নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
গল্প
জীবরে কাকুতি
সৈয়দ মবনু
গাছ কাঁদছে। ক্যানারি দ্বীপের লরেন গাছ নয়, আমাদের বাড়ির আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে থাকা গোলাপের গাছ। বিমানের লোহার কপাট খুলে বেরিয়ে আসা যাত্রীদের মতো কালো মেঘের ফাঁক দিয়ে দানা দানা হয়ে গোলাপ গাছের সবুজ পাতায় ক্রমাগত আকাশ থেকে পূর্ণিমার চাঁদ ঝরে, তবু গাছ কাঁদছে। গাছের চোখে জল দেখে সোনালি রাজহাঁসের বুকে আমি কেঁপে উঠি এক গভীর রাতে। অতলের প্রেম আমাকে গ্রাস করে। গোলাপের সাথে মানবের অনেক পুরাতন আত্মিক সম্পর্ক। জানতে হবে তার এত নীল বেদনা কিসের। পাশে গিয়ে একটা পাতায় হাত রেখে জিগ্যাস করি,
-ব্যাপার কি, পূর্ণিমার রাতে চোখে জল ?
ব্যথিত গাছের বুকে বজ্রপাত, সবুজ বাতাসে ফুস ফুস শব্দধ্বনি, শেকড়স্পর্শী তর্জন-গর্জন, বাতাসের মাঝে আহাজারি,
-আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে, আমার সোনামনিধন কলি ঝরে গেছে।
আবার হাউমাউ আহাজারী। আমি পাতায় পাতায় হাত বুলিয়ে সান্ত¡না দিতে চেষ্টা করি। সাপ কাটে যারে সে বুঝে বিষে কত ব্যথা, গাছ আমাকে উপেক্ষা করে। চলে আহাজারী। আমি নীরবে দাঁড়িয়ে বিষয়টা কি ধরতে চেষ্টা করি। ফিসফিস শব্দ হয়। বেশ কিছুক্ষণ ধ্যানের পর শব্দের বাক্যার্থ বুঝে আসে,
-যৌবনের সাতটি বসন্ত চলে গেলো, আমি একটি ফুলও ফোটাতে পারলাম না। আমার কি কোনো সৃজনী ক্ষমতা নেই, অস্তিত্ব রক্ষার্থে সৃজনীক্ষমতা কি আবশ্যক নয়?
গাছের কথা খুব যৌক্তিক। এই কথাগুলো আমায় ভাবায়। অতঃপর আমি তার আরো কাছাকাছি হই। তাকে সান্ত¡না দিতে চেষ্টা করি।
-এটাতো সোরেন কিয়ের্কেগর্ড-এর কথা। তাঁর দর্শনে অস্তিত্ব রক্ষায় সৃজনীক্ষমতার উপর গুরুত্ব দিলেও তোমার হতাশ হওয়ার কিছু নেই। একদিন এই পৃথিবীটাই অস্তিত্বহীন হয়ে যাবে, আমরা কেউ থাকবো না। অস্তিত্বের অস্তিত্ব যার হাতে তিনি কর্ম দিয়ে অস্তিত্বের গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, বংশ দিয়ে নয়। বংশতরুর শাখাহীন প্রাণীর অস্তিত্ব থাকে না, আমাদের এই ধারণা ভুল। বাস্তববাদী দয়াদর্শনের কথা হলো-পৃথিবীতে কর্মের অস্তিত্ব সর্বদা সংরক্ষিত। তাই তোমার ভেঙে যাওয়ার কোন কারণ নেই।
আমি যতই বুঝাই সে আরো ফুসকে উঠে-কাঁদে। আমার অন্তরাত্মায় হাজারো প্রশ্ন খেলা করে-উদ্ভিদজগতেও কি শাশুড়-শাশুড়ী-নন্দের উৎপিড়ন আছে? মানুষদের মতো তাদের মধ্যেও কি লিঙ্গবাদী ভণ্ডরা সংঘাত সৃষ্টি করে? গাছের স্বামী কি নিঃসন্তান স্ত্রীকে পাষান্ডের মতো তালাকের হুমকী দেয়? সেই জগতেও কি সন্তান প্রসবে অসামর্থদের প্রতি পারিবারিক নির্যাতন নেমে আসে? ইত্যাদি। আমি ভাবছি গোলাপ গাছকে জিগ্যাস করবো। গাছ নিজেই চোখের জল মুছতে মুছতে জানতে চাইলো
-মানবাত্মায় ফুল না গাছের গুরুত্ব বেশি, কে সুন্দর?
