![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অসমাপ্ত
সচারাচর বাইরে চা পান করি না । এক বন্ধুর পিড়াপিড়িতে বসে পড়লাম রাস্তার পাড়ের টম দোকানে । সেখান থেকে আমাদের স্কুলটা দেখা যায়। জিলা গভঃ বয়েজ স্কুল। সরাসরি চোখ পড়ল বারান্দাটায়। ওখানটাতেই জড়িয়ে আছে অনেক স্মৃতি । সন্ধ্যা বেলা। রাস্তায় হালকা গাড়ি চলছে। পাশের ল্যাম্প পোস্টের আলোতে হেঁটে স্কুলের সামনে গেলাম। কি যেন ভেবে উঠে পড়লাম স্কুলের বারান্দাটায়। খুটিতে স্পর্শ করতেই শৈশবের সব স্মৃতি । প্রিয় ছুটির ঘন্টা, মাস্টার মশাইয়ের পড়া, পড়া না পারার শাস্তি, বন্ধুদের সাথে খেলা, মজার ঝগড়া আরো কত কি !
একলা হাটছি বারান্দায় । সুজয় আর রানা চা হাতে নিয়ে মোবাইল টিপছে। আমি চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে শৈশবের অনুভুতি গুলো উপভোগ করছি। বারান্দার খুটি ও ক্লাস রুমের জানালায় হাত বুলাচ্ছি। আমাদের শাজাহান দাদু এখানকার পাহাড়াদার। সে খুব পুড়নো। আমাদের সময়কার। সে আমাকে বেশ ভাল করে চেনে। তাই কিছুু বলছে না। নইলে খবর আছিল ! হটাৎ দেয়ালে ইমু+আয়নি লেখা দেখে চমকে উঠলাম। আমার গাঁ শিউরে উঠল। হারিয়ে গেলাম বারো বছরের পুড়নো সেই দিনে।
তখন সবে অষ্টম শ্রেণী পাশ করে নবম শ্রেণীতে উঠছি। সর্দার স্যারের ক্লাস। বেশ রাগি। বেত নিয়ে ক্লাসে আসছেন। এসেই পড়া ধরলেন। ইংরেজি রচনা "গ্লোবারাইজেসন" । ছোটবেলা থেকেই আমার ইংরেজিতে এলার্জি। ইংরেজি পড়তে বসলেই ঘুম পেত। আর কষ্ট করে যেটুকু পড়তাম তাও সর্দার স্যারকে দেখে ভুলে যেতাম। ক্লাসের ঘন্টা বাজলে দোয়া দুরুদ ইচ্ছা মতো পড়তাম, যেন স্যার আমাকে পড়া না ধরেন। সেদিন বোধ হয় দোয়ায় কম হয়েছিল, তাই বেছে আমাকেই পড়া ধরলেন। স্বাভাবিক যা হয় আর কি। পড়া পারি নাই, এখন আমাকে পিটানো হবে। স্যারের লাঠিটা আমার চেয়েও লম্বা ছিল। আমাকে বাড়ি দিতেই আমি আতকে উঠি। তাতে স্যারের লাঠিটা আমার হাতে লেগে স্যারেরই চোখে আঘাত হানে। স্যার ত এবার বেশ খেপে যান। সম্পূর্ণ রাগ আমার পিঠে ঝাড়লেন। আমি হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলাম। ঘন্টা পড়ল, স্যার চলে গেলেন। আমি বেঞ্চে মাথা নিচু করে ব্যাথা আর লজ্জায় কাঁদতে লাগলাম। বেশ ক'জন এসে শান্তনা দিল। আমাদের ক্লাসে ইমু (ছদ্দনাম) নামে একটা ছেলে ছিল। রোল ৭। পড়াশুনায় খুব ভাল। আমাদের স্কুলে খুব প্রতিযোগিতা মূলক পড়াশুনা ছিল। তবে ইমু ইংরেজিটা একটু বেশিই পাড়ত।
ইমু ছিপছিপে দেহ আর লম্বা। ভিশন স্মার্ট, সর্বদা ইন করা প্যান্টশার্ট । আর বেশ ফ্যাশনাবল। হাতে পড়তো দামি ঘড়ি, চোখে ফ্যাশনাবল চশমা। পায়ে থাকত দামি ব্রান্ডের কেডস্। ওর পোষাকের চেয়ে ব্যবহার টা বেশি ভাল ছিল। অহংকার নাই, টাকার বাহাদুরি নাই। এমনকি পড়াশুনার ব্যাপারেও ওর তেমন অহংকার ছিল না। আমরা ক'জন এক সাথেই থাকতাম। ইমু রোজ ১০ টাকার ঝালমুড়ি কিনত আর বারান্দায় বাস করা শালিকদের খাওয়াতো। বলত যখন আমি (ইমু) থাকব না তখন ওরা আমার কথা মনে রাখবে। আর শালিক হল শুভ পাখি। সকালে ঘুম থেকে উঠে জোড়া শালিক দেখলে সেইদিনটা ভাল কাটে। ইমুর বেশ দাড়ি ছিল। প্রতি সপ্তাহে ভিন্ন ভিন্ন লুক। সে কি স্টাইল ! আর হেয়র কাট ত জুড়ি মেলা ভার। তার দাড়ির এক্সক্লুসিভ ফ্যাশন থাকত সবসময়ই।
ব্রেক টাইমে ইমু এসে আমাকে জোড় করে বারান্দায় নিয়ে গেল। আমি এবার চুপ। কান্না বন্ধ। পাছে নিচের ক্লাসের ছেলেরা দেখে ফেললে মান সম্মান যাবে। ইমু হয়তো এটাই ভেবেছিল। আমার আরো চার বন্ধু। শুভ, মাশুর, বগা ও মাহফুজ। ওরাও আসছে। ইমু আমাকে বলল,
-তুই আজ পড়া পাড়লি না ক্যেন ?
- স্যারের ভয়ে ভুলে গেছি। আর এই প্যসেজটার শব্দ গুলি বেশ কঠিন। আমার মনে থাকে না ।
-আচ্ছা, আজ টিফিন টাইমে মনে করিস। আমি তোকে বুঝিয়ে দিব।
-আচ্ছা।
টিফিন টাইমে আমাদের একটা অভ্যাস ছিল। স্যার মেডামদের নামে দোষ বলা এবং নিজেরা নিজেদের পড়া তৈরী করা। সেদিন সবাই আমার স্যার হয়ে গেল। আমি তাই ইতস্ততা বোধ করলাম।
শুভ ক্লাসের ফাস্টবয়। ওর রোল ১। আমি সবসময় চাইতাম কোন পড়া না পারলে ও আমাকে বুঝিয়ে দিক। কিন্তু ও ভাল মতো বোঝাতে পারতো না। এদিক দিয়ে মাশুর ও ইমু পড়া বোঝাতে বেশ পটু। আমি শুভকে পড়া জিজ্ঞাসা করলাম,
-শুভ এটা (ইংরেজী প্যাসেজ) একটু পড় তো।
-(ইংরেজিতে ২/৩ লাইন পড়ে) তুই মাশুর বা ইমু কে বল। ওরা ভাল বোঝাতে পারে।
এরই মধ্যে ইমু ও মাশুর চলে আসে। মাশুর আমাকে ইংরেজী কঠিন শব্দগুলির অর্থ বলে দেয়। তবে শেষে ভুলভাল উচ্চারণ করায় রাগ করে চলে যায়। বলে,
-এত গাধা পোলাপানের পড়ালেখার দরকার নাই। তুই বরং মুলো চাষ কর !
