নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ঘরহীন স্বরহীন

০৩ রা মে, ২০১৬ সকাল ৭:০৫

বিকাল থাকতে থাকতেই আসতে চেয়েছিলো বশীরউদ্দীন। কিন্তু পুরনো বন্ধু দুলালের আলিশান চোখ ধাঁধানো বাড়িতে নিজের একটু বসি একটু বসি গোছের গড়িমসি, ট্রাফিক জ্যামের বিড়ম্বনায় যখন গুলিস্তানে এসে নামলো বিকালের আলো তখন বিদায় নিয়েছে। ঘন সন্ধ্যার আগমনে আশেপাশে বুঝি একটু একটু বাতাস দিতে শুরু করেছে। সারাদিন গরমে বড্ড বিপর্যস্ত গিয়েছে বশীরউদ্দীনের। পাঞ্জাবীর দুইটা বোতাম সে খুলে দিলে তার ঘন লোমশ বুক কিঞ্চিত হালকা হয়ে উঠে।

ঢাকায় কি সে এই প্রথম এসেছে? আটচল্লিশ বছরের জীবনে এই নিয়ে কমপক্ষে হলেও ছিয়ানব্বই বারের মতো এখানে এসেছে। সে জানেনা এই সময়ে ঢাকায় কুত্তা পাগল গরম থাকে? সারা দুপুরে শহরের যেখানেই যাও দেখা যাবে নোংরা পানিতে আখের রস বানিয়ে বেয়াড়া ধরণের দেখতে চ্যাংড়া ছেলেপুলেরা তামাম মানুষের পকেট থেকে আখের রসের দাম হিসাবে দশ টাকা কেটে নিচ্ছে। আর মানুষদেরও দেখো, ভালো করে জানে পঁচা পানি দিয়ে বানানো আখের রস খেলে পেটের অসুখে ভুগতে হবে। তবুও গলা ভেজাতে সেই বিষেও মুখ দেবেই। বশীরউদ্দীনের ডানদিকের ভ্রু বিরক্তিতে কুঁচকে যায়। বেঁকে যাওয়া সেই ভ্রুতে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। পায়জামার পকেট থেকে ধবধবে সাদা রুমাল বের করে নিজের মুখমন্ডলের সমগ্রের উপর চালিয়ে দিলে বশীরউদ্দীনের নিজেকে কিছুটা হালকা বলে মনে হয়।

গুলিস্তানের খেলারসামগ্রীর দোকানগুলোর উপরে একবার চোখ রাখলে শিউরে উঠতে হয়। এতোবার ঢাকা এসেছে বশীরউদ্দীন তবুও যতোবারই এই স্থানে আসে সে শিউরে না উঠে পারেনা। সমগ্র রাস্তাজুড়ে কেবল মানুষ আর মানুষ। সারি সারি স্যান্ডেলের দোকান, দোকানীরা স্যান্ডেলগুলোকে শেষবারের মতো বিক্রয়ের জন্য প্রস্তুত করে নিতে তার তলায় শক্ত করে হাত দিয়ে বাড়ি দেয়। বিক্রেতাদের কেউ কেউ এই ভিড়ের মাঝে যতোটা আড়ালের আয়োজন করা যায় তার মাঝে বিক্রি হতে উন্মুখ জুতাগুলোর গন্ধ শোঁকে। দোকানগুলো পরস্পরের সাথে লাগোয়া। বিক্রেতাদের কেউ কেউ পাশের দোকানের সহকর্মীর দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসে কিংবা