![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্রথম অংশটুকু পড়ুন.।.।আহনাফের গল্প; পর্ব-১
(প্রথম অংশের পর থেকে>>>)
স্কুল থেকে ফিরে আহনাফ দেখে পাশের ফ্ল্যাটের দরজাটা খোলা, ভেতর থেকে ফার্নিচার সরানোর শব্দ আসছে। ও উঁকি দিয়ে ভেতরটা দেখতে যাবে, এমন সময় দরজার পাশে রাখা কয়েকটা জিনিসের সাথে ধাক্কা লেগে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। শব্দ শুনে ভেতর থেকে একজন লোক বেরিয়ে আসে।
- হেই...হু আর ইউ?
আহনাফ উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলে, আমি আহনাফ, আপনাদের পাশে... । ওর কথা শেষ হবার আগেই আন্টি আর নওরীন এসে দাঁড়ায়। আন্টি ওকে কাছে টেনে নিয়ে বলে, আরে আহনাফ তুমি! ব্যাথা পেয়েছ বাবা? আহনাফ লজ্জিত ভাবে বলে, না আন্টি, তেমন লাগেনি। আন্টি তখন লোকটার দিকে ফিরে বলে, “ও হচ্ছে আহনাফ, আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকে। তোমাকে না বললাম দরজার সামনে থেকে জিনিসগুলো সরাতে, দেখতো কি অবস্থা ছেলেটার!”
- ও... সেটা আগে বলবে তো! আহনাফ, এসো বাবা, ভেতরে এসো।
আহনাফের সাথে তাঁরা অনেকক্ষন গল্প করলেন। আহনাফ তাঁদেরকে সব কিছু বলল। ওর বাবা-মার কথা, খালু-খালামনির কথা, সিঙ্গাপুরে কেন এসেছে, সবকিছু। আহনাফের জন্য তাঁদের খুব খারাপ লাগল, এরকম লক্ষ্মী একটা ছেলেকে রেখে ওর বাবা-মা কিভাবে দেশে থাকে?
আঙ্কেল-আন্টি দুজনেই বললেন, “আহনাফ, মন খারাপ করোনা বাবা। তোমার যখনই ইচ্ছা হবে আমাদের বাসায় চলে আসবে, নওরীনের সাথে খেলা করবে, ঠিক আছে?”
আহনাফ নিজের ঘরে ফেরে। ওর মনটা আজ অনেক ভালো। আজ আর নিজেকে একা একা লাগছে না।
বিকালে আহনাফ নওরীনদের বাসায় গেল। নওরীন তখন ঘুমাচ্ছিল। আহনাফ এসেছে বলে নওরীনকে ওর মা ডেকে দিল। নওরীন ফ্রেশ হয়ে এসে বলল, তুমি দুপুরে ঘুমাও না?
- না। হোমওয়ার্ক করতে হয়। ছাদে যাবে? চলো আমরা ছাদে গিয়ে খেলা করি।
- চলো। আম্মু... আমরা ছাদে যাচ্ছি।
- যাও, কিন্তু সাবধানে থেকো। রেলিঙের কাছে যাবে না।
আহনাফ আর নওরীন দুজন গল্প করতে করতে ছাদে এলো।
- আচ্ছা আহনাফ, তোমার আব্বু-আম্মুর জন্য খারাপ লাগে না?
- লাগে। কিন্তু কি করব বলো, আমাকে তো এখানেই থাকতে হবে।
- কেন?
- আব্বু-আম্মু বলেছে এখানে থেকে আমাকে পড়াশোনা করে বড়ো হতে হবে। ... বলতে বলতেই আহনাফের মুখটা লাল হয়ে উঠল।
নওরীন আহনাফের সাথে অনেক গল্প করল। এর আগে যখন ব্যাংককে ছিল, সেখানকার গল্প করল। ওর আব্বু একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকরি করে। প্রতিবছরই একদেশ থেকে আরেকদেশে ওদের ঘুরে বেড়াতে হয়। বাংলাদেশে ওর ছোটচাচু ছাড়া আর কোন আত্মীয় নেই, সবাই বাইরে। তাই বাংলাদেশে খুব বেশি যাওয়া হয় না। তারপরও সবাই মিলে বছরে একবার বাংলাদেশে যায়, তখন অনেক মজা হয়।
সন্ধ্যার একটু আগে ওরা নেমে এল। নওরীন ওর ঘরে ফিরে গেল আর আহনাফ সন্ধ্যার নাস্তা সেরে গেমস খেলতে বসল। কিছুক্ষন পর কলিং বেল বেজে ওঠে। আহনাফ দরজা খুলে দেখে নওরীন এসেছে।
- ও তুমি! এসো।
- কি করছিলে?
