নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বেস্ত সময়ের ফাঁকে যারা আমার ব্লগ পরেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ
লালন ফকির
দু'হাজার চার সালে বিবিসি বাংলা একটি 'শ্রোতা জরিপ'-এর আয়োজন করে। বিবিসি বাংলার সেই জরিপে,শ্রোতাদের মনোনীত শীর্ষ কুড়িজন বাঙালির তালিকায় বারো তমো স্থানে আসেন লালন ফকির । লালন ফকির, যিনি লালন শাহ বা লালন সাঁই ফকির পরিচিত। লালন ফকির ছিলেন একাধারে একজন আধ্যাত্মিক বাউল সাধক, সমাজ সংস্কারক ও দার্শনিক। লালন ফকিরকে "বাউল-সম্রাট" বা "বাউল গুরু" হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। তাঁর গানের মাধ্যমেই উনিশ শতকে বাউল গান বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বাউল গানের উদ্ভবের ইতিহাস আগের হলেও এর হদিশ খুব একটা মেলেনি। সেদিক দিয়ে লালন -ফকিরকেই বলা যায় প্রথম ও প্রধান বাউল পদকর্তা।
বাউল মতের আবির্ভাব ও সময়কাল
বাউল-ধর্ম একটি সমন্বয়মূলক ধর্ম। এতে শিবশক্তিবাদ, রাধাকৃষ্ণবাদ, বৈষ্ণব সহজিয়া তত্ত,সুফি-দর্শন ,গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম ও তত্ত এর সঙ্গে আরও কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য যুক্ত হয়ে এ ধর্মমত তৈরি হয়েছে। পালবংশের রাজত্বকালে বাংলায় বৌদ্ধধর্ম বিশেষ ব্যাপ্তি লাভ করে ।আস্তে আস্তে তা বাংলার অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তরের মানুষের প্রাণে ঢেউ তোলে এবং তারই ফলে বৌদ্ধ সহজধর্ম অধিক বিস্তৃতি লাভ করে । তবে সেনদের রাজত্বকালে বৈষ্ণব ধর্মের প্রসার ঘটে ।কেননা সেনরা বৈষ্ণব মতালম্বী ছিলেন। হিন্দুদের শিবশক্তিবাদ পালযুগে বৌদ্ধদের প্রজ্ঞা-উপায়বাদের সহিত মিশে প্রকৃতি-পুরুষ রূপে রাধা-কৃষ্ণের কথা আসল ।বৌদ্ধ ও বৈষ্ণবদের সম্প্রদায়গত তেমন কোন বড় ধরনের পার্থক্য না থাকায়, সাধারণ মানুষ বৌদ্ধ সহজিয়া হতে বৈষ্ণব সহজিয়াতে পরিবর্তিত হতে লাগলো । এ বৈষ্ণব সহজ-সাধনা চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পর নতুনরূপে প্রকাশিত হতে থাকে ।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ হতে বাংলায় মুসলমান রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে । স্বভাবতই বিজয়ীরা বিজিতদের ওপর ধমীয় প্রভাবও বিস্তার করল । ফলে রাজধর্ম হিসেবে ইসলামের প্রসার ব্যাপকভাবে ঘটতে লাগল । কেননা সেনরা তাদের রাজত্বকালে যে কৌলিন্যপ্রথার সৃষ্টি করেছিলো তা দেশের সাধারণ মানুষ গ্রহণ করতে পারেনি, বর্ণ-বৈষম্যকে যেমন গ্রহণ করতে পারেনি, তেমনি অর্ধ ব্রাম্মনদের জীবনবাদকেও। ব্রাহ্মণবাদের কঠোরতম অধ্যাদেশে সাধারণ মানুষ শুদ্ব অস্পৃশ্যগণ বরাবরই দুর্বল-অসহায় ও অবহেলিত হয়ে পড়েছিল । তাই ইসলামের ঐশর্য ও সাম্যের বাণী এসব অবহেলিত সাধারণ মানুষদের পরম শান্তির পথ দেখালো ।এসব অসহায় মানুষ বিনা দ্বিধায় ইসলামের পতাকাতলে সমর্পিত হলেন।
অবশ্য খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দী হতে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে বহু আরবীয় সাধু ও ধর্ম-প্রাণ ব্যক্তি ইসলাম প্রসারের জন্য এ উপমহাদেশে আসেন । এমনকি আরবীয় বণিকরাও ,বাণিজ্যের ব্যপদেশে পূর্ব-পাকিস্তানে সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে লাগলেন ।মধ্যযুগে বাংলাদেশে আগত বিভিন্ন তরিকার সুফিদের মধ্যে পীর-প্রথার উৎপত্তি দেখা যায়; তারই সমান্তরাল ধারায় ক্রমে ফকিরি মতের উদ্ভব ঘটে ।আবার চৈতন্য দেবের সময় বৈষ্ণব ধর্মে যোগ হয় আবেগ দীপ্ত প্রেম। তার মৃত্যুর পর আনুমানিক ষোলোশো পচিশ শ্বীস্টাব্দের দিকে বাউল সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে।এভাবেই মুসলমান ফকির ও হিন্দু বাউলেরা স্ব-স্ব অবস্থানে থেকে নির্দিষ্ট আস্তানা কিংবা আখড়াতে মিলিত হয়ে তাদের ধর্মের নিগুঢ় তত্ত-সংকেত গানে গানে ব্যক্ত করত। গানই ছিল তাদের প্রধান অবলম্বন। সে হিসেবে বাউলধর্মের আবির্ভাবকাল সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ হতে আরম্ভ করে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত এর সৃষ্টি এবং ব্যাপ্তিকাল। অপরদিকে কাল-পরিক্রমায় উনিশ শতকে লালন ফকিরের হাতেই তা পূর্ণরূপ লাভ করে ।
লালন ফকির এর গানের বৈশিষ্ট্য
লালনের গানের একটি ভিন্ন ধর্মী প্রকৃতি বা স্বভাবগত বৈশিষ্ট রয়েছে। লালনের গানে সুবিন্যাস্ত যে বিন্যাস রয়েছে তা অন্যান্য বাউল গানে একেবারে বিরল। গানগুলো তার নিজস্ব গঠন শৈলীর নিপুণতায় অনন্য। সহজ -সরল ভাষায় শব্দ ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে তিনি ত্বত্বের গভীরে পৌছাতেন ,অন্যদিকে গভীর তত্ব -কথাকে রঙ্গ রোষের আবরণে সহজেই পরিবেশন করতেন। লালনের অসংখ্য গানের মধ্যে এমন একটি শব্দও খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য যা যথাযোথ এবং সুপ্রযুক্ত নয়। এমন একটি চরণও অনুপস্থিত যার বিন্যাস কোন প্রশ্ন উত্থাপন করে। শুধু ভাষার দিক দিয়ে নয় লালন গানের শুর ও সংগীত রীতি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে বিশেষত্ব ব্যাঞ্জক। লালনের গানের এমন এক অসাধারণ বৈশিষ্ট রয়েছে যে এক বার শুনলে বা এক নজর দেখলেই তাকে চেনা যায়।