নিজেদের মাঝে রসিকতায় মত্ত থাকে। জুতার দোকানগুলো পেরিয়ে এলে কিছু নিকটে একটি ছোট তেহারীর দোকানের ভেতরটা দেখা যায়। দেয়ালের রঙ অনেকটাই জীর্ণ, বদ্ধ সেই ঘরের মাঝে সর্বসাকুল্যে মাত্র দুই কি তিনজন বেশ খানিকটা আড়াআড়ি করে বসতে পারে। দোকানের সদ্যই কৈশোরোত্তীর্ণ ছেলেটি গালে গজিয়ে উঠা নরম ঘাসের মতো কিছু নিরীহ দাঁড়ি চুলকাতে চুলকাতে বিরস মুখে তেহারীর প্লেট নিয়ে ক্রেতাদের সামনে এনে ধরে। সেই দোকান অতিক্রম করে সামনে এগুতে থাকলে শার্ট-প্যান্টের দোকানের সামনে বেশ বড়সড় একটি সমান্তরাল ভিড় দেখা যায়। এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে বাম হাতে ধরে থাকা একটি সাদা-কালো চেক শার্টের দরদামে ব্যাপৃত। এই শার্টের দাম কোনভাবেই তিনশো টাকার বেশী হতে পারেনা এই নিয়ে ক্লান্তিহীনভাবে বিক্রেতার সাথে কলহ করে চলেছে। দোকানগুলোর থেকে কিছু সামান্য দূরত্বে একের পর এক বাস এসে থামছে। স্টেডিয়ামে খেলা উপলক্ষ্যে সান্ধ্যকালীন ফ্লাডলাইট জ্বলে উঠেছে। কিছু সময় পরেই স্থানীয় ফুটবল লীগ শুরু হবে বলে স্টেডিয়ামে প্রবেশ করতে অপেক্ষারত দর্শকদের স্টেডিয়ামের নিচের চা-সিগারেটের দোকানগুলোর সামনে অস্থিরভাবে হাঁটাহাটি করতে দেখা যায়। ঢাকায় যতোবারই আসে বশীরউদ্দীনের কাছে দৃশ্যগুলো হাতের তালুর মতো চেনা। এই জায়গার প্রাত্যহিক চিত্র এমনই। তবু প্রতিবারই এই দৃশ্যের অংশ হলেই তার সমগ্র শরীরের শিরা-উপশিরা ফুলে উঠে।


আট বছর বয়সী পুত্রের জন্য ছোট সাইজের ক্রিকেট ব্যাট আর মেয়ের জন্য ফ্রক কিনে বশীরউদ্দীনের খেয়াল হয় যে তার চেক আপটা করানো দরকার। ধানমন্ডিতে পপুলার ডায়াগনোস্টিক সেন্টার আছে সেখানে নিজের চেক আপ করাবে। এর আগেও অনেকবার সে দেখেছে যে রাতেরবেলাতে সেখানে সার্ভিস ভালো দেয়। সারাদিনকার জমজমাট ভীড় পাতলা হতে আরম্ভ করে, সুন্দর বাতাস দেয়। এমনকি রোগীদের সাথে আচরণের সময়ে বড়লোক-ছোটলোকের বিভাজন বজায় রাখতে সচেষ্ট রুক্ষ কঠিন মেজাজের নার্স, দারোয়ানরা পর্যন্ত মাখোমাখো কন্ঠে কথা বলতে শুরু করে। ঢাকা শহরের রাতের আলোতে এরকম অমায়িক হয়ে যাওয়া দারোয়ানদের সাথে দুই চারটা খেজুরে আলাপ করেও সুখ। আজকাল আর কোথায়ই বা এরকম দেখা যায়?


