নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

স্বাপ্নিক এই আমি

আমি কাল্পনিক সজল

আমি মানুষ হিসেবে খুবই সরল কারণ আমার মনে অত্যাধিক প্যাঁচ।

আমি কাল্পনিক সজল › বিস্তারিত পোস্টঃ

ধারাবাহিক ফ্যান ফিকশনঃ হিমু,মিসির আলী ও অন্যান্য...(ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ অংশ)

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ১:৫৩

আগের অংশ

১৫.

মৃতা সবিতার খোঁজে রাস্তায় নেমেই পড়লাম। প্রচণ্ড রোদ উঠেছে। তার মাঝেই খালি পায়ে হাঁটছি। মিসির আলির বাসা থেকে বের হয়েছি আধা ঘন্টা হয়ে গেল। মাথা ঘুরছে। আচ্ছা,এই পিচগলা গরমে পিচঢালা রাস্তায় হাঁটলে কেমন লাগবে? অত ভেবে লাভ নেই। ভাবা মানেই সময় নষ্ট। যেই ভাবা সেই কাজ। পিচঢালা রাস্তায় নেমে পড়লাম।

আগুন গরম রাস্তা। পায়ের পাতায় ফোস্কা পড়ে যাবে। যেই না লাফ দিয়ে রাস্তা থেকে সরে যাচ্ছি, অমনি কে যেন ধাক্কা দিল। একটা ঘূর্ণি খেয়ে সামনের দিকে তাকাতেই দেখি একটা লেগুনা। থেমে গিয়েছে। বোধহয় স্যরি বলার জন্য থেমেছে।

কিন্তু যাত্রীরাও কেন নামছে? আমি কেন পড়ে যাচ্ছি? সবকিছু কেন ঘোলা দেখছি? সবকিছু অন্ধকার হয়ে যাবার আগে শুনলাম, 'ধর,ধর। এক্কেরে মাইরা দিছে। শালা লেগুইন্নার বাচ্চা। হাসপাতালে নেওয়া...'

আমি নিজেকে ময়ূরাক্ষীর তীরে পেলাম। আমি বালুতীরে বসে আছি। প্যান্ট হাঁটুর নিচ থেকে গোটানো। আমার পাশে একটা কাঠের চেয়ার। পাশে চেয়ার থাকতে আমি কেন বালুতে বসে? এই নদীতীরেই বা কেন একটা চেয়ার রাখা। আবার চেয়ারের দিকে তাকালাম। সেটা এখন আর ফাঁকা নেই। সবিতা বসে আছে।

সবিতা নীল রঙের পাড় দেওয়া গাঢ় বেগুনী রঙের শাড়ী পড়ে আছে। কপালের টিপটাও বেগুনী, কানের দুলের পাথরটাও বেগুনী রঙের। কোলের উপর হাত রেখে বসে আছে। কাচের চুড়ি, সেটাতে নীল আর বেগুনী রঙের চুড়ি।

'আমাকে খুঁজছেন?'

'কি? হুম, হ্যাঁ... খুঁজছি।'

'তাই আমি এলাম। বলেন কেন খুঁজছেন?'

'এমনি খুঁজছি।'

'আপনি তো এমনি এমনি কাউকে খোঁজেন না।'

'খুঁজি। যারা আমাকে খোঁজে না আমি তাদের এমনি এমনি খুঁজি।'

'আপনি কি জানেন আমি আকাশের কোনটা তারা হয়েছি?'

'আমি আকাশ চিনি না।'

'বাদলও চেনে না। কিন্তু সে ঠিক বের করেছে। জানেন,আমার সাথে ও অনেক কথা বলে।'

'কি কথা বলে?'

'তা তো জানি না। এতদূর থেকে কি আর কথা শোনা যায়? হি হি হি।'

'তোমার হাসি সুন্দর।'

'আমার দাঁত সুন্দর। হি হি হি।'

'মুনাপু কোথায়?'

