নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জীবন এক বহতা নদী...

আসিফনবী

লিখতে ভালোবাসি, ভালোবাসি পড়তে। মৃত্যুপথযাত্রীদের প্যালিয়েটিভ কেয়ার নিয়ে লেখালেখি এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ করি।

আসিফনবী › বিস্তারিত পোস্টঃ

আরাফাতের ঐতিহাসিক গুরুত্ব, বিদায় হজ ও নহর ই-জুবাইদার প্রযুক্তি

০১ লা অক্টোবর, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৫৫

আসিফ হাসান
আরাফাত ময়দানের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। মুসলমানদের বড় হজের আবশ্যিক অনুসঙ্গগুলোর অধিকাংশ এখানে সম্পন্ন হয়। আরবি ভাষায় আরাফাতের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পরিচয় বা জ্ঞানের স্থান। মক্কা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে হিজাজ অঞ্চলে অবস্থিত আরাফাত ময়দান তিন দিক পাহাড়বেষ্টিত দৈর্ঘ্যে ২ এবং প্রস্থে ১ কিলোমিটার। দক্ষিণ পাশ ঘেঁষে মক্কা হাদা তায়েফ রিং রোড। এই সড়কের দক্ষিণ পাশে আবেদি উপত্যকায় মক্কার উম্মুল কুরআ বিশ্ববিদ্যালয়। উত্তরে সাদ পাহাড়। সেখান থেকে আরাফাত সীমান্ত পশ্চিমে প্রায় এক কিলোমিটার। সেখান থেকে দক্ষিণে মসজিদে নামিরায় গিয়ে আরাফাত সীমান্ত শেষ হয়েছে। ময়দানের দক্ষিণ পাশে প্রায় ২ কিলোমিটার পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে থেকে আগত হাজীদের জন্য জোন ভাগ করা আছে। আরবিতে এরা বলে খিত্তা। হজের সময় তারা ঐ নির্দিষ্ট জোনেই অবস্থান করেন। আধুনিক সুযোগ সুবিধাসম্বলিত প্রতিটি জোনেই ওজু এবং গোসল করার ব্যবস্থা আছে। প্রচুর নিম গাছ লাগানো হয়েছে যেগুলো গরমের সময় হাজীদের ছায়া দেয়। মক্কা থেকে আরাফাহ ময়দানে আসার জন্য বর্তমানে ট্রেন ব্যবস্থাও চালু করেছে সরকার। অত্যাধুনিক এই ট্রেন সাধারণত হজের সময়েই চলমান থাকে। আমরা যখন গিয়েছি তখন বন্ধ ছিলো।
৯ জিলহ্জ তারিখে আরাফাত ময়দানে বড় হজের সময় হাজীদের অবস্থান করা অবশ্যই পালনীয়। তা না হলে হজ সম্পূর্ণ হবে না। কারণ আরাফাতের ময়দান যেন বিশ্ব সম্মেলন। এ সম্মেলন থেকে মুসলমানদের ঐক্য, শৃঙ্খলা ও শান্তির বার্তা সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। মহান আল্লাহ চান সব মুসলমান একতাবদ্ধ হয়ে থাকুক। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত লোকদের সঙ্গে আরাফাতে অবস্থান করা মুসলমানদের একতার ইঙ্গিত বহন করে। আরাফাতের মাঠে অবস্থানকেই হজ বলা হয়েছে। অথচ এ মাঠে নির্দিষ্ট কোনো ইবাদত নেই।
এই ময়দানেই অবস্থিত জাবালে রহমত বা রহমতের পাহাড়ে বিবি হাওয়া এবং হযরত আদম (আ.)-এর পৃথিবীতে আগমনের পরে মিলিত হয়েছিলেন বলে ঐতিহাসিকদের অভিমত। আল্লাহর আদেশ অমান্য করে গন্ধম ফল খাওয়ায় প্রথম মানব মানবী আদম ও হাওয়াকে স্বর্গোদ্যান থেকে নামিয়ে দেওয়া হলো পৃথিবীতে। আদমকে সরনদীপে (শ্রীলংকা) ও হাওয়াকে জেদ্দায় (সৌদি আরব)। অবশ্য বিষয়টা নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। পৃথিবীতে আসার প্রায় ৩৫০ বছর পরে পর তাদের দু'জনের দেখা হয়েছিলা এই জাবালে রহমতের পাহাড়ের চূঁড়ায়। ঐতিহাসিকদের মতে, এ জন্য এই ময়দানকে আরাফাতও বলা হয়। আবার কেউ কেউ বলেন, হজরত জিবরাইল (আ.) হজরত ইবরাহিম (আ.)