লালন সহস্রাধিক গান রচনা করেছেন বলে ধারণা করা হয়। লালন ফকির মুখে মুখে গান রচনা এবং সুর করে পরিবেশন করতেন তবে তিনি নিজে তা লিপিবদ্ধ করতেন না। তার শিষ্যরা গান মনে রাখতো আর পরবর্তীকালে ফকির মানিক ও মনিরুদ্দিন শাহ্ সেই বাঁধা গান লিখে নিতেন। আর এতে করে তার অনেক গানই লিপিবদ্ধ করা হয় নি বলে ধারণা করা হয়। লালনের জীবদ্দশাতেই তাঁর গান বহুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো।লালনের গানের যে ধারা, তাতে এখানে আত্মতত্ত্ব ,দেহত্বতো ,গুরুত্ব্বত , পরমতত্ব ,প্রেম ও ভক্তি ,সাধনতত্ব কে উন্মোচন করা হয়েছে। এ ধরণের হেঁয়ালিপূর্ণ গান লেখা হোত গুরুর দ্বারা শিষ্যদেরকে বিভিন্ন তত্ত্বজ্ঞান শেখানোর জন্যে। এই সব গানের ছিল দ্বৈত স্তর। উপর উপর তা ভক্তিমূলক বা প্রেমের গান। কিন্তু অন্তঃসলিলে প্রবাহমান লুকোনো অর্থ যা সাধারণ বোধ্য নয়।বিভিন্ন রূপক শব্দ প্রয়োগ করে এটি রচিত। বাউল সাধনার শীর্ষস্তরে না গিয়ে কারো পক্ষে এই গানে কি বলার চেষ্টা করা হয়েছে তা উদ্ঘাটন করা সম্ভব- না। কেও কেও যে চেষ্টা করেন না তা কিন্তু নয়। কিন্তু তা জটিল রহস্যময় তাৎপর্য কতটুকু স্পর্শ করতে পারে তা কেবল প্রকৃত বাউলগণই বলতে পারবেন। কিন্তু এখানেও প্রতিবন্ধকতা আছে, কেননা প্রকৃত বাউল হলে তার কর্তৃক নিগূঢ় তত্ত্ব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষন পূর্বক বিতরণ করা সম্ভব না। কারণ বাউলগণ বলে থাকেন “আপন সাধনার কথা, না বলিও যথা তথা”।
লালন ফকির এর দর্শন ও তত্ত্বজ্ঞান যদি ভালোভাবে বুঝতে চাই, তবে অবশ্যই লালন এর যাপিত জীবন সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে। জানতে হবে ,আসলে তিনি কী রকম সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া বা কী রূপ ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করেছেন। নিজের জীবনকাহিনীটা না বলার ব্যাপারে লালন ফকিরের দিক থেকে একটা সচেতন প্রয়াস যেন ছিল। ওঁর জীবন সম্পর্কে বিশদ ভাবে জানার ব্যাপারে উনি নিজেই যেন কিছুটা ধোঁয়াশা ছড়িয়ে রেখেছেন! ফলে ,যেটুকু যা জানা যায় তা যতটা না তথ্যনির্ভর তার চেয়ে বেশি কল্পকাহিনীতে ভরা। সেটা সত্যি মিথ্যার কষ্টি-পাথরে মেপে আনা খুবই দুঃসাধ্য। তার মৃত্যুর পনেরো দিন পর কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত হিতকরী পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, “ইহার জীবনী লিখিবার কোন উপকরণ পাওয়া কঠিন। নিজে কিছু বলিতেন না। শিষ্যরা তাঁহার নিষেধক্রমে বা অজ্ঞতাবশত কিছুই বলিতে পারে না ,ফলে কেবল গানগুলোর মধ্য দিয়েই, মানুষটিকে ও তাঁর ব্যক্তিসত্ত্বাকে, আমাদেরকে বুঝে নিতে হচ্ছে।
লালন ফকিরের জীবন কাহিনী
লালনের জন্ম কোথায় তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। লালন জীবিত অবস্থায় কারো কাছে তাঁর জন্ম সম্পর্কে কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি। এমনকি তাঁর গানের মধ্যেও তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। কোনো কোনো লালন গবেষক মনে করেন ,লালন কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার চাপড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত ভাড়ারা গ্রামে জন্মেছিলেন। এই মতের সাথে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেন। এর পিছনে তাদের যুক্তি ,ছেঁউড়িয়া থেকে ভাড়ারা গ্রামের দূরত্ব মাত্র কয়েক কিলোমিটার অথচ তাঁর দীর্ঘ জীবদ্দশায় তাকে তার কোনো আত্মীয়-স্বজন কিংবা পরিচিতজন এর সাথে দেখা যায় নাই। তা কি করে সম্ভব ? আবার মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় এক প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয় “লালনের জন্ম যশোর জেলার ফুলবাড়ী গ্রামের মুসলিম পরিবারে”। অন্যদিকে পাজুশাহের ছেলে খোন্দকার রফিউদ্দিন তাঁর ভাবসংগীত নামক গ্রন্থে ফকির লালনের জন্মবৃত্তান্ত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন – ফকির লালন শাহের জন্মভূমি যে যশোর জেলার হরিণাকুন্ডু থানার অধীন হরিশপুর গ্রামেই ছিলো, ইহাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এ বিষয়েও যথেষ্ট মতের পার্থক্য লক্ষ করা যায়। যারা জাতিগতভাবে লালনকে মুসলমান ভাবতে আগ্রহ প্রকাশ করেন তাদের কাছে লালনের জন্মভূমি হরিশপুর বেশি প্রাধান্য পায়। এ বিষয়ে নিরপেক্ষ গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। লালন অবশ্য তার গানে হিন্দু মুসলমান ঐতিহ্য সমানভাবে দক্ষতার সাথে ব্যবহার করেছেন। সুতরাং হিন্দু ধর্মের কথা বলতে গিয়ে লালন হিন্দু ঘরের সন্তান হবেন আর মুসলমানের কথা বলতে গিয়ে মুসলমান হবেন এ ধারণার ভিত্তি নেই।
লালন ফকিরের জীবনের যে ‘টার্নিং পয়েন্ট’ তার মূলে আছে গুটি বসন্ত নামের ভয়ংকর রোগটি। বসন্ত রোগ দুই ধরনের , একটির নাম গুটি বসন্ত, অন্যটির নাম জল বসন্ত। কয়েক শ বছর ধরে গুটি বসন্ত ছিল পুরো পৃথিবীর মানুষের কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। কলেরায় যেমন গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে গেছে একসময়, গুটি বসন্তও তাই করেছে, স্রেফ গায়েব করে ফেলেছে জনপদের পর জনপদ। গুটিবসন্ত থেকে যাঁরা বেঁচে গেছেন, তাঁরা সারা জীবন তার চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন নিজেদের শরীরে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অন্ধত্ব, পঙ্গুত্ব এবং পুরো শরীরে বিশেষ করে মুখে ছোট ছোট গর্তের মতো দাগ । লালনের জন্মসাল ,জন্মস্থান , শৈশব ও জাত নিয়ে মতভেদ থাকলেও তিনি যে গুটি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন ও বসন্ত রোগে একটি চোখ হারান তা সবাই স্বীকার করেছেন। তবে ঠিক কবে, কোন বয়সে, কত সালে গুটি বসন্তের কবলে পড়েছিলেন, সেটি সঠিকভাবে উল্লেখ করা দুরূহ। এ বিষয়ে তাঁর জীবনীকারদের মধ্যেই রয়েছে মতদ্বৈততা ।
