিকে। বাসার কাছেই মসজিদ। মিনিট বিশেক পর তাঁরা ফিরে এলেন।কনে বিবাহের প্রস্তাব কবুল করেছে। এবার পরশের পালা। পরশ কবুল বললে, মসজিদের সকলে একসাথে বলে উঠলেন, "আলহামদুলিল্লাহ্‌ , মারহাবা,মারহাবা "। কনের ছোট ভাই আর ভাতিজারা বাঁশপাতা কাগজের প্যাকেট থেকে শুকনো খেজুর বের করে মুসল্লিদের মাঝে ফুলের মত করে ছিটিয়ে দিতে লাগলো। এরপর মসজিদের মাইকে বিয়ের কথা এলান করা হল সামাজিকভাবে। সকলকে রাতের খাবার দাওয়াত দেয়া হল।

বাদ এশা মসজিদের ভেতরে খাবার ব্যাবস্থা করা হল ঠিক যেভাবে ইফতারের আয়োজন হয়। খাসির পাকা বিরিয়ানি পাক করা হয়েছে। বাবুর্চির নাম রইস মোল্লা, তার কাজই হল বড় তাবলীগ পার্টির সাথে থাকা এবং তাদের খাবার রান্না করা। আরও রান্না করা হয়েছে টিকিয়া, খাসির কলিজা,মগজ,মাথার মাংস দিয়ে বুটের ডালের লটপটি। তবে রইস মোল্লার স্পেশাল হল খাসির পাকা বিরিয়ানি। এতে রইস মোল্লা পরিমাণ মত ছাগলের দুধ মিশিয়ে দেয়। ইয়াকুব সাহবের জোরাজুরিতে রইস মোল্লা বিয়েতে রান্না করতে এসেছেন। ভৌমিক বাবু কে একটা আলাদা প্লেটে খেতে দেয়া হয়েছে। ভৌমিক বাবু এত সুস্বাদু খাবার জীবনেও কোথাও খাননি।ভৌমিক বাবুর দেখাদেখি এবার সজলও আলাদা প্লেট চেয়ে নিল। খাওয়া দাওয়া শেষ হলে ইয়াকুব সাহেব পরশের হাত ধরে বললেন,
" বাবাজী, আজ রাতটা আমার বাড়িরে কাটালে খুবই খুশী হতাম। "
পরশ রাজী হচ্ছিলো না, কিন্তু সজল আর তার মেজো দুলাভাইয়ের জোরাজুরিতে সে শেষমেশ রাজি হল।ঠিক হল আগামী রবিবার বউ পরশের বাড়িতে তুলে নেয়া হবে।

সোমবার। রাত ৩ টায় ট্রেন এসে থামল প্রায় জনমানবশূন্য আক্কেলপুর স্টেশনে। যেকজন যাত্রী ট্রেন থেকে নামলো, একে একে সবাই চলে যাচ্ছে তাদের নিজেদের নীড়ে। এদিকে শীত বেশ জেঁকে বসেছে,স্টেশন থেকে বের হয়ে আকাশের দিকে তাকাতেই, পরশ দেখল ঝকঝকে জোছনা, ভাসিয়ে দিচ্ছে চারপাশ, ঝিঝি ডাকছে। সে আস্তে আস্তে এগোতে থাকলো তুলসী গঙ্গা নদীর দিকে। পরশের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল,হঠাৎ তার মনে পড়ল, probability'র নিয়ম অনুযায়ী,যে কোন মানুষের হঠাৎ করে শুন্যে মিলিয়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা আছে !



