নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ভাটি বাংলার কষ্ট
চীন, পাকিস্তান, ভারত ইত্যাদি রাষ্ট্রে বসে রাষ্ট্রীয়ভাবে ভাটি বললে গোটা বাংলাদেশকে বুঝায়। আর বাংলাদেশের ঢাকা-চট্টগ্রাম ইত্যাদিতে বসে ভাটি বললে ফরিদপুর, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ইত্যাদি অঞ্চলকে বুঝায়। আবার ভাটি অঞ্চলে গিয়ে ভাটি বললে আরও ভাটিতে যেতে হয়। আমরা যারা শহর বা নগর, মহানগরে বাস করি তাদের অনেকের অনুভবে ভাটির মানুষের সুখ-দুঃখ কাজ করে না। বর্তমান পাশ্চাত্যমুখি শিক্ষায় শিক্ষিত অনেক ভাটির মানুষ হয়েও ভাটির হাসি-কান্না সম্পর্কে আছেন অজ্ঞ। বিদেশী পোশাক গায়ে দিয়ে তারা বাবু সেজে মাঝেমধ্যে গ্রামে গেলেও দূরে থাকেন সাধারণ মানুষ থেকে। অনেকে গ্রামে চাষা-বোসাদেরকে অবজ্ঞা বা হেয় করতেও লজ্জাবোধ করেন না। তারা ভুলে যান তাদের বাপ-দাদাও যে এই চাষাদের মধ্যকার কেউ। কাকের ময়ূর সাজার মতো আমরা পশ্চিমা দুনিয়াকে অনুসরণ করতে গিয়ে যে ভুলটা করেছি তার ভূগান্তিতে আমরা আজ অনেক ক্ষতির মুখোমুখি। আজ যে বাংলাদেশে অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে যে এত সমস্যা, এর মূলে পাশ্চাত্যমুখি শিক্ষা, তা একটি অন্ধও বুঝে। এই শিক্ষা আমাদের চিন্তা-চেতনাকে মাটি এবং মানুষ থেকে দূরে নিয়ে শুধু আমলা, কামলা আর চামচা তৈরি করে দিচ্ছে। আমলা, কামলা ও চামচার মূল কেবলা সর্বকালেই নগর এবং মহানগরমূখি। তাদেরকে ইংরেজরা শিখিয়েছে দেশ-গ্রাম বিমূখতা। তারা কেটে ফেলেছে তাদের নাভির সম্পর্ক। তারা সুখের সন্ধানে পাগলের মতো দৌঁড়ছে নগর-মহানগরের দিকে। যত তারা যাচ্ছে ততই দেখছে সুখপাখি বহুদূর! পাখা গজানো উঁই পোঁকার মতো তারাও উড়তে গিয়ে আগুনে পোড়ে মরছে। এভাবেই চলছে গোটা বাংলাদেশ।
আমরা ভুলে গেছি এই বাংলাকে সোনার দেশ করেছে ভাটির অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি। আমরা মনে করি শহর-নগরই সবকিছু। গ্রাম বা ভাটি কিছুই নয়। ফলে আমরা তাদের সুখ-দুঃখের খবর রাখি না। সরকার, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় দলসমূহ মিডিয়া দেখানো নামমাত্র সাহিয্য-সহযোগিতা ছাড়া সেদিকে তেমন একটা নজর দেয় বলে মনে হয় না। ফলে ভাটির সমস্যাসমূহ হাওয়র-নদী অতিক্রম করে শহরের শব্দ সমূহ ডিঙিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়।
ভাটির মানুষদের হৃদয়ের টানে আমাকে প্রায়ই যেতে হয় বিভিন্ন অঞ্চলে। বিশেষ করে সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনার ভাটি এলাকাগুলোর মানুষ আমার আত্মার আত্মীয়। তাদের সুখ-দুঃখের সাথে আমি অনেকটাই পরিচিত। তাদের অনেকের কান্না আমাকে যেমন কাঁদায়, তেমনি অনেকের হাসিও আমাকে হাসায়। এখানে আমি কোন বিশেষ এলাকা বা গ্রাম নিয়ে কথা বলতে চাই না। প্রকৃত অর্থে সব এলাকার সমস্যা প্রায় সমান। ভাটির সমস্যাগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ১) যোগাযোগ ব্যবস্থা, ২) শিক্ষা, ৩) চিকিৎসা, ৪) প্রশাসনিক সুযোগসুবিধার অভাব, ৫) মহাজনি সুদ, ৬) নেতাদের শোষণ।
