![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১০১, ক্রিসেন্ট রোড সংকলনের এটি দ্বিতীয় গল্প, যেকোনো মতামত আমার কাছে মূল্যবান। পাঠক প্লিজ জানাবেন কেমন লাগছে।
‘আরে ওরা তো জাস্ট ফ্রেন্ড, সেই ছোট থেকে এক সাথে উড়তে শিখেছে। আপনার ছেলেটা তো আমার মেয়ের সাথেই থাকতো, আপনার মনে নেই’? ভরদুপুরে কলম করা কাঁচামিঠা আম গাছের পাতার ফাঁকে বসে মহিলা চড়ুই তার মেয়ের হালহকিকত নিয়ে ব্যাখ্যা দিচ্ছিল পাশের ডালের ভাবিকে। ছোট্ট ঠোঁট দিয়ে খুঁটে খুঁটে নিজের পালক পরিষ্কার করতে করতে পাশের ডালের ভাবি বলল, 'বুঝলেন ভাবি, বসন্তের তো আর বেশি বাকি নেই। ছেলেমেয়েগুলো বড় হয়ে যাচ্ছে। আগামী বছরই ওদের পেটে ডিম আসবে। মেয়ে কাকে পছন্দ করল কিছু বলেছে? আমার ছেলেটা কিন্তু মন্দ না। খুব দায়িত্ববান ভাবি, ডিম আসার পর থেকে দেখবেন কীভাবে দায়িত্ব নিয়ে নিবে। ভূতের গলিতে একটা ঘুলঘুলি ঠিকও করে রেখেছে, কদিন পরেই বাসা বাঁধবে’।
‘তা তো অবশ্যই ভাবি, আপনার ছেলে ভাবি আমারই ছেলে। আমি জানি ও কতটা লক্ষ্মী’।
পাশের ডালের ভাবি একটু লাফিয়ে কাছে এসে বলল, ‘কিন্তু ওই ভবঘুরে ছেলেটা কি করে ওদের সাথে? এত ঘুরে বেড়ায় কেন? পাখিরা থাকবে জোড়ায় জোড়ায়। এই ছেলের কোন পরিবার নেই, কিচ্ছু নেই। ও কি বুঝবে ডিমের দায়িত্ব’?
‘ওর জন্য আমার অবশ্য খারাপই লাগে। শুনেছিলাম গত বছর ঘূর্ণিঝড়ে ওর মা কার বাসায় নাকি আশ্রয় নিয়েছিল, ফ্যানের আঘাতে মারা গেছে’।
‘তা তো বুঝলাম ভাবি, কিন্তু আপনি জানেন ও ছোটবেলা কার কাছে উড়া শিখেছে? ওই যে কালো বুড়ো ভাম মৌটুসিটা আছে না? সারাক্ষণ চোখ গরম করে তাকিয়ে থাকে যে? ওর কাছে। ভেবে দেখেন, একটা চড়ুই মৌটুসির কাছে উড়া শিখেছে, ও কি বুঝে চড়ুইদের জীবন? ও যে মধু খাওয়া শুরু করেনি এটাই তো অনেক’!
দুই মায়ের কথা চলছিল। এদিকে ষাটোর্ধ্ব ডাক্তার মহসিন তালুকদারের ছোট্ট ছাদ বাগানের পাশের ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে ছুঁড়ে দেয়া হল ছোট ছোট পাউরুটির টুকরো। একটু পরেই সেই পাউরুটি খেতে হাজির হল যুবতি চড়ুই মেয়েটি, তার দুই বন্ধুকে নিয়ে। কিছুক্ষণ পাউরুটি খাওয়ার পর জলতরঙ্গের মত ঢেউ খেলে উড়তে উড়তে তিনজনকে কখনও বাঁশঝাড়ের ডালে, কখনও বট পাতার ফাঁকে খুনসুটি করতে দেখা গেল। তাদের কিচিরমিচিরে দুপুরের নিস্তব্ধতা হারিয়ে গেল, সূর্য গলির ফাঁক দিয়ে একটু একটু করে কমলা হতে শুরু করল।
সেদিন বিকেলবেলা যখন গাছে পানি দিতে এল আয়নাল, তখন ছাদবাগানের এক কোণে লাগানো মহসিন তালুকদারের মুন্সিগঞ্জের গ্রামের বাড়ি থেকে শখ করে আনা হিজল গাছের পাতা চিবিয়ে খাচ্ছিল একদল শুঁয়োপোকা। পানির পাইপ এগিয়ে গাছটির দিকে আনমনে এগিয়ে যাওয়ার পর তার সারা গায়ে চুলকানি শুরু হল। সে বিরক্ত মুখে চুলকাতে লাগলো। তখন ছাদবাগানের পাশের ফ্ল্যাটের বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আয়নালের সঙ্গে আলাপ জমাবার কোন একটা বিষয় খুঁজে বেড়াচ্ছিল লালমনিরহাটে আয়নালদের পাশের বাড়িতে বড় হওয়া আয়েশা। ঝাড়ুটা পাশে রেখে হিজল গাছের শুঁয়োপোকার দিকে তাকানোর পর তার গা রি রি করে উঠলো, সে মুখ দিয়ে অস্ফুট শব্দ করল।
ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃতভাবে সেই শব্দ বাগানের চড়ুইদের কিচিরমিচির কিংবা পাশের বিল্ডিংয়ের কার্নিশে বসে গান গাইতে থাকা দোয়েলের কণ্ঠ কিংবা ব্যাচেলর ফ্ল্যাটের চাইনিজ স্পিকারের চটুল গান কিংবা দাঁড়কাকের ক্লান্ত স্বরের কা কা কিংবা বাচ্চাদের হইচই করে খেলার শব্দ ছাপিয়ে আয়নালের কানে পৌছালো। শুঁয়োপোকা হত্যার জন্য ওষুধ দেয়ার পরামর্শ দিয়ে ছোটবেলার বন্ধু আয়নালের সঙ্গে আলাপ জমানোর চেষ্টা করল আয়েশা। স্বামী পরিতক্ত্যা এক সন্তানের জননী আয়েশার চোখের আহ্বান উপেক্ষা করে হতাশ কণ্ঠে আয়নাল জানালো, ‘এই পোকার তুন নাকি প্রজাপতি অইব, তাই স্যার ওষুধ দিবো না’।
আয়নালের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে একটা শুঁয়াপোকাকে নিশ্চিন্ত ভঙ্গীতে শুঁড় নাচিয়ে কচি পাতা চিবাতে দেখা গেল। আয়নালের কণ্ঠের হতাশা সঞ্চার করল আয়েশার মনেও, সে আর কী নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া যায় খুঁজে পেল না। কিছুক্ষণ কোন কথা না বলেই চুপচাপ আয়নালের দিকে তাকিয়ে থাকলো এক সন্তানের জননী আয়েশা। স্মৃতি হাতড়ে সে মনে করার চেষ্টা করল ১৬ বছর আগের এক দিনের কথা। বরাবরের মত সেদিন সকালে বান্ধবীদের সাথে গল্প করার ছলে মাঠে সাতচাড়া খেলতে থাকা আয়নালকে ঠিক এভাবেই দেখছিল আয়েশা, দুপুর গড়ালে যখন বাসা থেকে তার ভাই এসে ডেকে নিয়ে যায় তখনও আচ্ছন্ন হয়ে ছিল আয়েশার চারপাশ, চারিদিকে মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছিল সে। বাড়ি গিয়ে একদল বিভিন্ন বয়সী অচেনা লোক দেখেও আয়েশার মনে সেদিন প্রশ্ন জাগেনি। শ্বশুরবাড়ি থেকে বেড়াতে আসা বড় বোন জাহানারা যখন তাকে সাজাতে এসেছিল তখন ধীরে ধীরে আয়েশার চারপাশ থেকে মিষ্টি গন্ধযুক্ত ধোঁয়া কেটে যায়, আয়েশা বুঝতে পারে সন্ধ্যা নেমে গেছে বহু আগেই। জাহানারা তাকে প্রথম এবং শেষবারের মত জিজ্ঞেস করে, 'আয়নালরে তুই ভালা পাস?' অন্ধকার হাতড়ে আয়েশার মুখ খুলে কিন্তু কোন শব্দ বের হয় না, বুকের বাতাস সব বেরিয়ে যায় অদৃশ্য চাপে।
কুপি বাতির আলোয় লাল শাড়ি পরে বসে থাকা কিশোরী আয়েশা ছনের দেয়াল ভেদ করে শুনতে পায়, জাহানারা তার মাকে বলছে, 'আরে না আম্মা, ঐ পোলা তো আয়েশার বন্দু, একলগে ইস্কুলে পড়ছে না? আব্বারে কও এত চিন্তা করতে না। একবার শ্বশুরবাড়ি গেলে এইসব আর মনে থাকবো না।'
হঠাৎ আকাশে মেঘের গর্জনে চমক ভাঙে আয়েশার। আকাশকে এভাবে মেঘ সাজাতে দেখে আবারও বিরক্তি ঝরে আয়নালের কন্ঠে, 'হুদাই পানি দিলাম।'
ঝিরঝির করে বৃষ্টি নেমে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সবকিছু ভিজিয়ে দিয়ে যায়।
©somewhere in net ltd.