![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নুপুর ভুলেই গেছিল যে, ওটা ওদের-ই পুকুর। ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। বাবার মৃত্যুর পর থেকে মাছের ঘের এবং পুকুরটা শরীকরা দখল করে খাচ্ছে। নুপুররা সবাই ছোট, ওগুলো বুঝে খাওয়া ওদের পক্ষে সম্ভব নয়। ওরা এখন থাকে পাশের গ্রামে মামা বাড়িতে। মাঝে মাঝে বাড়িতে বেড়াতে আসে। ও গতকাল মায়ের সাথে বাড়িতে এসেছে।
শেষ রাত থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি হলে ওর খুব ভাল লাগে। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার ঝপঝপ শব্দ শুনতে ভালো লাগে, হাঁসগুলোর মাটিতে ঠোঁঠ বিলি করে কেচো খোঁজা দেখতে ভাল লাগে।
বর্ষাকালে গ্রামের দরিদ্র মানুষের সমস্যা বাড়ে, পাশাপাশি নতুন কিছু সুযোগও তৈরি হয়। বর্ষা গ্রামের চেহারাটা একেবারে বদলে দেয়। গ্রামের মানুষের জীবনের বৈচিত্র ঋতু বৈচিত্রের সাথে সম্পরকিত, ঋতু বদল হলে মানুষের জীবন বদলে যায়, জীবিকা বদলে যায়।
নুপুরের একটি বশি আছে। মাঝে মাঝে ও নিজেদের পুকুরে লুকিয়ে বশি ফেলে। বর্ষার সময় পুকুরে বশি ফেললে মাছ উঠবেই। চিকন সুতোর ছোট্ট বশি, এমন অনেক হয়েছে, সুতো ছিড়ে বশিসহ মাছ চলে গিয়েছে। কোনভাবে পাঁচমিনিট বশি ফেলতে পারলেই হাফ কেজি ওজনের একটা মাছ পাওয়া যাবেই। বশিতে আধার হিসেবে ভাত দিলেই হয়। বাড়ির পুকুর, তিন শরিকের পুকুর, সবাই পুকুরে থালা-বাসন ধোয়, খাবার হিসেবে ভাত মাছগুলোর অতিপরিচিত।
নুপুর একমুঠ ভাব এবং বশি নিয়ে পুকুরে যায়। বৃষ্টি পড়ছে, বেশ জোরেই পড়ছে, এসময় কেউ বাইরে বেরোনের সম্ভাবনা কম। ও পুকুরে বশি ফেলে। বৃষ্টির কারণে খোট বোঝা যাচ্ছে না, এমনিতেই পাখনা ডুবছে ভাসছে। ও মাঝে মাঝে আন্দাজ করে বশি টান দিচ্ছে, তাতেই উঠে আসছে বড় বড় তেলাপিয়া মাছ। দখলদাররা এবার মনে হয় পুকুরে তেলাপিয়া মাছ ছেড়েছিল। চার মাসে সেগুলো বেশ বড় হয়েছে। প্রতি মিনিটে চার পাঁচটি করে তেলাপিয়া মাছ পাচ্ছে ও। মাছ রাখার কিছু নেই। আনতে যাওয়ার সময়ও নেই। ও এখন ভীষণ উত্তেজিত। এভাবে কোনদিন মাছ ধরার কথা স্বপ্নেও ভাবেনি। মাছগুলো পিছনে ঝোঁপের মধ্যে ছুড়ি দিয়ে আবার বশি ফেলছে।
মনের ভেতর লোভের সাথে পাল্লা দিচ্ছে ভয়। দশ বারো বছর বয়সের ছেলে মেয়েদের সরল লোভ এবং অহেতুক ভয়, দুটোই প্রবল থাকে। মিনিট দশেক বশি ফেলে বিয়াল্লিশটা সাইজমত তেলাপিয়া মাছ ধরে ফেলে নুপুর। খালে বিলে বন্ধুদের সাথে বশি ফেলে একটি মাছও ধরতে পারেনি কোনদিন। খালের মাছ ধরা সহজ না, নিখুঁতভাবে খোট বুঝে বশি টান দিতে হয়। নুপুরের অত মনোযোগ নেই, সে শুধু পুকুরের মাছ-ই ধরতে পারে। মাঝে মাঝে নিজেদের পুকুরের মাছ চুরি করে। একদিন ধরা পড়েছিল, খুব অপমানিত হতে হয়েছিল। পুকুরটা তিন শরিকের, নুপুরদের অর্ধক, বাকি দুই শরিকের অর্ধক। নুপুরের বাবা মারা যাওয়ার পর গত চার বছর ধরে শরিকরা পুকুর এবং ঘেরটা দখল করে নিয়েছে। জমিজমা-বাড়িও নিতে চেয়েছিল। জাল দলিল করে মামালা করেছিল, শেষ পর্যন্ত কোর্টর রায় নুপুরদের পক্ষে যায়।