'আপনাকে একটা কাহিনী বলি। তারিখটা ২০০৭ সালে ৭ এপ্রিল। জীর্ণ শীর্ণ পোশাকে এক লোক ওয়াশিংটন ডি.সির মেট্রো স্টেশনে বসে ভায়োলিন বাজাচ্ছিল। তিনি প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে "সিক্স ব্যাচ পিসেস" বাজাচ্ছিলেন।

সেসময়টার হিসাব করে দেখা যায় প্রায় ১,১০০ জন মানুষ তখন স্টেশনে যাতায়াতরত অবস্থায় ছিল।

তিন মিনিট পর একজন মধ্যবয়স্ক লোক লক্ষ্য করলো একজন ভিক্ষুক মিউজিশিয়ান ভায়োলিন বাজাচ্ছে। তিনি একটু থেমে গেলেন। পরক্ষনেই গতি বাড়িয়ে দিলেন কাজে যাবার জন্য।

১ মিনিট পর ভায়োলিনিস্ট একজন ভদ্রমহিলার কাছ থেকে ১ ডলার টিপ পেলেন। এমন না যে মহিলাটি তার সঙ্গীতে মুগ্ধ হয়ে ডলারটা দিয়েছিল, সে ছিল ব্যস্ত এবং অনেকটা দয়াবশত তিনি মিউজিশিয়ানকে ডলারটি দেন।

কিছু সময় পর একজন দেয়ালে হেলান দিয়ে ভায়োলিনিস্ট এর সুর শুনলেন। হঠাৎ তিনি তার ঘড়ির দিকে তাকালেন। তারপর তার কাজের জন্য রওনা দিলেন।

এই মিউজিশিয়ানের প্রতি সবথেকে বেশী আকর্ষিত হয়েছিল কে জানেন? একটি ৩ বছরের ছেলে। কিন্তু তার মা তাকে বারবার টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, আর ৩ বছরের ছেলেটি বারবার ভায়োলিনিস্ট এর দিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিল।

শেষে তার মা তাকে জোরে ধাক্কা দিয়ে টেনে নিয়ে চললো। আজব ব্যাপার এই ঘটনাটা অন্যসকল বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও ঘটছিল। তারা সেই ভায়োলিনের সুরে কিছু একটা খুঁজে পেয়েছিল।

এইযে ৪৫ মিনিট মিউজিশিয়ান ভায়োলিন বাজান,তাতে স্টেশনে মাত্র ৬ জন লোক থেমেছিলেন এবং তার শুনেছিলেন। ২০ জন তাকে ডলার দিয়েছিলেন, কিন্তু তারা ব্যস্ত ছিলেন, তাই ভায়োলিনিস্টের সুর তারা অত খেয়াল করে শোনেন নি।

ভায়োলিনিস্ট ৩২ ডলার পান।

যখন তিনি বাজানো শেষ করলেন,তখন সবকিছু নিস্তব্ধ হয়ে যায়, কেউ তাকে খেয়ালও করে না। কেউ হাত তালিও দেয়নি কিংবা দেয়নি স্টান্ডিং অভিয়েশন।

কেউই খেয়াল করে নি, জীর্ণ শীর্ণ পোশাকের সেই ভায়োলিনিস্ট ছিলেন জশুয়া বেল,পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বেহালাবাদকদের একজন।

কেবল শিশুরা সুরের মোহনীয়তা ধরতে পেরেছিল। অথচ শিশুদের বিচারবুদ্ধিকে আমরা কতোই না হেলা করি।'

'মুনাপু কোথায়?'

'আপনাকে জেগে উঠতে হবে।'

'মুনাপু কোথায়?'

'হিমু, হিমু...'

আমি সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে বললাম, 'মুনাপু কোথায়?' কিন্তু কেবল গোঙানির আওয়াজ বের হল।

আবার কেউ ডাকলো, 'হিমু, হিমু, চোখ খোল...'

আমি চোখ খুললাম। আলোর তীব্রতায় চোখ প্রায় অন্ধ হয়ে গেল। চোখ বন্ধ করে আবার খুললাম। অনেক পরিচিত মুখ দেখলাম, বাকের ভাই, মিসির আলি, রূপা, শুভ্র...

মিসির আলিকে ইশারায় ডাকলাম। মিসির আলি তার কান আমার মুখের কাছে নিয়ে এলেন। আমি বললাম, 'মুনা আপু কোথায় তা হয়তো আমি জানি।'

মিসির আলি বললেন, 'কি বলছ, বুঝছি না। রেস্ট নাও।'

আমি আবারো বলার চেষ্টা করলাম। ঠোঁট নড়ছে কিন্তু সব গলায় আটকে যাচ্ছে। তাই মিসির আলি কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। আমি নড়াচড়া করার চেষ্টা করলাম।

কিন্তু সবকিছু আবার অন্ধকার হয়ে এল।


১৬.


