নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কোরআনিক ব্যাখ্যায় দয়াদর্শন : সূরা বাকারা, আয়াত : ৭
{7} غِشَاوَةٌ وَلَهُمْ عَذَابٌ عظِيمٌ هِمْ خَتَمَ اللّهُ عَلَى قُلُوبِهمْ وَعَلَى سَمْعِهِمْ وَعَلَى أَبْ
উচ্চারণ : খাতামাল্লাহু আ’লা কুলুবিহিম ওয়ালা সামইহিম ওয়ালা আবসারিহিম গিশাওয়াতুউ ওয়ালাহুম আযাবুন আলিম
অনুবাদ : আল্লাহ পাক তাদের অন্তর ও শ্রবণেন্দ্রিয় খতম করে দিয়েছেন এবং চোখের উপর আবরণ পড়ে আছে, তাদের জন্য রয়েছে বড় রকমের শাস্তি।
সুরা বাকারার ছয় নম্বর আয়াতের সম্পূরক হলো সাত নম্বর এই আয়াত। পূর্বের আয়াতে আমরা জেনেছি, তাদেরকে সতর্ক করা আর না করা সমান, তারা ঈমান আনবে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন? এই আয়াতে আল্লাহ পাক সেই কারণ বলছেন, তাদের অন্তর ও শ্রবণেন্দ্রিয় খতম করে দেওয়া হয়েছে। এখন তারা নাদান ও বধির হয়ে আছে। নাদানকে সারারাত ইউসুফ-জুলেখার কেচ্ছা বলার পরও সকালে জিজ্ঞাস করে-জুলেখা কার বাপ? আর যে বধির সে তো কিছুই শোনতে পায় না। এখানে যাদের প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে তারা তো শুধু নাদান আর বধিরই নয়, তাদের চোখের উপর আবরণ পড়ে আছে, তারা অন্ধও। এখন প্রশ্ন হলো কারা এই নাদান, বধির এবং অন্ধ সম্প্রদায়? এপ্রশ্নের উত্তরে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন, ওরা হলো সত্য গোপনকারী ইহুদি সম্প্রদায়। আর হযরত রাবী ইবনে আনাস বলেন, ওরা হলো কাফের সম্প্রদায়ের ঐ নেতারা, যারা বুঝতো রাসুল (স.) সত্য বলছেন, তবু বিরোধীতা করতো।
এখানে অন্তর আর শোনার শক্তির আগে শব্দ এসেছে ‘খাতামা’, যার আবিধানিক অর্থ- সিলমোহর, সমাপ্তি, পরিণতি। বেশির ভাগ কোরআন বিশেষজ্ঞ এখানে ‘মোহর’ শব্দকে অর্থ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। অন্তর এবং শ্রবণ শক্তি তো বস্তু নয়, তাহলে এগুলোতে কীভাবে মোহর লাগানো যাবে? তাদের কথা হলো- এখানে প্রতিকী অর্থে ‘মোহর’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ, কোন কিছুতে সরকার কর্তৃক সিলমোহর লাগানোর পর তাতে আর কারো স্পর্শের অধিকার থাকে না। আল্লাহ যাদের অন্তরে, কানে সিলমোহর লাগিয়ে দিয়েছেন ওদেরকে আর দাওয়াত দিলেও কাজ হবে না, তা বুঝানোর জন্যই এখানে সিলমোহর শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। অবশ্য এখানে ‘খাতামা’ অর্থ ‘সমাপ্তি’ বা ‘পরিণতি’ নিলেও আপত্তি হতো না। যদি ‘সমাপ্তি’ গ্রহণ করা হতো তবে আমরা বুঝতাম সত্য গোপনকারীদের বুঝার ও শোনার শক্তি শেষ হয়ে যাওয়ায় তারা আর বুঝতে এবং শোনতে পারবে না। আবার যদি ‘পরিণতি’ গ্রহণ করা হতো তবে অর্থ হতো, ওদের অন্তর ও কান কুফরিতে পরিণত হয়ে যাওয়ায় সেখানে আর ঈমানের স্থান নেই। খাতামা’র এই তিন অর্থই এখানে গ্রহণযোগ্য। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, হযরত রাসুল (স.) বলেন-‘ যে ফেরেস্তা মহর লাগিয়ে দেন তিনি আরশের কুটি ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। যখন কোন ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে এবং প্রকাশ্য আল্লাহর নাফরমানিতে লিপ্ত হয়ে যায়, তখন আল্লাহ পাক মহর লাগানোর ফেরেস্তাকে নির্দেশ দেন তার অন্তরে মহর লাগিয়ে দাও, যাতে সে আর সত্যকে গ্রহণ করতে না পারে। ইমাম বায়হাকি এই হাদিসকে জঈফ বলেছেন। (তাফসিরে দুররে মনসুর, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্টা ২৩৮)। তবে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে সহীহ হাদিস হলো, হযরত নবী করিম (স.) বলেন, মুমিন যখন কোন পাপ করে তখন তার অন্তরে একটি কালো দাগ লেগে যায়। যদি সে তাওবাহ করে তবে পাপ মাফের সাথে সাথে এই দাগ মুছে ফেলা হয়। কিন্তু তাওবাহ না করে আবার যখন পাপ করে তখন এই কালো দাগ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ধীরে ধীরে এই কালো দাগ তার অন্তরকে ঘিরে ফেলে। আর তা এই জঙ্গার, যা সম্পর্কে আল্লাহ পাক ‘কাল্লাবালরানা আলা কুলুবিহিম বিমা কানু ইয়াকসিবুন’-এ সংবাদ দিয়েছেন। (তিরমিযি)। অন্তরের মধ্যে ‘মহর’ দিয়ে মূলত আল্লাহপাক এই হাদিসের ‘কালো দাগ’-ই বুঝিয়েছেন।
যাই হোক, এই আয়াতে মূল বিষয়টা হচ্ছে, ওরা আর ঈমান আনবে না, তা স্পষ্ট করে দেওয়া। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর সূত্রে আবু তালহা (রা.)-এর তথ্যে ঘটনাটা কমবেশি এরকম-‘হযরত নবী করিম (স.) ছিলেন দয়ার সাগর, তিনি চাইতেন প্রত্যেক মানুষ মিথ্যা এবং অন্ধকার থেকে সত্য এবং আলোর পথে আসুক। তিনি মদিনার ঐ ইহুদিদের কাছে বারবার ঈমানের দাওয়াত দিচ্ছিলেন, মহান আল্লাহ তো প্রত্যেক জিনিষের খবর রাখেন, তিনি তাঁর হাবিবকে জানিয়ে দিলেন, লাভ নেই, আমি তাদের বুঝার ও শোনার শক্তি খতম করে দিয়েছি।’ এখন প্রশ্ন হলো, স্বয়ং আল্লাহ যদি কারো হেদায়তের শক্তি লুপ্ত করেদেন তবে সে কেন হেদায়তপ্রাপ্ত না হওয়ার জন্য শাস্তি পাবে? পূর্ব আয়াত থেকে স্পষ্ট যে, আল্লাহ তাদের পাপের শাস্তি হিসেবে তা করেছেন। এখানে তাদের মূল পাপটা হলো-কুফরি, সত্যকে গোপনকরা। যারা সত্য গোপন করে মহান আল্লাহ তাদেরকে - নির্বোধ, বধির, অন্ধ বলে চিহ্নিত করেছেন। অতঃপর বলছেন - তাদের জন্য রয়েছে বড় রকমের শাস্তি। এখানে শাস্তির কোন পরিমাণ বা ধরণ বলেন নি, বলেছে বড় রকমের শাস্তি। তা ছাড়া এ থেকে বড় শাস্তি আর কি হতে পারে যে, ওরা হেদায়তপ্রাপ্ত হবে না।
যদিও এই কথাগুলো তৎকালিন বিশেষ এক ইহুদি সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে, তবে আজও তা সত্যগোপনকারীদের অনেকের জন্য প্রযোজ্য। বিশেষ করে, বর্তমান জায়নবাদি ইহুদিরা কীভাবে সত্যকে গোপন করে ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে সেখানের জনগোষ্ঠির ওপর জুলুম-নির্যাতন চালাচ্ছে তা তো বিশ্ববাসীর চোখের সামনে। বারবার ইহুদিরা সেখানে রক্তের বন্যা ভাসিয়ে দেয়, পৃথিবীব্যাপী এতে প্রতিবাদের ঝড় উঠে, তবু তা জায়নবাদি ইহুদিরা শোনতে পায় না, দেখতে পায় না, অনুভব করতে পারে না। মহান আল্লাহ যে বলেছেন, তিনি তাদের বুঝার এবং শোনার শক্তি খতম করে দিয়েছেন এবং চোখের উপর আবরণ পড়ে আছে’, তার সত্যতা বর্তমান জায়নবাদি ইহুদিদের মধ্যেও পাওয়া যায়। ইসরাঈলের ঘটনাসমূহ আজ প্রমাণ দিচ্ছে, এই আয়াত সত্যই ইহুদি সম্প্রদায় সম্পর্কিত। ফিলিস্তিনে যখনই জায়নবাদি ইহুদিদের কর্তৃক ইসলাম বিশ্বাসী মানুষদেরকে রক্তাক্ত করা হয় তখনই পৃথিবীব্যাপী জার্মানের নেতা হিটলারের নামে একটি উক্তি খুব বেশি প্রচারিত হয়-‘আমি সব ইহুদিকে হত্যা না করে কিছু রেখে গেলাম যাতে মানুষ বুঝতে পারে ইহুদি কি জিনিষ।’ এই বক্তব্য হিটলারের কি না, তা জানি না। তবে বক্তব্যটা বাস্তবের সাথে সম্পর্কিত বলে সময়ে সময়ে অনেকেই তা প্রচার করে থাকেন।
