| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সৈয়দ কুতুব
নিজের অজ্ঞতা নিজের কাছে যতই ধরা পড়ছে প্রচলিত বিশ্বাসের প্রতি ততই অবিশ্বাস জন্মাছে!
২০০৯ সালের পিলখানার সেই কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল যেন এখনো বাঙালি জাতির মনে ধরা দিয়েছে, যেখানে ৯২১ জন ভারতীয় নাগরিকের অনিশ্চিত পদচারণা এবং সেনাবাহিনী-বিদ্রোহী সংঘাতের কোলাজ মিলেমিশে তৈরি করেছিল এক অপার রহস্যময়তা। জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন জানাচ্ছে, বিদ্রোহ পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ফল, যেখানে দেশকে অস্থিতিশীল করা, বাহিনীকে দুর্বল করা আর এক নেত্রীর ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করাই মূল উদ্দেশ্য ছিল। মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান, যিনি কমিশনের প্রধান, এমন একটি দুনিয়ার কথা বলছেন যেখানে রাজনৈতিক শক্তি, সেনা ক্ষমতা এবং বিদেশি হস্তক্ষেপ এক অদ্ভুত নাচের মতো মিলে গেছে।
তদন্তে উঠে এসেছে, শুধু সাধারণ সৈনিকের অসহায়তা নয়, প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ফজলে নূর তাপস, শেখ সেলিম, মীর্জা আজম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাহারা খাতুন—নামগুলো যেন এক দীর্ঘ নাটকের চরিত্র, যাদের হাতে দেশের নিরাপত্তা যেমন, তেমনি বিদ্রোহের অগ্নিশিখাও লুকানো ছিল। বিদ্রোহের সময়ে সেনা কর্মকর্তাদের উপর চলা বর্বর নির্যাতনের চিত্রও তদন্তে উঠে এসেছে; চোখ তুলে ফেলা, পা ভেঙে দেওয়া, পরিবারের উপর হামলা ও বাসায় লুটপাট—সবই যেন এক অমানবিক নাট্যকথা, যেখানে দোষী ও শাস্তিকর্তা একই সময়ে অস্পষ্ট।
৬০০ ঘণ্টার ভিডিও, ৮০০ স্থিরচিত্র, শত শত জবানবন্দি, ২৮০ পৃষ্ঠার রিপোর্ট—এই তথ্যের পাহাড়েও সত্যিকার মাস্টারমাইন্ডকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। রেকর্ড করা সাক্ষী, তদন্তকারীদের বিশদ অনুসন্ধান, সব মিলিয়ে যেন একটি রাষ্ট্র যা নিজেই নিজের কণ্ঠরোধ করছে। মোবাইল কোম্পানি, সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, প্রতিটি চিঠি, এবং রিপোর্টের ফেরত—সবই স্বচ্ছন্দে প্রমাণ দেয়, তথ্যের স্বচ্ছতা আর বাস্তবতার মধ্যে কতটা ফাঁক আছে। বিদেশি হস্তক্ষেপের ছায়া, বিশেষ করে ভারতের সম্ভাব্য লাভ, যেন জাতিকে আরও বিভ্রান্তির অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে।
অপারেশন ডাল-ভাতের নামে যে নকল ন্যায়বিচার দেখানো হয়েছে, তার আড়ালে মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশের শক্তি ক্ষয় করা, বাহিনীকে ভাঙা, আর ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা। বিদ্রোহে অংশ নেওয়া সুপারসেডেট কর্মকর্তাদের পরবর্তীতে পদোন্নতি দেওয়া, দুর্বল এলাকায় তাদের নিয়োগ—সবই একটি সূক্ষ্ম রাজনৈতিক কৌশল যা জনগণের চোখের সামনে ঘটে গেলেও কেউ কিছু দেখেনি।
পিলখানার ৫ নাম্বার গেটে র্যাব মোতায়েন ছিল, কর্নেল রেজা নুর নিষেধ করেছিলেন, অথচ হত্যাকাণ্ড চলছিল। শহরের তিন কিলোমিটার দূরে সেনা রাখা, শক্তিশালী বাহিনী থাকা সত্ত্বেও পরিস্থিতি অচল—সবই নির্দেশ করছে যে পরিকল্পনা কেবল বাহিনীকে শাস্তি দেওয়া বা বিদ্রোহ দমন নয়, বরং এক সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক কৌশল ছিল।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস, কমিশনের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠকে বলেছেন, জাতি দীর্ঘদিন অন্ধকারে ছিল। তবে সেই অন্ধকার উন্মোচনের চেষ্টার মধ্যেও প্রশ্ন থেকে যায়, যে সত্য উদ্ঘাটন হয়েছে, তা কি পুরোপুরি? শহীদদের পরিবারের জবানবন্দি, সাংবাদিকদের সাক্ষ্য, কমিশনের বিশদ অনুসন্ধান—সব মিলিয়ে একটি ছবিই ফুটে উঠছে: পরিকল্পিত হত্যা, রাজনৈতিক প্রভাব, বাহিনী দুর্বলকরণ, এবং ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার এক অভূতপূর্ব ষড়যন্ত্র।
এই ঘটনায় শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক ও সেনা কর্মকর্তাদের সরাসরি জড়িততার প্রমাণ, বহিঃশক্তির সম্ভাব্য সম্পৃক্ততা, আর স্থানীয় আওয়ামী লীগের ভূমিকা—সবই সেই হত্যাকাণ্ডকে কেবল একটি বিদ্রোহ নয়, বরং রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও ক্ষমতার খেলার অংশ হিসেবে চিহ্নিত করছে। পিলখানার রক্তক্ষয়, নির্যাতিত সেনা, অন্ধকারে থাকা নথি, রিপোর্টের ফেরত—সব মিলিয়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি নিষ্ঠুর অধ্যায় তৈরি হয়েছে, যেখানে শক্তি, ধোঁকা, এবং ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার লড়াইই সত্যিকারের নায়ক।
ডেইলি মেইল/Daily mail
©somewhere in net ltd.