লালন ফকির তরুণ বয়সে আত্মীয় স্বজন, সঙ্গী সাথী কিংবা পাড়া প্রতিবেশীর সাথে তীর্থ ভ্রমণে যান। যাওয়ার সময় কিংবা ফেরার সময় তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। তখনকার সময় এ রোগ মহামারী আকারে হচ্ছিলো এবং ব্যাপকভাবে ছোয়াচে ছিলো।অবস্থা খারাপ হলে লালন তার সাথের লোকদের দ্বারা পরিত্যাক্ত হন।মৃত্যু অনিবার্য ভেবে তাকে নদীতে ভেলায় করে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। কালিগঙ্গা নদীতে ভেসে আসা মুমূর্ষু লালনকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করেন ছেউড়িয়া গ্রামের মলম কারিকর ও তার স্ত্রী মতিজান। তারা তাকে বাড়িতে নিয়ে সেবা-শুশ্রষা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। আরোগ্য লাভের পর তিনি নিজগৃহে ফিরে যান ঠিকই কিন্তু মুসলমান গৃহে অন্নজল গ্রহণ করায় এবং তার নিজ গৃহে পরলৌকিক ক্রিয়া ইতিমধ্যে সম্পন্ন হওয়ার কারণে সমাজ সংসার কর্তৃক তিনি বিতাড়িত হলেন। শাস্রিয় বিধানের প্রতি অপরিসীম আনুগত্বের ফলে নিজ আত্মীয় স্বজন ও তাকে চিরতরে পরিত্যাগ করে। ফলে লালনের জাতি , ধর্ম , গোত্র, সমাজ ও সংসার সমন্ধে এক বিরাট বৈরাগ্যভাবের উদয় হয়। তিনি শেষ পর্যন্ত তার আশ্রয়দাতার কাছেই ফিরে আসেন। যাই হোক তীর্থভ্রমণের ঘটনাই তার জীবনের বাক পরিবর্তনে যে সুদূর ভূমিকা রেখেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই ঘটনাই তাকে আজকের লালন ফকিরে পরিণত করেছে।
ছেঁউড়িয়া গ্রামের মওলানা মলম কারিকর ছোট বেলাতেই ইসলামী ভাবধারায় মনোযোগী হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তিনি কুষ্টিয়ার একটি প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা থেকে কোরানে হাফেজ ও মৌলানা পাশ করেন। হাফেজ মলম নিজে সুশিক্ষিত ছিলেন। বিনয় এবং মার্জিত ব্যবহারের কারণে সকলে তাঁকে শ্রদ্ধা করতো। তাঁর এই সুনাম ছড়িয়ে পড়ে ছেঁউড়িয়ার আশেপাশের গ্রামে। তাঁর পিতা মুন্সি খায়রুল্লাহ্। মলম বাইশ বছর বয়সে গড়াই নদীর ওপাড়ের কয়া গ্রামের এক তন্তুবায়ী ধার্মিক পরিবারের বারো বছরের সুদর্শনা কন্যা মতিজানকে বিবাহ করেন। রুচিশীলা এই রমনী সবকিছু গুছিয়ে রাখতেন। মিষ্টি সুরে কোরান পাঠ করতেন। ভারী সুন্দর ছিলো তাদের ঘর দোর সংসার। এতো কিছুর পরও তাদের দু’জনের ভিতর ছিলো সন্তানহীন এক শূন্যতা। সন্তানের কামনায় পার হয়ে গেলো একযুগেরও বেশী সময়।মুন্সি খায়রুল্লাহ্র চার পুত্র মলম, আলম, কলম ও তিলম কারিকর। আলম কারিকর ছাড়া মলমের মতোই অপর দুইভাই কলম ও তিলম নিঃসন্তান ছিলেন। লালনের প্রতি অপরিসীম ভক্তি ও অনুরাগে অনুপ্রাণিত হয়ে এক সময় মলম ও মতিজান লালনের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে। মলম কারিকর থেকে হয়ে যান ফকির মলম শাহ্ অন্যদিকে মতিজান হয়ে যান মতিজান ফকিরানী। ফকির মলম শাহ্ ছিলেন সর্বাপেক্ষা বয়োজৈষ্ঠ শিষ্য। মলমের অপর দুইভাই কলম ও তিলম সস্ত্রীক পর্যায়ক্রমে লালনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
লালন আখরা
আরোগ্য লাভের পর নিঃসন্তান মলম ও মতিজান লালনকে ছেঁউড়িয়া তে থেকে যাবার জন্য ব্যাথিত হৃদয়ে অনুরোধ করে।লালন চিন্তা ভাবনা করে বলেন ,থেকে যেতে পারি তবে আমার জন্য আলাদা জায়গার ব্যবস্থা করতে হবে। মলম তাঁর কথা রাখলেন। কালিগঙ্গা নদীর তীরে শ্যামল বৃক্ষমন্ডিত মলমের বাগানে তৈরী করা হলো চৌচালা ঘর আর আঁখড়াবাড়ী। এই আখড়া স্থাপনে স্থানীয় কারিগর সম্প্রদায়ের উদার সাহায্য সহযোগিতা উল্লেখ করার মতো। করিগর সম্প্রদায়ের প্রায় প্রতিটি পরিবার ছিলো অতন্ত লালন ভক্ত ও অনুসারী। প্রথমত ,আখড়া খড়ের ছাউনি দেওয়া এবং সালের খুঁটির উপর নির্মিত ঘর ছিলো। তিন কামরা বিশিষ্ট পঁচিশ হাত দৈর্ঘে এবং ষোলো হাত প্রস্থে এঘরটির এক কামরায় লালন তার সাধন ভোজন করতেন। অন্য দুটি কক্ষ ছিল শিষ্য ও ভক্তমণ্ডলীর জন্য। এই আখড়ায় তিনি তার জীবনের সুদীর্ঘ পচাত্তর বছর অতিবাহিত করেন । এখানেই তিনি চিরদিনের জন্য শায়িত হন ।
লালনের জীবনী আলোচনায় এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে ছেউড়িয়ার এই আঁখড়াবাড়ীটি । মূলত এ আখড়া থেকে তার সাধন ভজন ,সংগীত ও দর্শন চর্চা থেকে আজকের লালন বিশ্বসভায় আলোচনায় উঠে এসেছেন। ক্রমে সাধন ভজনের পূন্যধামে পরিণত হওয়া এই আখড়াতেই লালন ফকির তার শিষ্যদের নীতি ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিতেন। তিনি প্রতি শীতকালে আখড়ায় একটি ভান্ডারা (মহোৎসব) আয়োজন করতেন। সে সময় এতে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় শত টাকা খরচ হতো। যেখানে চট্টগ্রাম, রংপুর, যশোর এবং পশ্চিমে অনেক দূর পর্যন্ত বাংলার ভিন্ন ভিন্ন স্থান থেকে সহস্রাধিক শিষ্য ও সম্প্রদায়ের লোক একত্রিত হতেন । সেখানে সংগীত ,তত্ত্ব ও দর্শন নিয়ে আলোচনা হতো। শোনা যায় ,সে সময় লালন ফকিরের শিষ্যের সংখ্যা প্রায় দশ হাজারের বেশি ছিল ।
