নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাজিদ উল হক আবির

সাধু সাবধান ! ব্লগের মালিক বঙ্গালা সাহিত্যকে ধরিয়া বিশাল মাপের ঝাঁকি দিতে নিজেকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রস্তুত করিতেছেন। সেই মর্মে তিনি এখন কিটো ডায়েটিং, ডন-বৈঠক ও ভারোত্তলন প্রশিক্ষণে ব্যস্ত। প্রকাশিত গ্রন্থঃ১। শেষ বসন্তের গল্প । (২০১৪)২। মিসিং পারসন - প্যাত্রিক মোদিয়ানো, ২০১৪ সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী (অনুবাদ, ২০১৫) ৩। আয়াজ আলীর ডানা (গল্পগ্রন্থ - ২০১৬ ৪। কোমা ও অন্যান্য গল্প(গল্প গ্রন্থ, ২০১৮) ৫। হেমন্তের মর্সিয়া (কবিতা, ২০১৮) ৬। কাঁচের দেয়াল (গল্পগ্রন্থ, ২০১৯)

সাজিদ উল হক আবির › বিস্তারিত পোস্টঃ

লেখক যখন পাঠক ৩ঃ সখী রঙ্গমালা ~ শাহীন আখতার

১৪ ই আগস্ট, ২০২১ রাত ১২:৫৪




১।
সমসাময়িক কথাসাহিত্যিক শাহীন আখতারকে আবিষ্কার, আমার বাংলা সাহিত্যের নিবিড় পাঠক জীবনে - একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সুনীলের তিনখণ্ড রামায়ণ, সেই সময়, প্রথম আলো, পূর্ব পশ্চিম পড়া শেষে তখন বাংলাদেশের কৌম জনগোষ্ঠীকে নিয়ে লেখা ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস হাতড়ে ফিরছি। ইলিয়াস হাজির হলেন খোয়াবনামা আর চিলেকোঠার সেপাই নিয়ে। শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন উৎরানো গেলো কয়েকবার প্রচেষ্টার পর। হুমায়ূন আহমেদের মধ্যাহ্ন পড়লাম। একটু জাম্প করে শাহাদুজ্জামানের ক্রাচের কর্নেল পড়া হল। পড়লাম হাসান আজিজুল হকের আগুণপাখি। খুঁজে ফিরছি, এরপর কার অনাঘ্রাতা আখ্যানের পৃষ্ঠায় নতুন গজিয়ে ওঠা সমালোচক - পাঠকসুলভ দাঁত বসানো যায়। প্রথম আলোর সাহিত্যপাতায় তখন নিয়মিত নাম দেখি এক লেখকের, তিনি উল্লেখযোগ্য প্রায় সব সাহিত্যপুরষ্কারে ভূষিত, অথচ তিনি আমার - আমাদের পঠনে সেভাবে নেই। তিনি অনুপস্থিত ঢাবি বা বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্র - কেন্দ্রিক বইপড়ুয়াদের আড্ডার বিষয়বস্তু হিসেবেও। ২০১৮ সালে প্রথমা - বেঙ্গল কর্তৃক আয়োজিত, শাহবাগ জাতীয় গ্রন্থাগার চত্বরে শীতকালীন বইমেলায় গিয়ে ২৫ % ছাড়ে কিনে নিলাম এই দুই প্রকাশনা থেকে বের হওয়া শাহীন আখতারের তিনটে বই - ময়ূর সিংহাসন, সখী রঙ্গমালা, এবং অসুখী দিন।
.
শাহীন আখতারের সাহিত্য জগতে আমার প্রথম পা রাখা ওনার উপন্যাস ময়ূর সিংহাসন দিয়ে, ২০১৯ সালে। অবাক লেগেছিল, উনি যে উপন্যাসই লেখেন, তা কোন না কোন পুরস্কার পেয়ে যায়। তাও যা তা পুরষ্কার নয়। বাংলা কথাসাহিত্যের জগতে উল্লেখযোগ্য সব পুরস্কার। ঘটনাচক্রে জানলাম, ওনার সবচে আলোচিত উপন্যাস তালাশ। তালাশের সঙ্গে ওনার প্রথম উপন্যাস পালাবার পথ নেই, এবং গল্পসমগ্র ১ অর্ডার করলাম এ বছর এপ্রিল / মে মাসে, অনলাইনে, মাওলা ব্রাদার্স থেকে। আজ দু'বছরের ব্যবধানে, শাহীন আখতারের প্রকাশিত সমস্ত উপন্যাস আমার পড়া। ময়ূর সিংহাসন দিয়ে শুরু করবার পর পালাবার পথ নেই, তারপর তালাশ, তারপর অসুখী দিন, এবং সবশেষে সখী রঙ্গমালা - এই ধারাবাহিকতায় ওনার পাঁচটি উপন্যাস পড়ে শেষ করলাম। আজকের এ লেখা, সখী রঙ্গমালার একটি (অসম্পূর্ণ, এবং তড়িঘড়ি করে লেখা) পাঠ প্রতিক্রিয়া।
.
২।
