নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মুক্তমনা লেখক ও বিজ্ঞান কর্মী, প্রকৃতির ছাত্র !
সকালে ঘুম থেকে উঠেই মুখ কালো করে বসে আছে ভোলাদা। হঠাৎ এমন হাবভাবের পিছনে যে বড় কোনো কারণ আছে এমনটি নয়। ভোলাদার ছাদ বাগানের বুনো বেগুন গাছটি ভালোভাবে বাড়ছে না। যত্নের কোনো ঘাটতি রাখে নি ভোলাদা। প্রতিদিন পানি দেওয়া, প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর উপাদান সবকিছু সে নিয়মিত দিয়ে থাকে। তবে গাছের চারপাশে বেড়ে উঠা আগাছা প্রচুর সমস্যা করছে। নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করলেও কয়দিন যেতে না যেতেই আবার আগের মতো অবস্থা। এই বিষয় নিয়ে ভোলাদার ভারি চিন্তা। আর যাই হোক, শখের বেগুন বলে কথা। সুদুর কামুক্ষ্যালিঙ্গমন দ্বীপ থেকে তার বন্ধু নিয়ে এই বেগুনের চারা নিয়ে এসেছে।
আগাছার সমস্যা কিভাবে সমাধান হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতেই হঠাৎ ‘ভোলাদা’ বলে কে যেন ডেকে উঠল। এদিক সেদিক তাকাতেই ভোলাদা দেখল, তার বন্ধু বলদলাল তার দিকে আসছে।কাছাকাছি আসতেই,
-কি হে ভোলা! এত সকাল সকাল মুখ গোমড়া করে বসে আছিস কেন?
-আর বলিস না বন্ধু, বিশাল এক সমস্যা নিয়ে আছি। তবে মাথায় কিছু আসছে না।
-কি সমস্যা? আমাকে বল। দেখি আমার গোবর ভর্তি মগজ থেকে তোকে কোনো সমাধান দিতে পারি কি না।
ভোলাদার সমস্যা শুনে বলদলাল বলল,
-বন্ধু এই সমস্যার সমাধান আমার ভালোভাবে জানা নেই। আমি অতি নগণ্য মানুষ। সামান্য একটু ব্যবসা বিষয়ক জ্ঞান আমার আছে, এর বাইরে তেমন কিছু জানা নেই আমার। তবে আমি তোকে একটি পরামর্শ দিতে পারি।
আবেগ তাড়িত হয়ে ভোলাদা বলল,
-বল, বল। কি সেই পরামর্শ?
-শোন, আমি এক মহাজ্ঞানী জয়কল্যাণী সর্বজান্তা বুদ্ধিসমুদ্র গুরুর কথা জানি, যে তোকে এই সমস্যার সমাধান দিতে পারবে। আমি একটি ঠিকানা লিখে দিচ্ছি, তুই গিয়ে দেখা করতে পারিস।
ভোলাদা এমন গুরুর পরিচয় জেনে বলদলালকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল,
-বন্ধু, উনি কি বুনোবেগুনের উপর গবেষণা করেছেন, মানে উচ্চতর পড়াশোনা বা দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আছে?
