নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আরও কত দূরে আছে সে আনন্দধাম...

সেলিম তাহের

স্মরণে ত্বরণ, স্পর্শে মুক্তি

সেলিম তাহের › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাংলার ভাবান্দোলনঃ জালালগীতিকা পাঠ

১৯ শে জুন, ২০১০ ভোর ৬:৪৯

শিল্পী আব্বাসউদ্দিনের কন্ঠে গাওয়া ‘ও আমার দরদী, আগে জানলে’, ‘আরে ও ভাটিয়াল গাঙ্গের নাইয়া’ অথবা আবদুল আলীমের কন্ঠে ‘দয়াল মুর্শিদের বাজারে’ বা ‘সেই পাড়ে তোর বসত বাড়ি’ ইত্যাদি জনপ্রিয় গানগুলোর কথা আপনাদের অনেকেরই মনে আছে নিশ্চয়ই? বাংলাভাষী প্রায় সবাই এই গানগুলো জানলেও, আমি সন্দিগ্ধ যে তাঁদের মধ্যে কমই জানেন সেগুলোর রচয়িতাকে- তাঁর বহুবর্ণ রচনা সম্ভারকে।



তাঁর নাম সাধক জালালউদ্দিন খাঁ (১৮৯৪-১৯৭২, বৃহত্তর ময়মনসিংহের বর্তমান নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানার আসদহাটি গ্রামে তাঁর জন্ম), লালনোত্তর এই বঙ্গীয় ভাবান্দোলনের সর্বধর্মসমন্বয়ের এক মরমী মানবতাবাদী দার্শনিক, মনীষী, কবি এবং শেষ অর্থে একজন গীতিকার। হাজারখানেকের মতো গান তিনি লিখে গেছেন (মতান্তরে প্রায় বারশ’ গান)। ভাবা যায়!!



দোহাকোষ ও চর্যাপদ থেকে শুরু করে মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য, সহজিয়া সাহিত্য, গাথা ও গীতির পরম্পরায় বাংলা সাহিত্যের যে বেগবান ধারাটি এই লোকায়ত ব-দ্বীপের অন্তররম ঐতিহ্য এবং লোকজীবনের মর্ম-উৎসারী বহুমাত্রিক চর্যা ও সাধনার ধারক, জালালউদ্দিন খাঁ সে ধারারই একজন বিশিষ্ট প্রতিনিধি। তাঁর সৃষ্টিসম্ভার লৌকিক জীবনবোধের ফল্গুধারায় নিষিক্ত, দেশজ জ্ঞান ও ভাবের আলোকচ্ছটায় দীপ্ত, গভীর জীবন-জিজ্ঞাসা ও প্রখর যুক্তির উৎসারণে এক সহজ মানবিকতার অভিসারী। বিশ শতকের উন্মেষলগ্ন থেকে পরবর্তি কয়েক দশকের নিরবচ্ছিন্ন চর্চায় গানের যে বর্ণিল জগৎ তিনি গড়ে তুলেছেন, তা বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কৃষিজীবি মানুষের মনোলোকে বিভা ছড়িয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এ গান তাদের প্রাণের গান। আজ যখন উৎসের দিকে ফেরার, দেশ ও মানুষের ভাবজগতকে আরো গভীরভাবে বোঝার এবং ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়বার তাগিদ মূর্ত হয়ে উঠেছে আমাদের চিন্তায়- তখন জালালউদ্দিন খাঁর সঙ্গীতসম্ভার আমাদের কাছে আরো প্রাসঙ্গিক, আরো জরুরী।



জালাল কি ‘লোককবি’?



এক শ্রেণীর কবিকে অবমানিত করার সচেতন উদ্দেশ্য নিয়েই ‘লোককবি’ আখ্যা দেওয়া হয়- এমন বললে নিশ্চয়ই তা হবে অতি সরলীকরণ। আসলে ‘লোককবি ছাড়া অন্য জুৎসই অভিধা এঁদের জন্য খুঁজে পাওয়াই শক্ত। কিন্তু প্রাকৃত ও প্রাকৃতজ সকল ভাষার মতোই বাংলাকে যে জন্মলগ্ন থেকে অনভিজাত লোকসাধারণই লালন-পালন করে এসেছে এবং অভিজাত ক্ষমতাধররা যে একে আঁতুরেই মেরে ফেলতে সচেষ্ট থেকেছে, তা ইতিহাস সিদ্ধ। বিশ দশকের (বিংশ শতাব্দী) কোলকাতাকেন্দ্রিক ‘বাবু’ রেঁনেসার পুরোধা প্রমথ চৌধুরী থেকে শুরু করে ‘সবুজ পত্রের’ বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ, অমিয় চক্রবর্তী প্রমুখ যখন একদিকে রবীন্দ্র বলয়ের ‘নাগপাশ’ থেকে বেরিয়ে এসে ক্রশবিদ্ধ যীশুর যন্ত্রণাকাতর পশ্চীমা আধুনিকতার পতাকাকে বাংলা সাহিত্যের মিশেলে ‘আধুনিক’ করে তুলতে ব্যস্ত, ঠিক একই সাথে তাঁরা ‘মফস্বলী’ দেশজ ভাবুক কবিদের নাক শিঁটকানো মানসিকতা নিয়ে নাকচ করে দিতে একটুও কার্পণ্য করেননি। এভাবেই তারা নাকচ করে দিয়েছিলেন উনিশ-বিশ শতকের ‘আধুনিক’ বাংলা সাহিত্যের সমান্তরালে বহমান এই ‘সনাতন মফস্বলী’ ধারার লালন শাহ, শীতালং শাহ, পাগলা কানাই, দুদ্দু শাহ, নেধু শাহ, পাঞ্জু শাহ, হাছন রাজা, আজাহার বয়াতি, রমেশ শীল, মুকুন্দ দাস, মনোমোহন দত্ত, কানাইলাল শীল, ভবা পাগলা সহ বিশ শতকের জালালউদ্দিনকেও।

