![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
খুবই সাধারণ মানুষ। খেটে খাওয়া শ্রমজীবি। ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে খুব উদার মনোভাব পোষন করি। পৃথিবীটাই আসলে প্রত্যেকের। জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও সীমানার বাধনে বাধা ঠিক নয়। এই মত লালন করি। আমার কামনা পুরো পৃথিবী একদিন একটাই দেশ হবে।
সাংবাদিকতার ইতিহাস আসলে সাহসিকতার ইতিহাস। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিশ্বের সব প্রান্তেই সাংবাদিকদের ঝুঁকির মধ্যেই কাজ করতে হচ্ছে। এরমধ্যে এমন কিছু সাংবাদিক আছেন যারা তাদের কর্মনিষ্ঠা, সততা ও সাহসিকতার জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন। আমার এই লেখায় গত একশ বছরের মধ্যে জন্ম নেয়া এমন কয়েকজন সাংবাদিকের জীবন ও কর্ম তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
বব উডওয়ার্ড
গত একশ বছরে বিশ্বে যে বড় আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা ঘটেছে তার একটি ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি। ১৯৭২ সালে নিউইয়র্ক টাইমসের যে দুজন রিপোর্টার এই রহস্য উন্মোচন করেন তাদের একজন বব উডওয়ার্ড।
১৯৪৩ সালের ২৬ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের জেনেভায় জন্মগ্রহন করেন। পুরো নাম রবাট উপসার এডওয়ার্ড। বাবা ছিলেন অঙ্গরাজ্যের প্রধান বিচারপতি। ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি সাহিত্যে লেখাপড়ার পর মার্কিন নৌ-বাহিনীতে যোগ দেন বব। ১৯৭০ সালে তিনি কমিশন লাভ করেন। ১৯৭১ সালে সামরিক চাকরি ছেড়ে ওয়াশিংটন পোস্টে রিপোর্টার হওয়ার আবেদন করেন। সাংবাদিকতার কোন অভিজ্ঞতা না থাকায় কর্তৃপক্ষ তাকে একটি ডিগ্রী নিয়ে আসার পরামর্শ দেন। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বব রিপোর্টার হিসেবে ওয়াশিংটন পোস্টে নিয়োগ পান।
১৯৭২ সালের ১৭ জুন সকালে ওয়াশিংটন ডিসির ডেমোক্রেট দলের সদর দপ্তর ওয়াটার গেট অফিস থেকে পাঁচ জনকে আটক করা হয়। বব ও আরেক রিপোর্টার কার্ল বার্নস্টেইনকে দায়িত্ব দেয়া হয় এরা কারা, তারা কি করছিল তা খুজেঁ বের করার জন্য। বব ও কার্ল অনুসন্ধান শুরু করেন এবং খুঁজে পান যে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন-ই তাদের নিয়োগ দিয়েছিলেন রিপাবলিকানদের অফিসের তথ্য জানার জন্য। তাদের কাজ ছিল টেলিফোনে আড়িপেতে প্রতিপক্ষের কৌশল জেনে নেয়া। বব ও কার্ল ‘অল দ্যা প্রেসিডেন্টস মেন’ নামে ধারাবাহিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরেন। এতে সারাবিশ্বে এমন তোলপাড় ওঠে যে মার্কিন কংগ্রেসে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রস্তাব আনা হয় এবং ১৯৭৪ সালে তিনি পদত্যাগে বাধ্য হন।
১৯৭৩ সালে বব কার্লের সাথে যৌথভাবে পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করেন। জীবনে তিনি এমন অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেছেন। তার জীবনের আরেক সাহসী অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ২০০১ সালে ‘সেপ্টেম্বর ইলেভেন আ্যাটার্ক’।
