নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
জাহাজে চাকরীর সুবাদে প্রচুর বন্দর শহর ইত্যাদি ঘোরা হয়। এর মধ্যে চায়নীজ পোর্টও । চায়নীজ পোর্ট বলতে বুঝাচ্ছি মেইনল্যান্ড চায়না বা পিপল্স রিপাবলিক অফ চায়না (PRC)। চীনের দক্ষিনের ছোট্ট দ্বীপ ফরমোজা যার বর্তমান নাম তাইওয়ান (রিপাবলিক অফ চায়না বা ROC)। মেইনল্যাণ্ড চায়না তাইওয়ানকে সব সবময় তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবী করে আসলেও তাওয়ান সম্পুর্ণ সার্বভৌম রাজ্য হিসেবে দেশ চালিয়ে আসছে এবং মেইনল্যাণ্ড চায়নাকে তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবী করে আসছে। যদিও চায়না এবং তাইওয়ানের সবাই চায়নীজ, রাজনৈতিক কারনে এখন দুই মেরুর বাসিন্দা।
যাই হোক, পৃথিবীর বহুদেশ, বহু শহর-বন্দর ঘুরে একটা কমন দুঃখ পেতাম তা হল "বাংলাদেশ? কোথায়?"। অর্থাৎ বাংলাদেশ নামের একটা দেশ, বাংলাদেশী নামের একটা জাতি আছে সেটা অনেক দেশের মানুষ জানেই না। অথচ সবাই ইণ্ডিয়া-পাকিস্তান চেনে। দুঃখ লাগবেনা? কিন্তু চায়নাতে গিয়ে মধুর অভিজ্ঞতা হয়েছে, ভালো লেগেছে।
আমার জীবনের প্রথম চায়নীজ পোর্ট ছিন্হুয়াংদাও। ছিন্হুাংদাও'র অবস্থান মেইনল্যাণ্ড চায়নার উত্তর-পূর্বে। সেখান থেকে দক্ষিন কোরিয়ার ইনচোন পোর্ট হয়ে আবার গেলাম চীনর ডালিয়ানে। ম্যাণ্ডারিন ভাষায় চায়নীজরা বাংলাদেশকে ওরা বলে “মুংজালা’গুঅ”। 'গুঅ' মানে দেশ। উদাহরণ, আমেরিকা:- মেইগুঅ, ইংল্যাণ্ড:- ইংগুঅ। কিন্তু ইণ্ডিয়াকে বলে ‘ইন্দো’ আর পাকিস্তানকে কি বলে বুঝিনা, ‘বাজিস্-থ্যায়’ ধরনের আওয়াজ শুনি।
গতবার ছিন্ হুয়াংদাও ডাউনটাউনের একটা শপে এটা ওটা দেখছিলাম। সেখানে একপাশে দেয়ালে চায়নীজ লীডারদের ছোট বড় অনেক পেপারকাট ছবি লাগানো (এরকম আরো দেখেছি)। মাও সেতুং থেকে শুরু করে দেং শিয়াও পিং। কোথাও সিঙ্গেল, কোথাও গ্রুপ বা কোথাও মিটিং বা সফরের ছবি। বাংলাদেশী বলতেই মাঝ বয়েসি দোকানদার ভদ্রলোকছিয়া ছিয়া করতে লাগলো, কি খুশী! ঘটনা কি? একটা ছবিতে আংগুল রেখে আবার বলে, “ছিয়া, ছিয়া! মুংজালা’গুঅ”। এমন করে ক্যান্? সাদাকালো একটা ছবি, চাইনীজ নিউজপেপার থেকে কেটে বসানো। চারজন মানুষ, কোন বৈঠকের ছবি। আমি বেয়াক্কেলের মত ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে সে যেন তাজ্জব হয়ে গেলো। বাঁ দিকের ছবিটার উপর প্রানপনে আঙ্গুল দিয়ে বাড়ি দিয়ে বলে,
“ছিয়া, ছিয়া..!”
তারপর নিজের দুহাত একসাথ করে বলে,
“ছিয়া, শি পাংইয়ো। মুংজালা’গুঅ, ছুং’গুঅ, শি পাংইয়ো!”