কে হজের যাবতীয় বিষয় শিক্ষা দেয়ার পর এখানে এসে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, হজসংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ের পরিচিতি লাভ করেছেন কী না? এ থেকেই এখানের নাম হয় আরাফাত। নবীজি (সা.) যে পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন সেই পাহাড়ের পিছনেই রয়েছে নহর ই-জুবাইদা। প্রকৌশল বিদ্যার এক আশ্চর্জনক স্থাপনা এই নহর বা খাল। কয়েকশ বছর আগে এটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে এই নহর দিয়ে হজের সময় হজ যাত্রীদের জন্য পানি সরবরাহ করা হতো। বর্তমানে এটি পরিত্যক্ত।
ময়দানের অনেকাংশজুড়ে রয়েছে অনেকগুলো নিমগাছ। এই সব নিমের চারা নাকি বাংলাদেশ থেকে নিয়ে ওখানে রোপণ করা হয়েছে। নিমগাছ রোপণের পর প্রতিদিন গাছের গোড়ায় পানি দেওয়া হয়। পানি দেয়ার কাজ করেন বাংলাদেশি শ্রমিকেরা। কিছু দূর পর পর পানির ট্যাপ বসানো আছে। শ্রমিকেরা তাতে পাইপ লাগিয়ে গাছে পানি দেন, গাছের পরিচর্যা করেন।

মসজিদে নামিরা
বাংলাদেশী নিমগাছগুলোর ওপারে পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত মসজিদে নামিরা। বিদায় হজের সময় যেখানে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) নামাজের ইমামতি করেছিলেন এবং খুতবা দিয়েছিলেন সেখানেই হিজরী দ্বিতীয় শতকে নামিরা মসজিদটি নির্মিত হয়। মসজিদের বর্তমান নান্দনিক রূপটি গ্রহণ করেছে সাম্প্রতিককালের সৌদি শাসনামলে। মসজিদটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। মসজিদের কিবলাহমুখি সামনের অংশ আরাফার ময়দানের বাইরে পড়েছে এবং এর পিছনের অংশ আরাফার মধ্যেই রয়েছে। মসজিদটির আয়তন ১,১০০০০ বর্গমিটার। এখানে একত্রে ৩,৫০,০০০ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদটিতে রয়েছে ৬০ মিটার উঁচু ৬টি মিনার, তিনটি গম্বুজ ও ১০টি প্রধান দরজা। সুবৃহৎ এ মসজিদটির কাছে রয়েছে জাবালের রহমত হাসপাতাল। ঐতিহাসিকদের মতে এই মসজিদের স্থানেই ফেরেশতা হজরত জিবরাইল (আ.) হজরত ইবরাহিম (আ.)কে হজের নিয়মকানুন শিক্ষা দিয়েছিলেন। ৯ জিলহজ হজপালনকারীরা এই মসজিদের পাশের রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে মুজদালিফা যান। এখান থেকে মুজদালিফার দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার। আমরা যখন আরাফা পরিদর্শন করি তখন নামিরা মসজিদের সংস্কার কাজ চলছিলো।
এই ময়দানের পশ্চিম পাশে জাবালে রহমত পাহাড়ের পাদদেশে পাথরের উপর দাঁড়িয়ে মহানবী (সা.) তার বিদায়ী হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। মুয়াল্লিম নির্দিষ্ট করে দেখালেন পাথরটি। সেই পাথরের উপর বসলাম। কিছুটা আবেগাপ্লুতও হলাম। প্রায় ১৫০০ বছর আগে দেয়া মহানবীর এই ভাষণের নির্দেশনা মানবজাতির কল্যাণ তথা পৃথিবীর সকল ধরণের শান্তি প্রচেষ্টায় আজও প্রাসঙ্গিক।