নাগরিক সাহিত্যের এই ধারাটি যতই প্রতাপান্বিত হোক না কেন, বাংলা সাহিত্যের সনাতন ধারাটির প্রবাহ কিন্তু কখনও রুদ্ধ হয়নি। আগের মতোই প্রাকৃতজন বা লোকসাধারণের মধ্যে তা যথারীতি প্রবহমান থাকে। বাংলার সনাতন ধারার এ সাহিত্য যেহেতু একান্তরুপেই ‘লোকায়ত’, তাই ‘লোক’ কথাটির সনাতন অর্থের বিচারে তাঁদের ‘লোককবি’ অবশ্যই বলা যেতে পারে। তবে ‘লোককবি’ আখ্যা দিয়ে তাঁদের প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দেয়া প্রকারান্তরে কুলীন ‘আধুনিক’ সাহিত্যচূড়ামনিদের মফস্বলী সংকীর্ণতারই পরিচায়ক।



মধ্যবিত্তের ‘আধুনিকতা’ বনাম বাংলার ভাবান্দোলনে প্রগতিশীলতার মর্মশাঁষ



বিশ শতকে যখন বাংলার নাগরিক সাহিত্যে হিন্দু রিভাইভ্যালিসমের (revivalism) প্রতিক্রিয়ায় মুসলিম রিভাইভ্যাইভালিসমের সাম্প্রদায়িকতা প্রকট হয়ে উঠে, তখনও কিন্তু মূলধারার কবিরা সকল ধরনের সাম্প্রদায়িকতা ও রিভাইভ্যালিসমের কু-প্রভাব থেকে মুক্ত থেকেছেন। শুধু তাই নয়। নাগরিক মধ্যবিত্তের বাংলা কবিতায় যখন কলাকৈবল্যবাদেরই প্রাধান্য, তখন বাংলা কবিতার মূলধারার কবিদের মধ্য থেকে প্রতিনিধিত্বশীল রুপে অন্ততঃ চারজন কবির কথা আমরা স্মরণ করতে পারি। এঁরা হচ্ছেন হরিচরণ আচার্য, মুকুন্দ দাস, রমেশ শীল ও নিবারণ পন্ডিত। তাঁদেরই উত্তরসূরী সাধক জালালউদ্দিন খাঁ। তাঁদের কবিতা-গানের আঙ্গিক আর ভাববস্তু বাংলার মূলধারার কবিতারই বিবর্তঞ্জাত। সেই বিবর্তনে কবিরা বারবার প্রথাবদ্ধতাকে ভেঙ্গেছেন, সামাজিক জড়তাকে আঘাত করেছেন। অথচ এই কবিরা নাগরিক মধ্যবিত্ত অভিজাতদের হাতে রচিত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কবি বলেই স্বীকৃতি পাননি। যাঁরা এঁদের সম্পর্কে আলোচনা করেছেন, তাঁরাও এঁদেরকে ‘কবি’ বলেননি। বলেছেন ‘লোককবি’ বা ‘কবিয়াল’।



ইতিহাস যে কেবল তথাকথিত ভদ্রজন বা মধ্যবিত্ত শিক্ষিতজনদের জন্যই সংস্কৃতি-সম্পদের যোগান নিয়ে আসে না, ব্রাত্যজন তথা অনক্ষর গ্রাম্যজনের জন্যও যে রয়েছে তার দাক্ষিণ্য- বাংলার সংস্কৃতি জগতে রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রত্তোর বিশ শতকের কুলীন ‘আধুনিক’ কবিদের আগমন-নিষ্ক্রমণ যেন তারই প্রমাণ বহন করে। এ বিষয়ে খুব মজার ঘটনার উল্লেখ করেছেন একজন লেখক। তিনি লিখেছেন, “রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকীর বছরের গল্প শুনছিলাম। কোন নিতান্তই অজপাড়াগেঁয়ে শতবার্ষিকীর উদ্যোক্তাদের বিপন্ন করে এক কৌতুহলী মানুষ নাকি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘বাপু এই যে কবি কবি বলছো, এই কবি রবি ঠাকুরটি কে? কই আমাদের গাঁয়ের দিকে তো কোনদিন গান গািতে আসেনি!’ অবাক হবার কিছু নেই এই গল্পে, কারণ এমনকি আজকের দিনেও গ্রামের মানুষের এক বিশাল অংশের কাছে কবি মানেই কবিয়াল। মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির নায়ক রবীন্দ্রনাথের সাথে কবিয়াল রমেশ শীল, গোমানি দেওয়ানদের পার্থক্য খুবই মৌলিক, একেবারে শ্রেণী-অবস্থানের। গ্রামীণ সংস্কৃতির কবি তাই অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত কবিয়ালেরাই। বলাই বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দ নন।” –পুলক চন্দ (‘গণকবিয়াল রমেশ শীল ও তাঁর গান’, কলিকাতা, ১৯৭৮, পৃষ্ঠা ১)