কিন্তু স্টেডিয়ামের বিপরীত পার্শ্ব থেকে সায়েন্সল্যাবগামী বাসে উঠে বশীরউদ্দীনের যাবতীয় আনন্দ ভোজবাজির মতো উবে যায়। বাম থেকে তৃতীয় রো এর জানালার পাশের সিটটা খালি আছে। সেখানে বসতে গিয়ে ব্যাগে পুত্রসন্তানের ক্রিকেট ব্যাটখানার অনিচ্ছাকৃত আঘাতে পাশের সিটে বসে থাকা অল্পবয়স্ক ছেলেটির কনুই কিঞ্চিত বিপর্যস্ত হলে সে বশীরউদ্দীনের দিকে রাগত চোখে তাকায়। গতোপরশু বশীরউদ্দীন মনস্থির করেছিলো চেক আপের জন্য ঢাকায় আসবে। আসলে তারই দুর্ভাগ্য। নয়তো এই খবর শুনেই পুত্র রুম্মান আর কন্যা রাজিয়া নিজেদের আকাঙ্খা পূরণের জন্য বাপের কাছে মরাকান্না জুড়ে দেবে কেন? সেই ছয় মাস আগে থেকে ছেলেটা একটা ক্রিকেট ব্যাটের জন্য ঘ্যানঘ্যান করেই যাচ্ছে। তা একটা ক্রিকেট ব্যাট কি মাঈজদীতে পাওয়া যায়না? বশীরউদ্দীন তো কতোই দেখে প্রতিদিন। কিন্তু না, ক্রিকেট ব্যাট আনতে হবে শুধু তাই না ঢাকা থেকেই আনতে হবে। তার কন্যাটিও হয়েছে সেরকম অনুদার। ছোট ভাইয়ের ইচ্ছা পূরণ করবে বাপে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে দেখে সেও বায়না জুড়ে দিলো। কি তার চাওয়া? ঢাকা থেকে একটা ফ্রক কিনে দিতে হবে। ধবধবে সাদা রঙের। একেই বলে ভাগ্য। বশীরউদ্দীন অন্য কোন যুৎসই শব্দ খুঁজে পায়না। খুঁজে দেখবার চেষ্টাও করেনা। ভাগ্য নয়তো কি? তার বদনসিব বলেই তো শ্রীনাথে আঠারো বছর ধরে কাজ করার পরেও মেয়ের জন্য ফ্রক কিনতে হয় ঢাকা শহর থেকে। মাঈজদীর বিখ্যাত কাপড়ের দোকান শ্রীনাথের নাম শোনেনি এমন লোক সমগ্র নোয়াখালীতে খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সেই নিয়ে বশীরউদ্দীন ঘোরতরভাবে সন্দিহান। সেখানে কিনা তারই ছেলেমেয়েদের জন্য জামাকাপড় কিনতে হয় সুদূর ঢাকা থেকে! কপাল চাপড়াতে বশীরউদ্দীন ডান হাত উঠাতে গেলে পুনরায় পাশের চ্যাংড়া দেখতে ছেলেটার শরীরের সাথে তার বেশ অস্বস্তিকর একটা সংঘর্ষ হয়। এবারে দুঃখিত বলেও সহজে পার পাওয়া যায়না। বশীরউদ্দীন এবার লক্ষ্য করে ছেলেটার চুল ঘাড় পর্যন্ত, পরনের প্যান্টটা জবরজং রঙা, গালে না কামানো মৃদু আকৃতির দাঁড়ি, শক্ত চোয়ালের চাহনী তীক্ষ্ণভাবে বশীরউদ্দীনের লম্বা দাঁড়ির দিকে নিবিষ্ট। বশীরউদ্দীন শঙ্কিত হয়ে উঠে। বিষয়টা কি?


বিষয়টা কি সেটা জানা গেলো কিছুক্ষণ পরেই। জিপিও থেকে দুইজন চাকুরীরত অল্পবয়স্ক ছেলে বাসে উঠেই রাজনৈতিক বিষয়ে আলাপ শুরু করলে জানা গেলো আজকে দুপুরে তেজগাঁয় একজনকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। নিহতজন ইন্টারনেটে লেখালেখি করতো। ওই কি জানি বলে, বশীরউদ্দীনকে বেশী সময়ের জন্য শব্দটি মনে করতে হয়না। হ্যা মনে পড়েছে, ব্লগার। এই নিয়ে গতো ছয় মাসে পাঁচজন ব্লগারকে কুপিয়ে হত্যা করা হলো। আনসারউল্লাহ বাংলা টিম দুপুরে হত্যা করে বিকালেই খুনের দায় স্বীকার করে একটি বার্তা পাঠিয়েছে। বশীরউদ্দীন সংশ্লিষ্ট দলটির নাম শুনেছে। মাঈজদী টাউনে না হলেও গ্রামের দিকে দলটির নাম ছড়িয়েছে বছর কয়েক হলো। রাজনীতিতে বশীরউদ্দীনের আগ্রহ বরাবরই কম। তাই স্রেফ নাম শোনাটুকু পর্যন্তই। এর বেশী কোন জানাশোনা তার গড়ে উঠেনি। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে সে ভালো বিপদে পড়তে পারে। দেশের অবস্থা এমনিতেই ভালো না। একবার করে ব্লগারদের কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তারপরে পুলিশ সারাদেশে ধরপাকড় শুরু করে। তাও সেই ধরার যদি কোন ছিরিছেদ আছে। মুখে লম্বা দাঁড়ি দেখলেই পুলিশ আর যাচাই করার বিশেষ কোন প্রয়োজন অনুভব করেনা। ব্যাস ঢুকিয়ে দাও জেলের ভিতরে। কপাল ভালো থাকলে তিন কি চার হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে বের হওয়া যায়। নয়তো জেলের মধ্যেই দিনের পর দিন পঁচে মরতে হয়। পুলিশ প্রশাসনের এই পরিশ্রমের পরেও কুপিয়ে হত্যার কোন শেষ হয়না। একটার পর আরেকটা হতেই থাকে। দুশ্চিন্তায় বশীরউদ্দীনের চোখ ছোট হয়ে আসে, নাকের পাশে বিনবিনে ঘাম জমে উঠতে থাকে। দিনকাল খুবই খারাপ। তার মুখে এমনিতেই ঘন লম্বা দাঁড়ি, তার উপরে আজকে পরেছেও পাঞ্জাবী। তার বউ ফাতেমা ঢাকায় আসবার আগে একবার তাকে মৃদুভাবে বলেছিলো যেন চলাফেরায় সাবধানতা অবলম্বন করে। বিশেষত স্বামীর মুখের লম্বা দাঁড়ির কথা ভেবে তাকে পাঞ্জাবী পরতে নিষেধ করেছিলো দেশের অবস্থার কথা ভেবে। তা মেয়েমানুষের কথা মতো চলাটা বশীরউদ্দীনের খানদানের দস্তুর নাকি? কোনকালেই হতে পারেনা। সে এখনো স্মরণ করতে পারে একবার তার মা কি জানি বাপের কোন আত্মীয়কে নিয়ে কি একটা হালকা রসিকতা করেছিলো সাথে সাথে নিজের স্ত্রীর পিঠের উপরে তার বাপের হাতপাখার বাড়ি। লোকটার হাতের নাগালেই ছিলো। সাথে সাথে বসিয়ে দিয়েছিলো। ঘন্টা দুয়েক ধরে কান্নাকাটি করার পরে তার মা একেবারে ঠিক। পাটিতে নিজের স্বামীর সাথে একত্রে বসে আরাম করে পালংশাক, আলু, ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে দিব্যি ঘুমাতে গিয়েছিলো। বশীরউদ্দীনের বাপও সেই দিন স্ত্রীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করবার কোন যুক্তিই খুঁজে পায়নি। এই পরিবারে জন্মে সে চলবে মেয়েমানুষের কথায়? পাঞ্জাবী না পরার অনুরোধে স্ত্রীর প্রতি সে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলো। তার ইচ্ছা করেছিলো নিজের বাপের মতোই হাতপাখা দিয়ে স্ত্রীর পিঠে কয়েক ঘা বসিয়ে দেয়। কিন্তু সেই দিন তো আর নেই। এখন পান থেকে চুন খসলেই মেয়েমানুষ আইন, থানা, পুলিশ করার জন্য ড্যাং ড্যাং করে অবলীলায় ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। এই যে ছেলেমেয়েগুলা তার এরকম বেয়াড়া হয়ে উঠেছে, ঢাকা থেকে তাদের জন্য জামাকাপড়, ক্রিকেট ব্যাট কিনে আনতেই হবে এমন বাধ্যবোধকতা বাপের উপরে আরোপ করেছে এর পেছনেও কি তাদের মায়ের হাত নেই? আলবৎ আছে। ছেলেমেয়েগুলাকে খালি আদর দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছে। আদবকায়দা, আল্লাহখোদার ভয় এসবের কিছুই শেখায়নি। বিয়ের পর থেকেই বশীরউদ্দীন দেখে আসছে তার স্ত্রী একটু ত্যাড়া টাইপের। সহজে পোষ মানতে চায়না। সরাসরি কখনোই স্বামীর মুখের উপরে তর্ক করেনা কিন্তু আবার ঠিক তাকে মানেও না। নিজের মতানুযায়ীই চলতে চেষ্টা করে। কিন্তু জীবনে এই প্রথম নিজের স্ত্রীর কথা না শুনবার কারনে বশীরউদ্দীনের ইচ্ছা করে নিজের মাথার সামান্য কিছু চুল যা অবশিষ্ট আছে সেগুলাও ছিঁড়ে ফেলে। নিজের উপরে রাগ স্তিমিত হয়ে এলে আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের উপরে তার ক্রোধ জাগ্রত হয়। আরে হারামজাদারা, কুপিয়ে মানুষ মারবি তো সময় বুঝে মারতে পারিস। কয়েকদিন পরপরই একটা করে এভাবে খুন করলে তোদের বাঁচাবে কে রে শুয়োরের বাচ্চা? মাঝখান দিয়ে তার মতো রাজনীতির সাতে পাঁচে নাই কিন্তু মুখে লম্বা দাঁড়ি আছে এমন মানুষদের জান বেরিয়ে যাবার উপক্রম হবে। খোদা না খাস্তা যদি আজকে ঢাকাতেই তার ভালোমন্দ কিছু একটা ঘটে, যদি তাকে পুলিশ খুনের সন্দেহভাজন মনে করে জেলে আটকে নিয়ে প্যাদানী দেয় তবে তার পরিবারের দায়িত্ব কারা নেবে? নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবর বলে চাপাতি দিয়ে শরীর থেকে কল্লা আলাদা করা বাহিনী? বশীরউদ্দীন রাজনীতির প্যাচঘোচ বিশেষ একটা না বুঝলেও এটুকু ঠিকই বুঝে যে কেউই কারো দায়িত্ব নেয়না। আজকে তাকে খুনের মিথ্যা দায়ে জেলে পঁচে মরতে হলে তার পোষ না মানা জেদী বউ, দুইটা দুধের বাচ্চার দিকে কেউ মুখ ফিরেও চাইবেনা। বশীরউদ্দীন মানুষ চেনেনা? চারপাশ চেনেনা? বিলক্ষণ চেনে।


সায়েন্সল্যাবের ফুটওভার ব্রিজ়ের সামনে বাস চলে আসতে আসতে বশীরউদ্দীনের অনেকটাই অসাড় অবস্থা। মানসিক এবং শারীরিক উভয় দিক থেকেই। বাস থেকে যন্ত্রের মতো সে সাবধানে পা ফেলে। আগে বাম পা দিয়ে নামলেও নিজের শরীরের টাল সামলাতে তাকে হিমশিম খেতে হয়। ফুটওভার ব্রিজে উঠতে উঠতে বশীরউদ্দীন চারিদিকে এক জোড়া উদ্বিগ্ন চোখ দিয়ে তাকিয়ে দেখে। খালি মানুষ আর মানুষ। হাঁটতে গিয়ে একে অপরের সাথে মুহূর্মুহ ধাক্কা খাচ্ছে কিন্তু কোন হোলদোল নেই। অবিরাম চলতে থাকা রিকশাগুলো নিয়মিতই একটার সাথে আরেকটা লাগিয়ে দিয়ে পরস্পরের সাথে কলহে মেতে উঠছে। নীলক্ষেতগামী বাসগুলো থেকে কিছু যাত্রী অত্যন্ত সন্তর্পণে সায়েন্সল্যাবের সামনে নেমে গিয়ে বিপুল জনরাশির মাঝে নামহীন পরিচয়হীন নাগরিকদের মধ্যে মিশে যাচ্ছে। পাঞ্জাবীর দোকানগুলোতে মানুষজন সফেদ রঙের পাঞ্জাবীগুলোর উপরে নিজেদের হাত বুলাচ্ছে। একেবারে উল্টাদিকে পুলিশ ফাঁড়ির পাশে থাকা গিটারের দোকানগুলোর একটি থেকে অল্পবয়সী কিছু ছেলেপেলেকে গিটারের দাম নিয়ে অসন্তোষ জানাতে জানাতে বের হতে দেখা গেলো। বশীরউদ্দীন ফুটওভার ব্রিজের মধ্যখানে পৌঁছে একটু থামে। নিঃশ্বাস নেয়। চোখ একেবারে সামনে চলে