১০ম হিজরি অর্থাৎ ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে হজ পালনকালে আরাফাতের ময়দানে রাসুল মুহাম্মাদ (স:) কর্তৃক প্রদত্ত খুৎবা বা ভাষণই বিদায় হজ ভাষণ। হজের দ্বিতীয় দিনে আরাফাতের মাঠে অবস্থানকালে অনুচ্চ জাবাল-এ-রাহমাত টিলার শীর্ষে দাঁড়িয়ে উপস্থিত সমবেত মুসলমানদের উদ্দেশ্যে তিনি এই ভাষণ দিয়েছিলেন। মুহাম্মাদ (স:) জীবিতকালে এটা তাঁর শেষ ভাষণ ছিলো, তাই সচরাচর এটিকে বিদায় খুৎবা বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। ইসলামের প্রকৃত মূল্যবোধ অনুযায়ী মুসলমানদের করণীয়, মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা ও বিশ্বশান্তির জন্য এই ভাষণকে সর্বজনীন মানবাধিকারের দলিলও বলা হয়ে থাকে। এই ভাষণে ইসলাম ধর্মের মর্মবাণী সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছিলো। মুসলিম জাতির সাফল্যের ধারা বজায় রাখতে মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে মুহাম্মাদ (স:)-এর নির্দেশনা ছিলো। এই ঐতিহাসিক ভাষণ কেবল উপাসনামূলক অনুশাসন ছিলো না; বরং মানবসমাজের জন্য করণীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ভাষায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপদেশও ছিলো। আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, তাঁর সার্বভৌমত্ব, মানবজাতির ঐক্য, মানবতা, বিশ্বশান্তি, ভ্রাতৃত্ব, সামাজিক স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক সাম্য ইত্যাদি সমাজ বিনির্মাণের অন্যতম সব বিষয়ই এই ভাষণের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। এই ভাষণে ধর্ম পালনের প্রতি দায়িত্বের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছিলো। পাপাচারের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি করা হয়েছিলো। আল্লাহর প্রতি দায়িত্ব ও মানবসম্প্রদায়ের প্রতি কর্তব্য পালনের মধ্যে সীমারেখা টেনে দেয়া হয়েছিলো। মুহাম্মদ (স.) এই ভাষণে সমাজ ও রাষ্ট্রে অরাজকতা, বিদ্রোহ এবং কুপরামর্শ প্রদানকারী অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে বলেছেন। এই ভাষণে বিভিন্ন ধরনের সুদপ্রথা রহিত করে শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছিলো। নারীর পূর্ণ নিরাপত্তা, সম্মান ও অধিকারকে নিশ্চিত করার জন্য মুসলমানদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো এই ভাষণে। মানুষে মানুষে আত্মীয়তার বন্ধন, বিশেষ করে রক্তের সম্পর্কের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিলো। সামাজিক কুসংস্কার থেকে মানুষের মুক্তি লাভের ওপর জোর দেয়া হয়েছিলো। মুহাম্মদ (স.)-এর এই ঐতিহাসিক ভাষণে স্বর্গ-মর্ত্যরে সকল কিছুর ওপর আল্লাহর কর্তৃত্ব সুনিশ্চিত করা হয়েছিলো এবং মানুষকে এসবকিছুর আমানতদার হিসাবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। আল্লাহর মালিকানায় সবার অধিকার স্বীকৃত বলে উত্তরাধিকার আইনের ওপর অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করা হয়েছিলো। আমানতের খেয়ানতকারীর প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছিলো। মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তা বিধানের জন্য কাজ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিলো। সাম্য, স্বাধীনতা, ন্যায়পরায়ণতা, ভ্রাতৃত্ব এবং বদান্যতা ও মানবতার পরম ধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিলো।