জালালউদ্দিন খাঁ যাঁদের উত্তরসাধক তাঁরা জন্মসূত্রে কেউ ছিলেন হিন্দু, কেউ মুসলমান। কিন্তু ওই হিন্দুত্ব বা মুসলমানত্ব ছিল তাঁদের ইচ্ছা-নিরপেক্ষ বাস্তবতা। সেই অমোঘ বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে তাঁরা হিন্দু কিংবা মুসলমান সমাজের অন্তর্গত হয়ে জীবন যাপন করেছেন। কিন্তু অন্তরের গভীরে তাঁরা ছিলেন অন্যরকম। তাঁদের নিজস্ব ধর্মবোধে শাস্ত্রীয় হিন্দু, বৌদ্ধ বা ইসলাম ধর্মের হুবহু অনুসৃত ছিল না। তাঁদের ঈশ্বর-বিশ্বাসও শাস্ত্রীয় ঈশ্বর-বিশ্বাস থেকে পৃথক। ঈশ্বরকে ও বিশ্বব্রহ্মান্ডকে তাঁরা মানবদেহের মধ্যেই উপলব্ধি করেছেন। ‘যা নাই ভান্ডে, তা নাই ব্রহ্মান্ডে’- অর্থাৎ সারা ব্রহ্মান্ডে যা আছে তার সবই আছে মানব্দেহের ভেতরে- এটাই তাঁদের ধর্মবোধ ও জীবনবোধের ভিত্তি।



জালালের কাব্যপাঠ



‘বাউল কবি’ বলে পরিচিত হলেও জালালউদ্দিন খাঁ সংসার-বিবাগী, উদাসী কিংবা আখড়াবাসী ছিলেন না। ঘোর সংসারী ছিলেন তিনি। তবে সংসারবাসী হলেও একধরণের নির্লিপ্তি তাঁর সমগ্র সত্তায় পরিব্যপ্ত ছিল। এদিক দিয়ে তাঁর সঙ্গে মূলধারার আরেক কবি সুনামগঞ্জের হাছন রাজার অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ধর্মভাবনায় শুধু যে হাছন রাজা ও জালাল খাঁরই ঐক্য ছিল, তা নয়।



জালালউদ্দিন খাঁ’র যাপিত জীবন ও জীবনদর্শন- এই দুয়ের মধ্যে কোন অনৈক্য বা বৈপরিত্য ছিল না। তাঁর কবিতা চর্চা তথা সংগীত-সাধনাও ছিল তাঁর যাপিত জীবন ও জীবনদর্শনের সাথে একই সূত্রে গাঁথা। আর এসবের সঙ্গেই জড়িত মিশ্রিত ছিল লোকায়ত ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। সেই উত্তরাধিকারের কেবল ভারবাহী ছিলেন না তিনি, কিংবা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের নির্বিচার ভোগেই জীবন কাটিয়ে দেননি। সময় ও পারিপার্শ্ব সম্পর্কে সচেতন এই মানুষটি ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারকে আপন সময় ও পরিপার্শ্বের উপযোগী করে নেওয়ার প্রয়োজন সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। সেই অবহিতির পরিচয়ই তাঁর রচনার পরতে পরতে ধরা আছে।



জালাল তাঁর কবিতা তথা গানগুলো ‘জালালগীতিকা’ নাম দিয়ে চার খন্ডে প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় জালালগীতিকার পঞ্চম খন্ড। গীতিকা’র পরিবর্তে ‘গীতি’ নাম দিলে হয়তো এ্যাকাডেমিক ধারার আলোচকরা স্বস্তি পেতেন। কারণ দীনেশ চন্দ্র সেন সম্পাদিত ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ ও ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’ প্রকাশের পর থেকে ‘গীতিকা’ শব্দটি আর কবিতা বা গান অর্থে ব্যবহৃত হইয় না। এখন এর অর্থ দাঁড়িয়েছে গাথা বা ballad। তবু ‘জালালগীতিকা’কে আমাদের জালাল রচিত গীতি রুপেই গ্রহণ করতে হবে। মূলধারার গীতিকবিতায় গীতি (গান) আর কবিতা তো সমার্থক। এখানে গীতিই কবিতা, কবিতাই গীতি। এরই অনুস্মৃতি আমরা রবীন্দ্রনাথের গীতালি, গীতিমাল্য, গীতাঞ্জলী পর্যন্ত দেখতে পাই।