- গেমস খেলছিলাম।
- তোমার একা থাকতে ভয় করে না?
- নাহ। অভ্যাস হয়ে গেছে। বাসায় বলে এসেছ?
- হ্যা, আম্মুকে বলেই এসেছি।
- তাহলে ঠিক আছে। কি করছেন আন্টি?
- আম্মু রান্না করছে, আর আব্বু বাইরে গেছে।
আহনাফের মনে পড়ল কতদিন মায়ের হাতের রান্না খায় না। নওরীনকে বলল, “আন্টি তোমাকে অনেক ভালবাসে তাই না?”
- হ্যা... আর তোমার আম্মু?
- আমার মাও আমাকে অনেক ভালবাসে।
- তাহলে তোমাকে এমনভাবে দূরে পাঠিয়ে দিয়েছে কেন?
- জানি না।
ওরা দুজন কিছুক্ষন গেমস খেলল। তারপর নওরীনের আম্মু ডাক দিলে নওরীন বাসায় চলে গেল। সেদিন আহনাফের খালামনি খালু ফিরে এলে পাশের ফ্ল্যাটের আন্টি- আঙ্কেল এসে পরিচিত হলেন।
পরদিন স্কুল থেকে ফিরে আহনাফ নওরীনের সাথে দেখা করতে গেল। নওরীন অসুস্থ, ভীষন জ্বর এসেছে, ঘুমাচ্ছে। আন্টি বললেন, “গতরাতে বাথরুমে গিয়ে ভয় পেয়েছে। তারপর মাঝরাত থেকে জ্বর আসে।” আহনাফের মনটা খারাপ হয়ে যায়। সারাদিন ও নওরীনের পাশে বসে থাকে। সন্ধ্যার পরে বাসায় ফিরে যায়। পরদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় নওরীনের সাথে দেখা করে যায়। ওর জ্বর কমেছে। অনেকটা সুস্থ। স্কুল থেকে ফিরে আবার নওরীনের বাসায় যায়।
নওরীন আহনাফের খুব ভাল একটা বন্ধু হয়ে উঠেছে। ওর আব্বু ওকে কাছেই একটা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছেন। স্কুল থেকে ফিরে দুজন একসাথে খেলা করে, গল্প করে, টিভি দেখে। এমনকি প্রায়ই আন্টি দুজনকে একসাথে খাইয়ে দেন। অনেক মজায় দিন কাটতে থাকে আহনাফের। আহনাফের এখন আর আগের মত খারাপ লাগে না। সেদিন ওর বাবা ফোন দিয়ে জানায় আহনাফের একটা ছোট ভাই হয়েছে। আহনাফ অনেক খুশি হয়। সারাদিন নওরীনের সাথে গল্প করে- ছোট ভাইয়ের সাথে এটা করবে, সেটা করে, আরও কত কি!