জাবালে রহমত
এই আরাফাতেই আছে জাবালে রহমত নামে একটি পাহাড়। এই পাহাড়টি নানা কারণেই আলোচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ। এই পাহাড়ের পাদদেশেই মহানবী তাঁর বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন।
পাহাড়টি গ্রানাইটে গঠিত এবং উচ্চতা প্রায় ৭০ মিটার। এই পাহাড়ের চতুর্দিকে দৈর্ঘে প্রস্থে দুই মাইল। পাথর কেটে সিড়ি বানিয়ে চূড়া পর্যন্ত নেয়া হয়েছে। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে হজ করতে আসা লোকজন এবং পর্যটক এখানে এসে ফলকটি ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন, কান্নাকাটি করেন, সেলফি তোলেন। কেউ কেউ নানা রঙ্গের কলম দিয়ে তাদের মনের কথা লিখছেন। মিশর থেকে আসা এক নবদম্পতি পরস্পরকে জড়িয়ে সেলফি তুলছেন। এ যেন এক পবিত্র এলাহি কারবার। সকলেরই চোখে মুখে উচ্ছ¡াস। হয়ত বিবি হাওয়া আর আদমের দীর্ঘ বিরহের পর এইখানে প্রথম দর্শনে তাদের মধ্যে যে আবেগ আর উচ্ছ¡াস সৃষ্টি হয়েছিলো এই চূড়া দর্শন করতে এসে পর্যটক আর হজ যাত্রীদের মধ্যেও সেই আবহ ধরে রাখার চেষ্টা হয়ত।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে চোখে পড়বে বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সমাহার নিয়ে বসে আছে অনেক মহিলা। পুরুষও কিছু আছে। এসব পণ্যের মধ্যে তসবিহ, আতর, টুপিসহ আছে সংসারে ব্যবহার কর্রা অনেক কিছু। আপাদমস্তক বোরকায় ঢাকা এসব মহিলা চিৎকার করে যে হারে গ্রাহক আকর্ষণের কসরত করেন তা দেখে গুলিস্তানের হকারদের কথা মনে করিয়ে দেয়। মূল্য দেখে মনে হলো মক্কার চেয়ে কিছুটা কম। ভিক্ষুকও আছে অনেক। তা দেখে মনে হয় প্রদীপের নিচেও অন্ধকার!

নহর ই-জুবাইদা
জাবালে রহমতের দক্ষিণ দিকে সুরঙ্গের মত পাথরের খাল বা নালা চোখে পড়লো। মুয়াল্লিম জামাল ভাই বললেন এই খালটি নহর ই-জুবাইদা বা জুবাইদার খাল নামে পরিচিত। নহর আর সরোবর শব্দ দু’টি সমার্থক না হলেও অর্থের দিক থেকে খুব কাছাকাছি। আরবি নাহর থেকে বাংলায় নহর শব্দটি এসেছে। এর অর্থ নদী, প্রণালী, নালা, খাল, সরু জলপথ, স্্েরাতস্বিনী, জলধারা ইত্যাদি। অন্যদিকে, সরোবর মানে পদ্মফুলযুক্ত বড় পুষ্করিণী; হ্রদ বা দীঘি।