বিকেলবেলা আব্দুর রউফ সর্দার প্রতিদিনের মত নদীর পার ধরে হাঁটতে বের হয়েছেন। দূর থেকে তিনি খেয়াল করলেন, কালরাতের সেই ছেলেটা আজ বিকালেও নদীর ধারে হাঁটাহাটি করছে। বিকেলের আলোতে তিনি ছেলেটিকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন। ছেলেটির বয়স কত হবে ২৪-২৫, লম্বা, ছিপছিপে গড়ন, গায়ের রঙ পাঞ্জাবীদের মত লাল,মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি। লম্বা নাক, কাটা থুতনি, বড় বড় চোখ দুটিতে তার বিষাদ ভরা, অপূর্ব সুন্দর চেহারা। ঠিক যেন সদ্য ভূপাতিত কোন দেবদূত। এধরনের ছেলেরা আর যাইহোক চোরছ্যাঁচড় হয় না, তবে নেশাখোর হতে পারে।ফেন্সিড্রিল খোররা নাকি দেখতে টুকটুকা হয়। আব্দুর রউফ সর্দার ছেলেটির কাছে গেলেন,
"কি নাম? "
"জ্বী পরশ। "
" মুরুব্বীরা জিজ্ঞাসা করলে ভালো নাম কতে হয়। "
" জ্বী, মাফ করবেন, ভালো নাম মুবিন বক্স। "
" আর বংশ পরিচয়?"
" জ্বী সৈয়দ বংশ। "
" অরে বাবা! তা আসল না নকল! "
"মানে? "
" বাড়ি কোথায়? "
" ঢাকা "
" অহ, তা কি করা হয়? "
" জ্বী আমি ডাক্তার, এখানে উপজেলা সাস্থ্য কমপ্লেক্স এ নতুন জয়েন করতে আসচি।"
" আরে! ছিঃ ছিঃ! তা আগে কবেন তো! আমি আবার... আসলে ডাক্তার সাহেব, কাল রাতে আপনাকে দেখলাম নদীর ধারে হাঁটাহাঁটি করতে।আগে মাষ্টার ছিলাম তো, তাই স্বভাবসুলভ ভাবে কম বয়েসী ছেলে দেখলে ছাত্র ছাত্র মনে হয়.... হাহ হাহ হা। "
" না আসলে কাল রাতের ট্রেনে আসছি। এখানে ডাক বাঙলো টা খুঁজে পাচ্ছিলাম না তাই.."
"ও আপনি ডাকবাংলোতে উঠিছেন? ভালো ভালো, তা জয়েন করছেন? "
"জ্বী আজকে সকালে। "
" তা কেমন লাগিচ্ছে আক্কেলপুর? আগে আসছেন এখানে? "
" জ্বী না, এই প্রথম। ভালো লাগছে। সবাই খুব ভালো, সবাই দেখি ঢাকা থেকে আসচি শুনে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করছেন, কিন্তু এখান কার ভাষার টান টা অদ্ভুত! থেকেই যাচ্ছে, দূর থেকে শুনলে মনেহয় যেন জাপানী ভাষা শুনতেছি।"
" আপনি জাপান গেছলেন নাকি?"
" জ্বী না, তবে সিনেমায় ওদের ভাষা শুনছি। "
আব্দুর রউফ সর্দার হাসলেন, কিছু বললেন না। পরশের মনে হল তাঁর ভাষা সংক্রান্ত কথাটা পছন্দ হয়নি।
" আমার নাম আব্দুর রউফ সর্দার। আমি আগে এখানে কলেজে শিক্ষকতা করতাম, ইতিহাস। এখন কিছুই করিনা, ঐ যে ঐটা আমার বাড়ি। ছেলেমেয়ে নাই, একাই থাকি। ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করি, টুকটাক লেখালেখি করি লোকাল পত্রিকা গুলাতে। রাতে ঘুম হয় না, তাই বারান্দায় বসে থাকি, কালকে বসে বসে জোছনা দেখিচ্ছিলাম।চলেন বেয়াদবি যখন করিছি, তখন এক কাপ চা খাওয়াই আমার বাসায় চলেন। "
"আচ্ছা এই নদীর এত সুন্দর নাম কে দিয়েছে বলতে পারেন? "
"জ্বী না। এই নদী এখন মরা ,কিন্তু কিছু দিন আগে মিষ্টি নামধারী এই নদীর বাঁধ ভেঙে বন্যার পানি ঢুকে ছয়লাপ "
" না নামটা সুন্দর, তুলসী গঙ্গা! "
" নাম কেন তুলসী গঙ্গা তা জানিনা, কিন্তু কে দিয়েছে তা হয় তো জানি। চলেন খাঁটি দুধের চা খেতে খেতে গল্পকরি, অনেকদিন কারও সাথে বসে চা খাই না।"
" কেন? আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কেউ? "
" নাহ! এখানে কেউ আমার সাথে উঠা বসা করে না। সবাই জ্বলে! চলেন চলেন চা খেতে কথা বলি। "
আব্দুর রউফ সর্দারের বাড়ির সামনে দুইটি বাচ্চা ছেলে মার্বেল খেলছিল। তিনি তাদের কুকুর খেদানোর মত দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেন। কোমর পাচিলে ঘেরা একতলা পাকা বাড়ি। বাড়ির সামনে ছোট্ট বাগান তারপর গ্রিল ঘেরা বারান্দা। বারান্দার গ্রিলের তালা খুলে, রউফ সাহেব একপাশে স্যান্ডেলটা খুলে ঘরে ঢুকলেন, তাঁর দেখাদেখি পরশও তাই করলো। আব্দুর রউফ সর্দারের বৈঠক খানাটা বেশ ছিমছাম, সবকিছুতেই একটা চকচকে ভাব। রউফ সাহেব ঘরে ঢুকেই শোকেস'র উপরে রাখা একটা সোনালী ন্যাশনাল প্যানাসনিকের সিংগেল স্পিকার ক্যাসেট প্লেয়ারে মিহি ভলিউম এ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান ছাড়লেন,
"এ শুধু গানের দিন
এ লগন গান শোনাবার।
এ তিথি শুধু গো যেন
দখিন হাওয়ার।।
এ লগনে দুটি পাখি
মুখোমুখি নীড়ে জেগে রয়
কানে কানে রূপকথা কয়।
এ তিথি শপথ আনে
হৃদয় চাওয়ার।।
এ লগনে তুমি আমি
একই সুরে মিশে যেতে চাই
প্রাণে প্রাণে সুর খুঁজে পাই।
এ তিথি শুধু গো যেন
তোমায় পাওয়ার।।"

