নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মনের কথা বলে যাই

নিঝুমবাবুই

বলি ও লিখি, কারণ বলতে বলতে লিখতে লিখতে বদল হয়, পরিবর্তন হয়।

নিঝুমবাবুই › বিস্তারিত পোস্টঃ

শাম্মীর সাথে আমার শেষ দেখা....

০২ রা নভেম্বর, ২০১৪ দুপুর ২:১৩

২০১৩। ঈদের সকাল। একটা ক্লিনিকের ১০৪ নম্বর রুম। আমার সামনে বিছানায় যে মেয়েটি বসে আছে, ওর নাম শাম্মী। রক্তের কোন বন্ধন নেই। অথচ ওর জন্ম থেকেই গত ২০ বছর এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে আছি ওর সাথে। ঢাকায় সবাইকে রেখে ঈদের দিনে কেন ওকে দেখতে এলাম!
"চাচ্চু তোমার অফিস কি ছুটি হয়েছে? আচ্ছা কালকে আসতে পারবে? একদিনের জন্য! আসো না, চাচ্চু। "
টানা কয়েক বছর এই ফোন পেয়ে আমি অভ্যস্ত। প্রথম প্রথম যখন ফোন পেতাম, তখন কথা বলতাম আর আমার চোখ দুটো ভিজে যেতো আর আর গলাটা ভারী হতে হতে বাকরুদ্ধ হওয়া পর্যন্ত কথা বলে যেতাম।
ইচ্ছে হতো ছুটে যাই, ইচ্ছে করলেও যেতে পারতাম না। আর গেলেই বা কী। আসার সময় মনটা এত খারাপ হয় যে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পেতে আমারই কয়েকদিন লেগে যায়।
তবু ব্যস্ত জীবনের এই ছুটে চলাকে ক্ষান্তি দিয়ে গিয়েছি অনেকবার।
সেই ১৯৯৩ জন্ম নেয়া মেয়েটি আজ ২১ বছরের কন্যা। শাম্মীর যখন দুই বছর তখন থেকেই তার চাচ্চু ডাক শুনে আসছি। শাম্মীরা থাকতো আমাদের পাশের ফ্লাটেই। আমরা তখন থাকতাম চট্টগ্রামে, কাতালগঞ্জ এলাকায়। ১৯৯৩ সালে বুয়েটে ক্লাস শুরু হলে প্রিয় জন্মশহর চট্টগ্রামের মায়া ছেড়ে ঢাকায় চলে আসতে হয়।
কিন্তু মায়া কি সহজে কাটে? বাবা চাকুরি করতেন রেলওয়েতে। বাবার দৌলতে প্রতি বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম আর শনিবার রাতে ঢাকায় রওয়ানা দিতাম। এই দু'দিন শাম্মীর সাথে আমার সময়টা কাটতো। ওকে আমার কোলে দিয়ে বেশ থাকতেন শাম্মীর মা।
শাম্মীর প্রতি দুটি বিশেষ কারণে আমার অদ্ভুত মায়া জন্মে যায়। আমার নিজের একটা ছোট ভাইবোনের খুব সখ ছিলো। আর দ্বিতীয়টা হলো শাম্মীর ঘটনাবহুল জন্মটা! প্রথম সন্তান সিজারিয়ানসহ কিছু জটিলতায় শাম্মীর বাবা মায়ের প্রতি পরবর্তী সন্তান নেয়ার জন্য একটু সময়ের গ্যাপ নেয়া আর বিশেষ সতর্কতার পরামর্শ ছিলো চিকিৎসকদের।
জীবনের হিসাব কি আর সব সময় পরামর্শ মতো চলে? ছয় মাসের মাথায় শাম্মীর মা আবারও কনসিভ করেন। বাবা -মা দু'জন চিন্তা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন অ্যাবোর্শনের। ডাক্তারও সায় দিলেন।