বব বর্তমানে লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত। অল দ্যা প্রেসিডেন্টস মেন ছাড়াও বুশ এ্যাট ওয়ার, প্ল্যান অব এটার্ক, স্টেট অব দানিয়েল, এ সিক্রেট হোয়াইট হাউজ স্টোরি তার বিখ্যাত কয়েকটি বই। তার সম্পর্কে কার্ল বলেছেন, ‘উডওয়ার্ড নিজেকে আমাদের সময়ের সেরা রিপোর্টার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। হয়তো তিনিই বিশ্বের সর্বকালের সেরা রিপোর্টার’।
হান্ট ডিঙ্ক
হান্ট ডিঙ্ক ছিলেন তুরস্কের সংবাদপত্র ‘আগস্’ এর প্রধান সম্পাদক। পাশাপাশি কলামনিস্ট ও সংখ্যালঘু আর্মেনিয়ানদের প্রতিনিধি হিসেবে তুরস্কের রাজনৈতিক জগতে পরিচিত এক নাম।
১৯৫৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তুরস্কের মাল্টায়া এলাকায় জন্মগ্রহন করেন হান্ট। ১৯৬০ সালে তার পরিবার ইস্তাম্বুলে চলে আসে। এরপর ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিবিদ্যায় লেখাপড়া করেন এবং সেসময় নিষিদ্ধ সমাজতান্ত্রিক দল টিককোর সদস্য হন। লেখাপড়া শেষ করে হান্ট সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন কিন্তু টিককোর সাথে একসময় জড়িত থাকার দায়ে কমিশন বঞ্চিত করা হয়। হান্ট চাকরি ছেড়ে দেন। ১৯৮০ সালে জেনারেল কেনান এভরান সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করলে, পুরো পরিবার বিপদে পড়ে। এসময় হান্ট ও তার বাবা জাল পাসপোর্ট তৈরি করে পালানোর সময় ধরা পড়েন। তুর্কি বিরোধী সংগঠন ‘আসালা গেরিলা’রা প্যারিসে তুর্কি রাষ্ট্রদূতকে জিম্মি করলে সরকার হান্ট ও তার বাবাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
১৯৯৬ সালে হান্ট আগস্ নামে সাপ্তাহিক সংবাদপত্র বের করেন। এই সংবাদপত্রের মাধ্যমে তিনি আর্মেনিয় জনগোষ্টীর ওপর তুকি জেনারেলদের নীপিড়ন, গণহত্যা ও সমস্যার কথা তুলে ধরতেন। পাশাপাশি তিনি অন্যান্য জাতীয় দৈনিক ‘জামান’ ও ‘বিরগান’-এ কলাম লিখতেন। তবে সমসাময়িক অনেক সাংবাদিকদের কাছে তিনি ‘গোড়া সাম্প্রদায়িক’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
২০০৭ সালের ১৯ জানুয়ারী দুপুর ১২টার দিকে আগস্ অফিসের কাছে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, ২৫-৩০ বছরের এক যুবক প্রকাশ্যে তাকে গুলি করে হত্যা করে। জানা গেছে ওই যুবক আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরিচয় দিয়ে দেখা করতে চাইলে হান্ট তাকে প্রত্যাখান করেন।
এই মামলার দীর্ঘ শুনানি শেষে ওগান সামাস্ট নামে এক যুবককে ২২ বছর কারাদণ্ডের আদেশ দেয় ইস্তাম্বুলের আদালত।
জোর্তিময় দে
ভারতের মুম্বাই এ জন্মগ্রহণকারী এই সাংবাদিক শহরটির অপরাধের শিকড় তুলে ফেলতে চেয়েছিলেন। অপরাধের অন্ধকার জগতকে জোর্তিময় যতটা আলোকিত করেছিলেন, অন্য কোন সাংবাদিকের পক্ষে এতটা সম্ভব হয়নি। তাকে বলা হত ‘ফাদার অব ক্রাইম রির্পোটিং’।
