![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
চারতলাতে তখন নতুন ভাড়াটে এসেছে ।
প্রায় চার মাস ধরেই খালি পড়ে ছিল । দুষ্টু লোকেরা বলে ,ভূতের আনাগোনা আছে ও ফ্ল্যাটে । আসলে একসাইডের জামগাছটার জন্য আলো আসে না পূর্বদিকে , একটা বিষণ্ণ অন্ধকার চেপে থাকে দিনের বেলাতেও , পছন্দ না হওয়ারই কথা । আমি আর উৎস তখন প্রথম প্রথম লুকিয়ে সিগারেট খাওয়া ধরেছি , বিল্ডিং এ এরকম ফাঁকা জায়গাতো কল্পনাই করাই যায় না । ছাদে কেউ দেখে ফেলার চান্স থাকতে পারে ,কিন্ত যেখানে ভূতের ভয় সেখানে ছায়া মাড়ানোর সম্ভাবনাই নেই । রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে , দুজনে মিলে ভালই আড্ডা জমত ,আর কিচ্ছুক্ষণ পরপর লাইটারের ঝলকানি । তো নতুন ভাড়াটিয়া আসার পর আমাদের কাছ থেকে অভিশাপ ছাড়া আর কিছু পেল না ।
কিন্ত ঐ পর্যন্তই । ওদেরকে ভয় দেখিয়ে ফ্ল্যাট থেকে তাড়ানোর প্ল্যান প্ল্যানই থেকে গেল । দুমাস কেটে গেল , কে আসল , চিনতামই না । ঢাকার বাড়িগুলো বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত । সবার লক্ষণরেখা নিজের ফ্ল্যাটের চোকাঠ পর্যন্তই , সামনে কারা আছে জানতে মানা । লিফটে হঠাৎ দেখা হলে কেমন আছেন কিংবা বাসায় আসবেন বলে মেকি হাসির মধ্যেই সম্পর্ক স্পষ্ট , হাজার বার প্রতিশ্রুতি দিয়েও আর দরজা পার হয়ে অন্য বাড়িতে ঢোকা হয় না , এমনকি বছরে কোন নিয়ম রক্ষার অনুষ্ঠানে কারো সাথে কথা হলে তাদের নাম মস্তিষ্কের গহীন কোণে হাতড়ে ফিরি । এরকম অবস্থায় বিল্ডিঙ্গের আটাশ নম্বর ভাড়াটের সাথে আর দশজনকে আলাদা করা প্রায় অসম্ভব । তবুও গভীররাতে সুখটানের তীব্র তাড়নায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনে হত , কে আছে ওখানে ?
এইত তিনমাস আগের কথা । সারাদিন ক্লাস শেষে বাসে দুঘন্টা দাড়িয়ে চিড়েচাপ্টা হয়ে অর্ধমৃত্প্রায় । লিফটে উঠে কোনমতে চোখবুজে আমি ফ্যানের কাছে মাথা নেবার চেষ্টা করছি । হঠাৎ পায়ের ওপর এসে পড়ল কিছু । তাকাতেই দেখি পাশে এক আন্টি হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে আছেন , আর ছেড়া পলিথিন ব্যাগ থেকে থেকে এক এক করে আলু,ঢেড়স,বেগুন ফ্লোরে আছড়ে পড়ছে । অতটুকু ব্যাগে এত সবজিসহ এতদূর কিভাবে এলেন -এটা ভেবে অবাক হয়ে রইলাম আমিও । হঠাৎ লিফটের আওয়াজ শুনে আমার কমন সেন্স ফিরে এল । এক পা দিয়ে দরজা আটকে ধরে কাছের আলু পটল কুড়ানোর সময় বললাম , " আন্টি আপনি দ্রুত একটা গামলা নিয়ে আসুন । একবার পায়ের নিচে পড়লে সবকিছু শেষ ।"
"বাবা খামোখা ধরার দরকার নেই । তুমি --"
"ভদ্রতার সময় নেই । তাড়াতাড়ি করুন । "