"পড়াশোনার পর, এই একটা শখ। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। এই ক্যাসেট প্লেয়ারের বয়স প্রায় ২৫ বছর। গ্রেট সার্ভিস! চলেন বারান্দায় বসি, সেখানে চায়ের ব্যাবস্থা আছে , শুধু ফ্রিজ থেকে দুধটা নিতে হবে। এইগুলা সবই নতুন, এগুলা আমার ভ্যাগ্না কিনে দিসে। সেও ঢাকায় থাকে, মাঝেমধ্যে ছুটিতে বেড়াতে আসে পরিবার নিয়ে।"
বারান্দায় দুইটি কাঠের গদিওয়ালা চেয়ার। একটার ওপর কিছু লোকাল পত্রিকা। বারান্দার একপাশে ছোট কেরোসিন স্টোভ রাখা, তাতে একটা ছোট হাড়ি, তারপাশে একটা প্লাস্টিকের জগে পানি রাখা, দেয়ালে একটা চা ছাকনি ঝুলছে, মেঝেতে একটা চায়ের কাপ,দুইটা ছোট টিনের কৌটা, একটা চামচ। রউফ সাহেব প্রথমে হাড়িতে পানি দিলেন, তারপর তাতে চামচ, ছাকনি, কাপ ফুটাতে দিলেন।পরশের জন্য তিনি বাড়ির ভেতর থেকে একটা নতুন চকচকে কাপ নিয়ে এলেন। তারপর চেয়ারে বসলেন আরাম করে।
" ডাক্তার সাহেব বসেন। কি যেন বলছিলাম? ও তুলসি গঙ্গা নদীর নাম! এই নিয়ে আমার যতদূর জানা আছে, লোকে বলে, ভারতের নদীয়া জেলার শান্তিপুরে প্রভুপাদ অদ্বৈত গোস্বামী সবসময় ঈশ্বরের ধ্যান করতেন। তার স্ত্রী সীতা দেবীও ছিলেন সতী-সাধ্বী নারী । একদিন ২৪ পরগণার যুবক নন্দ কুমার এবং নদীয়া জেলার আর এক যুবক যজ্ঞেশ্বর রায় প্রভুপাদ অদ্বৈত গোস্বামীর নিকটে এসে দীক্ষা গ্রহণ করতে চাইলে অদ্বৈত গোস্বামী মহোদয় তাদেরকে সীতাদেবীর কাছে পাঠান । সীতাদেবী ধ্যান যোগে জানতে পারেন যে, এই যুবকেরা পূর্ব জম্মে জয়া ও বিজয়া নামে দুই শখী ছিল। তখন সীতাদেবী যুবকদের মাথা ন্যাড়া করে স্নান করে আসতে বলেন । সীতাদেবীর নির্দেশ মত কাজ শেষ করে এলে তিনি তাদের দীক্ষা দেন। সীতাদেবী নন্দকুমারের নাম নন্দিনী এবং যজ্ঞেশ্বরের নাম জঙ্গলী রাখলেন।সেই নন্দিনী প্রিয়া বরেন্দ্র এলাকায় বর্তমান জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার গোপীনাথপুর গ্রামের ১কিঃমিঃ উত্তরে গভীর জঙ্গলে নদীর ধারে একটি মন্দির তৈরি করেন। এই নন্দিনী প্রিয়াই এই নদীর নাম রাখেন তুলসী গঙ্গা। যদিও এর কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নাই। তবে ১৫২০ হতে ১৫৩০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সুলতান আলাউদ্দীন হুসেন শাহ নন্দিনী প্রিয়ার পূজা-পার্বণ ও অতিথি সেবার কথা শুনে খুশি হয়ে তাম্রফলকে লিখে পূর্ণগোপীনাথপুর ও গোপালপুর মৌজার সব সম্পত্তি দেবোত্তর হিসেবে দান করেন । আর আজকালকার হিন্দুরা বলে, মুসলিম শাসকরা এদেশের জন্য কিছুই করেননি, শুধু লুটই করে গেছেন! হায়! ১৩০৪ বঙ্গাব্দে এই বাংলার বেল্ট ধরে একটা বড় ভূমিকম্প হয়, এই ভূমিকম্পে গোপীনাথপুর মন্দিরটি ভেঙ্গে পড়ে যায়। ১৯২৮ হতে ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বর্তমান মূল মন্দিরটা আবার তৈরি করা হয়,কোনদিন গেলে দেখবেন, এখানে প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় আরতি এবং মধ্যাহ্নে আধামণ চালের অন্নভোগ দেওয়া হয় । প্রতিবছর দোল পূর্ণিমাতে এখানে মেলা বসে এবং ১৩দিন ধরে এ মেলা চলে। এক্কেবারে জাঁকজমক ব্যাপার!"
রউফ সাহেবের গল্প বলার ভঙ্গিটা অনেক আকর্ষণীয়, শিক্ষক হিসাবে যে তিনি ছাত্রদের প্রিয় ছিলেন এতে কোন সন্দেহ নাই।
" এই হয়ে গেছে এবার চা টা চড়ায়ে দেই, বেশীক্ষণ লাগবে না, আপনি বিরক্ত হচ্ছেন না তো? কোন কাজ আছে? "
" না না, একেবারেই না, আপনার গল্প শুনতে ভাল লাগছে। "
" জ্বী ইতিহাস তো গল্পই।এই আক্কেলপুরের নাম কেন আক্কেলপুর জানেন?"
"জ্বী না। কেন?"
" দাঁড়ান, চা চড়ায়ে দিয়ে বলি "
রউফ সাহেব খুব যত্ন করে চা চাপিয়ে দিলেন।
" কথিত আছে যে, আগে এই জায়গার নাম ছিল 'ইকুরকুরি'। তো সাবেক 'ইকুরকুরি' মৌজায় সপ্তদশ শতাব্দীতে হজরত শাহ মখদুম (রাঃ) নামক একজন ধর্মীয় সাধক সুদূর পারস্য থেকে ধর্ম প্রচারের জন্য আসলেন।এখানে এসে তিনি দেখলেন যে এখানকার লোকজন অত্যন্ত বুদ্ধিমান। ফারসি আক্কেলমান্দ শব্দের অর্থ বুদ্ধিমান। তিনি এই এলাকার নাম দিলেন আক্কেলমান্দ পুর, সেই আক্কেলমান্দ থেকে এই আক্কেলপুর নাম হয়েছে। হাহহা হাহ হা। এই গল্পেরও কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নাই, তবে এখানকার লোকজন খুবই ধূর্ত এতে কোন সন্দেহ নাই। আপনি নতুন মানুষ একটু সাবধানে থাকবেন।তা আপনার পরিবার? বিয়ে করেছেন? "
" জ্বী এইতো গত শুক্রবারে। "
" বলেন কি! নিউলি ম্যারিড! বাহ, তা মিসেস কে নিয়ে আসবেন কবে? "
" এখানে স্টাফ কোয়াটারে বাসা ভাড়া নেয়ার কথা চলছে, হয়ে গেলেই নিয়ে আসবো।"
রউফ সাহেব চা ছাকনীতে চা ছেঁকে দুই কাপে ঢাললেন। নতুন কাপটা পরশের হাতে দিলেন, দুধ চায়ের কড়া গন্ধে বারান্দা মৌ মৌ করছে। চায়ের রঙ ইট লাল। রউফ সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে, তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ করলেন,তারপর উদাস নয়নে তুলসী গঙ্গার শুকনো বুকে অস্তমিত সূর্যের লালিমার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। ম্লান একটা হাসি ঠোঁটের কোনায় মিলিয়ে দিয়ে বললেন,
" বিয়ে আমিও করেছিলাম, প্রথম যখন কলেজে চাকরী পাই তখন। তাঁর নাম ছিলো নীলিমা...। " বলেই রউফ সাহেব কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন। পরশ চায়ে চুমুক দিয়ে জীজ্ঞেস করল,
" তারপর..? "
" শেষপর্যন্ত টেকেনি, আমি সারাদিন ব্যাস্ত কলেজ, ছাত্র পড়ানো, লেখালেখি আর আমার সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় নিয়ে, বেচারি একা একা সারাদিন...। তারপর কোন সন্তান হলো না, বাপের বাড়ি চলে গেল।আমি গেসিলাম ফিরিয়ে আনার জন্য,তার বাড়ি থেকে আমাকে দেখা করতে দেয়নি, আর দেখাও হয়নি।"

