![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১৯৯৪ সালের কথা , ছাত্রদের মারামারির কারনে অনির্দিষ্ট কাল
কলেজ বন্ধ। আমি সবেই মাত্র সপ্তাখানেক ছুটি কাটিয়ে ক্যাম্পাসে
এসেছি। অনেক কার্ড আইটেম পেন্ডিং ক্লিয়ার করার মনোভাব নিয়ে
এসেছিলাম। মন ও মেজাজ দুটোই খারাপ হল। প্রায় ফাঁকা ক্যাম্পাসে রয়ে গেলাম। হস্টেলে থাকা নিষিদ্ধ হলেও পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি দুএকদিন পরেই থাকা যায়, দারওয়ান বাবুদের ম্যানেজ করে।হঠাৎ শহরে ফরেনসিক মেডিসিনের লেকচারার হাবিবুর রহমান স্যারের সাথে দেখা। আমাকে রাস্তায় হাটতে দেখে রিক্সা থেকে একপ্রকার ঝাঁপিয়ে পড়লেন আমার উপর। আর মাত্র একটা ছেলে দরকার , তুই আছিস আগে বলবিনা- বলে আমাকে রিক্সায় উঠিয়ে নিলেন। একটি এন জি ও ,র সার্ভের কাজে ২৪ জন মেডিক্যাল স্টুডেন্ট দরকার বরিশাল বিভাগের ৬ টি জেলায় একমাস ব্যাপী এই সার্ভে চলবে। প্রতি জেলায় ৪ জনের একটি দল একজন করে স্যারের আন্ডারে। বললাম কলেজ খুলে গেলে কি করব, স্যার জানালেন একমাসের আগে কলেজ খুলছেনা , খুললেও সেটা আমি দেখব। অবশ্য পরদিন স্যার প্রিন্সিপ্যাল সারের অনুমতিপত্র সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। আমাদের কাজ হল ছাপানো কাগজে নির্দিষ্ট করে দেয়া বাড়ি গুলো ঘুরে ঘুরে পরিবার গুলোর স্বাস্থ্য , পরিবার পরিকল্পনা, হাইজিন সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা।এলাকাগুলো একেবারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত।
আমার পড়ল বরগুনা জেলার আমতলী থানার সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায়।তবে পারিশ্রমিক ভাল, কিন্তু সময়টা ছিল মে,র দিকে। এমন রিমোট এলাকায় এক মাস কাটাতে জান কয়লা হয়ে গিয়েছিল। তবে এই জান কয়লা করা টাকায় নেপাল এবং ভারতে ১৫ দিনের ট্যুর করতে পেরেছিলাম। বিদ্যুৎ নেই , থাকার বানিজ্যিক কোন ব্যবস্থা নেই, এমন পরিবেশে অপরিচিত লোকের মাঝে কাজ করা একজন সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্টের পক্ষে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। তবে এখন এসে উপলব্ধি করি এই সার্ভেটি জীবন সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গী পালটে দিয়েছিল। একটি অন্তর্মুখী স্বভাবের লাজুক ছেলেকে বিরূপ পরিবেশে বাস্তবতার মুখোমুখি দাড় করিয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার উপযোগী করে তুলতে যে মাত্রায় অভিযোজিত করেছিল, তা দেখে আমি নিজেই অবাক হই। এক সম্পূর্ণ অজানা অচেনা এক মানুষ হিসেবে নিজেকে আবিস্কার করি। গ্রামের নাম নিশানবাড়িয়া, সাগর পাড়ের গ্রাম। বেড়িবাঁধের একপাশে ছোট
ছোট কুড়েঘরে বাস করা হতদরিদ্র্য ছিন্নমুল মানুষের এলাকা, অধিকাংশই নদী ভাঙা তাড়িত মানুষ। পেশা মাছ ধরা আর সুন্দর বনের এক্সটেনশন অর্থাৎ ফাতরার জঙ্গল থেকে গোলপাতা, শামুক, জ্বালানী সংগ্রহ করা।এমনও হয়েছে যে একটি বিড়ির দোকান খুজতে আমাকে ৫ মাইলেরও বেশী হাটতে হয়েছিল।
ট্যুরের শেষ সপ্তাহটি আমাকে এখানেই কাটাতেহয়। একদিন বাঁধের উপর দিয়ে মে,র গরমের মধ্য দুপুরে হাটতে হাটতে
তেষ্টায় বুকের ছাতি যেন ফেটে যাছিল। বোতলে সংগৃহীত পানি শেষ প্রায় ১৫ মিনিটের হাঁটাপথ পেরিয়ে এক কুড়ে ঘরের সামনে এসে মাটিতে বসে পড়লাম। অনুচ্চ স্বরে বললাম - বাড়িতে কে আছেন, আমাকে পানি দেন। এক থুত্থুরে বৃদ্ধা মহিলা জবাবে জানালেন - বাবা বসেন দিতেছি। কলসীতে রাখা ঠাণ্ডা পানির স্বপ্নে আমি তখন বাস্তবের তীর্থের কাক হয়ে আছি। আমার শরীরের প্রতিটি কোষ তখন তৃষ্ণার্ত। দিতেছি বলে বুড়ীর কোন খবর নাই, আমি অধৈর্য হয়ে আছি। এটা সেটা নাড়াচাড়ার খুটখাট শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। যেখানে আমার এক সেকেন্ডের তর সয়না সেখানে পাক্কা ৫ মিনিট পরে ভেতর থেকে বের হয়ে আসলেন । তিন হাত