১৯৫৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন জোর্তিময়। লেখাপড়া শেষ করে প্রথম জীবনে চাকরি নেন বন বিভাগে। ফটোগ্রাফি ছিল তার নেশা। মুম্বাইয়ের কাছে বড়িভালি সঞ্জয় গান্ধী ন্যাশনাল পার্কে চাকরি করার সময় বন্যপ্রাণী অপরাধের সাথে জড়িতদের চিনতে থাকেন। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে চিঠি লিখে কাজ না হওয়ায় ছবিসহ প্রমাণ যুক্ত করে লিখতে থাকেন সংবাদপত্রের চিঠিপত্র কলামে। এতে কাজ হলেও চাকরি চলে যাওয়ার উপক্রম হয়। ১৯৯৬ সালে চাকরি ছেড়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্রে অপরাধ বিটের রিপোর্টার হিসেবে কাজ শুরু করেন। অপরাধের প্রাণকেন্দ্র মুম্বাই শহরের অপরাধীদের মুখোশ খুলে যেতে থাকে তার একের পর এক প্রতিবেদনে। এমনকি ডন খ্যাত দাউদ ইব্রাহিম ও ছোটা রাজন বাহিনীর সাম্রাজ্যও ধ্বংসের মুখে পড়ে। ফলে মৃত্যু হুমকি জোর্তিময় এর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাড়ায়।
২০০৫ সালে তিনি প্রভাবশালী সংবাদপত্র হিন্দুস্তান টাইমসে যোগ দেন। তবে বনিবনা না হওয়ায় ওই বছরই তিনি মিড-ডে নামে একটি ট্যাবলয়েড দৈনিকের অপরাধ ও অনুসন্ধানী সংবাদ বিভাগের সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন।
২০১১ সালের ১১ জুন বিকাল তিনটার দিকে মোটর সাইকেলে যাবার পথে হিরানন্দরি পার্কের কাছে অজ্ঞাত বন্দুকধারীরা তাকে গুলি করে। সাথে সাথে হিরানন্দরি হাসপাতালে নেয়া হয়। তবে তাকে বাঁচানো যায়নি।
এ ঘটনায় প্রথমে পুলিশ ও পরে ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো(সিবিআই) তদন্ত করে। এতে জানা যায়, ছমাস আগে মাফিয়ারা নাসিক এলাকায় যশোবন্ত নামে এক সরকারী কর্মকর্তাকে হত্যা করে। তাদের অনুসরণ করতে গিয়ে জ্বালানি তেল সিন্ডিকেটের খোঁজ পান জোর্তিময়। যে কর্মকান্ডের সাথে ছোটা রাজন এবং তার মাস্টারমাইন্ড দাউদ ইব্রাহিমের ভাই ইকবাল কাসকার জড়িত। পরে এ হত্যার সাথে একজন সাংবাদিকের জড়িত থাকার প্রমান পাওয়া যায়। মামলাটি এখনো চলছে।
আনা পলিটকোভস্কি
আনা পলিটকোভস্কি আমেরিকান জন্মনেয়া ইউক্রেন বংশোদ্ভূত রাশিয়ান সাংবাদিক ও লেখক। চেচেন স্বাধীনতাকামীদের পক্ষে লেখা ও সেখানকার নির্যাতনের চিহ্ণ তুলে ধরার অপরাধে ২০০৬ সালের ৭ অক্টোবর পুতিন সরকার গোপনে মস্কোর একটি ফ্ল্যাটে তাকে গুলি করে হত্যা করে। এখনো এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করা হয়নি।
আনা পলিটকোভস্কি প্রথম আলোচনায় আসেন ১৯৯১ সালে চেচনিয়া বিষয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর। যেখানে চেচেনদের পক্ষ নেয়াকে রাশিয়ার গণমাধ্যমে দেশদ্রোহী ও গোপন মুসলমানিত্ব বলে মনে করা হয়, সেখানে পলিটকোভস্কি প্রথম চেচনিয়া নির্যাতন সম্পর্কে বিশ্বকে জানান দেন।
১৯৫৮ সালে আনা নিউইয়র্কে জন্মগ্রহন করেন। বাবা ছিলেন জাতিসংঘে নিযুক্ত রাশিয়ার কুটনীতিক। ১৯৮০ সালে মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে থেকে সাংবাদিকতায় স্নাতক হন। এরপর টিভি রিপোর্টার হিসেবে টিভি চ্যানেল ভ্ল্যাদিস্লাভ লিস্তিয়েভ-এ যোগদান করেন। ১৯৮২ সালে তিনি লাজভেস্তিয়া সংবাদত্রের রিপোর্টিং বিভাগে যুক্ত হন। এরপর একে একে অবচ্চায়া গেজেট ও নভয়া গেজেটে চাকরি করেন।