তারা দুজনই বারান্দায় বসে চুপচাপ চা খেতে থাকলেন। সন্ধ্যানেমে এল। চারিদিক ঘরে ফেরা পাখিদের কলকাকলিতে ভরে গেল। পরশ এত পাখির ডাক একসাথে ঢাকা শহরে কোনদিন শোনে নি। এমন সময় মাগরিবের আজান দিলো।
"আজান দিচ্ছে আমি ক্যাসেট টা বন্ধ করে আসি দাড়ান " রউফ সাহেব ক্যাসেট প্লেয়ারটা বন্ধ করে ফেরত এলেন।
"আপনি কি নামাজ পড়বেন? "
" জ্বী না, কেন আপনি পড়বেন? "
"না, আমি শুধু জুম্মার দিনে মসজিদে নামাজ পড়তে যাই। আপনি?"
" আসলে বিশ্বাসটা ঠিক...। "
" ডাক্তার সাহেব, ধর্ম হল মান্য করার বিষয় , এতে বেশী মাথা ঘামালেই সব ভেস্তে যায়। আমার মতে সকলেরই ধর্ম মানা উচিৎ। "
আযান শেষ হলে, রউফ সাহেব আবার আগের প্রক্রিয়ায় চা বানাতে বসলেন।
"আপনি একা থাকবেন না। এই এলাকা খুবই খারাপ ডাক্তার সাহেব। যত তাড়াতাড়ি পারেন ওয়াইফ কে নিয়ে আসেন। "
" আপনি বলছিলেন এখানে কেউ আপনাকে দেখতে পারে না, কেন?"
" সেটা তো একটা বিরাট গল্প, ওটা শুনতে হলে রাতে আমার সাথে খ্যাতে হবে, আমি আবার একটু আগে আগেই রাতের খাবারটা খাই। আজকে সবজি খিচুড়ি, ডিম সিদ্ধ খাব, দেশী ঘী দিয়ে, খাবেন? "
" না না আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমি আবার কালকে আসবো। "
" রাতে খাবেন কোথায়? দাওয়াত আছে নাকি? "
"নাহ, হোটেলে। "
" হোটেলের চেয়ে আমার রান্না ভালো, কয়ে দিলাম। বসেন।"
পরশ হাসিমুখে রাজি হয়ে গেল দুইটা কারনে, একতো আব্দুর রুউফ সর্দারের গল্প, দ্বিতীয়ত তাঁর হাতের চা, অসাধারণ! নেশা ধরা চা, আগের বারে স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে।
"আপনি ছাত্রদের কাছে খুব পপুলার ছিলেন তাইনা? "
" হ্যা, আমার ক্লাস ছাত্ররা মিস দিতো না, অন্য কলেজের ছাত্ররা আমার কাছে প্রাইভেট পড়তে চাইতো। "
"চাকরিটা ছাড়লেন কেন? "
" দাড়ান, বিস্কুট নিয়ে আসি, ঘরেই আছে, নোনতা, চলবে?"
"জ্বী হ্যা।"
রুউফ সাহেব ২য় দফা চা বসিয়ে, ভেতরে গেল বিস্কিট আনতে । ভেতরে আবার ক্যাসেট প্লেয়ার চালু হল।এবারের গান,
"আজ চঞ্চল মন যদি মৌমাছি হতে চায় ক্ষতি কি ?
গুণ গুণ সুরে যদি সারারাত গান গায় ক্ষতি কি ?
সেই সুরে ফোটে ফুল ফুটুক না সেই গানে ওঠে চাঁদ উঠুক না
যদি স্বপ্নে এ আঁখি দুটি ভরে যেতে চায় ক্ষতি কি ?
এই রাতে জোনাকী যত জ্বলুক না সেই সাথে হাওয়া কথা বলুক না
এই মন যদি মন থেকে আজ ছুটি পায় ক্ষতি কি ?"