লালন ফকিরের তত্ত্ব
লালনের ভাবশিষ্যরা বিশ্বাস করেন যে ,শারীরিক প্রেম ভালোবাসার মধ্যে প্রকৃত শান্তি নেই ,প্রকৃত শান্তি আছে স্বর্গীয় ভালোবাসায়। ফকির লালন দর্শনে খণ্ডিত আত্মা নিয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় না। ফকির লালন সাঁইয়ের মতাদর্শে সন্তান উত্পাদন নিষিদ্ধ। লালন দর্শনের অন্যতম আরেকটি দিক হলো গুরুবাদ। গুরুর প্রতি ভক্তি ও নিষ্ঠাই হলো তাদের শ্রেষ্ঠ সাধনা। ধেন ছাড়া যেমন গুরুকে ধারণ করা যায় না ,তেমনি গুরুর প্রতি অসমান্য ভক্তি ছাড়া অন্তরআত্মা পরিশুদ্ধ হয় না।
গুরুর নিকট দীক্ষা গ্রহণের পর সাধনার বিশেষ স্তরে পৌঁছালেই কেবল শিষ্যকে খেলাফত প্রদান করা হয়।এ সময় সত্যের বাণী পাঠ করানো হয়। প্রথমে দেওয়া হয় তহবন ,এরপর কোপনি ,তারপর খিলকা , অচলা , তসবিহ , পাগড়ি , পেয়ালা এবং শেষে দেয়া হয় ছড়ি। সবশেষে গুরু ভক্তের কানে গুরু বাক্য দান করেন। সাধনার কোন স্তরে কাকে কোন বিষয়ে কি দেওয়া হবে তা কেবল গুরুই জানে।যে বিষয়ে যে যোগ্য তাকে সেই বিষয়ের ত্বত্তজ্ঞান প্রদান করা হয়।খেলাফত অর্জনের পর একজন সাধক সকল পার্থিব বিষয় থেকে নির্মোহ হয়ে উঠেন।পুরুষরা সাদা আলখাল্লা এবং সাদা লুঙ্গি পরে ,অন্যদিকে মেয়েরা সাদা শাড়ি পরে ,যাকে তারা বলে খিলকা। খিলকা হলো কাফন সদৃশ্য পোশাক। তাদের ভাষায় জিন্দা দেহে মুর্দার পোশাক। যারা খিলাফত পান তারা পশু পাখি হত্যা করতে পারে না ।
লালন ফকিরের ভাব
লালন অসংখ্য গানে পরিশুদ্ধ আত্মার অনুসন্ধান করেছেন ,তার গানে ও ভাবাদর্শে কিছুটা সুফিবাদের ভাবধারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন খেলাফতের ধারণাটি কিন্তু ইসলামী সুফীজম থেকে এসেছে। এর মূলকথা আধ্যাত্বিক সাধনার মাধ্যমে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে খোদার নৈকট্য লাভ করা।
সুফিবাদ সাধনার দুটি পর্যায় হলো বাকাবিল্লাহ এবং ফ্যানাফিল্লাহ । বাকাবিল্লাহ মানে খোদার অপার ভালোবাসা , অন্যদিকে ফানাফিল্লাহ হলো আত্মার ভিতর খোদাকে ধারণ করা বাকাবিল্লাহ ও ফানাফিল্লাহ অর্জন করার জন্য প্রয়োজন আত্মার পরিশুদ্ধি।
আউল ,বাউল ,দরবেশ ,সাঁই এবং ফকির হচ্ছে সাধন স্তরের পাঁচটি পর্যায়ের নাম।
১। আউল, যিনি মাত্র উদাসীনতাকে ধারণ করতে শুরু করেছেন, শান্তির খোঁজ শুরু করেছেন, যার বাউলদের গান ভাল লাগে, ফকির সন্যাসীদের সঙ্গ যাকে আনন্দ দেয়। অর্থাৎ অনুরাগী সংসারী লোক।
২। বাউল, যারা দীক্ষা নিয়েছেন, গুরু ভজেন, নিজের বিশ্বাস ও আবেগ গানের মাধ্যমে প্রকাশ ও প্রচার করেন, দেশ-দেশান্তর ঘুরে বেড়ান, যারা বাতাসের, আলোর বা আত্মার সন্ধান করেন। ('বা' অর্থ বাতাস আর 'উল' অর্থ সন্ধানকারী।) এঁরা সংসারী।
৩। দরবেশ, যারা নিজেরাই দীক্ষা দিয়ে থাকেন, ধ্যানের জগতে বসবাস করেন, পার্থিব জগতের কোনকিছু যাদের আকর্ষণ করেনা। বাউলেরা এঁদের কাছে জ্ঞান ও ভাব নিতে আসেন।
৪।সাঁই,যারা অধ্যত্ব জ্ঞানে শিক্ষিত
৫। ফকির, যারা পার্থিব সমস্ত কিছু ত্যাগ করেছেন, যারা সাধনার উচ্চস্তরে পৌঁছে গেছেন, যারা সমাজ সংসার থেকে দূরে থেকে কেবল মনের মানুষের সাথে বসবাস করেন, যাদের চাওয়া বা পাওয়ার আর কিছু নেই অর্থাৎ ঈশ্বর আর তাঁর মধ্যে বিশেষ পার্থক্য নেই, যারা কামেলিয়াত অর্জন করেছেন।
লালন ফকিরের পরিবার
কয়েক বছর ছেঁউড়িয়ায় থাকার পর একদিন লালন তাঁর শিষ্যদের ডেকে বললেন, আমি কয়েক দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি তোমরা আমার সাধন কক্ষটার দেখাশুনা করো। সপ্তাহ তিনেক পর তিনি একটি অল্পবয়স্কা সুশ্রী যুবতিকে নিয়ে ফিরলেন।মতিজান ফকিরানী জিজ্ঞাসা করলেন, মেয়েটি কে বাবা?-তোমাদের গুরুমা।একথা শোনার পর আঁখড়াবাড়ীর সকলেই গুরুমাকে ভক্তি করলেন। বিশখা নামের এই মেয়েটি সারাজীবন লালনের সাথে ছিলেন। লালনের মৃত্যুর তিনমাস পর সেও মারা যায়। বিশখা ফকিরানী প্রায় একশো বছর ধরে ছেঁউড়িয়ায় ছিলেন কিন্তু তাঁর প্রকৃত নাম পরিচয় জানা যায়নি। এমনকি মৃত্যুর পরও তাঁর কোন আত্মীয় বা পরিচিতজনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। অচিন মানুষ ফকির লালনের মতোই বিশখা ফকিরানী আজো এক অচিন নারী।
ফকির লালন একদিন তাঁর সাধন ঘরে একা একা বসেছিলেন। এমন সময় খোসা থানার কমলাপুর গ্রামের দুইজন ভক্ত এসে জানালেন যে তাদের গ্রামে কলেরা লেগেছে, সেখানকার ভক্ত ফকির রহিম শাহ্ তাঁর নাবালক পুত্র এবং স্ত্রীকে রেখে কলেরা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। সব শুনে লালন খুব মর্মাহত হলেন। ফকির রহিম শাহের নাবালক পুত্র শীতলকে নিজের কাছে নিয়ে আসলেন। বিশখা ও লালন তাকে পুত্র স্নেহে লালন পালন করতে লাগলেন। অন্যদিকে তারও বেশ কয়েক বছর পর ফকির শুকুর শাহ্ তাঁর মাতৃহারা কন্যাকে লালনের কাছে নিয়ে আসেন, লালন সস্নেহে তাকে কোলে তুলে নিলেন এবং বিশখাকে বললেন-আজ থেকে এই শিশুটিও তোমার কন্যা। পরীর মতো সুন্দর এই মেয়েটিকে লালন পরী না বলে প্যারিনেছা বলে ডাকতেন। ভোলাই শাহ্ লালনের একান্ত শিষ্যদের অন্যতম, বাল্যকাল থেকেই সে আর শীতল একই ঘরে থাকতেন। ভোলাই শাহ বড় হয়ে কোন এক দোল পূর্ণিমার রাতে প্যারীনেছার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