একটি প্রশ্ন আমাকে প্রায় ভাবিত করে; যখন ইউরোপ-আমেরিকা-রাশিয়ার মিত্র বাহিনীর পক্ষে করম চাঁদ গান্ধী এবং তাঁর সংগঠন কংগ্রেস ছিলো হিটলারের বিরুদ্ধে তখন বাঙালী মানবতাবাদি নেতা, ভারতের সর্বশ্রেণীর মানুষের কাছে নেতাজী বলে খ্যাত সুভাষচন্দ্র বসু লাল ফৌজ গঠন করে বৃটিশ জেল থেকে পালিয়ে পুলিশ-গোয়েন্দার চোখে ফাঁকি দিয়ে হিটলারের পক্ষে জার্মান গিয়েছিলেন কেন? হিটলারের সাথে নেতাজীর চিন্তা-চেতনা এবং কর্মের মিল ছিলো কি? মোটেও না। মানুষকে নির্মমভাবে গণহত্যার পক্ষে তিনি ছিলেন না। হিটলার জার্মানি থেকে ইহুদিদেরকে তাড়াতে যে গণহত্যা করেছে তা অবশ্যই সমর্থনযোগ্য নয়। তবু নেতাজী গেলেন হিটলারের পক্ষে! প্রথম দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ছিলেন হিটলারের পক্ষে, পরে অবশ্য তিনি তা সংশোধন করে নিয়েছিলেন অনেকেই প্রচার করেন। আবার অনেকে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হিটলারের পক্ষাবলম্বন ত্যাগ না করলে নোবেল পুরস্কার পেতেন না, তাই তিনি হিটলারের পক্ষ ত্যাগ করে বৃটিশ রাণী ভিক্টোরিয়ের পক্ষে কবিতা লিখেছেন। সে যাই হোক, আজ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের দিকে দৃষ্টিপাত করলে হিটলারের ঐ নির্মম ভূমিকাকে জার্মানীরা স্বাগত জানাতেই পারে এজন্য যে, এই জঘন্য মানুষগুলো থেকে হিটলার জার্মানকে মুক্তি দিয়েছেন। ইউরোপ-আমেরিকা হিটলারের এই জায়নবাদি বর্জকে নিজেদের পাশে থাকতে দেয়নি, কারণ তারা জানে বর্জ থেকে একদিন গন্ধ বের হবেই। তারা সবাই মিলে ‘ইসরাঈল’ নামক একটা ডাস্টবিন তৈরি করেছে আরবের মাটি-ফিলিস্তিনে। আরব নেতাদের নেতৃত্বের অবস্থা খুবই খারাপ। তারা তাদের চারিত্রিক দুর্বলতার কারণে বুক উঁচু করে সেদিনও দাঁড়াতে পারেন নি, আজও পারছেন না। আর আরব নেতাদের মুনাফিকি চরিত্র তো আছেই। প্রথমদিকে সবার একটা আশা ছিলো সৌদি আরবের প্রতি, কিন্তু রাজতান্ত্রিক সৌদি আরবের অবস্থা তো আরও নাজুক। তারা বিশ্বমুসলিমের স্বার্থে, মানবতার স্বার্থে বুক উঁচু করে যদি জায়নবাদিদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারতো তবে আজও ফিলিস্তিনের মুসলমানদের রক্তাক্ত হতে হতো না। মুসলিম বিশ্বের মুনাফিক সরকারদের কারণে ফিলিস্তিন সহ বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা আজ শোষিত-বঞ্চিত-নির্যাতীত। এই আয়াতদ্বয় যদিও ইহুদি সম্প্রদায়কে ইঙ্গিত করে অবতীর্ণ হয়েছে, তবে প্রশ্ন তা কি আজও শুধু ইহুদিদেরকে বুঝাচ্ছে? সহজ উত্তর-অবশ্যই না। যারা যুগে যুগে সত্য গোপন করে বা সত্য গোপনের চেষ্টা করে তাদের সবার জন্য এই বক্তব্য; হোক সে হিন্দু-বৌদ্ধ-ইহুদি-খ্রিস্টান-মুসলমান কিংবা অন্যকোন ধর্মের লেবাসধারী। একটি বস্তু, একজন ব্যক্তি কিংবা কোন নির্দিষ্ট সমাজের প্রেক্ষাপটে কোরআনের আয়াত অবতীর্ণ হলেও তার উদ্দেশ্য থাকে গোটা মানব সমাজ।
©somewhere in net ltd.