ততদিনে অল্পস্বল্প চাইনীজ রপ্ত হয়েছে। ও যা বলছিলো তার বাংলা হল,
“ছিয়া বন্ধু, বাংলাদেশ আর চায়না বন্ধু।”
ছবিটা ভালোমত দেখে অবাক আমি। বাঁ দিকের ছবিতে ওটা জিয়াউর রহমান। পুরোনা, সাদাকালো বিবর্ণ ছবি হওয়ায় প্রথম দেখায় বোঝা যাচ্ছিলোনা। মেজাজ খারাপ হল, ‘জিয়া’-কে কুৎসিতভাবে ছিয়া ছিয়া করছে কেন? সামনের ডানদিকের ছবি দেখিয়ে বললো, “হোঁয়া গু’ফোং!” হুম, এবার বুঝলাম। কোন এক রাষ্ট্রীয় সফরে তৎকালীন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট (কিংবা সামরিক প্রধান) জিয়াউর রহমান চীন সফরে এসেছিলো, তখন চীনের প্রেসিডেন্ট হুয়া-কুও-ফেং। এটা তাদের বৈঠকের ছবি। পেছনে কলম আর নোটবুক হাতে ওরা দুজন দোভাষী।
(জিয়াউর রহমান এবং হুয়া-কুয়ো ফেং - পিকিং, জানুয়ারী, ১৯৭৭)
বাংলাদেশ নিয়ে এক অজানা চীনে নাগরিকের এই আবেগের বহিপ্রকাশের অভিজ্ঞতা ছিলো আমার জন্য প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ। সুদুর চীন দেশের কোন এক শহরে দোকানের দেয়ালে আমার দেশের নেতার ছবি বসিয়ে রেখেছে এক দোকানী। এত বছর পর নামও মনে রেখেছে। জিয়াকে ‘ছিয়া’ বলার দুঃখ আর রইলোনা। এই বিশেষ অভিজ্ঞতা আমার জন্য, আমার দেশের জন্য সম্মানের। ক্যামেরা থাকলে ছবি তুলে রাখতাম।
জিয়াউর রহমান কখনো চায়না নিয়ে কিছু লিখেছেন বলে শুনিনি তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ‘আমার দেখা নয়াচীন’ পড়েছি এবং আবেগে আপ্লুত হয়েছি। (১৯৫৪ সালে জেলে বন্দী অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর লেখা ডায়েরী থেকে নেয়া একটা সংকলন)। ডায়েরীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন,
“জেলে থাকতে ভাবতাম, আর মাঝে মাঝে মাওলানা ভাসানী সাহেবও বলতেন, যদি সুযোগ পাও একবার চীন দেশে যেও”।
(১৯৫৭ সালে তৎকালীন নয়াচীনের মহান নেতা চেয়ারম্যান মাও সে তুং এর সংস্পর্শে এসেছিলেন তরুন বঙ্গবন্ধু।)
চায়নীজদের নিয়ম শৃংখলা এবং সাধারণ মানুষের বিপ্লবী গণচীন সরকারের প্রতি অগাধ আস্থা আর বিশ্বস্ততা দেখে তিনি অভিভূত হয়েছিলেন। ১৯৫২ সালে আজকের সোশালিষ্ট কমিউনিষ্ট চায়না’র বয়স যখন মাত্র তিন, তরুণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চীন সফরে গিয়েছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে। শান্তি সম্মেলনে। তখন তাঁর বয়স মাত্র বত্রিশ। চীনের নাম তখন গণচীন হলেও পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে নতুন কমিউনিষ্ট চায়নার নাম ‘নয়াচীন’। বঙ্গবন্ধুও একে নয়াচীন বলেই সম্মোধন করেছেন। মহান নেতা মাও সে তুং তখন পূর্ণমাত্রায় গণচীনকে নতুন করে গড়ে তুলছেন। এই সবই প্রত্যক্ষ করেছেন তরুন বঙ্গবন্ধু।
আশ্চর্য্য, বিমোহিত এবং শিহরিত হয়েছেন নতুন এই দেশ, দেশের মানুষ, নয়াচীনের নয়া পরিবেশ, তাদের সরল্য, সততা, ত্যাগ এবং দেশের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা দেখে। তাঁর ডায়েরীতে তিনি একাধিকবার বলেছিলেন যে এই গরীব নয়াচীন অনেক উন্নতি করবে।
বঙ্গবন্ধুর ভবিষ্যৎবানী অক্ষরে অক্ষরে ফলেছে। শুধু তাই নয় বিদায় বেলায় বঙ্গবন্ধু অন্তর থেকে নয়াচীনের জন্য দোয়াও করেছিলেন। তিনি গিয়েছিলেন মিয়ানমারের রাজধানী ইয়াংগন থেকে হংকং হয়ে মেইনল্যাণ্ড চায়নার ক্যান্টন (বর্তমান গুয়াংঝোউ), সেখান থেকে পিকিং (বর্তমান বেইজিং), বেইজিংয়ের কাছে চীনের প্রাচীর ‘দ্য গ্রেট ওয়াল’-এর মু তিয়েন ইয়ু স্পট, নানকিং (বর্তমান নানজিং), সাংহাই, হ্যাংচো (বর্তমান হানঝোউ)।