হঠাৎ করে নিজেই কনফিউজড হয়ে গেলাম , কি একটু বেশি আদেশের মত শোনালো কথাটা ? নাকি আন্টি বলাতে ভদ্রমহিলা মাইন্ড করবেন ? ভার্সিটিতে ওঠার পর অনেকজনকে আন্টি বা আঙ্কেল বললে বিরক্তি নিয়ে তাকায় , আবার ভাই বলতেও নিজের কাছেই কেমন জানি লাগে । মহাযন্ত্রণা !!!! ভাবতে ভাবতেই উনি ঝুড়ি নিয়ে হাজির , আমি চার পাঁচ মিনিট লিফট ধরে রাখলাম , এর মধ্যে উনি দুবার আনা নেওয়া করলেন । এই সময়ের মাঝে বেশ কয়বার ইনিয়ে বিনিয়ে বাজার করাটা কত কঠিন ,বাড়িতে আর কেউ না থাকলে কি ঝামেলা সব বলে নিজের নার্ভাসনেস কাটাতে চাইলেন , আর আমি হু হা করে গেলাম । শেষবার তোলার সময় একবার চা খাবার জন্য অনুরোধ করলেন ,আমি হাসি দিয়ে এড়িয়ে গেলাম ।
" যখনই সময় পাবে বাসায় আসিও ,কেমন -" বলতে বলতে লিফটের দরজা লেগে গেলো , আর উপরের দিকে তাকিয়ে টের পেলাম , আরে এটাতো থার্ডফ্লোর ! সেই চারতলা !!এদেরকে নিয়ে কত অদ্ভূত প্লানই না করেছি আমরা ! মনে মনে হাসলাম ।
পরের সপ্তাহে কোন একদিন বাসের জানলা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আকাশ দেখার চেষ্টা করছি ,আর মনে মনে রাস্তার ফাস্টফুড দোকানগুলোকে দিয়ে যাচ্ছি একের পর এক অভিশাপ , সামনে তাকাতেই দেখি সেই ভদ্রমহিলা , উনিও আমার দিকে তাকিয়ে আছেন । দুজনই চোখ নামিয়ে ফেললাম । ধ্যাৎ ! বাসে আসার সময় কালে ভদ্রে সিট পাই সেটাও আবার ছেড়ে দিতে হবে ? কিছুই করার নেই .উঠে উনাকে বসালাম । এরপর পুরো রাস্তাজুড়ে আমার অ্যাদোপান্ত জেনে ফেললেন ।ঘটকের কাজ করেন নাকি ? আমি বিরক্তি চেপে রেখে একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেলাম । মহিলার চেহারায় তামাটে ভাব , বিগত যৌবন এখনও মুখে সৌন্দর্যের চিহ্ন রেখে গেছে । চুলও বেশি নেই , যত্নের অভাবে ফেলে রাখা সুতোর মতই তাকিয়ে আছে । বেগুনি রঙ্গের নরমাল সিল্কের শাড়ি , সবকিছুই আর দশজনের মত । চোখের জ্যোতিতে জানার অসীম আগ্রহ , ছোট ছোট প্রশ্ন করে যে আনন্দ পান তার জন্য অবশ্য তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে।
একথা ওকথা বলতে বলতে বাসায় পৌছালাম । লিফটে থেকে উনি বের হওয়ার সময় হঠাৎ আমার হাত চেপে ধরলেন ,"আজকে কিন্ত আমার বাসায় যেতেই হবে ।"
" আজকে না অন্যদিন ।আজ একটু কাজ আছে । আমি নিজেই না হয় কোনদিন চলে আসব ।" আমার মুখে নার্ভাস হাসি
'কালতো ছুটি, আজকে যেতে সমস্যা কিসের ? চল আজকে । বেশিক্ষণ ধরে রাখব না তোমাকে ।" এই বলেই টান দিয়ে ভিতরে নিয়ে গেলেন আমাকে ।"বাধ্য হয়ে ঢুকলাম আমি । দুইদিনের পরিচয়ে আমাকে কি না জানি ভাবছেন , আর দেয়ালগুলো যদি প্রতিরাতে আমার আর উৎসের পাপের সাক্ষ্য দিত , কি অবস্থাটাই না দাড়াতো ।
ফ্রেশ হয়ে আসতেই টেবিলে দেখেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল । একের পর এক নাস্তা সাজানো । বিস্কুট ,চানাচুর থাকতেই পারে , কিন্ত একসাথে সেমাই, রোল ,সিঙ্গারা কি উনি একাই করলেন , দূর্গার মত দশ হাত হলে মেনে নেওয়া যেত , কিন্ত আর কেউ তো নেই ?