১৯৯১ সাল থেকে অর্থণৈতিক ও সামাজিক সমস্যা বিশেষ করে দুর্নীতি এবং পুলিশ ও সামরিক প্রশাসনের কর্মকান্ড নিয়ে সরব হন। সরসরি চেচেন অভিযানের সমালোচনা করে লেখালেখি শুরু করেন। সেখানে বিদ্রোহের নামে মুসলিমদের ধরপাকড়, নির্যাতন, অপহরণ ও হত্যার বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো রাশিয়ান সংবাদপত্রে প্রশাসনকে দায়ী করেন এবং প্রমাণ দিতে থাকেন।
২০০১ সালে আনা চেচনিয়ায় একের পর এক গুম, হত্যা এমনকি পুরো পরিবার অদৃশ্য হওয়ার বিষয়ে প্রতিবেদনের জন্য অনুসন্ধান করছিলেন। যেখানে তিনি অভিযোগ পান সামরিক কর্মকর্তারা যাকে খুশি ধরে বন্দি শিবিরে ধরে নিয়ে যায়, যারা রড় দিয়ে পেটায়, ইলেকট্রিক শক দেয় শুরু নারী নয় এমনকি যেখানে পুরুষদেরও ধর্ষণ করা হয়। এসময় সামরিক কর্মকর্তারা চেননিয়ার দক্ষিণনাঞ্চল থেকে আনাকে গ্রেফতার করে। গ্রেপ্তারের পর আনার ওপরও নির্যাতন শুরু হয়। পিটিয়ে সারা শরীরে কালসিটে দাগ বানানো হয়। এমনকি তারা মাঝে মাঝে শরীরের সব পোশাক খুলে নিতো। এরপর উপহাসমুলক বিচারে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এ ঘটনার পর মস্কোর কোন সংবাদপত্র আর চেচেনিয়ায় সাংবাদিক পাঠানোর ঝুকিঁ নেয়নি।
ইউরোপে ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে সরকার আনাকে মুক্তিদিতে বাধ্য হয়। তবে নানাভাবে বিদেশে পালিয়ে যেতে হুমকি দেয়া হতো। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নেয়ার সুযোগ থাকলেও তিনি তা না করে রাশিয়ার অন্যায়ের প্রতিবাদ করাকেই উপযুক্ত মনে করতেন।
২০০৬ সালের ৭ অক্টোবর তালাবদ্ধ ফ্ল্যাটে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তার বুকে দুটি গুলি করা হয়েছিল। এরপর আনার বিচার নিয়ে সরকার নানা নাটক শুরু করে। তবে এ ঘটনা রহস্যই থেকে গেছে।
লাসান্থা বিক্রমাতুঙ্গে
লাসান্থা মানিলাল বিক্রমাতুঙ্গে ছিলেন শ্রীলংকার জাতীয় ইংরেজি দৈনিক সানডে লিডার এর সম্পাদক। একইসাথে টাইম ম্যাগাজিনের রিপোর্টার ও টিভি শো গুড মর্নিং এর উপস্থাপক ছিলেন।
১৯৫৮ সালের ৫ এপ্রিল লাসান্থা কলম্বোয় জন্মগ্রহণ করেন। কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে ডিগ্রী নিয়ে আইন পেশায় জীবন শুরু করেন লাসান্থা। পাশাপাশি কলম্বোয় আইল্যান্ড ও সান পত্রিকায় সাংবাদিকতায় জড়িত হন। ১৯৭২ সালে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং দেশটির প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েকের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করেন।
১৯৯৪ সালে তিনি নিজে সানডে লিডার সংবাদপত্র চালু করেন। সম্পাদক হলেও মাঝে মাঝে নিজেই বেরিয়ে পড়তেন খবরের খোঁজে। একইসাথে সরকার ও তৎকালীন তামিল টাইগারদের কর্মকান্ডের সমালোচনা করতে থাকেন তিনি। মাত্র একবছরেই পত্রিকাটি সবচেয়ে জনপ্রিয় সংবাদপত্রে পরিনত হয় এবং সেইসাথে জীবনের ওপর হামলাও আসতে থাকে।
