![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। মাঝে মাঝে শখের বশে ফটোগ্রাফিও করি।
আখড়ার বাইরে মানুষের প্রচন্ড ভিড়। এলাকার মানুষ বলছে গতবারের তুলনায় এই ভিড় কিছুই না। অর্ধেক লোক হয়েছে এবার। আমি ভিড় ঠেলেই ভেতরে ঢুকলাম। পুলিশি কড়া পাহারা। একমাত্র বাংলাদেশেই মনে হয় পুলিশি কড়া নিরাপত্তায় মাদক সেবন হচ্ছে। জয়গুরু। ভিড় ঠেলে ঢুকে শেষপ্রান্তে দেখলাম এক আসরে ৫ জন বসে সিদ্ধি বানাচ্ছে। আমার হাতে ক্যামেরা। পাশে গিয়ে বললাম, “আমি কি এখানে একটু বসবো?” পাশের বুজুর্গ বলে বসলো, “বয়, কিন্তু কোন ছবি তুলতে পারবিনা।” উনি এটা বলার পরই পাশের ‘কাসেম পাগলা’ বলল, “আহা! ও তো বসতে চাইছে। বসুক। কি সমাচার শুনি। আগে থেইকাই এত কথা কও ক্যান মিয়া। বহো বাজান।” আমি বসলাম। কাসেম পাগলা বলতে থাকলো, “এখন সিদ্ধির সময়। কও কি কইতে চাও।” আমি জানতে চাইলাম লালন সম্পর্কে। উৎসুক হয়ে মজলিসের প্রধান ‘ফজলু পাগলা’ আমার দিকে তাকালো। শুরু হলো এক আশ্চর্য কথোপকথনের। বক্তার সংখ্যা ৪, শ্রোতা একা আমি। আশেপাশের মানুষ উৎসুক ভঙ্গিতে পাশে ঘুরছে। কি করছে ছেলেটা? জানলাম, শুনলাম। প্রশ্ন করলাম। উত্তর পেলাম। আধ্যাত্মিক কথা শুনলাম। সিদ্ধির গন্ধে বাতাস ভারি। আমার মাথা ধরছে, কথা শুনতেও ভালো লাগছে। এরা সহজ হচ্ছে। ফাঁক বুঝে বললাম এখন ছবি তোলা যাবে? ফজলু পাগলা বললেন, তোল। আমারে আর পায় কে!
ফজলু পাগলা
"বাপ মা নাম দিছে ফজলু। এদিক সেদিক ঘুইরা নামের শ্যাষে পাগলা লাগাইছি। থাকি সাঁইজির দরবারে। এই যে দাড়ি দেখছেন এইডা তো আগে ছিলো না। ১৬ বছর আগে পরিবাররে বলছি সাইঁজির চরণে জীবন দিমু। এই জীবন আর কতদিনের? আইজ আছি কাইল নাই। খাওয়ার মইধ্যে এই বাঁশীতে কইরা সিদ্ধি খাই। পরিবার বুঝছে। সংসার ধর্ম না মনের ধর্মই আসল। মা-বাপের দোয়া না থাকলে এই লাইনে থাকন যায় না। আমার মা-বাপের দোয়া ছিল। এহন থাকি কুষ্টিয়া। দরবারের কাছেই। গান বাজনা করি। কিন্তু এই স্টেজের গানের লগে কোন সম্পর্ক নাই। থাকেন আমগো লগে। দেখেন, বুঝেন। পরীক্ষায় শূন্য পাইবেন যদি না জীবন বুঝেন। এই দেহ বানাইছে আল্লায়, কিন্তু চলতে হইবো মন দিয়া। নিজেরে খুঁজেন।"
অনেক ধরণের মানুষ দেখলাম্। মানুষ দেখতে ভালো লাগে। কত মানুষ, কত বিচিত্র মানবজনম। কত বিচিত্র মানবচরিত্র। যাকে দেখে নি, তার জন্য পাগল। কেউ ভবের পাগল, কেউ ভাবের পাগল। অনেক ভন্ড দেখলাম। অনেক সাধু দেখলাম। গাঁজাটা আলাদা করে দিলে পুরা জিনিসটাই হতো এক ধর্মের মিলনমেলা। মানবধর্ম। আপনি আমন্ত্রিত। এক ফকিরের ছবি তোলার পর বললো, “তুই তো বিদেশী মানুষ। থাকবি কই, খাবি কি? আমার এহানে চাইল আছে, ডাইল আছে। আমার চাটিতে ঘুমাবি। থাকবি, খাবি।” আমি সাধারণত অল্পতে অভিভূত হই না। কিন্তু এই লোকের কথা শুনে অভিভুত হলাম। এই বোধহয় বিখ্যাত বাউল সম্রাটের শিক্ষা। মানবধর্ম শিক্ষা।