আমি মন খারাপ করে বসে থাকি। ইমুও হাঁসে, এরপর সে আমাকে পড়া বুঝিয়ে দেয়। শুভ'র সাথে আমার বন্ধুত্ব ক্লাস সিক্স থেকে, হাইস্কুল জীবনের প্রথম দিন থেকে । ও সবসময়ই ক্লাসে ফাস্টবয় হয় এবং ক্যাপ্টিন থাকে। আমি একটা বিশেষ কারণে ক্লাস সিক্সে ২ মাস পরে ভর্তি হই। প্রথমদিন মীর স্যারের হোমওয়ার্ক ছিল ৬০ পৃষ্ঠা আরবী লেখা, কারণ ৬০ দিন স্কুল বন্ধ ছিল। আমি জানিও না আর করিও নাই। তাই আমার শাস্তি ৬০ বার কান ধরে উঠবস করা। আমার এবিষয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে, কিন্তু তাই বলে হাইস্কুল লাইফের প্রথম দিনই ! ক্যাপ্টিন (শুভ) স্যারকে বলল,
-স্যার, ও আজকে নতুন এসেছে।
- তাতে কি ? ও কেন জেনে নিল না যে স্কুলে কি পড়া দিয়েছে ?
-স্যার, ও আজকেই ভর্তি হয়েছে।
-তা তো যখন এত দরদ তখন তুই ওকে হোমওয়ার্ক কি সেটা জানিয়ে দিলি না কেন ? এবার তুইও ৬০ বার কান ধরে উঠবস কর।
-স্যার, আমি ত হোমওয়ার্ক করছি।
-এদিকে আয়
এই বলে ক্যাপ্টিন শুভ'র চুল ধরে নিচু করে পিঠে ডাস্টার দিয়ে দিল বেশ কয়েকটা। এরপর আবার কান ধরে উঠবস ত আছেই। এরপর ক্লাস শেষ হলে আমি ওকে স্যরি বলতে যাই। ও আমাকে বরে "ইট্স ওকে"। এরপর থেকেই আমরা বন্ধু। বন্ধু মহলে সর্বদা আমার মর্যাদা ছিল। ঠিক মর্যাদা নয়, এটা আসলে ভালবাসা। আমাকে সবাই একটু বেশিই ভালবাসতো। তেমনই মাশুর খুব ভাল গজল গাইত। গাইত গানও। মাশুরের গজলটার একদিন প্রশংসা করেছিলাম, তাই ও আমার ফ্যান হয়ে গেল। মাশুর লোকটা ভাল। তবে টাকা পয়সা বা লেখাপড়ায় যারা গরিব তাদের প্রতি ওর একটা ঘৃনা দৃষ্টিভঙ্গী আছে। ক্রাসে একটা পড়া ওই সবার আগে বুঝে ফেলতো। আর আমরা না বুঝলে ও বিরক্ত হতো। সেও আমাদের পড়া মুখস্থ করায় সাহায্য করতো। তবে একটু কম বুঝলেই রেগে যেত। ক্লাসে আমি আর মাশুর সবচেয়ে বেসি মুটু ছিলাম। তবে মাশুর আমার চেয়ে একটু বেশি লম্বা আর বেশি মটু ছিল। তাই অনেকে আমাদের ছোট মটু বড় মটু বলে ডাকতো।
শিশিরের বাবা ডাক্তার। সেও আমাদের বন্ধু। সে সারাদিন পড়াশুনা নিয়ে থাকে। বন্ধু শুভ'র সাথে তার টেক্কা। যদিও তারা খুব ভাল বন্ধু। পড়াশুনায় যারা ভাল তারা এখন একদলে। ফেলু আর মাঝারিরা আলাদা। তবে আমি ছিলাম সর্বদলীয়। সবাই আমাকে ফ্লোর দিত।
এই যা ! আরেকটা ক্যারেকটার না বললেই নয়। এটা তাহের। সে পড়াশুনায় মাঝারি। কিন্তু আমি সর্বদলীয় গ্রহনীয় আর তাহের সর্বদলীয় বর্জনীয় ব্যাক্তি।ওকে কেউ পছন্দ করে না তার কারণ ও অনেক বড় মাপের ক্লিকবাজ। আমাদের ক্লাসে ত বটেই, এমনকী ও স্যার মেডামদের মধ্যেও ক্লিক লাগিয়ে দেয়।
আর বগা। ওর ভাল নাম লোকমান। দেখতে লম্বা আর কালো থাকায় আমি বগা বলে ডাকি। এক নম্বর ভেবলাকান্ত। অবাস্তব স্বপ্ন দেখা তার হবি/সখ। বগা পড়াশুনায় একদমই ভাল না। তাই ওদের সাথে মিশতো না তেমন। তবে আমাদের স্কুলের গ্রুপের মধ্যে সেও ছিল। ওকে দিয়ে আমি প্রজাতন্ত্র চালাতাম। একটু বোকা হলেও আমার খুব ভাল বন্ধু ছিল। একবার আমি ওর সাথে রাগ করি। দোষ আমার কিন্তু স্যরিটা ওই বলেছিল। মাহফুজ ক্লাসে সবচেয়ে পিচ্চি। নবম শ্রেণীতে পড়লেও ওর সাইজ যেন ষষ্ট শ্রেণীও পার হয়নি। চুপচাপ থাকতো, পড়াশুনায় ঘেটে পন্ডিত। সাইজ যেমনই হোক খাতায় নম্বর কিন্তু বরাবর আমার চেয়ে ভাল। ঠিক হিংসে না করলেও ইর্সা ঠিকই হতো। সেও আমাদের দলে।
আমাদের প্রতিভা বিকাশের জন্য প্রতি বৃহস্পতিবার সর্দার স্যার তার ক্লাসে আমাদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশনা করার সুযোগ দিত। আমরা যে যা পারতাম করতাম। আমার একটা বিশেষ টক সো ছিল। 'বিশ্ব মানব বাঁচান সভা'। এখানে সমাজের অসঙ্গতি গুলো ব্যঙ্গাত্মক ভাবে তুলে ধরতাম। ইমু খুব ভাল গিটার বাজাতো। ভাল গানও গাইতো। আমাদের স্কুলে ত বটেই বন্ধুপাড়ায়ও তখন শুধু ওরই গিটার ছিল। সে গিটার বাজায় দুই সময়। যখন তার মন খারাপ হয় আর যখন তার মন খুব ভাল থাকে। এভাবে আমরা গোটা স্কুলে একটা সাংস্কৃতিক টিম গড়ে উঠলাম। স্কুলের ও স্কুলের বাইরে আমরা বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করা শুরু করলাম। ভালই চলছিল সব। হটাৎ প্রথম সাময়িক পরীক্ষা চলে আসলো। বগা দুই ববিষয়ে ফের। আর আমি সব বিষয়ে পাশ করলেও ইংরেজী ও গণিতে অনেক কম নম্বর পেয়েছি। লুকিয়ে লাভ নাই, ৩৩ আর ৩৫ পেয়েছি। মাশুর ত বেশ খেপে গেছে। সে আমাকে এভয়েট করা শুরু করল। শুভ বলল,
-আমাদের সাথে থেকেও এরকম অবস্থা !