প্রকৌশল বিদ্যার এক আশ্চর্জনক স্থাপনা এই খাল বা নহর। কয়েকশ বছর আগে এটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে এই নহর দিয়ে হজের সময় হজ যাত্রীদের জন্য পানি সরবরাহ করা হতো। বর্তমানে এটি পরিত্যক্ত। দেখলাম যুদ্ধকালীন সৈন্যরা যেমন বাংকার তৈরি করে তারমধ্যে বন্দুকের নল বের করার জন্য ছিদ্র তৈরি করে রাখে তেমনি সারিবদ্ধভাবে ছিদ্রগুলো চলে গেছে। এই ছিদ্র দিয়েই হজের সময় পানি প্রবাহিত হতো। আরো অবাক হলাম এই খাল পাথর কেটে কেটে সুরঙ্গ করে তৈরি করা হয়েছে এবং আরাফাত ময়দান থেকে সোজা মিনা, মুজদালিফার দিকে এঁকে বেঁকে চলে গেছে। আমরা যখন আরাফাত থেকে মিনা, মুজদালিফার দিকে যাচ্ছিলাম বাসে করে তখন পর্যন্ত এই খাল রাস্তার সাথে সেই পর্যন্ত গেছে। এরপরেও কতদূর আছে তখন সেটা বুঝতে পারিনি। পরে অবশ্য এ নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছি এবং বিস্তারিত জেনেছি।
ইতিহাস বলে, ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১২৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ছিলো আব্বাসীয় শাসনামল। এসময় এই শাসকদের রাজধানী ছিলো ইরাকের বাগদাদ ও কুফায়। সৌদি আরবও তখন এই শাসনের অধীন ছিলো। আব্বাসীয় সাম্্রাজ্যের ইতিহাসে নহর শব্দটির সাথে জুবায়দা নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আব্বাসীয় শাসনামলে ক্ষমতাধর নারী ছিলেন জুবাইদা। বাগদাদ নগরীর প্রতিষ্ঠাতা খলিফা আল-মনসুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র জাফরের কন্যা ছিলেন তিনি। এ সময় শাসক ছিলেন খলিফা হারুনুর রশিদ। সম্পর্কে চাচাতো বোন জুবাইদাকে তিনি বিয়ে করেন। জুবাইদা ছিলেন যেকোনো ভালো কাজে আগ্রহী আর অগ্রগামী। সমসাময়িক দুনিয়ায় তার মতো বিদুষী, সুন্দরী, পরোপকারী ও বুদ্ধিমতী নারী দ্বিতীয়জন ছিলেন না। তিনি কেবল উচ্চগুণসম্পন্ন নারীই ছিলেন না; ছিলেন একজন কবিও। খলিফা হারুনুর রশিদের এই বিদুষী স্ত্রী কেবল মুসলিম জাহানের সম্রাজ্ঞীই নন, বিশ্বনবী (সা.)-এর রক্তের ধারক এবং খলিফা আল মানসুরের নাতি। কুরআন, হাদিস, ইজমা, কিয়াস, ইতিহাস, ভূগোল, জ্যামিতি এবং ধর্মতত্ত¡ সম্পর্কে সম্রাজ্ঞীর পাÐিত্যের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র- এশিয়া থেকে ইউরোপ, চীন থেকে ভারত কিংবা আফ্রিকা থেকে রাশিয়াঅবধি।
মরুপ্রবণ পবিত্র মক্কায় জমজমের পানি ছাড়া তেমন পানির উৎস ছিল না। ফলে হাজিরা সেকালে সুপেয় পানির অভাবে কষ্ট পেতেন। কিংবদন্তি আছে- রানি জুবাইদা একরাতে স্বপ্ন দেখেন অসংখ্য পুরুষ তাঁর সঙ্গে শারীরিকভাবে মিলিত হচ্ছে। ঘুম ভাঙার পর তিনি খুব বিব্রত বোধ করছিলেন। এক বিচক্ষণ দাসীকে তাঁর নিজের দেখা স্বপ্ন বলে শিখিয়ে দিয়ে বাগদাদের বিখ্যাত মুফতির কাছে পাঠালেন স্বপ্নের ব্যাখ্যার জন্য। দাসী থেকে স্বপ্নের কথা শুনে মুফতি বললেন, ‘এটি তোমার স্বপ্ন হতে পারে না। স্বপ্ন কার তুমি আগে খুলে বলো, তারপর আমি ব্যাখ্যা দেব।’ সব কিছু খুলে বলার পর মুফতি বললেন, রানি জুবাইদা এমন কাজ করবেন, যাতে অগণিত মানুষ উপকৃত হবে।