(ছবিতে নীচে হংকংয়ের লাল রংয়ের START পয়েন্ট দ্রষ্টব্য: লাল ডটেড লাইন উপরে উঠে আবার নীচে নেমেছে। ছবির ক্যাপশনে শহরগুলোর নাম আছে)
এসব যায়গার অভিজ্ঞতা পড়ছিলাম আর শিহরনে আমার গায়ের রোম খাড়া হয়ে যাচ্ছিলো, আর আবেগে ভিজে গিয়েছিলো চোখ। এই যায়গা গুলোতে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু এসে ঘুরে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর লেখার বিশেষ প্যাটার্ন তাঁর কথা বলার ভঙ্গির সাথে মিলে যায়। প্রঞ্জল ভাষায় অভিজ্ঞতা যা লিখেছেন প্রায় সব আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার সাথে মিলে গেছে। তরুণ বঙ্গবন্ধু চীন দেখে ইমপ্রেসড হয়েছিলেন ৩২ বছর বয়সে, আমি হয়েছি কুড়িতে। তবে পারিপার্শিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর দেখা নতুন, গরীব নয়াচীনের সাথে আজকের গণচীনের যোজন যোজন ফারাক। আজকের চীন আধুনিক, সমৃদ্ধ, কসমোপলিটন। বিশাল অর্থনৈতিক শক্তি। তবে বঙ্গবন্ধু যেমন দেখেছেন চায়নার সাধারণ জনতা এখনও সেরকম, সরল এবং বন্ধুবৎসল।
“খোদা তুমি এদের মঙ্গল করিও। এরা যেন এদের দেশকে দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেশ হিসাবে গড়ে তুলতে পারে। আর আমাদের দেশকেও যেন আমরা সোনার দেশে পরিবর্তন করতে পারি। আমাদের জনগণও যেন সুখে স্বাচ্ছন্দে বাস করতে পারে। পাশাপাশি দু’টা রাষ্ট্র যেন যার যার আদর্শ নিয়া গড়ে উঠে।”
(১৯৫৪ সালে জেলে বন্দী অবস্থায় লেখা বঙ্গবন্ধুর ডায়েরী থেকে,
চীন ভ্রমন প্রসঙ্গে।) - “ ‘আমার দেখা নয়াচীন’, শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা ৭৮”
তরুন বঙ্গবন্ধু মন থেকে নয়াচীনের চায়নীজদের জন্য, আমাদের দেশ এবং জাতির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন। আল্লাহ্ বঙ্গবন্ধুর দোয়া কবুল করেছেন চায়নীজদের জন্য, আমাদের জন্য এখনও কবুল করেন নি। একদিন আমাদেরও চরিত্রে পরিবর্তন আসবে, তাখন আল্লাহর রহমত হবে, আমরাও চায়নীজদের মত সফল হবো ইনশা আল্লাহ্।
** ** **
২| ২২ শে মার্চ, ২০২৩ বিকাল ৩:৫৭
আফলাতুন হায়দার চৌধুরী বলেছেন: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা। সত্যি বলেছেন। রেকর্ডই বটে।
৩| ২৯ শে মার্চ, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:৪৫
শুভ্রকথা শুভ্রর দিনলিপি বলেছেন: আপনি লিজেন্ড। আপনার ব্লগে ঘুরতে এসে নিজেও লিজেন্ড হয়ে গেলাম।
ভালো থাকবেন।
০৪ ঠা এপ্রিল, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:২৭
আফলাতুন হায়দার চৌধুরী বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা। আমি ছদ্মনামে ২০০৮ থেকে এখানে লেখেছি। সেখানেও অনিয়মিত। এখন আসল নামে অল্পস্বল্প ট্রাই করছি। ভালো থাকবেন। (ছদ্মনামটা এখনউ ক্লাসিফাইড রেখেছি )
৪| ৩১ শে মার্চ, ২০২৩ বিকাল ৩:১৮
গেঁয়ো ভূত বলেছেন: অনেক সুন্দর ভ্রমণ কাহিনী! আরো লিখুন, আমাদের পড়ার সুযোগ করে দিন।
০৪ ঠা এপ্রিল, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:২৮
আফলাতুন হায়দার চৌধুরী বলেছেন: আপনাকে শুভেচ্ছা এবং অনেক ধন্যবাদ। কাজকর্ম, চাকরী বাকরী সব মিলিয়ে হয়ে ওঠেনা। চেষ্টা করবো ভাই। আপনি ভালো থাকুন।
©somewhere in net ltd.
১| ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ বিকাল ৪:৩১
জ্যাক স্মিথ বলেছেন: Oh my my!! আপনার ব্লগের বয়স ১৪ বছর অথচ পোস্ট করেছেন মাত্র একটি, কোন মন্তব্য করেননি, আমিই প্রথম মন্তব্য করলাম আপনার ব্লগে। নিঃসন্দেহে এটি একটি বিশ্ব রেকর্ড।