নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

\'আমাদের চাওয়া আর পাওয়ার মাঝখানে একটা দেয়াল আছে, এর একদিকে থাকে চাওয়া,আর একদিকে পাওয়া। মুখ্য সমস্যা হল দেয়ালটা স্বচ্ছ কাঁচের\'

যাযাবর জোনাকি

‘আমাদের চাওয়া আর পাওয়ার মাঝখানে একটা দেয়াল আছে, এর একদিকে থাকে চাওয়া,আর একদিকে পাওয়া। মুখ্য সমস্যা হল দেয়ালটা স্বচ্ছ কাঁচের’

যাযাবর জোনাকি › বিস্তারিত পোস্টঃ

# নোট: পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে..

২৯ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ৯:৩৭


প্রত্যেক মানুষের দুইটা করে পৃথিবী থাকে একটা ‘আমার পৃথিবী’ আরেকটা ‘আমাদের পৃথিবী’।আমার পৃথিবীতে আমার জন্মের কয়েক বছর পর আমাদের পৃথিবীতে বার্লিনের দেয়ালটা ভাঙা হয়েছিল।
আমাদের পৃথিবীতে রাজীব গান্ধী যখন মারা গেল,তখন আমি অনেক ছোট।ঘটনার পরের দিন আমার পৃথিবীতে গ্রীষ্মের খুব সকালে বড় মামা দোকান থেকে ডিম কিনে এনে হন্তদন্ত হয়ে, বাসার রেডিওটা অন করে ভয়েস অব আমেরিকা ধরতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন। রেডিও এডজাস্ট করতে করতে তিনি বড়দের সকলকে চিৎকার করে ডেকে বললেন, “এই! রাজীব গান্ধী মারা গেছে।” কিছুক্ষন পর ভয়েস অব আমেরিকা রেডিওতে ধরা হল। বৈঠকখানাতে আমার পৃথিবীর বড়রা চায়ের কাপ হাতে গভীর মনযোগের সাথে রেডিওতে খবর শুনছেন। ছোটদের হট্টগোল করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ঘরে পিনপতন নিরবতা কেউ কেউ চায়ের কাপ পর্যন্ত সাবধানে নামিয়ে রাখছেন যাতে অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দ না হয়। সেদিনের থমথমে সকালে আমার পৃথিবীর সকলের গোমড়া মুখ দেখে নিজের ভেতরেও অজানা, অযথা একটা ভয় কাজ করেছিল। এর কিছুদিন পরে আমাদের পৃথিবী থেকে আমার পৃথিবীতে ‘ভারত বিচিত্রা’ এল। তার কভার পেজ জুড়ে ছিলো বোমায় ছিন্নভিন্ন হওয়া রক্ত,মাংস আর ফুলে মাখামাখি কিছু মানুষের দেহ। আমার পৃথিবীতে শুনলাম বড়রা সকলে আহা উহু করে বললেন, “ রাজীব গান্ধী অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন।” কিন্তু তখনও আমার পৃথিবীর আমি জানিনা আমাদের পৃথিবীতে রাজীব গান্ধী কে? তার সাথে আমার পৃথিবীর সম্পর্কই বা কোথায়? আর কেনইবা একটি তামিল মেয়ে কোমরে বোমা বাঁধে? কিসের নেশায়? কিসের আশায় সে ধ্বংসের স্বপ্ন দেখে?

আমার পৃথিবীটা তখন আমার মতই ছোট্ট। আনন্দ বলতে সাদাকালো টিভিতে “ দি সোর্ড অব টিপু সুলতান” দেখা, সারাদিন একা একা পাঁচিল ঘেরা বাড়ির পিছনে ঝোপঝাড়ে খড়ির তলোয়ার দিয়ে কাল্পনিক ইষ্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানির অদৃশ্য সৈন্যদের সাথে লড়াই করা। দুঃখের কালো থাবা তখনও আমার পৃথিবীতে পড়েনি। একমাত্র দুঃখ ছিল, রবিবার সকালবেলা দূরদর্শনে হিন্দি কার্টুন দেখার সময়, প্রাইভেট টিউটরের অঘোষিত আগমন। স্বাধীনতা! প্লাস্টিকের ‘সোলজার সেট’ নিয়ে অগ্রজের সাথে খেলার সময়, সবুজ রঙের সেনাবাহিনী অগ্রজের, ও আমেরিকা। ধূসর নীল রঙের সেনাবাহিনী আমার,আমি ভিয়েতনাম। খেলার ফাঁকে ফাঁকে অগ্রজ আমাকে প্রায়ই বোঝাতে চেষ্টা করতো, আমাদের পৃথিবীতে স্বাধীনতা বিষয়টা সহজ নয়। বাংলাদেশ মাত্র ৯ মাসে স্বাধীনতা যুদ্ধে জিতলেও, ভিয়েতনামের স্বাধীনতা যুদ্ধ জিততে এক যুগ লেগেছে। আমার পৃথিবীতে আমি তখনও জানতাম না, যে স্বাধীনতা মানে কেবল যুদ্ধে জেতা নয়। এরপর আরও গল্প থেকে যায়।