আজ ১৭ নভেম্বর। আহনাফের জন্মদিন। গত দুই বছর আহনাফের খালামনি বা খালু কেউ একবারের জন্যও ওর জন্মদিনের কথা মনে করেনি, এবারো হয়ত করবে না। শুধু বাবা-মা ফোন করে উইশ করে, কিন্তু উইশ করার পরই শুরু হয়, “আব্বু, তোমার পড়াশোনার কি অবস্থা? ঠিকমত পড়াশোনা করবে, তোমাকে অনেক বড় হতে হবে।......।” এই হল ওর জন্মদিন।
তবে আহনাফ জানে এবারের জন্মদিন আর অন্য জন্মদিনগুলোর মত হবে না। ও স্কুল থেকে ফেরার সময় পাশের পেস্ট্রি শপ থেকে সুন্দর একটা চকোলেট কেক কিনে আনে। বাসায় ফিরে নওরীনকে ডাক দেয়। নওরীন আসে, ওর হাত দুটো পেছনে লুকানো। আহনাফ জিজ্ঞেস করে, ‘‘কি ব্যাপার নওরীন? তোমার হাত পেছনে কেন?’’ নওরীন ওর হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে দেয়, ‘‘হ্যাপি বার্থডে আহনাফ’’। ওর হাতে একটা খুব সুন্দর একটা নোটবুক। আহনাফ নোটবুকের মলাট উলটে দেখে গোটা গোটা হাতে লেখা -‘For my best Friend’। আহনাফ অবাক হয়ে বলে, ‘‘কিন্তু আমি তো তোমাকে কখনও জানাই নি যে আজ আমার বার্থডে!’’
- আমি জানতাম। কিন্তু কিভাবে জেনেছি তা বলব না।
দুজন মিলে কেক কাটে। নওরীন হঠাৎ দুষ্টুমি করে আহনাফের মুখে কেকের ক্রীম লাগিয়ে দেয়। আহনাফও নওরীনের মুখে ক্রীম লাগানোর জন্য ওর পেছনে ছুটতে থাকে। ওদের ছোটাছুটিতে ঘরের জিনিসপত্র সব ওলট-পালট হয়ে যায়। এমন সময় কলিং বেল বেজে ওঠে।
আহনাফ দরজা খুলে দেখে খালামনি দাড়িয়ে আছে। আজ শনিবার, খালামনি যে দুপুরেই বাসায় ফিরবে তা ওর মনেই নেই। খালামনি ঘরে ঢুকে দেখে সারা ঘর নোংরা হয়ে পড়ে আছে, জিনিসপত্র সব এলোমেলো, পাশের বাসার মেয়েটা সোফার উপর দাঁড়িয়ে আছে। নওরীন আহনাফের খালামনিকে দেখে আস্তে আস্তে সোফা থেকে নেমে নিজের বাসায় চলে যায়। খালামনি সেদিন আহনাফকে অনেক বকাবকি করে, ‘‘আমি বাসায় থাকি না, আর তুমি সারাদিন লেখাপড়া বাদ দিয়ে এইসব কর! অন্য ফ্ল্যাটের মেয়ে আমাদের ঘরে কেন? যদি কোন কিছু ভেঙ্গে ফেলে বা হারিয়ে ফেলে তখন কি হবে?......” কথাগুলো শুনে আহনাফের খুব খারাপ লাগে, ও নিজের ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। বিছানায় উপুড় হয়ে অনেকক্ষন কাঁদতে থাকে। রাতের খাবার খেয়ে ব্যাল্কনিতে গিয়ে বসে। মা-বাবার কথা ভেবে ওর আবারও কান্না আসে, ছোট ভাইটাকে অনেক দেখতে ইচ্ছা করছে। এবার যখন বাবার সাথে ফোনে কথা হবে তখন বলবে যেন ওকে কিছুদিনের জন্য দেশে নিয়ে যায়।
নওরীনের সাথে আর এখন আগের মত খেলা করতে পারে না, শুধু বিকালে ছাদে গিয়ে গল্প করে। তারপরও নওরীনই হল ওর একমাত্র বন্ধু। গল্পে গল্পে একদিন নওরীন বলে যে ওরা এমাসের ৩০ তারিখে এখান থেকে চলে যাবে। বলতে বলতে নওরীন কেঁদে ফেলে। ওর কান্না দেখে আহনাফ কিছু বলতে পারে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। বাবা-মাকে ছেড়ে আসার পর ও একটাই ভালো পেয়েছিল। অবশেষে সেও চলে যাচ্ছে। সন্ধ্যার সময় দুজন যখন নেমে আসে তখন দেখে আহনাফের খালামনি দরজার সামনে দাঁড়ানো। আহনাফ ঘরে ঢুকলে আহনাফকে অনেক বকাঝকা করে। পরদিন খালামনি বাইরে যাবার সময় যে লোকটি খাবার দিয়ে যায় তাকে ফোন করে জানিয়ে দেয় দুপুরে খাবার দিয়ে যাবার পর যেন বাইরে থেকে তালা দিয়ে চাবি নিচে সিকিউরিটি রুমে দিয়ে যায়।
