নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কোরআনিক ব্যাখ্যায় দয়াদর্শন
সুরা বাকারা, আয়াত-২
ذَلِكَ الْكِتَابُ لاَ رَيْبَ فِيهِ هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ {২}
উচ্চারণ : ‘যালিকাল কিতাবু লা রাইবা ফিহ; হুদাললিল মুত্তাকিন
অর্থ : এ সেই গ্রন্থ যাতে কোন সন্দেহ নেই, যা মুত্তাকিদের জন্য পথ প্রদর্শক।
সাধারণত যে কোন গ্রন্থের শুরুতে বলা হয়, যদি কোন ভুল-ত্রুটি থাকে তবে দয়া করে জানাবেন। কিংবা ভুল-ত্রুটির জন্য অগ্রিম ক্ষমাপ্রার্থী। এ কথার অর্থ, ভুল থাকার ব্যাপারে লেখক বা প্রকাশকের সন্দেহ আছে। কিন্তু কোরআনে তা না বলে স্পষ্ট বলা হয়েছে, এই গ্রন্থে কোন সন্দেহ নেই। এখানে বলা হয়েছে ‘যালিকাল’; যার শাব্দিক অর্থ হলো : ঐ। ‘ঐ’ ব্যবহার হয় এমন দুরের কিছু বুঝাতে যা অদৃশ্য। কিন্তু কোরআন তো দৃশ্যত এবং খুবই কাছে রয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, এখানে ‘যালিকাল’ শব্দের অর্থ হবে ‘হাযাল’। তারা দলিল এনেছেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে। ‘হাযা’ অর্থ : এই, যা দিয়ে খুব কাছের কিছু বুঝানো হয়। ‘যালিকা’ অর্থ : ঐ, যা দিয়ে দুরের কিছু বুঝানো হয়। তবে আল্লামা আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে জরীর তাবারী (র.) বলেন, ‘যালিকা’-ই যথার্থ। কারণ যা দিয়ে কোন খবর জানা যায় তা নামপুরুষ হলেও বক্তার কাছে মধ্যম পুরুষ হিসাবে গণ্য হয়। ‘যালিকাল কিতাব’ কথার মধ্যে ‘যালিকা’র অবস্থা এরকমই। কারণ, মহান আল্লাহ যখন ‘যালিকাল’ শব্দের পূর্বে ‘আলিফ লাম মিম’ উল্লেখ করেছেন তখন তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, তিনি তাঁর নবীকে যেন বলছেন : হে মুহাম্মদ (স.) এটাই সেই কিতাব যা আমি তোমার কাছে বর্ণনা করেছি। আর এই কারণেই ‘হাযা’র স্থানে ‘যালিকা’ উচ্চারণ যথার্থ হয়েছে। (তাফসীরে তাবারী)।
‘লা রাইবা ফি’-র অর্থ : এতে কোন সন্দেহ নেই। হযরত রাবী ইবনে আনাস, মুজাহিদ এবং আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) প্রমূখ সাহাবির মতে এখানে ‘লা রাইবা ফি’-র মূল অর্থ হবে ‘লা শাক্কা ফি হি’ অর্থাৎ এতে কোন সন্দেহ নেই। কোরআন বিশেষজ্ঞদের মতে এই ‘যালিকাল কিতাবু লা রাইবা ফি’ বাক্য দিয়ে বুঝানো হচ্ছে, এই গ্রন্থ যে আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আবার শানে নুজুল সামনে নিয়ে বলা যায়, এখানে মালেক নামক জনৈক ইহুদীর অপপ্রচারের জবাব দেওয়া হয়েছে। হযরত নবী করিম (স.