ইমু বলল,
-তুই আমাদের সাথে প্রাইভেট পড়। আমরা যে স্যারের কাছে পড়ি সে খুব ভাল পড়ায়। আর তার কাছে পড়লে সে খাতায় নম্বরও বেশি দিবে।
আমি বন্ধু মহলে সুনাম ধরে রাখতে রাজি হয়ে গেলাম।
পড়তে গেলাম অভয় স্যারের কাছে। সেখানে সব ভাল ছাত্ররা পড়তো। এতে সুবিধার পাশাপাশি অসুবিধা ছিল আমাকে অনেক পরিশ্রম করতে হত। কারণ : ওদের চেয়ে বেশি না হোক, অন্তত ওদের সমপরিমাণ নম্বর আমায় তুলতে হবেই । স্যারের পড়ানোর স্টাইল অন্যরকম।
ক্লাসের চেয়ে ভিন্ন ও সহজ পদ্ধতিতে পড়ান। বেছে বেছে গণিত করান। আর সব পড়া প্রাইভেটেই শেষ করে দেন। পরীক্ষায় যা আসবে তাই ই পড়ান। আর নম্বরও বেশি বেশি দেন। আমি সব সামলে প্রাইভেট চালিয়ে যাচ্ছি । আমাদের ব্যাচে কয়েকজন মেয়েও পড়ে। ওরা গার্লস স্কুলের ছাত্রী। তাদের মধ্যে একজন আমাদের স্কুলের মেডামের মেয়ে। নাম অয়নী। অয়নী রোজ এক একটা নতুন ড্রেস পড়ে আসত। আর স্বভাব ও চলন ছিল সিনেমার নায়িকাদের মতো। হালকা গয়না ও সেই বয়সেই তার ফ্যাশনেবল হেয়ার কাট ! কথা বলার ভঙ্গি ভিশন স্টাইলিশ। জামার সাথে জুতা, ব্যাগ, লিপিস্টিক ও কলমও ম্যাচিং করে পড়ত। একদিন আমি ওর এসব নিয়ে হাঁসি ঠাট্টা করছিলাম। ইমু আমাকে ধমক দিয়ে বলল,
-তুই যে কি ? বাজে জিনিস নিয়ে কথা বলিস! এটা ত স্টাইল, এ নিয়ে বলার কি আছে !
ইমুর হটাৎ ধমক খেয়ে আমি চুপসে গেলাম। কারণ ইমু কখনো কাউকে প্রয়োজন ছাড়া ধমক দেয় না। পরে বুঝলাম। জল কদ্দূর গড়িয়েছে। আসলে ইমু অয়নীর সাথে প্রেম করে।
সেবার শুভ মেডামের মেয়েকে পটাবে বলে লাভ লেটার ভরে দিছিল অয়নীর বইয়ে। এটা অয়নীর বাসার স্যারের হাতে পরে যায়। ওদিকে বাসার স্যারও অয়নীর প্রতি দূর্বল। কিন্তু মেডামের ভয়ে প্রপোজ করে না। এখানে মেডাম চরিত্রটার একটু বর্ণনা দিই। মেডাম উচ্চ বংশীয়, সৎ চরিত্রবান ও ভদ্র মহিলা মানুষ। ভিশন রাগি আর ভাল মানুষ। ভাল মানুষ একারণে যে, ২/১ পড়া না পারলে আর ঐ পড়া কাউকে ধরতেন না। অয়নী বোধহয় ম্যেচিং করাটা ওর মা আমাদের মেডামের কাছেই শিখেছে। শাড়ি, ব্লাউজ, জুতা ও ব্যাগ সব ম্যাচিং । মেডাম সাধারনত কালারফুল গহনাই পড়তেন, তাও সব ম্যেচিং । এমন ভাবে থাকতেন যেন পান থেকে চুন খসলে বিরাট শাস্তি দিবেন। কিন্তু আসলে তেমন কিছুু বলতেনও না, শুধু রাগি ভাবটাই দেখাতেন। পড়াতেন বাংলা, কিন্তু সিরিয়াস ছিলেন গণিত ও ইংরেজির চেয়েও বেশি। এমনকী কেউ নম্বর কম পেলেও তাকে ক্লাসেই বকতেন।
চিঠিটা পেয়ে অয়নী কে শাসিয়েছেন তার বাসার স্যার। অয়নী তাই প্রাইভেটে এসে শুভকে ইচ্ছা মতো বকছে আর শাসিয়েছে। এরপর সে মেডামকে বলবেও বলেছে। শুভ অনেক ভয় পেয়ে যায়। সে ইমুকে বলে বিষয়টি সমাধান করে দিতে। ইমু দায়িত্ব নেয় এর অবসান করার। শেষে ইমু ওদের ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটায়, শুভ অয়নীর কাছে মাফ চায় আর অয়নী মেডামকে বলবে না বলে কথা দেয়। বন্ধুদের সাহায্য করায় ইমুর বেশ আগ্রহ ছিল। কারো কিছুু হলে ও ঝাপিয়ে পড়ত। টাকা, পয়সা, বুদ্ধি দিয়ে সাহায্য করা ওর নেশা ছিল। প্রায় সময় ও অন্যদের হোমওয়ার্ক করে দিত। ক্লাসে আমরা এরকম ২/৩ টা গাধা ছিলাম, যারা অন্যদের হোমওয়ার্ক করে দিতাম। যাক সে কথা। ইমুর ব্যববহার ও বন্ধুদের প্রতি সাহায্য এবং বিশেষ করে ইমুর গান অয়নী কে বেশ আকর্ষন করতো। এর ফলে অয়নী ইচ্ছা করে ইমুর সাথে গল্প আড্ডায় মেতে উঠত। প্রায় দিন ওরা প্রাইভেটের নির্দিষ্ট সময়ের আগেই চলে আসতো। অয়নী গণিত বোঝার কথা বলে ওকে আগে আসতে বলতো। কিন্তু গণিত কম আড্ডাই হতো বেশি। আস্তে আস্তে ইমু অয়নীর প্রেমে পড়ে গেল। একদিন অয়নী ইমুর নোট ধার নিয়ে খাতার সবকটি পৃষ্ঠায় লিখে দেয় "ইমু তোমাকে ভালবাসি, ইতি অয়নী "। ব্যাস, শুরু হয়ে গেল ওদের প্রেম। যে বয়সে আমরা সিনেমার প্রেম দেখে হাসতাম, কার্টুন ভাবতাম সেই বয়সে ওরা চুটিয়ে প্রেম করত। সে এক কঠিন প্রেম।
একদিন ইমু অয়নী কে দেখতে দেখতে কাত হতে যেয়ে পরে গেল। অয়নী তাই দেখে হা হা করে হেঁসে উঠল। স্যারের গণিত বুঝানোর সময় অন্যদিকে তাকালেও খেপে যায়, আর অয়নী হেঁসে দিছে ! যতই মেডামের মেয়ে হোক, শাস্তি তাকে পেতেই হবে। তাই স্যার তাকে কান ধরে ক্লাসের বাইরে দাড় করিয়ে রাখলেন। এদিকে ইমু ! পাড়া অংকটা কেঁটে ভুলভাল অংক করে স্যারকে দেখালেন। স্যার রেগে ওকেও কান ধরে বাইরে দাড় করিয়ে রাখলেন। আমি বুঝলাম, ইমু অয়নীর শাস্তির অংশিদার হতেই এরকম করছে। কারণ : এই অংকটাই ও আমাকে একটু আগেই বুঝিয়েছে। অয়নী মুখ চেপে ইমুকে ভেংচি কেটে হাসঁতে রাগল। ইমু ওকে এক্সপ্রেশন দিয়ে কান ধরে দাড়িয়ে রইল। অয়নী পা দিয়ে ইমুকে খোঁচা দিল। ইমু অয়নীর গাঁ সালাম করে বলল,