২য় দফা চা পরিবেশনের সময় কারেন্ট গেল। নদীর অপারে কয়েকটা শিয়াল ডেকে উঠলো।বিস্কিট খেতে খেতে চায়ে চুমুক দিয়ে রউফ সাহেব বললেন,
" আপনি খেঁকশিয়াল দেখিছেন? "
" না তো, কেন?"
" না আমার বাড়ির পেছনে বাচ্চা দিছে, অতি মায়াবী প্রানী। দিনের বেলা দেখাবো একদিন। "
" আপনি কিন্তু বললেন না... অবশ্য না বলতে চাইলে থাক। "
" না না বলব না কেন। আসলে এই বয়সে আমার মত মানুষের অনেক একা একা লাগে। মানুষের সঙ্গ পেতে মন চায়। তাই আপনাকে আটকাচ্ছি। আমার এই জন্মে ঐ ভাগ্না ছাড়া আর কেউ নাই। ওর চার বছরের একটা ছেলে আছে, নাম সুমন। আমাকে খুব ভালোবাসে। "
" এখানে কারও সাথেই আপনার আলাপ পরিচয় নাই? কথা বার্তা হয় না! "
" আলাপ পরিচয় আছে, সবই লেনদেনের আলাপ পরিচয়। এমনিতে এখানে আমি প্রায় অচেনা, একঘরে মানুষ। "
" বলছিলেন সবাই জ্বলে, কেন?"
" শোনেন তাহলে, আমি আমার বাবার একমাত্র সন্তান। বাবা মারা যাবার সময় প্রচুর জমিজিরাত আমার নামে রেখে যায়, তখন আমি রাজশাহী কলেজে মাস্টার্স পড়ি। পাশ করে বের হতে হতে আমার মাও মারা যান। তখন আমি সম্পূর্ণ একা। চাকরি পেলাম জয়পুরহাট কলেজে,ট্রেনে যাওয়াআসা। এখানে হাস্তাবসন্ত পুরে জমিজমা আর জয়পুরহাটে কলেজ। ভাল ঘরে বিয়ে হল। আল্লাহর রহমতে টাকাপয়সার অভাব ছিলোনা। কিন্তু ঐ যে বললাম বিয়েটা টিকলো না। আমি আবার একা হয়ে গেলাম। তখন অবশ্য একা একা লাগতো না, কলেজে ছাত্ররা ছিলো, ইতিহাস পড়াতাম। বাড়িতে জমিজমা দেখাশুনা করতাম, ইতিহাস নিয়ে পত্রিকায় লেখতাম,গান শুনতাম। ভালোই দিন কাটিচ্ছিলো।একদিন আবিষ্কার করলাম বাড়িতে মানে এখানে আত্মীয়রা, কলেজে কলিগরা কেমন আমাকে হিংসা করে।"
"কেন?"
"ক্যান, একটু চিন্তা করে দেখেন। আমি কলেজে ছাত্রদের কাছে পপুলার,বিনা পয়সায় প্রাইভেট পড়াই, বিত্তশালী, বিয়েশাদি করা লোকেদের মধ্যে একা একা থাকি,স্বল্প শিক্ষিত লোকেদের মাঝে শিক্ষিত, মাঝেমধ্যে গরীবলোকদের সাহায্য করি,তারাও আমাকে মানে। "
" পরে আর বিয়ে করলেন না কেন?"
" প্রথমবারের ব্যার্থতার গ্লানি নিয়ে, দ্বিতীয়বার আর কেন জানিনা ইচ্ছা হয়নি। আত্মীয়স্বজনরা জমিজমা নিয়ে গোলমাল করার চেষ্টায় থাকতো, কলেজে সবাই এভোয়েড করতে লাগলো, সমস্যা হলনা। কারন তখনো ছাত্ররা খুবই ভালোবাসতো। বাড়িতে একা থাকতাম । একবার আমার এক দূরসম্পর্কের চাচাতো ভাই, নাম হাফিজ।আমার কাছে এলো সাহায্য নিতে। সে ছিলো মাদ্রাসার ছাত্র। আমি আবার একেবারে বিনা পরিশ্রমে কাউকে নগদ সাহায্য করতাম না, লোকে পেয়ে বসে। আমি হাফিজকে বললাম তিলক পুরে আমার কিছু জমি আছে। সেটা আমার যাতায়াত পথে পড়েনা, একেবারে উলটা পথে পড়ে। আমি দেখাশুনা করতে পারি না। সেটা দেখা শুনা করে টাকা এনে দিতে হবে। সে রাজি হল। এরপর থেকে সে প্রায়ই আমার বাসায় আসতো। জমিজমা তদারকি নিয়ে বিভিন্ন ডিসিশন আমি তাকে দিতাম। সে যেদিন আমার বাসায় আসতো, সেদিন সে নিজেই রান্নাবাড়া করে আমার সাথে খাওয়াদাওয়া করতো, রাতে থাকতো। আমার আত্মীয় স্বজনরা এই ব্যাপারটা ভালোভাবে নিলো না। একবার কি হল,ঐ তিলকপুরের জমি নিয়ে আমার আপন ভাতিজার সাথে আমার ভিষন গোলমাল হল, সেই ভাতিজা কোর্টে কেস তুললো। জমিজমার মামলা বোঝেনইতো। আমার কোর্টে হাজিরা দেয়া লাগে প্রায়। কলেজে ক্লাস থাকে, ছাত্রদের সামনে পরীক্ষা। কি করবো। কোনদিকে সামলাবো বুঝতে না পারছিলামনা। এইসময় উকিলের পরামর্শে আমি হাফিজকে পাওয়ার অব এটর্নি দিয়ে দিলাম। হাফিজ তখন মোটামুটি যুবক। জ্ঞান বুদ্ধিও ভালো। সে সব কাজ ঠিকমত করতে লাগলো।এর পর একদিন , আমি কলেজে ক্লাস নিচ্ছি। এমন সময় দেখলাম আমার এলাকার কিছু মাস্তান ছেলেপেলে আমার ক্লাসে ঢুকছে। কিছু জিজ্ঞাস করার আগেই তাদের একজন আমার শার্টের কলার ধরে আমাকে একটা কষে চড় মারল, তারপর হিরহির করে টেনে নিচে নিয়ে যেতে লাগলো, আমার ছাত্ররাও সবাই তাদের পিছন পিছন নিচে নেমে এল। নিচে নেমে দেখি আমার এলাকার কিছু লোকজন, কয়েকজন শিক্ষক, অনেক ছাত্র একজায়গায় জটলা করে আছে। আমার ছাত্ররা জিজ্ঞাস করলো কি হয়েছে। তখন একটা মৌলবি এগিয়ে এসে আমাকে দেখিয়ে বলল,
এই লোক আমার মাদ্রাসার ছাত্র মোঃহাফিজুর রহমানের দারিদ্র্যতার সুযোগ নিয়ে তার সাথে দিনের পর দিন সহবাস করে আসছে,আজকে হাফিজুর রহমান মাদ্রাসার শালিশে এই কথা নিজে মুখে স্বীকার করছে। আমি তখন বললাম, মিথ্যা কথা, কিসের শালিস! এইসব বাজে কথা বলছেন কেন? পাশথেকে মাস্তান দের একজন আবার আমাকে চড় মারল। এরপর ঐ মৌলবি আবার বলল, কিছুদিন আগে হাফিজুর রহমান মাদ্রাসায় থাকা খাওয়া, পড়ার ফি দিতে পারছিল না, আর এখন সে হাতে ক্যাসিও ঘড়ি পড়ে, রেডিওতে গান শোনে, পড়াশোনায় মন নাই,মাদ্রাসায় প্রায়ই থাকেনা ।এই দেখে মাদ্রাসা থেকে তাকে চোখে চোখে রাখা হয়। এই লোকের বাড়িতে তার সন্দেহজনক আসাযাওয়া দেখে, হাফিজুর রহমান কে শালিসে ডাকা হয়। শালিসে হাফিজুর রহমান সবার সামনে স্বীকার করে যে এই লোকটা একজন মিথলি আলজিনসান এবং প্রায়শই তার বাড়িতে ডেকে হাফিজুর রহমানের সাথে হারাম কাজ করে। বিনিময়ে হাফিজুর রহমান কে সে টাকা দেয়। আমি বিহ্বল হয়ে তাদের কথা শুনেগেলাম। এরপর ওরা আমাকে আমার সব ছাত্র, শিক্ষক সবার সামনে জুতা পেটা করলো, আমার গায়ের জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলে দিল, আমার মাথা ন্যাড়া করে, মাথায় আলকাতরা মাখিয়ে, গলায় জুতার মালা পরিয়ে,মাজায় দড়ি বেঁধে ট্রেনে করে জয়পুর হাট থেকে আক্কেলপুর নিয়ে এল। সারাদিন ইষ্টিশনে বেঁধে রাখল,আমি লজ্জায়, অপমানে.... "
রউফ সাহেব শিশুদের মত হাউমাউ করে কাঁদে উঠলেন। পরশ স্তম্ভিত হয়ে চুপচাপ বসে রইল।চট করে রউফ সাহেব চাদরের কোনায় চোখ মুছতে মুছতে, নিজের কান্না লুকানোর চেষ্টা করে, আবার বলা শুরু করলেন ,
".... এত কিছু করলো, কোনকিছুই এখন আর মনে লাগেনা আমার জানেন, শুধু আমার ছাত্রদের সামনে আমাকে উলঙ্গ করে জুতা পেটা করা.... এটা আজও মেনে নিতে পারিনা...। "
রউফ সাহেব আর কান্না আটকাতে পারলেন না, আবার কান্নায় ভেঙে পড়লেন।পরশের মনে হল, বহুদিনের জমা ক্ষোভ বদ্ধ থাকতে থাকতে এভাবে মাঝেমধ্যেই বের হয়ে আসে।সে রউফ সাহেবের হাত ধরে শান্তনা দিতে থাকলো।
" আপনার আর কিছু বলার দরকার নেই। "
" না শোনেন , পুরাটাই শোনেন। সন্ধ্যাবেলা ইষ্টিশনে এলো আমার প্রতিবেশী সম্পর্কের এক নাতী। এসে বলে, দাদা আপনার বাড়ি জ্বালায়ে দিচ্ছে, আপনি তাড়াতাড়ি যান। বলে সে আমার দড়ির বাধন খুলে দিয়েই পালিয়ে গেল। আমি পালিয়ে বাড়ি গেলাম, আমার তখন আধা পাকা বাড়ি। দেখি ঘরের চাল গুলা দাউদাউ করে জ্বলিচ্ছে। পানি দিয়ে নেভানোর চেষ্টা করলাম, প্রতিবেশীদের ডাক দিলাম, কেউ আসলো না। বাড়ি থেকে যতটুকু প্রয়োজনীয় জিনিষ পত্র,টাকা পয়সা পেলাম সব সরায়ে রাখলাম। চোখের সামনে বাড়িটা পুড়ে গেল। তারপর আমার হুশ হল যে আমার গায়ে কোন পোশাক নাই। গোসল করলাম, জামাকাপড় পড়লাম। জিনিষ পত্র গুলা গোছায়ে একটা পোটলা করলাম। এমন সময় দেখি কলেজের পিওন মারফত প্রিন্সিপাল সাহেব জরুরী তলব করেছেন। পোটলাটা নিয়ে গেলাম প্রিন্সিপাল সাহেবের বাসায়। তখন কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন পরিতোষ সাহা।আমি তাঁর খুব কাছের লোক ছিলাম।তিনি আমাকে স্নেহ করতেন। উনি অনেক সিনিয়র ছিলেন, ঐটা তাঁর চাকরির শেষ বছর ছিলো।আমি তাঁর বাড়িতে গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করলাম। তিনি বললেন কলেজে আমার পদত্যাগের দাবি জানায়ে ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করছে , কিছু শিক্ষকও এই আন্দোলনের সাথে জড়িত। তিনি তাঁর রিটায়ারমেন্টের বছরে কলজে কোনরকম ঝামেলা চান না। তিনি আমাকে সাদা কাগজে নিজের অসামাজিক কর্মকান্ডের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে একটা চিঠি লেখতে বললেন এবং একই সাথে পদত্যাগ পত্রও লিখে দিতে বললেন। আমি বিনাবাক্য ব্যায়ে লিখে দিলাম। তারপর তিনি আমাকে বললেন আমি যেন আর আক্কেলপুর ফিরে না যাই। ফিরে গেলে আগামীকাল এলাকার শালিসে আমার আরও কঠোর শাস্তির ব্যাবস্থা করবে, এমন কি আমাকে জানেও মারতে পারে। তিনি আমাকে একটা ছোট চিঠিসহ ঠিকানা লেখে দিলেন। বললেন, আমি যেন রাতের ট্রেনেই নীলফামারী ওই ঠিকানায় চলে যাই। এদিকে পরিস্থিতি শান্ত হলে পরে তিনি জানাবেন। আমি সেই রাতেই নীলফামারী চলে গেলাম। "
এশার আজান দিলো। রউফ সাহেব নাক টেনে নিজের চোখ মুছলেন। তারপর চায়ের কাপ হাতে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
" দাঁড়ান গানটা বন্ধ করে আসি, রাতের খাবার টাও তুলে দিতে হবে, আপনি বসেন।"
" আমি ও রান্না করতে পারি, সাহায্য করবো? "
" না না, আপনি অতিথি মানুষ, ৫ মিনিট, আমি আসছি, সব রেডিই আছে ফ্রীজে শুধু ধুয়ে প্রেশারকুকারে চরায়ে দিব। আপনি বসেন,চা শেষ করেন। "
রউফ সাহেব ভেতরে গেলেন। রান্না ঘরে পানির কল ছাড়ার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, কলটা আরও জোরে ছাড়ার শব্দ পাওয়া গেল। এখন পানির শব্দের তলায় চাপা পড়া, রউফ সাহেবের ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। পুরুষ শাসিত সমাজে পুরুষদের কান্নাকাটি করা অনেক লজ্জাজনক ব্যাপার। শাসকশ্রেণীর চোখে অশ্রু তাদের দূর্বলতার পরিচয়। পুরুষরা কান্নাকাটি করবে না। তারা রাগারাগি করবে, মারামারি করবে,খুন করবে, ধর্ষণ করবে,চুরি, ডাকাতি, লুট করবে কোন লজ্জানেই তাতে। শুধু কাঁদবে লুকিয়ে লুকিয়ে। এটাই নিয়ম। পরশ এক দৃষ্টিতে জোছনার আলোয় চকচকে কংকালসার সরীসৃপের মত নদীটার দিকে তাকিয়ে থাকলো।