দৈর্ঘের ঘোমটা এক হাতে ধরে অন্য হাতে বহুযত্ন করে বানানো একখিলি পান। হায়রে কপাল, কানে খাটো বুড়ি শুনল পান। অধৈর্য না হয়ে বিরক্তি প্রকাশ না করে বললাম- নানী আমি পান চাই নাই পানি চাইছি। সাথে হাত দিয়ে পানি খাবার মূকাভিনয় আর পানি শব্দটির উপর অতিরিক্ত জোর থাকল, সঙ্গে পিপাসার্ত চেহারাটাতে আরও আরও পিপাসা ফুটিয়ে তোলাতো আছেই- কোন ভাবেই দ্বিতীয় বার পানিভিন্ন অন্য কিছুর মুখোমুখি হওয়াটা এড়াতে চাইছিলাম। তৃষ্ণার মানে এমন করে আর কোনদিন বোঝার প্রয়োজন হবে কিনা আমি জানিনা। মনে হল বুড়ী এবার ঠিকঠিক বুঝতে পেরেছে , ভেতরে পানি আনতে যাওয়ার আগে স্পষ্ট
গলায় জানালেন- বাবা অতিথিরে খালি জল দিতে নাই, অমঙ্গল হয়, তোমারে খাইতে দিব এমন কিছু নাই ঘরে। একমুঠ চাইল ও নাই যে দিব। সেজন্যে পানটা দিলাম , আগে এইটা খান আমি কলসির জল আনতেছি। আমি নির্বোধ অথবা বোধহীন হয়ে গেলাম। সবকিছু নিমেষে বদলে গেল। চারপাশটাতে এত শব্দ, এতো আলো, ভেতরটায় এত তৃষ্ণা সব নেই হয়ে এক বিবশ শূন্যতার মধ্যে পান দানিতে রাখা পরিপাটি করে সাজানো পিরামিডাকৃতির সবুজ খিলিটা ছাড়া আমি আর কোন কিছুই
অনুভব করতে পারছিলামনা। সম্মোহিত মানুষের মত সেটি মুখে পুরে চাবাতে লাগলাম। শিরিষ কাগজে মোড়ানো গলার ভেতরটাও মুখের পানটুকুকে অসম্মান করলনা। কাঁচা সুপারি দেয়া ছিল তাই অল্প সময়েই শেষ হল সবুজ পান পর্ব। আমার বিহবলতা কাটলো বুড়ী কলসির ছোঁয়ায়। অর্ধেকের মত ভরা ছোট আকারের কলসিটা একহাতে ধরে অন্য হাতে এলুমিনিয়ামের হাতল ছাড়া মগ ধরে বুড়ী আমার পাশে দাঁড়ানো। আমি ছো মেরে কলসিটা কেড়ে নিলাম। ঢক ঢক শব্দ করে পানি পড়ছে আর আমি অদ্ভুত ভঙ্গিমায় ,জলের ধারাটি ঠিক মুখের মধ্যি খানটায় যেন থাকে কলসিটি ধরে রাখলাম। এই সময় এবং অনুভূতি যেন অনন্তকাল চলছিল।
কলস শূন্য করে শুধু একবার তার দিকে তাকালাম। দন্তহীন ফর্সা মুখটিতে ততোধিক মায়াময় হাসি দিয়ে তিনি ভেতরে চলে গেলেন, ফিরে এলেন আরেকটি কলসি হাতে। সেখান থেকে একটু মুখে দিয়ে বুঝলাম আসলে পেটে আর জায়গা নেই।
তার পরিতৃপ্ত চেহারাটা আমি যে কোন সময়
মনে করতে পারি, আবার কখনও কখনও এমনিতেই চোখে ভাসে তার মায়াময় মুখখানি। তার পরে কি কি করেছিলাম, বা বলেছিলাম আমার স্পষ্ট করে মনে নেই।প্রয়োজনও নেই। সেই নিশানবাড়িয়া গ্রামটি কত বড়, নিশ্চয়ইঅনেক বড়, নিশ্চয়ই অনেক লোকের বসবাস, এই মহাবিশ্বে খুদ্র হলেও
একটা স্থান দখল করে রাখা জায়গাটি নিয়ে বা এখানে মে,র তপ্ত দুপুরে গায়ের ঘাম শুকিয়ে গায়ে লবণ হয়ে লেগে থাকা নিয়ে, বা জোয়ারে জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙ্গে এখানেই যে নিশানবাড়িয়া নামের গ্রামটির প্রতিবছর তলিয়ে যাওয়া নিয়ে, কিংবা এই সার্ভের ফলাফলের ভিত্তিতে অচিন্ত্যনীয় উন্নয়ন নিয়ে আমার কোন আগ্রহ নেই, হবেওনা। নিশানবাড়িয়াআমার কাছে ১০ মিনিটের একটি পরাবাস্তব ডকুমেন্টারি।নিশানবাড়িয়া একটি রূপকথা, দন্তহীন ফর্সা মুখের ততোধিক মায়াময় হাসি দেয়া বৃদ্ধাটি রূপকথার একটি চরিত্র। যেটি খুব সাদামাটা হলেও মৃত্যুহীন কিংবা বিবশকর
ইথার।
২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১:৪১
Adil বলেছেন: ধন্যবাদ , আদরসারাদিন, কিন্তু সারারাত কি?
২| ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১:৪৭
দি সুফি বলেছেন: লেখা ভালো হয়েছে।
©somewhere in net ltd.
১|
২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সকাল ১০:১৫
আদরসারািদন বলেছেন: সুন্দর হৈছে