-পা লাগার জন্য স্যরি।
-না ঠিক আছে, ইটস্ ওকে।
ওরা একসঙ্গে মেলায়ও যেত। একবার ইমু আমাদের বাদ দিয়ে অয়নী কে নিয়ে মেলায় যায়। অয়নী ওর গায়ে ঝালমুড়ি ফিকে দিয়ে দৌড়লে ইমু ওকে দৌড়েই ধরে ফেলে। বলে,
-এভাবে দূরে সড়ে যেও না খুকি। তাহলে আমার দম। বন্ধ হয়ে যায়।
অয়নীর হাতে একটা নতুন মাফলার। সে সেটা ইমুর হাতে পেচিয়ে দিচ্ছিল আর বলছিল,
-নাও, মনে কর এটা একটা দড়ি। এটা তোমার জন্য কিনেছি। আমি যেন দূরে না যাই তাই আমাকে বেধে রেখ।
ইমু বলেছিল,
-হুম। তোমাকে বেধে না রাখতে পারলেও নিঃশ্বাসটাকে ত বেধে রাখতে পারব। (অয়নীকে জড়িয়ে ধরে) তোমাকে ছাড়া মরে যাব আমি।
অয়নী ইমুর মুখ চেপে ধরে বলেছিল "আমিও"।
একুশে ফেব্রুয়ারি আমরা শহীদ মিনারে ফুল দিতাম। অনুূষ্ঠানে যেতাম। ইমু প্রায় অনুষ্ঠানে গান গাইত। কিন্তু ইদানিং অয়নীর সাথেই ঘুরে বেড়ায়। ইমু ছাড়া আমরা ৪জন ছেলে। আর আমাদের ৫ জনের মধ্য গল্প আড্ডায় ঠিক নিজেকে মানিয়ে নিছিল সে। একুশে ফেব্রুয়ারিতে একে অন্যের সাজ বেশ পছন্দ করল। ইমু ত শহীদ মিনারে যে ফুল দেয়ার জন্য আনছিল তা অয়নী কেই দিয়ে দিল। দুজনেই খুঁশি।
আজকাল ইমু একটু বেশি ফাঁকি দিচ্ছে। আসলে যে কখনো ফাঁকি দেয় না তার সামান্যতম ফাঁকিও বড় করে দেখা যায়। অয়নীর জন্মদিনে ইমু স্কুল পালিয়ে ওকে উইস করতে যায়। আর সেদিনই দুবার করে নাম ডাকে। শুভ ইমুর প্রেজেন্টটাও দিয়ে দেয়। কিন্তু স্যার মাথা গুনে দেখে একজন কম। ধরা পড়ে ইমু নেই। ওর প্রেজেন্ট কেউ দিয়ে দিছে। স্যার বলেন,
-কে দিছছ বল ? তা না হলে ক্লাসের সবাইকে পিটাব।
ক্যাপ্টিন (শুভ) কে দিয়ে ৩ টা বেত আনানো হয়। আমরা কেউ শুভ'র নাম বলব না বলে ঠিক করি। শুভ হাত তুলতে চায়, আমরা ওকে টেনে বসিয়ে রাখি। হটাৎ তাহের স্যারকে বলে,
-স্যার, আমার মনে হয় সামনের দুই বেঞ্চে ইমুর বন্ধুরা বসা। ওদের কেউ ই একাজটা করছে।
স্যার এবার রেগে গিয়ে আমাদের দুবেঞ্চের সবাইকে খুব পেটায়। ছুটির সময় আমরা ওকে পিটানোর জন্য সবাই মিলে ধরি। মাশুর ওকে কষে একটা চড় দেয়। আমি দেই ইচ্ছা মতো অভিষাপ। আর ক্লাসের সবাই ওকে নিন্দা করে। তবে পিটাতে পারিনি। শুভ আর ইমু ওকে ছেড়ে দেয়। সেবার ইমু অয়নী কে গিফট্ দিছিল ঠিকই কিন্তু পুরো ধোলাই টা খাই আমরা। আর ইমু দৌড়ানি খায় গার্লস্ স্কুলের কুকুর টমি'র। দৌড়ানি খেয়ে রাস্তায় আছাড় খেয়ে পরে যায়। পায়ে খুব চোট লাগে, গোড়ালী মচকে যায়।
সেবার আমাদের স্কুলে আন্তঃ স্কুল ক্রিকেট ম্যাচের কার্ড আসে। স্যার আমাদের ডেকে টিম করে দেয় আর বেছে বেছে খেলোয়াড় নিতে বলেন। আর যদিও ইমু খেলাতে তেমন একটা পারদর্শী ছিল না কিন্তু তারপরও ওকেই ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টিন করা হয়। তাহের খুব ভাল ক্রিকেট খেলে। এজন্য আপত্তি থাকার পরেও ওকে নেয়া হয়। ক্যাপ্টিন না হতে পারায় শুভ'র মন খারাপ ছিল, কিন্তু তারপরও সে ক্যাপ্টিনের মতো সব দায়িত্ব পালন করে ইমুকে সাহায্য করতো। আর তাহের ইমুর নামে শুভ'র কানে খালি ঘ্যান ঘ্যান করতো। একদিন আমাদের প্রাকটিসের সময় ইমু ব্যাট করল আর বল যেয়ে লাগল শুভ'র গুপ্তস্থানে। শুভ ত চেপে ধরে বসে পড়ল। ইমু দৌড়ে আসলে তাহের ইমু কে দশ কথা শুনিয়ে দিল। শিশির তাহেরকে থামতে বললে শিশিরের সাথে তাহেরের ঝগড়া লেগে যায়। পরে হাতাহাতিও হয়। এই নিয়ে ফাইনালের আগের দিন ম্যাচ বন্ধ প্রায়। শেষে ক্রিয়া স্যার সিদ্ধান্ত নেয় শিশির আর তাহেরকে বাদ দিয়েই ম্যাচ খেলা হবে। কিন্তু ওরা দুজনেই খুব ভাল ক্রিকেট খেলে। তাই ইমু আর শুভ মিলে স্যারকে রিকুয়েস্ট করে ওদের ফিরিয়ে আনে। অবশেষে ফাইনালে আমরা জিতে যাই। ইমুর চেয়ে শুভ র রান বেশি ছিল। তবে ইমুর যথাযথ নেতৃত্বেই আমরা পুরো জেলায় বিজয়ী হই। আনন্দের বন্যা বসে পুরো স্কুলে। ২ দিন ধরে আনন্দ উৎসব চলে। ঢাকা থেকে শিল্পি আনা হয়। তারা নাচ গান করে। আমরাও অংশ নেই। ইমু গান গায়, আমরা নাটক করি, রম্য খবর পড়া হয়, এক বড় ভাই ব্রেকড্যান্স দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেন।
