নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নিজের সম্পর্কে এখনো সঠিকভাবে জানা হয়নি। অনেক কিছু জানার বাকি। আপাতত মানুষ দেখি। মানুষ দেখে নিজেকে যাচাই করছ

ইমতিয়াজ ইমু

আমি একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। মাঝে মাঝে শখের বশে ফটোগ্রাফিও করি।

ইমতিয়াজ ইমু › বিস্তারিত পোস্টঃ

বোবা চিৎকার অথবা দিনলিপি

১৯ শে এপ্রিল, ২০১৭ রাত ১১:৪৫

কয়টা মা পারে লুকিয়ে ছেলের পোষাকে পরম যত্নে হাত বুলাতে? রাবেয়া প্রতিদিন নিয়ম করে কিছু সময় তার ছোটছেলের ঘরে কাটান। ওর পরিধেয় বস্ত্রে হাত বুলান। টেবিলের উপর রাখা অগোছালো বইগুলো গুছিয়ে আবার অগোছালো করে রাখেন। নিজের সত্ত্বার সাথে যে জড়িত তাকে নিয়ে তার অলক্ষ্যে এক প্রগাঢ় ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। এ কাজটি তিনি করে আসছেন বিগত ২ বছর ৩ মাস ১৬ দিন ধরে। হয়তো আজীবন করে যাবেন। ছেলেটা নিখোঁজ হবার পর থেকেই কাজটা করে যাচ্ছেন।
বাসার সবাই এ ঘরটাকে ভুলতে চেষ্টা করে। রাবেয়া পারেন না। ভুলে যাবার চেষ্টা করলেই মাথায় হাসপাতালের দৃশ্যটা ফুটে উঠে।

৬ ই এপ্রিল ১৯৯৬। প্রসব বেদনায় রাবেয়ার অবস্থা মুমূর্ষু প্রায়। তার বড় ছেলে জায়েদের বয়স তখন ৭। মেয়ে লুবণার বয়স ৪। অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান বলেই হয়তো জায়েদের বাবা জুবায়েরের পৃথিবীতে আগমনকে ঠিক ভালো চোখে দেখেননি। প্রথমে রাবেয়াও জুবায়েরের অস্তিত্ব নিজের মধ্যে চিন্তা করে অস্বস্তি বোধ করেছেন। তারপর নিজের ভারী শরীরটা দেখে অনাগত শিশুর প্রতি এক ধরণের আকর্ষণ বোধ করতে থাকলেন। নিজের মধ্যে ওর অস্তিত্বকে প্রবলভাবে বোধ করতে থাকলেন। ওর ক্ষতির কথা ভেবেই নিয়মিত চেকআপে যেতেন। তারপর একদিন তীব্র প্রসব বেদনা নিয়ে উপস্থিত হলেন হাসপাতালে। স্বামী হামিদ রহমান তার সুবিশাল কাজের ফাঁকে স্ত্রীর পাশে রইলেন সারাটা সময়।
হাসপাতালের সাদা সিলিং, সবুজ পর্দা, ঝাপসা চোখে ডাক্তারের আনাগোনা, তলপেটে তীব্র ব্যাথা নিয়ে দাঁতে দাঁতে চেপে নরম্যাল ডেলিভারী করলেন। ডেলিভারী এর আগেও করেছেন দু’বার। কিন্তু এবারেরটার কথা ভিন্ন। একরকম জেদ চেপেই নরম্যাল ডেলিভারী করেছেন। প্রচন্ড ব্যাথায় শরীর দুমড়ে মুচড়ে আসছিলো। ডাক্তার তলপেটে সুঁচ ঢুকিয়ে কি যেন করেছিলেন। চোখ খোলার রাখার চেষ্টা করেছেন। চিৎকার করেছেন ভেতরে, গলা দিয়ে শব্দ বের হয়নি। এরপরে জুবায়েরকে কোলে নেবার পর সকল কষ্টের অবসান।

