নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জীবন এক বহতা নদী...

আসিফনবী

লিখতে ভালোবাসি, ভালোবাসি পড়তে। মৃত্যুপথযাত্রীদের প্যালিয়েটিভ কেয়ার নিয়ে লেখালেখি এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ করি।

আসিফনবী › বিস্তারিত পোস্টঃ

মক্কার কাঁচা বাজার ও এক রোহিঙ্গার করুণ কাহিনি!

২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ৯:৪৯

আসিফ হাসান
মক্কা শহরে একটা কাঁচা বাজার খুঁজছিলাম দেখার জন্য। কোনো দেশের কিছুটা ধারনা পেতে হলে সেদেশের সুপার শপে না গিয়ে কাঁচা বাজারে গেলে দেশটি সম্পর্কে একটি চিত্র পাওয়া যায়। ওমরাহ হজ করতে এসে মক্কায় আমরা যে হোটেলে ছিলাম তার নাম বদর। ২৬ তলার এই হোটেলটি মিসফালা এলাকার ইব্রাহিম খলিল সড়কে অবস্থিত ৩ তারকা মানের। এখান থেকে পবিত্র হেরেম শরিফ পায়ে হাঁটা ১০ মিনিটের দূরত্ব। মুয়াল্লিমের নাম হাজী জামালউদ্দিন। তিনি বিকালে নিয়ে গেলেন হোটেলের পিছনে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে একটি বাজারে। গিয়ে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম। সমতল থেকে প্রায় ৭শ ফিট উঁচুতে পাহাড়ের উপর ঘনবসতিপূর্ণ বাজারটির নাম দাহালা। এর পাশে আরেকটি বাজার আছে যার নাম জাওরাল। যেহেতু এত উপরে হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয় তাই জনপ্রতি ২ রিয়াল করে কিছুটা মুড়ির টিন মার্কা টয়োটা গাড়িতে করে মনে হলো অগ্যস্ত যাত্রা করছি। ধারণা করছি ৪ হুইলের এই গাড়িগুলোর কোনো অনুমোদন নেই মূল সড়কে চলার। প্রায় ৪ মিনিট উপরে উঠার পরে ড্রাইভার ইশারা দিলো নামো। মনে মনে ভাবলাম এত কাছে? কিন্তু বলবো কাকে? এই ড্রাইভারগুলো অধিকাংশই আফ্রিকান। এরা আরবি ছাড়া কিছু বোঝে না। নেমে গেলাম। কিন্তু যাবো কীভাবে? রাস্তা এতটাই সরু যে পাশাপাশি দুজন হাঁটতে পারবে না। মোয়াল্লিম তার পেছনে পেছনে আসতে বললেন। সামনে যতই যাচ্ছি ততই অবাক হচ্ছি। মনে হচ্ছে পুরানো ঢাকার কোনো এক সরু গলিতে ভুল করে ঢুকে পড়েছি। দুপাশে খুপড়ির মত ঘরে শুধু দোকান আর দোকান। হেন কোনো জিনিস নেই যা পাওয়া যাবে না। অনেক দোকানের সামনে ঝুলছে বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড। একটি পানের দোকানের সামনে দেখলাম বিকাশের পোস্টার। জানতে চাইলাম বিকাশে টাকা আনতে চাইলে কীভাবে সম্ভব। বললেন আপনার যত টাকা লাগে আনানো যাবে, পাঠানোও যাবে। কোনো সমস্যা নাই। অধিকাংশ লোকের চেহারাই বাংলাদেশীদের মত। কিছুটা বিভ্রান্ত হলাম। মোয়াল্লিমকে জিজ্ঞেস করাতে বললেন এরা সবাই রোহিঙ্গা। সৌদি সরকার এদের গত ৪৫ বছর পর্যন্ত আশ্রয় দিয়ে রেখেছে। যদিও নাগরিকত্ব দেয় নি। দোকানগুলোর পেছনে পাথর কেটে সুড়ঙ্গের মত অনেক নিচে ছোট ছোট খুপড়ির মত করে দেয়া হয়েছে। যেখানে তারা বছরের পর বছর বাস করছে। এরা জন্মনিয়ন্ত্রণ করেনা বলে একেকটা পরিবারে কমপক্ষে ৮ থেকে ১০ জন সদস্য। কীভাবে এত ছোট ঘরের মধ্যে এরা বছরের পর বছর