১) যোগাযোগ সমস্যা : ভাটি মানে বর্ষার থৈ থৈ জলে নৌকা ছাড়া কোন রাস্তা নেই। হেমন্তে পায়ে হেটে পথ চলা। বিষয়টি বেশির ভাগে প্রাকৃতিক সমস্যা হিসাবেই চিহ্নিত হয়। তবে কিছুটা রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের অবহেলার কথা অস্বীকার করা যাবে না। অবশ্য কিছু কিছু স্থানে ইতোমধ্যে গাড়ির যোগাযোগ বেশ উন্নত হয়েছে। কিছু স্থানে পাথর-সিমেন্টের ব্লক তৈরি করে এমনভাবে রাস্তার ব্যবস্থা রয়েছে যা বর্ষায় পানির নীচে গেলেও রাস্তার তেমর ক্ষতি হয় না। তারপরও বলতে হবে, চাইলে সরকার যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত করতে পারতো। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্যে, শিক্ষায় আরও এগিয়ে যেতে পারতো।
২) শিক্ষা সমস্যা : ভাটিতে শিক্ষা সমস্যা অত্যন্ত মারাত্মক। প্রথমতো যোগাযোগের অভাবে অনেক ছাত্র-ছাত্রী স্কুলে যেতে পারে না। গ্রাম পর্যায়ে এনজিওদের কিছুটা প্রাইমারি স্কুল থাকলেও মাধ্যমিক স্কুলে যেতে হয় সাত-আট মাইল দূর বর্ষায় নৌকা দিয়ে আর হেমন্তে পায়ে হেটে। প্রতিদিন যেতে সাত এবং আসতে সাত মোট চৌদ্দ মাইল হাটতে হয়। ছেলেদের জন্য বিষয়টি সহজ হলেও মেয়েদের জন্য খুবই কষ্টদায়ক। সরকার ইচ্ছে করলে ভাটি অঞ্চলের জন্য ইউনিয়ন কিংবা উপজেলা পর্যায়ে একটি প্রতিষ্ঠানকে প্রধান কেন্দ্র করে পৃথক শিক্ষনীতি প্রণয়নের মাধ্যমে গ্রাম ভিত্তিক একেকটি মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠান চালু করতে পারতো। এতে গ্রাম থেকে আরও শিক্ষিত উঠে আসতো। রাষ্ট্রে শিক্ষিতের হার বৃদ্ধি লাভ করতো। নারী-পুরুষ সবার জন্য মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করে সরকারের উচিত এই ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনে প্রত্যেক এলাকার ধনীদের কাছ থেকে সরকারীভাবে আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করা যেতো। যে সকল এনজিও শিক্ষা বিষয়ক কর্মসূচী নিয়ে কাজ করছে তাদেরকে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে এবং সৎ উদ্দেশ্যে আরও নজরদারীতে নিয়ে এসে শিক্ষা কর্মসূচীকে আরও ব্যাপক করা যেতে পারে। শিক্ষাকে আরও ব্যাপক করতে মাদরাসা এবং মসজিদগুলোর সাহায্য সরকারী উদ্যোগে গ্রহণ করা যেতে পারে। কওমী মাদরাসার আলেম সমাজের অভিজ্ঞতাকে ইসলামিক ফান্ডেশনের মাধ্যমে কাজে লাগানো যেতে পারে। মসজিদ কেন্দ্রিক গণশিক্ষা চালু করা যেতে পারে। শিক্ষা বিষয়ক পরিল্পকদেরকে বিদেশী চশমা খুলে দেশীয় চশমা চোখে দিয়ে গ্রামগুলোতে শিক্ষা আন্দোলন শুরু করতে হবে।
৩) চিকিৎসা সংকট : ভাটির গ্রামগুলোতে চিকিৎসকের সংকট খুবই মারত্মক। সুচিকিৎসার অভাবে মানুষ বিভিন্ন প্রকার শারিরিক কষ্টে আছে। একজন মারাত্মক রোগীকেও ডাক্তার দেখাতে হলে উপজেলা সদরে যেতে হয়, আবার উপজেলা সদরেও যাওয়া সহজ নয়। এখানে অসুবিধা একদিকে অর্থনৈতিক, অন্যদিকে যোগাযোগ ব্যবস্থা। মহিলাদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত অসুবিধা সামাজিক এবং পারিবারিক তো রয়েছেই। মহিলাদের সামাজিক সমস্যা হলো সে মহিলা ডাক্তরের অভাবে নিজের রোগ সম্পর্কে ডাক্তারকে সবকিছু বলতে পারছে না, ফলে সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছে না। মহিলাদের পারিবারিক সমস্যা হলো, সে