নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

...

অর্ক

...

অর্ক › বিস্তারিত পোস্টঃ

ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনীঃ যেমন দেখেছি মায়া নগরীকে

২২ শে এপ্রিল, ২০১৭ রাত ৯:৩৮


কল্যাণ স্টেশন, মুম্বাই।

ট্রেনের ভুল কামরায় সফর
(পূর্ব প্রকাশের পর)
মুম্বাইয়ে আমার প্রথম দিকের ঘটনা। সেটা বোধহয় সেখানে আমার দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিন ছিল। সকাল ন'টা বা দশটা হয়ে থাকবে। ঠিক কোন স্টেশন এখন আর মনে নেই। অহেতুক অনুমান করেও লাভ নেই, সত্য কথা হলো স্টেশনের নামটা আমি ভুলে গেছি। আমি অনেকটাই নিশ্চিত কোনদিন সঠিক স্টেশনের নামটা আর মনেও পড়বে না। হা হা হা। কারণ মুম্বাইয়ে আমি অসংখ্য স্টেশনে অগুনিতবার থেমেছিলাম, নেমেছিলাম, মুগধ চোখে ঘুরে ঘুরে দেখেছিলাম মায়া নগরীকে। আনলিমিটেড রেল ভ্রমণের ট্যুরিস্ট টিকিটের বদৌলতে অনেক স্টশনে শুধুমাত্র স্টেশন দেখার জন্য নেমেছিলাম। ব্যাপারটা এমন যে, মন চাইল নেমে পড়লাম। সেসব স্টেশনের, প্লাটফর্মের, স্টেশনের নিকটবর্তী শহরের অসংখ্য স্মৃতি জমে আছে। কিন্তু নামধাম অতো বিস্তারিত এখন আর মনে নেই। আমার পক্ষে অতো কিছু মনে রাখা সম্ভব নয়; আমি আমার স্মৃতিশক্তির সীমাবদ্ধতা জানি, হা হা হা! যা হোক এবার সরাসরি মূল ঘটনায় যাই। সেই স্টেশনে প্রচণ্ড ভীর, মানুষের ট্রেনে ওঠা নামার দুদ্দাড় হুড়োহুড়ির মাঝে একটা কামরায় অভাবনীয় কম ভীর দেখে অনেকটা বাদরের মতো নাচতে নাচতে লাফিয়ে উঠে পড়লাম। অমন নির্জন কামরা দেখে বেশ অবাক হয়েছিলাম। যাক বাবা বুদ্ধি করে এই কামরায় উঠে ভালই করেছি। ট্রেনের দরোজায় বাদুড়ঝোলার পরিবর্তে, দিব্যি আরামে পায়ের ওপর পা তুলে সিটে বসে যাওয়া যাবে। ভাবলাম কামরায় বসে।
ট্রেন ছেড়ে দিল। আগের কোনও এক পর্বে হয়তো লিখেছিলাম, মুম্বাইয়ের লোকাল ট্রেন স্টেশনগুলোতে খুব অল্প সময় দাঁড়ায়; দু' থেকে তিন মিনিট। এর মধ্যে চড়তে হবে। ট্রেন যাওয়া আসাও করে অনবরত। পাঁচ মিনিটের ভিতরেই আপনি আপনার গন্তব্যের ট্রেন পেয়ে যাবেন। এটা নয়তো ওটা, কোনও একটা ঠিক পেয়ে যাবেন। আমি যথারীতি ট্রেনে সিটে পায়ের ওপর পা তুলে রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে মনের সুখে গুনগুনিয়ে হিন্দি গান গাইতে গাইতে চলেছি। খানিকক্ষণ পর বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম, কামরায় যারা অবস্থান করছে, তাদের সবারই কোনও না কোনও শারীরিক সমস্যা আছে। কম বেশি আছেই। সবমিলিয়ে সাত আট জনের মতো যাত্রী ছিল কামরায়। ব্যাপারটা উপস্থিত মুহূর্তে আমার কাছে নিতান্তই কাকতালীয় বলে মনে হয়েছিল! যাত্রীদের সবাইকে লক্ষ্য করতে লাগলাম, কার কি সমস্যা। এসময় দেখলাম কামরার অন্য যাত্রীরাও একইভাবে আমার দিকে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। কয়েকজনের চেহারা ভীষণ রকম বিরক্ত। এদের মাঝে দুয়েকজনের ভাবভঙ্গি আবার রীতিমতো আক্রমণাত্মক; কেমন ভ্রু কুচকে, তীক্ষ্ণ চোখে দেখছিল আমাকে! এসময় যাত্রীদের ভিতর থেকে একেবারে পিছনের সিটের একজন আমাকে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলো, 'আপনি এই কামড়ায় কেন?' ইনি মারমুখী যাত্রীদের একজন। শুরু থেকেই দেখছি ভ্রূ কুচকে, তীক্ষ্ণ চোখে বিদ্ধ করে চলেছে আমাকে, চেহারা দারুণ ক্ষুব্ধ।