২০০০ সালে রাষ্ট্রপতি চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গের সরকার তার নামে অপরাধ মামলা দেন। কিন্তু তা প্রমাণিত হয়নি। লাগাতার জীবনের হুমকি আসতে থাকায় ২০০২ সালে তার প্রথম স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যান। ২০০৮ সালে মাহিন্দ্রা রাজা পাকসে ক্ষমতায় আসেন, এবং তিনিও লাসান্থার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। জনসমক্ষেই রাজা পাকসে লাসান্থাকে ‘সন্ত্রাসী সাংবাদিক’ উপাধি দেন। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী গৌতব্য রাজাপাকসে অস্ত্রচুক্তি নিয়ে এক প্রতিবেদনের দায়ে মানহানির মামলা করেন। এই প্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের জানুয়ারীতে সানডে লিডার-এ তিনি এক প্রবন্ধ লেখেন যার শিরোনাম ছিল ‘যদি তুমি লেখ, তোমাকে হত্যা করা হবে’।
২০০৯ সালের ৮ জানুায়ারী সকাল সাড়ে দশটায় অফিসে যাওয়ার পথে চার মোটরসাইকেল আরোহী লাসান্থাকে গুলি করে। পরে তাকে কলম্বো ন্যাশনাল হাসপাতালে নেয়া হয় এবং তিনঘন্টার মধ্যে তিনি মারা যান।
বিরোধীদল এ ঘটনার জন্য সরকারকে দায়ী করে। তবে অভিযোগ আছে এ ঘটনার কোন সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি। মৃত্যুর মাত্র দু’মাস আগে তিনি সোনালী সামারাসিঙ্গেকে বিয়ে করেন। হত্যাকাণ্ডের পর সোনালী শ্রীলংকা থেকে চলে যেতে বাধ্য হন।
ভেরোনিকা গুইরেন
যেসব সাংবাদিকদের জীবন দিয়ে হলিউডে চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে তাদের একজন হলেন ভেরোনিকা গুইরেন। আইরিশ এই সাংবাদিক অপরাধ বিষয়ক সংবাদ সংবাদ কভার করতেন।
ভেরোনিকার জন্ম ১৯৫৮ সালের ৫ জুলাই, আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে। আইরিশ জাতীয় মহিলা দলের হয়ে কিছুদিন বাস্কেটবল ও ফুটবল খেলেছেন। ১৯৮৩ সালে বিখ্যাত ট্রিনিটি কলেজ থেকে হিসাব বিজ্ঞানে ডিগ্রি লাভ করেন এবং জনসংযোগ পেশায় জড়িয়ে পড়েন। পেশাগত কারণে সাংবাদিকদের সাথে কাজ করতে হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে পেশা বদল করে ১৯৯০ সালে ‘সানডে বিজনেস পোস্ট’-এ রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯৪ সালে তিনি যোগ দেন আয়ারল্যান্ডের জনপ্রিয় সংবাদপত্র সানডে ইনডিপেনডেন্ট-এ। এ সময় তিনি নানা ধরণের পেশাদার অপরাধীদের মুখোশ তুলে ধরেন তার প্রতিবেদনে। সেখানে প্রথমবারের মতো উঠে আসে অপরাধীদের সাথে আইরিশ পুলিশ ও রিপাবলিকান আর্মির সখ্যতার কথা।
আইরিক মাদক সম্রাট বলে পরিচিত জন জিলিগ্যানের শিষ্য জন ট্রেইনরের কর্মকান্ড নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর অনবরত মেরে ফেলার হুমকি পেতে থাকেন ভেরোনিকা।
১৯৯৬ সালের ২৬ জুন গাড়ি নিয়ে ট্রাফিক সিগনালে দাড়ান তিনি। এসময় তাকে অনুসরণকারী জিলিগ্যানের ভাড়াটে গুন্ডারা ছয়টি গুলি করে ভোরোনিকার বুক ঝাঝরা করে দেয়।
১৯৯৮ সালের নভেম্বরে এই মামলার রায় হয়। এতে জিলিগ্যানের চার শিষ্যকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আইরিশ আদালত।
ভেরোনিকার জীবন নিয়ে ২০০৩ সালে বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার জোয়েল সুমাখার ছবি নির্মাণ করেন। তার সম্মানে ডাবলিন পার্কে একটি আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে।
ড্যানিয়েল পার্ল