লালন ফকিরের গুরু
লালনের মতো লালনের গুরু সিরাজ সাঁই সম্বন্ধেও মতবিরোধ আছে । কোনো কোনো লালন গবেষক মনে করেন ,সিরাজ সাই কোনো ব্যাক্তি নন বরং প্রয়োজনে একটি প্রতীকধর্মী নাম। অবশ্য কাঙাল হরিনাথ তার গ্রন্থে উল্লেখ করেন সিরাজ সাঁই ছিলেন সিদ্ধযোগী। এছাড়া আরো পরিষ্কারভাবে তথ্য পাওয়া যায় লালন শাহ খরিদকৃত ভূসম্পত্তির রেজিস্ট্রি দলিলে পিতার নাম সিরাজ সাঁই এর উল্লেখ থেকে। এখন পর্যন্ত এ লালন গুরু সিরাজ সাঁইয়ের জন্মস্থান কিংবা নিবাস নিয়েও বিতর্ক শেষ হয়নি। কোনো কোনো গবেষক বলেন সিরাজ সাঁইয়ের জন্ম যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার হরিশপুর গ্রামে আবার এ বিষয়ে তাদের পূর্ববর্তী গবেষকরা মনে করেন যশোর জেলার ফুলবাড়ী গ্রামে আবার এমনও মতবাদ আছে সিরাজ সাঁই এর জন্মস্থান ফরিদপুর জেলার কালুখানি স্টেশনের সন্নিকটে কোনো এক গ্রামে। অবশ্য সিরাজ সাঁই এর পেশাগত পরিচয় যে তিনি পাল্কিবাহক ছিলেন এ বিষয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। তিনি তত্বক সাধক কিংবা পীর মুর্শিদ ছিলেন না। তিনি সংগীতপ্রিয় সাধক ছিলেন এবং মাঝে মধ্যে নিজেও গান বাঁধতেন তবে এ ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ কোনো প্রমান আজো পাওয়া যায়নি । তিনি তত্বকথা শুনার জন্য ধর্মীয়সভা এবং আধ্যাত্বিক গানের আসরে গমন করতেন। মুসলমান হইলেও হিন্দুদের বহু তীর্থে তিনি ভ্রমণ করিয়াছিলেন। তিনি ওই অঞ্চলের সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি বর্জিত ফকিরি ধর্মের অন্যতম আদি গুরু। এই সাধক গুরুর প্রভাব লালনের জীবনকে নতুন ভাবে গঠিত কোরিয়াছিলো। লালন তার একাধিক গানের ভণিতায় সিরাজ সাঁই এর উল্লেখ করেছেন। সতেরোশো আটানব্বই সালে সিরাজ সাঁই মৃত্যুবরণ করেন। ধারণা করা হয় তখন লালন ছাব্বিশ বছর থেকে তিরিশ বছর এর মাঝে কোনো একটা সময় পার করছেন।
লালন ফকিরের ধর্ম
লালনের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে গবেষকদের মাঝে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে, কেউ তাঁকে মুসলিম বলেন, কেউ বলেন হিন্দু। কেউ কেউ বলেন, তিনি 'ওয়াহেদানিয়াত' ধর্মের অনুসারী ছিলেন। তিনি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ধর্ম প্রবর্তন করেছিলেন বলেও অনেকে মনে করেন। লালন ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু কোনো বিশেষ ধর্মের রীতিনীতি পালনে আগ্রহী ছিলেন না। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় লালনের জীবদ্দশায় তাকে কোনো ধরনের ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করতেও দেখা যায়নি। লালনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। নিজ সাধনা বলে তিনি হিন্দুধর্ম এবং ইসলামধর্ম উভয় শাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। লালনের সকল ধর্মের লোকের সঙ্গেই সুসম্পর্ক ছিল। মুসলমানদের সঙ্গে তার সুসম্পর্কের কারণে অনেকে তাকে মুসলমান বলে মনে করতেন। আবার বৈষ্ণব ধর্মের আলোচনা করতে দেখে হিন্দুরা তাকে বৈষ্ণব মনে করতেন। লালনের গানের ভিতর দিয়েও তাঁকে চেনা কঠিন, কারণ যে-পরিমান ইসলামী চিন্তার গান আছে প্রায় সেই পরিমাণেই বৈষ্ণব ভাবনার গান আছে। আল্লাহ-মুহাম্মদ-কৃষ্ণ-গৌর সবাইকে নিয়ে তিনি উদারভাবে গান বেঁধেছেন।প্রকৃতপক্ষে লালন ছিলেন মানবতাবাদী এবং তিনি ধর্ম, জাত, কূল, বর্ণ, লিঙ্গ ইত্যাদি অনুসারে মানুষের ভেদাভেদ বিশ্বাস করতেন না ।
লালন ফকির এর মৃত্যু
লালন ফকির শাহ কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী থানার ছেউড়িয়া গ্রামে তার নিজস্ব আখড়ায় আঠারোশো নব্বই সালের সতেরোই অক্টোবর, শুক্রবার মৃত্যুবরণ করেন। এ বিষয়ে সকল গবেষক, সাধারণ মানুষ এবং বিভিন্ন পণ্ডিতদের মতামত মোটামুটি এক। মারা যাওয়ার এক মাস আগে তাঁর পেটের পীড়া হয়। তখন পানি জমে হাত-পা ফুলে যায় তাঁর। সে সময় দুধ ছাড়া তিনি অন্য কোনো খাবার খেতেন না। তবে খাবারের পাতে মাঝেমধ্যে মাছ চাইতেন। অসুস্থাবস্থায়ও শিষ্য-ভক্তদের নিয়ে গানের আসর বসাতেন। সে সময়টাতে বেশ কিছু গানও রচনা করেছেন লালন। মৃত্যুর আগের দিন ভোররাত পর্যন্ত গান শুনেছেন। এরপর ভোর পাঁচটার দিকে শিষ্যদের ডেকে বলেছেন, ‘আমি চলিলাম।’ এর কিছুক্ষণ পরই মারা যান লালন। তার নির্দেশ বা ইচ্ছা না থাকায় তার মৃত্যুর পর হিন্দু বা মুসলমান কোনো ধরনের ধর্মীয় রীতিনীতিই পালন করা হয়নি। তারই উপদেশ অনুসারে ছেঁউড়িয়ায় তার আখড়ার মধ্যে একটি ঘরের ভিতর তার সমাধি গড়ে তোলা হয়। ছেঁউড়িয়াতে ফকির লালনের সাথে তার পালিত মা মতিজান ফকিরানী, পালিত বাবা ফকির মলম শাহ্, ফকির পন্ডিত মানিক শাহ্, শীতল শাহ্, ভোলাই শাহ্, বিশখা ফকিরাণী এবং ফকির মনিরুদ্দিন শাহসহ অন্যান্য আরো অনেক ভাবশিষ্যের সমাধি আছে। মৃত্যুর পূর্বে তিনি যে সম্পত্তি উইল করে যান তাতে তার স্ত্রী ,পালিত কন্যা ও প্রিয় শিস্য শীতলকে বন্টন করে যান।