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পর যখন দলে দলে মানুষ ইসলামে আসতে শুরু করে তখন মদিনার ইহুদিরা ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করলো। বিশেষ করে মালেক নামী জনৈক ইহুদি এই বলে প্রচার করতে থাকে যে, আল্লাহ পূর্ববর্তি গ্রন্থসমূহে যে গ্রন্থের কথা বলেছেন এই গ্রন্থ (কোরআন) সেই গ্রন্থ নয়। তখন এই অপপ্রচারের জবাবে আল্লাহ পাক এই আয়াতে ঘোষণা করেন, এটাই সেই গ্রন্থ যাতে কোন সন্দেহ নেই। (তাফসিরে হোসেনী)। আবার এমনও হতে পারে, এখানে আল্লাহ পাক ঘোষণা করছেন, এই গ্রন্থ (আল- কোরআন) মুত্তাকিদের জন্য পথ প্রদর্শক, তাতে কোন সন্দেহ নেই। অথবা ‘এই গ্রন্থের কোন বিষয়েই সন্দেহ নেই। অথবা বলা হচ্ছে, এই গ্রন্থ যে আল্লাহর কালাম তাতে কোন সন্দেহ নেই।
‘যালিকাল কিতাবু লা রাইবা ফি’র পরে এখানে বলা হয়েছে ‘হুদাললিল মুত্তাকিন’। ‘হুদাললিল’-এর অর্থ বেশির ভাগ মুফাস্সির ‘পথ প্রদর্শক’ বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থের দিকে তা সঠিক, আরবী অভিধানে ‘হুদা’ শব্দের অর্থ বলা হয়েছে, সৎ পথ বা সোজা পথের প্রদর্শন। আল্লামা শাবী (র.) ‘হোদা’ অর্থ বলেছেন-‘হোদা মিনায যালালা’ অর্থাৎ গোমরাহী থেকে হিদায়ত করা। কোরআনের ব্যাপকতার দিকে দৃষ্টি রেখে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) প্রমূখ সাহাবী বলেন-‘হুদাললিল মুত্তাকিন’-এর মূল অর্থ : ‘নুরুল মুত্তাকিন’ অর্থাৎ মুত্তাকিদের জন্য নুর বা আলো। এই সকল অর্থ সামনে নিয়ে আমরা বলতে পারি হেদায়তের মূল অর্থ সচেতন হওয়া। যে হেদায়ত লাভ করলো সে মূলত দুনিয়াÑআখেরাতের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে সচেতন হলো। এই আয়াতে ‘হুদাললিল’ এর পরে বলা হয়েছে ‘মুত্তাকিন’। ‘মুত্তাকিন’ হলো ‘মুত্তাকি’ শব্দের বহুবচন। মুত্তাকির শাব্দিক অর্থ : পবিত্রতা রক্ষাকারী। যিনি খারাপ থেকে নিজকে রক্ষা করেন তিনি মুত্তাকি। খারাপ থেকে আত্মরক্ষার নামই ‘তাকওয়া’। তাকওয়া কি? এই প্রশ্ন হযরত উমর (রা.) হযরত উবাই ইবনে কাব (রা.) কে করেছিলেন। তিনি উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন করেন, আপনি কি কখনো কন্টাকাকীর্ন পথ দিয়ে চলেছেন? উত্তরে ওমর বলেন, হ্যাঁ। উবাই বলেন, কীভাবে চলেছেন? ওমর বলেন, কাপড় চোপড় গুটিয়ে অত্যন্ত সন্তর্পনে চলেছি। উবাই বলেন, এটাই তাকওয়া। হযরত ওমর (রা.) এবং হযরত উবাই ইবনে কাব (রা.) এর কথকতাকে সামনে নিয়ে সাইয়েদ কুতুব (র.) বলেন, বস্তুত ঃ বিবেকের সার্বক্ষনিক সচেতনতা ও সতর্কতা, চেতনা ও অনুভূতির স্বচ্ছতা, অব্যাহত ভীতি, নিরবিচ্ছিন্ন সাবধানতা, জীবন পথের এই কন্টকসমূহ থেকে আত্মরক্ষার প্রবণতা এসবেরই নাম তাকওয়া। ( ফী যিলালিল কোরআন, সাইয়েদ কুতুব র.)।