একটি সম্পর্কের যে কোন একজনের হাতে স্বর্গ থাকে, অন্যজনের হাত থাকে খালি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই স্বর্গটা থাকে পুরুষদের কাছে। কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় তা নারীদের কাছে। এই স্বর্গ যতটা না দৈহিক তারচেয়েও বেশি আত্মিক।


সম্পর্ক তৈরিই হয় এই স্বর্গের লোভে। শিরি-ফরহাদ, লাইলি-মজনু কিংবা রোমিও-জুলিয়েট যাদের অমর প্রেমগাঁথার কথাই উল্লেখ করা হোক না কেন ঘুরে ফিরে এই স্বর্গের কাছেই ফিরে আসতে হবে।


সম্পর্কের শুরুতে কেউই জানে না কার হাতে স্বর্গ আর কার হাত শূন্য। তাই দুইজনই এই স্বর্গ ভাগাভাগি করে, আর তাই সব সম্পর্কের শুরুটা স্বর্গীয় হয়। সবাই নিজেকে আদম এবং হাওয়া হিসেবে স্বর্গে আবিস্কার করে। কিন্তু খুব দ্রুতই হোক কিংবা খুব দেরিই হোক ইবলিশের আগমন ঘটেই। যার হাতে স্বর্গ সে একসময় সে সেটা বুঝতে পারে সে-ই সেই সম্পর্কের স্বর্গের মালিক আর অন্যজন তার ভৃত্যমাত্র।


যদি না কেউ ইবলিশের দেওয়া আপেল/গন্ধব না খায় তাহলে সম্পর্কটা স্বর্গীয়ভাবেই চলতে থাকে। যদি খেয়ে ফেলে তাহলে অচিরেই বিস্কুট খেলা শুরু হয়। বিস্কুট খেলায় যেমনিভাবে মুখের উপর সুতোয় বিস্কুট নাচতে আর নাচাতে থাকে তেমনিভাবে যার হাতে স্বর্গ থাকে সে অন্যজনকে নাচাতে থাকে মান-অভিমান-ঝগড়া-বিচ্ছেদ ইত্যাদি নামে। অপরদিকে শূন্যহাতের মানুষটি স্বর্গের জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকে। ডুবন্ত মানুষ বাতাসের জন্য যেমনটা করে।


মানুষ স্বর্গ থেকে বিতারিত হওয়ার পর থেকেই এই বিষয়টা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে। ভারসাম্য রক্ষা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তাই মানুষ একটা প্রথা তৈরি করল যাতে এই স্বর্গ দুজনের মাঝেই ভারসাম্য পায়। এই প্রথাটা হল বিয়ে। এটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সফল প্রথা যেখানে নারী-পুরুষ বাধ্য নিজের স্বর্গকে ভাগাভাগি করতে।


ইবলিশও কিন্তু স্বর্গ ছেড়ে মর্ত্যে এসেছে। সে কি বসে থাকবে? সেও কিছু প্রথা বানালো যেগুলো উপরে ফিটফাট ভিতরে সদরঘাট। চায়না সেলফোন আর কি। সাধ্যের মাঝে সবটুকু দুখ। প্রথাগুলো মাঝে ফর্সা বদন, কৃষ্ণ মদন, রাত্রি যাপন, অর্থ কাঁপন, কর্পোরেট জীবন অন্যতম।


হিমুদের তাই স্বর্গলোভী হওয়া চলে না। তাদের হতে হয় নরকলোভী। ইবলিশ নরকে থাকে, হিমুরাও নরকে থাকে। তাদের মাঝে একটা দোস্ত দোস্ত ভাব চলে আসে। ইবলিশ তখন তাদের আর ঘাটায় না। এই সুযোগে তাঁরা খুব সহজেই কিছু নরকবাসীকে স্বর্গীয় আনন্দ বিলি করে। হিমুদের কাজ আনন্দ করা না, বরং তা বিলি করা।

তাইতো হাসপাতাল থেকে দুইদিনের মাথায় বেড়িয়ে এসেছি। হাসপাতালে এপ্রোন পড়া হুরপরীর আনাগোনা বেশি, ওখানে হিমুদের জন্য থাকা বিপদজনক। স্বর্গলাভের মনোবাসনার উদ্রেগ ঘটতে পারে। তাই চলে এসেছি, বেশিদূর আসতে পারিনি, পিজি থেকে সেগুনবাগিচা। সন্ধ্যা নেমেছে অনেক আগেই। শিল্পকলা একাডেমির এই পথটাকে আমি হিমুরোড নাম দিয়েছি। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোয় এই পথটা আলোকিত, হিমু হিমু ভাব।