একটা দিনক্ষণ দিলেন। আমার বোনদের সাথে ভাবীর অনেক খাতির ছিলো। তাদের কল্যাণে জানতে পারলাম আজ ডাক্তারের কাছে যাচ্ছেন বাচ্চা ফেলে দিতে। একদিন হাসপাতালে থাকতেও হতে পারে। না থাকতে হয় নি। বিকাল বেলা ভাবী বেশ হাসিমুখে ফিরে আসলেন।
অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটে যায় সেদিন। যে ডাক্তারের অ্যাবোর্শনটা করার কথা ছিলো, সেদিন কোন এক ব্যস্ততায় তার আসা হয় নি। যিনি দায়িত্বে ছিলেন সেদিন, তিনি অনেক চেক আপ করে বললেন, " যে এসে গেছে, তাকে আসতে দিন না, দেখুক না পৃথিবীর আলো।"
এভাবেই শাম্মী ঘর আলোকিত করে আসে।শাম্মীর মত এত সুন্দর বাচ্চা দেখিনি আমি। আমার মনে হলো,ইশ্, আমার যদি একটা বোন হতো এমন! তারপর, কারণ অকারণে ওদের বাসায় যেতাম, ক্লাশ শুরু হয়নি তখন, অফুরন্ত আমার সময়।
এভাবেই ওর সাথে আমার হৃদ্যতা শুরু। মনে হয় দু'বছরের মাথায় প্রথম চাচ্চু ডাকা শুরু করে। ঢাকা থেকে যতবার যেতাম ওর জন্য সুন্দর সুন্দর খেলনা নিয়ে যেতাম।
আমার পড়া শেষ হতে লাগলো, শাম্মীও বড় হতে থাকলো। আমাকে ছড়া শুনানো শেষ করে গল্প শোনানো শুরু হলো। সেই শাম্মী দেখি হারমোনিয়াম বাজিয়ে সা রে গা মাও শিখতে শুরু করলো। লেখাপড়া মোটামুটি ভালো। ওর মা প্রায়ই বলতো, "আম্মু, চাচ্চুকে খুশি করতে হলে রেজাল্ট ভালো করতে হবে। "
বলতো, "চাচ্চু, দেখো এবার অনেক ভালো করবো। "
একটু একটু বড় হচ্ছে, আর আমার আরোও ন্যাওটা হতে থাকলো। ২০০২ সালের ঘটনা, শাম্মীর বয়স তখন ৯, আমাকে কয়েকটা ছড়া শুনালো, বললো, চাচ্চু একটা গল্পো বলি? একটা নয়, কয়েকটা গল্পো শুনালো। এত সুন্দর করে কেউ গল্পো বলে? ওর গল্পো বলার ধরন দেখে মনে হলো, গল্পো বলা একটা দারুণ শিল্প। মানুষ কিছু কিছু ক্ষমতা এমনি এমনি পায় মনে হয়। শাম্মীর গল্পো বলার স্টাইল ছিলো গড গিফটেড।
হঠাৎ মনে হলো, কোথাও একটা ছন্দপতন হচ্ছে। ওর আচরণে কোথাও একটা গরমিল হচ্ছে। এবার বললো, "চাচ্চু, গান শুনবা? "
ওর চলায় দেখলাম একটা দারুণ অস্থিরতা। কোথাও সে স্থির হয়ে বসছে না। এর ছয়মাস পরে আবার চট্টগ্রাম গেলাম। ভুলে গেছিলাম ওর কথা। আমি যাওয়ার সাথে সাথেই হাজির। "চাচ্চু, মাকে বলো না, আজকে স্কুলে যেতে হবে না! "
শাম্মীর মা বলে চলেছেন, "এই শয়তান মেয়ে প্রত্যেকদিন তোর এই স্কুলে যাওয়া নিয়ে ফাজলামো ভালো লাগে না। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। "
বয়স ১০, স্ট্যান্ডার্ড থ্রি। পড়াশুনায় অব্যাহতভাবে অমনোযোগের ফলাফল বাবা মা দু'জনকেই হতাশ করে দিচ্ছে। বড় হচ্ছে, আর গা থেকে উজ্জ্বল আলোর ছটা বের হচ্ছে। দিন দিন আরো সুন্দর হচ্ছে, আর পড়াশুনায় পাল্লা দিয়ে খারাপ করছে।
