মৃত ব্যক্তির কথন

০১ লা জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৫:৪৮

আমার জন্য ৩.৫ হাত পরিমাণ মাটি খুড়ে কবর তৈরি হচ্ছে। সারাজীবন অনেক ভাল মন্দ কাজের হিসাব দিতে হবে আমাকে। আমার জন্য মানুষ কাঁদছে, তাদের চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে সেই মৃত্তিকার পৃষ্ঠে। আমার জানাজায় যে এত মানুষ হবে আমি কখনও ভাবতে পারিনি। আমার পরিবার, আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধু বান্ধব, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নবিত্ত শ্রেণীর লোকই বেশি। কি এমন করেছিলামরে ভাই যে আমার জানাজা পরানোর জন্য এত ঝামেলা পোহাতে হবে স্থান ও সময় নিয়ে ৪ টি জামাত লাগল ১৫ মিনিট পর পর। বুঝেন এবার কত মানুষ হল। আমি হয়ত নামাজ কালামের দিক দিয়ে অনেক গুনাহগার হব, তবে আমার মধ্যে একটা গুণ ছিল যে আমি মানুষকে কখনও ঠকাই নাই আর উঁচু-নিচু-মাঝারি সব শ্রেণী পেশার মানুষের সাথে মিশেছি, বিপদে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি।মানবিক ঘটনাগুলাতে আমি আবেগি হয়ে যাই, তাই ভবঘুরে হয়ে সারা জীবন মানুষের পাশে ছিলাম, মানুষও তাই এখন পর্যন্ত আমার পাশে। জানাজা শেষ, খাটিয়া বহন করছে আমার ২ ছেলে ও ২ নাতি। ৩ ঘণ্টা আগে আমাকে গোসল করিয়ে পবিত্র করা হয়েছে, গোসলের সময় আমার ছোট বেলার গোসলের কথা মনে পরে গেল। মা কত সুন্দর করে গায়ে সাবান দিয়ে ডলেডলে গোসল করাতেন আর আজ পৃথিবীতে আমার শেষ গোসল করাল আমার ছেলে। খুব ভালভাবে মুছে সাদা কাফনের কাপড়ে পেঁচালো আমায় আর আমিতো আত্মাহীন, সব চোখ বন্ধ করে দেখছি।সাদা কাপড়ে পেঁচিয়ে আমাকে খাটিয়ায় তোলা হল। অনেকক্ষণ পরে কবর দেওয়া হবে এই ভেবে ৩-৪ প্যাকেট চা পাতা আমার মাথা, পা ও ২ পাশে রাখা হল যাতে লাশপচা গন্ধটা একটু ম্লান হয়ে আসে আর জীবিত থাকতে শুনেছিলাম যে চা পাতা আর বরফ নাকি পচনশীল জিনিসের দুর্গন্ধ কমিয়ে দেয় এবং কিছুটা সতেজ রাখে।ছেলে আর নাতিরা খাটিয়া তুলল।আর সাথে সাথে সবাই দোয়া পড়া শুরু করল। এখন আমাকে ওরা সবাই কবরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পিছনে অনেক মানুষ, গুনে শেষ করা যাবেনা।এত মানুষ দেখে আমার চোখ বেয়ে পানি বেরিয়ে আসছে। এত লোকের ভালোবাসা কামিয়েছি যে যেটা জীবিত অবস্থায় কখনও কল্পনা করতে পারিনি। চারকোণা কবর খোঁড়া শেষ, আমাকে খাটিয়া থেকে নামাচ্ছে মাটিতে। তার আগে ১ জন নিচে নেমেছে ধরার জন্য। আমাকে মাথা ও পা দুই পাশ থেকে ৪ জন ও নিচের ১ জন ধরে মাটিতে আনলো। লম্বালম্বিভাবে শুইয়ে দিল।কাজ গুলো করার সময় সবাই দোয়া পড়তে লাগল। তারপরে ১ জন নারকেল পাতা কোণাকোণি ভাবে দিয়ে দিল আমার শরীরের উপর দিয়ে। তারপর খোঁড়ানো মাটি ও মাটির টুকরোগুলো সবাই দোয়া পড়তে পড়তে ছিটিয়ে দিল আমার দেহের ওপর আর আমি ধীরে ধীরে অন্ধকার জগতকে অভ্যর্থনা জানালাম। উপরের লোকদের মাটি দেবার কাজ শেষ প্রায়। তারা এখন মাঝের জায়গাটুক উঁচু করে তার ওপর একটা নারকেল পাতা দিয়ে দিবে।আমার আপনজনরা আমার জন্য কাঁদতে কাঁদতে চোখ, মুখ লাল করে ফেলছে কিন্তু আমার কি করার আছে?আমার চারপাশ আচ্ছন্ন, আমি বদ্ধ, আমি বাকরুদ্ধ, আমার আশেপাশে কোন আলোবাতাস নেই। আমি পুরোপুরি অন্ধকার জগতে নিমজ্জিত আছি, আমার অন্ধকার জগত ক্রমেই আমাকে অন্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমি চলে যাচ্ছি অতল এক গহবরে।

০ টি +০/-০