লালন ফকির ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাঁর জমিদারীর এলাকা শিলাইদহের অন্তর্ভুক্ত ছেঁউড়িয়ায় লালন ফকির বসবাস করতেন, লালনের গানের আধ্যাত্মিক গভীরতায় ব্যাপকভাবে মুগ্ধ হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ লালনের কয়েকটি গান প্রকাশ করেছিলেন এবং বাঙ্গালি শিক্ষিত সমাজে লালনের কাজকে পরিচিত করিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ লালন ফকির ও সামগ্রিকভাবে বাউলদের দ্বারা এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে উনি নিজেও বাউলদের মত পোশাক পরা শুরু করেন এবং নিজেকে বলতেনও “রবীন্দ্র বাউল”। লালনের সাথে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয়েছিল কি না, সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে। নিশ্চিত কোনো খবর এ বিষয়ে পাওয়া যায় না। তবে লালনের শিষ্যদের অনেকের সঙ্গে যে রবীন্দ্রনাথের অনেকবার দেখা ও কথা হয়েছে, সে বিষয়ে অনেক ঐতিহাসিক দলিল রয়েছে। শিলাইদহে অবস্থানকালে তিনি লালনের গান সংগ্রহের উদ্যোগ নেন। জানা যায়, ছেউড়িয়ার আখড়া থেকে লালনের গানের খাতা আনিয়ে ঠাকুর এস্টেটের কর্মচারী বামাচরণ ভট্টাচার্যকে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ২৯৮টি গান নকল করিয়ে নেন।রবীন্দ্র ভবনের খাতা দুটিই ছেউড়িয়ার আশ্রমের আসল খাতা এবং যেভাবেই হোক তা রবিবাবুর হাতে পৌঁছানোর পর আর আখড়ায় ফিরে আসেনি।‘লালন শিষ্য ভোলাই শাহ বলেছিলেন-‘দেখুন, রবিঠাকুর আমার গুরুর গান খুব ভালোবাসিতেন, আমাদের খাতা তিনি নিয়া গিয়াছেন, সে খাতা আর পাই নাই, কলিকাতা ও বোলপুরে চিঠি দিয়াও কোনো উত্তর পাই নাই।‘কবিগুরুর জগতে লালন যে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, তা বুঝতে এর বেশি জানার প্রয়োজন পড়ে না।
লালনের জীবদ্দশায় তাঁর একমাত্র স্কেচটি তৈরি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। বলতে গেলে ঐ একটাই লালনের প্রত্যক্ষ চিহ্ন পাওয়া গেছে।গবেষকদের অনুমান, এ ছবি লালনের মৃত্যুর এক বছর আগে আঁকা।- যা ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।- তাতে শিল্পী নিজের হাতে লিখেছেন, ’লালন ফকির (শিলাইদহ বোটের উপর) তারিখ দেওয়া ৫ ই মে আঠারোশো উননব্বই একটা মজার ব্যাপার কি জানেন, অজ্ঞাত কারণে দীর্ঘ কাল এ প্রতিকৃতি লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিলো। সনৎকুমার মিত্র এবং তুষার চট্টোপধ্যায় উনিশশো ছিয়াত্তুর সালের দিকে যতীন্দ্রনাথ কর্তৃক লালনের প্রতিকৃতিটা আবিষ্কার করেন। লালন গবেষক সনৎকুমার মিত্র উল্লেখ করেন দীর্ঘ ছিয়াশি বছর পর আমি তাকে প্রকাশ্যে লোক চক্ষুর সামনে হাজির করলাম। এর আগে নন্দলাল বসু অঙ্কিত কাল্পনিক লালনের প্রতিকৃতিটি জনসম্মুখে প্রচার করা হতো। লালনের মৃত্যুর ছাব্বিশ বছর পর আঁকা নন্দলালের এ ছবিটি কোনোক্রমেই লালনের নয় ,বরং কাল্পনিক কোনো বাউলের ছবি। ছবি দুটি নিয়ে মতোপার্থক্য লালনের জীবনের অন্যান্য ঘটনার মতো প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিলো।
লালন ফকিরের মৃত্যু পরবর্তী সময়
লালনের মৃত্যুর পর বাউল সাধনায় কিছুটা ভাটা পড়ে যায়। তার মৃত্যুর পর ভক্ত ও অনুরাগী শিষ্যদের মধ্যে বাদবিসংবাদ ও মতান্তর এত প্রবল হয়ে ওঠে যে সমাধি প্রায় ভগ্ন দশায় পৌঁছে যায়। পরাধীন দেশের একটি কোণে সুদূর ছেঁউড়িয়া গ্রামে লালন শাহ ফকির নামে একজন বাউল সাধকের জীবন বা গান কিংবা চুনসুরকিতে গাঁথা তাঁর জীর্ণ সমাধি নিয়ে ক'জনেরই বা উৎসাহ থাকে। কয়েজন গরীব অসহায় শিষ্য শুধু গুরুর কণ্ঠের গান আঁকড়ে পড়ে ছিল। লালনের মৃত্যুর পর তার সমাধি তৈরী করার জন্য কোনো জমিদার সাহায্য করে নি বরং পরবর্তীতে আখড়ার অনেক খাজনা বাকি পরে গেলে জমিদারগণ ঊনিশশত পঁয়তাল্লিশ সালের এগারোই ই ডিসেম্বর খাজনার জন্য লালনের আখড়াটি নিলামে তুলেন। লালনের শিষ্যরা ১ শত ৭ টাকা ৪ আনা দিয়ে নিলামে সম্পত্তি কিনে আখড়ার অস্ত্বিত্ব রক্ষা করেন।
ইতিমধ্যে উনিশশো সাতচল্লিশ সালে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কুষ্টিয়া পড়েছে খন্ডিত বাংলার পূর্ব পাকিস্তান অংশে। ঊনিশশত আটচল্লিশ সালের গ্রীষ্মে প্রচন্ড ঝড়ে লালন শাহের আখড়ার দক্ষিণ দিক ভেঙ্গে পড়ে। ‘লালনশাহ আখরা কমিটি’ ভেঙ্গে-পড়া সমাধিঘরের অংশটুকু সংস্কারের চেষ্টা করে, কিন্তু টাকার অভাবে সেটুকু শেষ করা সম্ভব হয়নি। ফলে, ঊনিশশত আটচল্লিশ থেকে ঊনিশশত বাষট্টি সাল পর্যন্ত দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় লালনের আখড়া নির্জন, উপক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকে। কয়েকজন বিশ্বাসী ভক্ত অনুরাগীরা- যারা সেখানে থাকতেন, সন্ধ্যাবেলা জ্বেলে দিতেন প্রদীপ। লালনের রচনার ধারা বজায় রাখতে তাঁর গান গাইতেন। কেউ কেউ তাদের কাছে আসতো। আবার অনেক সময় সেইসব গান নিজেরাই শুনতেন।
পাকিস্তান হওয়ার পর রবীন্দ্রনাথের প্রতি পাকিস্তান সরকারের প্রবল বিদ্বেষ ছিল । সরাসরি রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ না করে, যবনিকার আড়ালে ঠেলে দিতে চেয়েছিল । সুপরিকল্পিত ভাবে তাঁর বদলে ইকবাল, নজরুল বা লালন ফকির এর দিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিলো । ঊনিশশত একষট্টি সালে রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী পালনের ব্যাপারে সরকার এবং সরকার-প্রভাবিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মনোভাব ছিল নিত্যন্ত প্রতিকূল। চার বছর পরে ঊনিশশত পঁয়ষট্টি সালে যখন যুদ্ধ হলো ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে, তখনো রবীন্দ্রনাথের গান সরকারি মাধ্যমে নিষিদ্ধ হয় অলিখিতভাবে। ঊনিশশত সাতষট্টি সালে নিষিদ্ধ হয় লিখিতভাবে।