গম্ভীরভাবে বলদলালের উত্তর,
-তুই আমাকে যা বলেছিস, বলেছিস। ভুলেও সেই পন্ডিতের আশ্রমে গিয়ে এই কথা জিজ্ঞেস করবি না। উনি সর্বজান্তা, সর্ববিষয়ে অভিজ্ঞ। এমন কোনো বিষয় নেই যা তিনি জানেন না। সর্ববিষয়ে তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, পান্ডিত্য। রাজা অমিত্যরাধাশ্রী’র রাজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে টানা দুই যুগ তিনি সেবা দিয়েছেন। দেশ, বিদেশে উনার সুনাম, শত শত দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। এখন এক বিশাল আশ্রম খুলেছেন। দেশ বিদেশ থেকে মানুষ আসে, রাজা বাদশা থেকে সাধারণ মানুষ। সকল সমস্যার সমাধান মানেই পন্ডিত ‘জয়কল্যাণী সর্বজান্তা বুদ্ধিসমুদ্র চটপটাং’।
এমন খবর জেনে ভোলাদা আর এক মুহূর্ত দেরি করতে চাইলো না। কোনোমতে মুখ ধুয়ে, ঘরের কাঠের তাকে রাখা মুড়ির কৌটা থেকে এক মুঠো মুড়ি মুখে দিয়েই পন্ডিতের আশ্রমের দিকে দৌড়াল। দীর্ঘ যাত্রা শেষে পন্ডিতের আশ্রমে পৌঁছাল ভোলাদা। দীর্ঘ যাত্রা, নদীপথে, সড়কপথে আবার এই আশ্রমে আসার জন্য পাহাড়ের চূড়ায় হেঁটে আসায় ভোলাদাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল, পানির পিপাসায় গলা শুকিয়ে আসছে। হঠাৎ উদ্ভট পোশাক পরিহিত একজনকে দেখে ভোলাদা সম্মান জানিয়ে বলল,
-একটু পানি হবে গুরুজি? ক্লান্ত, শ্রান্ত দীর্ঘ ভ্রমণে বুক ফেঁটে যায় আর কি।
ব্যক্তির আন্তরিকতা আকৃষ্ট করলো ভোলাদাকে। যেন কত চেনা, আপন মানুষ। আন্তরিকতার সুরে উত্তর এলো,
-অবশ্যই বৎস। পানি কেন, চাইলে শরবত পান করতে পারো।
খুশিতে গদগদ হয়ে ভোলাদা বলে উঠল,
-তাই, বলেন কি! তাহলে আমাকে শরবত দিন।
একদিকে পিপাসা, অন্যদিকে আগন্তুকের আন্তরিকতায় ভোলাদা তিন গ্লাস শরবত সাবাড় করে দিল।
তৃপ্ত হৃদয়ে ধন্যবাদ দিতেই আগন্তুক হাত বাড়িয়ে বলল,
-ধন্য হও বৎস। শরবতের বিনিময়ে খুশিমনে দশ হাজার টাকা দাও।
ভোলাদা হঠাৎ চমকে উঠার মতো জিজ্ঞেস করল,
-বলেন কি! তিন গ্লাস শরবত দশ হাজার। অদ্ভুত তো! ভাবলাম আপনি আমাকে এমনি খাওয়াচ্ছেন।
আগন্তুক উত্তর দিল,
-এ জগতে হায়, এমনি এমনি কি কিছু হয়? আর এতো পন্ডিত ‘জয়কল্যাণী সর্বজান্তা বুদ্ধিসমুদ্র চটপটাং’র আশ্রম। এখানে সব সমস্যা আসান হয়। তোমার থেকে তো সামান্য চেয়েছি।
কোনো উপায় না দেখে, ঝামেলা এড়াতে, নিজের শার্ট, প্যান্টের সব প্যাকেট হাতিয়ে টাকা দিয়ে ভোলাদা আগন্তুককে বিদায় করলো। কান ধরে শপথ করলো, আর কারো সাথে কথা না। এবার সোজাসুজি পন্ডিতের কাছে তার সমস্যা নিয়ে যাবে।
যাই হোক, অনেক খোঁজাখুঁজির পর ভীর ঠেলে পন্ডিতের সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ হলো। বলা যায় এই সুযোগও সহজে আসে নাই, পন্ডিতের কয়েকজন শিষ্যকে হাত করে পন্ডিতের খুব কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে সে।
এক শিষ্যের সাথে ভোলাদা পন্ডিতের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে বললে ভুল হবে, প্রায় দশ হাত দুরে। এই সীমানা থেকে সামনে যাওয়া নিষেধ, সাধারণ মানুষের খুব কাছাকাছি যাওয়া পছন্দ করেন না পন্ডিত। শোনা যায় রাজার রাজ্যের বিভিন্ন বিভাগে যখন ছিলেন তখন থেকে তিনি এই চর্চা করে আসছেন।
সাথে আসা শিষ্য পন্ডিতকে ভোলাদার বিষয়ে জানালেন। চোখ বন্ধ পন্ডিত হঠাৎ উচ্চস্বরে অদ্ভুত ভাষায় কি যেন বলে চোখ খুললেন। সরাসরি ভোলাদার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-কি সমস্যা বাছা? কেন এসেছ আমার কাছে?
