নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি কেউ নই, আমি আমার নই, আমি তোমার নই, আমি তুমিও নই

বেচারা

Walid

বেচারা › বিস্তারিত পোস্টঃ

কেমন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম? এমনটা নিশ্চই নয়

০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সকাল ১১:১৫

একদা হেনরি কিসিঞ্জারের বর্ণিত ’তলাহীন ঝুড়ি’ বাংলাদেশ বিভিন্ন কারনেই আজ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ। স্বাধীনতার ৪৫ বছরে শুরুর বিভিন্ন হোঁচট কাটিয়ে সর্বসাম্প্রতিক বাংলাদেশ জিডিপি গ্রোথ, রিজার্ভ মানি, এ্যনুয়াল বাজেটের ভলিউম, সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট, হেলথ সেক্টর, প্রাইমারি এডুকেশন, ইমিউনাইজেশনসহ বিভিন্ন খাতে (আমাদের সরকার বাহাদুর ও স্টাটিসটিক্যাল ডিপার্টমেন্টের বর্ননামতে) আমাদের সাফল্য রীতিমতো বাঘা বাঘা উন্নয়ন তাত্ত্বিক ও ওয়ার্ল্ড লিডারদের তাক লাগিয়ে দিয়েছে ।
’উন্নয়ন‘ একটি বিশাল টার্ম যার ব্যাখ্যা অনেক তথ্য, উপাত্ত, বিশ্লেষনের দাবী রাখে। আমার মতো একজন সামান্য কেরানীর পক্ষে সিপিডি বা বিআইডিএস’র মতো বিজ্ঞ বিশ্লেষন করা একেবারেই বাতুলতা। আমার উদ্দেশ্যও তা নয়। আমি দেশের (তথাকথিত) এই উন্নয়নে আর দশজন বাঙালীর মতো আপ্লুত অবশ্যই। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সাফল্যের খবরে আর দশজন বাংলাদেশীর মতো আমিও গর্বিত বোধ করি। তবে উন্নয়নের যেমন অর্থনৈতিক ও বানিজ্যিক ডাইমেনশন আছে তেমনি তার সামাজিক পারসপেকটিভও আছে। উন্নয়ন বা ফ্যাব্রিকেটেড উন্নয়নের সত্যিকারের স্ট্যাটাস মাপবার যেমন অনেক বৈজ্ঞানিক প্যারামিটার আছে তেমনি উন্নয়নের অনেক সাইড এফেক্টও আছে। আমি ওগুলোকে বলি উন্নয়নের প্রসব যন্ত্রনা। বাংলাদেশের অর্জনগুলো নিয়ে খুব বেশি গবেষনায় আমি যাবনা। ওটা আমাদের রাজনীতিক, আমলা আর টকশো’র সেলিব্রেটিদের ক্রেডিটের জন্য রেখে দেব।
আমার মতো ভেতো বাঙালীর চোখে বাংলাদেশের সবচেয়ে লাগসই সাফল্যগুলি ‍খুব সংক্ষেপে যদি বলতে চাই তবে বলা যায়:-
১.৪০ বছর পরে নিজস্ব স্বচ্ছ আইনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করতে পারা।
২.ক্রীকেটের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিশ্বপরিচীতি এবং ধারাবাহিকভাবে ক্রীকেট পরাশক্তি হবার পথে অগ্রগতি।
৩.বাংলাদেশের একজন মানুষের নোবেল জয়।
৪.বাংলাদেশী হিসেবে কারো এভারেষ্ট জয়।
৫.এককালের তলাহীন ঝুড়ির ৪ লক্ষ কোটি টাকার বার্ষিক বাজেট দেবার দুঃসাহস
৬.পদ্মা সেতুর মতো একটি অত্যন্ত দুঃসাহসিক চ্যালেঞ্জ দেবার মতো দাপট।
৭.গার্মেন্টস নামক একটি বিষ্ময়কর শিল্পন্নোতি।
৮.কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা, প্রাথমিক শিক্ষা, সাক্ষরতা, টিকাদান কার্যক্রম, স্যানিটেশন-এই সামাজিক উন্নয়ন সূচকগুলোতে বাংলাদেশের সারাবিশ্বের মধ্যে স্বীকৃত সাফল্য।
৯.বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি বিশাল অঙ্কের ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ।
১০.এসডিজি ও এমডিজিতে বাংলাদেশের ইর্ষনীয় সাফল্য। এই সবগুলো বিভিন্ন প্যারামিটারে বাংলাদেশের ইতিবাচক অর্জন। এই অর্জনগুলোর চর্বিত চর্বন করতে ভালই লাগে। বুকের ছাতিটা ফুলে দশহাত হয়ে যায়।
অর্জনের এই উজ্জল চিত্রটির বিপরীতে একটা পঁচন ও অধঃগমনের কালো মেঘও ক্রমশ ঘনাচ্ছে (এটা আমার মতে)। ওই যে বলেছিলাম না উন্নয়নের কিছু প্রসব বেদনা আছে? উন্নয়ন বা ফ্যাব্রিকেটেড উন্নয়নের সাইড এফেক্ট ও ইমপ্যাক্ট হিসেবে অনেক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নোংরা, অধঃপতন, জঞ্জালও ঢুকে পড়ে সমাজে। উন্নয়ন উপভোগের পাশাপাশি এগুলোর কামড়ও সহ্য করতে হয় উন্নয়নভোগী দেশের মানুষকে। তো বাংলাদেশের ভবিষ্যত কী? ওয়েল, এটি একটি দুরকল্পনা হয়ে যাবে। তবু বলব। ভাববেন না, আমি দেশের বদনাম করছি বা অতি কল্পনা করছি। আমি শুধু আমার সীমিত জ্ঞানে আমার এই জন্মভূমির একটা ভবিষ্যত চিত্র কল্পনায় আনার চেষ্টা করছি। আমি খুব খুশি হব যদি এই প্রোপোজিশন মিথ্যে প্রমানিত হয়।
১.বাংলাদেশের অন্যতম ভবিষ্যত হল নিউক্লিয়ার ফ্যামেলি ও নিউক্লিয়ার সোসাইটি। আমাদের সমাজে বাড়ছে ব্যাক্তস্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের নামে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা আর বিচ্ছিন্নতা। সামাজিক ও বন্ধুবৎসল হিসেবে আমাদের বাঙালীদের যে বহু বছরের ঐতিহ্য ছিল তাতে চিড় ধরেছে বহু আগে। বিশেষ করে মোবাইল, ইন্টারনেট, ডিশ ও সোস্যাল মিডিয়ার যুগে প্রবেশের পর। আমরা কি আমেরিকার মতো একটি বিচ্ছিন্ন সমাজ ব্যবস্থার ধনী দেশ হতে চাইব যেখানে দিল্লীর মতো একজন দুর্ঘটনা আক্রান্ত ব্যক্তি প্রকাশ্য দিবালোকের রাস্তায় কারো সাহায্য না পেয়ে রাস্তায় মারা যাবেন? মনে হয় না সেটা খুব বেশি দূর। আমাদের এই বাংলাদেশেই এখন ঘটছে এমন ঘটনা যেখানে একজন দুর্ঘটনা আক্রান্ত মুমূর্ষূ ব্যক্তির সর্বস্ব লুট করা হয়েছে তার স্ত্রীর সামনে। তাকে উদ্ধারের কোনো চেষ্টা করার বদলে। প্রমান পাবেন এখানে: Click This Link