ঊনিশশো তেষট্টি সালের দিকে লালন ফকির এর আখড়ার অবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটে। জৈনেক লালন গবেষক ,মুহাম্মদ মনসুরউদ্দীন প্রস্তাব করেন, ‘লালন লোক সাহিত্য কেন্দ্রে’ তৈরির। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তার প্রস্তাব মেনে নেন। সরকারের প্রত্যক্ষ আর্থিক সহায়তায় গড়ে ওঠে লালন লোক সাহিত্য কেন্দ্র। গণপূর্ত বিভাগ বহু অর্থ ব্যয় করে দিল্লির মুসলিম সাধক নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজারের অনুকরণে প্রস্তুত করা হলো সুরম্য ও বিশাল সমাধিসৌধ। এবার লালন ফকিরকে সত্যি সত্যি জাতে তোলার চেষ্টায় লেগে গেল একদল ইতিহাসবেত্তা।জীবিতকালে লালন ফকির যে জাতি-বর্ণ পরিচয়ের ক্ষুদ্র সাম্প্রদায়িক বৃত্ত ভাঙতে চেয়েছিলেন, এবার তাঁকে সেই বৃত্তের মধ্যে বন্দী করা শুরু হলো। যার ফলে লালনের যারা উত্তরসূরি ,তারাও পর্যন্ত বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন লালনের জীবন কাহিনীর সত্যতা সম্পর্কে। আর তাই আজও লালন সম্পর্কে সত্যিকার জীবন-বৃত্তান্ত বের করা সম্ভব হয়ে উঠেনি।
আইয়ূব শাসনামলে ১৯৬৩ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান লালনের সমাধিক্ষেত্রের পাশে লালন লোক সাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন পদাধিকার বলে এর সভাপতি হন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক। ১৯৭৬ সালে এই প্রতিষ্ঠানের নাম রাখা হয় লালন একাডেমি। ১৯৮৪ সালে লালনের মৃত্যু বার্ষিকীর দিনে তৎকালীন জেলা প্রশাসক সেখানে ধর্ম শোভা বসান এবং লালন ভক্তদের বের করে দেন। তিনি তাদের তওবাও করতে যান। জেলা প্রশাসক এভাবে হন ধর্মেরও শাসক। প্রায় পাঁচ হাজার ফকির সাধক বিক্ষোভ করলে রিজার্ভ পুলিশ দিয়ে তাদের পিটিয়ে তাড়ানো হয়। মাজারের সিন্দুকের চাবিও সেই দিনই বেহাত হয়। ১৯৯৭ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে মাজারের মূল চত্বরে তৈরী হয় চার তালা ভবন। যেখানে রয়েছে একটি অত্যাধুনিক মিলনায়তন ,জাদুঘর ও অথিতিশালা।
লালন ফকিরের নিতিবাচক দিকগুলো
বাউলদের ব্যাপারে ধর্মনিরপেক্ষ মধ্যবিত্তদের অতিরিক্ত আগ্রহের কারণে জাতীয়তাবাদী আলোচনার বয়ানগুলিতে দেখা যায় লালনের “বাউল” উপাদানগুলিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে এবং লালন ফকিরের উপর “ফকিরী” বা সুফি প্রভাবকে হয় পুরোপুরি অবহেলা অথবা এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে একই সঙ্গে লালনের উপর সুফি মতবাদের প্রভাবের বিষয়টিকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়াটাও তেমন ঠিক হবে না। কারণ “সহজ মানুষ”, “অধর মানুষ”, “অচিন মানুষ”, “মনের মানুষ” অথবা “সোনার মানুষ”, এসবই হচ্ছে এক কৌশলী ও ছলনাময় স্রষ্টার নানা নাম, যাঁকে একটা বিশেষ মুহূর্তে বিশেষ ধরণের যৌনসাধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ধরা সম্ভব এবং তাঁকে সেভাবে ধরতে পারলে এক নীরোগ সুন্দর দেহ, এমনকী অমরত্ব লাভ করা যেতে পারে। লালনের এসব ধারণার উৎস মূলত: এদেশীয় নাথপন্থী সহজিয়া দেহতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা এবং পারস্যের সুফিবাদের সঙ্গে এসবের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। সুফি ধারণার স্বর্গীয় আলো বা “নূর-ই-মোহাম্মদ”-য়ের ধারণা কখনো কখনো লালনের গানে দেখা গেলেও লালন ফকির ও তাঁর অনুসারীদের সৃষ্টিতত্ত্ব মূলতঃ এদেশে ইতিমধ্যে প্রচলিত নাথ-তান্ত্রিক-সহজিয়া দেহতান্ত্রিক সাধনচর্চার উপরই বেশি নির্ভরশীল ছিল। লোকজ এই বিশ্বাসের জগতটি মধ্যপ্রাচ্যের সুফি বিশ্বাসের সৃষ্টিতত্ত্ব থেকে একেবারেই আলাদা এক জগৎ। লালন ফকিরের উপর সুফি বিশ্বাস ও চর্চার প্রভাব অবশ্যই কিছুটা ছিল, কিন্তু লালনের জীবনবীক্ষার মূল রূপটি গড়ে উঠেছিল যুগ যুগ ধরে এ মাটিতে প্রচলিত যোগ-তান্ত্রিকতার ধ্যান-ধারণা থেকে যার সঙ্গে এসে মিশেছিল নদীয়ার বৈষ্ণবদের চৈতন্য-পরবর্তী যুগের সহজিয়া সাধনচর্চা। মনে রাখতে হবে, লালন ফকির এই নদীয়া অঞ্চলেরই মানুষ ছিলেন।
লালনের গানের আপাত: সহজ প্রতীক ও রূপকগুলিও “অচিন পাখী”, “মৎস্য”, “চাঁদ”, “পুকুর”, “নদী”, এসবই নানা যৌন সাধন-প্রক্রিয়ার অর্থবহ। লালন ফকিরের গানের প্রকৃত মানে এবং লালন-ঘরানার ফকিরদের দেহকেন্দ্রিক সাধনপ্রক্রিয়াটা বাঙ্গালি ভদ্র শ্রেণীগুলির সংবেদনশীলতার পক্ষে ঘৃণ্য বোধ হতে বাধ্য। বাউল ফকিরদের প্রধান রক্ষাকবচ হচ্ছে যে গ্রামের সাধারণ মানুষেরা লালনের গানের প্রকৃত অর্থ তেমন জানে না। এই তরিকার বাইরের মানুষেরা এসব গানের অন্তর্ঘাতমূলক বাণীর কিছুই না বুঝে গানগুলোর কাব্যগুণের সৌন্দর্য্যেই কেবল মুগ্ধ হয়ে পড়ে। এটা ইতিহাসের এক পরিহাস যে লালনের গানগুলি আজ প্রেমের গান কিংবা নাগরিক উচ্চবিত্তদের জন্যে আধ্যাত্মিক পলায়নী প্রবণতার গান হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যা এসব গানের মূল উদ্দেশ্য কখনোই ছিল না!