গেলে গ্রীন রোডের ল্যাব এইড হাসপাতালের লাল-সবুজ রঙের জ্বলজ্বল করতে থাকা সাইনবোর্ড দেখে। হাসপাতালটায় গিয়েছে বশীরউদ্দীন। বেশ ভালো পরিবেশ। রোগীদের আত্মীয়স্বজনেরা যেই বড় ঘরটায় বসে সেখানে টেলিভিশন আছে। পরিবার-পরিজনের কাউকে নিয়ে হাসপাতালে যাবার সময়তে মাথা ঠান্ডা রাখা দরকার সবচেয়ে বেশী। টেলিভিশন দেখে সময় পার করতে পারলে দুশ্চিন্তা কিছুটা হলেও তো লাঘব হয়। বশীরউদ্দীন অবশিষ্ট পথটুকু অতিক্রম করতে অগ্রসর হয়। বিপরীত দিক থেকে এক জোড়া যুগল সায়েন্স ল্যাবের পথে নেমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে হেঁটে আসছিলো। বশীরউদ্দীনের কাছাকাছি চলে আসলে তাকে চমকে দিয়ে সেই যুগল নিজেরা চমকে উঠে। সে স্পষ্টতই দৃশ্যটা দেখে। “আমার নাম বশীরউদ্দীন, আমি মাঈজদীতে কাপড়ের দোকানে কাজ করি, আমার দিকে আপনারা এমনে তাকাইয়েন না” কথাগুলা সে ভীত যুগলের দিকে তাকিয়ে উচ্চারণ করে। কিন্তু পুরোটাই মনে মনে। বাসে বসে থাকবার সময়ে শেষের দিকে আজ দুপুরে তেজঁগায় খুন হওয়া ব্লগারের রক্তাক্ত শরীরের কথা কল্পনা করে সে আতঙ্কিত হয়েছিলো। শৈশব থেকেই রক্তপাত সে বড্ড ভয় পায়। কিন্তু মুখোমুখি আগত যুগলের ভীত আতঙ্কিত মুখ তার মস্তিষ্ক অনেকটুকুই দখল করে নিতে শুরু করলে কুপিয়ে হত্যা এবং সেই রক্তাক্ত শরীরের কথা কল্পনা করে শিউরে উঠা কোনটাই আর তার মনে বিশেষ গুরুত্ব পায়না। বশীরউদ্দীন ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে দ্রুতগতিতে পা চালিয়ে নিচে নেমে যায়। রসুই নামক রেস্টুরেন্টে তেলে খাবার ভাজার ঝাঁঝালো তীক্ষ্ণ শব্দ শোনা যায়। বাসস্টপে দাঁড়িয়ে প্রত্যাশিত বাসের জন্য অপেক্ষারত কিছু যাত্রী বীতশ্রদ্ধ ভঙ্গিতে সিগারেট টানে আর দেশের সামগ্রিক পরিবহণ ব্যবস্থা নিয়ে ধারাবাহিক শাপশাপান্ত করে নিজেদের হালকা রাখতে সচেষ্ট হয়। বশীরউদ্দীন রসুই অতিক্রম করে সিটি ব্যাঙ্ক এবং এবি ব্যাঙ্ক অতিক্রম করে যায়। তারপর স্থির দাঁড়ানো রিকশাগুলোর সাথে নিজের সম্ভাব্য সংঘর্ষ বাঁচিয়ে পপুলার ডায়গ্নোস্টিক সেন্টারে প্রবেশ করে। তার দিকে দারোয়ানের চোখ পড়তেই কিছুক্ষণ আগে পরিচিত হওয়া সেই একই চাহনীর সাথে পুনরায় বশীরউদ্দীনের পরিচয় ঘটে। “আমার নাম বশীরউদ্দীন, মাঈজদীতে কাপড়ের দোকান শ্রীনাথে আমার কথা জিগাইয়েন, সবাই চিনবো।” বশীরউদ্দীনের কন্ঠ দিয়ে কথাগুলো বেরিয়ে আসতে প্রাণপণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। আলোকজ্জ্বল হাসপাতালে তার চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে আসে। দারোয়ানের থেকে মনোযোগ ফিরিয়ে বশীরউদ্দীন টেলিভিশনের দিকে তাকাতে তাকাতে পাঞ্জাবীর সর্বশেষ বোতামটিও খুলে দিলে নিজের লোমরাজির উপরে হাত বুলাতে বুলাতে সে এখানে আসবার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিস্মৃত হয়ে পড়ে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.