" বসো বাবা । সারাটা রাস্তা দাঁড়িয়ে ছিলে ।" এই বলে একে একে নাস্তা নাস্তা তুলে দিতে থাকলেন ,একদিক থেকে দাঁড়িয়ে লাভ হয়েছে । উনি যতই কথা বলুক না কেন , রান্নার হাত যে বেশি ভালো সেটা স্বীকার করতে বাধ্য হলাম । আমি খেয়েই চলেছি , হঠাৎ "দূর্জয় ওখানে দাঁড়িয়ে কেন তুই ? এদিকে আয় ।"
প্রশ্নটা আমার পিছনের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা কারো জন্য করা । আবাক হয়ে পিছনে ঘুরতেই দেখি চৌদ্দ-পনের বছরের রোগা একটা ছেলে দরজার অর্ধেক ধরে দাঁড়িয়ে আছে , মুখটা লম্বাটে পড়নে লাল ঢোলা গেঞ্জি , খয়েরি থ্রি কোয়ার্টার । পাশ দিয়ে বিকালের রোদ এসে বর্ণচ্ছটার সৃষ্টি করছে ।এত ঢোলা গেঞ্জি কেন পড়ে সেটা একটা রহস্য ।আপাতদৃষ্টিতে মুখটা কিছুটা অদ্ভূত , না না সুন্দর অসুন্দর নয় , কোন কাটা বা পোড়া দাগ নয় , কি যেন হিসাবমত মিলছে না ।
“এই ভাইয়ার কথাই ওইদিন বলেছিলাম রে । আর বাবা ,আমার ছেলে দূর্জয় । আজকের সিঙ্গাড়া আর রোল ওর বানানো ।“ ছে্লে্টা যেন পাহাড় ঠেলে মায়ের কাছে দাড়ালো । লজ্জা মিশ্রিত দৃষ্টিতে কৌতূহল । " আমরা শুধু দুজনই বাবা । বুঝতেই পারছো সব নিজে করতে হয় । এই বিল্ডিং প্রথম তোমার সাথেই যা কথা হল "
এইসময় প্রশ্ন জেগে উঠল আমার মধ্যেও , হাসবেন্ড নেই কেন ? হয়ত এই জিজ্ঞাসা প্রতিবেশিদেরও মনে ঘুরে ফিরে , কেউ হয়ত আমার মতই জানতে চান ,পারেন না । দূর্জয়ের সাথে কথা হল বেশ , লজ্জার রেশ কাটিয়ে উঠার পর অনেক কিছুই বলল সে । যা বুঝলাম বাহিরের লোকজনের সাথে খুব একটা মিশেও না , তাই শিশুসুলভ সরলতা চিন্তাভাবনায় আচঁড় রেখে গেছে । রান্না করতে ভালবাসে , আর ছবি আঁকতে । আমি খাদক মানুষ , খাওয়া নিয়েই চলল আলোচনা , এক সময় বিদায় নিলাম ।
এরপর থেকে ওর সাথে একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠল । নতুন পিসি কিনেছে , মুভি নিতে আসত । তবে ওর মধ্যে জানার আগ্রহ প্রবল , হয়ত বংশগতই ব্যাপারটা । ভার্সিটি সম্পর্কে জানতে চাইত বেশি ।আমার প্রজেক্টের জিনিসও নেড়ে চেড়ে দেখত । মাঝখানে ওকে একদিন ভার্সিটিতে নিয়ে গেলাম । ও বেশ খুশি । নিজের কখনো ছোট ভাইবোন ছিল না , কিন্ত ওকে দেখে মনে হত থাকলে হয়ত এরকমই লাগত । এভাবে চলতে চলতে আম্মা একদিন জিজ্ঞেসা করলেন ,'কি রে ভাই পাতালি নাকি ?"
আমি হাসলাম ।"ওকে দেখে তোর কিছুটা অন্যরকম লাগেনি ? হাত কেম্নে যে নাড়ায় , কিভাবে জানি কথা বলে --''
" আরে সবাইতো একটু নিজের মতই হয় । আবাক হচ্ছ কেন ?"
কিন্ত নিজের মনে আমারও জিজ্ঞেসা , ওর মধ্যে কি যেন একটা অদ্ভূত ব্যাপার আছে । আমার মনে প্রশ্নটা ঘুর ঘুর করে , সংকীর্ণতার দোহাই দিয়ে চাপিয়ে রাখার চেষ্টা করি । কিন্ত একদিন সামনের দোকানের সামাদ চাচা বললেন ," ভাইস্তা তোমার লগে বিল্ডিং র আরেকখান পোলা দেখি মাঝে মইধ্যে ।শুকনা কইরা , আমার দোকানেও আসে ।"
" কে সজিব ? নাকি দূর্জয় ?আমার ঘাড়ের সমান লম্বা ? "
" হু বাবা । দোকানেও আসে । তয় পোলাটা একটু অন্যরকম লাগে , তোমার মনে হয় না কি কও ?"
শুধু একজন নয় ।কয়েকজনের মধ্যে সেই একই প্রশ্ন - ও এমন কেন ? আমার জানার আগ্রহ যত বাড়ল ,আমি ততই জিনিসটা ভুলার চেষ্টা করলাম ।
একদিন সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম । তবে না জানলেই মনে হয় ভালো ছিল ।
©somewhere in net ltd.