২.সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও উচ্চাসনে পৌছাবার একটা উদগ্র লোভের তীব্র স্রোত আমাদের সমাজকে খুব স্লো পয়জনের মতো গ্রাস করছে। বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, ব্যাংক ব্যালেন্স, প্লট, দামী চাকরী, সোস্যাল স্ট্যাটাস, সেলিব্রেটি তকমা, ফ্যান বেস, প্রোপার্টির মালিকানা-এসব বিত্তবাসনা কার না থাকে। সব কালেই ওগুলো মানুষকে মোটিভেশন যুগিয়েছে নিজেকে আরো উপরে নিয়ে যাবার। কিন্তু সেই মোটিভেশন আজ রূপ নিয়েছে মহামারির। উপরে যাবার বাসনা এখন আর শুধু আশা বা বাসনায় সীমিত নেই। সেটা ইন জেনারেলি গোটা সমাজের আত্মিক দুর্যোগে পরিণত হয়েছে। একটু কান পাতলে আর চোখ বোলালেই দেখতে পাবেন, আমাদের চারপাশের অধিকাংশ মানুষ খোলাখুলিভাবে বড়লোক হবার জন্য, উপরে উঠবার জন্য যেকোনো তরিকা এপ্লাই করতে তৈরী। উপরে ওঠার জন্য যেকোনো কিছুতে ছাড় দিতে, যেকোনো কিছুতে কম্প্রমাইজ করতে, যে কাউকে ল্যাং মারার মতো দানবীয় সমাজ আমরা নির্মান করছি। এই উদগ্র লোভের সমাজের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ।