উপন্যাসের প্লটের বর্ণনা নিজে করবার বদলে আমি সরাসরি তুলে দিচ্ছি তার ব্যাকফ্ল্যাপে থাকা তথ্যটুকু। তাতে আমার বিশ্লেষণে মনোযোগ দেয়ার ফুসরত তৈরি হবে। বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখা -
.
"দক্ষিণ সমতট অঞ্চলের দুশো বছরেরও আগেকার এক কিংবদন্তির আখ্যানকে উপজীব্য করে রচিত হয়েছে উপন্যাস সখী রঙ্গমালা। নায়ক জমিদারনন্দন রাজচন্দ্র চৌধুরী। তার নারীপ্রীতির সুযোগ নিয়ে পিতৃব্য রাজেন্দ্র নারায়ণ নানা কৌশলে তাকে ঠকাচ্ছেন। এ অবস্থায় নীচু জাতের নরকন্যা সুন্দরী রঙ্গমালার প্রেমে পড়েন রাজচন্দ্র। উপন্যাসে ধূর্ত রাজেন্দ্র নারায়ণ, দাপুটে মা সুমিত্রা, পাখি পোষা বৌ ফুলেশ্বরী ও মোহময়ী রঙ্গমালাকে ঘিরে জমে উঠেছে প্রেম ও ক্ষমতার অভূতপূর্ব নাটক। তার মধ্যে ধরা পড়েছে কতগুলো মানুষের কম্পমান মুখচ্ছবি, জঙ্গ - ফ্যাসাদে তছনছ এক জনপদ ..."
.
৩।
উপন্যাসটিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে চলে রঙ্গি - রাজচন্দ্র প্রেম। এটা যদি উপন্যাসের মূল স্রোত হয়, তবে তার প্রবাহের নীচে বেশকিছু বহুমুখী আন্ডার কারেন্ট / চোরা স্রোত উপন্যাসের গঠনটাকে আঁটসাঁট করে ধরে রাখে, এবং উপন্যাসটিকে কেবল আরেকটি প্রেমের উপন্যাস হওয়া থেকে বাঁচায়। তারমধ্যে আছে ব্রিটিশদের আগমনে জমিদার প্রথায় ক্ষয়ের আদি চিহ্ন, জমিদারীর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খুড়ো - ভ্রাতুষ্পুত্রের লড়াই, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, নিম্নবর্গের মানুষের জীবন, এবং নানা আঙ্গিক থেকে সমাজের বিবিধ স্তরের নারীদের জীবন বিশ্লেষণ। শাহীন আখতারের সকল উপন্যাসে এই এক বিশেষত্ব, যা তাকে আলাদা করে বাংলা ভাষাভাষী সমসাময়িক কথাসাহিত্যিকদের থেকে। যে সময়ের প্রেক্ষাপটে তার আখ্যানসমূহের রচনা, সে সময়ে সমাজের প্রায় সমস্ত স্তরের নারীদের জীবনকে তিনি স্পর্শ করে করে তৈরি করেন তার গল্পের গাঁথুনি।
.
সখী রঙ্গমালা এমন এক সময়ের এবং অঞ্চলের আখ্যান - যেখানে সমাজে নারীদের অর্থনৈতিক অবদান রাখার কোন সুযোগ ছিল না। সামাজিক কাঠামোর ফেরে উপার্জনে অক্ষম নারীদের দেহজ বিষয়াদিই তাদের প্রাসঙ্গিক করে রাখতো সমাজে।
.
যেমন, উপন্যাসটিতে নারীদের উপস্থিতি, যদি সমাজ কাঠামোর একদম নিম্নস্তর থেকে ধরা হয় - দাসী (হীরা দাসী, দুর্গা দাসী), ভিখারি (শ্যামপ্রিয়া বৈষ্ণবী), রক্ষিতা (রঙ্গমালা), বাড়ির বৌ (ফুলেশ্বরী রাই), এবং জমিদার বাড়ির রাজমাতা (মা সুমিত্রা)।
.
দাসীদের বাড়ির কাজের পাশাপাশি বাড়ির পুরুষরা যৌনাচারের সঙ্গী বানাত। ভিখারি বৈষ্ণবীর অবস্থাও তথৈবচ। রক্ষিতা যদিও প্রেমের হকদার, কিন্তু তাতেও জোর খাটানোর ব্যাপার আছে। জমিদারনন্দনের ইচ্ছামাফিক সে সম্পর্কের মোড় ডানে বামে ঘোরে। সে প্রেমের প্রশ্নে সন্দেহও তৈরি হয় যখন রাজচন্দ্র দুই কানির যবন জমিদার ইঙ্গা চৌধুরীর দ্বিতীয় বৌ গুলবদনের রূপে দিওয়ানা হয়। সেই মাথানষ্ট বৌ আবার দুয়ারে বসে গড়গড়া টানে, নয়তো উদলা গায়ে চুল খুলে নাচে। রাজবাড়ির মা'র প্রতাপ, তার স্বামী এবং পুত্র সন্তানের জোরে। রাজবাড়ির বৌ রাজবাড়িতে প্রাসঙ্গিকতা হারায় যখন সে পুত্রসন্তান জন্মদানে অক্ষম। এই সোশ্যাল ডাইমেনশনের উপস্থাপন উপন্যাসের সবচে' গুরুত্বপূর্ণ ঝোঁক, আমার মতে।