চাইলেই ডাক্তারে যাওয়ার অনুমতি পাচ্ছে না এবং সে যার-তার সঙ্গেও যেতে পারছে না। এই সুযোগে কিছু অসাধু কবিরাজ ও লালসালু মার্কা পির চিকিৎসার নামে সাধারণ নারীদেরকে ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে। এভাবে ভাটি বাংলার মানুষ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সরকারের উচিৎ উপজেলাকে কেন্দ্র করে গ্রাম ভিত্তিক চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করা। এক্ষেত্রেও এলাকার ধনীদের সহযোগিতা সরকারীভাবে গ্রহণ করা যেতে পারে।
৪) প্রশাসনিক সুযোগসুবিধার অভাব : ভাটি বাংলায় প্রশাসনিক সুযোগসুবিধার অভাবে মানুষ বিভিন্ন প্রকারের জটিল সমস্যায় আটকে থাকে। একজন গরীব মানুষ প্রশাসনিক প্রয়োজনে জেলা কিংবা উপজেলা সদরে চাইলেই আসতে পারে না যোগাযোগের অভাবে। ধর্মপাশা থেকে সুনামগঞ্জ আসতে যে খরচ ও সময় প্রয়োজন হয় তা অনেক মানুষের পক্ষে ব্যবস্থা করা সম্ভব হয় না। ফলে তারা বিভিন্ন প্রকার আইনী জটিলতায় আটকে থাকে। এক্ষেত্রে ইউনিয়ন কিংবা উপজেলা কেন্দ্রিক প্রশাসনকে আরও শক্তিশালী করা যেতে পারে। বিশেষ করে ভাটি বাংলার জন্য পৃথক নীতি গ্রহণ করা যেতে পারে।
৫) মাহাজনি সুদ : ভাটি বাংলায় মাহাজনি সুদ একটি মারাত্মক রোগ। কৃষকদের প্রায় পরিবারকেই দেখা যায় বিভিন্ন প্রকারের সুদের সাথে জড়িত। জমিদার প্রথা শেষ হলেও তাদের সুদী নীতিগুলো এখনও ভাটি সমাজে চালু আছে। লগন লাগানোর প্রথা এখনও চালু রয়েছে। এই সুদ প্রথা বিভিন্ন প্রকারের অপকর্মেরও জন্ম দিচ্ছে। অনেক কৃষক বাড়ি ও জমি বন্ধক দিয়ে সুদ নিয়ে শেষ পর্যন্ত বাড়িÑঘর ছাড়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে মানুষকে আরও সচেতন করতে হবে।
৬) নেতাদের শোষণ : ভাটি বাংলায় জমিদারী প্রথা না থাকলেও নেতারা একেকজন জমিদার হয়ে আছেন। তারা সাধারণ মানুষকে থানা, মামলা ইত্যাদির ভয়-ভীতি দেখিয়ে বিভিন্নভাবে শোষণ করছে। বিশেষ করে ভাটি মূল সম্পদ নদী, হাওড় কিংবা বিভিন্ন জল মহলগুলোকে তারা সরকারী লিজের নামে হাতিয়ে নিচ্ছে। একটা হাওড়ে যদি ছোট একটি সরকারী জল মহল থাকে তা হলে গোটাও হাওড়ই চলে যায় লিজের অধিনে, আপানি যতই এই হাওড়ে জমির মালিক হোন না কেন আপনার জমিনেও মাছ শিকার করতে পারবেন না। নদীগুলো সরকারের অধীনে লিজ হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ চাইলেও তার বাড়ির সামনে নদীতে মাছ ধরতে পারবে না। গরীব মানুষগুলো প্রতিদিন নদীর বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, কিন্তু একদিনও নদীর সুফল গ্রহণ করতে পারছে না। নেতারা সবই নিয়ে যাচ্ছেন লিজের নামে। নদী কিংবা হাওড় লিজ হোক তাতে আমাদের আপত্তি নেই, কিন্তু এই টাকা গ্রামের উন্নয়নে ব্যবহার করা হোক।
ভাটি বাংলার সমস্যাগুলোকে আমাদের অবশ্যই ভাবতে হবে। ভাবতে হবে সমস্যাগুলোর সমাধান কীভাবে সম্ভব তা নিয়ে। সরকার ও জনগণ সবাইকে ভাবতে হবে। বাঁচাতে হবে বাংলাদেশের কৃষক পরিবারগুলোকে। কৃষক বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ।
©somewhere in net ltd.
১| ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ২:৪১
বিজন রয় বলেছেন: চিন্তার বিষয়।