৩.ঘুষ, দুর্নীতি, অবৈধ আয়-তিনটি বিষয়কে বরাবরই আমাদের সমাজে নিচু চোখে দেখা হয়ে এসেছে। এই কিছুদিন আগেও আমাদের পরিবার বা বন্ধুমহলে কেউ দুর্নীতি করে ধরা পড়লে বা কারো ঘুষ খাবার ব্যাপারে আভাস পেলে আমরা তীব্রভাবে তাকে ঘৃনা করতাম। ঘুষখোরের সামাজিক অবস্থান ছিল বেশ কোণঠাসা। ঘুষ বিনিময় হয় এমন চাকরী করা পাত্রদের পাত্রী পাওয়া যেত না। আজ এই ২০১৭ সালের বাংলাদেশের চিত্র জানেন? এখন আর ঘুষ খাওয়া, সুদ খাওয়া, অবৈধ আয়, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানির ইনকামকে তেমন দোষনীয় বলে মনে করা হয় না। বরং কারো ওসবের মুরোদ না থাকলে বন্ধু ও আত্মীয় মহলে তাকে বেকুব তকমা দেয়া হয়। একটা গোটা সমাজ যখন দুর্নীতিকে বরন করে নেয় তাদের ভবিষ্যত খুবই প্রশ্নসাপেক্ষ।

৪.স্বাধীনতার পরে আমাদের সবচেয়ে মৌলিক ধ্বংসসাধন বলে কিছু ঘটে থাকে তবে সেটা বোধহয় শিক্ষা ও সংস্কৃতির মৌলিক দুষন ও মানের অবনতি। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে খুব পরিকল্পিত ও ধারাবাহিকভাবে শিক্ষার মূল প্রবাহ ও থীম হতে সরিয়ে একে শুধুমাত্র চাকরী পাবার সার্টিফিকেট প্রদান প্রক্রিয়ায় পরিণত করা হয়েছে। আর তারপর সেই কমার্শিয়াল এডুকেশনটাকেও লেখাপড়া ব্যতিত সার্টিফিকেট প্রদানের মহোৎসবে পরিণত করা হয়েছে। বড় বড় শহরের কয়েকটা হাতে গোনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যতিত স্কুলের পড়াশোনার মান শূন্যের তলানীতে। শিক্ষার রেডিক্যাল অবনতি শুরুর পরবর্তি ব্যাচগুলো হতে ছাত্ররা এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। এখন শিক্ষক হন অন্য চাকরী না পেয়ে পড়ে থাকারা। শিক্ষকতাকে ভালবেসে ক’জন এখন শিক্ষক হন? (হ্যা ব্যতিক্রমী পূজনীয় ব্যক্তিত্ব এখনো আছেন।) তো এই শিক্ষকরা ছাত্রদের কোন কোয়ালিটির শিক্ষা দান করবেন? শিক্ষা নিয়ে আমার মৌলিক একটি বিস্তারিত লেখা পাবেন এখানে:-http://www.somewhereinblog.net/blog/Bechara/30208642

