![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
জেগে ওঠ
সকল প্রশংসা আল্লাহ্’র জন্য যিনি গোটা আলমের রব্ব। দুরুদ ও সালাম মুহাম্মাদ (দ.) ও তাঁর পরিবার-পরিজন এবং তাঁর সাহাবাদের উপর।
আজ আমরা মানুষেরা সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ, সাদা-কালো, আলো-আঁধারের যাচাই-বাছাই করছি না। আজকে জ্ঞান থাকতেও তা কাজে লাগাচ্ছি না, চোখ থাকতেও তা দিয়ে দেখছিনা, কান থাকতেও তা দিয়ে শুনছি না। এসম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন,
“আমি অধিকাংশ মানুষ এবং জ্বীন সৃষ্টি করেছি তাদেরকে জাহান্নামে দেয়ার জন্য। তারা হল- যাদের অন্তকরণ আছে কিন্তু তা দিয়ে বুঝার চেষ্টা করে না, চোখ আছে তা দিয়ে দেখে না এবং কান আছে তা দিয়ে শুনেনা। তারা হল জানোয়ারের মত বরং তার চেয়েও পথভ্রষ্ট। তারাই হল উদাসীন। -সূরা আ’রাফ, ৭/১৭৯
এই আয়াতটিতে আল্লাহ্ বারি তায়ালা বলছেন যে, আমি অধিকাংশ মানুষ এবং জ্বীন সৃষ্টি করেছি তাদেরকে জাহান্নামে দেয়ার জন্য। তারা হল- যাদের অন্তরকরণ আছে কিন্তু তা দিয়ে (সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ, যাচাই-বাছাই করেনা) বুঝার চেষ্টা করে না, চোখ আছে তা দিয়ে (সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ, যাচাই-বাছাই করেনা) দেখে না এবং কান আছে তা দিয়ে (সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ, যাচাই-বাছাই করেনা) শুনেনা। তারা হল জানোয়ারের মত। কোন জানোয়ারের মত জানেন কি? এ সম্পর্কে আল্লাহ্ তায়ালা বলেছেন যে,
“...কিন্তু সে যে অধঃপতিত এবং নিজের কামনা-বাসনার অনুগামী হয়ে রইল। সুতরাং তার অবস্থা হল কুকুরের মত; যদি তাকে তাড়া কর তবুও হাঁপাবে আর যদি ছেড়ে দাও তবুও...।” -সূরা আ’রাফ, ৭/১৭৬
এই আয়াতটিতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন যে, যারা সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ, যাচাই-বাছাই করেনা তারা হল কুকুরের মত। কুকুরকে যদি তাড়া করা হয় তখন সে জিবটা বের করে হাঁপাতে থাকে আবার এমনি-এমনিও সে হাঁপাতে থাকে। অর্থাৎ যারা সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ, সাদা-কালো, আলো-আঁধারের যাচাই-বাছাই করেনা তারা হল জানোয়ারের মত মানে কুকুর জানোয়ারের মত। তারা এই পৃথিবীতে এসেছে শুধু নিজের উদর ভরতে আর কুকুরের মত মৌসুমী বাচ্চা ফুটাতে। তাদের আর কোন কাজ নেই।
এদের সিনেমা দেখার সময় আছে কিন্তু সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ বুঝার সময় নেই, এদের ক্রিকেট খেলা দেখার সময় আছে কিন্তু সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ বুঝার সময় নেই, এদের পত্রিকা পড়ার সময় আছে সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ বুঝার সময় নেই, টক শোতে বড় বড়া নীতিবাক্য বলতে পারে কিন্তু কাজের বেলায় ঠেঙ্গা। থু... এরকম জীবনের! বড় ঘৃণা হয়।
মানুষ একটি ব্যতিক্রমধর্মী প্রাণী
মহান আল্লাহ্ বলেন,
“এবং আয়ত্ত্বাধীন করে দিয়েছেন তোমাদের জন্য যা আছে আকাশ ও পৃথিবীতে তাঁর (আল্লাহ্) পক্ষ থেকে...” -সূরা জাসিয়া, ৪৫/১৩
আয়াতটি দ্বারা বুঝা যায়, আল্লাহ্ বারি তায়ালা আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সকল বস্তুকে মানুষের অধীন করেছেন।
মহান আল্লাহ্ বলেন,
“আর যখন আমি আদামকে সাজদাহ্ করার জন্য মালাইকাহ্'দের নির্দেশ দিলাম, তখনই ইবলীস ছাড়া সবাই সাজদাহ্ করল...।” -সূরা বাক্বারাহ্, ২/৩৪
