নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভবঘূরে জীবন;

মাসুদ সরদার

ছন্নছারা

মাসুদ সরদার › বিস্তারিত পোস্টঃ

কবি ও কবিতা

১১ ই আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ২:৫৫


জীবনানন্দদাশ

১৯৫৪ সাল এবং তার পূর্বের একশো বছরে - কলকাতা শহরে ট্রামের ধাক্কায় একজন মারা গেছেন।একশো বছরে মাত্র একজন মারা গেছেন ট্রাম দুর্ঘটনায়।যে মারা গেছে তার ভেঙ্গে গিয়েছিলো কন্ঠার হাড় ,পাজর এবং উরুর হাড়।এবং সেই ব্যক্তি তার মৃত্যুর বহু আগে থেকেই অন্যদের বলে আসতেন - তার মৃত্যু হবে ট্রামের ধাক্কায়।

যেই ঘটনা পূর্বের একশো বছরে ঘটে নাই - সেই ঘটনা যার সাথে হলো - তিনি তর্কস্বাপেক্ষে - রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি।কবি জীবনানন্দ দাশ।একটা কথা এসেছে - "তর্কস্বাপেক্ষ" - কেনো এসেছে?তর্ক করাই যায়।যেখানে মানুষ আল্লাহ তায়ালা আছেন কিনা - এটা নিয়েই তর্ক করে - মারামারি কাটাকাটি করে - সেখানে কবি জীবনানন্দদাশ শ্রেষ্ঠ কবি কিনা - এটা নিয়েও তর্ক হতে পারে।হোক তর্ক।

তবে তার লেখা একটা কবিতা যে বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতার একটা - সেটাতে সন্দেহ নাই।বনলতা সেন সেই কবিতা।নাটোরের বনলতা সেন।মানুষ জেনে হোক বা না জেনে হোক - মনের তাড়নায় হোক বা ফ্যাশানের ঝোকে - আজও এই কবিতাটা পড়ে।চলেন আমরাও পড়ি আরেকবার

**********
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধুসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের’পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী-ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

এই বনলতা সেন কে?

এটা নিয়ে অনেক ধারনা জল্পকল্প হয়েছে। আজোও হয়। কদিন আগে এই গ্রুপেই একজন গবেষণা করে বের করেছিলেন - বনলতা হলেন আরেকজন পুরুষ মানুষ। এবং জীবনানন্দদাশ ছিলেন সমকামী!!

সত্যিই মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব।নাহলে মানুষ এতো গবেষণা করতে পারতো না।

তা কবির কথা হচ্ছিলো। কবি জীবনানন্দদাশ।আমরা তাকে কবি হিসাবে চিনি।তবে তিনি চুপিচুপি ১৪ টা উপন্যাস আর শতাধিক গল্প লিখেছিলেন।আসলেই চুপিচুপি।তিনি বেচে থাকা অবস্থায় তিনি এসব উপন্যাস আর গল্প প্রকাশের কোনো উদ্যোগ ন্যান নাই।বরং তিনি সেসব রেখে দিয়েছিলেন বিছানার নিচে আজেবাজে জিনিসের সাথে।এই তথ্যটা পেয়েছি - সুনীলের "আমার গদ্য সাহিত্যপাঠ" বইয়ে। সেখানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অনেক প্রশংসা করেছেন জীবনানন্দদাশের উপন্যাসের্।সুনীলের মতো অভিজ্ঞ জুহুরি যখন প্রশংসা করেন - নিশ্চয়ই প্রশংসা পাওয়ার মতো জিনিস।

কবি ছিলেন নিজের লেখার সবচেয়ে বড় সমালোচক।তিনি সাড়ে আটশোর মতো কবিতা লিখলেও - জীবদ্দশায় প্রকাশ করেছেন মাত্র পাচটি কাব্যগ্রন্থ।যাতে ঠাই পেয়েছে মোট ২৬২টা কবিতা

কবির একটা কবিতা আছে। বেশ বড় কবিতা।তবে তার একটা অংশ আমার মাথায় মাঝে মাঝে ঘুরে। অংশটা হলো -

**********
শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে—ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ।

বধু শুয়ে ছিল পাশে—শিশুটিও ছিল;
প্রেম ছিল, আশা ছিল—জ্যোৎস্নায়—তবু সে দেখিল
কোন্ ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল—লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।

কেমন জানি গা ছমছমে নিশির ডাকের মতো কবিতা না??আসলেই কবি নিশিতে পাওয়া ছিলেন।অনেকে বলেন প্রচন্ড আত্মহত্যাপ্রবনতা ছিলো কবির্।