আমাদের কাছে স্পষ্ট হলো যে, তাকওয়ার অধিকারীকে মুত্তাকি বলে। অভিধানিকভাবে মুত্তাকি হলো, পরহেজগার এবং সৎ ব্যক্তি। ‘পরহেজ’ হলো কোন কিছু থেকে নিজকে বাঁচিয়ে রাখা। যিনি পরহেজ করেন তাকে বলা হয় পরহেজগার। অনেকে মুত্তাকি অর্থ লিখেছেন-আল্লাহ-ভীরু বা খোদাভীরু। কেউ লিখেছেন, ধর্মভীরু। মুত্তাকি অর্থ আল্লাহভীরু বা ধর্মভীরু একথা পূর্ণাঙ্গ সঠিক নয়। যারা বলেছেন আল্লাহভীরু, তাদের ধারণা-আল্লাহর ভয় ছাড়া মানুষ খারাপ কাজ থেকে বাঁচতে পারে না। যেহেতু ভয়টাই রক্ষা করছে তাই তারা ভয়কে মূল ধরে নিয়েছেন। আমরা তাদের বক্তব্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে বলতে চাই, ভয় ছাড়া প্রেমও মানুষকে মুত্তাকী করতে পারে। প্রকৃত অর্থে আল্লাহ কিংবা ধর্মকে ভয় করার কিছু নেই। আল্লাহ কিংবা ধর্ম প্রকৃত অর্থে ভয়ের বস্তু নয়। সাধারণত আমরা ভয়ের বস্তু মনে করি বাঘ, বাল্লুক, সাপ ইত্যাদি। আল্লাহ হয়তো শ্রদ্ধার, নয়তো প্রেমের। তবে যারা পাপিষ্ট তাদের ভয়ের কারণ রয়েছে। তাই ভয় করার কথা পাপকে, আল্লাহকে নয়। আল্লাহ প্রত্যেককে সঠিক বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাবেন, কাউকে বিনা বিচারে কোন শাস্তি দেবেন না। আল্লাহ ন্যায় বিচারক। ন্যায় বিচারককে ভয় করার কিছু নেই। ভয়ের মূল কারণ হলো নিজের কর্ম। খারাপ কর্ম থেকে পরহেজ করতে পারলেই বিচারকের সামনে নির্ভয় দাঁড়ানো যায়। আর আল্লাহ তো এমন বিচারক যিনি অনন্ত দয়াময় এবং অতিশয় দয়ালু। তাকে ভয়ের কোন কারণই নেই। আর যে প্রেমিক সে তো ভয়ের কোন চিন্তাই করে না। প্রেমিকের সাথে প্রেমিকার কিংবা প্রেমিকার সাথে প্রেমিকের সবকিছু হিসাবের উর্ধ্বে। প্রেমিকের সহজকথা, রাখ কিংবা মারো তাতে প্রেমিকের কি আসে যায়? তবে ভণ্ড প্রেমিকদের স্মরণ রাখতে হবে, আল্লাহ হলেন অন্তর্জামি, তিনি সব দেখেন-সব জানেন। যারা আল্লাহর ভয়ে কম্পিত তাদের প্রতি রইলো আমাদের শ্রদ্ধা। তবে সবার স্মরণ রাখতে হবে, ভয়ের মুত্তাকি থেকে প্রেমের মুত্তাকির মূল্য মহান আল্লাহর কাছে বেশি। মোটকথা হলো : কোরআন সত্য, কোরআনের সবকথা সত্য, তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর এই সত্য আলো দেখায় যারা মুত্তাকি শুধু তাদেরকে। আমরা এই বক্তব্য থেকে মুত্তাকি বুঝেছি তাদেরকে যারা সচেতন নিজের অধিকার সম্পর্কে, অন্যের অধিকার সম্পর্কে, আল্লাহর অধিকার সম্পর্কে, প্রকৃতির অধিকার সম্পর্কে। মোটকথা, সচেতন মানুষই প্রকৃত মুত্তাকি। আর তা যৌক্তিকও। কারণ, সচেতন মানুষ ছাড়া কেউ সঠিক পথে গন্তব্যে পৌঁছতে পারে না। মানুষকে সচেতন করতে আল্লাহ পাক সচেতন মানুষদের বৈশিষ্ট্য বলছেন পরবর্তী আয়াতে,
(চলবে)
©somewhere in net ltd.