নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মনের আড়ালে রুঁধিয়া রাখিতে পারি নাই যে আবেগ, \nচোখের কোনের বাষ্প হয়ে উড়ে যায় সে জলমেঘ

মনের এলোমেলো ভাবনাগুলোকে শব্দের ফ্রেমে বাঁধার এক অপচেষ্টা।

জলমেঘ

মনের আড়ালে রুঁধিয়া রাখিতে পারি নাই যে আবেগ,চোখের কোনের বাষ্প হয়ে উড়ে যায় সে জলমেঘ

জলমেঘ › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমার পর্বতারোহণঃ হ্যালো মাউন্ট ফুজি

১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ দুপুর ২:৫৩


আমি ঢাকাবাসী। খোলা আকাশ দর্শন আর দূষণমুক্ত বাতাস সেবনের মতো বিলাসিতা কপালে কদাচিৎ জোটে। আমার হাঁটাহাঁটির ব্যাপ্তিও বড় নগণ্য। বাসা থেকে বের হয়ে লিফট, লিফট থেকে বের হয়ে রিক্সা, রিক্সা থেকে নেমে আবার লিফট এবং অফিস। এইভাবেই চক্রাকারে চলে আমার হাটাচলা। এই আমি গেলাম হাইকিং এ। তাও বিদেশের মাটিতে। ব্যপারটা খুব একটা জটিল হওয়ার কথা ছিলোনা। সাদামাঠা উইকেন্ড প্ল্যান। কিন্তু উপরওয়ালার মর্জি ছিলো ভিন্ন। সফলভাবে বেঁচে থাকার অনুভুতি কেমন আমি জানিনা। আমি সেই দলে পড়িনা। কিন্তু সচলভাবে বেঁচে থাকতে পারা যে সৃস্টিকর্তার এক বিশাল আশীর্বাদ এ বিষয়ে সেদিনের পর থেকে আর কোন দ্বিমত পোষন করবোনা। দিনশেষে সোস্যাল মিডিয়ায় আপলোড করা সুন্দর ছবিগুলো নয়, এই উপলব্ধিটাই আমার একমাত্র প্রাপ্তি।

এবার হাইকিং কথনে ফিরে আসি। ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যের বিবেচনায় জাপান একটি ভলকানিক দ্বীপ। একটিভ ভল্কানিক পাহাড় যেমন রয়েছে, তেমনি আছে বরফের টুপি পড়ানো জাপানিজ আল্পস। আর মাউন্ট ফুজির কথা তো বলার অপেক্ষা রাখেনা। আমাদের গন্তব্য ছিলো টোকিওর পাশেই ইয়ামানাশি প্রিফেকচারের ওৎসুকিতে। টোকিও স্টেশনকে যদি টোকিও মেগাসিটির মধ্যমনি ধরি তবে সেখান থেকে প্রায় আটানব্বই কিলোমিটার দূরে। তবে জাপানের সুবিধাজনক ট্রেন নেটওয়ার্কের বদৌলতে আটানব্বই কিলোমিটার শুনে আঁতকে উঠার কিছুই নেই। ঘন্টা দুয়েকের ব্যাপার মাত্র।