আমার সাথে একটা পিচ্চি হিমুও আছে। সে অবশ্য হলুদ পাঞ্জাবী আর খালি পায়ে নেই। পিচ্চিদের জন্য কিছু ছাড় আছে কিনা। পিচ্চি হিমু হলো সবিতার ভাই। সবিতার বাসা থেকে চুপ করে নিয়ে এসেছি। তার হাঁটতে অনেক কষ্ট হলেও সে খুব আগ্রহ নিয়ে চারপাশ দেখছে। গুটিয়ে থাকা আঙ্গুল হাত বাঁকা করে অনেক কসরত করে নানা জিনিসকে নির্দেশ করছে। মুখ দিয়ে লালা পড়ছে অনবরত। অবশ্য সেজন্য বুকে একটা রুমাল বেঁধে দেওয়া আছে। সবিতার ভাই একজন অটিস্টিক শিশু। সে সমাজের ৩.৮% এর একজন।


হাঁটতে হাঁটতে বলছে,'মাআআ আ-মা-আকেএএ বাহিরেবের হতেএএএ দেয়য়য়না,দেয়না। চাঁদ আমাররর খুউউব্ব ভালোওও লাগে,ভাললাগে।' কিছুক্ষণ দম নিয়ে, 'জোজছনা ভালোলাগে। ফুল ভালোলাগে। সবব ভালোলাগে।'


'আপুকে ভালো লাগে না?'


'আপুউউউ, আপু অনেক ভালো। আমাকেএএএ চক চকলেট দেয়। আদর দেয়,দেয়।'


'তোমার আপু এখন কোথায়?'


'ঐইইই যে ওইখানে। ঐ তারাটা।'


'কে বলেছে?'


'আপুউউউ।'


'কখন?'


যখনন চলে গেল। আমাকে বলে গিয়েছে। বলে গিয়েছে।তাকে না পেলে, না পেলে, ঐ তারাটার সাথে কথা বলতে। আপু নাকি এখন তারা, তারা। আমি ডাক দিলেই চলে আসবে, আসবে।'


'তাহলে ডাকো।'


'না, না। আব্বু মারবে, অনেক মারবে, মারবে।'


'মারবে কেন?'


'আপু, আপু আম্মুর শাড়ি গলায় দেয়, দেয়।'


'কেন?'


পিচ্চি হিমু চুপ হয়ে গেল। আমিও চুপ হয়ে গেলাম। এখন চুপচাপ থাকার সময়। এখন চারদিকে শুধু জ্যোৎস্না, এই জ্যোৎস্নায় ভেসে যেতে হবে বহুদূর। আমি বসে পড়লাম, পিচ্চি হিমুও বসে পড়লো।


'ভাইয়া।'


'বল।'


'আপু।'


'কোথায়? আকাশে?'


'না।'


'তাহলে?'


'উখানে, উউউউখানে।'


পিচ্চি হিমু গুটানো আঙ্গুল যে কোনদিক দেখাচ্ছে কে জানে। নিশ্চয়ই দৃষ্টিভ্রম। নাহ, তাহলে আমিও তাকে দেখছি কেন? সবিতা এক হাত নাড়ছে। তার ভাইও নাড়ছে। আজব।


স্বর্গের লোভ কেউ ছাড়তে পারে না। পিচ্চি হিমুও পারছে না, সবিতাও পারছে না। স্বর্গ কেবল নারী-পুরুষের প্রেমের তাজমহলেই থাকে না, থাকে মা-সন্তানের মাঝে, থাকে বাবা-সন্তানের মাঝে, থাকে ভাই-বোনের পাগল ভালোবাসার মাঝে, থাকে পিচ্চি হিমু আর সবিতার মাঝে।


সবিতা যেন বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে, জ্যোৎস্নায় ভরে যাচ্ছে চারপাশ। একটা তারা যেন জ্বলে উঠল। পিট পিট করে জ্বলছে।


পিচ্চি হিমু আকাশের দিকে দুইহাত তুলে বলছে,'আপু, আমি যাব।'


পিচ্চি হিমুর চোখ জলে ভিজে যাচ্ছে। আমার চোখেও যেন কি পড়ল। ধেৎ। হিমুরা নরকলোভী, তাদের কি স্বর্গলোভী হলে চলে?


