![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আগের অংশ
৯.
যেভাবে সবকিছু অন্ধকার হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ঠিক সেরকম ভাবেই সবকিছু আলো হয়ে জেগে উঠলাম। ঠিক জেগে উঠলাম কিনা জানি না। কারণ, আমার মুখের উপর একটা মুখ। মাথা ভর্তি রেশমী চুল, সাদা মোমের মতো শরীর, লালচে ঠোঁট। এক দেবশিশু।
নাহ, দেবশিশু না। দেবশিশু হলে চোখে চশমা থাকতো না। কে এই দেবশিশু? মনে আসছে আবার আসছে না। এই পরিস্থিতিটা খুবই অস্বস্তিকর। যেন কোন এক পরিচিত মানুষ হাসিভরা মুখ নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে, অথচ আমি তার নামটাই মনে করতে পারছি না।
উঠে বসতেই দেবশিশু বলল, 'হিমু ভাইয়া, আমি শুভ্র। রূপা আপু আমাকে আপনার খোঁজে পাঠিয়েছে।'
অন্য যে কেউ 'রূপা আপু"-কে উচ্চারণ করবে রূপাপু। কিন্তু শুভ্র খুব সুন্দর করে সময় নিয়ে প্রতিটা শব্দ বলেছে। 'রূপা' তারপর খানিক থেমে 'আপু'।
'আমার খোঁজ কিভাবে পেলে?' আমি খানিকটা বিস্মিত।
'রূপা আপু আপনাকে যে মোবাইলটা দিয়েছেন সেটাতে কল দিয়েছিলেন। এই দোকানদার ভাইয়া ধরেছিল। তিনি ঠিকানা দিয়েছেন। আপু ঠিকানা জেনে আমাকে পাঠিয়েছেন।'
'কতক্ষণ আগে এসেছ?'
'অনেকক্ষণ। আপনি ঘুমিয়েছিলেন দেখে ডাকি নাই। বসে বসে রুবিক্স কিউব মিলাচ্ছিলাম।'
এবার তার হাতে রুবিক্স কিউবটা চোখে পড়ল। আর কোন কথা না বলে শুভ্রকে নিয়ে বেড়িয়ে
পড়লাম। দোকানদার ডেকে বলল, 'হিমু ভাই। আপনার মোবাইলটা নিন।'
'ওটার কাজ শেষ। ওটা আপনার কাছে রেখে দিন। যদি কখনো ওটার দরকার হয় এসে নিয়ে যাব।'
আমি চাই না আমি হারিয়ে গেলে কেউ আমাকে খুঁজে বের করুক। শুভ্রকে নিয়ে রিকশায় উঠলাম। পিছনে শুভ্রের গাড়ি আসতে লাগলো। ড্রাইভারকে বোধহয় শুভর মা রেহানা অথবা তার বাবা ইয়াজউদ্দিন কড়া নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন,যাতে শুভ্র চোখের আড়াল না হয়।
শুভ্র রুবিক্স কিউবটা আমাকে দেখাতে দেখাতে বলছে, 'জানেন ভাইয়া রুবিক্স কিউবের সম্ভাব্য কম্বিনেশন হতে পারে ৪৩,২৫২,০০৩,২৭৪,৪৮৯,৮৫৬,০০০ টি।'
'এত বড় সংখ্যা মনে রেখেছ কি করে?'
'প্রথম প্রথম মনে রাখা কষ্টকর ছিল। সবাইকে বলতে বলতে আত্মস্থ হয়ে গিয়েছে।' বলেই শুভ্র একটা হাসি দিল। অসম্ভব সুন্দর হাসি। একজন মানুষের হাসি এত সুন্দর হয় কি করে?