ভোলাদা উৎফুল্লভাবে নিজের সমস্যা বলতে যাবে, ঠিক এই সময় শিষ্যের ইশারায় বুঝলো, অন্যভাবে কথা বলতে হবে।
ভোলাদা বিনয়ের সাথে সামনে সামান্য ঝুঁকে বলল,
-জয় গুরুজির জয়, জয় পন্ডিতের জয়। আমার বাসার ছাদে একটি টবে বেগুন গাছ আছে, সব ঠিক আছে। তবে বারবার পরিষ্কার করলেও কদিন পর আবার আগাছা বেড়ে উঠছে। কোথাও কোনো সমাধান না পেয়ে আপনার নিকট এসেছি পন্ডিত মহাশয়।
পন্ডিত চোখ বন্ধ করে বললেন,
-জটিল সমস্যা। জগতে প্রতিনিয়ত সমস্যা বেড়েই চলেছে। এভাবে আগাছা বাড়লে বেগুন গাছ ভালোভাবে বাড়বে কিভাবে, আর তোমরাই খাবেই কি! তবে এটার সমাধান আছে। ফসল ফলাদির বিষয়ে আমার পান্ডিত্য আছে। আমার পড়াশোনা অন্য বিষয়ের হলেও রাজা অমিত্যরাধাশ্রী’র রাজ্যে আমি বহুবছর এই বিষয়ের দায়িত্বে ছিলাম। বিস্তর অভিজ্ঞতা আমার। আমি এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ না হলেও আমার পরামর্শে ফসল ফলাদি আবাদ হতো, নতুন নতুন উদ্ভাবন হতো। দেশ বিদেশে ঘুরে ঘুরে দেখে দেখে বলতে পারো আমি এই বিষয়ের পন্ডিত। আর তোমার বুনো বেগুন, সে তো আরেক ইতিহাস। হুনুলুলু দ্বীপ থেকে পাঁচ হাজার কিলোমিটার দুরের এক জনাকীর্ণ দ্বীপ চুনুপুনু, সেখানে আমি বুনো বেগুনের বাগান দেখেছি, ঘুরেছি, প্রচুর ছবি আছে আমার। এই বিষয়ে আমার চেয়ে ভালো পরামর্শ তোমাকে কেউ দিতে পারবে না।
মিনতির সাথে ভোলাদা বলল,
-পন্ডিত জি, যদি পরামর্শ দিতেন। অনেক দুর থেকে এসেছি, বাড়ি ফিরতে হবে।
ভোলাদার কথায় পন্ডিত কিছুটা বিরক্ত হলেন। বললেন,
-এত অস্থির হলে চলে। আমিতো আমার অভিজ্ঞতা বলা শুরুই করি নি। যাই হোক, যেহেতু দুর থেকে আসছো তাই বলছি, তুমি বেগুন গাছের চারদিকে বেড়ে উঠা আগাছার মাথা কেঁচি দিয়ে কেঁটে দেবে, নিয়মিত ছেটে রাখবে।
সমাধান শুনে ভোলাদা কি বলবে বুঝতে পারছে না। তার মনে হলো, এতে কী সমস্যার সমাধান হবে? তাই সাহস নিয়ে পন্ডিতকে জিজ্ঞেস করলো,
-পন্ডিত মশাই, এতে কী আমার সমস্যার সমাধান হবে?
রক্তরঞ্জিত চোখে আগুনলাল চেহারায় ভোলাদার দিকে পন্ডিত তাকিয়ে বললেন,
-তুমি কে হে? আমার মতো অভিজ্ঞ মানুষের সমাধানে খুশি নও। দেখাবো তোমাকে আমার ইতিহাস, আমার কাজের ফিরিস্তি, আমার ভ্রমণের ছবি?