(চলবে)



১৫.


মৃতা সবিতার খোঁজে রাস্তায় নেমেই পড়লাম। প্রচণ্ড রোদ উঠেছে। তার মাঝেই খালি পায়ে হাঁটছি। মিসির আলির বাসা থেকে বের হয়েছি আধা ঘন্টা হয়ে গেল। মাথা ঘুরছে। আচ্ছা,এই পিচগলা গরমে পিচঢালা রাস্তায় হাঁটলে কেমন লাগবে? অত ভেবে লাভ নেই। ভাবা মানেই সময় নষ্ট। যেই ভাবা সেই কাজ। পিচঢালা রাস্তায় নেমে পড়লাম।

আগুন গরম রাস্তা। পায়ের পাতায় ফোস্কা পড়ে যাবে। যেই না লাফ দিয়ে রাস্তা থেকে সরে যাচ্ছি, অমনি কে যেন ধাক্কা দিল। একটা ঘূর্ণি খেয়ে সামনের দিকে তাকাতেই দেখি একটা লেগুনা। থেমে গিয়েছে। বোধহয় স্যরি বলার জন্য থেমেছে।

কিন্তু যাত্রীরাও কেন নামছে? আমি কেন পড়ে যাচ্ছি? সবকিছু কেন ঘোলা দেখছি? সবকিছু অন্ধকার হয়ে যাবার আগে শুনলাম, 'ধর,ধর। এক্কেরে মাইরা দিছে। শালা লেগুইন্নার বাচ্চা। হাসপাতালে নেওয়া...'

আমি নিজেকে ময়ূরাক্ষীর তীরে পেলাম। আমি বালুতীরে বসে আছি। প্যান্ট হাঁটুর নিচ থেকে গোটানো। আমার পাশে একটা কাঠের চেয়ার। পাশে চেয়ার থাকতে আমি কেন বালুতে বসে? এই নদীতীরেই বা কেন একটা চেয়ার রাখা। আবার চেয়ারের দিকে তাকালাম। সেটা এখন আর ফাঁকা নেই। সবিতা বসে আছে।

সবিতা নীল রঙের পাড় দেওয়া গাঢ় বেগুনী রঙের শাড়ী পড়ে আছে। কপালের টিপটাও বেগুনী, কানের দুলের পাথরটাও বেগুনী রঙের। কোলের উপর হাত রেখে বসে আছে। কাচের চুড়ি, সেটাতে নীল আর বেগুনী রঙের চুড়ি।

'আমাকে খুঁজছেন?'

'কি? হুম, হ্যাঁ... খুঁজছি।'

'তাই আমি এলাম। বলেন কেন খুঁজছেন?'

'এমনি খুঁজছি।'

'আপনি তো এমনি এমনি কাউকে খোঁজেন না।'

'খুঁজি। যারা আমাকে খোঁজে না আমি তাদের এমনি এমনি খুঁজি।'

'আপনি কি জানেন আমি আকাশের কোনটা তারা হয়েছি?'

'আমি আকাশ চিনি না।'

'বাদলও চেনে না। কিন্তু সে ঠিক বের করেছে। জানেন,আমার সাথে ও অনেক কথা বলে।'

'কি কথা বলে?'

'তা তো জানি না। এতদূর থেকে কি আর কথা শোনা যায়? হি হি হি।'

'তোমার হাসি সুন্দর।'

'আমার দাঁত সুন্দর। হি হি হি।'

'মুনাপু কোথায়?'

'আপনাকে একটা কাহিনী বলি। তারিখটা ২০০৭ সালে ৭ এপ্রিল। জীর্ণ শীর্ণ পোশাকে এক লোক ওয়াশিংটন ডি.সির মেট্রো স্টেশনে বসে ভায়োলিন বাজাচ্ছিল। তিনি প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে "সিক্স ব্যাচ পিসেস" বাজাচ্ছিলেন।

সেসময়টার হিসাব করে দেখা যায় প্রায় ১,১০০ জন মানুষ তখন স্টেশনে যাতায়াতরত অবস্থায় ছিল।