.
৪।
মুলানুগ আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার উপন্যাসটিকে এক আলাদা সৌকর্য দিয়েছে সন্দেহাতীতভাবে। একই সঙ্গে, দুশো বছর আগের আঞ্চলিক ভাষার, শব্দের ব্যবহার উপন্যাসের পাঠ, আয়েসি পাঠকদের জন্যে দুরূহও করেছে। একেবারে প্রথম চ্যাপ্টার থেকে আঞ্চলিক ভাষা প্রয়োগের একটা উদাহরণ দিই -
.
" 'দিদিমণি, দিদিমণি, ... আই আমনেরে তামান দুইন্যাই খুঁজি খুঁজি মরি - আমনে ইয়ানে? ... আয়ো। চান্দা বীর কল্লা কাডি লই আইছে। মহারাজ রাজিন্দ্র খুড়ার হুকুম তামিল কইচ্ছে ..."
.
নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষাই সংলাপের কথ্য ভাষা, পুরো উপন্যাসে। একই সঙ্গে প্রচুর শব্দের ব্যবহার আছে, এমন, যা ঐ সময়, সময়ের মানুষ, তাদের জীবনযাত্রাকে সজীব করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ - চাঁচর কেশ, জেওরের বটুয়া, তাঞ্জাম, জলটুঙ্গি, সুরাই - চিলামচি, কোশা, কুড়ায় বাক দেয়া, টঙ্কা ইনাম, তাওয়াফি সাজ, ধলা টাঙ্গন, খেংরা - বাড়ি, বাতার বেড়া, পান - দোক্তা, হাইনজা, একলপ্ত - ইত্যাদি।
.
সমালোচক দেবেশ রায়ের বক্তব্য - "উপন্যাসটিতে এমন কোন পেছুটান কনামাত্র কাজ করে নি যে, পাঠক সব শব্দ, বাক্য, ঘটনা বুঝবেন কি না। গল্পটি যে ভাষা পরিস্থিতিতে ঘটছে, সেই ভাষা - পরিস্থিতি গল্পটির সঙ্গে এমনই একাকার যে, গল্প তার ভাষার অর্থ ঠিক করে দেয়..." - এর সাথে উপন্যাসের ভেতরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠক হিসেবে আপনি একাত্ম বোধ করবেন।
.
৫।
উপন্যাসটির আরেক বিশেষত্ব, নারীর দৃষ্টিতে নারীশরীরের আকুতি, আকাঙ্ক্ষা, যৌন উপস্থিতির বর্ণনা। উপন্যাসে নারীদের যৌনজীবনের বর্ণনা অহরহ আসে। নারীরা বুকের পাশ, কোমরের খাঁজ দেখিয়ে কাপড় কাঁচে, চাঁদির রেকাবিতে সোনালী রুপালি তবক দিয়ে পানের খিলি সাজিয়ে, হরিদ্রা - দুধের সর গায়ে মেখে স্বামীসজ্জার জন্যে নিজেদের প্রস্তুত করে তোলে - এসবকিছুর বেশ গ্রাফিক বর্ণনা উপন্যাসে উপস্থিত, কিন্তু তা কখনোই বিবমিষা সৃষ্টি করে না। সাহিত্যে যৌনতা প্রায়সই হয় রগরগে, আবার কখনো কখনো বর্ণনার কাব্যিকতার চাপে যৌনতা পেছনের দরজা দিয়ে পালায়। এ দুয়ের একটাও নয় নারী - পুরুষের যৌনজীবনের আখ্যান, এ উপন্যাসে।
.
৬।