আসলে বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি - বাস্তব জীবনে ছিলেন ব্যর্থ একজন মানুষ।বারবার চাকরি হারিয়েছেন।বীমা কোম্পানির এজেন্ট হিসাবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোককে বীমা করতে বলার কাজও তাকে করতে হয়েছে।এবং তিনি টিউশনিও করতেন!একবার তো ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ছোটখাটো ব্যবসা করতেও নেমেছিলেন।তবে ব্যর্থ ছিলো সব প্রচেষ্টা।অনেক দৈন্যদশায় জীবনটা কাটিয়েছেন এই কবি।ভাগ্যিস উনার বউ এক স্কুলে শিক্ষকতা করতেন।

কিছু কিছু মানুষের জীবন ব্যর্থভাবেই কেটে যায়।নাহলে জীবনানন্দদাশ একজন ইংরেজীতে মাস্টার্স পাশ করা লোক - তাকে টিউশনি করে জীবিকা নির্বাহ করতে হবে?সব উপর ওয়ালার ইশারা।হয়তোবা দারিদ্রতাই তাকে মহান করেছে। কে জানি বলেছিলো - হে দারিদ্র্য করেছো মোরে মহান!

তবে কবি ব্যর্থ নন।তার সৃষ্টি আজও অমর্।জীবনকালে তেমন খ্যাতি তিনি পান নাই।তবে তার মৃত্যুর পর থেকে পেতে থাকেন খ্যাতি।আখ্যা পান - বাংলার শুদ্ধতম কবির্।রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলায়সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি

কবি ছিলেন - রুপসী বাংলার কবি।তার জন্ম আমাদেরই বরিশালে। বেড়ে উঠাও এখানে।এই বাংলায় তাই তিনি বারবার ফিরে এসেছেন।আসতে চেয়েছেন

**********

আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শংখচিল শালিখের বেশে,
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়।
হয়তো বা হাঁস হব- কিশোরীর- ঘুঙুর রহিবে লাল পায়
সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে।
আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে
জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এই সবুজ করুণ ডাঙ্গায়।

হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে।
হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমূলের ডালে।
হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে।
রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদা ছেঁড়া পালে
ডিঙ্গা বায়; রাঙ্গা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে
দেখিবে ধবল বক; আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে।

ধানসিঁড়ি নদীটা বারবার এসেছে কবির কবিতায়।

**************

হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে-উড়ে ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে!
তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে!
পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;
আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে
বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!
হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর উড়ে-উড়ে কেঁদো নাকো ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে!

কবি বেশ ভালো করে দেখেছেন পৃথিবীর রুপ।

***************

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই - প্রীতি নেই - করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব'লে মনে হয়
মহত্‍ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।

*****************

সুরন্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,
বোলো নাকো কথা অই যুবকের সাথে
ফিরে এসো সুরন্জনা :
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে ;

ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে ;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার ;
দূর থেকে দূরে-----আরো দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়ো নাকো আর ।

কী কথা তাহার সাথে? তার সথে!
আকাশের আড়ালে আকাশ
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ :
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে ।

সুরন্জনা,
তোমার হৃদয় আজ ঘাস :
বাতাসের ওপারে বাতাস
আকাশের ওপারে আকাশ ।

*****************

আমি যদি হতাম বনহংস;
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনো এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে
ছিপছিপে শরের ভিতর
এক নিরালা নীড়ে;

তাহলে আজ এই ফাল্পুনের রাতে
ঝাউয়ের শাখার পেছনে চাঁদ উঠতে দেখে
আমরা নিম্নভূমির জলের গন্ধ ছেড়ে
আকাশের রুপালি শস্যের ভিতর গা ভাসিয়ে দিতাম-
তোমার পাখনায় আমার পালক, আমার পাখনায় তোমার রক্তের স্পন্দন-
নীল আকাশে খইক্ষেতের সোনালি ফুলের মতো অজস্র তারা,
শিরীষ বনের সবুজ রোমশ নীড়ে
সোনার ডিমের মতো
ফাল্গুনের চাঁদ।
হয়তো গুলির শব্দঃ
আমাদের তির্যক গতিস্রোত,
আমাদের পাখায় পিস্টনের উল্লাস,
আমাদের কন্ঠে উত্তর হাওয়ার গান!