লালনের গানগুলির মর্মার্থ পাঠ করলে বোঝা যায় ওঁর ধারণাগুলো কতটা বস্তুবাদী, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানবিরোধী ও অন্তর্ঘাতমূলক ছিল। তাই এটা আশ্চর্যের নয় যে কেন লালনকে এত হেঁয়ালিপূর্ণ ও রূপকভাষায় ওঁর গানগুলি রচনা করতে হয়েছিল। বর্ণবাদী হিন্দুসমাজ ও শরীয়তী ইসলামপন্থীদের কাছে লালনের ধ্যান-ধারণাগুলো ছিল অতিরিক্ত ধ্বংসাত্মক, যা কেবল প্রচার নয়, ওদের পক্ষে সহ্য করাও ছিল কঠিন। ফলে দেখি লালন কেবল ব্রাহ্মণীয় তাঁকে ওয়াহাবী ধর্মান্ধদের ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হয়েছে, যাঁদের কাছে এসব বক্তব্য ছিল সহ্যের অতীত। তাই এটা আশ্চর্য্য করে না যে বাউলদের বিরুদ্ধে শরীয়ত পন্থীদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে “বাউল ধ্বংস ফতোয়া” জারী করা হয়েছিল।
মনে রাখতে হবে যে লালন ফকির ও তাঁর অনুসারীরা নিজেরাও ছিলেন সমাজের মূলধারা থেকে বিতাড়িত এক বঞ্চিত জনগোষ্ঠী। লালনের গানের অনেক দুঃখ, বিষণ্ণতা ও অস্তিত্ববাদী জিজ্ঞাসা আসলে বাংলার এক বিশেষ সময়কালে গ্রামবাংলার দরিদ্র ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর দুঃখবোধ ও অস্তিত্ববাদী শূন্যতারই প্রকাশ যে দরিদ্র সামাজিক শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত ছিলেন লালন ফকির নিজেও। লালন ফকিরের কাহিনী হচ্ছে নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সৃজনশীলতা ও প্রতিবাদের কাহিনী। লালনকে নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবি সমাজ ,ও কর্পোরেট বাণিজ্য যতোই সমাজবিচ্ছিন্ন এক শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করুক না কেন, বাস্তবতা রয়েই যায় যে বাংলার বাউল ফকিরদের দর্শন প্রতিষ্ঠান বিরোধী, লালন যে ধারার সবচে প্রভাবশালী সঙ্গীতগুরু
০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ১০:১০
শিশির খান ১৪ বলেছেন: কাজল ভাই, আমিও কয়েক বার শুনছি কিন্তু শুনা কোথায় কান দেই নাই আপনি যেভাবে বললেন তাতে তো মনে হচ্ছে ঘটনা সত্যি হইতে পারে। তার মানে আপনার মতামত হচ্ছে পাজুশাহের ছেলে খোন্দকার রফিউদ্দিন এর কথাই ঠিক। কাজল ভাই একটা ছোট প্রশ্ন সিরাজ শাহ এর মাজার হরিশপুর গ্রামে এটা কি আপনি নিশ্চিত ওই খানে গেলে কি দেখা সম্ভব ?
২| ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ১০:৪৪
কামাল১৮ বলেছেন: লালন এক জন অসাম্প্রদায়িক লোক।ধর্ম তাকে সাম্প্রদায়িক করতে পারে নাই।
০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ১২:৩৭
শিশির খান ১৪ বলেছেন: অসম্প্রদায়িক ঠিক আছে ,কিন্তু উনার সব বিষয় তো উনি নিজেই ধোঁয়াশা কইরা রাখছেন কোনো তথ্যই তো ঠিক মতো পাওয়া যায় না। জন্ম কোথায় কখন কেউ জানে না ,পরিবার কোথায় কেউ জানে না ,জাত আর ধর্ম তো আরো কঠিন বিষয় ,শিক্ষা না থাকলে এইরকম দর্শন তত্ব কি ভাবে উনার মাথায় আসতো। অনেক কিছুই জানা যায় না উনার বেপারে আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয় উনার আসল নাম যে লালন সেটারই বা কি কোনো প্রমান আছে। উনার বিষয়ে সব কিছুই অস্পষ্ট। আজকের জামানায় জন্মাইলে উনি গায়ক হতেন না হয়তো ম্যাজিসিয়ান হতেন।
৩| ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ২:০০
চারাগাছ বলেছেন: এই জামানায় লালন শাহ জন্মালে টিকতে পারতেন না বোধহয়।
০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ সকাল ৮:১৮
শিশির খান ১৪ বলেছেন: হুম ,এই জনমে বাংলাদেশে জন্মাইলে টিকা কঠিন হওয়া যাইতো আসলেই ঠিক বলছেন।
৪| ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ সকাল ৭:০১
কামাল১৮ বলেছেন: তার কর্মই তার পরিচয়।ওসব জেনে আপনি কি করবেন।
০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ সকাল ৮:২৮
শিশির খান ১৪ বলেছেন: আসলেই তার কর্মই তার পরিচয় খুব সুন্দর কথা বলছেন কামাল ভাই। তারপরেও একজন মানুষের দর্শন ও তত্ব ভালো মতো বুঝার জন্য মানুষটাকে ভালো মতো জানা প্রয়োজন। না হইলে ভাব টা ধরা তো কঠিন হওয়া যাবে।
৫| ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১:০৪
রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর লেখা।
আমার ঘরে দেয়ালে লালনের একটা ছবি আছে। লালন ধর্মে নিজেকে বন্ধী করে নি।
সুনীলের মনের মানুষ বই থেকেই তার সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছি।
০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ সকাল ১০:০৮
শিশির খান ১৪ বলেছেন: রাজীব ভাই লালনের ছবি নিয়েও কিন্তু রহস্য আছে আমরা সচরাচর যেই ছবি দেখি সেটা কাল্পনিক তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর ভাই তার একটা ছবি এঁকেছিলেন সেটা আসল এখন ভারতের মিউজিয়ামে সেই ছবিটি সংরক্ষিত আছে।
৬| ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ৮:৫০
সাড়ে চুয়াত্তর বলেছেন: লালন শাহ নিজেও বিভ্রান্ত ছিলেন মৃত্যুর পরে লাখে লাখে লোক তার দেখানো পথে বিভ্রান্ত হচ্ছে।
০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ সকাল ১০:১৩
শিশির খান ১৪ বলেছেন: হুম ,ঠিক বলেছেন উনি নিজেই বিভ্রান্ত ছিলেন। তবে ভালো সাহিত্যিক বা গীতিকার ছিলেন। উনার গানের অন্য রকম বৈশিষ্ট রয়েছে।
৭| ০৮ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৫৭
আসিফ ইকবাল কাজল বলেছেন: জ্বি দেখা সম্ভব। সেখানে লালন শাহ এঁর পীর সিরাজ সাঁইয়ের মাজার শরীফ ছাড়াও তার বংশধররা আছেন। আপনি চাইলে আমি তাদের ফোন নাম্বারও দিতে পারি
©somewhere in net ltd.
১| ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ৯:১৮
আসিফ ইকবাল কাজল বলেছেন: লালন শাহ বা লালন ফকীর ঝিনাইদহের হরিনাকুন্ডু উপজেলার হরিশপুরের বাসিন্দা। সেখানে তার স্বজনরা এখনো বসবাস করেন। তার পীর বা দীক্ষা গুরু সিরাজ শাহ এর মাজার হরিশপুর গ্রামে। এই পরিবারের কাছে লালন শাহ এর জমির দলিলও আছে। তাই তার জন্মস্থান নিয়ে বিতর্ক যারা সৃষ্টি করেন, তারা আজীবন করবেন।