![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আজও কি তোমার শহরে হলুদরঙা রোদ ওঠে, চকচকে সোনার মত রোদ ? সে রোদ দেখে কি আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে পাখির ডাকে ভোর হয় ? সকালের সে স্নিগ্ধতা কি আজও আছে ? তুমি কি আজও ছাদে আসো সূর্য্ দেখতে ? নিশ্চয়ই আমার মত তোমাকে কেউ পাগলী বলে ডাকে না। তোমাদের খাঁচার গলায় লাল মালা ওঠা টিয়াপাখিটা কি আজও আধোসুরে ডেকে ওঠে ? তোমাদের দোতলার রেলিং এর ফাঁকা দিয়ে আজও কি তুমি কারও মাথায় জল ছেটাও ? আর যদি ছেটাও সে নিশ্চয়ই আমার মত রেগে যায়না। তোমাদের বাড়ীটার রং-করা দেওয়াল কি এখনও আগের মত স্নিগ্ধ আর মনকাড়া ? বড় দেখতে ইচ্ছে করে তোমায় ? কি করব বল ? অনেক দূর শহরে নির্বাসিত আজ আমি।
মনে আছে তোমার সেই ছোট্টবাটের প্রিয় ছাতাটার কথা ? তুমি কখনও কাছছাড়া করতেনা। একদিন কলেজে আমি নিয়েছিলাম বলে অনেক রেগে ছুড়ে ফেলেছিলে। আমি ভিজে গেছিলাম। আমার সদ্য কেনা লাল কাগজে জড়ানো প্রিয় লেখকের গল্পের বইয়ের রং আর গন্ধ ধুয়ে গেছিল সেদিন। আমি রাগতে গিয়েও তোমার চোখের দিকে অপলকে তাকিয়ে থেকেছি। বইখানা অনেক কষ্টে পকেট খরচ বাঁচিয়ে তোমার জন্যে কিনেছিলাম। অনেক না খাওয়া দুপুরের গল্প লুকিয়েছিল ওটাতে। তুমি সেই অনাহারী আর্তনাদের দিকে কর্ণপাত না করে প্রিয় ছাতার জন্যে কতইনা বকলে আমায়। বইখানা আমার করুন চোখের দিকে তাকিয়ে বিনাপ্রতিবাদে নিজেকে বিলিয়ে দিল নিষ্ঠুর বৃষ্টিতে। তখন আমার চোখেও বৃষ্টি ছিল, তপ্ত, যার সাথে প্রকৃতির নিষ্ঠুর বরফশীতলতাময় বৃষ্টির পার্থ্ক্য তোমার উদাসীন চোখে ধরাও পড়ল না। এখনও কি তোমার শহরে বৃস্টি হয়? আজও কি তোমার কোনও প্রিয় ছোট্টবাটের ছাতা আছে ? সেটা যদি কেও নেয় তাকে আর বোক না। তার সাথে বৃষ্টিতে ভিজো। তার প্রিয় বইখানাকে বৃষ্টিতে ধুয়ে যেতে দিও না। তার চোখে অশ্রু ঝরিও না। আমি তো এই হারিয়ে যাওয়া শহর থেকে কখনও ফিরব না জানি তবু তোমায় বড় দেখতে ইচ্ছে করে। কি করব বল ? বহুদূরে যে আমি।
আজও কি তোমার সেই ছোট্ট লাল টিপটা আছে যেটার সাথে লাল শাড়ী পরতে তুমি ? পরীর মত লাগত তোমায়। তোমার কালোচুলে বর্ষার মেঘ কি আজও খেলা করে ? পটলচেরা চোখের তীব্র কটাক্ষে আজও আমার মত কারও মনে বাজ পড়ে কি ? তুমি রেগে গেলে কি এখনও শরতের আকাশের কালো মেঘের মত আঁধার ঘনায় ? তোমার পায়ের যে ঝুমঝুম শব্দবাজা নূপুর ছিল যা আমার কানে সবসময় বাজত, ওটা কি এখনও বাজে ? বড্ড শুনতে ইচ্ছে করে আজও, কিন্তু চিরবিদায়ের গান শোনার পরে তো আর তোমার শহরে ফেরার কোনও উপায় নেই আমার কাছে।