হয়তো গুলির শব্দ আবারঃ
আমাদের স্তব্ধতা,
আমাদের শান্তি।
আজকের জীবনের এই টুকরো টুকরো মৃত্যু আর থাকত না:
থাকত না আজকের জীবনের টুকরো টুকরো সাধের ব্যর্থতা ও অন্ধকার;
আমি যদি বনহংস হতাম,
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনো এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে।

জীবনানন্দদাশ

১৯৫৪ সাল এবং তার পূর্বের একশো বছরে - কলকাতা শহরে ট্রামের ধাক্কায় একজন মারা গেছেন।একশো বছরে মাত্র একজন মারা গেছেন ট্রাম দুর্ঘটনায়।যে মারা গেছে তার ভেঙ্গে গিয়েছিলো কন্ঠার হাড় ,পাজর এবং উরুর হাড়।এবং সেই ব্যক্তি তার মৃত্যুর বহু আগে থেকেই অন্যদের বলে আসতেন - তার মৃত্যু হবে ট্রামের ধাক্কায়।

যেই ঘটনা পূর্বের একশো বছরে ঘটে নাই - সেই ঘটনা যার সাথে হলো - তিনি তর্কস্বাপেক্ষে - রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি।কবি জীবনানন্দ দাশ।একটা কথা এসেছে - "তর্কস্বাপেক্ষ" - কেনো এসেছে?তর্ক করাই যায়।যেখানে মানুষ আল্লাহ তায়ালা আছেন কিনা - এটা নিয়েই তর্ক করে - মারামারি কাটাকাটি করে - সেখানে কবি জীবনানন্দদাশ শ্রেষ্ঠ কবি কিনা - এটা নিয়েও তর্ক হতে পারে।হোক তর্ক।

তবে তার লেখা একটা কবিতা যে বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতার একটা - সেটাতে সন্দেহ নাই।বনলতা সেন সেই কবিতা।নাটোরের বনলতা সেন।মানুষ জেনে হোক বা না জেনে হোক - মনের তাড়নায় হোক বা ফ্যাশানের ঝোকে - আজও এই কবিতাটা পড়ে।চলেন আমরাও পড়ি আরেকবার

**********
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধুসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের’পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী-ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

এই বনলতা সেন কে?

এটা নিয়ে অনেক ধারনা জল্পকল্প হয়েছে। আজোও হয়। কদিন আগে এই গ্রুপেই একজন গবেষণা করে বের করেছিলেন - বনলতা হলেন আরেকজন পুরুষ মানুষ। এবং জীবনানন্দদাশ ছিলেন সমকামী!!

সত্যিই মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব।নাহলে মানুষ এতো গবেষণা করতে পারতো না।

তা কবির কথা হচ্ছিলো। কবি জীবনানন্দদাশ।আমরা তাকে কবি হিসাবে চিনি।তবে তিনি চুপিচুপি ১৪ টা উপন্যাস আর শতাধিক গল্প লিখেছিলেন।আসলেই চুপিচুপি।তিনি বেচে থাকা অবস্থায় তিনি এসব উপন্যাস আর গল্প প্রকাশের কোনো উদ্যোগ ন্যান নাই।বরং তিনি সেসব রেখে দিয়েছিলেন বিছানার নিচে আজেবাজে জিনিসের সাথে।এই তথ্যটা পেয়েছি - সুনীলের "আমার গদ্য সাহিত্যপাঠ" বইয়ে। সেখানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অনেক প্রশংসা করেছেন জীবনানন্দদাশের উপন্যাসের্।সুনীলের মতো অভিজ্ঞ জুহুরি যখন প্রশংসা করেন - নিশ্চয়ই প্রশংসা পাওয়ার মতো জিনিস।

কবি ছিলেন নিজের লেখার সবচেয়ে বড় সমালোচক।তিনি সাড়ে আটশোর মতো কবিতা লিখলেও - জীবদ্দশায় প্রকাশ করেছেন মাত্র পাচটি কাব্যগ্রন্থ।যাতে ঠাই পেয়েছে মোট ২৬২টা কবিতা

কবির একটা কবিতা আছে। বেশ বড় কবিতা।তবে তার একটা অংশ আমার মাথায় মাঝে মাঝে ঘুরে। অংশটা হলো -

**********
শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে—ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ।

বধু শুয়ে ছিল পাশে—শিশুটিও ছিল;
প্রেম ছিল, আশা ছিল—জ্যোৎস্নায়—তবু সে দেখিল
কোন্ ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল—লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।

কেমন জানি গা ছমছমে নিশির ডাকের মতো কবিতা না??আসলেই কবি নিশিতে পাওয়া ছিলেন।অনেকে বলেন প্রচন্ড আত্মহত্যাপ্রবনতা ছিলো কবির্।