দুর্বলের উপর অত্যাচারের নির্মম উদাহরণ তৈরি করে রেখেছে মসনী গ্রামের কিছু মানুষ। ছোট ছোট এতিম ছেলে মেয়েদের মুখের দিকে তারা না তাকিয়ে শরিকদের সাথে জোটবদ্ধ হয়েছিল। শরিকরা জোর করে তালগাছ কেটে নিয়েছে। গ্রামের মানুষ শালিস করে শরীকদের পক্ষ নিয়েছে। সবখানেই যে এখনো শয়তানেরা ক্ষমতা এবং বিত্তে এগিয়ে রয়েছে নুপুর তা ঐ বয়সেই বুঝতে পেরেছিল। গ্রামের মাতব্বর শ্রেণির মধ্যে একজনও ভাল মানুষ নেই! বিষয়টা ওকে তখন ভাবিয়েছিল।
তারপর থেকে ওরা মামাদের বাড়িতেই থাকে। বাড়ি এবং জমিজমা উদ্ধার হয়েছিল নুপুরের বড় মামা মামলা লড়ায়। যেহেতু ওরা সবাই না-বালক ছিল তাই সরকারি উকিল মামলা চালিয়েছিল। মামলায় জিতলেও সবকিছু দেখাশুনার মানুষ নেই। নুপুরের মা অসুস্থ, তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন, বিষয়টি শরিকদের আরো বেশি করে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।
মাছগুলো ঝোঁপের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। ও বশি রেখে একটি মাটির ঠিলে নিয়ে আসে মাছগুলো তুলে নেওয়ার জন্য। একটা একটা করে তুলতে থাকে। যত দ্রুত সম্ভব মাছগুলো তুলে নিতে হবে। দখলদাররা দেখে ফেললে অপমানের সীমা থাকবে না। পাড়া প্রতিবেশীরা শরিকদের পক্ষ নেবে, কেউ বলবে না যে, পুকুরে নুপুরদের ভাগ আছে, বরং ওদের ভা্গ-ই বেশি। চরম উত্তেজনায় ও মাছগুলো তুলে নিতে থাকে। হঠাৎ নুপুর চমকে ওঠে। একটি সাপ ওর ডান হাতের এক বিগত দুরত্বে ফণা তুলেছে। দেখার সাথে সাথে এক পা উঁচু করে মাছ ধরার ভঙ্গিতে ও স্টাচু হয়ে রয়েছে। চিৎকার দিতে পারছে না, নড়তেও পারছে না। চিৎকার দিলে সাপটি হয়ত কামড়ে দেবে। দৌঁড়ে পালাতে গেলে সাপটা ছোবল দিয়ে দেবে।
হিন্দুরা সাপকে দেবতা জ্ঞানে পূজো করে। সাপদের নেত্রী হচ্ছেন মঁনশা। নুপুর মঁনশাকে স্মরণ করে। পূজো দেওয়ার কথা বলে। সাপটাকে দুধ-কলা খাওয়ানোর কথা বলে। নুপুর দু’হাত জোড় করে। সাপটা নড়ে না, ওভাবে ফণা তুলে বসে থাকে। ভয়ে ও চোখ বন্ধ করে রাখে। পাঁচ মিনিট চোখ বন্ধ করে “হরে রাম হরে রাম” করতে থাকে। ওর দিদিমা বলেছিল, “হরে রাম হরে রাম” করতে হয়। তখন ও “হরে রাম হরে রাম” করবে না বলেছিল। এখন বিপদে পড়ে চোখ বুঝে “হরে রাম হরে রাম” করছে। কয়েকবার “হরে রাম হরে রাম” করে আর করে না।
“করবা না বলেছিলাম তো করবই না। শয়তান সাপ কামড় দিলে দিক!”
এভাবে দশ মিনিট কেটে যায়। ও নতুন একটা মন্ত্র আবিস্কার করে। বলে, “সাপ, কামড় দিস না, তোরে দুটো মাছ দিব, আমার বন্ধু সাইফুলদের দশটা মাছ দিব, ওদের কোন মাছ নেই। সাপ, কামড় দিস না।” এভাবে আরো পাঁচ মিনিট চোখ বন্ধ করে থাকার পর নুপুর চোখ খুলে দেখে সাপটি ওখানে নেই, ছড়ানো ছিটানো মাছগুলোও নেই। ঠিলের মাছগুলো আছে। ঠিলে নিয়ে বাড়িতে আসে। রান্নাঘরের মেঝেতে ঢেলে গুণে দেখে ঠিক বিয়াল্লিশটা মাছ! বিয়াল্লিশটা মাছ-ই তো ও ধরেছিল। কিন্ত … ?
“আমি তো মাত্র আঠারোটি মাছ তুলতে পেরেছিলাম, বাকী মাছগুলো তাহলে ঠিলেতে তুলল কে?”
©somewhere in net ltd.