ডে হাকিং এর প্ল্যান। হাইকিং পিকের নাম ১৫৯৩ মিটার উচ্চতার সেইহাচিয়ামা। ১৩ কিলোমিটারের ট্রেইল। নর্মাল পেসে হাটলে ৬/৭ ঘন্টায় পৌছে যাওয়ার কথা। কিন্তু টুইস্ট হল, টিমে ছিলাম আমি। এখন আমাকে নব্য হাইকার বলা গেলেও তখন আমি কিছুই না। আমার এক্সপেরিয়েন্স লিফট নস্ট থাকলে সিড়ি ক্লাইম্বিং করে ৫ তলা উঠা পর্যন্তই। টিমের বাকিরা আমার ভিয়েতনামিজ ফ্রেন্ডস, এক্সপেরিয়েন্সড হাইকার আর আমি দুধভাত। যদিও ভেতরটা ধুকপুক ধুকপুক করছিলো তাও সাহস করে গেলাম। সবকিছুরই প্রথমবার থাকে। আমি যখন পুচকি ছিলাম, প্রথমবার হাঁটার প্ল্যান করছিলাম, তখনও নিশ্চয়ই আমার এমন লাগছিলো। দুর্ভাগ্যবশত ব্যাপারটা আমার মনে নাই। আমার আব্বা আম্মাও এখনকার আব্বা আম্মাদের মতো স্মার্ট ছিলোনা তাই ছবি তুলে প্রমানাদি রাখারও কোন প্রয়োজনবোধ করেন নাই। কি আর করা। ধরে নিলাম হাঁটতে যখন সফল হয়েছি হাইকিং এও কোনভাবে উতরে যাবো। সুতরাং বন্ধুরা যখন প্ল্যান ঠিক করে আমার সম্মতি চাইলো, আমি নেচে নেচে বলে দিলাম, অক্কে। আর মনে মনে বললাম, ইয়া আল্লাহ মান ইজ্জত বাঁচাইয়ো।
আমরা বাসা থেকে ওৎসুকির উদ্দেশ্যে রওনা করেছিলাম পৌনে আটটার দিকে। ট্রেনের দেড় ঘন্টার পথ মানে ঘুমিয়ে নেয়ার অনেক সময়। কিন্তু টোকিওর ব্যাস্ত শহরের ফাঁকফোকর ভেদ করে উঁকি দেয়া মাঊন্ট ফুজির মাথাটা ঘুমাতে দিচ্ছিলোনা একদমই। এর উপর রেললাইনের দুইপাশে ওয়েস্টার্ন টোকিওর পাহাড়ের সারির কথা তো বাদই দিলাম। টোকিও তে তখন মাঝ হেমন্ত। পাতাদের রঙ বদল করে ঝরে যাওয়ার সময়। প্রকৃতির এই রুপ বলে বা লিখে বোঝানো বড় মুশকিল। এ যেন কোন রঙ্গিলা চিত্রকরের বিশাল ক্যাম্পাস। একদিকে লাল ম্যপললীফ তো অন্যদিকে হলুদ গিঙ্কু ট্রি। যতই টোকিও থেকে দূরে যাচ্ছিল্লাম। রঙের ছটা যেন ততই বাড়ছিলো। গন্তব্যে যখন পৌছালাম প্রায় সাড়ে নয়টা বেজে গিয়েছে। ওয়ার্কিং ডে তেও সুনসান স্টেশন। বুঝলাম প্রকৃতিকে ঘাঁটাবার উপকরণ এখানে খুবই কম।

অতঃপর হাইকিং শুরু। স্টেশনের প্রবেশমুখেই ঐ এলাকার হাইকিং ট্রেইলের এক বিশাল ম্যাপ বসানো। যদিও জাপানিজ তবে গ্রাফিক্যাল লেভেলিং এর কারনে মর্মোদ্ধার করাটা অতোটা দুঃসাধ্য নয়। পিকের উচ্চতা থেকে শুরু করে সেখানে যাওয়ার রাস্তা ও সম্ভাব্য সময় সবই দেয়া আছে। সবকিছু প্ল্যানমাফিক চললে, দিনের আলো থাকতে থাকতেই হাইকিং শেষ করে আসা সম্ভব। পাহাড়সারির ভেতরে অনেকদূর পর্যন্ত আমরা প্রশস্ত পাকা রাস্তা দিয়েই আসলাম। বুঝলাম ইহা জাপান। আমাদের হাইওয়ের রাস্তা ভাঙ্গাচোড়া থাকতে পারে তবে এদের জঙ্গলের রাস্তা নয়। টোকিওর কাছাকাছি এমন অনেক হাইকিং ট্রেইলও আছে যেখানে পাকা রাস্তায় হেঁটে এবং সিড়ি বেয়ে পিকে পৌঁছানো সম্ভব। এরপরেও যদি কষ্ট লাগে, নো প্রবলেম। আছে কেবল কার ও চেয়ার লিফট। সুতরাং জাপানে হিল পড়ে বেবি স্ট্রলার নিয়ে হাইকিং করা মোটেও কোন রুপকথা নয়। দুর্ভাগ্যবশতঃ আমাদের ট্রেইলে এমন কিছুই ছিলোনা।