ওদিকে ক্রিকেট ম্যাচের কারণে অয়নীর সাথে ইমুর যোগাযোগ কয়দিন একরকম প্রায় বন্ধই থাকে। এতে অয়নী রেগে যায়। ইমুর সাথে শুরু হয় ওর রাগা রাগি। শেষে একদিন ওদের স্কুল ছুটি হলে ইমু অয়নীর পথ আটকে স্যরি বলতে যায়। এটা অয়নীর বাসার স্যার দেখে ফেলে রাস্তায়ই ইমুকে অনেক বকা জকা করে আর মেডামের কাছে বলে দেয়ার হুমকি দেয়। শেষে অয়নী ওর স্যারকে অনেক বলে কয়ে ম্যেনেজ করে। তবে সে মেডামকে ডায়রেক্ট না বলে ইনডায়রেক্ট ভাবে বলে এবং তার চাকরি হওয়ায় সে অয়নী কে পড়ানো বন্ধ করে চলে যায়। মেডাম কখনো অয়নী কে ইমুর সাথে মিশতে বাধা দিত না। বরং পরীক্ষার সময় রাত হয়ে গেলে বলত, ইমু যেন অয়নী কে একটু এগিয়ে দেয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বা এমনিতেই ইমুর মেডামের বাসায় আসা যাওয়া ছিল স্বাভাবিকের মতো। ইদানিং মেডাম ইমুর বাসায় যাওটা পছন্দ করছে না বলে মনে হচ্ছে। হয়তো তাহের কিছুু বলেছে এটা আমরা ভাবতাম। তবে তাহের যে কিছুু জানে না সেটা আমরা মোটামুটি সিওর ছিলাম। আর ছাত্রদের মধ্যে ইমু আর শুভ ছাড়া মেডামের সাথে খুব দরকার না হলে কেউ কথাও বলে না। আর ইমু আর অয়নীর ব্যাপারটা শুধু আমরা ক'জন ই জানতাম। বগা আমাকে বলেছিল সে শুভকে ২/১দিন আগে মেডামের সাথে অনেক কথা বলতে দেখেছে। তবে কি বিষয়ে বলেছে সেটা সে জানে না। বগাকে কেউ তেমন একটা গুরুত্ব দেই না আমরা। একদিন স্কুলের বারান্দায় কে যেন লিখে রাখছে "ইমু+অয়নী"। সকালে এসে সেটা দেখেই আমাদের জল্পনা কল্পনা শুরু। বগার বুদ্ধিতে আমি চক ঘষে লেখাটা মিলিয়ে দিলাম। মাশুর বলল,
-ইস ! মিলানোর আগে কার হাতের লেখা সেটা চেক করা দরকার ছিল। ওদের সন্ধেহ এবার আমার দিকে। কারণ আমি লেখাটা মুছেছি। আমি অনেক কিড়া কসম কেটে ওদের কোন রকম বিশ্বাস অর্জন করলাম।
হটাৎ একদিন মেডাম ইমুকে অফিস রুমে ডেকে পাঠালেন। কি বলেছেন সেটা ইমু হয়তো আমাদের সত্য বলেনি। আমাদের শুধু বলেছিল, মেডাম ওকে অয়নীর সাথে একটু সিরিয়াস বিহ্যাব করতে বলেছেন। ও ছেলে আর অয়নী মেয়ে। তাই ওদের এতটা ঘনিষ্ঠতা ভাল দেখায় না। এটা শুনে আমাদের চিন্তা বেড়ে গেল। এরমধ্যেই এসে গেল নবম শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষা। পরীক্ষা দিলাম। রেজাল্ট দিল ঠিক দেড় মাস পর। এবার হেডস্যার নতুন নিয়ম করলেন, যারা এক বিষয়ে ফেল করেছে তাদের কাউকে দশম শ্রেণীতে উঠতে দিবে না। আমাদের রেজাল্ট মোটামুটি মান সম্মান বাচানোর মতো হলেও মিরাক্কেল হলো ইমুর রেজাল্ট। আমরা পাশ করে ক্লাস টেন এ আর ও নাইনে ই রয়ে গেল। যে ছেলে পড়াশুনায় এত ভাল সে বাংলা আর ইংরেজিতে ফেল। আমরা কনফিউজড হয়ে গেলাম। ইমুর মাথায় যেন বাজ পড়ল। আমাদের রীতিমত ক্লাস শুরু হয়ে গেল। মূলত মাধ্যমিকের রেজাল্টের উপর স্কুলের মান সম্মান ও ভাবমূর্তি উজ্জল হয়। তাই আমাদের সর্বোত্তম সাপোর্ট দিয়ে পুরোদমে পড়াশুনা শুরু করে দিয়েছে। পিছনে পড়ে রইল শুধু ইমু।
ফেল করার পর ইমু আর স্কুলে আসে নাই। ওর বাসায় শুভ আর শিশির ছাড়া কেউ যেতও না। আর ক্লাস টেনে উঠে পড়া এত বেড়েছে যে নিয়মিত খোঁজ খবর নেয়াটাও অসম্ভব হয়ে গেছে। খেলা আড্ডা কই যে হাড়িয়ে গেল ভেবেই পাই না। আগে ত স্যাররা জোড় করে পড়াতেন, এখন নিজের তাগিদেই পড়ি। বরংচ স্যারদের কাছ থেকে পড়া আদায় করে নিই। এরমধ্যে ইমুর কথা ভাবার সময় তেমন একটা হয় না। আর সবার বাসায়ই পড়ার চাপ আর শক্ত গাইড পরে গেছে। ওদের দুজনকে জিজ্ঞেস করলে ওরা বলত,
ভাল নেই রে। ওর মন খারাপ। হয়তো আর পড়বেও না। ইমু রা দুই ভাই ছিল। ক'বছর অাগে ক্যানসারে ওর বড় ভাই মারা যায়। এত কম বয়সে ছেলের মৃত্যু ইমুর বাবাকে অনেক আঘাত করে। সিঙাপুর নিয়ে চিকিৎসা করাতে হয়েছিল ইমুর ভাইকে। তারপরও বাঁচাতে পারে নাই। আর এতে ওদের আর্থিক অবস্থাও বেশ খারাপ হয়ে যায়। তবে ইমুর বাবা বড় সরকারি চাকরি করেন। তারা সমাজের আর দশটা স্বচ্ছল পরিবারের একটি। তাই বোঝা যায় না। বড় বাইয়ের মৃত্যুর পর ইমু ই তার মা বাবার একমাত্র অবলম্বন।
এসবের চাপটা ও হয়তো নিতে পারছে না।
একদিন ঐ বাংলা মেডামের ক্লাস। হটাৎ দেখি ইমু আসছে। এখন আর সেই ইমু নেই। গায়ে গোল গলার একটা কালো গেঞ্জি আর গেভার্টিং প্যান্ট। কাধে একটা জোলানো ব্যাগ। এলোমেলো চুল দাড়ি। আজ ওর দাড়িতে কোন স্টাইল নেই। নেই চুলের কাটিং। চুল দাড়ি এলোমেলো। চোখ গুলো ফুলে লাল হয়ে গেছে। বোঝা যাচ্ছিল বেশ কয়েকদিন খুব কেঁদেছে ও।
যে ইমু সবার বিপদে ঝাপিয়ে পড়ল আজ তার দূর্দিনে আমরা কেউ তার পাশে নেই। কেউ ওকে সাহায্য বা এমনকি কোন বুদ্ধি পরামর্শ দিয়েও কিছুু করতে পারছি না। ইচ্ছে থাকলেও সময়, সুযোগ বা উপায়ও নেই। মেডামকে দেখে বলল,
-মেডাম। আপনার সাথে একটু কথা বলব।
এতটুকু কথায় রেগে উঠার কোন কারণ ছিল না। কিন্তু মেডাম রেগে উঠে তেড়ে এলেন ! বললেন,
-কি কথা? কি কথা ? কোন কথা নাই। যা বলার তা ত আমি নিচেই বলে দিছি। এখন আবার কি ? যাও যাও...!