" দুইবার সিটি দিলেই নামিয়ে নিব। বেশীক্ষণ লাগবে না, আমি আবার ৮টার মধ্যে রাতের খাবার খেয়ে ফেলি। এই অভ্যাস আগে ছিল না,গহীন গ্রামে থাকতে থাকতে এই অভ্যাস হয়েছে। "
" নীলফামারীতে গিয়ে কোথায় উঠলেন? "
"আমি নীলফামারী থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে গোড়গ্রাম ইউনিয়নের ধোবাডাঙ্গা মৌজায় একটা হিন্দু পরিবারের সাথে প্রায় ১৩ বছর ছিলাম। দরিদ্র চাষাভুষা পরিবার , দুইবেলা খাবার ঠিকমত খেতে পায় না। লোকাটার নাম ছিলো, চন্দন শীল, তাঁর স্ত্রী বীথি রানী। তাদের কোন সন্তান ছিলো না। বংশে তাঁরা নরসুন্দর ছিলেন। কায়েত পরিবার। তখন কমিউনিস্ট পার্টির পান্ডারা পুলিশের ভয়ে শহর থেকে পালায়ে , এইরকম পরিবারের সাথে থেকে গা ঢাকা দিত। খুনের আসামী হলে, কিছুদিন এরকমভাবে থেকে, সুযোগ বুঝে বর্ডার পার হয়ে ইন্ডিয়া! পরিতোষ বাবুর আবার কমিউনিস্ট পার্টিত ভালো হোল্ড ছিলো, তিনি আদর্শের রাজনীতি করতেন। গ্রাম্য পরিবারে টাকা পয়সা দিয়ে থাকা আরকি। ওখানে থাকতে প্রথম প্রথম ঘর থেকে বের হতাম না। এই তুলসী গঙ্গা নদীটার কথা অনেক মনে পড়তো। একদিন ভরদুপুরে বীথি রানী আমাক এসে ডাকলেন, কলেন, এভাবে ঘরে বসে না থেকে বাইরেবাহির হতে। তাঁর স্বামীকে কৃষিকাজে সাহায্য করতে। ঐদিন তিনি আমাকে নিয়ে বের হলেন, নিয়েগেলেন নীলসাগর দেখাতে। নীল সাগর ‘বিরাট দিঘি’ ও 'বিন্না দিঘি' নামেও পরিচিত। বীথি রানী আমাকে কলেন, 'এই দিঘীর নাম জানেন? বিরাট দিঘী, কেন বলেন তো? এটা একটা ধাঁধা।'। দেখেন ডাক্তার সাহেব দিঘীটা প্রায় ৩২.৭০ একর। স্বাভাবিক ভাবে সকলেই কবে যেহেতু অনেক বড় দিঘী তাই এর নাম বিরাট দিঘী। কিন্তু আমি জানতাম, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর কোন এক সময়ে এ জলাশয়টির খননকাজ শুরু হয়েছিল, রাজা বিরাট তার বিশাল গরুর পালের জন্য পানির সংস্থান করতেই এ দিঘি খনন করেন এবং তার কন্যা বিন্নাবতীর নামে এর নামকরণ করেন বিন্না দিঘী। আমি বীথি রানীকে কোলামও তাই। তিনি হেসে কলেন, ধাঁধার উত্তর ঠিক আছে কিন্তু একটু ভুল হছে। মহাভারতের পান্ডবরা যখন ১২ বছরের বনবাস ও ১ বছরের অজ্ঞাতবাসে যান,তখন বৈদিক রাজা বিরাটের মৎস্য দেশের এই জায়গাত ছদ্মবেশে বসবাস শুরু করেন। সেসময় পাণ্ডবদের তৃষ্ণা মেটাতে রাজাবিরাট এ দিঘিটি খনন করেছিলেন। যদিও এই গল্পেরও কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নাই।তবুও একজন অশিক্ষিত হিন্দু মহিলার তুলনা দেখে অবাক হলাম। আমার হতাশা,জড়তা কেটে গেল। ধীরেধীরে চন্দন শীল আমাকে দড়ি পাকানো,জাল বোনা শেখালেন। আমি বাসায় বসে বসে সারাদিন মনোযোগের সাথে কাজ করতাম।আমিও বিরাট রাজার মৎস দেশে ১৩টা বছর থাকলাম। চলেন দুইটা সিটি পড়ে গেছে, ডিম সিদ্ধ হতে সময় লাগবে ৭ মিনিট, একসাথে টেবিলে বসে গরমগরম খেতে খেতে বাকিটা বলি। "
রউফ সাহেব একটা হকিন্সের কালিমাখা প্রেশারকুকার থেকে সরাসরি অর্ধতরল সবজি খিচুড়ি ঢাললেন নতুন চকচকে দুটি চিনেমাটির বড় থালায়।এরপর তিনি রান্না ঘরে ঢুকলেন, খুটখুট আওয়াজ হল কিছুক্ষণ, বারিয়ে এলেন দুই হাতে দুইটা আলাদা বাটিতে করে সদ্য খোসা ছাড়ানো রাজহাঁসের ডিম সেদ্ধ নিয়ে। পরশ একটু অবাক হল। ডিম সেদ্ধ বলে একেবারে রাজহাঁসের ডিম সিদ্ধ সে কল্পনা করেনি। রউফ সাহেব ঘি ভর্তি একটা হরলিক্সের কাঁচের বয়াম এনে টেবিলে রাখলেন।
" আপনার হাইপারটেনশন নাই তো? "
" জ্বী না ডাক্তার সাহেব, আমি নিরামিষাশী। "
"কেন? নিরামিষাশী হলে কি হাইপারটেনশন থাকেনা? "
" না তা নয়। হেহ হেহ হে হে "
"তারপর, মানে ১৩ বছর পর কি হল? "
" ও আচ্ছা! বলছি, আপনি ঘিটা খিচুড়ির মাঝখানে নেন, তারপর এভাবে মাখায়ে খান। আমার এক দূর সম্পর্কের ভাগ্না,নাম সবুর মিঞা।রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক ইতিহাসের ছাত্র। সে একদিন হঠাৎ এসে হাজির হল নীলফামারীতে। আমার সাথে দেখা করল। বলল ঠিকানা নাকি তাকে পরিতোষ বাবু দিয়েছেন। আমি একটু অবাক হলাম। এতদিন পর কথাবার্তা ছাড়াই এসে খোঁজ নিচ্ছে, আমি সরাসরি তাকে জিজ্ঞাস করলাম, সে কি চায়। সে ইনিয়েবিনিয়ে বলল, আমার আক্কেলপুরের জমিজমার কথা। বলল সে নাকি সব জমিজমা আবার আমাকে দখল করে দিবে, আক্কেলপুরে আমার বাড়ি সে পুনরুদ্ধার করবে, আমার থাকার ব্যাবস্থাও করে দেবে।আমি বললাম, সে আমার ব্যাপারে সব কিছু জানে কিনা? সবুর মিঞা বলল সে আমার কাছে আসার আগে সব খোঁজ খবর করেই এসেছে। আমার সব জমি আমার বড়ভাইয়ের ছেলে ইব্রাহীম সর্দার জবরদখল করে আছে। আমার পোড়া বাড়িটাতে সে আবার চালা দিয়ে ঘর ভাড়া দিসে। আমি সবুর মিঞাকে একটু সংকোচের সাথে তিলকপুরের জমির গুলার কথা জিজ্ঞাস করলাম। হাফিজুর রহমানের কথা জিজ্ঞেস করলাম।সবুর বলল হাফিজুর রহমানের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি, সে নাকি তিলকপুরের জমি আমার ভাতিজার কাছে নামমাত্র দামে বিক্রি করে এলাকা ছেড়ে পালাইছে। সবুর মিয়া আমাকে বলল,মামা এখন সরকার বদলে গেছে। আপনি অযথা ভয় করিচ্ছেন।এখন ক্ষমতা আমাদের দলের হাতে।আপনি আমার সাথে আক্কেলপুর চলেন। আমি আপনাকে সব কড়ায়গণ্ডায় আদায় করে দিব, কোর্টকাছারি কোন সমস্যা হবে না। সবখানে আমাদের লোক আছে। ইব্রাহীম সর্দারের নামে মার্ডার কেস দিসি। ওর বাঁচার কোন রাস্তা নাই।আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইব্রাহীম কাকে মার্ডার করসে? সবুর মাথা নিচু করে বলল, তার কাছে খবর আছে হাফিজুর রহমান কে নাকি আমার ভাতিজা ইব্রাহীমই গুম করাইসে, তাই সে হাফিজুর রহমানের পরিবার কে দিয়ে ইব্রাহীমের নামে কেস দিসে।এই কথায় আমি একটু রেগে গিয়ে বললাম , তা তুমি কি চাও, কি নাবা? সে নিঃসংকোচ ভাবে বলল মামা, আপনি আমার নামে সব জমিজমা রেজিস্ট্রি করে দিবেন,আমার বাপ-মা নাই আমি এতিম। খোদার কসম, আপনার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি আপনার দেখাশুনা করবো। আমি হিসাবনিকাষ করে দেখলাম, দুইদিকেই আমার হার। কিন্তু শুধু প্রতিশোধ নেয়ার জন্য আমি রাজি হলাম। দীর্ঘ ১৩ বছর পর আমি সবুরের সাথে আসলাম আক্কেলপুর। আক্কেলপুর এসে বুঝতে পারলাম সবুর মিয়া ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বড় নেতা। আমার বাড়ি একদিনের নোটিসে ফাঁকা করা হল। কোর্টকাছারি ছাড়াই দখল করা জমি ফেরত পেলাম। তিলকপুরের জমি নিয়ে মামলা করার পরের দিন আমার বড় ভাই এসে আমার হাতপা ধরে আমার পলাতক ভাতিজার জন্য ক্ষমা চাইলেন।নেগসিয়েশনের মাধ্যমে মার্ডার কেস তুলে নেওয়া হল,আমার তিলক পুরের জমি ফেরত পেলাম। শুধু হাফিজুর রহমানেরই কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। এখন সবুর মিঞা আমার একমাত্র আত্মীয়। সে আমার এই পাকা বাড়ি বানায়ে দিসে। বিয়ে করসে পরশাতে। ঢাকাতে ব্যাংকে চাকরি করে, বৌ, ছেলে নিয়ে মোহম্মদ পুরে থাকে। ছুটিছাটা হলে আসে,আমি মাঝেমধ্যে ঢাকা যাই।এতসব কিছুর পরে আমি আমার সব জমিজমা ওর নামে রেজিস্ট্রি করে দিসি। যাক! সে তো আমাকে খারাপ রাখেনি, নিজের বাপের মত সম্মান দিয়ে রাখিসে। সেটা যে কারনেই হোক।আমার কোন আফসোস নাই।একটা কথা মনে রাখবেন ডাক্তার সাহেব, নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, পৃথিবীতে ঠিক বা ভুল বলে কোন কাজের অস্তিত্ব নাই! এই ঠিক বা ভুল হল একটা মার্কা। মানুষ আর সমাজ পরিস্থিতি মত এটা যেকোন কাজের ওপর মেরে দেয়। ক্ষমতার দম্ভ একটা আদিম অমর দানব ! এটা সব ক্ষমতাবানদেরই কাঁধে চাপে। "
পরশ কি বলবে বুঝতে না পেরে খাবার দিকেই মন দিলো, কারন খাঁটি দেশী ঘি দিয়ে অর্ধতরল সবজি খিচুড়িটা অমৃতের মত হয়েছে, রাজ হাসের ডিম দিয়ে মাখিয়ে খেতে চমৎকার লাগছে। গল্প করতে করতে রাউফ সাহেবের খাওয়া প্রায় শেষ।
" গরিবখানার খাবার কেমন লাগছে। ডিনারের পর কি আরেক কাপ চা চলবে? "
" জ্বী খিচুড়িটা অনেক মজাদার হইছে।"
" এটার নাম লংগরখানার খিচুড়ি।"

