![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মক্কা বিজয়ের ঘটনা (১ম খন্ড)
(আল্লাহতা'লা প্রতিনিয়ত এই নগরীর সম্মানকে বৃদ্ধি করুন)
হযরত ইবনে আব্বাস(রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু রুহম কুলসুম ইবনে হুসাইন গিফারী(রাঃ)কে মদীনার আমীর নিযুক্ত করে ১০ই রমজান মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন, তিনি নিজে এবং তাঁর সন্গে লোকেরাও রোযা রেখেছিলেন। উসফান ও আমাজ্জ এর মধ্যবর্তী কাদীদ নামক ঝর্ণার কাছে পৌঁছুনোর পর রোযা পরিত্যাগ করেন। সেখান থেকে দশ হাজার সৈন্যসহ রওয়ানা হয়ে মাররায যাহরান নামক স্থানে অবতরণ করেন। মুযাইনা ও সুলাইম গোত্রদ্বয়ের এক হাজার লোক এবং মুহাযিরীন ও আনসার সকলেই তাঁর সন্গে ছিলেন। প্রতিটি গোত্রই অস্ত্রশস্ত্রসজ্জিত ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোরাঈশদের অজান্তে মাররায যাহরান পর্যন্ত এসে পৌঁছুলেন তখনো পর্যন্ত তারা কোন সংবাদ পায় নি। এমনকি তারা এটাও জানতে পারেনি যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন।
আবু সুফিয়ান ইবনে হারব, হাকীম ইবনে হিযাম ও বুদাইল ইবনে ওয়ারকা সে রাতে খবর সংগ্রহ ও পরিস্থিতি আঁচ করার জন্য বেরুলো। ওদিকে আবু সুফিয়ান ইবনে হারেস ইবনে আবদুল মুত্তালিব ও আবদুল্লাহ ইবনে উমাইয়া ইবনে মুগীরাহ এই দু'জনও মক্কা-মদীনার মধ্যবর্তী এক জায়গায় এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে দেখা করার সুযোগ খুঁজতে লাগল। হযরত উম্মে সালামা(রাঃ) তাদের দু'জনের ব্যাপারে সুপারিশ করতে গিয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! একজন আপনার চাচাত ভাই, অপরজন ফুফাত ভাই ও শ্বশুর পক্ষের আত্মীয় অতএব তাদের সাক্ষাতের অনুমতি দিন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাদের সাথে সাক্ষাতের আমার কোন প্রয়োজন নাই। কারণ আমার চাচাত ভাই সে তো মক্কায় আমাকে যথেষ্ট অপমান করেছে। আর আমার ফুফাত ভাই ও আমার শ্বশুর পক্ষের আত্মীয় সেও আমাকে মক্কায় যা ইচ্ছা বলেছে। তারা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই প্রতিউত্তর জানতে পারল তখন আবু সফিয়ানের সাথে একটা ছোট্ট ছেলে ছিল, সুফিয়ান বললেন, খোদার কসম, হয় আমাকে সাক্ষাতের অনুমতি প্রদান করবেন, আর না হয় আমি আমার এই ছেলের হাত ধরে খোলা ময়দানের দিকে চলে যাব এবং ক্ষুধা-তৃষ্ণায় স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করব।
একথা শুনে তাদের প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মন নরম হল। তিনি তাদের সাক্ষাতের অনুমতি দিলেন। তারা সামনে উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাররায যাহরানে অবতরণের পর হযরত আব্বাস(রাঃ) বললেন, হায় কোরাঈশের ধ্বংস! খোদার কসম যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জোরপূর্বক মক্কায় প্রবেশ করেন এবং কোরাঈশগণ তার আগেই নিজেদের জন্য নিরাপত্তা চেয়ে না নেয় তবে কোরাঈশ চিরদিনের জন্য ধ্বংস হয়ে যাবে। হযরত আব্বাস(রাঃ) বলেন, এরপর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাদা খচ্চরের পিঠে চড়ে চললাম। আরাক নামক জায়গায় পৌঁছে ভাবলাম হয়ত কোন লাকড়ি সংগ্রহকারী অথবা দুধওয়ালা অথবা কোন দরকারে মক্কার পথে চলেছে এরকম কোন লোকের দেখা পেলে তাকে বলব, সে মক্কা পৌঁছেই মক্কাবাসীকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমণ সংবাদ দিয়ে দেবে যাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কা প্রবেশের পূর্বেই তারা নিজেদের জন্য নিরাপত্তা চেয়ে নেয়।