রঞ্জিত ফকির
আমার দেখা লালনের আখড়ায় সবচেয়ে সেরা মানুষ।
"ধর্ম, জাত, গোত্র এগুলো মানুষের কাছে মুখ্য। কিন্তু লালন বলে গেছে “জাত কারে কয়”, আমি জাত পাতে বিশ্বাসী না। হুম, এইটা মানি আল্লাহ আমারে তৈরী করছে। কিন্তু উনি কিন্তু ধর্ম দিয়ে পাঠান নাই। আখিরাতের দিন উনি ডাকবেনও না যে এই মুসলমানের দল এদিকে আয়, এই হিন্দুর দল এদিকে আয়। তার কাছে সব মানুষই সমান। সব একই ধর্ম। মানবধর্ম। লালন বলছে, “সহজ মানুষ ভজে দেখ নারে মন দিব্যজ্ঞানে”, ধর্ম বলছে মানুষের সেবা করতে। তাহলে কি দাড়ালো? সাইঁজির কথাই সত্য। মানুষের সেবা করতে হবে। এটাই ধর্ম, এটাই জাত।
আমি ১৯৬০ সাল থেকে এই আখড়ায় আসি সাইঁজির চরণে। আমি সেবাদাস। মানবধর্ম যাতে নিজে করতে পারি সে চেষ্টা করি। দোয়া করি, তুমিও যাতে মানবধর্ম করতে পারো। সাইঁজির কৃপা তোমার উপর পড়ুক।"
আমি যেখানেই গিয়েছি বসার পরপরই মোবাইলের রেকর্ডটা অন করে কথাবার্তা রেকর্ড করেছি। পরেরবার আর এই ভুল করবো না। টেপ রেকর্ডার নিয়ে যেতে হবে।
পুরো আখড়া জুড়ে মানুষ খুজে প্রকৃত সাইঁজির শিষ্য খোঁজার চেষ্টা করলাম। ভন্ডকে জিঞ্জাস করলাম ধর্ম সম্পর্কে, আর যাকে দেখে প্রকৃত সুধিজন মনে হলে তাকে জিঞ্জেস করলাম লালন সম্পর্কে। বিভিন্ন মানুষ, ভিন্ন উত্তর। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো যতো জনের সাথেই কথা বলেছি, ছবি তুলেছি কেউ টাকা চায়নি। উল্টো আতিথেয়তা করেছে। ঢাকা বা অন্য জায়গার পীর ফকির পাগলা সব কিছু্তেই পাওনা খোঁজে। এদের হয়তো ধর্মটাই এমন। ভীড়ের মধ্যে এক বাউল হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো। বললো, আয় তোরে গান শুনাই। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো গেলাম। ৮-৯ জনের একটা গ্রুপ। শুরু করলো, “করিমনা কাম ছাড়ে না মদনে” দিয়ে। গান শুরু দোতারা দিয়ে। ঢোলের বাড়িতে লোক জুড়ে গেলো অনেক। এরই মাঝে বাউলের গান শুনলাম। আহ! জীবনটা অতটা খারাপ না। হোক না গাঁজার পরোক্ষ সেবনে বছর পাঁচেক আয়ু কমেছে!
ঢোল এবং ঢুলি
রাতে শুরু হলো সকল বাউলদের গান। আগে হয়তো বটতলায় হতো। এখন স্টেজ বানিয়ে সেখানে হচ্ছে। শুরু হলো “মারেক পাগলার” গান দিয়ে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো লোকটার গায়েকী শুনলাম। একে একে শাহাবুর, নজরুল, আবির, মানসী বিভিন্ন গায়কের গান শুনলাম। এরা প্রখ্যাত কেউ নয়। সাধারণ লালনগীতির ভক্ত। কি চমৎকার এদের গানের গলা। আর আমরা কি সব বালছাল দিয়ে গানের ইন্ড্রাস্ট্রি ভরিয়ে রেখেছি। হতাশা জনক। গান দেখে যখন রাত ২ টায় কুষ্টিয়া ফিরছি তখন মনের মধ্যে এক আশ্চর্য প্রশান্তি।
মারেক পাগলা সাথে আব্দুল কুদ্দুস।[/si
পুরো অ্যালবাম বা স্টোরি দেখতে এখানে ক্লিক করুন
©somewhere in net ltd.