তিন মিনিট পর একজন মধ্যবয়স্ক লোক লক্ষ্য করলো একজন ভিক্ষুক মিউজিশিয়ান ভায়োলিন বাজাচ্ছে। তিনি একটু থেমে গেলেন। পরক্ষনেই গতি বাড়িয়ে দিলেন কাজে যাবার জন্য।

১ মিনিট পর ভায়োলিনিস্ট একজন ভদ্রমহিলার কাছ থেকে ১ ডলার টিপ পেলেন। এমন না যে মহিলাটি তার সঙ্গীতে মুগ্ধ হয়ে ডলারটা দিয়েছিল, সে ছিল ব্যস্ত এবং অনেকটা দয়াবশত তিনি মিউজিশিয়ানকে ডলারটি দেন।

কিছু সময় পর একজন দেয়ালে হেলান দিয়ে ভায়োলিনিস্ট এর সুর শুনলেন। হঠাৎ তিনি তার ঘড়ির দিকে তাকালেন। তারপর তার কাজের জন্য রওনা দিলেন।

এই মিউজিশিয়ানের প্রতি সবথেকে বেশী আকর্ষিত হয়েছিল কে জানেন? একটি ৩ বছরের ছেলে। কিন্তু তার মা তাকে বারবার টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, আর ৩ বছরের ছেলেটি বারবার ভায়োলিনিস্ট এর দিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিল।

শেষে তার মা তাকে জোরে ধাক্কা দিয়ে টেনে নিয়ে চললো। আজব ব্যাপার এই ঘটনাটা অন্যসকল বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও ঘটছিল। তারা সেই ভায়োলিনের সুরে কিছু একটা খুঁজে পেয়েছিল।

এইযে ৪৫ মিনিট মিউজিশিয়ান ভায়োলিন বাজান,তাতে স্টেশনে মাত্র ৬ জন লোক থেমেছিলেন এবং তার শুনেছিলেন। ২০ জন তাকে ডলার দিয়েছিলেন, কিন্তু তারা ব্যস্ত ছিলেন, তাই ভায়োলিনিস্টের সুর তারা অত খেয়াল করে শোনেন নি।

ভায়োলিনিস্ট ৩২ ডলার পান।

যখন তিনি বাজানো শেষ করলেন,তখন সবকিছু নিস্তব্ধ হয়ে যায়, কেউ তাকে খেয়ালও করে না। কেউ হাত তালিও দেয়নি কিংবা দেয়নি স্টান্ডিং অভিয়েশন।

কেউই খেয়াল করে নি, জীর্ণ শীর্ণ পোশাকের সেই ভায়োলিনিস্ট ছিলেন জশুয়া বেল,পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বেহালাবাদকদের একজন।

কেবল শিশুরা সুরের মোহনীয়তা ধরতে পেরেছিল। অথচ শিশুদের বিচারবুদ্ধিকে আমরা কতোই না হেলা করি।'

'মুনাপু কোথায়?'

'আপনাকে জেগে উঠতে হবে।'

'মুনাপু কোথায়?'

'হিমু, হিমু...'

আমি সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে বললাম, 'মুনাপু কোথায়?' কিন্তু কেবল গোঙানির আওয়াজ বের হল।

আবার কেউ ডাকলো, 'হিমু, হিমু, চোখ খোল...'

আমি চোখ খুললাম। আলোর তীব্রতায় চোখ প্রায় অন্ধ হয়ে গেল। চোখ বন্ধ করে আবার খুললাম। অনেক পরিচিত মুখ দেখলাম, বাকের ভাই, মিসির আলি, রূপা, শুভ্র...

মিসির আলিকে ইশারায় ডাকলাম। মিসির আলি তার কান আমার মুখের কাছে নিয়ে এলেন। আমি বললাম, 'মুনা আপু কোথায় তা হয়তো আমি জানি।'

মিসির আলি বললেন, 'কি বলছ, বুঝছি না। রেস্ট নাও।'

আমি আবারো বলার চেষ্টা করলাম। ঠোঁট নড়ছে কিন্তু সব গলায় আটকে যাচ্ছে। তাই মিসির আলি কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। আমি নড়াচড়া করার চেষ্টা করলাম।

কিন্তু সবকিছু আবার অন্ধকার হয়ে এল।


১৬.