আমি তার প্রশ্ন শোনে দু’চোখ খুলে সবুজ পাতাগুলোর দিকে চেয়ে থাকি। সে একই প্রশ্ন আবার করলে আমি বললাম;
-মানব দার্শনিকরা এ নিয়ে সংশয়ী। দ্বান্দ্বিকদের মূল দর্শনটাই হলো সংশয়বাদ, তারা সমাধান দিতে পারেননি। নিঃসংশয়বাদীরা দ্বান্দ্বিক নয়। সংশয় আর সমাধানের মধ্যখানে সৃষ্টি হয়েছেন দেকার্ত, স্পিনোজ, ব্লেইজ, প্লোটো, সক্রেটিস, এরিস্টটল, সোরেন, স্টলস্টয়, ইমাম গাজ্জালী, ইবনে রুশদ, আবু হানিফা, ইবনে তাইমিয়া প্রমুখ। যুক্তি-তর্কে সবাই নিজেদের অবস্থানে যুক্তিবাদী, তর্কবাদী, দার্শনিক, সমাধানের খাতায় অনেকে দিয়েছেন ঘোড়ার আন্ডা। নিঃসংশয়বাদী দয়াদর্শনের স্পষ্ট কথা ‘তোমরা স্রষ্টার কোন নিদর্শন অস্বীকার করবে’? গাছ এবং ফুল দু’টাইতো স্রষ্টার নিদর্শন।
আমার কথায় গাছ পুলকিত হয়, মুচকি হাসে। বাতাসে গাছের পাতা নড়ে উঠে, আমাকে ইশারা করে পাশে বসতে। আমি দুঃখি গাছকে উপেক্ষা করতে পারলাম না। বসতে বসতে জানতে চাইলাম
-উদ্ভিদ জগতেও কি নিঃসন্তান গাছদের উপর শশুর বাড়ির উৎপিরণ আছে?
গোলাপ গাছের সবুজ পাতা চমকে উঠে
-ছিঃ ছিঃ! এত স্বার্থপরতা উদ্ভিদ জগতে নেই। আমরা স্রষ্টার বিশ্বাসে কোনো প্রকার মোনাফেকী রাখি না। শোনেছি তোমাদের মানব জাতে স্রষ্টার বিশ্বাসী হয়েও অনেকে সন্তানের দাবীতে স্ত্রী জাতের প্রতি জুলুম করে, আর নিঃসন্তানদেরকে করে হেয়-প্রতিপন্ন? আমাদের গাছজাতে এমন কেউ করলে আমরা তাকে অগাছের বাচ্চা বলে গালি দেই আর ঘৃণিত মোনাফেক হিসেবে চিহ্নিত করে রাখি।
আমি মানব জগত নিয়ে গাছের সামনে কিছুটা লজ্জিত হলেও তার কাছে আরো জানতে চাইলাম,
-তোমাদের উদ্ভিদ জগতে শাশুড়-শ্বাশুড়ি-নন্দের উৎপিড়ন আছে কি?
সে রেগে লাল হয়ে বলে,
-ছিঃ! এমন দয়াশূন্য কথা মুখে নিতে নেই। দেখ, আমাদের শশুড়-শ্বাশুড়ী-নন্দেরা যেমন গাছ, তেমনি ঘরের বউরাও । গাছ হয়ে গাছের উপর উৎপিড়ন-নির্যাতনের চিন্তাটাও ঘৃণিত অপরাধ। যদি এমন কোথাও ঘটে যায় তবে আমরা তাকে উদ্ভিদ সমাজ থেকে বের করে ছাগলের বাচ্চা উপাধী দেই।
-এত কিছু থাকতে ছাগলের বাচ্চা কেনো?
আমি জানতে চাইলে গোলাপ গাছ বলে,
-পাগল কি না কয়, ছাগল কি না খায়, তাই।
আমি আবার জানতে চাইলাম,
-উদ্ভিদ জগতে যৌতুক সমস্যা আছে কি? যৌতুকের দাবীতে বিয়ে ভঙ কিংবা জুলুম হয় কি? স্বামী পক্ষের যৌতুকের দাবী মিটাতে ব্যর্থ হয়ে স্ত্রীরা আত্মহত্যা করে কি?
আমার প্রশ্ন শোনে ক্ষুব্ধতায় গাছের শরীরটা কেঁপে উঠে। মেয়েলী কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে জানতে চায়-
-কি যে বলেন সাহেব? বিয়েতে আবার যৌতুক! এমন ছাগলের বাচ্চা উদ্ভিদ জগতে নেই।
আমি জানতে চাইলাম
-তাইলে কাঁদছো কেনো?
সে বললো;
-আমার সমস্যা হলো একটি ফুলের কাকুতিতে মালির চোখে জল। সে আমায় ভালোবেসে বড় যতœ করে চাষ করেছে, আমি তাকে বিনিময়ে একটি ফুল উপহার দিতে ব্যর্থ হলাম। আমি কাঁদছি অংকের সমস্যায় নয়, প্রেমের স্পন্দনে। আমার কান্নায় মেকিয়াভেলীর বস্তুবাদ নয়, হৃদয়ের ব্যথা আর স্বর্গীয় আদমের নিঃসঙ্গ কাকুতি লুকিয়ে আছে। এসব অংক কিংবা আল-জেবরার সূত্র দিয়ে তোমাকে বুঝানো যাবে না, যাদের হৃদয় আছে একমাত্র তারাই বুঝতে পারে আমার কাকুতি।
©somewhere in net ltd.