![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আজিজ সাহেব রেল স্টেষণের প্লাটফর্মে বসে আছেন।তার হাতে একটি সিগারেট।সিগারেটের দিকে তিনি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।এক সময় তার খুব ই প্রিয় এই বস্তু টা এখন তিনি খেতে পারছেন না।২০ বছর আগে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন কিন্তু তারপরেও সিগারেট কেনার স্বভাব টা ছাড়তে পারেননি।সিগারেটকেনার পর সিগারেট নিয়ে বেশ চিন্তায় পরে যান তিনি।একটা বয়সের পর মানুষ ছোট ছোট জিনিস নিয়েও মহা চিন্তায় পরে যায়।তিনি সম্ভবত সেই বয়সে প্রবেশ করছেন।সিগারেটটাখেয়ে নিলেই ল্যাটা চুকে যায়।বেশিরভাগ সিগারেটের শেষ পরিনতি এটাই।খাওয়ার পর স্যান্ডেলের খচা খাওয়াও তার ভাগ্যে লেখা থাকে।তবে কিছু ভাগ্যবান সিগারেটের হিসাব আলাদা।এরা জ্বলন্ত অবস্থায় কিছুক্ষন থাকে।অনেকসময় ঘরবাড়ীও জ্বালিয়ে দেয়।নে বাবা এতক্ষন আমারে পুড়াইছস।এখন নিজে পুড়ে ছাই হ।
চাচা ম্যাচ হবে?ম্যাচ?-এক যুবক কিছুটা হেলে প্রশ্ন করলো।আজিজ সাহেব ছেলেটার দিকে তাকালেন।কোন এক চিত্রনায়কের সাথে এর চেহারার গভীর মিল।নায়কের নাম মনে পড়ছে না।ব্যাপারটা অস্বস্থিকর।বয়সবাড়ার সাথে সাথে স্মৃতিশক্তি কমে যায়।একটা বয়সে এসে একদম ই কমে যায়।ব্যাপারটা ঠিক না।বয়ষ্ক অবস্থায় স্মৃতিরোমন্থন করা ছাড়া আর কোন কাজ বাকি থাকে না।তাই এই সময় স্মৃতিশক্তি প্রখর থাকলে সুবিধা হত।কিন্তু উল্টা কমে যায় কেনো?স্রষ্টার এ কেমন বিচার?
- ম্যাচ হবে না ইয়ং ম্যান।সিগারেট হবে।বেনসন আয়ান্ড হেজেজ।নাও
-না চাচা।ঠিক আছে।লাগবে না।আমার কাছে আছে।আপনার হাতে সিগারেট দেখে ভাবলাম ম্যাচ হয়তো আছে
- বৃদ্ধদ্দের কাছে থেকে সিগারেট সচারাচর পাওয়া যায় না।সুযোগটা মিস কর না।নাও
যুবকটি সঙ্কোচের সাথে সিগারেটটি নিল
- থ্যাঙ্ক ইউ চাচা
- ইউ আর ওয়েলকামড ইয়ং ম্যান
যুবকটি চলে গেল।আজিজ সাহবে তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।যুবকের চেহারার সাথে যে চিত্রনায়কের চেহারার মিল আছে তার নাম মনে পড়ছে-সালমান শাহ।রহস্যনক মৃত্যু।আহারে!
আজিজ সাহেব ঘড়ি দেখলেন।রংপুর থেকে ট্রেন আশার কথা ১০টার সময়।এখন বাজে ১০টা ৪৫।তিনি মহা বিরক্ত হলেন।এ দেশের কোন কিছুর মধ্যে কোন সিস্টেম নেই।ট্রেনের সাথে সাথে দেশ ও পিছিয়ে পড়ছে।এ এক নির্মম বাস্তবতা।
*****
২০ বছর আগের ঘটনা।আজিজ সাহেবের বয়স তখন আনুমানিক ৪০ বছর।তিনি বসে আছেন হাসপাতালের একটা ওয়েটিং রুমে।কেবিন নাম্বার ২২০ এ তার মা মূমূর্ষু অবস্থায় শুয়ে আছেন।আজিজ সাহেব কেবিনের ভিতরে যেতে পারছেন না।অথচো তার ভিতরে যাওয়া খুব ই জরুরী।খুব ই জরুরী…
তার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি ঝরছে।তার হাতে একটা গোলাপফুল।তিনি বারবার গোলাপফুলটার দিকে তাকাচ্ছেন।তাকানোর পর তার কান্নার বেগ আরো বেড়ে যাচ্ছে।ছোটবেলা থেকে প্রতি ১৪ ফেব্রুয়ারীতে তিনি তার মা কে একটা গোলাপ ফুল দেন।তার বা গোলাপ নিয়ে হাসিমুখে বলতেন-গাধা এই দিনে কেউ মা কে গোলাপ দেয়?অন্য কাউকে পছন্দ হয় না তোর?আজিজ সাহেব তাকে জড়িয়ে ধরে বলতেন-মা,তুমি ই তো আমার পৃথিবী।আমি তোমাকে ছাড়া আর কাকে গোলাপ দেব বল?