একটি সম্পর্কের যে কোন একজনের হাতে স্বর্গ থাকে, অন্যজনের হাত থাকে খালি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই স্বর্গটা থাকে পুরুষদের কাছে। কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় তা নারীদের কাছে। এই স্বর্গ যতটা না দৈহিক তারচেয়েও বেশি আত্মিক।


সম্পর্ক তৈরিই হয় এই স্বর্গের লোভে। শিরি-ফরহাদ, লাইলি-মজনু কিংবা রোমিও-জুলিয়েট যাদের অমর প্রেমগাঁথার কথাই উল্লেখ করা হোক না কেন ঘুরে ফিরে এই স্বর্গের কাছেই ফিরে আসতে হবে।


সম্পর্কের শুরুতে কেউই জানে না কার হাতে স্বর্গ আর কার হাত শূন্য। তাই দুইজনই এই স্বর্গ ভাগাভাগি করে, আর তাই সব সম্পর্কের শুরুটা স্বর্গীয় হয়। সবাই নিজেকে আদম এবং হাওয়া হিসেবে স্বর্গে আবিস্কার করে। কিন্তু খুব দ্রুতই হোক কিংবা খুব দেরিই হোক ইবলিশের আগমন ঘটেই। যার হাতে স্বর্গ সে একসময় সে সেটা বুঝতে পারে সে-ই সেই সম্পর্কের স্বর্গের মালিক আর অন্যজন তার ভৃত্যমাত্র।


যদি না কেউ ইবলিশের দেওয়া আপেল/গন্ধব না খায় তাহলে সম্পর্কটা স্বর্গীয়ভাবেই চলতে থাকে। যদি খেয়ে ফেলে তাহলে অচিরেই বিস্কুট খেলা শুরু হয়। বিস্কুট খেলায় যেমনিভাবে মুখের উপর সুতোয় বিস্কুট নাচতে আর নাচাতে থাকে তেমনিভাবে যার হাতে স্বর্গ থাকে সে অন্যজনকে নাচাতে থাকে মান-অভিমান-ঝগড়া-বিচ্ছেদ ইত্যাদি নামে। অপরদিকে শূন্যহাতের মানুষটি স্বর্গের জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকে। ডুবন্ত মানুষ বাতাসের জন্য যেমনটা করে।


মানুষ স্বর্গ থেকে বিতারিত হওয়ার পর থেকেই এই বিষয়টা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে। ভারসাম্য রক্ষা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তাই মানুষ একটা প্রথা তৈরি করল যাতে এই স্বর্গ দুজনের মাঝেই ভারসাম্য পায়। এই প্রথাটা হল বিয়ে। এটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সফল প্রথা যেখানে নারী-পুরুষ বাধ্য নিজের স্বর্গকে ভাগাভাগি করতে।


ইবলিশও কিন্তু স্বর্গ ছেড়ে মর্ত্যে এসেছে। সে কি বসে থাকবে? সেও কিছু প্রথা বানালো যেগুলো উপরে ফিটফাট ভিতরে সদরঘাট। চায়না সেলফোন আর কি। সাধ্যের মাঝে সবটুকু দুখ। প্রথাগুলো মাঝে ফর্সা বদন, কৃষ্ণ মদন, রাত্রি যাপন, অর্থ কাঁপন, কর্পোরেট জীবন অন্যতম।


হিমুদের তাই স্বর্গলোভী হওয়া চলে না। তাদের হতে হয় নরকলোভী। ইবলিশ নরকে থাকে, হিমুরাও নরকে থাকে। তাদের মাঝে একটা দোস্ত দোস্ত ভাব চলে আসে। ইবলিশ তখন তাদের আর ঘাটায় না। এই সুযোগে তাঁরা খুব সহজেই কিছু নরকবাসীকে স্বর্গীয় আনন্দ বিলি করে। হিমুদের কাজ আনন্দ করা না, বরং তা বিলি করা।

তাইতো হাসপাতাল থেকে দুইদিনের মাথায় বেড়িয়ে এসেছি। হাসপাতালে এপ্রোন পড়া হুরপরীর আনাগোনা বেশি, ওখানে হিমুদের জন্য থাকা বিপদজনক। স্বর্গলাভের মনোবাসনার উদ্রেগ ঘটতে পারে। তাই চলে এসেছি, বেশিদূর আসতে পারিনি, পিজি থেকে সেগুনবাগিচা। সন্ধ্যা নেমেছে অনেক আগেই। শিল্পকলা একাডেমির এই পথটাকে আমি হিমুরোড নাম দিয়েছি। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোয় এই পথটা আলোকিত, হিমু হিমু ভাব।