আমার মতে, উপন্যাসে চান্দা বীরের চরিত্রটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, এবং গুরুত্বের অনুসারে যথেষ্ট যত্ন পায় নি। চান্দা বীর, যে কিনা জমিদারীর হকদার রাজচন্দ্রের সবচে বড় শত্রু, দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, হৃদয়হীন হন্তারক, নায়িকা রঙ্গমালার মাথা কেটে যে হাতে করে রাজবাড়িতে নিয়ে আসে, রাজচন্দ্রের বিপক্ষে থাকা রাজেন্দ্র নারায়নের বাহুতে - বুদ্ধিতে সবচে শক্তিশালী ঠিকাদার, তার চান্দা বীর হয়ে ওঠাটা, তার মনোজগৎ এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে আরও একটু প্রসারিত হলে চরিত্রটির প্রতি পূর্ণাঙ্গ ন্যায়বিচার করা হতো।
.
পুরুষ চরিত্রগুলির অধিকাংশই ফ্ল্যাট ক্যারেক্টার। মানে, উপন্যাসে তাদের যার যতটুকু রোল প্লে করা প্রয়োজন, তাদের স্রেফ ততোটুকু কাজ করবার জন্যেই সৃষ্টি, এবং সমাপ্তি। রাজচন্দ্র টিপিক্যাল বখে যাওয়া জমিদারনন্দন, রাজেন্দ্র খুড়া টিপিক্যাল ষড়যন্ত্রকারী, ভেলু চৌধুরী টিপিক্যাল সাধ্বীপুরুষ, চান্দা বীর টিপিক্যাল হৃদয়হীন হন্তারক। প্রধান নারীচরিত্রদের, অন্তত রাই, রঙ্গি, মা সুমিত্রা, হীরা দাসী, শ্যামপ্রিয়া বৈষ্ণবীর বিপরীতে পুরুষ চরিত্রগুলির মনোজগতে আর একটু অধিক বিচরণ প্রয়োজন ছিল, পাঠক হিসেবে এমনটা আমার মত।
.
৭।
সাহিত্য সমালোচক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যারের সখী রঙ্গমালা নিয়ে একটি মূল্যায়নধর্মী বক্তব্য উপন্যাসের ব্যাক ফ্ল্যাপে যুক্ত করা হয়েছে। স্যার বলেন -
.
"গল্পটিতে যদিও বিয়োগের অভিঘাতই বেশি, তা জমাট বাঁধে না এর অন্তর্গত এক সূক্ষ্ম কৌতুকময়তার জন্য। এই কৌতুকময়তার উৎস জীবনের প্রতি বর্ণনাকারীর প্রসন্ন এক দৃষ্টিভঙ্গীতে।"
.
স্যারের এ মন্তব্যের প্রেক্ষিতে বিনয়ের সঙ্গে আমার দু'একটি কথা বলার আছে। সখী রঙ্গমালার মূল সুর বিয়োগাত্মক, এবং সূক্ষ্ম কৌতুকময়তার সাম্পানে চড়ে বিয়োগের অভিঘাতগুলো আমাদের ধাক্কা দেয় এসে বটে, কিন্তু সচেতন, অনুভূতিসম্পন্ন মানুষের পক্ষে সে কৌতুকময়তায় প্রসন্ন হওয়া মুশকিল। কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে উল্লেখিত কৌতুকময়তা ডার্ক হিউমার। তাতে হাসি আসে না। বেশি করে কান্না পায়।
.
কাছারিঘরে, উপন্যাসের নায়িকা রঙ্গমালার কাটামুণ্ডু যখন এনে রাখা হয়, উপনায়িকা ফুলেশ্বরী রাই তখন ফলবাগিচায় দোলনায় দোল খেতে খেতে আঙ্গুল টিপে কাক গুনছিল। কারণ, ততদিনে গর্ভপাতজনিত কারণে সে রাজচন্দ্রের জমিদারবাড়িতে পাগলের খেতাব সম্বলিত অবাঞ্ছিত বাঁজা বৌ হিসেবে পরিণত হয়ে গেছে।
.
এতটুকু অংশকেই যদি বিবেচনা করি, পুরো ঘটনাটুকু বর্ণনায় একটা অন্তরীন কৌতুকময়তা আছে অবশ্যই, কিন্তু তা সচেতন পাঠকের মুখে আরও কঠিনভাবে তালা লাগিয়ে দেয়। পাঠক হাসবে কি, ঘটনার নির্মমতায় বোবা হয়ে বই নামিয়ে বসে থাকে বেশ কিছুক্ষণ।