জালালগীতিকার প্রথম খন্ডে ২০২ টি ও দ্বিতীয় খন্ডে ২২৮ টি গীতি প্রকাশিত হয়েছিল। এবং দুই খন্ডেই গীতিগুলোকে কবি ১৪ টি ‘তত্ত্ব’-এ বিভক্ত করে প্রকাশ করেছিলেন। সেই তত্ত্বগুলো হচ্ছেঃ আত্মতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, সংসারতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, মাতৃতত্ত্ব, লোকতত্ত্ব, দেশতত্ত্ব, বিরহতত্ত্ব ও ভাটিয়ালি। শেষোক্ত ‘ভাটিয়ালি’কে অবশ্য তত্ত্ব বলা চলে না, এটি আসলে প্রাকৃত বাংলার একটি বিশিষ্ট গীতিরুপের নাম।



এখন এই ১৪টি ‘তত্ত্ব’ থেকে একটি করে স্থায়ী ও প্রথম অন্তরার সংক্ষিপ্তসার উদাহরণ দিয়ে রচনাটির ইতি টানতে চাই।



আত্মতত্ত্ব (২য় খন্ড-তিন)

আমি তুমি তুমিই আমি দুজনার এক পরিচয়

শাস্ত্র পড়ে আমার জানা কখনও কিন্তু নাহি হয়।।

প্রেম কালিতে পরাণ আঁকা স্বভাব নিলে যাবে দেখা

খুঁজিতে হয় একা একা, দুজনারই কার্য নয়।।



পরমতত্ত্ব (১ম খন্ড-পাঁচ)

রুপের ঘরে ডুব দিয়ে দেখ ‘স্বরুপ’ ছাড়া নাই সাধন

স্বরুপ তোমার সেই রুপ বটে, ঘটে ঘটেই নিরঞ্জন।।

স্বরুপে রুপ মিশে যাহার, হয়ে যায় একই আকার

কাষ্ঠ লোহা পুড়ে অঙ্গার, আগুনেতে হয় যেমন।।



নিগূঢ়তত্ত্ব (৩য় খন্ড- দুই)

শূণ্য হতে শূণ্য হয়ে ষূণ্যে বদ্ধ রই আবার

তুমি শূণ্য আমি শূণ্য শূণ্য আমার চারি ধার।।

দুনিয়ায় সব শূণ্য কান্ড, শূণ্যময় এই ব্রহ্ম অন্ড

বিচার কালে শূণ্য দন্ড শুণ্যে শুণ্য এক আকার,

এই অনন্ত মহাশূণ্য ব্যাপিয়া যে আছে শূণ্য

সপ্ত শূণ্য কোটির মাঝে নব শূণ্যের আবিষ্কার।।



দেহতত্ত্ব (৩য় খন্ড-আট)

পঞ্চ আত্মা ছয় রিপু আর অষ্ট শক্তি আছে এই ঘরে

দিন ফুরালে কেউ কারো না যার তার মতে যাবে ছেড়ে।।

পাঁচ পাঁচা পঁচিশের ঘরে তত্ত্ব চব্বিশ রয়

বাহির ভিতর দশ ইন্দ্রিয় আগেই জন্ম লয়

মনের পাছে জ্ঞানের উদয় হইতেছে এই ভবপুরে।।



সৃষ্টিতত্ত্ব (১ম খন্ড-দুই)

বাসনায় বিভেদ্য জীব, নিবৃত্তি প্রাণ তুমিময়

তা না হলে সারা বিশ্বে আমি তুমি কেবা কয়।।

জাগন্ত বাসনার বলে তরুশাখে ফুলে ফলে

সজীব চেতন ভূমন্ডলে, কর সৃষ্টি-স্থিতি-লয়।।

তুমি না জাগিলে প্রভু আমি না হিতাম কভু

সাধ মিটে না তোমার তবু বারে বারে করে ক্ষয়।।

আমারি ঐ জন্ম-মরণ, খন্ড ভাবের সুনির্দর্শন

পন্ড হবে খন্ড যখন- অখন্ড সে কেবল রয়।।

আমি বলতে নাই কিছু আর “সর্বংসত্ত্ব” বিশ্ব তোমার

আমায় নিয়ে জাগিস নে আর, লীলার ছলে দয়াময়।।

তোমার প্রেমের চাপায় পড়ে কষ্ট পেলেম জীবন ভরে

সুখ দিয়ে দে জন্মান্তরে তীত প্রেমের বিনিময়।।

জালালে কয় হিসাব নিবে, শুনেছি তুই শাস্তি দিবে

তোর বিচার তুই করিবে, আমার কিবা আছে ভয়?



সংসারতত্ত্ব (৩য় খন্ড-দশ)

কূল না পেয়ে ভেসে আছি সদায় মনের ভাবনা

যারে চেয়ে জীবন গেল তারে কি আর পাব না?