তুমি কি এখনও গান কর ? যে গানে মনের ময়ূর নাচত আমার। তোমার মুক্তোর মত আঙুলগুলো কি এখনও হারমোনিয়ামের সাদা চাবিগুলোর উপরে সাবলিল যাতায়াত করে ? আদা দেওয়া রং চা কি বাবার বকুনি লুকিয়ে এখনও খাও তুমি ? গানটা থামিওনা তুমি। আমি যেতে না পারলেও আমার বিশ্বাস হাওয়ার নাচনে তোমার গলা হয়তো এই অজানা শহরের অজানা গলির ছোট্ট ঘরে একদিন নিশ্চয়ই ভেসে আসবে । বিবর্ণ্ এই নীল আঁধার শহরে আমি অপেক্ষা করব অনন্তকাল।
তোমাদের বাড়ীর কিছুটা দূরের সেই বৈশাখী মেলা নিশ্চয়ই থেমে যায়নি আজও! তুমি সেদিন লালটিপে আর লালশাড়ীতে নকশাকাটা নীল রুমাল নিয়ে বেরিয়েছিলে। পথে রুমালটা পড়ে গেছিল অন্যমনষ্কতায়। আমি কুড়িয়ে পেয়ে তিনমাইল পায়ে হেঁটে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম তোমায়। তোমার কোমল হাতখানি আমার হাতে একটু ছুঁয়েছিল যেটাকে আমি কয়েকদিন কাওকে স্পর্শ্ করতে দিইনি। আমার বন্ধু ছিলনা। থাকলে নিশ্চয়ই মজা করে বলত, রুমাল দিলে ঝগড়া হয়। আমিও হয়তো জবাব দিতাম না ভাবতাম, ভাল করে দেখায় হলনা, ঝগড়া হবে কি করে ? আজ এই অজানা শহরে কথা বলার মতনই কেও নেই তাই ঝগড়া করার সুযোগও নেই। হাঁটার সুযোগ না থাকলে দৌড়ের কথা কল্পনা করা বৃথা।
জান, আজ এই সাদা-কালো অজানা শহরটাতে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। সাথে ঝড়ের মাতাল হাওয়া। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ঘনঘন। খুব তেষ্টা পাচ্ছে। তোমাকে দেখার তেষ্টা, তোমার কথা শোনার তেষ্টা, তোমার নকশাকাটা রুমালের স্পর্শ্ পাওয়ার তেষ্টা, তোমার সাথে বৃষ্টিতে ভেজার তেষ্টা। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। পূর্ন্ জলের পাত্রটা দুই-তিনবার শূন্য করার পর হাল ছেড়ে দিয়েছি। জানিনা তোমার শহরে আজ বৃষ্টি আছে কিনা ! বাজ আর বিদ্যুৎচমকের সাথে শীতল হাওয়া বইছে কিনা তাও জানা নেই। তবু কামনা করি তোমার ঘুমটা যেন ভাল হয়। আর যেন তেষ্টা না পায়। তেষ্টা খুব খারাপ। নেশার মত। কোনও কিছুতেই থামে না। এই শহরের আকাশে-বাতাসে মানুষ নেই, নেই জীবজন্তু, পাখির গান নেই, চাঁদ নেই, নেই সাগর। কোনও আশা-নিরাশা-আবেগ কিছুই জীবন্ত নেই। চারপাশের স্মৃতিভক্ষক কীটগুলো নেই দেখে সযত্নে তোমাকে স্মৃতি থেকে বের করেছি। আবার যত্ন করে রেখে দেব, তুমি ভেবনা। তোমাকে নিরাপদেই রাখব আমি। এই হারিয়ে যাওয়া মৃতশহরে আমি হাজার মৃতমানুষের ভীড়ে মৃত হয়েও বাঁচিয়ে রাখব তোমার স্মৃতি, বেঁচে থাকব তোমার স্মৃতির পাহারাদার হয়ে।
---তোমার মৃত স্মৃতির পাহারাদার
©somewhere in net ltd.