৫.আমি আমার হাফপ্যান্ট বয়স হতেই দেখতাম আমাদের মিডিয়া, সংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক চর্চার খুব সুন্দর একটি সামাজিক আন্দোলন এদেশে ছিল। আমাদের সেই সুস্থ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আজকে ডিস, ট্যাব, ইন্টানেট, স্মার্টফোন, গ্লামার, স্ট্যাটাস-এসবের চক্করে পরে ত্রাহি মধুসুদন অবস্থা। আমি যদি খুব ভুল না করে থাকি, বাংলাদেশের কতজন দর্শক এখন আমাদের দেশের কোনো চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখেন। গান, নাচ, ফাইন আর্টস, লোকশিল্প-কোনটাতে আমরা আমাদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছি? হয়তো বলবেন, সংস্কৃতি যুগে যুগে বদলায়। হ্যা বদলায় তবে সেটা নিজের ভিত্তি ও কৃষ্টিকে ধরে রেখে। আমাদের সংস্কৃতি এখন পুরোপুরি ইন্ডিয়া, পাকিস্তান আর হলিউডের অনুকরন। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি বলে কিছু আপনি খুঁজে পাবেন? পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসনে আমাদের কোন নিজস্বতা আর অবশিষ্ট আছে জানা আছে কি? গানের কথাই ধরুন। আমাদের অন্তত কয়েক ডজন নিজস্ব সংগীতের ধারা ছিল-জারি, সারি, মুর্শীদি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালী, শ্যামা, কীর্তন, ঠুমরী, লালন, হাসন, মরমী, হামদ, নাত-কোনটা বেঁচে আছে বলুন তো? আপনি শেষ কবে কাউকে দেখেছেন সিডিতে জারি গান শুনতে? যে জাতি তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয় ইচ্ছে করে ভুলে যায়, তার ভবিষ্যত পরিচয় কী হবে?

৬.রাজনীতিকরন বা পলিটিসাইজেশন নিয়ে নতুন করে কী বলব? বাংলাদেশে এখন শিশু লীগ নামক অদ্ভূৎ রাজনৈতিক প্লাটফরম আত্মপ্রকাশ করে ফেলেছে। রাজনীতির পরিপক্কতায় কি আমরা আমেরিকা, ভারত, ইংল্যান্ড বা ফ্রান্সকেও ছাড়িয়ে গেছি যেখানে শিশু তো দূরে, ছাত্রদেরও কোনো রাজনীতি করার সুযোগ নেই? আমার এলাকার এমনকি টেম্পুর হেলপার ১২ বছর বয়সি বাচ্চাটিও কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য। তাকে এখন ভাড়া নিয়ে একটি টু শব্দও করা যায় না। কারন সে তাহলে মুহূর্তের মধ্যে একটি গ্যাঙ নিয়ে আপনাকে সাইজ করতে সক্ষম। আমি নিজে এর সাক্ষি। সরকারী অফিস হতে মসজিদ মন্দির-কোনোকিছু আর রাজনীতিকদের কবলের বাইরে নেই। সবরকম সুবিধা, অধিকার, মালিকানা, বরাদ্দ, এখন সবই পলিটিসাইজেশনের শিকার। পলিটিক্যাল ব্যাক আপের কারনে এই দেশে কোনো অপরাধ করাই এখন আর খুব বড় সাহসের বিষয় না। পাড়ার বিড়ির দোকান হতে সংসদ-সর্বত্রই পলিটিক্যাল ব্যাকআপ থাকাটাই এখন সবকিছুর ভাগ্য নিয়ন্ত্রন করে। পৃথিবীর কোনো দেশে এরকম পলিটিসাইজেশনের পরিণতি ভাল হয়নি।