আমরা অবাক হচ্ছি। যে ইমুকে সে তার মেয়েকে বাড়ি পৌছে দিতে বলতো আজ সে তাকে এভাবে তাড়িয়ে দিচ্ছে ! এবার ইমু ক্লাস রুমের দরজার সামনে হাত জোড় করে অপরাধীর মতো কান্নায় ভেঙে পড়ল।
- মেডাম প্লিজ, প্লিজ মেডাম। আমাকে আর একটিবার সুযোগ দিন । প্লিজ.....
মেডাম এবার জোড়ে জোড়ে চেচামেচি করতে লাগলেন। পাশের রুমের স্যার চলে এলেন। মেডাম যা নয় তাই বলে ইমুকে গাল মন্দ করতে লাগল। ইমু কিছুু বলছে না, শুধু ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। আমাদের হৃদয় টা কেপে উঠল। বন্ধুদের জন্য এত ভালবাসার ইমু আজ দরজার সামনে কাঁদছে আর আমরা আজ নিরব দর্শক। মেডামের চেচামেচি থামাতে পাশের রুমের স্যার ইমুকে নিচ তলায় পাঠিয়ে দিলেন। ইমু চলে গেল। আমরা টিফিন টাইমে বসলাম। আজ কেউ পড়ার কথা বলছে না। সবার কথায় শুধু ইমু। শুভ ও শিশির ইমুদের বাসার কাছাকাছি থাকত। তাই ওদের বাসায় যাতায়াত ছিল। ওরা দুজনই ইমুর সবচেয়ে ভাল বন্ধু ছিল। তবে ইমু শিশিরকে সব কথা আগে বলত আর ওর সাথে এতটু বেশি খাতির ছিল। বগা বলল,
-আজ ত ইমুর সাথে এক আঙ্কেলকে দেখলাম।
শিশির - হুম। ওনি ওর বাবা। আজ হেডস্যারের সাথে কথা বলতে আসছিল।
আমি জানতে চাইলাম সবকিছু। আসলে ঘটনাটা কি ? শুভ বলতে না করে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।। শিশিরকে ধরে অনেক রিকুয়েস্ট করে শেষে মাশুর ওকে অনুরোধ করায় শুনলাম সবটা। মেডাম ইমু আর অয়নীর প্রেমের খবরটা জেনে যান পরীক্ষার ক'দিন আগে। তাই সে ওদের দুজনকে খুব ধমকেছে। ইমুকে শাসিয়েছে খুব। এরপর ইমুকে বাংলায় ইচ্ছাকৃত ফেল করিয়ে দিছে। আর ইংরেজি ও গণিত স্যারকে অনুরোধ করছে তারা যেন ইমুকে ফেল করিয়ে দেয়। মেডাম ঐ স্যারকে হাত জোড় করে কেঁদে কেঁদে বলছে। আর বলছে তারা যেন মেডামের মেয়ে অয়নীর জীবনটা ভিক্ষে দেন ! এই সম্পর্কটা ভাঙতে ইমুকে ফেল করানো ছাড়া আর কোন রাস্তা নেই। ইংরেজি স্যার তাই ফেল করিয়ে দিছে। কিন্তু গণিত স্যার উল্টো মেডামকে তার মেয়ের চরিত্র ঠিক করতে বলেন। আর এই নিয়ে স্যার মেডামদের মধ্যে গ্রুপিং হয়ে যায়। একদল মেডামের পক্ষে আরেকদল ইমুর পক্ষে চলে যায়। এদিকে মেডাম হেডস্যারের কাছে সব ঘটনা খুলে বলে হেডস্যার কে অনুরোধ করে সে যেন ইমুর বাবার সাথে দেখা না করেন। কিন্তু ইমুর বাবা আসলে হেডস্যার দেখা করেন, তবে ইমুকে নাইনে আরেক বছর পড়তে বলেন। কোন অনুরোধ যখন কাজ করছে না তখন ইমু এসে প্রত্যেক স্যারের কাছে কেঁদে কেঁদে টেনে উঠার জন্য বলে। সবাই বলে এতে তাদের কোন হাত নেই। যা করার সব মেডাম ই করতে পারে। কিন্তু মেডাম ত কোন কথাই শোনেন না। আবার ইমুর বাবা মেডামের সাথে দেখা করতে গেলে মেডাম ইমুর বাবাকে অনেক আজে বাজে কথা বলছে। এসব নিয়ে ইমু ফ্যাডাপ হয়ে পরেছে। এদিকে ইমুর বাবা কে দেখো তাহের বলেছে,
-কাকু লাভ নাই। আরেক বছর নাইনে পড়ে আসুক।
এটা শুনে আরো খারাপ অবস্থা ইমুর বাবার। তারপরও কাউকে কিছুু না বলে নিরবে স্কুলের পার্শ গেইট দিয়ে চলে গেছেন।
প্রতিদিনের মতো স্কুলে আসলাম। আমারা যারা একসাথে থাকতাম, ওদের দেখছি না কোথাও । বারান্দার শালিক গুলো ছোটাছুটি করছে না। থম ধরে বসে আছে কারেন্টের তারের উপর। স্যাররা অফিস রুমে। মিজান চাচা আজ আর চা বানাচ্ছে না। পিটি হলো না, ক্লাসের সময় পার হয়ে যাচ্ছে । কারো খবর নেই। বগা বলল,
-জানিস, ইমু সুসাইড করছে।
শোনা মাত্র হৃৎপিন্ডে চাপ অনুভব করলাম। চোখ বেয়ে পানি পড়ছে, কিন্তু কাঁদতে পারছি না । বগা আরো বলল,
- সবাই ত সেখানে গেছে। তুই যাবি না ?
তাকিয়ে দেখলাম, আমাদের কাছের বন্ধুরা কেউ ক্লাসে নাই। ব্যাগ গুলো এলোমেলো। আমি বললাম,
-বগা, আমাকে নিয়ে যাবি ? আমি ত উঠতেই পারছি না !
বগা আর আমি রওনা দিলাম ইমুদের বাসার দিকে। বগা একটু আগেই ঘুরে এসেছে। ফেল করার পর ইমু পড়াশুনা ছেড়ে দেয়। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে শুধু দরজা বন্ধ করে একা থাকত। ইস, যে কাউকে একা থাকতে দিত না আজ সে এরকম একাকি ছিল। তাও মৃত্যুর শেষ সময়ে ! আর বেশি মন খারাপের সময় সবচেয়ে কাছের বন্ধু গিটারটা হাতে তুলে বাজাতো। সেদিন স্কুল থেকে ইমু তার বাবা কে নিয়ে ফেরার পর মানসিক ভাবে ভেঙে পরে। ইমুর বাবা ইমুকে যথেষ্ট শান্তনা দেয়ার চেস্টা করে বারবার ব্যার্থ হন। ইমুকে অন্য স্কুলে ক্লাস টেনে ভর্তি করানোর সিদ্ধান্ত নেয় ওর বাবা। ইমু বলে, সে পড়লে এই স্কুলেই পড়বে না হয় আর পড়াশুনা করবে না। সব মিলিয়ে বেশ ঝামেলা চলছিল। এরই মধ্য অয়নী ইমুকে সন্ধ্যায় দেখা করতে বলে।
ইমু অয়নীদের বাড়ির পাশে চা দোকানের আড়ালে দেখা করে। সাথে শুভ ও শিশির ছিল। অয়নী ইমুকে সব ভুলে গিয়ে আবার পড়াশুনা শুরু করতে বলে। আসলে শুভ অয়নী কে দেখা করে এসব বলতে বলছিল। ইমু অয়নী কে বলে সে যেন মেডামকে একটু অনুরোধ করে। কিন্তু অয়নী এব্যাপারে কোন কথা বলেনি। যাওয়ার সময় শুধু বলে গেছে,
-আমরা ভাল বন্ধু ছিলাম, ভাল বন্ধু থাকব।
ইমু বলে,
-আর আমাদের ভালবাসা !