'কেন, তাতে কি হয়েছে!' হিন্দিতে বললাম। স্বভাবতই আমার কণ্ঠেও বিরক্তি ও বিস্ময়। বুঝে উঠতে পারছিলাম না, ট্রেন কি ওর বাবার সম্পত্তি নাকি যে এমন আক্রমণাত্মকভাবে আমার সাথে কথা বলছে! কী মহাভারত অশুদ্ধ করেছি আমি!
'এই কামরা শুধুমাত্র শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধীদের জন্য।' জবাবে বললেন ভদ্রলোক। যদিও তার অভিব্যক্তি ও ব্যবহার ঠিক ভদ্রলোকসুলভ ছিল না, তারপরও ভদ্রলোক বললাম। কারণ সেদিন দোষটা ছিল আমারই।
যাই হোক এই কথা শুনে 'ওহ্' বলে তৎক্ষণাৎ তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম সিট ছেড়ে। তখন-ই পরিষ্কার হয়ে গেল পুরো ব্যাপারটা। এটা প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত কামড়া, তাই যাত্রীদের সকলের-ই কমবেশি শারীরিক সমস্যা আছে। তাই এমন পিক আওয়ারেও এখানে ভীর এতো কম, প্রায় পিনপতন নীরবতা বলেলেও ভুল হবে না অন্যান্য জেনারেল কামরার সাথে তুলনা করলে। বুঝতে পারলাম, কেন একামরায় না উঠে যাত্রীরা সব অন্য কামরায় মারামারি করে উঠছে!
ছিঃ ছিঃ ছিঃ কী লজ্জা! পাঁচ ফিট নয় ইঞ্চি উচ্চতার ব্যায়াম করা ঋষ্টপুষ্ট শরীর নিয়ে প্রতিবন্ধীদের কামড়ায় পায়ের ওপর পা তুলে বসে যাচ্ছি! ছিঃ, লজ্জা লজ্জা লজ্জা! কামরার অন্য যাত্রীরা নির্ঘাত সেসময় আমকে দু'নাম্বার পাবলিক ভেবে ইচ্ছেমতো গালিগালাজ করছিল মনে মনে। কারণ ওদের পক্ষে আমার চেহারা ও অনর্গল হিন্দিতে কথা বলা দেখে বোঝার কোনও সুযোগ ছিল না যে, আমি আসলে ভারতীয় নই বাংলাদেশি মানে বিদেশী। এরকম লোকাল ট্রেন যাত্রায় আমি মোটেও অভ্যস্ত নই। মাথা ঘুরিয়ে সব যাত্রীদের চেহারায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। ভয়ের এক শীতল স্রোত নেমে গেল শিড়দাড়া বেয়ে। সকলের চেহারায় বিরক্তির সাথে সাথে ক্ষুব্ধভাবও পরিষ্কার দৃশ্যমান। আমার সেখানে তখন 'ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি'' অবস্থা। একটা উদাহরণ দিলে হয়তো আমার তখনকার পরিস্থিতিটা সকলের বুঝতে আরও সুবিধা হবে। মনে করুন, একটা চিকন দরির ওপর বাঁশ হাতে আমাকে দু'দিকের ঠিক মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি, অথচ আমি সার্কাস জানি না, কস্মিনকালেও আমি এর ট্রেনিং করিনি! হাতে আড়াআড়ি লম্বা একটা বাঁশ নিয়ে, দরির ওপর দাঁড়িয়ে আছি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কোনকিছুই করার নেই, ফ্যালফ্যাল করে নির্বোধের মতো কেবল সামনে দেখছি।
আশা করি এখন আমার তখনকার পরিস্থিতিটা বুঝতে পেরেছেন সবাই, কী জটিল হয়ে উঠেছিল ব্যাপারটা। চলন্ত ট্রেন থেকে নেমে দৌড়তেও পারছিলাম না! দরোজার হাতল ধরে দাঁড়িয়ে শো শো করে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে অপেক্ষা করতে লাগলাম পরবর্তী স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ানোর। ট্রেন দাঁড়ালেই যেভাবে বাদরের মতো লাফিয়ে উঠেছিলাম, আবারও সেভাবেই তবে এবার ততোধিক দ্রুত গতিতে নেমে যাব ট্রেন থেকে। ঠিক এসময় একজন বৃদ্ধ লোক আমাকে বললেন, 'কোনও ব্যাপার না, বসে পড়ো, বান্দ্রায় নেমে যেয়ো।' (আমি ঠিক শতভাগ নিশ্চিত নই উনি বান্দ্রায় নামার কথাই বলেছিলেন কিনা। যতদূর মনে পড়ছে, বান্দ্রার কথাই বলেছিলেন, তাই বান্দ্রা উল্লেখ করলাম। কিন্তু এই ঘটনাটা ঠিক কোন স্টশনে, তার ক্ষেত্রে কোনও শক্ত অনুমানও করতে পারছি না।)