৭.যেকোনো দেশের এগোনো, বেঁচে থাকা আর ভবিষ্যত নির্ভর করে তার জেনারেশন বিল্ড আপ করা ও শিশুদের গড়ে তোলার উপরে। আমাদের শিশুদের ঠিক কিভাবে গড়ে তোলার ব্যবস্থা আমাদের স্টেট নিয়েছে জানেন কি? আমি জাপান, ইতালি, ফিনল্যান্ড ও ইউএসএর শিশুদের লালনপালন ও গড়ে তোলার উপরে যতটুকু পড়ে দেখেছি তার কোনোটির সাথে আমাদের দেশের সিস্টেমের মিল পাইনি। আপনি হয়তো বলবেন, দেশে দেশে সিস্টেমের ভিন্নতা থাকে। হ্যা থাকে তবে সেটার মৌলিক ভিত্তিটা একই। আমাদের দেশ শিশুদের অদ্ভুৎ এক প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে বড় হতে বাধ্য করছে। সচেতন বা অচেতনভাবেই। যার পরিনতি হল একটি বোধ বুদ্ধিহীন রবোটিক ও নৈতিকতাহীন পরবর্তি প্রজন্ম। একবার ভেবে দেখুন আপনার নিজের শৈশবকাল ও আপনার সন্তানের শৈশবকালের মধ্যে যেসব মৌলিক ব্যবধান দেখতে পাচ্ছেন তার পরিনতি কি আপনি গেস করতে পারছেন? আমি একটি সামারি বলি-একটি ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ও রোগপ্রবন, দুর্বল শারিরীক ফিটনেসের মৌলিক বিদ্যাবিহীন, রবোটিক বুদ্ধির, সৃষ্টিশীলতা বর্জিত, দুর্বল নৈতিকতার একটি প্রজন্ম পেতে যাচিছ আমরা।

৮.উন্নয়নের হাত ধরে এদেশে বাড়ছে অস্থিরতা, পরমত সহিষ্ণুতার অভাব, হিংসাত্মক কর্মকান্ড, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, হিংস্রতা, স্বার্থপরতা, ব্যক্তিসাতন্ত্র ও সামাজিক ভাঙন। ওগুলোর সম্মিলিত প্রভাব আমাদের অন্যান্য স্ট্যাটিসটিক্যাল উন্নয়নের সুফল কতটা ভোগ করতে দেবে সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ। সামাজিক হিংস্রতার উগ্রতা এতটাই বেপরোয়া পর্যায়ে পৌছেছে যে, মায়ের হাত সন্তানের বা সন্তানের হাতে মায়ের খুন হওয়ার মতো অসম্ভব বিকৃত অপরাধের কিংবা ১ বছরের শিশুকে ধর্ষনের ঘটনা অহরহ দর্শন করতে হচ্ছে আমাদের। সবই উন্নয়নের সাইড এফেক্ট।

৯.বাংলাদেশ বরাবরই ছিল একটি শান্তিপ্রিয় ও ধর্মভিরুদের দেশ। খুব দুঃখজনক হলেও সত্যি, আজকের বাংলাদেশে ধর্ম, ধর্মবিশ্বাস, ধর্মীয় আইন, ধর্মীয় মতপার্থক্য অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি তীব্র। আপনার কাছে খুব বায়াজড মনে হলেও একটা কথা বলি, এদেশে ধর্মান্ধতা মহামারির পর্যায়ে পৌছেছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ইস্যুতে নিকট অতীতে তার প্রমান নিশ্চই পেয়েছেন। সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হল, ধর্মান্ধতা একসময় যাকে মনে করা হত গ্রামের মানুষের মধ্যেই আছে এখন সেটা শহুরে মানুষ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মনমগজেও ঠাই করে নিয়েছে। কোনো বিশেষ ধর্ম নয়, সব ধর্ম নিয়েই চলছে উগ্রতার চর্চা। ধর্ম-যার আগমন হয়েছিল শান্তি ও সম্প্রীতীর হাত ধরে তার এখনকার ব্যবহার হল ও দুটোর বিপরীতে।