আমার সাথে একটা পিচ্চি হিমুও আছে। সে অবশ্য হলুদ পাঞ্জাবী আর খালি পায়ে নেই। পিচ্চিদের জন্য কিছু ছাড় আছে কিনা। পিচ্চি হিমু হলো সবিতার ভাই। সবিতার বাসা থেকে চুপ করে নিয়ে এসেছি। তার হাঁটতে অনেক কষ্ট হলেও সে খুব আগ্রহ নিয়ে চারপাশ দেখছে। গুটিয়ে থাকা আঙ্গুল হাত বাঁকা করে অনেক কসরত করে নানা জিনিসকে নির্দেশ করছে। মুখ দিয়ে লালা পড়ছে অনবরত। অবশ্য সেজন্য বুকে একটা রুমাল বেঁধে দেওয়া আছে। সবিতার ভাই একজন অটিস্টিক শিশু। সে সমাজের ৩.৮% এর একজন।


হাঁটতে হাঁটতে বলছে,'মাআআ আ-মা-আকেএএ বাহিরেবের হতেএএএ দেয়য়য়না,দেয়না। চাঁদ আমাররর খুউউব্ব ভালোওও লাগে,ভাললাগে।' কিছুক্ষণ দম নিয়ে, 'জোজছনা ভালোলাগে। ফুল ভালোলাগে। সবব ভালোলাগে।'


'আপুকে ভালো লাগে না?'


'আপুউউউ, আপু অনেক ভালো। আমাকেএএএ চক চকলেট দেয়। আদর দেয়,দেয়।'


'তোমার আপু এখন কোথায়?'


'ঐইইই যে ওইখানে। ঐ তারাটা।'


'কে বলেছে?'


'আপুউউউ।'


'কখন?'


যখনন চলে গেল। আমাকে বলে গিয়েছে। বলে গিয়েছে।তাকে না পেলে, না পেলে, ঐ তারাটার সাথে কথা বলতে। আপু নাকি এখন তারা, তারা। আমি ডাক দিলেই চলে আসবে, আসবে।'


'তাহলে ডাকো।'


'না, না। আব্বু মারবে, অনেক মারবে, মারবে।'


'মারবে কেন?'


'আপু, আপু আম্মুর শাড়ি গলায় দেয়, দেয়।'


'কেন?'


পিচ্চি হিমু চুপ হয়ে গেল। আমিও চুপ হয়ে গেলাম। এখন চুপচাপ থাকার সময়। এখন চারদিকে শুধু জ্যোৎস্না, এই জ্যোৎস্নায় ভেসে যেতে হবে বহুদূর। আমি বসে পড়লাম, পিচ্চি হিমুও বসে পড়লো।


'ভাইয়া।'


'বল।'


'আপু।'


'কোথায়? আকাশে?'


'না।'


'তাহলে?'


'উখানে, উউউউখানে।'


পিচ্চি হিমু গুটানো আঙ্গুল যে কোনদিক দেখাচ্ছে কে জানে। নিশ্চয়ই দৃষ্টিভ্রম। নাহ, তাহলে আমিও তাকে দেখছি কেন? সবিতা এক হাত নাড়ছে। তার ভাইও নাড়ছে। আজব।


স্বর্গের লোভ কেউ ছাড়তে পারে না। পিচ্চি হিমুও পারছে না, সবিতাও পারছে না। স্বর্গ কেবল নারী-পুরুষের প্রেমের তাজমহলেই থাকে না, থাকে মা-সন্তানের মাঝে, থাকে বাবা-সন্তানের মাঝে, থাকে ভাই-বোনের পাগল ভালোবাসার মাঝে, থাকে পিচ্চি হিমু আর সবিতার মাঝে।


সবিতা যেন বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে, জ্যোৎস্নায় ভরে যাচ্ছে চারপাশ। একটা তারা যেন জ্বলে উঠল। পিট পিট করে জ্বলছে।


পিচ্চি হিমু আকাশের দিকে দুইহাত তুলে বলছে,'আপু, আমি যাব।'


পিচ্চি হিমুর চোখ জলে ভিজে যাচ্ছে। আমার চোখেও যেন কি পড়ল। ধেৎ। হিমুরা নরকলোভী, তাদের কি স্বর্গলোভী হলে চলে?


(চলবে)


মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.