৮০৮ খ্রিষ্টাব্দ তথা ১৯৩ হিজরিতে খলিফা হারুনুর রশিদের সময়ে পানির অভাব এতই তীব্র হয়েছিল যে এক বালতি পানি ২০ দিরহামে বিক্রি করা হতো। খলিফা হারুনুর রশিদ কর্তৃক পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনাও হাজিদের পানির সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারল না। একই বছর তাঁর মৃত্যুর পর রানি জুবায়দা হজব্রত পালনে গেলেন। পবিত্র মক্কায় পানির সমস্যা দেখে তাঁকে এতই ব্যথিত করেছিল যে পানির সমস্যা চির অবসানের জন্য একটি খাল খননের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেন। তখন একমাত্র জমজম কুপ ছাড়া পানির আর কোনো উৎস ছিলো না। জমজমের উৎস মক্কা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে আরাফাতে পানির জন্য হাহাকার লেগে থাকতো। বিশেষ করে হজের সময়। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) মক্কায় আগত হাজিদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে পানির ব্যবস্থা করেন। মুয়াবিয়া (রা.) তা আরো সম্প্রসারিত করেন।
হজব্রত পালনের পর বাগদাদ ফিরে রানী জুবাইদা জনগণের উদ্দেশ্যে বললেন, পানি সরবরাহের উদ্দেশ্যে খাল খননের নিমিত্তে আমি সকল হিসাব বন্ধ করে দিচ্ছি। যাদের কাছে আমি টাকা পাবো সে টাকা পরিশোধ করতে হবে না এবং আমি যাদের কাছে ঋণী তাদের ঋণ অতিসত্বর দ্বিগুণ হারে পরিশোধ করা হবে। এরপর তিনি হাজিদের কল্যাণে পবিত্র মক্কা নগরী পর্যন্ত একটি খাল খননের আদেশ দেন। হাজার বছর ধরে এই খাল দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়েছে।
রানি জুবাইদা খাল খননের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে বিখ্যাত প্রকৌশলী, বিশেষজ্ঞ ও ভূমি জরিপকারকদের ডেকে পাঠান। এখনকার মত তখন আধুনিক প্রযুক্তিও ছিলো না। সমগ্র এলাকা জরিপ করার পর তাঁরা সিদ্ধান্ত দেন আরাফাত থেকে ৯৫ কিলোমিটার দূরে হুনায়ন পার্বত্য এলাকায় প্রবাহিত ঝর্ণা থেকে খাল কেটে আরাফাতে পানি আনা হবে। এ হুনায়নে এর আগে মুসলমানদের সাথে বিধর্মীদের একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো- যা গাযওয়ায়ে হুনায়ন যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই ঝরনা তখন সেখানকার অধিবাসীদের পানীয় জল, সেচের জলের প্রয়োজন মেটাত। এই অঞ্চলটি কঙ্করময়, অনুর্বর, শুষ্ক এবং এর আবহাওয়া উষ্ণ। ফলে ভূ-পৃষ্ঠে একটি খালের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন ছিল। তাই প্রকৌশলীরা টানেলের মাধ্যমে ভূ-গর্ভস্থ খাল খননের পরিকল্পনা করেন। জনগণ যাতে এই খাল থেকে পানি সংগ্রহ করে তাদের প্রয়োজন মেটাতে পারে এর জন্য কিছুদূর অন্তর অন্তর ভূপৃষ্ঠে পানির স্টেশন স্থাপন করা হয়। হুনায়ন উপত্যকার ঝরনার পানি এবং পথিমধ্যে অন্যান্য উৎসকে এই নহর অভিমুখে এনে এর সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। রানি জুবাইদার নির্দেশে হুনায়ন উপত্যকার ঝরনার পানির অন্যান্য উৎস বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘যদি প্রয়োজন হয় কোদাল এবং শাবলের প্রতিটি আঘাতের জন্য আমি এক দিরহাম অর্থ পরিশোধ করব।’ বহু বছরের কঠোর পরিশ্রমের পর অবশেষে জাবাল-ই-রামা তথা দোয়ার পর্বত পেরিয়ে এই নহর আরাফাতে নিয়ে আসা হয়। এরপর এই খালের সংযোগ মুজদালিফা ও মিনা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। কথিত আছে এই খাল নির্মাণে সেসময় জুবাইদা প্রায় ২০ লাখ দিনার ব্যয় করেছিলেন।