১০.বিগত ১০ টি বছরে বিশেষত আমাদের দেশে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ডিশ ও স্মার্টফোন সস্তায় গ্রাহকের হাতে পৌছানোর সাথে এদেশে পশ্চিমা দেশের মতো নাইটক্লাব ও ওপেন প্রেম সংস্কৃতি যেমন সামাজিক ব্যাধির রূপ পেয়েছে তেমনি এর সাথে আরেকটা ব্যাধিও বাড়ছে-রেপ। আপনি হয়তো খেয়াল করেছেন বা করেননি, প্রতিটি মাসে ‍নিরবে নিভৃতে মোট কতগুলি রেপের ঘটনা ফাইল হচ্ছে? সেই সংখ্যাটি ১৯৯০ সালের সাথে তুলনা করলে কি মনে হচ্ছে ব্যবধান ও বৃদ্ধিটা খুব অস্বাভাবিক? শুধুমাত্র টেকনোলজি আর অবাধ মিডিয়াই দায়ী তা নয়। তবে ওরাই বেশিরভাগটা দায়ী। যে কারনেই হোক, রেপ এখন আমাদের প্রতিষ্ঠিত একটি সামাজিক ব্যাধি। একসময় আমরা ইন্ডিয়াকে ব্লেম করতাম। এখন আর ওদের সাথে আমাদের কোনো ব্যবধান নেই (সংখ্যা ও ব্যপকতার বিচারে।) রেপ শুধু চুুরি বা ডাকাতির মতো একটি ক্রাইম না। একটি গোটা দেশে মহামারির আকারে রেপের ঘটনা ওই দেশ ও সমাজের সার্বিক স্ট্যাটাসের চিত্র।

১১.খুব নিরবে একটি মহামারি ঘটে যাচ্ছে এই দেশে যার চোরাস্রোত কান পাতলে শুনতে পাবেন। বাংলাদেশে এখন ভেজাল ও বিষ দেয়া হয় না এমন কোনো খাদ্য বা পানীয়ের নাম বলতে পারবেন? পাশাপাশি আছে তীব্র মাত্রার বায়ু ও পরিবেশ দূষন। বলবেন, ওগুলোতো মামুুলি বিষয় আর সবদেশেই তো ওগুলো আছে। আছে। তবে তার ব্যপকতা আমাদের মতো নয়। ভেজাল খাদ্য ও পানীয় এদেশের ১৭ কোটি মানুষ বিশেষত শিশু ও মায়েদের অবশ্যম্ভাবিভাবে ধ্বংস করছে। শারিরিকভাবে আনফিট, দুর্বল,রোগগ্রস্থ ও দুষিত অর্গান নিয়ে গড়ে উঠছে আমাদের গোটা বাংলাদেশের সমস্ত নাগরিক। ভাবুন তো, একটি দেশের ১০০% মানুষ বিষাক্ত খাবার, পানি ও বাতাস গ্রহন করলে তার পরিণতি কী? এর পাশাপাশি আরেকটা বিপদ ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে। মাদকের ছোবল ও তামাক সেবন। বাংলাদেশের মতো এত ব্যাপক ও মহামারি আকারে মাদক ও তামাকের অবাধ ব্যবহার পৃথিবীর খুব কম দেশেই হয়। আমাদের জনগোষ্ঠির একটা বিশাল অংশ মাদক ও তামাকের বিষপানে খুব নিরবে পরিণত হচ্ছে জাতির বোঝা ও ক্যান্সারে।