প্রায় ৪০ মিনিট সভ্য রাস্তায় হাঁটার পর শুরু হলো আসল হাইকিং। রাস্তা এখন অনেক স্টিপার। হেমন্তের বিদায়লগ্ন এখানে শুরু হয়ে গিয়েছে। রাস্তার উপর ঝরা পাতার স্তুপ, আর দুইপাশে ন্যাড়া গাছ। কিছুদুর পর পর পাহাড়ি ঝর্নার স্রোত। হেমন্তের আলোতে ঝিলমিলিয়ে উঠা সেই বহতা স্রোতধারা যেন পাথরের ফাকফোকড় দিয়ে শতকোটি হীরকচুর্ণ সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে। এই দৃশ্য পার্কে বসে আরাম করে দেখতে পারলে হয়তো দুই লাইন কবিতা লিখে ফেলা যেতো। কিন্তু শরীর তখন এমন ঠান্ডার মধ্যেও গলদঘর্ম। লক্ষ্য একটাই যে করেই হোক, দুপুর একটার মধ্যেই চুড়ায় পৌছাতে হবে। রাতের শিশির পড়ে রাস্তা কিছুটা পিচ্ছিল। পাতা ডাল পালা মাড়িয়ে উপরে উঠছি। পাথরের উপর লাফিয়ে পাহাড়ি ঝর্না পার হচ্ছি। এই করতে করতে চলে গেলো আরো একঘন্টা। এখন নতুন চ্যলেঞ্জ। পাহাড়ের মধ্যেই খাড়া ঢালের মতো কিছু জায়গায় শাকসবজি চাষ করা হচ্ছে। বন্য হরিণ যেন খেয়ে সাবাড় করতে না পারে সে জন্য পুরো এলাকায় নেটের বেড়া দেয়া। বেড়ার গায়েই ডিরেকশন দেয়া ছিলো কিভাবে খুলে ভেতরে ঢুকতে হবে। আমরা তাই করলাম। ঢোকার পরে আবার লাগিয়ে দিলাম। রাস্তা এখন আরো খাঁড়া। নিচে পিচ্ছিল কাদামাটি। দুইহাতে ডালপালা সরিয়ে সামনে আগাতে হচ্ছে। নিজেকে এডভেঞ্চার মুভির নায়িকা মনে হচ্ছিলো কিন্তু আফসোস কোন ক্যামেরা নাই। রাস্তা যেহেতু খুবই সরু একজন একজন করে উপড়ে উঠছি। ক্ষেত খামার যখন পার হলাম তখন আমরা প্রায় ১০০০ মিটার উচ্চতায়। আশে পাশের অনেক পাহাড়ের চুড়া নিচে পড়ে গিয়েছে। ছবি তোলার একটু ফুসরত পেয়ে অইরকম অর্ধমৃত অবস্থাতেও ছবি তুলতে ভুল্লাম না।


রাস্তা এইবার কিছুটা বাগে এলো। যদিও স্টিপ, তাও হাচড়ে পাচড়ে, ডালপালার বাড়ি খেয়ে ঘন্টা দেড়েক কসরত করে, কোনরকমে জান হাতে নিয়ে উঠে গেলাম চুড়ায়। আমরা এখন সেইহাচিয়ামার চুড়ায়। আসার পথের প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টার পরিশ্রমের মুহুর্তে মুহুর্তে মনে হয়েছে, কি দরকার ছিলো, কেন বাসায় শুয়ে ঘুমালাম না, কোন ভুতের আছড়ে আজ আমি পাহাড়ে। কিন্তু চুড়ায় উঠার পর আমি মত পাল্টালাম।

আমাদের ছোটবেলার একটা প্রচলিত ধাঁধা ছিলো। স্কুলের খাতায় একটা রেখা টেনে বলতাম এটাকে কোন কাটাছেড়া করা ছাড়াই ছোট করতে হবে। সেটা কিভাবে করা যায়। সমাধান হলো, ঐ রেখার পাশে আরেকটা লম্বা রেখা আঁকতে হবে। পাশেই আরেকটা বড় রেখা থাকলে তো আপনা আপনিই আগের রেখাটা ছোট হয়ে গেলো। ব্যাপারটা ছেলেভুলানো সোজা সাপটা ধাঁধা হতে পারে কিন্তু এর অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু এতো সহজ নয়।