তারপর, ডাক্তার দেখানো হলো। ডাক্তার বললেন "হাইপার অ্যাকটিভ বেইবি! জোর করলে হিতে বিপরীত হবে। " জীবনে প্রথমবার আমি হাইপার অ্যাকটিভ বেইবি কথাটা শুনলাম।
এরপর আমি ঘর সংসার, চাকুরি নিয়ে আরো ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। শাম্মীর খবর নেওয়া কমতে কমতে বন্ধ হয়ে গেলো। ভাবী একদিন ফোন করলেন, ঢাকায় আসবেন, শাম্মীকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ ফিরোজের (এখন প্রয়াত) সিরিয়াল নিয়ে রাখতে বললেন। আমার অফিস তখন ধানমন্ডি ৮ এ। সিরিয়াল নিতে কোন দেরি নয়। ভাই ভাবী আসলেন শাম্মীকে নিয়ে।২০০৮ সাল, ১৫ বছরের কিশোরী এখন, কত কোলে নিয়েছি ওকে। কত বড় হয়ে গেলো চোখের সামনে।
এক মাসের জন্য ভর্তি হলো ওনার ক্লিনিকে। কিছুতা সুস্থ হয়ে ফিরেও গেলো চট্টগ্রাম।
সময় যেন কেমনে চলে যায়। এক বছর পরে আবার কথা।মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হেদায়েত স্যারের ক্লিনিক থেকে ফোন। "চাচ্চু, কেমন আছো? বলতো আমি এখন কোথায়? আমি ঢাকায়! " কোথায় মা মণি, খবর দাও নি কেনো?
বয়স আরেকটু বাড়ছে। মা মণিটাকে কী সুন্দর লাগছে। শাম্মী আর স্কুলে যায় না। ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করে মাঝে মাঝেই। অসহায় ভাবী আস্তে আস্তে আত্মসমর্পণ করে। আচ্ছা, লেখাপড়া সবাইকে ভালো করতে হবে, এমন কথা নেই। কিন্তু লেখাপড়াটা চালিয়েতো যেতে হবে।
সময়টা ২০১০। আমি অফিসের কাজে চট্টগ্রাম। শাম্মীদের বাসায় গেলাম। শাম্মী যখন আমার সাথে কথা বলে, কে তাকে বলবে, ক্রমশ সে মানসিক রোগী হয়ে পড়েছে! যে শাম্মীকে দিনের পর দিন কোলে করে আদর করতাম, তার ভীষণ অবাক করা এক ব্যবহারে আমি চমকে গেলাম। সে আমার পাশে বসছে, আমাকে সব সময় যেমন জড়িয়ে ধরে, এবার তেমন নয়। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, "সামথিং রঙ!"। কোনমতেই শাম্মী আমার গা ছাড়ছে না। বুঝলাম, সমস্যা জটিলতর হচ্ছে। ভাই ভাবী ম্যানেজ করতে পারছেন না।
জীবনের প্রয়োজনে আমরা নিরন্তর ছুটে বেড়াই। অন্যের জীবনের সমস্যা নিয়ে ভাবার সময় কই? ভাবীকে শুধু বলে আসলাম, ওর আচরণের কথা। ভাবীকে খুব স্বাভাবিক দেখলাম। ডাক্তার নাকি বলেছেন, এই সব বাচ্চাদের বিপরীত লিংগের প্রতি আকর্ষণ প্রবল থাকে - তাদের মন কে আপন, কে পর তার বিবেচনার ক্ষমতা রাখে না।