অবস্থা বেগতিক দেখে, ভোলাদা মিনতির সুরে ক্ষমা চেয়ে দ্রুত বিদায় নিল।
ভোলাদার পিছে পিছে আসা শিষ্য দরজা পার হতেই ভোলাদর হাত চেপে ধরে বলল,
-কি মিঞা, হুরপার করে কয় যান? ফিস দিবেন না?
আমতা আমতা করে ভোলাদা বলল,
-ফিস! এই পরামর্শের জন্য ফিস! তা, কত?
গম্ভীরভাবে পন্ডিতের শিষ্য বলল,
-মাত্র, পঞ্চাশ হাজার টাকা।
শুনে যেন ভোলাদা আকাশ থেকে পড়লো। পূর্বের অভিজ্ঞতায় বিপদ এড়াতে কিছু টাকা আর নিজের স্বর্ণের চেইনটা শিষ্যকে দিয়ে বিদায় নিলো।
ভোলাদার দেয়া টাকা পকেটে পুরে স্বর্ণের চেইন হাতে নিয়ে পন্ডিতের সামনে দাড়িয়ে শিষ্য বলল,
-গুরুজি, ফিস হিসেবে লোকটি এই চেইনটি রেখে গেছে। বেচারা বড্ড গরীব।
আচ্ছা আচ্ছা বলে পন্ডিত তার সিংহাসনে বসে পড়লো। আবার ধ্যানের প্রস্তুতি নেবে, এমন সময় শিষ্য জিজ্ঞেস করল,
-আচ্ছা গুরুজি। আমার মনে একটা প্রশ্ন, আপনি নিজের বাড়ির বেগুন গাছের আগাছা মালিদের শিকড়সহ উপড়ে ফেলতে বলেন, সবসময় আগাছামুক্ত রাখতে বলেন। কিন্তু লোকটাকে বললেন, কাঁচি দিয়ে আগাছার মাথা কাটতে। এতেতো তার বেগুন গাছের আগাছা নিধন হবে না। বরং আরোও শাখা-প্রশাখা হবে।
হাসতে হাসতে পন্ডিত উত্তর দিলো,
-এই বুদ্ধি যদি তোমার থাকতো, তাহলে বাইরের এত পান্ডিত্য নিয়ে এসে আমার শিষ্য হতে না। আর আমি কোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ না হয়েও এত সমস্যার সমাধান দিতাম না। আরেহ পাগলা, ওদের ঘরে যদি সমস্যা জিইয়ে না থাকে, তাহলে আমি সমাধান দিব কিসের! আর আমাকে মানুষ এত মানবে কেন?
মাথা চুলকিয়ে শিষ্য উত্তর দিল,
-মানে? এটা কি ঠিক, গুরুজি? নিজের ঘর ঠিক রেখে, অন্যের সমস্যা জিইয়ে রাখা, আবার সেই সমস্যা সমাধানেই আপনার কাছে আসা!
অদ্ভুদ এক হাসি দিয়ে পন্ডিত ‘জয়কল্যাণী সর্বজান্তা বুদ্ধিসমুদ্র চটপটাং’ বলে উঠল,
- সেবানং পন্ডিতং পেটভরাং তপঃ
শিষ্য হঠাৎ এই অদ্ভুদ বাক্য শুনে অবাক হলো। তার মনে হলো এতো মহাপন্ডিত, কি যেন এক মন্ত্র জপছে। মনে যতটা খুশি তার চেয়ে পন্ডিতকে দেখানো জন্য উচ্চস্বরে বলে উঠল,
-জয় ! পন্ডিতের জয়, সর্বজান্তা পন্ডিতের জয়!
আর পুরো আশ্রমে থাকা অন্যান্য শিষ্যরা একসুরে চিৎকার করে বলে উঠল,--
-জয় পন্ডিতের জয়, জয়কল্যাণী সর্বজান্তা বুদ্ধিসমুদ্র চটপটাংয়ের জয়!
সূত্রঃ মানসিক বিকারগ্রস্থ ভোলাদা’র ডায়েরি।
©somewhere in net ltd.