সম্ভবত সে কারনেই ১৫৯৩ মিটার উচ্চতায় দাড়িয়েও প্রকৃতির বিশালত্বের কাছে নিজেকে অনেক নগণ্য মনে হচ্ছিলো। সামনে মাউন্ট ফুজি আর তার বরফের টুপি। যদিও এত কাছে থেকে দেখে সেটাকে আর টুপি মনে হচ্ছেনা। বরং মনে হচ্ছে সাদা মুকুট পড়া রাশভারী কোন রাজা। মেঘের সৈন্যদল ভীষন ভয়ে ভয়ে যাকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। চারপাশের আদিগন্ত অব্দি তার রাজ্য। হেমন্তের শেষবেলার ছোঁয়ালাগা বাদামী পাহাড়গুলো রাজার অনুগত প্রজা। এমনি এক প্রজার মাথায় চেপে আমি হা করে রাজার রাজ্য শাসন দেখছিলাম। এ এমন এক দৃশ্য যা বার বার দেখেও ক্লান্তি আসেনা। এমনকি ক্লান্ত শরীরও চাঙ্গা হয়ে যায়। সুতরাং সেইহাচিয়ামার চুড়ায় বসে লাঞ্চ শেষ করে যখন হোঞ্জাগামারুর (১৬৩০ মিটার) উদ্দেশ্যে রওনা করলাম তখন বেশ চাঙ্গাবোধ করছিলাম। আরো ৪০ মিনিটের পথ। তবে এবার আর ট্র্যাকিং ট্রেইল নেই। বড় বড় পাথর বেয়ে উপড়ে উঠতে হচ্ছে। এক জায়গায় পাথরের আকৃতি বেশ বড় হওয়ায় দেখলাম ছোট একটা মই বসিয়ে রাখা হয়ছে। জাপানিজ ট্রেইল বলে কথা। এই ৪০ মিনিটের রাস্তায় প্রায় পুরোটা সময় ধরেই মাউন্ট ফুজির ভিউ ছিলো। ১৬৩০ মিটার উচ্চতার হোঞ্জাগামারুর চুড়ায় উঠার পর তো কথাই নেই। পুরো সাসাগোমাচি এলাকার ৩৬০ ডিগ্রী ভিউ আর সাথে মাউন্ট ফুজি তো আছেই।



এবার ফেরার পালা শুরু। আবারো সেই পাথরের চাই বেয়ে বেয়ে কিছুটা নামার পরে মাটির ট্রেইলের দেখা মিললো। মাউন্ট ফুজিকে বাই বলে নামা শুরু করলাম। গতি কিছুটা বাড়লো কিন্তু যন্ত্রণা হল সেটার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। তার উপর দিন এখন ছোট। দ্রুত নামার তাড়া, রাস্তাও ভীষন খাঁড়া আর আমার অনভ্যস্ত আনাড়ি পা। সব মিলিয়ে বিশাল গ্যড়াকলে পড়লাম। কিন্তু থামার উপায় নেই। দলের সবাই এগিয়ে যাচ্ছে। নামার রাস্তায় আরেকটা ছোটখাটো পাহাড়ের চুড়া। আমরা সেটাতেও উঠলাম। পা তখন একটুকরো সমতলের জন্য হাহাকার করছে। কিন্তু ক্লাইমেক্স শুরু হলো এবার।

আমরা ট্রেইলমার্কের ডিরেকশন দেখে স্টেশনের উদ্দেশ্যে আগাচ্ছিলাম। ১৩৭৭ মিটার পর্যন্ত নামার পর দেখলাম ডিরেকশনের সাইনটা আধভাঙ্গা। আমরা সেটা ধরেই আগালাম এমনকি নামার আগে সেটাকে ঠিক করে দিয়ে আসতে ভুললাম না। কিন্তু কিছুদুর আগানোর পর আর ট্রেইল খুজে পেলাম না। অগ্যতা খাঁড়া পাহাড়ের ঢাল ধরেই নামতে থাকলাম। এখনকার মাটি বেশ আলগা। পাতার স্তূপের নিচে কোথায় যে পা রাখার মতো শক্ত মাটি আর কোথায় আলগা পাথর বোঝার উপায় নেই। ডালপালাগুলোকেও আর বিশ্বাস করা যাচ্ছেনা।
বডি ব্যলেন্স করার জন্য সেগুলো ধরতে গেলে ভেঙ্গে যাচ্ছে। পায়ের আঙ্গুলে প্রচন্ড প্রেসার পড়ায় ব্যাথা শুরু হয়ে গিয়েছে। গোড়ালি ছাড়িয়ে ব্যাথা এখন হাঁটুতে। তারপরেও থামলাম না। পড়লাম, উঠলাম, আছাড় খেলাম, ডাল পালার বাড়ি খেলাম। একসময় এমন অবস্থা হল যে পায়ে কোন অনুভূতি আর কাজ করছেনা। পড়ে গেলেও আর পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারছিনা। গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে নামতে হচ্ছে। দিনের আলো কমে এসেছে। শরীর প্রচন্ড ক্লান্ত। যখন মনে হচ্ছিলো আর হয়তো সম্ভব না তখনই ভাগ্য মহাশয় সহায় হলেন। সমতল রাস্তা দেখতে পেলাম। হুড়াহুড়ি করে নেমে রাস্তার পাশে প্রায় সাতফুট উঁচু দেয়ালের উপর দাঁড়িয়ে বুঝলাম লাফ দেয়া ছাড়া সমতলে নামার উপায় নাই। বন্ধুরা বলল তুমি লাফ দাও আমরা তোমাকে ধরবো। মনে মনে বললাম, আল্লাহ বাঁচাও। মান ইজ্জতের ব্যাপারটা আর উল্লেখ করলাম না।