এত ব্যস্ততার মাঝে শাম্মীর জন্য আমার মনটা প্রায়ই কাঁদে। খুব দেরি হয়ে গেছে। মনে হয়, ছোটবেলা থেকে ওর বাবা মা যদি খালি পার্টি করে সময় ব্যয় না করতো, শাম্মীর জন্য আরো সময় ব্যয় করতো, হয়তো বা এমন হতো না।
এখন শাম্মীর বাবা মা খুব একটা সময় বাহিরে ব্যয় করেন না।ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। মেয়ের জন্য সব কিছুই করছেন, চিকিৎসার সব আয়োজন চলছে। তারা এখন ক্লান্ত, অনেক ক্লান্ত। তারপরও মেয়ের যত্ন নিচ্ছেন, বড্ড দেরিতে।
এভাবে কতদিন?
২০১৩। রমজানের কোন একদিন। অফিসে আছি, ফোনে দেখলাম শাম্মীর বাবার ফোন। "চাচ্চু, চাচ্চু, তুমি কোথায়? এক্ষুণি একটু আসোতা, কয়েকটা মহিলা আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে! বাসার সামনে একটা অ্যাম্বুলেন্স। আমাকে কোথায় যেন নিয়ে যাবে। আমি বলেছি, চাচ্চু আসার পরে নিয়ে যেও। প্লিজ চাচ্চু বলো না আব্বুকে, তুমি না আসা পর্যন্ত যেন না পাঠায়! প্লিজ চাচ্চু, তুমি আসো। "
চোখ দুটো ভিজে যাচ্ছিলো আমার, অনেক মানুষের শব্দ পাচ্ছিলাম।
কয়েকদিন পরে আবার ফোন পেলাম। শাম্মীর বাবার নাম্বার থেকেই। "চাচ্চু, কালকে চলে আসো, আমাকে দেখে যাও। বস ছুটি না দিলে আমার কথা বলো। অফিস থেকে বের হয়ে তোমার বাবুকে দেখে সোজা চট্টগ্রাম চলে আসো। "
না যেতে পারি নি। তারপর ঈদের ছুটির সময় হলো। ছেলের সাথে আগেই সব ঠিকঠাক, ঈদের ছুটিতে বাপব্যাটা ঘুরার প্ল্যান।
আমার ছেলে নাহু। বললাম, বাবা তোমাকে কোরবানির ঈদে নিয়ে যাবো। এবার বাবাকে একটু মাফ করে দাও। ছেলে আমার খুবই কনসিডারেবল, শুধু বাবার জন্য।
ছেলেকে ভুলিয়ে রেখে গেলাম চট্টগ্রাম। নাহু যেমন আমার বাবা, শাম্মী আমার তেমন একটা মা। মা যেতে বলেছে, না যাই কীভাবে!
জীবনের একটা ঈদের দিন কি শাম্মীর সাথে দিতে পারি না।
আড়ং থেকে ঈদের কিছু কেনাকাটা আগেই করে রাখলাম। নামাজ পড়ে শাম্মীর বাবার সাথে গেলাম শাম্মীকে দেখতে।
রুম নাম্বার ১০৪। ক্লিনিকটা অনেকটাই ফাঁকা। একটা বেডে ভাবীর পাশে হাড় জিরজিরে একটা মেয়ে শুয়ে আছে। আচ্ছা, ও কী শাম্মী না অন্য কেউ? গত ১৭-১৮ বছর যে শাম্মীকে দেখেছি, এ তো সে নয়! ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় সারাক্ষণ ঝিমায়, গোসল করে না, আর খাওয়ার রুচি তার কমছেই। এত কিছুর পরেও খুব নিষ্ক্রিয়ভাবে বললো ,"চাচ্চু, কেমন আছো? "

এরপরে শাম্মীর ফোন আর কখনো পাই নি। আর শুনিনি, "চাচ্চু, কালকে চলে আসো। আমাকে দেখে যাও! "

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৪:০১

সালমান মাহফুজ বলেছেন: খুব আবেগময়ী বর্ণনা ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.