অয়নী কিন্তু কোন উত্তর দেয়নি। সে কথার পাশ কাটিয়ে গেছে। এরই মধ্যে মেডাম অয়নী কে বাসায় না পেয়ে খুঁজতে চলে আসে। মেডামকে দেখে শুভ ও শিশির পালিয়ে যায়। যাওয়ার সময় শিশির মেডামের আসার খবর বলে যায়। অয়নী চলে যায়, আর যাওয়ার সময় ইমুকে বলে যায় সে যেন মেডামের সামনে না পরে। মেডাম ওকে দেখলে আবার অপমান করবে। মেডাম ইমুকে না দেখলেও অয়নীকে দেখে ফেলে। ওকে একটা চড় দেন মেডাম, অয়নী দৌড়ে বাসায় চলে যায়।
আকাশে প্রচন্ড ঝড় হচ্ছে। বেশ বৃষ্টিও হচ্ছে। ইমু ভিজছে বৃষ্টিতে। চিৎকার করে কাঁদল, হয়তো বুকটা হালকা হবে ! আরো আরো জোড়ে বৃষ্টির তীব্রতা কামনা করে ইমু। আজ কেবল বৃষ্টির তীব্রতা ওর কষ্টকে লুকাতে পারে। ওর কান্না কেউ শুনেছে কিনা জানা নেই, ওর সাথে আকাশ কেঁদেছে। কেঁদেছে মেঘ। রাগে গর্জেছে প্রকৃতি।
এক সময় ইমুর হুশ ফিরে এলো। বাসায় ফিরল ইমু। এসে দেখে ওর বাসার স্যার এসছে।
সোলেমান গণি ইমুকে বাসায় পড়াতেন। রগচটায় তার দ্বিতীয়জন নেই। সে সন্ধ্যায় এসছেন। দিনে রাতের এক মিনিট সময়ও সে নষ্ট করেন না। ঘুমানও ঘড়ি ধরে। দৈনিক ৮টি প্রাইভেট পড়ান। এছাড়া স্কুল ত আছেই। জনপ্রতি দেড় দুহাজার টাকা করে। ইমুর ব্যাপারটা আলাদা। ইমুর বাবা দেন পাঁচ হাজার করে। তাই সে ইমুর জন্য ৫ ঘন্টা বসে থাকতে পারে। ইমু বাসায় ফিরে স্যারকে দেখেও সোজা নিজের রুমে চলে যায়। পোষাক বদলে গিটারটা নিয়ে বসে। গিটারের আওয়াজ শুনে ইমুর মা ইমুকে ডেকে নিয়ে এসে পড়ার টেবিলে বসায়। ইমু কে হোমওয়ার্ক জিজ্ঞেস করেন সোলেমান স্যার। ইমু চুপ, কোন উত্তর দেয় না। বেশ কয়েকবার জিজ্ঞাস করার পর ইমু বলে,
-স্যরি স্যার। আজ হোমওয়ার্ক করিনি আর পড়তেও ইচ্ছে করছে না। আজ পড়ব না স্যার।
ক্ষেপে যান সোলেমান গণি। ইমু পড়বে না সেটা আগে বললে ৪ ঘন্টা বসে বসে নষ্ট করত না সে। অন্যদের অন্তত পড়াতে পারতেন। আর পড়বে না বললেই হল ! ওকে পড়তেই হবে। নানান চেচামেচি করতে লাগল। ইমু কিন্তু একেবারে চুপ। স্যারের চেচামেচি শুনে ইমুর বাবা চলে এল। এসে ইমুর মাথায়, পিঠে হাত বুলালেন। আদর করে বললেন,
-ঠিক আছে আব্বু। তোমাকে বেশি পড়তে হবে না। একটু পড়ো।
-বাবা, আজ আমার মনটা খুব খারাপ। ভয়ঙ্কর খারাপ। আমার পড়া আসছে না। আজ আমাকে ছেড়ে দাও না বাবা ?
ইমুর বাবা তারপরও ওকে খোশামোদ করতে থাকে। সোলেমান স্যার কিন্তু তাতে কান দেবার লোক নয়। সে এবার ইমুকে রেখে ইমুর বাবাকে কথা শোনাতো লাগল। ইমুর বাবা শেষে বললেন,
-স্যার, আপনি আজ আসুন। ইমু মানসিক ভাবে একটু ভেঙে পড়েছে ত তাই পড়তে চাচ্ছে না। ২/১দিন পর আমি আপনাকে ফোন দিব।
-না না। সেটা হবে না। আপনি আমাকে আগে বলেননি কেন ? আজ আমার ৪টে প্রাইভেট পড়ানো ওর জন্য নষ্ট হয়েছে। আজ ওকে পড়তেই হবে। তা না হলে আমি আর ওকে পড়াবো না।
ইমু এবার দাড়িয়ে হাত জোড় করে বলল,
-স্যার আমাকে মাফ করবেন। আমি আর পড়াশুনা করব না। অন্তত আপনার কাছে না।
এটা বলে ইমু নিজের রুমে চলে গেল। স্যার এবার ভিশন রেগে গেলেন। তিনি ইমুর বাবাকে বললেন,
-কেমন পোলাপান বানিয়েছেন দেখুন। স্যারদের সাথে কথা বলাই শেখে নাই। এরা কিভাবে পাশ করবে। এর জীবনেও লেখাপড়া হবে না। এগুলো তার জন্মগত দোষ। মা-বাপের শিক্ষা না থাকলে যা হয় আর কি ।
স্যার বুঝলো না যেখানে জীবনটাই বিপন্ন সেখানে পড়াশুনার দায় নেই। ইমুর বাবা তার রুমে চলে গেলেন। স্যারও চলে গেলেন। ইমুর মা ইমুর বাবাকে সান্তনা দিচ্ছেন। এমন সময় ইমুর ঘর থেকে গিটারের আওয়াজ এল। ইমুর বাবা রেগে গেলেন এবার। ইমুর রুমে এসে ওকে বকতে লাগলেন। ইমু বাবার সামনে দাড়িয়ে বলল,
-এমন করছ কেন ?