হযরত আব্বাস(রাঃ) বলেন, খোদার কসম আমি এই খেয়ালে চলছিলাম এবং লোক পাই কিনা খুঁজছিলাম এমন সময় আবু সুফিয়ান এবং বুদাইল ইবনে ওয়ারকার কথাবার্তার আওয়াজ শুনতে পেলাম। আবু সুফিয়ান বলছিল, আমি আজকের মত এরকম অসংখ্য আগুণ জ্বলতে দেখি নাই এবং এত বিরাট বাহিনীও দেখি নাই। বুদাইল বলল, খোদার কসম, এটা খোযাআ গোত্রের আগুণ হবে। মনে হয় যুদ্ধাভিলাষই তাদের উ্ত্তেজিত করেছে। আবু সুফিয়ান বলল, খোদার কসম, এত অধিক সংখ্যক আগুণ এবং এত বিরাট বাহিনী খোযাআর হতে পারে না। কারণ তারা এর চেয়ে দূর্বল আর নগণ্য।
হযরত আব্বাস(রাঃ) বলেন, আমি তার কণ্ঠস্বর চিনতে পেরে বললাম, হে আবু হানযালাহ! সে আমার আওয়াজ চিনতে পেরে বলে উঠল, আবুল ফযল নাকি ? আমি বললাম, হ্যাঁ। আবু সুফিয়ান বলল, আমার মাতাপিতা তোমার ওপর কোরবান হোক, তুমি এখানে, কি ব্যাপার ? আমি বললাম, তোমার নাশ হোক ! হে আবু সুফিয়ান, এই যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকজন সহকারে এসে পড়েছেন, খোদার কসম! হায় কোরাঈশের ধ্বংস! আবু সুফিয়ান বলল, আমার মাতাপিতা আপনার ওপর কোরবান হোক, এখন উপায় ? হযরত আব্বাস(রাঃ) বলেন, আমি বললাম, তোমাকে গ্রেফতার করতে পারলে তো অবশ্যই তোমার গর্দান উড়ি্যে দেয়া হবে। কাজেই তুমি আমার সাথে এই খচ্চরের পিঠে সওয়ার হয়ে চল। তোমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে যাই এবং তোমার জন্য নিরাপত্তা চেয়ে নিই।
পরদিন সকালে আমি তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে গেলাম। তিনি বললেন, হে আবু সুফিয়ান, তোমার ভাল হোক। তোমার কি এখনও এই সাক্ষ্য দেওয়ার সময় আসে নাই যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন মা'বুদ নাই ? আবু সুফিয়ান বললেন, আমার পিতামাতা আপনার ওপর কোরবান হোক ! আপনি কতই না সম্মানিত, কতই না ধৈর্যশীল, আর কতই না উত্তম সম্পর্ক স্থাপনকারী ! এখন তো আমার দৃঢ়বিশ্বাস হয়ে গিয়েছে যে, যদি আল্লাহর সাথে কোন মা'বুদ শরীক থাকত তবে অবশ্যই আমার কোন কাজে আসত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে আবু সুফিয়ান ! তোমার ভাল হোক, এখনও কি তোমার আসে নাই যে, আমাকে আল্লাহর রাসূল বলে বিশ্বাস করবে ? আবু সুফিয়ান বললেন, আমার পিতামাতা আপনার ওপর কোরবান হোক ! আপনি কতই না সম্মানিত, কতই না ধৈর্যশীল, আর কতই না আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপনকারী ! এই ব্যাপারে এখনও মনে কিছুটা খটকা রয়েছে। হযরত আব্বাস(রাঃ) বললেন, হে আবু সফিয়ান, তোমার নাশ হোক! তোমার গর্দান উড়িয়ে দেয়ার আগেই মুসলমান হয়ে যাও এবং সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন মা'বুদ নাই, আর হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল। এবার আবু সুফিয়ান কালেমায়ে শাহাদাত পড়ে মুসলমান হয়ে গেলেন।