দেখব বলে করে আশা সার হল অকূলে ভাসা

হায় নিদারুণ ভালবাসা তোর কাছে আর যাব না।।

এবার যদি বাঁচি প্রানে বাঁধব হৃসয় পাষাণে

মন দিয়া তার বাঁশির গান দৈ জেনে চুন খাব না।।



সাধনতত্ত্ব (২য় খন্ড-সাত)

আরশিতে যা দেখবে তুমি পাবে তারে সাধনায়

পরকে সাধন করলে পরে পাবেরে সেই আপনায়।।

দেহ-নৌকায় তিনটি গুণ টানিতেছে তিন জনায়

পাছায় বসা মানুষ একজন, হালের বৈঠা সেই ঘুরায়।।



গুরুতত্ত্ব (২য় খন্ড-আট)

আপন বলে দুনিয়াতে ভাবতেছ মন তুই কারে?

একাই শুধু যেতে হ্লাগে যাবি যে দিন ভব পারে।।

তেরো নদী সপ্ত সাগর, পাথর ভাসে জলের উপর,

মধ্যে গরম বালুর চর, কাছে গেলেই ডাকািতে মারে।।

রাস্তা-ঘাতের পাই পরিচয়, ঘোর অন্ধকার সব সময়,

ফিরে এসে কেহই না কয় কোথায় গিয়া কী করে।।

দেখে যাও আজ বিশ্বসাসী, জানি না আর কবে আসি

গলে বান্ধা যমের ফাঁসি বুক ভাসিছে অশ্রুধারে।।

জালালের এই ভাঙ্গা নায় আর একজন পার হিতে চায়

সেই মানুষটি আছে কোথাঊ ভাবুক বিনে জানে নারে।।



প্রেমতত্ত্ব (২য় খন্ড-পাঁচ)

প্রেম করা হবে না আর থাকলে কুলের ভয়

প্রেমিক যারা জীবন ভরে কত দুঃখের বোঝা বয়।।

ধরম করম লোকাচার প্রেমিকের নাই সে বিচার

কুল মান হারাইয়া তার প্রেমেতেই মজিয়ে রয়

আত্মসুখের একটি কণা থাকতে কারও প্রেম হবে না

মুখের কথায় প্রেম জোটে না সকল ছেড়ে দিতে হয়।।



মাতৃতত্ত্ব (১ম খন্ড-তিন)

মেয়েরুপী কাল-সাপিনী, জগত খেয়ে চেয়ে রয়

অবিচারে পুরুষ মরে, মেয়ে কিন্তু দোষী নয়।।

যত আছে মায়ের বংশ, আদ্য-শক্তির অর্ধ-অংশ

তার কাছে সবাই ধ্বংস, ধনী কাঙাল যত হয়।।

ফুল ফোটে যার বারো মাস, তাতে হয় শক্তি বিকাশ

তার চরনে হয়ে দাস, মধু খায় যে মৃত্যুঞ্জয়।।

উথলিয়া লোহিত সাগর, তিন দিন ভাসে লহর

মানুষ গড়া ছাঁচের ভিতর, নূতন মানুষ জন্ম লয়।।



লোকতত্ত্ব (১ম খন্ড-আট)

পাগলের হাট বাজারে দেবগণ যুক্তি করে

এ বিশ্বের মঙ্গল তরে ঘুরিয়ে বেড়ায়।।

সত্ত্ব-রজ-তম গুণে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ তিনে

ছিল তারা সাধনে যোগ-মায়ার দায়,

পরে সে মা কুন্ডলিনী সাজিয়ে যোগিনী

রা হয়ে ভেসে তিনি বাসনা পুরায়।।



দেশতত্ত্ব (১ম খন্ড-দশ)

জীবন আমার ধন্য যে হায়

জনম মাগো তোমার কোলে।।

স্বর্গ যদি থেকেই থাকে

বাংলা মা তোর চরণ মূলে।।

মলয় ধোয়া সবুজ শ্যামল

ছায়া ঢাকা অঙ্গ শীতল

গাহে পাখি কুঞ্জবনে

আমিয় ঝরে ফুলে ফুলে।।



বিরহতত্ত্ব (১ম খন্ড-পাঁচ)

দিন গেল বিফলেরে বন্ধু, দিন গেল বিফলে

মনের মতন মানুষ রতন পাইলে যতন করিব বলে।।

বলা জানিয়া এলোনা পিয়া, বসিয়া কাঁদি নরলে

কিবা দোষে দোষী অভাগিনী দাসী, কাল শশী বসে না ফুলে।।

পুরুষ জাতি পাষাণ অতি, পীরিতি জানে না কোন কালে

নারীর বেদনা বুঝিয়ে বুঝেনা, কোন পরাণে রয়েছে ভুলে।।

গেল দু’টো আঁখি মরণ বাকি পৃথিবী সাক্ষী অন্তিম কালে

রয়ে গেল আশা কুল-ধর্ম নাশা প্রেমের পিয়াসা কেন রাখিলে।।



তথ্যসূত্রঃ জালালগীতিকা সমগ্র, জালালউদ্দিন খাঁ। সম্পাদনাঃ যতীন সরকার



স্বীকারোক্তিঃ এই রচনাটির একটি বড় অংশ খন্ড খন্ড ভাবে সরাসরি জালালগীতিকা সমগ্র গ্রন্থের সম্পাদকীয় থেকে উদ্ধৃত করেছি।