অতঃপর কারো ধরাধরি ছাড়াই মাটিতে পা রাখলাম। কিন্তু পা আর অক্ষত রাখা গেলোনা। গোড়ালিতে প্রচন্ড ব্যাথা পেলাম। কিন্তু তারপরেও খুশি, একটুকরো সমতলে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হলেও হাটতে পারছি। দলনেতা বলল, এই রাস্তায় আর দেড় কিলোমিটার হাটলেই স্টেশন। কিছুদুর হাঁটার পর আবিস্কার করলাম এতো ঝক্কির আসল কারন। আমরা আসলে ভুল পথে নেমেছি। সামনেই ওয়েলমার্কড এবং সভ্য ভব্য ট্রেইল। বিশেষ করে দেয়ালের সাথে গাঁথা রডগুলো দেখে পায়ের ব্যাথাটা যেন আরো বেড়ে গেলো। এতক্ষণে আমরা বুঝলাম আধাভাঙ্গা ডিরেকশনের রহস্য। রাস্তা খারাপ দেখে ইচ্ছে করেই সেটা ভেঙ্গে রাখা হয়েছিলো। সেই ভাঙ্গা ডিরেকশন ঠিক করার জন্য নিজেদেরকে এতক্ষণ হিরো হিরো মনে হলেও অচিরেই আমরা নিজেদের কাছেই ভিলেনে পরিনত হলাম। যাই হোক, নতুন কোন এডভেঞ্চার ছাড়াই বাসায় পৌছানো যাবে এই খুশিতে আমরা বাদাম খেতে খেতে ফরেস্ট রোডে হাটছিলাম। সুর্য তখন প্রায় ডুবো ডুবো। এমন সময় হঠাৎ এক লোক গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো কোথায় যাবো? অবশ্যই জাপানীতে তবে আমাদের টিমে জাপানিজ জানা বন্ধু থাকায় যোগাযোগ চালাতে অসুবিধা হলনা। আমরা কনফিডেন্টলি উত্তর দিলাম সাসাগো স্টেশন। সে এবার খুবই উৎকন্ঠিত হয়ে উত্তর করলো, এই রাস্তা তো সাসাগো স্টেশন যাবেনা। তোমাদের এই ট্রেইল ধরে নিচে নেমে স্টেশনে যেতে হবে। এই বলে সে আমাদের ট্রেইলমার্কের সামনে এনে দাড় করিয়ে দিলো। আমার তো মাথায় হাত। পায়ের এই অবস্থা নিয়ে কিভাবে কি। যদিও ইচ্ছে করছিলোনা তারপরও পথপ্রদর্শনকারিকে ধন্যবাদ দিয়ে আবারো সংগ্রাম শুরু করলাম। এবারের রাস্তা আরো স্টিপার। এবং মরার উপর খাঁড়ার ঘা, চারপাশ দ্রুত অন্ধকার হয়ে আসছে। আমি জানি আমাকে দ্রুত নামতে হবে, আমার জন্য আমার টিমমেটরা পিছিয়ে পড়ছে কিন্তু পারছিনা। আমি যতই চেস্টা করছি গতি