আসলে বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি - বাস্তব জীবনে ছিলেন ব্যর্থ একজন মানুষ।বারবার চাকরি হারিয়েছেন।বীমা কোম্পানির এজেন্ট হিসাবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোককে বীমা করতে বলার কাজও তাকে করতে হয়েছে।এবং তিনি টিউশনিও করতেন!একবার তো ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ছোটখাটো ব্যবসা করতেও নেমেছিলেন।তবে ব্যর্থ ছিলো সব প্রচেষ্টা।অনেক দৈন্যদশায় জীবনটা কাটিয়েছেন এই কবি।ভাগ্যিস উনার বউ এক স্কুলে শিক্ষকতা করতেন।

কিছু কিছু মানুষের জীবন ব্যর্থভাবেই কেটে যায়।নাহলে জীবনানন্দদাশ একজন ইংরেজীতে মাস্টার্স পাশ করা লোক - তাকে টিউশনি করে জীবিকা নির্বাহ করতে হবে?সব উপর ওয়ালার ইশারা।হয়তোবা দারিদ্রতাই তাকে মহান করেছে। কে জানি বলেছিলো - হে দারিদ্র্য করেছো মোরে মহান!

তবে কবি ব্যর্থ নন।তার সৃষ্টি আজও অমর্।জীবনকালে তেমন খ্যাতি তিনি পান নাই।তবে তার মৃত্যুর পর থেকে পেতে থাকেন খ্যাতি।আখ্যা পান - বাংলার শুদ্ধতম কবির্।রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলায়সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি

কবি ছিলেন - রুপসী বাংলার কবি।তার জন্ম আমাদেরই বরিশালে। বেড়ে উঠাও এখানে।এই বাংলায় তাই তিনি বারবার ফিরে এসেছেন।আসতে চেয়েছেন

**********

আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শংখচিল শালিখের বেশে,
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়।
হয়তো বা হাঁস হব- কিশোরীর- ঘুঙুর রহিবে লাল পায়
সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে।
আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে
জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এই সবুজ করুণ ডাঙ্গায়।

হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে।
হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমূলের ডালে।
হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে।
রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদা ছেঁড়া পালে
ডিঙ্গা বায়; রাঙ্গা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে
দেখিবে ধবল বক; আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে।

ধানসিঁড়ি নদীটা বারবার এসেছে কবির কবিতায়।

**************

হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে-উড়ে ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে!
তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে!
পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;
আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে
বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!
হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর উড়ে-উড়ে কেঁদো নাকো ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে!

কবি বেশ ভালো করে দেখেছেন পৃথিবীর রুপ।

***************

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই - প্রীতি নেই - করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব'লে মনে হয়
মহত্‍ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।

*****************

সুরন্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,
বোলো নাকো কথা অই যুবকের সাথে
ফিরে এসো সুরন্জনা :
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে ;

ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে ;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার ;
দূর থেকে দূরে-----আরো দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়ো নাকো আর ।

কী কথা তাহার সাথে? তার সথে!
আকাশের আড়ালে আকাশ
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ :
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে ।

সুরন্জনা,
তোমার হৃদয় আজ ঘাস :
বাতাসের ওপারে বাতাস
আকাশের ওপারে আকাশ ।

*****************

আমি যদি হতাম বনহংস;
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনো এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে
ছিপছিপে শরের ভিতর
এক নিরালা নীড়ে;

তাহলে আজ এই ফাল্পুনের রাতে
ঝাউয়ের শাখার পেছনে চাঁদ উঠতে দেখে
আমরা নিম্নভূমির জলের গন্ধ ছেড়ে
আকাশের রুপালি শস্যের ভিতর গা ভাসিয়ে দিতাম-
তোমার পাখনায় আমার পালক, আমার পাখনায় তোমার রক্তের স্পন্দন-
নীল আকাশে খইক্ষেতের সোনালি ফুলের মতো অজস্র তারা,
শিরীষ বনের সবুজ রোমশ নীড়ে
সোনার ডিমের মতো
ফাল্গুনের চাঁদ।
হয়তো গুলির শব্দঃ
আমাদের তির্যক গতিস্রোত,
আমাদের পাখায় পিস্টনের উল্লাস,
আমাদের কন্ঠে উত্তর হাওয়ার গান!

হয়তো গুলির শব্দ আবারঃ
আমাদের স্তব্ধতা,
আমাদের শান্তি।
আজকের জীবনের এই টুকরো টুকরো মৃত্যু আর থাকত না:
থাকত না আজকের জীবনের টুকরো টুকরো সাধের ব্যর্থতা ও অন্ধকার;
আমি যদি বনহংস হতাম,
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনো এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.