.
আর, এই কৌতুকময়তার উৎস হিসেবে বর্ণনাকারীর জীবনের ব্যাপারে প্রসন্ন দৃষ্টিভঙ্গীকে চিহ্নিত করাটা হয় বলার জন্যে বলা, বা নিতান্ত ম্যাসকুলিন নির্মমতা। কারণ, আখ্যানের রচয়িতা শাহীন আখতার নিজে একজন নারী, এবং যে ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তার আখ্যানে অপরাপর নারী চরিত্রগুলিকে স্থাপিত করছেন, এবং কলমের টানে তাদের ভাগ্য রচনা করছেন, ইতিহাসের সে পাতায় নারীদের অবস্থা এতোটাই নিপীড়িত যে - এর বর্ণনায় জীবনের ব্যাপারে, অ্যাজ ইট ইজ, বা জীবনের ব্যাপারে, যেমনটা উপন্যাসে ফুটে উঠেছে - উভয় ক্ষেত্রেই খুব প্রসন্ন, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী, সাহিত্যিকের পক্ষে সচেতনভাবে থাকা মুশকিল। থাকলে সে বরং সে রচয়িতার মানবিক বোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। যে আখ্যানে নারীরা মূলত দাসী, এমনকি যারা অবস্থাসম্পন্ন ঘরের গৃহিণী, তাদের নিজ নিজ সংসারে প্রাসঙ্গিকতাও যৌন সদ্ভোগ, এবং পুরুষ সন্তান উৎপাদন। জীবনের এই চেহারার ব্যাপারে প্রসন্ন দৃষ্টিভঙ্গী রাখা কীভাবে সম্ভব?
.
৮।
উপন্যাসের শেষে কোন চরিত্রটির সঙ্গে নিজেকে সবচে বেশি একাত্মবোধ করতে পারি, বা কার দুঃখ মনে বাজে বেশি - এ প্রশ্নটাই পাঠক হিসেবে আমার কাছে চূড়ান্ত প্রশ্ন হিসেবে থেকে যায়। এ ক্ষেত্রে আমার ভোট যাবে জমিদার নন্দন রাজচন্দ্রের বাঁজা ও পরিত্যক্ত বৌ ফুলেশ্বরী রাই এর পক্ষে।
আমার এহেন সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যার জন্যে উপন্যাসের অন্যান্য জেনানার সঙ্গে রাইয়ের চরিত্রের সমাপ্তির একটা তুলনামূলক আলোচনা প্রয়োজন।
.
উপন্যাসের মূল নায়িকা রঙ্গমালা, দানব চান্দাবীরের হাতে নির্মমভাবে প্রাণ হারায়। কিন্তু মৃত্যুর আগে সে পেয়েছে জমিদার রাজচন্দ্রের অকুণ্ঠ ভালোবাসা, রাজকোষাগারের খরচে জমিদারের সঙ্গে একত্রে গিয়েছে তীর্থভ্রমণে, তার নামে সায়রসমান দীঘি খননের কাজে লাফিয়ে নেমেছে জমিদার, মৃত্যুর আগে তাকে হিন্দু শাস্ত্রমতে জাতে তুলে আনার কাজও শুরু করে জমিদার।
.
মা সুমিত্রা, জমিদার রাজচন্দ্রের গর্ভধারিণী, উপন্যাসের শেষে দেখা যায় রাজবাড়ির নানা কূটকৌশলের শেষে কিছুটা ভাগ্য আর অনেকটা নিজের চেষ্টায়, সমাসীন হন রাজমাতার আসনে। তার পুত্র রাজচন্দ্রের অধিকারে আসে মসলন্দের গদি।
.
হীরা দাসী - ফুলেশ্বরীর আজন্ম দাসী, সে নিজেও তার স্বৈরিণী পূর্বপুরুষের বাড়ি যজ্ঞেশ্বরীর কোঠায় আঁট করে বসে।
.