রউফ সাহেব পরশকে ডাকবাংলো পর্যন্ত টর্চ নিয়ে এগিয়ে দিলেন। পরশ অনেকক্ষণ ধরে মনে জমিয়ে রাখা একটা প্রশ্ন ডাকবাংলোর গেটে এসে করেই ফেলল।
"একটা প্রশ্ন করবো?যদি কিছু মনে না করেন। "
" অবশ্যই! করতে পারেন। "
" ইয়ে মানে, আপনার নামে যে অপবাদ এখানকার লোকেরা ছড়িয়েছিল, সেটা কি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন? "
রউফ সাহেব মাথানিচু করে টর্চের আলোর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বললেন,
" ডাক্তার সাহেব, আপনি উচ্চশিক্ষিত মানুষ। বিবেক বিবেচনা দিয়ে চিন্তা করে দেখেন, এই জীবনে আমার আর বেচারা হাফিজের সাথে যাকিছু হয়েছে, তার কাছে এই অপবাদ কতটুকু ন্যায্যতা রাখে ?"
পরশ মনে মনে বহুদূর চলে যায়– যেখান থেকে ফিরতে হলে আরো একবার জন্মাতে হয়। জন্মেই হাঁটতে হয়, হাঁটতে-হাঁটতে হাঁটতে-হাঁটতে একসময় যেখান থেকে শুরু করেছিলো সে, সেখানে পৌঁছাতে পারে। পথ তো একটা নয় –তবু, সবগুলোই ঘুরে ফিরে ঘুরে ফিরে শুরু আর শেষের কাছে বাঁধা। নদীর দু –প্রান্তের মূল একপ্রান্তে জনপদ অন্যপ্রান্ত জনশূণ্য দুদিকেই কূল, দুদিকেই এপার-ওপার, আসা-যাওয়া, টানাপোরেন –দুটো জন্মই লাগে, আসলেই মনে মনে দুটো জন্মই লাগে।পরশের শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লেখা একটা কবিতা মনেপড়ে।