মন্তব্য ১১ টি রেটিং +৮/-০

মন্তব্য (১১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৯ শে জুন, ২০১০ সকাল ৭:১৬

প্রজা-পতি বলেছেন: অনেক কিছু জানলাম।

১৯ শে জুন, ২০১০ রাত ৯:৩৫

সেলিম তাহের বলেছেন: আচ্ছা।

২| ১৯ শে জুন, ২০১০ সকাল ৮:১০

জেগে আছি বলেছেন: নাইস লেখা +

১৯ শে জুন, ২০১০ রাত ৯:৩৬

সেলিম তাহের বলেছেন: থ্যাংক ইয়্যু।

৩| ২০ শে জুন, ২০১০ বিকাল ৪:৫৮

রাত্রি২০১০ বলেছেন:

আরশিতে যা দেখবে তুমি পাবে তারে সাধনায়
পরকে সাধন করলে পরে পাবেরে সেই আপনায়।।

দারুন! খুব খুব ভাল লেগেছে। লোকগীতির গায়কদের নিয়ে লিখবেন?

২০ শে জুন, ২০১০ বিকাল ৫:৫৫

সেলিম তাহের বলেছেন:

রাত্রি২০১০ বলেছেন: লোকগীতির গায়কদের নিয়ে লিখবেন?

>> বাপরে! দিলেন তো ফাঁসিয়ে।

প্রথমতঃ আমি গবেষক নই। নিছক খুন্নিবৃত্তি করে খাই। নব্বইয়ের দশকের প্রথম ভাগে “নবপ্রাণ আন্দোলন” নামে একটা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়। বাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য বাউল, দেহতাত্ত্বিক আর মরমী গানের একটা বিশাল আর্কাইভ তিল তিল করে গড়ে তুলে তাঁরা। আমিও পাকে চক্রে একসময় জড়িয়ে যাই তাঁদের সঙ্গে। ইচ্ছে আছে নবপ্রাণের আর্কাইভ থেকে কিছু গান সংগ্রহ ক’রে একটা পোস্ট দেবার। দেখা যাক!

৪| ১৮ ই জুলাই, ২০১০ রাত ১২:০৮

ব্লগার কমল বলেছেন: জালাল খাঁ নিয়া আমার যথেষ্ঠ আগ্রহ। তার একটা বই আছে বিশ্বরহস্য, সেইটা যদি আপনার খোঁজে থাকে তবে আমি কপি করে নিতে আগ্রহী। আপনার লেখাটা ভালো হয়েছে এই কথাটা বলতে চাইছিলাম না। কিছু মনে করবেন না। বলেই ফেললাম।

১৮ ই জুলাই, ২০১০ ভোর ৫:৫৯

সেলিম তাহের বলেছেন: ব্লগার কমল, জালালকে নিয়ে আপনার “যথেষ্ঠ আগ্রহের” কথা জানতে পেরে সত্যি আপ্লুত হলাম। আপনার জ্ঞতার্থে জানাচ্ছি, তাঁর ওই বইটির নাম ‘বিশ্বরহস্য’ নয়, বরং ‘বিশ্ব পরিচয়’। এটি জালালের একটি বিখ্যাত গদ্য রচনা। অনেক আত্মশ্লাঘার সাথে বলতে হচ্ছে যে, বইটি আমার সংগ্রহে ছিল যখন আমি দেশের বাইরে অবস্থান করতাম। দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের সময় এই বইটি সহ আমার আরো অনেক প্রিয় বই সাথে করে নিয়ে আসতে পারিনি। ‘বিশ্ব পরিচয়’ বইটি আপনি বাংলা একাডেমিতে খোঁজ করে দেখতে পারেন।

বাংলা একাডেমি বা শিল্পকলা একাডেমির দায়িত্ব বাংলা ভাষার এই শীর্ষস্থানীয় কবি ও ভাবুকের সকল রচনার সংগ্রহ অবিলম্বে প্রকাশ করা।

আপনার মন্তব্যের সূত্র ধরে জালাল সম্পর্কে আরো কিছু কথা বলবার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। জালালের গান বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয়। “এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া, এতো জত্নে গড়াইয়াছেন সাঁই”, "মানুষ রতন করো তারে যতন, যারে তোমার প্রাণে চায়”, “কেহ করে বেচাকেনা কেহ কাদেঁ রাস্তায় পড়ে ধরবি যদি তারে দয়াল মুর্শিদের বাজারে”... আব্দুল আলীমের কন্ঠে এই গানগুলো শুনেননি, অমন মানুষ খুব কম।