কিন্তু উপন্যাসে রঙ্গমালার ফয়েল ক্যারেক্টার, অপর নায়িকা ফুলেশ্বরীর কপালে কি জোটে? স্বামীর সোহাগ বরাদ্দ ছিল স্বামীর প্রেমিকা রঙ্গমালা বাইয়ের কপালে। দু' চার রাত্রি, যা স্বামীসঙ্গ লাভ, তাও রাইয়ের রঙ্গমালার মতো নটির সাজ দিয়ে -
.
"শাড়ি - কাঁচুলি গাঁ থেকে খসে পড়লেও এ যেন রঙ্গিরোই দেহ, ফুটন্ত পদ্মের মতো টা মেলে মেলে ধরে রাই ... পালঙ্কে ঝড় বয়ে যায়। চোখ বুজেও ফুলেশ্বরী দেখতে পায়, রঙ্গমালার পেলব শরীরটা গভীর এক সুখানুভূতিতে মোচড় খেয়ে ধীরে ধীরে স্থির হয়ে যাচ্ছে।" (৭৮)
.
অপরদিকে, ঘটনার ঘনঘটায় স্বামী রাজচন্দ্রের ধাক্কায় উঁচু খাট থেকে পড়ে পেটের সন্তান খোয়ানোর পর থেকেই রাইয়ের রাজবাড়ির গিন্নীপনার পাট চুকে যায়। এদিকে বাপের বাড়ি থেকে যে অলঙ্কার নিয়ে এসেছিল, তার সবই রাইয়ের স্বামী রাজচন্দ্র, রক্ষিতা রঙ্গমালার পদাঙ্কে অর্পণ করে শেষ। হীরা দাসীর সঙ্গে যখন রাজবাড়ির দহলিজ ত্যাগ করবে, তখনকার অবস্থাটা উপন্যাসের ভাষায় -
.
"এক রাজ্যের জঞ্জাল দিয়ে রাজবাড়ির বৌ পথে নেমেছে - ভাবতেই বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে ... মায়া হয় অবোধ মেয়েটার জন্য। পাখির শোকে পুরাদস্তর পাথর বনে গেছে। দেহটাও পাখির মতো পলকা। বয়স কুড়ি ছাড়ায় নাই, এর মধ্যেই শরীরে ক্ষয় ধরেছে। সাজ - সজ্জাহীন বিবর্ণ মুখ। উস্কখুস্ক চুল। শীর্ণ হাতে জানালার শিক ধরে খালি বাদামের দিকে তাকিয়ে আছে। অভাগী কী নিয়ে রাজবাড়িতে ঢুকেছিল আর কী নিয়ে ফিরে যাচ্ছে।
...
মা সুমিত্রার সারা বিকাল কাটে ঘরের দোর লাগিয়ে জেওরের বাক্স নেড়েচেড়ে। এ তার শেষ সম্বল। এ থেকে এক পদ গহনাও হাতে ধরে ফুলেশ্বরীকে দিতে মন সায় দিচ্ছে না। খরচের খাতায় যার নাম উঠে গেছে, তাকে কিছু দেয়াটাই লোকসান। সে কানাকড়ি হলেও। তামাম জিন্দেগী কেউ বাগী হয়ে থাকে না। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরবে। ফের বিয়েথা করে সংসারী হবে। চন্দ্রের নয়া বউয়ের জন্যে এ জেওরের বাক্সখানা তোলা থাকলো। যার গর্ভাধার আশ্রয় করে প্রতাপ নারায়ণের বংশধারা ডালপালা ছড়াবে, এ তার প্রাপ্য বৈকি। তবে আলগোছে একগাছা সোনার চুড়ি বালিশের তলায় রেখে তিনি বাক্স বন্ধ করেন। আস্ত একটা রাত সামনে পড়ে আছে। কাল বিহানে দেখা যাবে, এ কখান চুড়ি বাক্সে ফেরত যায়, না ফুলেশ্বরীর হাতে ওঠে।" (১৯৮)
.
উপন্যাসের একদম শেষে, ফুলেশ্বরী রাই যখন হীরা দাসীর স্বৈরিণী পূর্বপুরুষের বাড়িতে আশ্রিতা, তখন তার মনের কথা -
.