যেন ততই কমছে। এইরকম অসহায়ত্ব জীবনে আর কখনো অনুভব করেছি কিনা মনে করতে পারিনা। চারপাশ এখন পুরোপুরি অন্ধকার। আমরা রাস্তা হারিয়ে ফেললাম। পাহাড়ী ঝর্নার পানির শব্দ শুনে বুঝতে পারছি কাছাকাছি চলে এসেছি কিন্তু কোনদিকে যাবো বুঝতে পারছিনা। আমার মোবাইলের চার্জ শেষ। অন্যদের মোবাইলের আলোয় এক পা এক পা করে আগাচ্ছি। আমি কিভাবে কিসের বলে আগাচ্ছি নিজেই বুঝতে পারছিনা। পায়ের উপর কোন কন্ট্রোল নাই। পা উপড়ে তুলতে পারছিনা। পায়ের উপর ভর দিয়ে নিচুও হতে পারছিনা। কিছুদুর পর পরই বেসামাল হয়ে পড়ে যাচ্ছি। কিন্তু থামছিনা। কোন একভাবে আমার পুরোশরীর প্রোগ্রামড হয়ে গিয়েছে যে আমাকে এখন আগাতে হবে। শুরু হলো অনুমানের উপর রাস্তা চলা। ম্যাপ আর মোবাইলের ডিরেকশন দেখে অন্ধকারেই আগাতে থাকলাম। সকালে যে ঝর্নার স্রোত দেখে কবিতা লিখতে ইচ্ছে করছিলো রাতের বেলায় সেটাকে মনে হলো বিভীষিকা। আমি এরকম অকেজো পা নিয়ে কিভাবে পিচ্ছিল পাথরে আছাড় খাওয়া ছাড়াই ফেরত আসলাম সে এক রহস্য। একসময় চোখে পরলো একটা ড্যাম। ড্যামের পরেই স্টেশনে যাওয়ার রাস্তা থাকার কথা। পেলাম না। আবার সামনে আগালাম। মাথার উপর অর্ধেক চাঁদের আলো। সেটা কোন কাজে তো আসছেইনা বরং আরো ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি করছে। কিন্তু কি অদ্ভুত ভয়ের অনুভুতিও কাজ করছেনা। ভেতরে ভেতরে একটা চাপা কান্না। নিজের ভাষায় কাছের কাউকে বলতে ইচ্ছে করছে যে আমার কত কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু পারছিনা। যে খালি বাসাটায় আমার ফেরত যেতে ইচ্ছে করতোনা, আজ সেখানে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ দলনেতার চিৎকার, ‘উই ফাইন্ড দ্যা ডিরেকশন। উই ক্যান গো হোম’। আমি কেঁদে দিলাম। অন্ধকার থাকায় কেউ দেখেনি। আল্লাহ দয়াময়। আমার জানের সাথে সাথে মান সন্মান কিছুটা হলেও বাচিয়ে দিয়েছে।