বাংলা একাডেমি জালালের উপর একটি জীবনীগ্রন্থ বের করেছে। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে তার একটা স্বীকৃতি আছে। জালাল ঔপনেবিশেক শাষণ দেখেছেন, পাকিস্তানি শাসনামলও দেখেছেন। কিন্তু যে দিকটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ সেটা হলো সাধারণ মানুষের সংস্কৃতির মধ্যে জাতীয়তাবাদ কখনই মাথাচারা দিয়ে উঠতে পারেনি। কেন জাতি, জাতীয়তাবাদ, বাঙালিত্ব, বাঙালিপনা ইত্যাকার বিষয়গুলো সাধারণের সংস্কৃতির উঠোনে প্রবেশাধিকার পায়নি, সেটা গভীর গবেষণার বিষয়। একদমই পা পড়েনি, সেটা বলা ভুল হবে। কিন্তু পিঁড়ি পায়নি। অর্থাৎ বসবার জন্য কেউ কোন আসন এগিয়ে দেয় নি। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী যখন নিজেদের “বাঙ্গালি” হিসেবে গড়ে তোলার সাধনা করছে, তখন এরা তাদের আত্মপরিচয় তখনও অন্বেষণ করছেন ‘মানুষ’ নামক ধারণার মধ্যে। সেই পুরোন আদি অন্বেষণ। যার ইশারা বরাবরই ভাবুককে উন্মাদ করে তোলে। ইংরেজ/বাঙালি, বা পাকিস্তানি/বাঙালি এই প্রকার ভেদবুদ্ধির উর্ধ্বে রাজনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতির তুমুল জাতীয়তাবাদী তুরীয় কালপর্বে কী করে এই সংস্কৃতির অবস্থান সম্ভব ছিল, সেটা বিস্ময়কর বটে! এই বিষয়ে কোন গবেষনা হয়নি।

এটা কি ভাববার বিষয় নয় যে জালালের মতো কবি রবীন্দ্রনাথের মতো ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’, কিম্বা ‘ ও আমার দেশের মাটি তোমার পায়ে ঠেকাই মাথা’- এই ধরণের দেশাত্ববোধক গান লিখলেন না। উলটো লিখলেন, এইসব দেশটেশ আবার কী! দেশ মানে তো তোমার নিজের শরীর। দেহ। তোমরা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী যে ভূগোলটাকে দেশ বলে চালিয়ে দিচ্ছ, সেটা নয়। আপন দেশে বসে, অর্থাৎ নিজের শরীরের মধ্যে বাস করেও যে নিজেকেই চিনতে পারেনা, সে আবার কেমন মানুষ? সে আবার কেন অন্য দেশ খুঁজতে যায়? মজার ব্যাপার হলো, বয়াতিরা যখন এই গানটি গান তখন তারা ইচ্ছে করে গানটিকে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ ধরণের ঝোঁক রেখে গেয়ে থাকেন। সঙ্গীতে যাদের মুন্সিয়ানা বেশি তারা ঝিঁঝিট রাগের একটা আবহ তৈরি করে কায়দা করে গানটি গাইতে পছন্দ করেন। মনে হয় চেনা জাতীয়তাবাদী সুরের একটা রেশ আছে, কিন্তু সেটা টিকছে না, কেটে যাচ্ছে। সাধারণের গান হওয়ার কারণে এর কোনো পেটেন্ট বা কপিরাইট নেই। ফলে কোনো প্রামাণ্য সুর প্রতিষ্ঠা মুশকিল। কিন্তু বিভিন্ন জনের কাছে গানটি যখনই শোনা যায়, তখনই মনে হয়েছে সুরের মধ্যেও সাধারণের সংস্কৃতি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জাতীয়তাবাদী উগ্রতাকে মশকরা করতে যেন ছাড়ে না। গানটির মধ্যে জাতীয়তাবাদী মানচিত্রের ভূগোল যখন শরীরবৃত্তিয় অঙ্গসংস্থানে রূপান্তরিত হতে থাকে, তখন পুরো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদের প্রতি একটি প্রচ্ছন্ন হাসি তৈরি হয়ে যায়।

ভাববার কোন কারণ নেই যে, জালাল ভূগোল ও রাজনীতি সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন। মোটেও নয়। ইংরেহ হলো, ‘বিজাতি ও অধিকারী’। তার আসল বাড়ি বিলাতে। তার শাসনকেন্দ্র বা ঔপনিবেশিকতার রাজদন্ড কোলকাতায়। দিল্লিতেও এই অধিকারীর কাছারি আরেকটি আছে। কিন্তু তার আইনের শাসন বিচার-আচার নিকটের কুচবিহারে খাটে না। কুচবিহার ছিল ইংরেজের করদ মিত্ররাজ্য। ইংরেজের শাসন আচারবিচার ওখানে খাটে না। জালাল শুধু আর্য বা অনার্যের সংগ্রামের ইতিহাসই জানতেন না, এইসকল ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার ইতিহাসের খোঁজখবরও রাখতেন।