"রাতের প্রহরে প্রহরে পাখিটা থেমে থেমে ডাকে। রাইয়ের চোখেও নিঁদ নেই। রাজচন্দ্র কবে বিয়ে করলো! ছেলে হয়েছে আজ আট দিন। রাজবাড়িতে মা সুমিত্রার নাতির উৎসব চলছে। যার দাপানিতে নাড়ি সরে রাই বাঁজা হয়ে গেলো, তার জীবনে তো কিছুই উনা থাকল না। এ কার বিচার! মসলন্দের গদিতে বসেছেন মহারাজ। রঙ্গমালার বদলে ঘর আলো করে আছে নয়া বধূ। ফুলেশ্বরী বরাবরই ফাউ। জিন্দেগিতে রাজচন্দ্র ছাড়া রাইয়ের দুসরা মরদ ছিল না। তার দেহে সে দেহ মিলিয়েছে রঙ্গমালা সেজে, রঙ্গিরই দেহ নিয়ে। সেই শরীরই যখন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে - ফুলেশ্বরী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এ জনম তো পরার্থেই গেল।"
.
এমন সময়, যজ্ঞেশ্বরীর কোঠার অদূরে, জেলেপল্লীর কাছাকাছি বটতলায় রাতে গানের আসর বসে। তাতে পালাগান হয় - চৌধ্রির লড়াই। তাতেও মূল কুশীলব রঙ্গমালা স্বয়ং -
.
"রঙ্গমালার মন্দভাগ্য লয়ে গীত বেঁধে আসরে নেমেছে এক অচেনা গায়েন।
...
রাজচন্দ্র ও রাজিন্দ্রের গীত আমি গাই।
যে কারণে খুড়া ভাতিজা কৈরাছে লড়াই।।
...
সত্য প্রেমকাহিনি গো আমি করব বর্ণনা।
মন দিয়ে শোনেন সবে রঙ্গমালার ঘটনা।।" (২২১-২২)
.
এ পালাগান যখন চলছে, বড়বাড়ির রাজবধূ তখন তার পূর্বমর্যাদা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বসে আছে কুলি কামিনের আসরে। আফসোস, সেই পালাতেও নেই তার ত্যাগ ও বঞ্চনার গাঁথা। কাজেই ফুলেশ্বরীর দুঃখ পাঠকের মর্মমূলে গিয়ে বিঁধতে বাধ্য প্রায়। সবাই যে যার মতো জীবন গুছিয়ে নিলেও, ফুলেশ্বরী থেকে যায় ভুলে যাওয়া, বাদ পড়ে যাওয়া মানুষদের কাতারে।
.
৯।
বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চা, সাহিত্য সমালোচনা, কোন সাহিত্যিককে মূলধারায় তুলে আনা - ইত্যাদি বিষয় এখনো, অনেকাংশেই পুরুষদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, এটা আমার একটা পর্যবেক্ষণ। নইলে, শাহীন আখতার, যিনি তালাশের মতো, বা আজকে যে উপন্যাসের পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখলাম, সে সখী রঙ্গমালার মতো উপন্যাস লিখেছেন - তিনি আমাদের সাহিত্য আলাপে - আড্ডায় নেই কেন?
.
আমি বরং গর্ববোধ করি, শাহীন আখতার আপা এখনো লিখছেন, এমন একটা সময়ে আমি - আমরাও লিখছি বলে। নারীরা নিজেদের আখ্যান রচনার দায়ভার নিজেদের কাঁধে তুলে না নিলে সর্বদা তারা পুরুষ লেখকদের দ্বারা চিত্রায়িত , ক্ষেত্র বিশেষে অবজেক্টিফাইড হতে থাকবে।
আর তারা সে গুরুভার কাঁধে নিলে ফলাফল হবে তালাশ, পালাবার পথ নেই, অথবা সখী রঙ্গমালার মতো উপন্যাস।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই আগস্ট, ২০২১ বিকাল ৩:২৩