বাস করে তা এক বিস্ময়। একটি সরু গলি দিয়ে মাটির নিচে চলে গেলাম। সারি সারি একইরকম ঘর। পাথরের ছাদ। একটি বা দুটি জানালা আছে। কোনো কোনো খুপড়িতে দেখলাম আবার এসিও লাগানো। বুঝলাম খুব খারাপ নেই। প্রথমে দেখে মনে হয়েছিলো ঢাকার জেনেভা ক্যাম্পে বিহারীদের করুণ অবস্থার মত আছে হয়ত এরা। পরে দেখলাম অতটা খারাপ না হলেও বিহারিদের চেয়েও ভালো আছে। অবশ্য কক্সবাজারে আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গারা এদের চেয়ে অনেক ভালো আছে বলে মনে হয়।
মাংসের দোকানে দেখলাম উটের মাথা কেটে বসিয়ে রেখেছে ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। হাড় ছাড়া কেজি ২০ রিয়াল, হাড়সহ ১৮ রিয়াল। এছাড়া আছে দুম্বা আর গরুর মাংস। ব্রয়লার মুরগী, সমুদ্রের বিভিন্ন প্রজাতির মাছ আর তায়েফ থেকে আসা তাজা সবজিতে দোকানগুলো পূর্ণ।
ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে এক দোকানে বসলাম কিছু হালকা নাস্তা করতে। দোকানদার বুট, মুড়ি আর ছোলা নিয়ে আসলো। আমাদের সামনে বসা শ্মশ্রমুণ্ডিত একজনকে দেখলাম একই খাবার খেতে। বয়স আনুমানিক ষাটের উপরে। জিজ্ঞেস করলাম কী নাম? কী করেন? ইত্যাদি। এতকিছু জিজ্ঞেস করাতে ভদ্রলোক কিছুটা বিব্রত। সন্দেহের চোখে তাকিয়ে শুধু জানতে চাইলেন ‘হাজী’? মাথা নাড়লাম। কণ্ঠ শুনে বুঝলাম রোহিঙ্গা। মোয়াল্লিম তাকে আশ্বস্ত করে বললেন আমরা জানতে চাইছি আপনি কী করেন? কবে এদেশে এসেছেন? প্রথমে এড়িয়ে যেতে চাইলেন। আস্থা রাখতে পারছিলেননা আমাদের উপর। অনেক অনুরোধ করার পরে খাওয়া বন্ধ করে উদাস চোখে বলে যেতে লাগলেন তার জীবনের করুণ কাহিনি।
নাম হারুন, গত প্রায় ৪৫ বছর ধরে এদেশে আছেন। নাগরিকত্ব পাননি। যদিও সৌদি আরবের নাগরিকত্ব পাওয়া অনেক কঠিন। তিনি অবৈধভাবে আছেন এখানে। দর্জির কাজ করেন। ৩ ছেলে ৩ মেয়ে নিয়ে ছোট্ট একটি খুপড়ির মত ঘরে থাকেন। ১ ছেলে বিয়ে করে আলাদা থাকে। তৎকালীন বার্মার রাখাইনে ছিলো আদি বাড়ি। ’৭৯ সালে ছিলেন যুবক। সেসময় বার্মার জান্তা সরকারের অত্যাচারে উদ্বাস্ত হয়ে চলে আসেন কক্সবাব্জারের উখিয়ায়। সেখান থেকে অবৈধ উপায়ে ভারত হয়ে চলে যান পাকিস্তান। সেখানে থাকেন ৩ বছর। এরমধ্যে পেয়ে যান পাকিস্তানের নাগরিকত্ব ও পাসপোর্ট। ’৮৩ সালে সেই পাসপোর্ট নিয়ে ওমরাহ ভিসায় চলে আসেন সৌদি আরব। এখানে এসে পাসপোর্ট ফেলে দিয়ে রোহিঙ্গা পরিচয় দেন। সে সময় সৌদি সরকার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে তাদের বিষয়ে যথেষ্ট উদার ছিলেন। আমরা যেখানে গিয়েছি সেই দাহালা আর জাওরান অঞ্চলে সরকার তখন তাদের আশ্রয় দেয়। পরবর্তীতে সৌদি সরকার রোহিঙ্গাদের বিষয়ে তাদের ইতিবাচক মনোভাব পরিবর্তন করে। এ অবস্থায় ’৯০ সালে সৌদি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন হারুন। নিজেকে পরিচয় দেন পাকিস্তানি নাগরিক হিসেবে। পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাকে নেয়া হয় পাকিস্তান