মধ্যবিত্তের দেশ, ভূগোল ও রাষ্ট্রসংক্রান্ত ধ্যানধারণাকে সাধারণ মানুষের কাব্যশক্তি গোটাটাই কী করে বেমালুম লোপাট করে ফেলতে পেরেছে, তার একটি ভালো উদাহরণ হচ্ছে জালালউদ্দিনের একটি বিখ্যাত গান। সাধারণ মানুষের ভিতর থেকে উঠে আসা ভাবুক, তত্ববিদ, দার্শনিক বা কবিদের ক্ষমতা ছিল দুর্দান্ত! ‘সোনার ভারত’ সংক্রান্ত জাতীয়তাবাদী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ধারণা, কল্পনা, ভূগোল, অর্থনীতি, রাজনীতিকে জালাল একটা দেহতাত্ত্বিক প্রকল্পে রূপ দিয়েছেন। অথচ হাজার হাজার বছরের দেহতাত্ত্বিক চর্চা ও ধারাবাহিক তন্ত্র সাধনার পুরো সূত্রটাই এখানে হাজির। অসাধারণ তার ক্ষমতা, দুর্ধর্ষ তার কল্পনাপ্রতিভা! জালালের এই পুরো গানটা তাই উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারলাম না এখানে:

আমি ধন্য বলি তারে-
আপন দেশে যে-জন বসে চিনতে পারে আপনারে।।

বিজাতি এক অধিকারী
বিলাতে তার আসল বাড়ি
কলিকাতায় হয় কাছারি হুগলী নদীর পারে,
আর একখানা আছে জানা দিল্লির শহরে-
খাটে না তার আইনের বিচার নিকটে ঐ কুচবিহারে
আমি ধন্য বলি তারে।।

উত্তরে নেপাল-ভুটান
পশ্চিমে হয় বেলুচিস্তান
দক্ষিণেতে লঙ্কাপুরী মণিপুর পুবধামে,
ব্রহ্মপুত্রের জন্ম হইলো মানস সরোবরে-
গঙ্গা আর যমুনা মিশে ত্রিবেণী তার নামটি ধরে
আমি ধন্য বলি তারে।।

আপন দেশে গয়া কাশী
নাসিকাতে বাজে বাঁশি
হরিদ্বারে শব্দ করে শুনা যায় কানপুরে-
বিদেশী মাল আমদানি হয় করাচির বন্দরে
আমি ধন্য বলি তারে।।

বোম্বাই হতে রপ্তানি মাল
বাহির হয়ে যায় চিরকাল
আধনে আদরের বিকি রমনির বাজারে-
লাকসাম হইতে লাইন খুলেছে বাহাত্তুর বাজারে-
শোনিত স্বরূপ রানি, সে সব পথে সদাই ঘোরে
আমি ধন্য বলি তারে।।

খাইবার-বোলান দুটি পাশে
পরম-আর্য্য বেটা এলো দেশে,
জীবাত্মা অনার্য বেটা পলাইল পাহাড়ে,
মেয়ের কাছে লইছে আশ্রয় গৌরি শংকরে-
সোনার ভারত আপন মুরত জালাল উদ্দিন চিনল নারে
আমি ধন্য বলি তারে।।

‘সোনার ভারত’-টা জালাল উদ্দিনের নিজেরই শরীর, অথচ তাকে চিনতে না পেরে তার নিজের সে কী আক্ষেপ! অথচ এই কল্পনার সোনার ভারতই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাল্পনিক জাতিবোধ বা জাতিসত্তাকে দানাদার করে তোলার আবেগসংকুল প্রতীক হিশেবে কাজ করছে।

পরিশেষে, আমার এই লেখাটা যখন ‘ভালই হয়েছে’ ব’লে মত প্রকাশ করেই ফেললেন, তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

৫| ১৮ ই জুলাই, ২০১০ রাত ৯:০৪

ফকির ইলিয়াস বলেছেন: ভালো লাগলো , আপনার প্রয়াস।

এসব গুণীজনদের কর্মকান্ড আরও আলোচিত হওয়া দরকার।

২০ শে জুলাই, ২০১০ ভোর ৪:৩৮

সেলিম তাহের বলেছেন: সহমত।

৬| ১৭ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ১১:৪৭

লালশাপলা বলেছেন: জালাল উদ্দীন খাঁ- র লেখা তত্ত্বমুলক বইটির নাম নিয়ে কিছু মতান্তর লক্ষ্য করলাম, এ লেখা গুলো পড়ে। বইটির নাম হচ্ছে, বিশ্ব রহস্য। এ মুহূর্তে আমার সামনেই বইটি রয়েছে। আটটি অধ্যায় আছে এতে, অবশ্য জালাল এগুলোকে খন্ড হিসেবে বইয়ে উল্লেখ করেছেন। প্রথম খন্ড থেকে অস্টম খন্ড হিসাবে বইটি সাজিয়েছেন তিনি।
প্রথম খন্ড ১ থেকে ৩৩ পৃষ্ঠা পর্যন্ত। এ খন্ডের নাম দেয়া হয়েছে- বিশ্ব রহস্যে স্রস্টা। আর শেষ খন্ডের শিরোনাম হচ্ছে- ফকিরী বা সাধুর মতামত, যা শুরু হয়েছে ১০৪ পৃষ্ঠা থেকে।
আশা করি বই এর নাম নিয়ে বিদ্যমান সমস্যা দূর হবে। লেখাগুলো পড়ে খুব ভালো লাগলো, সেজন্য ধন্যবাদ জানাই।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.