শেরজা তপন বলেছেন: পুরোটা পড়া হল না সময়ের অভাবে ভাই।

লেখকের ব্যাপারে আগ্রহী হলাম- বেশ গুণী লেখক মনে হচ্ছে। তার নামটাই কখনো শুনিনি- সেটা মার জানার সীমাবদ্ধতা।
ধন্যবাদ শেয়ার করার জন্য

১৪ ই আগস্ট, ২০২১ বিকাল ৩:৫৪

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: ধন্যবাদ তপন ভাই। ওনার তালাশ উপন্যাসটা পড়তে পারেন। আমার মতে এটা ওনার সেরা কাজ। মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গদেশে নারীদের ওপর কি ভূমিকা রেখেছিল, বীরাঙ্গনাদের পরে কি অবস্থা হয় - তালাশের মতো আর কোন লেখায় এসমস্ত সেনসিটিভ বিষয় আনুপুঙ্খিকভাবে ফুটে ওঠে নি। শুভেচ্ছা আপনার জন্য।

২| ১৪ ই আগস্ট, ২০২১ বিকাল ৪:০৫

শেরজা তপন বলেছেন: ওক্কে আমি চেষ্টা করব বইটি সংগ্রহ করে পড়তে।
আপনি ব্লগে ইদানিং ভীষন অনিয়মিত-কেন?

১৪ ই আগস্ট, ২০২১ বিকাল ৫:৫৮

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: আপনার প্রশ্নের জন্যে ধন্যবাদ, ভাই। নিজের কথাসাহিত্যে সময় বেশি দিই। প্রতিদিন লেখালিখির জন্যে বরাদ্দ সময়টুকুর পুরোটাই প্রায় যায় আমার আপকামিং উপন্যাসটার ঝাড়ামোছায়। ব্লগের লেখাগুলি ফলো করি, আলোচনায় এঙ্গেজ করবার মতো লেখা, বা মানসিকতার ব্লগার পাই কম। উত্তেজক লেখাগুলির তৎক্ষণাৎ জবাব দেয়ার প্রবণতা আগে ছিল। এখন আর তা ভালো লাগে না। বিশেষত, যদি আমার বিবেচনায় লেখার উদ্দেশ্য অসৎ মনে হয়, তাহলে তা আর ভেতরে পড়ার, বা জবাব দেয়ার তাড়না তৈরি করে না। তবে ব্লগের জন্যে বেশ কিছু নন ফিকশন লেখার পরিকল্পনা আছে। সেগুলি আস্তে আস্তে শেয়ার করবো। রকমারিতে আপনার সোভিয়েত ইউনিয়নের অভিজ্ঞতা নিয়ে যে বইটা আছে, ওটা কিনি নাই এখনো, তবে প্রিভিউ পড়লাম। খুব পরিণত গদ্য। আপনার বাবনিক সে অনুপাতে তুলনামূলক অযত্নের সাথে লেখা। বাক্য বিন্যাস, শব্দচয়ন, বানানের দিক থেকে। যত্ন সহ এডিট করলে শেষমেশ ভালো কিছুতে পরিণত হবে আশা রাখি। ভালো থাকবেন! : )

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.