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১১:৪২

নিশ্চুপ কবি বলেছেন: প্রিয়তে রেখে দিলাম। সময় করে পড়ে দেন মন্তব্য করবো :)

০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ১:৩১

যাযাবর জোনাকি বলেছেন: অপেক্ষায় রইলাম।

২| ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১২:১০

দীপঙ্কর বেরা বলেছেন: খুব ভাল লাগল
গুছিয়ে লেখা

৩| ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৮ সকাল ৯:৫১

আটলান্টিক বলেছেন: সর্বনাশ এতো বড় গল্প B:-)

৪| ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৮ সকাল ১০:৩৬

রাজীব নুর বলেছেন: এত বড় গল্প !!!!!!!!!!!!!


গল্পটা চার বারে পোষ্ট দিলে ভালো হতো।

৫| ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৪২

আমিন রবিন বলেছেন: শাপ আর এই গল্পের লেখক একই ব্যক্তি মানতে কষ্ট হচ্ছে

০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ১২:৫৯

যাযাবর জোনাকি বলেছেন: এতটাই বাজে? :(

৬| ১৭ ই জুলাই, ২০১৮ রাত ৯:৩৯

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: অ-নে-ক বড়!!!!!

বাপুস!!!!!!!!রে .... ;)

অনেক গুলো বিষয়, অনেকগুলো প্লট, অনেক গুলো ভিন্ন ভিন্ন গল্প হবার উপাদান!

ভাল লাগল ।


আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.