৮৫০ খ্রিষ্টাব্দ তথা ২৪৫ হিজরিতে পবিত্র মক্কা এলাকায় ভূমিকম্প হয়েছিল। ফলে নহর-এ-জুবাইদার বিভিন্ন অংশে ফাটল দেখা দেয়। তৎকালীন শাসকের নির্দেশে তাৎক্ষণিকভাবে তা মেরামতও করা হয়। পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকজন শাসক নহর-এ-জুবাইদার উন্নয়ন সাধন করেছিলেন। কালের প্রবাহে ব্যবস্থাপনা ও মেরামতের অভাবে নহর-এ-জুবাইদা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। কয়েক শতাব্দী পর পানির চাহিদা মেটানোর জন্য নতুন নতুন পর্যাপ্ত পানির উৎস তৈরি করা হয়। আমরা যখন মুজদালিফা আর মিনার দিকে যাচ্ছিলাম তখন রাস্তার পাশে মরুভূমির মধ্যে দেখেছি লাখ লাখ গ্যালন পান ধারণসমৃদ্ধ বিশালকারের জলাধার নির্মাণ করে সেখানে পানি ধরে রাখা হয়েছে।
১৮৭৮ সালে তৎকালীন শাসকরা নহর-এ-জুবাইদা ব্যবস্থাপনা ও মেরামত করার জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ১৯২৫ সালে উজানে নুমান উপত্যকায় বন্যায় খালটি অনেক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এতে তিন মাসের জন্য পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাদশাহ আবদুল আজিজ শাসনভার গ্রহণ করার পর নহর-এ-জুবাইদা সংস্কার করেন। কিন্তু ১৯৮০ সালের প্রথম দিকে নানা কারণে নহর-এ-জুবাইদার পানিপ্রবাহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায় এবং তা আর পুনঃসংস্কার করা হয়নি। পরে নহর-এ-জুবাইদার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যার কারণে এই নহরটি এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে।
রানি জুবাইদা শুধু এই নহর তৈরি করেই বিখ্যাত হননি; তিনি কুফা থেকে পবিত্র মদিনা ও মক্কা নগরী পর্যন্ত মরুভূমির ওপর দিয়ে প্রায় এক হাজার ৪০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কের উন্নয়ন সাধন করেছিলেন, যা হজযাত্রীরা ব্যবহার করতেন। মক্কা থেকে মদিনা পর্যন্ত যেতে আমরা যে রাস্তা ব্যবহার করেছি সেই রাস্তাটিই নাকি তিনি সংষ্কার করেছিলেন বলে ইতিহাসে জানা যায়। পবিত্র মক্কা ও মদিনা বাগদাদভিত্তিক আব্বাসীয়দের শাসনাধীন ছিল দীর্ঘ সময় ধরে। ফলে আব্বাসীয় শাসকরা বাগদাদের সঙ্গে এই পবিত্র নগরীর যাতায়াতের জন্য রাস্তা সংস্কার, মঞ্জিলে নানা সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে অর্থ ব্যয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। প্রাচীনকালে দিনে বিশ্রাম, রাতে যাতায়াতের প্রচলন ছিল। সাধারণ নিয়মে এক রাতে ১৬ মাইল পর্যন্ত যাওয়া যেত। ১৬ মাইল পর বিশ্রাম অবস্থানকে বলা হতো মঞ্জিল। রানি জুবাইদা বাগদাদ থেকে পবিত্র এই দুই নগরীতে যাওয়ার মঞ্জিলগুলোর সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে বিপুল অর্থ ব্যয় করেন। সঙ্গে উট, গাধা, ঘোড়া যাতায়াতে সুবিধার জন্য সমতলে বালু সরিয়ে এবং পাহাড়-পর্বত কেটে সড়ক সংস্কার করেন।
মক্কা, সৌদি আরব: ১০ ফেব্রæয়ারি ২০২২
E-mail: [email protected]

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.