আজিজ সাহেবের মা খুব কষ্টে চোখের পানি আটকাতেন।তার ধারনা তিনি জীবনে খুব বড় কোন পূন্য করেছেন।যার উপহার তিনি প্রতি বছর এই ভাবে পান।
*******
রংপুর থেকে ট্রেন এসে ষ্টেশনে থেমেছে।সাথে সাথে কোলাহল মাত্রা ছাড়িয়ে গেল।কুলিদের মধ্যে কর্মতৎপরতা বেড়ে গেল।কিছুক্ষন আগে যে কুলিটা আয়েশকরে কান খোচাচ্ছিল সেও এখন ব্যাস্ত হয়ে গেল।কান খুচিয়ে আরাম করার সময় শেষ।
আজিজ সাহেব উঠে দাড়ালেন।গোলাপফুল হাতে নিলেন।৫ টাকার গোলাপফুল আজকে কিনতে হয়েছে ৬০ টাকা দিয়ে।অথচ এই দিনে গোলাপ ফ্রী করে দেয়া উচিত ছিল যাতে সবাই তাদের ভালবাসা প্রকাশ করতে পারে।হতদরিদ্র রিকশা চালক তার স্ত্রী কে গোলাপ দিতে পারে।গোলাপ পেয়ে তার কিশোরী স্ত্রী রান্নাঘরে ঢুকে গোপনে চোখের পানি মুছবে।না জানি কত সুন্দর হবে সেই দৃশ্য।কিন্তু পরিতাপের বিষয় এটা হচ্ছে না।ভালবাসা প্রকাশ ধনীদের সম্পত্তিতে পরিনত হচ্ছে।গরিবদের ভালবাসা এবং হাহাকার বুকের মাঝে পাশাপাশি অবস্থান করছে।বের হয়ে আসতে পারছে না।
জোহরা বেগম ট্রেনের গেটে দাড়িয়ে আছেন।তার বয়স ৮০ বছরের কম হবে না।ভাল মত হিসাব করলে বেশী হ ওয়ার সম্ভাবনা আছে।তিনি ট্রেন থেকে নামতে পারছেন না।এ দিক ও দিক তাকাচ্ছেন।সবাই খুব ব্যাস্ত।কেউ তাকে সাহায্য করবে কি না কে জানে।
আজিজ সাহেব জোহরা বেগমকে দেখতে পেলেন।বুঝতে পারলেন তিনি ট্রেন থেকে নামতে পারছেন না।তিনি বিড় বিড় করতে করতে এগিয়ে গেলেন-মা এসেছে।মা এসেছে।
*******
কেবিনের পাশের এই যন্ত্রটার নাম কি?পিপ পিপ শব্দ করছে কেন?সমস্যা কি এর?হৃদপিন্ডের স্পন্দন কি সুচারুভাবে মেপে চলছে যন্ত্রটা।এর আবিষ্কারকের নাম কি?বাকা বাকা ঢেউ খেলানো দাগটা সোজা হয়ে গেলেই নাকি মা মরে যাবে।মরে যাওয়া এত সহজ?মা মরে গেলে ভাত তুলে খাওয়াবে কে?বৃষ্টিতে ভিজলে শারীর আচল দিয়ে মাথা মুছে দিতে দিতে বকা দিবে কে?হু?
আজিজ সাহেব তার মায়ের পাশে বসে আছেন।দাক্তার নার্স পাশে দাড়িয়ে আছেন।তাদের সবটুকু দিয়ে তারা চেষ্টা করছেন।আর যেন কিছুই করার নেই।মিরাকল ই তার মা কে বাচাতে পারে।অনেক মিরাকল ই তো জীবনে ঘটে।আর একটা মিরাকল যদি ঘটে ক্ষতি কি?পরম করুনাময় একবার করুনা করলে কি এমন ক্ষতি হবে?