ইমুর বাবা ইমুকে একটা চড় কষিয়ে দিলেন। জীবনে প্রথম ইমুর গায়ে আঘাত করলেন। ইমুর হাত থেকে গিটারটা নিয়ে এক টানে গিটারের তার ছিড়ে দিলেন। ইমু গিটারটা বুকে চেপে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। ইমুর মা ওর বাবাকে রুম থেকে নিয়ে গেলেন। রাতে ঘুম হল না কারো। এরপর মাঝরাতে ফ্যাস ফ্যাস আওয়াজ শুনে ইমুর মা দৌড়ে এল ইমুর ঘরে। মা তো, তাই বোধহয় নাড়ির টানেই বুঝে গেছিল ইমু চলে যাচ্ছে। হ্যা। ইমু অয়নীর দেয়া মাফলার টা ফ্যানের সাথে বেধে দম বন্ধ করে চলে গেছে নিরবে নিভৃতে। কাউকে বলেনি ওর দুঃখের কথা। হয়তো নিজের দুঃখের ভাগিদার কাউকে করতে চায়নি। যদিও ওর সুখের ভাগিদার হতো সবাই। যাওয়ার আগে ওর ডায়েরির সব পৃষ্ঠা মুছে দিয়ে গেছে। একটি মাত্র পৃষ্ঠা ছিল। তাতে লেখা ছিল, "ব্যার্থতা আমার, তাই চলে গেলাম। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ি নয়"। ওর সুখ দুঃখের কাব্য আজও জানে না কেউ। শুধু শুভ, শিশির আর অয়নী কে একটা মেসেজ পাঠিয়ে ছিল। তাতে লেখা ছিল "তোমরা ভাল থেকো আর আমাকে কেউ মনে রেখ না" ।
ইমুর মা ইমুর মৃত্যু যন্ত্রণা দেখে চিৎকার দিয়ে উঠে। ওর বাবা এসে ওকে জুলন্ত অবস্থা থেকে নামায়। রাতে প্রথমে নেয়া হয় একটি প্রাইভেট হাসপাতালে। সেখানে কর্মরত নার্স ইমুর চিকিৎসা করতে চায়নি। বলে,
-এসব পোলাপান ত এমনেই মরে। এগুলো সুসাইড কেস। পুলিশি ঝামেলা হতে পারে। সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। তারা কোন রকম চিকিৎসা না দিয়েই ইমুকে ছেড়ে দেন। তবে ডাক্তারের ভিজিট ৭০০ টাকা রাখতে ভুল করেনি। এরপর ইমুকে আনা হয় সরকারি হাসপাতালে। ভাগ্যক্রমে সেদিন শিশিরের বাবার নাইট ডিউটি পড়ায় শেষ সময়ে একটু চিকিৎসা পায় ইমু। শত চেস্টা করেও বাঁচাতে পারেনি ওকে। ডাক্তার এসে বলল, যার নিজেরই বাচার ইচ্ছা নেই তাকে তার শরিরও কোন সাপোর্ট দেয় না। ইমুর মায়ের চিৎকারে ভাড়ি হয়ে আকাশ বাতাস, গোটা হাসপাতাল। ওর বাবা নিশ্চুপ। ২/৩ জন পুলিশ এসেছিল তদারকি করতে, ইমুর বাবা ওদের পকেটে ৫০০ টাকা পুরে দিয়ে নিজেকেই গ্রেফতার করতে বলে। বলে সে তার ছেলেকে মেরে ফেলেছে। পরে শিশিরের বাবার হস্তক্ষেপে পুলিশ চলে যায় এবং সবাইকে বাসায় পৌছে দেয়া হয়। সকালে মেসেজ পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসে শুভ আর শিশির।
ইমুকে গোসল করানো হল। পড়ানো হলো ধবধবে সাদা কাপড়, মাখানো হল আতর, গোলাপজল আর লোবান। শুইয়ে দেয়া হল শেষ বিদায়ের খাটে।
ইতিমধ্যে আমি আর বগা ওদের বাসার কাছাকাছি চলে এসছি। এসে দেখি ওর শবদেহ বয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে আমাদের স্কুলের মাঠে। আমরা লাশের পিছন পিছন গেলাম। আজ আর কোন দল/গ্রুপ নেই। সবার চোখে বেদনার অশ্রু। কান্না আর আহাজারিতে গোটা স্কুলে শোকের মাতম। স্তব্ধ ছিল স্কুলের বারান্দার শালিক গুলো। শালিক রাও দুঃখ বোঝে। হয়তো ওরা বুঝে গেছিল, আজ আর কেউ ওদের ঝালমুড়ি খাওয়াবে না। গাছের পাতা গুলোও নড়ছে না। কে আত্মীয়, কে অনাত্মীয় আর কারা ওর বন্ধু, কে শত্রু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। সবাই কেঁদে উঠছে। আজ তাহেরের চোখেও জল। ইমুর শবদেহ স্কুলের গেট দিয়ে ঢুকলে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল সোলেমান গণি। ওর লাশের খাট ধরে বসে পড়লেন তিনি। দাড়িয়ে চোখের বাধাহীন অশ্রু মুছছেন গণিত আর ইংরেজী স্যার। সব স্যার মেডামদের আজ যেন হৃদয় জুড়ে দুঃখের মাতম।
বাংলা মেডামের পাশে দেখলাম দাড়ানো অয়নীকে। তার চোখ দুটো ফোলা আর লাল। অয়নীর একটা হাত ধরে দাড়িয়ে আছে বাংলা মেডাম। শাড়ির আচলের কোনা দিয়ে মুখ ডেকে দাড়ানো তিনি।
যখন ওর প্রাণহীন দেহটা বিদায়ের খাটে শুয়ে আসছিল তখন চোখে জল ছিল সবার। শুধু বাংলা মেডামের চোখের জল কেউ দেখেনি । মৃত লাশটির কাছেও আসেনি। দূর থেকে দেখেছে, হয়তো কোন চিরকুটের ভয় ভেবেছে ! একটু পরে জানাজা হল, আমরা ইমুর জানাজা পড়লাম। আমাদের ছেড়ে, ওর স্কুল ছেড়ে, ওর পৃথিবী ছেড়ে না ফেরার দেশে অভিমান নিয়ে চলে গেল ইমু। আজও ওকে মনে পড়ে। এই বারান্দায় কত আড্ডা, কত দুষ্টুমি করতাম আমরা। তুই এভাবে চলে যাবি জানলে তোকে আগলে রাখতাম রে ইমু, তোকে আগলে রাখতাম।
আজ পার হয়ে গেছে অনেকগুলো বছর। প্রায় একযুগ, কিন্তু তারপরও বই খুললে তোর স্পর্শ পাই। তুই তোকে মনে রাখতে না করেছিলি, কিন্তু তোর কথাটা আমরা রাখতে পারিনিরে। মাফ করে দিস আমাদের।
এর মধ্যে সুজয়ের ফোন চলে আসল, আমাদের চা পান শেষ সেই সাথে আমার ছেলেবেলার স্মৃতিও। আমরা চলে এলাম বাড়িতে । মাধ্যমিক পাশ করার পর শুভ, শিশির, মাশুরের সাথে আর দেখা বা যোগাযোগ হয় নাই। কয়দিন আগে হটাৎ শুভ'র সাথে দেখা। কুশল বিনিময় করছি, হটাৎ শুভ শুভ বলে মেয়ে কন্ঠের ডাক শুনে চমকে গেলাম। পরিচিত মানুৃষ, পরিচিত কন্ঠ। চেয়ে দেখি অয়নী ! শুভকে ডেকে বলছে,
-এক বোতল পানি এনো, বাবুর (অয়নীর সন্তান) পা ধুইয়ে দেব।
আমি অবাক হয়ে শুভ'র দিকে চাইলাম। ও আমার বাহুতে মৃদু চাপ দিয়ে বলল,
-অয়নী, সী ইজ মাই ওয়াইফ।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে ইমুকে খোঁজবার ব্যার্থ চেস্টা করি। কিন্তু, সব হারানো জিনিস ত আর ফেরত পাওয়া যায় না ! যেখানেই থাক, ভালো থাকিস ইমু !
---অসমাপ্ত---
লেখক : আবদুল্লাহ আল মামুন
সর্বস্বত্ত সংরক্ষিত : A.MAMUN আর্কাইভ
গল্পটি এবং গল্পের চরিত্রগুলো সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে কোন মিল হলে সেটা সম্পূর্ণ ই অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয়। এটা কাউকে আঘাত বা কোন উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয়। এটা আমার (লেখকের) নিজ চিন্তা থেকে লেখা একটা ছোট গল্প।
©somewhere in net ltd.