শুভ্র আবার বলা শুরু করল,এর মানে হলো ৪৩-এর পরে আঠারোটা শূন্য বসালে যে সংখ্যা হয়, ঠিক তত রকম চাল আছে নাকি রুবিক্স কিউবের খেলায়। সবচেয়ে কম ২০টি ধাপেই এর সমাধান সম্ভব। কেউ সাড়ে পাঁচ সেকেন্ডে, কেউ বা আবার দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে চেষ্টা করে রুবিক্স কিউবের সমাধান করেছেন। আমি ইউটিউবে টিউটোরিয়াল দেখে আড়াই ঘণ্টায় শিখেছি।'
'তাই নাকি? তোমার চুলগুলো খুব সুন্দর।'
'হি হি হি। জানেন, ৮২৯ থেকে ৮৪২ সাল পর্যন্ত পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য শাসন করেন সম্রাট থিওফিলাস। ৮৪০ সালের দিকে মাথার সব চুল হারিয়ে একেবারে টাক হয়ে গেলেন সম্রাট। তারপরই তিনি তাঁর রাজ্যের সব পুরুষ, নারী আর বাচ্চাকে চুল ফেলে ন্যাড়া হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। এই আদেশ অমান্য করার শাস্তি কি ছিল জানেন! মৃত্যুদণ্ড। কি ভয়ংকর। তাই না ভাইয়া?'
'হুম।'
'জানেন ভাইয়া, ১৯৩৮ সালে টাইম ম্যাগাজিন অ্যাডলফ হিটলার কে “ম্যান অফ দা ইয়ার” নির্বাচন করে।'
'হুম'
'জানেন ভাইয়া...'
'হ্যাঁ রে ভাই, সব জানি। চুপ কর।'
শুভ্র চুপ হয়ে গেল। বেচারা কথা বলার মানুষই পায় না। আমাকে পেল, আমিও তাকে চুপ করে দিলাম। কিন্তু তাতে শুভ্র মন খারাপ করে নাই। মন খারাপ করলে মানুষের মুখাবয়বে যেসব পরিবর্তন হয় সেরকম কোন পরিবর্তন নেই। এরকম ঘটে কেবল শিশুদের বেলায়। তাদের কোন কিছুতেই মন খারাপ হয় না। তারা সবকিছুতেই আনন্দ খুঁজে পায়।
মানুষ যত বড় হয় সে তত বেশি মন খারাপ করা শিখে। সবচেয়ে বেশি মন খারাপ করা শেখে কিশোর বয়সে। এই মন খারাপকে বেগ দেয় আবেগ। এই আবেগের বাতাসে উড়ে তারা নানা কান্ড ঘটায়। যার বেশিরভাগই প্রেম বিষয়ক।
শুভ্র মনে হয় না কখনো বড় হবে। এই শিশুমন নিয়েই তার এই পৃথিবী একসময় অন্ধকার হয়ে যাবে। একজন অন্ধ মানুষের চেয়ে দুঃখী হয়তো কেউ নয়। আবার তার মতো সুখীও কেউ নয়। তাকে অন্যায় দেখে আমাদের অন্ধ সাঁজতে হয় না। সে এমনিতেই অন্ধ।
হাজার লোকের ভীড়ে আমি যেন কাউকে দেখলাম। এ হলো ঘুমিয়ে পড়ার আগে ময়ূরাক্ষীর তীরে দেখা সেই নারী। এবার আমি তাকে চিনেছি। এখন দ্রুত মিসির আলির কাছে যেতে হবে। একটা চাপ কমে যাওয়ায় আমার বেশ আনন্দ হতে লাগলো। আনন্দের চোটে আমি শুভ্রকে বললাম, 'তুমি আর কি কি জানো?'
শুভ্র শিশুর মতো উৎসাহ নিয়ে বলতে লাগলো, 'জানেন ভাইয়া...'
হ্যাঁ, আমি জানি। স্রষ্টা ভুল করে মাঝে মাঝে এঞ্জেল পাঠিয়ে দেয়। তুমি হলে সেই সুন্দর ভুল। শুভ্র বলেই চলেছে 'জানেন ভাইয়া...', আমিও 'হুম' বলেই চলেছি।
গন্তব্যে প্রায় এসে গিয়েছি।
১৭.১১.১৪
(চলবে)
©somewhere in net ltd.