হযরত আব্বাস(রাঃ) বলেন, আমি আরজ করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, এই আবু সুফিয়ান কিছুটা সম্মানপ্রিয় মানুষ। সুতরাং তাকে বিশেষ একটা কিছু দান করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হাঁ, যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ হবে, যে নিজ ঘরের দরজা বন্ধ করে দেবে সে নিরাপদ হবে, এবং যে মসজিদে হারামে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ হবে। অতঃপর আবু সুফিয়ান(রাঃ) চলে যেতে উদ্যত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে আব্বাস, তাকে নাকের মত পাহাড়ের সেই বাড়তি অংশের ওপর দাঁড় করাও যেদিকে পাহাড়ি সরুপথ গিয়েছে, যাতে সে আল্লাহর বাহিনীগুলো অতিক্রম করার দৃশ্য অবলোকন করতে পারে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরাম(রাঃ)কে সুশৃংখল করলেন। প্রত্যেক গোত্র আপন আপন দলপতির সাথে এবং প্রত্যেক সৈন্যদল নিজ নিজ ঝান্ডা উত্তোলন করে রওয়ানা হল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বাগ্রে হযরত খালিদ ইবনে ওলীদ(রাঃ) নেতৃত্বে বনু সুলাইম গোত্রের দল প্রেরণ করলেন। তাদের সংখ্যা এক হাজার ছিল। এই দলের একটি ঝান্ডা হযরত আব্বাস ইবনে মিরদাস(রাঃ) হাতে, একটি হযরত খুফাফ ইবনে নুদবাহ(রাঃ) এর হাতে ও অপর একটি হাজ্জাজ ইবনে ইলাত(রাঃ) এর হাতে ছিল। আবু সুফিয়ান(রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, এরা কারা ? হযরত আব্বাস(রাঃ) বললেন, ইনি খালিদ ইবনে ওলীদ(রাঃ)। আবু সুফিয়ান(রাঃ) বললেন, সেই নওজোয়ান ছেলেটা ? হযরত আব্বাস(রাঃ) বললেন, হাঁ। তাঁরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন খালিদ(রাঃ) যখন সেখানে পৌঁছুলেন তখন তাঁর দল 'আল্লাহু আকবার' বলে তিনবার তাকবীর দিল এবং সম্মুখে অগ্রসর হয়ে গেল। তাদের পেছনে হযরত যুবাইর ইবনে আওয়াম(রাঃ) পাঁচশত জনের একটি দল নিয়ে অতিক্রম করলেন। এদের মধ্যে কিছু মুহাজিরীন ও কিছু বিভিন্ন গোত্রের অপরিচিত লোক ছিলেন। হযরত যুবাইর(রাঃ) এর হাতে কাল রংয়ের বড় একটি ঝান্ডা ছিল। তিনি যখন আবু সুফিয়ান(রাঃ) এর বরাবরে এলেন তখন আপন দল সহকারে 'আল্লাহু আকবার' বলে তিনবার তাকবীর দিলেন। আবু সুফিয়ান(রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, এই ব্যক্তি কে ? হযরত আব্বাস(রাঃ) বললেন, ইনি যুবাইর ইবনে আওয়াম(রাঃ)। আবু সুফিয়ান(রাঃ) বললেন, তোমার ভাতিজা ? হযরত আব্বাস(রাঃ) বললেন, হাঁ। অতঃপর গিফার গোত্রীয় তিনশত জনের একটি দল অতিক্রম করল যাদের ঝান্ডা হযরত আবু যর গিফারী(রাঃ) বহন করছিলেন। কেউ কেউ বলেন তাদের ঝান্ডা হযরত ঈমা ইবনে রাহাদাহ(রাঃ) এর হাতে ছিল। তাঁরাও আবু সুফিয়ান(রাঃ) এর বরাবরে এসে তিনবার তাকবীর দিলেন। আবু সুফিয়ান(রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, হে আবুল ফযল, এরা কারা ? হযরত আব্বাস(রাঃ) বললেন, এরা বনু গিফার। আবু সফিয়ান(রাঃ০ বললেন, বনু গিফারের সাথে আমার কি সম্পর্ক ? তারপর আসলাম গোত্রীয় চারশত জনের দল অতিক্রম করল। এই দলের দু'টি ঝান্ডা ছিল। একটি হযরত বুরাইদা ইবনে হুসাইব(রাঃ) ও অপরটি হযরত নাজিয়া ইবনে আ'জম(রাঃ) বহন করছিলেন। এঁরাও বরাবরে এসে তিনবার তাকবীর দিলেন। আবু সুফিয়ান(রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, এরা কারা ? হযরত আব্বাস(রাঃ) বললেন, এরা আসলাম গোত্র। আবু সুফিয়ান(রাঃ) বললেন, আসলাম গোত্রের সাথে আমার কি সম্পর্ক ? আমাদের ও তাদের মধ্যে তো কখনো ঝগড়া বিবাদ ছিল না। হযরত আব্বাস(রাঃ) বললেন, এরা একটি মুসলমান কওম, যারা ইসলাম গ্রহণ করেছে।
সংকলন ও পরিমার্জনঃ A.MAMUN আর্কাইভ
©somewhere in net ltd.