দূতাবাসে। বিশ্বাসযোগ্য তথ্য না থাকায় দূতাবাস তাকে সেদেশের নাগরিক হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে। সৌদি পুলিশ মনে করে তিনি ভারতীয়। তাই তাকে ভারতে ফেরত পাঠায়। ভারতে কয়েকদিন কারাগারে থাকেন। জামিন পেয়ে পুনরায় অবৈধভাবে বাংলাদেশে আসেন। ঠাই নেন উখিয়া ক্যাম্পে। এখানে নতুন করে আবার বাংলাদেশের পাসপোর্ট করে ’৯২ সালে ওমরাহ ভিসায় সৌদি আসেন। সেসময় আজকের মত বায়োমেট্রিক পদ্ধতি ছিলো না বলে দালালদের মাধ্যমে পাসপোর্ট ও ভিসা পাওয়া সহজ ছিলো। এভাবেই তিনি এসে থেকে যান। পরবর্তীতে সম্ভবত নাগরিকত্ব বিষয়ে অস্পষ্টতা থাকায় সৌদি আরবে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস তার পাসপোর্ট আর নবায়ন করেনি। সেই থেকে আজঅবধি তিনি অবৈধভাবেই আছেন। তার সন্তানের মত এখানে জন্ম নেয়া হাজার হাজার রোহিঙ্গাও এখানে অবৈধ। অনিশ্চিত তাদের জীবন।
জিজ্ঞেস করলাম ভয় করে না? চোখের কোণে অশ্রু ঝরিয়ে শুধু বললেন, ভয়তো আমাদের প্রতিনিয়তই তাড়া করে। আমাদের দেশ থেকেও নেই, ঘর থেকেও নেই। দেশহীন একজন মানুষের যে কি যন্ত্রণা সেটা যার নেই তিনি কী করে বুঝবেন? আমরা কী করবো বলুন? চোখে মুখে অসহায়ত্ব আর যন্ত্রণা ঝড়ে পরে তার। বিয়ে করেছেন এখানেই আরেক রোহিঙ্গা মহিলাকে। ৬ টি সন্তান। এক মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। প্রতিমুহূর্তে আতঙ্কে থাকেন এই বুঝি ধরা পড়লেন। দর্জির কাজ করেন এই ক্যাম্পেই। কোনো রকম চলে জীবন। তার মতো আরো হাজার হাজার রোহিঙ্গা আছেন এই আতঙ্কে। বললেন সৌদি সরকার এরমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, নগর উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য যে কোনো সময়ে এ ক্যাম্প ভেঙ্গে দেয়া হবে। এখানে প্রায় লাখখানেক রোহিঙ্গা আছে। সবারই চোখে মুখে আতঙ্ক এই ক্যাম্প ভাঙ্গলে কই যাবে তারা? কারণ তাদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ঘোষণাও দেয়া হয়নি।
ভাবছি সৌদি আরবের মত বিশাল ধনী দেশে কি রোহিঙ্গারা এখন বড় বেশি বেমানান? তবে এটাও সত্য যে সৌদি আরব তাদের রক্ষণশীল সমাজে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে, লালন করছে বছরের পর বছর, যেমন এখন করছে বাংলাদেশ।
এক বিপন্ন বিস্ময়, প্রশ্ন আর বিষন্ন মন নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।

মক্কা, সৌদি আরব: ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২
E-mail: [email protected]

ছবি পরিচিতি
১। বায়ে রোহিঙ্গা হারুন ও ডানে মোয়াল্লিম হাজী জালাল
২। পাথরের পাহাড় কেটে কেটে এভাবেই ছোট ছোট খুপড়ি বানিয়ে দেয়া হয়েছে।
৩। বাজারে কর্তিত উটের মাথাসহ মাংস বিক্রির জন্য এভাবেই রাখা হয়।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই অক্টোবর, ২০২২ রাত ১০:৫৬

পদাতিক চৌধুরি বলেছেন: খুবই কষ্টের জীবন যাপন তাহলে সৌদিতে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.