১২.আরো আরো অধঃপতনের মাঝে কয়েকটা সংক্ষেপে নাম বললে বলব, পরচর্চা, পরমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা, জাতীয় ঐক্যের অভাব, প্রজন্মের বিকৃত শারিরীক ও মানসিক বৃদ্ধি আমাদের ধ্বংসের গোড়াতে ধীরে ধীরে নিয়ে যাচ্ছে। আমার দুঃশ্চিন্তা হয়, আর ১০ বছর বা ২০ বছর পরে আমরা হয়তো সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া কিংবা কোরিয়ার মতো ধনী দেশ হতেও পারি। কিন্তু নৈতিকতা, আত্মিক উৎকর্ষ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও দেশবোধের দিক দিয়ে আমাদের ঐসময়ের পরিস্থিতি কী হতে পারে ভেবে দেখেছেন? এগুলোর পাশাপাশি আরেকটা দুঃসংবাদ আছে আমাদের জন্য। সেটা হল আমাদের তীব্র জাতিগত বিভেদ। আপনি কি বলতে পারবেন, শেষ কবে বাংলাদেশ যেকোনো জাতীয় ইস্যুতে পুরো জাতি একমত হতে পেরেছে? আমি খুবই মর্মাহত হই যখন দেখি এমনকি এই দেশের তাবৎ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে নিহত মানুষের মোট সংখ্যাটি নিয়েও বিতর্ক করে থাকেন।
হ্যা, যেগুলো বললাম ওসব বিষয় ও বিপদ সবদেশেই কমবেশি আছে। তবে বাংলাদেশের সাথে এর ব্যবধানটা কোথায় জানেন? সবদেশেই ওগুলোকে প্রতিরোধ, প্রশমনের জন্য নির্দিষ্ট প্ল্যান ও সিস্টেম তৈরী করা হয় ও হচ্ছে। বাংলাদেশে এই বিষয়গুলোকে আদৌ পাত্তা দেবার মতো বিষয় ভাবাই হয় না। যখন আপনি জানেন আপনার বিপদ কি-তখন সেটা থামানোর অন্তত চেষ্টা করবেন। কিন্তু যদি বিপদকে বিপদ মনেই না করেন, তবে তো নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে বাঘকে ঘাড়ের কাছে আসতে দেবেনই। না, আমি কোনো তথাকথিত বুদ্ধিজীবি বা দেশপ্রেমিক নই। আমি এই দেশের খুব সাধারন একজন মানুষ হিসেবে আমার প্রিয় দেশের ও আমার প্রিয় পরবর্তি প্রজন্মের কাছে রেখে যাওয়া একটুকরো /বাংলাদেশকে নিয়ে চিন্তিত। ইবনে বতুতা ভারতবর্ষকে দেখে একদা বলেছিলেন, ”ভাল জিনিসে পরিপূর্ণ জাহান্নাম।” আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ কি ওরকম একটি নোংরামিতে ও ক্লেদে পূর্ণ সমাজে সাজানো ধনী দেশ হতে যাচ্ছে? তেমন যদি হয় তো অমন বাংলাদেশ দিয়ে আমরা কী করব?

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সকাল ১১:৫৮

লর্ড অফ দ্য ফ্লাইস বলেছেন: ৭ নাম্বার পয়েন্টটা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। শিশুদের জন্য সবচেয়ে নিকৃষ্ট দেশগুলির মধ্যে বাংলাদেশ একটি। দুই পয়সা লাভের আশায় ডাক্তাররা সিজারের মাধ্যমে বাচ্চাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। চাকরিদাতারা মেয়েদের ব্যাপারে যতোটা আগ্রহী মায়েদের ব্যাপারে ততোটা না, ফলে বাচ্চারা বড় হচ্ছে বুয়ার কাছে। খেলাধুলার জায়গা নেই, বাচ্চারা সময় কাটাচ্ছে ডিভাইসে। হাইস্কুলে ওঠার আগেই পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হচ্ছে। বাবা-মা দুজনেই ব্যস্ত, ফাকা বাসায় চলছে রুমডেট। সুস্থরাই তেতাল্লিশ বছরে তেমন কিছু করতে পারেনি আর এই শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত প্রজন্ম কি আর করবে।

২| ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ দুপুর ২:২৪

বেচারা বলেছেন: আমি আমাদের শিশুদের নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন আর হতাশ। আমি অন্ধকার ছাড়া কোনো কিছু দেখি না।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.