যে কোনভাবেই হোক সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন, নিছক দুর্ঘটনাবশত আমি একামড়ায় উঠে পড়েছি, ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত নয়। আমি অমন স্বভাবের মানুষ নই, দু'নাম্বার নই। তাঁর কোমল কণ্ঠে সহানুভূতিভরা কথাগুলো শুনে প্রাণ ভরে উঠল।
'না, ঠিক আছে। এই তো নেমে যাব।' স্মিত, লজ্জিত হেসে বললাম। কিন্তু বসলাম না। এরপর আর সেখানে বসা যায় না।
একটা খালি সিটের দিকে তর্জনী উঁচিয়ে অকৃত্রিম আন্তরিকতার সাথে আবারও আমাকে বসে যেতে বললেন তিনি। আমি এবারও লজ্জিত হেসে, ইতস্তত করে তা পাশ কাটিয়ে গেলাম।
ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার কথোপকথন শুনে, আমি নিশ্চিত কামরার অন্যান্য যাত্রীদেরও আমার প্রতি তিক্ত মনোভব কিছুটা কমে এসেছিল। কিন্তু শুধু ওই একজন ছাড়া। সেই একজন যে কে আশা করি সবাই বুঝতে পেরেছেন। হ্যা, পিছনের সিটের সেই বড় মাথাআলা ভদ্রলোক!
'কোনও চেকার একে এভাবে দেখলে পাঁচশ' রুপি ফাইন করবে!' এসময় বললেন তিনি। পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, আমার সাথে সাথে সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোকের ওপরও বিরক্ত তিনি, আমার প্রতি তাঁর সহানুভূতি দেখানোটা একটুও পছন্দ করেননি। কথাটা মূলত তাকে ইঙ্গিত করেই বলা।
যাই হোক পাঁচশ' রূপি ফাইনের কথা শুনে মুম্বাইয়ে নতুন নতুন এসে এমন ভয় পেয়েছিলাম যে হঠাৎ তখন মনে হলো, আমার কোমরের নীচ থেকে আর কিছু নেই, আমি শূন্যে ভেসে আছি! উর্ধাঙ্গও ভয়ে শিরশির করতে লাগল। পাঁচ বা পঞ্চাশ রুপি হলে কথা ছিল, কিন্তু পাঁচশ রুপি ফাইন! এরপর পরের স্টেশনে আমার নামার আগেই যদি চেকার ওঠে, তখন! এরকম পরিস্থিতির মধ্যে, দুড়ুমদুড়ুম ঢাকঢোল বাজা কম্পিত বুকে পরবর্তী স্টেশনে নামলাম। কিছুই হলো না। অহেতুক এতো ভয় পেয়েছিলাম, কিংবা আমাকে ভয় দেখানো হয়েছিল; পিছনের সিটের সেই ন্যাড়া মাথা ভদ্রলোক! পনের দিনের মতো ছিলাম মুম্বাইয়ে অসংখ্যবার ট্রেনে আসা যাওয়া করেছি। কোনদিন দেখিনি চলন্ত ট্রেনে চেকার উঠতে। চেকার থাকে স্টেশনে, প্লাটফর্মে।
ঘটনাটা এটুকুই। পরে দেখেছি মহিলা ও প্রতিবন্ধীদের কামরায় স্বচিত্র লেখা থাকে। মহিলাদের কামরাগুলো ইঞ্জিনের সাথে ও সেখানে সব মহিলাদের উপস্থিতির কারণে পরিষ্কার বোঝা গেলেও, প্রতিবন্ধীদেরটা বাইরে থেকে দেখে অতো বোঝা যায় না। আর সমস্ত ট্রেনে তাদের জন্য বোধহয় একটাই কামরা বরাদ্দ। ভুল হয়ে গিয়েছিল। পাঁচশ' রুপি ফাইন, এটাওটা শুনে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম সেদিন ট্রেনের ভিতর। কিন্তু এখন ঘটনাটি মনে পড়লে, ভয়ডর নয় শুধু হাসি পায়।(চলবে)