এভাবেই হঠাৎ একদিন, আমার পৃথিবীর সাদাকালো টিভিটাতে আমাদের পৃথিবীর একটা বয়স্ক লোককে বিটিভির খবরে দেখাতে লাগলো। লোকটা কোটপ্যান্টের সাথে মাথায় সাদার মধ্যে কালো ফোটা ফোটা একটা কাপড় কালো দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতো। ঈদের সময় অনেক মানুষের সাথে তাঁকে নামাজ পড়তে দেখাত, আর ক্রিসমাসের সময় তাঁকে কেক কাঁটতে দেখা যেত গির্জায়। আমার এক বন্ধু একবার বলেছিল "ওরা পেলেস্টাইন। ওরা কোরান এবং বাইবেল একসাথে পড়ে। ওদের শত্রু ইহুদি যাদেরকে সাপে কামড়ায় না "। লোকটার অদ্ভুত চেহারার চেয়ে বেশী আকর্ষণীয় ছিলো তার মাথার কাপড়টা। একা একা খেলার সময় একটা ছোট টেবিল ক্লথ মাথায় দিয়ে তাঁর মত সাজতাম। তখনও আমার পৃথিবীতে আমি জানতাম না ঐ লোকটার নাম কি? কি তার শান্তিতে নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পেছেনের এবং ইন্তিফাদার রক্ত ঝরা আরব্য রজনীর গল্প।

আমার পৃথিবীতে আমাদের পৃথিবীর আসল যুদ্ধের সাথে পরিচয়ও ঐ সাদাকালো বিটিভির পর্দায়। খবরে একটা অংশে থাকতো ‘বসনিয়ার যুদ্ধ’। কার সাথে কার যুদ্ধ, কে জিতছে কে হারছে কিছুই জানতাম না। একদিন শুধু জানলাম আমার পৃথিবী থেকে আমার পুলিশ বড় ফুপা আমাদের পৃথিবীর বসনিয়ার যুদ্ধে যাচ্ছেন, শান্তি রক্ষা মিশনে। তাকে বিদায় দিতে গিয়েছিলাম এয়ারপোর্ট,শুধুই এয়ারপোর্ট দেখার লোভে। তখনও আমার পৃথিবীতে আমি জানতাম না শান্তি রক্ষা একটা ব্যয়বহুল ব্যাপার।

একা একা চুল কাটাতে যাওয়ার মত বয়েসটা শরীরে আসার পর, আমাদের পৃথিবীতে ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের ফাইনাল খেলাতে সেবার পাকিস্তান ‘কোকাকোলা কাপ’ জিতেছিল।আমার পৃথিবীতে সেই রাতেই পাড়ায় গুরু জবাই দিয়ে তেহেরী রান্না হয়েছিল। আর শহরের বড় বাজারে ঐতিহ্যবাহী হিন্দু মিষ্টির দোকানের কাঁচটা ভাঙা হয়েছিলো আনন্দ মিছিলের উছিলায়। চুল কাটার দোকানে বসে এই গল্প শোনার সময় আমার পৃথিবীতে আমি জানতাম না কেন আমার পৃথিবীতে আমরা মানেই আমাদের পৃথিবীর পাকিস্তান আর আমার পৃথিবীতে হিন্দু মানেই আমাদের পৃথিবীর ইন্ডিয়া?

এর অনেক দিনপর আমার পৃথিবীর টিভির পর্দায় বার বার ভেসে ওঠে আমাদের পৃথিবীর একটা এরোপ্লেন আর দুইটা বড় বড় দালানের ধসে গুঁড়িয়ে যাওয়ার দৃশ্য। আমার পৃথিবীর বাজারের দোকান, রাস্তাঘাট ছেয়ে যায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সম্পন্ন বড় চোখ আর আধা কাচা-পাকা দাড়িওয়ালা একটি লোকের ছবিতে। একসময় সেই লোকের ছবি আমার ঘরেও দেয়ালে স্থান পায়। একসয়ম আমার পৃথিবীর সাদাকালো টিভিটা বদলে গিয়ে রঙিন টিভি হয় আর আমাদের পৃথিবীতেও খুব দ্রুত বদলাতে থাকে সব কিছু। সময়ের হাত ধরে আমার পৃথিবীর বইয়ের শেল্ফে এক এক করে আসে বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ, বাইবেল কুরআন ও বিজ্ঞান, মোটরসাইকেল ডায়েরি, আমাদের আমেরিকা ও তাদের, মাও সেতুং, জীবনানন্দ দাস, উইংস অব ফায়ার, হুমায়ুন আহমেদ, ক্র‍্যাচের কর্নেল, সিরাজ শিকদার, সুনীল, শীর্ষেন্দু, চারু মজুমদার, শক্তি চট্যোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার। শেষে অরুন্ধতী রায়, পামুক, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এবং ফেসবুক। ধীরে ধীরে কখন যে আমাদের পৃথিবীটা ছোট হতে হতে আমার পৃথিবীটাতে ঢুকে পরেছে টের পাইনি৷এখন দুইটার পার্থক্য করা যায় না খুব একটা।
আমার পৃথিবীতে আমার জন্মের কয়েক বছর পর আমাদের পৃথিবীতে বার্লিনের দেয়ালটা ভাঙা হয়েছিল। কেন যে ভাঙা হয়েছিল তা আজও বুঝতে পারলাম না।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ১২:০২

নাঈম জাহাঙ্গীর নয়ন বলেছেন: বেদনা আর আক্ষেপ ভরা কিছু স্মৃতিপট তৈরি করেছেন।
ভালো লাগলো

২| ৩০ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ২:১৭

ভ্রমরের ডানা বলেছেন:



দুর্দান্ত বিশ্লেষণ করেছেন। সত্যি প্রৃথিবী সংকুচিত হচ্ছে!

৩| ৩০ শে জুলাই, ২০১৮ সকাল ১০:১৩

রাজীব নুর বলেছেন: ভালো লিখেছেন।
নিজেকে যোগ্য করে গড়ে না তুলতে পারলে পৃথিবীর কিছুই ভোগ করা যায় না।

৪| ২১ শে নভেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১২:১৫

খায়রুল আহসান বলেছেন: আমার পৃথিবী আর আমাদের পৃথিবীর মিল অমিলগুলগুলো খুব সুন্দর করে দেখিয়ে দিলেন।
চমৎকার নোট! + +

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.