যেদিন বাড়ির দরজায় এসে পুলিশ কড়া নেড়েছিল সেদিন পর্যন্ত রাবেয়া জানতেন তার ছেলে বেঁচে আছে। সে আজ থেকে প্রায় ৭ মাস আগের কথা। দুপুরে পুলিশের কলিং বেলের শব্দে কাজের বুয়া যখন রাবেয়াকে ডাকলো, “খালাম্মা পুলিশ আপনারে খুঁজে” তখনই বুকের মাঝে ধ্বক করে উঠেছিল। অজানা সংশয় নিয়ে পুলিশের সামনে দাড়াতেই পুলিশ জানালো তারা জুবায়েরের ঘরটা সার্চ করতে চায়। তাদের কাছে সার্চ ওয়ারেন্ট আছে। রাবেয়া নিজেকে শান্ত রেখেছিলেন। প্রবল বানের ধাক্কায় পাড়ে থাকা গাছ যেভাবে প্রতিরোধের চেষ্টা করে ঠিক সেভাবে। যন্ত্রচালিতের মতো পুলিশকে জুবায়েরের ঘরে নিয়ে গেলেন। এর মাঝে কাজের বুয়াকে বললেন স্বামীকে ফোন করতে।
পুলিশ অনেক খুঁজলো। কি খুঁজলো রাবেয়ার সেরকম ধারণা ছিল না তখন। পরবর্তীতে জেনেছেন ওরা জিহাদী বইয়ের তল্লাশে এসেছিল। তারপরে তারা রাবেয়াকে বসিয়ে সবচেয়ে মর্মান্তিক খবর টা দিলো।

অপ্রকৃতিস্থ হবার লক্ষণ কি? নিজের বিশ্বাসের সাথে আটকে থাকা? প্রাচীন মিশরীয় ফারাও দাবী করেছিলো সে ঈশ্বর। সে কি তবে অপ্রকৃতস্থ? রাবেয়া বিশ্বাস করেননি তার জুবায়ের জঙ্গী। নিজের সত্ত্বাকে অবিশ্বাস করা যায়!! পুলিশ তাকে আর হামিদ সাহেবকে লাশ সনাক্তের জন্য নিয়ে গেলো। হাসপাতালের মর্গে তখন ৬ টা লাশ। এরা সবাই জঙ্গী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে নিহত। ৬ জনের পরিবারকেই খবর দেয়া হয়েছে। ২ টি পরিবার লাশ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। রাবেয়া এসেছেন, জোর করেই এসেছেন। হাজার হোক খারাপ হোক, রক্তের সম্পর্ক তো ছিন্ন করা যাবে না।

রাবেয়া বিশ্বাস করেন কোন মানুষই খারাপ না। মাঝে মাঝে মানুষ কিছু ভুল করে যার জন্য অন্যদের চোখে সে খারাপ হয়ে যায়। তার জুবায়ের অবশ্যই ভুল করেছে। কিন্তু এই মর্মান্তিক মৃত্যু দেখার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। শরীরের কোন অংশ অক্ষত নেই। পোস্টমর্টেমের পর লাশটা চেনার জন্য কেবল মুখটা একটু অক্ষত। প্রচুর পরিমাণ বুলেট যখন ওর নরম শরীরটাকে ভেদ করছিলো ও কি একবারও ভেবেছিলো রাবেয়ার কথা? ওর ক্লাসের এক মেয়ের সাখে ওর বন্ধুত্ব ছিল। নিখোঁজ হবার পর মেয়েটি ওর খোঁজে বাসায়ও এসেছিলো। জুবায়ের কি একবারও ওই মেয়েটির কথা ভাবেনি? নিজের বন্ধু আকিবের কথা ভাবে নি?

আকিব এসেছিলো। স্কুল জীবন থেকে ওরা একসাথে। ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি বন্ধুর অবনতি। টের পেলে নিশ্চয়ই বাধা দিতো। এটা তো পথ নয়। রাবেয়ার ছেলে তো কম মেধাবী ছিল না। প্রচুর বই পড়তো। তারপরেও কেন এ পথে পা বাড়ালো?
রাবেয়া ভাবে গুলি করে মেরে না ফেলে পঙ্গু করে দিতো। তাও তো ছেলেটা থাকতো। একবার তো জিঞ্জাসাবাদের দরকার ছিল। কেন একাজে লিপ্ত হলো। অনেকে বলে ব্রেনওয়াশ। রাবেয়া ভাবেন, ছেলেটাকে হুমকি দেয় নি তো? তার পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার ভয় দেখায়নি তো? হয়তো মা’র কথা চিন্তা করেই ছেলেটা নিজের উপর সব নিয়ে নিলো। রাবেয়া আর বেশি ভাবতে পারেন না। ভাবলেই দেড় বছর বয়সের ছোট্ট জুবায়েরকে দেখেন। সবে হাঁটতে শিখেছে। পা দুটো দুই দিকে ফেলে ধুপ করে পড়ে গেলো। রাবেয়া দৌড়ে গেলেন কাছে। ছেলেটা কাঁদতো না। জায়েদ তুলে আবার দাড় করাতো।