শেষবারের মতো পাহাড়ি পানি-প্রবাহ পার হয়ে আমরা সমতল রাস্তায় পা রাখলাম। সাসাগো স্টেশন এখান থেকে দেড় কিলোমিটারের পথ। আমরা হাঁটছি, আমাদের পেছন পেছন চাঁদের আলো হাঁটছে। সেই আবছা চাঁদের আলোয় চোখে পড়ল একটা সাইন। তাও আবার ডেঞ্জার সাইন। ঘটনা কি? কাছে গিয়ে বোঝা গেলো এই এলাকায় মাঝে মধ্যে বন্য ভাল্লুক দেখা যায়। অতঃপর সাবধান। মানে এই এক দেড় ঘন্টা আমরা বন্য ভাল্লুকের সাথে দেখা হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা মাথায় নিয়ে অন্ধকার জঙ্গলে রাস্তা খুঁজছিলাম। ষোলকলাপুর্ণ তবে এটাকেই বলে।

লোকালয়ে যখন ফিরলাম, হাত পা কাদা আর বালুতে মাখামাখি। আমরা পাহাড় ছেড়ে বের হয়েছি বটে কিন্তু পাহাড়ি মাটি আমাদের ছাড়েনি। রুমে যখন ফিরলাম হাত পা নাড়ানোর শক্তি আর নেই। আমার পায়ের নিচে টাইলস বসানো মেঝে, সামনে নরম বিছানা। যেখানে তিনঘণ্টা আগেও জানা ছিলোনা আজকের রাতটা কাটানোর জন্য একটুকরো সমতল মাটি জুটবে কিনা। আমাদের জীবন কতইনা ঠুনকো, অনিশ্চয়তায় ঠাসা। অথচ এই অনিশ্চিত জীবন নিয়েই আমরা বড় ব্যাস্ত। আমাদের সময় নেই। ভুল কথা। সময় কখনো ফুড়িয়ে যায়না। আমরাই ফুড়িয়ে যাই। রাতে ঘুমানোর আগে, নিজেই নিজেকে বাহবা দিলাম, "আই ডিড আ গুড জব টুডে”। তারপর লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিলাম। পৃথিবীতে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারার মতো প্রশান্তি আর কোন কিছুতে নেই।

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:০৭

আর্কিওপটেরিক্স বলেছেন: বিশাল লেখা....
তবে ভালো লেগেছে :)

শেষ থেকে ৩নং প্যারাটা ছোট ছোট অংশে ভাগ করলে ভালো হতো...

১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৫:০০

জলমেঘ বলেছেন: হুম লেখার পর আমিও চিন্তা করলাম, আসলেও বিশাল হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমি কোন ডিটেইলস বাদ দিতে চাইনি। আমি সবকিছু মনে রাখতে চাই। পুরো লেখাটা পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

২| ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:৫৪

রাজীব নুর বলেছেন: দারুন অভিজ্ঞতা হলো আপনার।

১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৫:০১

জলমেঘ বলেছেন: সে আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। মনে হয়না কখনো ভুলতে পারবো।

৩| ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৫:০১

নয়া পাঠক বলেছেন: কী যে ভালো লাগে পাহাড়ে চড়তে! যদিও এখন পর্যন্ত অভিজ্ঞতা শুধু সিলেটের টিলাগুলোতে ভ্রমণ করার। তবুই ভীষণ ইচ্ছে জাগে মনে বড় বড় বিখ্যাত পাহাড়-পর্বত ট্রেকিং করি। কিন্তু সাধ থাকলে সাধ্য যে নেই। তাই আপনাদের অভিজ্ঞতাগুলিই নিজের মনে করে আপাতত দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাই। চমৎকার বর্ণনার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আরো অভিনন্দন বিনা খরচে এই সুন্দর অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সহায়তা করার জন্য। কিন্তু আপনার পিক থাকলে আরো আকর্ষণীয় লাগতো। ছবিগুলি চমৎকার হয়েছে।

১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৫:০৮

জলমেঘ বলেছেন: পুরো লেখা পড়ে আসার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আমি নিজেও দেশের কোন পাহাড়ে হাইকিং কিংবা ট্র্যাকিং এ যাইনি। এই রকম শ্বাসরুদ্ধকর হাইকিং এ গিয়ে চেহারা ভালো রেখে ছবি তোলা তাও আবার গনমাধ্যমে প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আপনার পরবর্তী পাহাড় ভ্রমণের জন্য শুভকামনা রইলো।

৪| ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৫:২৪

গরল বলেছেন: আপনার পোষ্ট দেখে নষ্টালজিক হয়ে গেলাম, দশ বছর আগে টোকিওর যে বাসায় থাকতাম (তোশিমা গো চৌমে দানচি, ঔজি ষ্টেশন থেকে ৫ মিনিট বাসে) তার বারান্দা দিয়ে শীতকালে ফুজি সান এর চুড়া স্পষ্ট দেখা যেত। সকালের রোদ চুড়ায় পড়লে সেই সৌন্দর্য অবর্ণনীয়।

১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৫:৩৫

জলমেঘ বলেছেন: আমার বাসার বারান্দা থেকেও দেখা যায়। যতবার দেখি ততবারই অবাক হই। এই একই দৃশ্য এতবার দেখেও কেন বোর হইনা। এত্ত সুন্দর কেন!! জাপান ছেড়ে যাওয়ার পর সবার আগে যেটা মিস করবো সেটা হচ্ছে ফুজিসান। তারপর অন্যকিছু।

৫| ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:১২

অপু দ্যা গ্রেট বলেছেন:




দারুন । আমারও হাইকিং এর শখ আছে । তবে তেমন সুযোগ হচ্ছে । তবে সামনেই এক জায়গায় ঘুরতে যাচ্ছি । একা ।

১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৪:২৮

জলমেঘ বলেছেন: শুভকামনা রইলো। :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.