যেসব সাংবাদিক পেশার জন্য জীবন দিয়েছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও নৃসংশ হত্যাকান্ডের শিকার হন ড্যানিয়েন পার্ল। ড্যানিয়েল পার্ল সহকর্মীদের কাছে ড্যানি নামে সমাধিক পরিচিত ছিলেন।
১৯৬৩ সালে ১০ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সির প্রিন্সটনে জন্মগ্রহণ করেন ড্যানিয়েল জ্যাকব পার্ল। ইহুদি বংশোদ্ভূত পার্ল ১৯৮৫ সালে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে যোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি নর্থ এডামস ট্রান্সক্রিপ্ট, বার্কশায়ার ঈগল, ম্যাসাসুচেটস ও সান ফ্রানসিসকো বিজনেস টাইমসে কাজ করেন।
১৯৯০ সালে তিনি ওয়াল স্টিট জানার্লের আটলান্টা অফিসে নিয়োগ পান, এর ৯৩ সালে ওয়াশিংটন ও ৯৬ সালে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে নিযুক্ত হন। এই সময় তিনি বসনিয়ায় গণহত্যার ওপর প্রতিবেদন করেন। ২০০১ সাল থেকে ওয়াল স্টিট জানার্লের দক্ষিন এশিয়া প্রধান হিসেবে ভারতের মুম্বাইয়ে চলে আসেন। সেখান থেকে আল-কায়েদাকে অনুসরণের জন্য পাকিস্তানের অন্যতম ধর্মীয় নেতা শেখ মুবারক আলী গিলানীর সাক্ষাৎকার নিতে ২০০২ সালের ২৩ জানুয়ারীতে ড্যানি পাকিস্তানের করাচীতে আসেন। সেখান থেকে একটি জঙ্গী গ্রুপ তাকে অপহরণ করে ই-মেইলে মুক্তিপন দাবি করে। তবে ওয়াল স্টিট জার্নাল বা তার স্ত্রী সাড়া দেয়নি। এরপর তালেবান জঙ্গীরা তাকে অমানুষিক নির্যাতনের পর ছুরি দিয়ে গলা কেটে মাথা আলাদা করে ফেলে এবং পুরো ঘটনাটি ভিডিও করে। ২১ ফেব্রুয়ারী ২০০২ জঙ্গীরা ভিডিও গণমাধ্যমের কাছে পাঠিয়ে দেয়।
২০০২ সালের জুলাই মাসে আহমেদ ওমর সাঈদ শেখ নামে একজন পাকিস্তানী-ব্রিটিশকে এই হত্যার দায়ে পাকিস্তানের আদালত মৃত্যুদন্ড দেয়। অবশ্য ২০০৭ সালে গুয়ান্তানামো বে কারাগারে এক বিচারে আল কায়েদা নেতা খালিদ শেখ মোহাম্মদ স্বীকার করেন তিনি নিজে ড্যানিয়েলের শিরচ্ছেদ করেন। ফলে পাকিস্তানের আদালতের ওই বিচার নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে।
ডেভিড রোড
বর্তমান বিশ্বের এক অনন্য সাহসী এক রিপোর্টারের নাম ডেভিড স্টিফেন রোড। নিউইয়র্ক টাইমসের ৪৫ বছর বয়সী এই সাংবাদিক প্রতিবেদনের প্রয়োজনে এখনো সারা পৃথিবী চষে বেড়ান।
ডেভিডের জন্ম ১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মেইনল্যান্ডে। ব্রাউন ইউনিভার্সিটি থেকে সাংবাদিকতায় ডিগ্রি নেবার পর আর পেছনে তাকাননি। ১৯৯০ সালে যোগ দেশ এবিসি নিউজের ওয়ার্ল্ড সার্ভিস-এ। ১৯৯৪ সালে ক্রিস্টিয়ান সাইন্স মনিটরে যোগ দেয়ার পর তাকে ক্রোশিয়া পাঠানো হয় সার্ব-বসনিয়া যুদ্ধ কভার করার জন্য। এসময় তিনি দ্যা গার্ডিয়ানের হয়েও কাজ করতে থাকেন। ডেভিড প্রথম সাংবাদিক হিসেবে মুসলিম জনগোষ্ঠীতে নিশ্চিহ্ণ করার সার্ব পরিকল্পনার প্রমান বিশ্বের কাছে তুলে ধরেন। সেখানকার যুদ্ধের কারণ ও গণহত্যা পরিকল্পনায় জড়িত ব্যক্তিদের কর্মকান্ড তুলে ধরেন সবিস্তারে।