লুবনার বিয়ে হয় ঘটনার ২ মাস আগে। তারপরে একদিন মাসখানেক আগে কথায় কথায় হামিদ সাহেবের বড় বোনকে বলতে শুনলেন, “ভাগ্যিস তোর বিয়েটা জুবায়েরের কর্মকান্ডের আগে হয়েছিলো, নয়তো তোর বিয়েটা আর হতো না”। লুবণা চুপ করে কথাটা হজম করেছে। রাবেয়া পারেন নি। চিৎকার করেছিলেন। তার ছেলের জন্য হামিদ সাহেব প্রচুর পরিমাণে তিরস্কারের স্বীকার হয়েছেন। জায়েদের অফিসের কলিগরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতো। তারপরেও পরিবারের কেউ কখনো টুঁ শব্দ করেনি। তারা তো ভালবেসেছিলেন ছোট্ট জুবায়েরকে যার সাথে তার কৃতকর্মের মিল নেই।

মানুষের জীবনটা অনেকটা অবরুদ্ধ জলের মতো, বাধা পেলে একটা না একটা পথ ঠিকই খুঁজে নেয়। সবাই কিছুদিন বিমর্ষ থাকলেও অতীত ভুলে নতুন করে শুরু করেছেন। হামিদ সাহেব বাসায় জুবায়েরের ব্যাপারে কথা বলতে নারাজ। ছেলেটার জন্মদিন ছিল। রাবেয়া একা ঘরে মোমবাতি জ্বেলেছেন। ছেলেটা হয়তো বন্ধুদের নিয়ে পালন করতো। এখন মা’র সাথে একা পালন করছে। সবাই ব্যস্ত। কেবল লুবণা ভোলে নি। ৬ই এপ্রিল সে মা’কে ফোন করে। রাবেয়া রিসিভারের এপাশে চোখ মোছেন নিঃশব্দে।

অনেক সাংবাদিক এসেছিল। ক্ষুধা নিয়ে। এত বড় একটা কাহিনী। ছেলের পরিবারের কাছে ছেলের বিষয়ে জানা যাবে। একটা স্টোরি হবে, পত্রিকা বিক্রি হবে। হামিদ সাহেব ভেঙ্গে পরেছিলেন। বাসা বদলাতে চেয়েছেন। রাবেয়া বারণ করেছেন। কেন অহেতুক সত্য থেকে পালাবেন? এখানে তার ছেলের স্মৃতি। অনেক প্রশ্নের ভিড়ে কেউ জানতে চায়নি, যে ছেলেটা নিজের হাতে ভাত তুলে খেতে পারতো না সে কিভাবে বন্দুক ধরেছে। রাবেয়ার জানতে ইচ্ছা করে। অনেক সময় বিরক্ত হয়েছেন পরিবারের সবাই। তারপরেও চুপ করে ছিলেন। ভেঙ্গে পড়া যাবে না। জীবন চলবে জীবনের নিয়মে। জুবায়ের সহ সবার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। সবাই ধিক্কার দিচ্ছে। গালি দিচ্ছে। রাবেয়া মা। মা’দের সহ্য ক্ষমতা অনেক। নয়তো পৃথিবীতে কেউ আসতো না। রাবেয়া জানেন সবই। তার ছেলে ঘৃণিত। সে তার ছেলের গতিবিধি জানতেন না। নিজেকে অনুতপ্ত মনে হচ্ছে। তারপরেও ফেরানোর পথ কি ছিল না?

আমরা সবাই বিবেচক, নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলি, সৎ নাগরিক। আমরা কখনোই রাবেয়ার আবেগকে মেনে নেবো না। সত্যি বলতে কি তার ছেলে যে এমন কলঙ্কিতভাবে মরেছে এ খবরটাও আমরা একসময় ভুলে যাবো। ভুলবেনা কেবল রাবেয়া। বোকা মায়ের বোবা আর্তনাদ।

পুনশ্চ:
১. গল্পের সমস্ত চরিত্র কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে মিল খোঁজার চেষ্টা করা বৃথা।
২. গল্পের অণুপ্রেরণা: মহাশ্বেতা দেবীর “হাজার চুরাশির মা”

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.