আহনাফের স্কুল ছুটি। তাই ঘর থেকে বের হবার কোন সুযোগ নেই। সেদিনের পর থেকে নওরীনের সাথেও আর দেখা হয় নি।
দেখতে দেখতে ৩০ তারিখ চলে আসে। আহনাফ দুপুরে টিভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ওর ঘুম ভাঙ্গে বিকালে। ঘুম থেকে উঠে দেখে যে লোকটি খাবার দিয়ে যায় সে চলে যাচ্ছে। ও দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে দেখে নওরীনদের দরজায় তালা ঝুলছে। লোকটি জানায় যে কিছুক্ষন আগে সব মালপত্র গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে এইমাত্র তারা নিচে নেমে গেছে। আহনাফের মন খারাপ হয়ে যায়। হঠাৎ ওর মনে পড়ে নওরীনরা কোথায় যাচ্ছে তাতো জানা হল না। ও তখনই দৌড়ে নিচে নামতে যায়। কিন্তু তার আগেই লোকটি ওকে জোর করে ভেতরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা দিয়ে চলে যায়। কোন উপায় না পেয়ে ও দৌড়ে ব্যালকনিতে ছুটে যায়। নিচে তাকিয়ে দেখে নওরীন ওর আব্বু-আম্মুর সাথে গাড়িতে উঠছে। ও চিৎকার করে নওরীনকে ডাক দেয়। কিন্তু নওরীন শুনতে পায় না। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। আহনাফ কি করবে কিছুই বুঝতে পারে না। কি মনে করে কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ ও ব্যালকনি থেকে লাফ দেয়।
আহনাফ জ্ঞান ফেরার পর বুঝতে পারল ওর মাথায় আর বুকে প্রচণ্ড ব্যথা। আস্তে আস্তে চোখ খোলার চেষ্টা করল। ভালভাবে কিছুই দেখতে পারছে না, তারপরও দেখার চেষ্টা করল। ও একটা কাচের ঘরের ভেতর শুয়ে আছে। মুখের সাথে কি যেন বাধা, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ও বামদিকে ফিরে তাকাতেই দেখতে পেল ওর মা দাঁড়িয়ে আছে, কোলে ছোট্ট একটা বাবু- ওর ছোট ভাই। পাশে বাবা দাঁড়িয়ে। ও আর চোখ মেলে তাকাতে পারছে না, নিঃশ্বাস মনে হচ্ছে ভারী হয়ে আসছে। তবুও আরেকবারের জন্য চোখ মেলে ওর মায়ের দিকে তাকানোর চেষ্টা করল। এটা ওর মা?! ওর বিশ্বাস হচ্ছে না, ও কি স্বপ্ন দেখছে! এমন সময় ওর মাথায় কে যেন হাত রাখল। ‘মনে হয় মা’... আর কিছু ভাবতে পারছে না। তবুও ও মার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ‘মা’ বলে ডাকতে চাইল। অসাড় দুটো ঠোঁটের মাঝ থেকে হাল্কা একটা স্বর বেরিয়ে এল। ওর ‘মা’ ডাক কেউ শুনতে পেল না, শুধু ঠোঁট দুটো একটু কেঁপে উঠল। ঠিক তখনই ওর ছোট্ট অভিমানী চোখের কোণা থেকে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। ও আর তাকিয়ে থাকতে পারল না। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে। নিঃশ্বাস আরও ভারী হয়ে আসছে। অশ্রুসিক্ত গলায় আবারও ওর মাকে ডাকার চেষ্টা করল। কিন্তু আর পারল না। মাথার ভেতর সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, কেমন যেন সব কিছু দূরে সরে যাচ্ছে। প্রচণ্ড ঘুম পেল আহনাফের, এত ঘুম আগে কোন দিন পায়নি। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না, অভিমানী চোখদুটো বন্ধ করে নিরবে ঘুমিয়ে পড়ল...............
©somewhere in net ltd.