-গাধা হাতে ফুল নিয়ে বসে আছিস কেনো?আমাকে দিবি?…কথাটা হাসিমুখে বলার চেষ্টা করলে শেষের দিকে আজিজ সাহেবের মা এর গলা ধরে যায়
-হু।
-দেরী করিস না খোকা।
আজিজ সাহেব প্রান্পন চেষ্টায় নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছেন।তিনি তার হাতের গোলাপটি তার মা এর হাতে ধরিয়ে দেন
তার মা কান্না জড়িত কন্ঠে বলে-এই দিনে কেউ মা কে গোলাপ দেয় গাধা?আর কাউকে পছন্দ হয় না তোর?
আজিজ সাহেব নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেন না।তার মাকে জরিয়ে ধরে ডুকরে ওঠেন-মা,তুমি ই তো আমার পৃথিবী।আমি আর কাকে গোলাপ দিব বলো?
********
আজিজ সাহেব জোহরা বেগমের হাত ধরে তাকে নামিয়ে দেন।
- এত দেরী করলে কেন মা?আমি কতক্ষন ধরে বসে আছি
- ট্রেন টা লেট করে ফেললো যে বাবা
-আচ্ছা বাদ দাও।শুভ ভালবাসা দিবস।তোমাকে অনেক ভালবাসি মা
আজিজ সাহেব জোহরা বেগমকে কদমবুসি করে সালাম করেন।জোহরা বেগমের দুনিয়া কাপিয়ে কান্না আসে।মূহূর্তের জন্য তার মনে হয় মৃত্যুর আগেই তার জান্নাত নসিব হয়ে গেছে।
প্লাটফর্মের মানুষগুলো ব্যাস্ত থাকে।তাদের চোখে এই অসাধারন দৃশ্য ধরা পরে না।এই দৃশ্য উপর থেকে হয়তো একজনের চোখ এড়ায় না যিনি এই স্বর্গীয় ভালবাসার স্রষ্টা।
*********
জোহরা বেগমের ডায়েরী- ছেলেটা হয়তো জানেই না যে আমি তার আসল মা নই।কি আশ্চর্য!মা এর জন্য নাকি পাগলোটা বিয়ে পর্যন্ত করে নি।খুব ইচ্ছা জাগে ওর মা এর সাথে দেখা করার।পরকালের মানুষদের সাথে দেখা করার ব্যাবস্থা থাকলে ভাল হত।
যে শ্রদ্ধায়,যে মমতায় সে প্রতিটা বছর ভালবাসা দিবসে তার জন্য গোলাপ হাতে রেল স্টেশনে দাড়িয়ে থাকে তাকে কিসের সাথে তুলোনা করা যায়?নাকি এটা অতুলনীয়।আমি জানি না সে জানুক আমি তার আসল মা নই।সে জানুক আমি ই তার আসল মা,সে আমার জন্য প্রতিটা ভালবাসা দিবসে গোলাপ হাতে অপেক্ষা করুক।আমি মরে গেলে সে খুজে পাক আরো কোন এক মা কে।ইশ্বর যেন কখনো এই ছেলেটাকে মাতৃ হারা না করে।কখনো না।কারন ভালবেসে যাওয়া এই মানুষগুলো খুব অল্প কষ্টে মরে যায়।এদেরকে মরে যেতে দিতে হয় না।এরা মরে গেলে পৃথিবীতে ভালবাসার নামে ভন্ডামির রাজত্ব কায়েম হয়ে যাবে।
কত মানুষ ই তো ভুল ধারনা নিয়ে বেচে থাকে।এই পাগল ছেলেটাও না হয় থাকবে।কি এমনটা ক্ষতি হবে?অন্তত সুখে তো থাকবে।বেচে তো থাকবে।
এক বৃদ্ধ তার মাকে ভালবাসার দিনে গোলাপ দিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে।এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কি হতে পারে?
জানি না কোন টানে প্রতি বছর ঢাকা যাই।জানতেও চাই না।তবু যদি কেউ প্রশ্ন করে উত্তর দিব-ভালবাসি তাই
(প্রজম্নের কবি থেকে পূর্বে প্রকাশিত)
©somewhere in net ltd.