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৭ সকাল ১০:৫৯

সঞ্জয় নিপু বলেছেন: এখনো পড়ে যাচ্ছি, আপনি চালিয়ে যান,
তবে
প্রতিটি লেখাতেই ভুলে যাওয়া এবং সম্ভবত ব্যপারটা বেশী দেখা যাচ্ছে।
আমি ও একবার কলকাতায় লোকাল বাসে উঠি এবং প্রচুর ভীড় কিন্তু অনেক লোকজন দাঁড়িয়ে কিন্তু দেখলাম ডাবল সিটের ১ টা সিট খালি কেউ বসে না আমি ভীড় ঠেলে গিয়ে বসলাম, সাথে সাথেই লোকজন চেচিয়ে উঠলো, এটা তাদের, সিনিয়র সিটিজেনের জন্য সংরক্ষিত সিট, ২-১ টা ঝাড়ি খেয়ে উঠে গেলাম, প্রচন্ড পরিমানে প্রচুর অপমানিত ফিল করলাম। হা হা।

ধন্যবাদ আপনাকে।

২৪ শে এপ্রিল, ২০১৭ রাত ১১:০২

অর্ক বলেছেন: আপনাকেও ধন্যবাদ। আসলে প্রচুর ট্রেন ভ্রমণ করেছিলাম মুম্বাইয়ে। স্মৃৃতিগুলো কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। লেখাতেও তা দৃশ্যমান।

২| ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৭ সকাল ১১:০৫

রেজা এম বলেছেন: কপাল ভালো টিটি ওঠেনি। আর রেইড থাকলে, সোজা হাজতবাস

২৪ শে এপ্রিল, ২০১৭ রাত ১১:৩২

অর্ক বলেছেন: ওরকমই ভয় পেয়েছিলাম! ধন্যবাদ।

৩| ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৭ রাত ১:৩৮

নিভা ইয়ামা বলেছেন: কামড়া শব্দটি পড়তে ভাললাগছে না। দৃষ্টিকটু লাগছে কিছুটা। বানানটা ঠিক করে দেবেন দয়া করে। ধন্যবাদ।
আর আপনার মায়া নগরীর ছবিগুলো আমার বেশ লাগছে। :)

২৪ শে এপ্রিল, ২০১৭ রাত ১১:০৬

অর্ক বলেছেন: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ভুলটা ধরিয়ে দেয়ার জন্য। শীঘ্রই সংশোধন করবো। ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.