১৯৯৬ সালের এপ্রিলে ডেভিড নিউইয়র্ক টাইমসে যোগ দেন এবং বলকান যুদ্ধের পুরোটা সময় সার্বিয়ান ধ্বংসযজ্ঞ তুলে ধরেন। ইরাক দখলের পর কিছুদিন সেখানেও কাজ করেন তিনি। আবু গ্রাইব কারাগার ও ইরাক জুড়ে মার্কিন বাহিনীর নৃশংস নির্যাতন তুলে আনার কৃতিত্বও ডেভিডের। ২০০২ সালে তাকে দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরোর সহকারি প্রধান হিসেবে দিল্লিতে পাঠানো হয়। এসময় তিনি পাকিস্তান, আফগানিস্তান তালেবান ও আল-কায়েদা নিয়ে একের পর প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। ২০০৮ সালে তাকে তালেবানরা অপহরণ করে। ডেভিডের নিরাপত্তা নিয়ে দরকষাকষি চলতে থাকায় ঘটনাটি নিউইয়র্ক টাইমস ব্লাক আউট করে। সাতমাস পর তিনি মুক্তি পান। এরপর থেকে তিনি নিউইয়র্ক টাইমসের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সাঈদ সালেম শাহজাদ
জঙ্গী বিক্ষুব্ধ পাকিস্তানে স্বাভাবিকভাবেই সাঈদ সালেম শাহজাদের সাংবাদিকতার বিষয় ছিল জঙ্গীবাদ, তালেবান ও আল-কায়েদা। আর এটাই তার জীবনের কাল হয়ে দাড়ায়।
পাকিস্তানের করাচীতে বসবাসকারী অনুসন্ধানী সাংবাদিক ছিলেন সাঈদ সালেম শাহজাদ। ১৯৭০ সালে এই শহরেই জন্মগ্রহন করেন তিনি। পরে করাচী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন।
সাঈদ হংকং ভিত্তিক এশিয়া টাইমস অনলাইনের পাকিস্তান ব্যুরো প্রধান ছিলেন। এছাড়া একাধারে পাকিস্তানের ডন, ফ্রান্সের লা মনদ, ইতালির লা স্ত্যাম্পায় লিখতেন। হর হামেশায় চলে যেতেন তালেবান অধ্যুষিত এলাকায়। তুলে আনতেন নানা অজানা কথা। তালেবানকে সেনাবাহিনীর সহায়তার কথা তিনি লিখেছেন তার বই ‘ইনসাইড আল কায়েদা এন্ড তালিবান: বিয়ন্ড বিন লাদেন এন্ড নাইন ইলেভেন’-এ। আর এভাবেই তিনি পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন।
আগে থেকেই তালেবানরা একের পর এক হুমকি দিয়ে আসছিল শাহজাদকে। ২০১০ সালে সহকর্মী সাংবাদিক আবদুল গনি বারাদারকে আইএসআই আটক করলে এর প্রতিবাদে স্পর্শকাতর প্রবন্ধ লেখেন শাহজাদ। এবার হুমকি দিতে থাকে আইএসআই। নিরাপত্তা চেয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কাছে শাহজাদ এক চিঠি লেখেন, সেখানে তিনি আশঙ্কা করেন আইএসআই তাকে হত্যা করতে পারে।
২৯ মে ২০১১। সন্ধ্যা ছটায় একটি টিভি টক শোতে অংশ নেয়ার কথা ছিল শাহজাদের। ৫.৪২ মিনিট থেকে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরদিন করাচীর ১৫০ মাইল দূরের মান্দি বাহাউদ্দিন জেলার একটি খালের পাশ থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়।
এ ঘটনায় পাকিস্তানের সুপ্রীম কোর্ট বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে। তবে ৪ জুলাই ২০১১ নিউইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে জানায়, ওবামা প্রশাসনের কাছে বিশ্বাসযোগ্য প্রমান আছে যে এই হত্যার ঘটনায় আইএসআই জড়িত। যদিও আইএসআই কড়াভাবে তাদের সংশ্লিষ্টতা নাকচ করে আসছে।
তথ্যসুত্র: আইপিআই, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স, কমিটেড টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস, উইাকপিডিয়া ও অন্যান্য।
©somewhere in net ltd.
১|
০৬ ই আগস্ট, ২০১৪ বিকাল ৩:১৮
মুহিব বলেছেন: সাহসী আছে। আপনি না লিখলে তো জানতেই পারতাম না তাদের কথা।