আয়াতটি দ্বারা বুঝা যায়, মানুষ (আদাম) মালাইকাহ্'দের চেয়ে ও ইবলীস তথা জ্বীন জাতির চেয়েও মর্যাদাবান। ইবলীস আগুনের তৈরী জ্বীন জাতির অন্তর্ভূক্ত (দেখুন- “জ্বীন অগ্নিশিখা থেকে সৃষ্টি” -সূরা আর-রহমান, ৫৫/১৫, “শয়তানকে আগুন থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে” -সূরা আ’রাফ, ৭/১২)।
“অবশ্যই আমি আদাম সন্তনদেরকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি; তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্টির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।” -সূরা বানী ইসরাঈল, ১৭/৭০।
এই আয়াতটি বলছে যে, আদাম সন্তান তথা মানুষকে আল্লাহ্ সম্মানীত করেছেন এবং বহু সৃষ্টির উপরে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন।
তাহলে উল্লেখিত আলোচনা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহু রহমানুর রহীম আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সব কিছু মানুষের অধীন করেছেন অর্থাৎ মানুষকে আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সব কিছুর উপর কর্তৃত্ব দিয়েছেন এবং মালাইকাহ ও জ্বীন জাতির অন্তর্ভূক্ত ইবলীসকে আদামকে সাজদাহ্ করার আদেশের মাধ্যমে এটাই প্রমাণ হয় যে, মানুষকে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে যাবতীয় সৃষ্টি সেরা হিসেবে মর্যাদা দিয়েছেন (সুবহানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহী)। এ সম্পর্কে একটি হাদিস নিম্নে দেয়া হল-
রসূলুল্লাহ্ (দ.) বলেন,
“... এসে বললেন, হে (মুহাম্মাদ দ.) সৃষ্টির সেরা। তিনি (দ.) বললেন সেতো ইবরাহীম (আ.)।” -তিরমিযী, হাসান ...?
এই হাদিসটিতে রসূলুল্লাহ্ (দ.) বলেন, সৃষ্টির সেরা হলো ইবরাহীম (আ.)। তাহলে বুঝাই যায়, ইবরাহীম (আ.) যেহেতু মানুষ অর্থাৎ আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা মানুষকেই সৃষ্টির সেরার মর্যাদা দান করেছেন। অর্থাৎ মানুষ হলো সৃষ্টি সেরা। এ থেকেই বুঝা যায় মহান আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সৃষ্টির মাঝে মানুষ একটি ব্যতিক্রমধমী ও মর্যাদাপূর্ণ সেরা সৃষ্টি।
সত্য এবং মিথ্যা বুঝার উপাদানসমূহ
“আল্লাহ্ মানুষকে সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ বুঝার জন্য ৩টি উপাদান দিয়েছেন। যথা- (১) সর্বোত্তম দেহ (২) চেতনাবোধ (৩) ঐচ্ছিকতা।
(১) সর্বোত্তম দেহ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন,
“...তিনি তোমাদেরকে আকৃতি দান করেছেন, অতঃপর তোাদেও আকৃতি সুন্দও করেছেন...” -সূরা মু’মিনূন, ৪০/৬৪
“শপথ প্রাণের এবং যিনি তাকে সুবিন্যাস্ত করেছেন, তাঁর” -সূরা শামস্, ৯১/৭
“অবশ্যই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে সুন্দর অবয়বে।” -সূরা ত্বীন, ৯৫/৪
উল্লেখিত আয়াতদ্বয় থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহ্ বারি তায়ালা তিনি আমাদেরকে অন্যান্য সৃষ্টি থেকে সুন্দর অবয়ব ও সৃষ্টির সেরা শারীরিক অবকাঠামো দান করেছেন।
(২) ইন্দ্রিয় শক্তির উপদানসমূহ হল (১) চিন্তা করা, দেখা, শুনা, ঘ্রাণ, স্বাদ যাকে পঞ্চ ইন্দ্রিয় বলা হয়। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন,
“অতপর তাকে ভাল ও মন্দের চেতনাবোধ দান করেছেন” -সূরা শামস্, ৯১/৮
এই আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, ভাল ও মন্দের জ্ঞান আল্লাহ্’র তরফ থেকে আসে। তাহলে আল্লাহ্ তায়ালা প্রতিটি কর্মের ব্যপারে তিনি মানুষকে ভাল ও মন্দের চেতনাবোধ দিয়েছেন।
(৩) ইচ্ছা শক্তি ঃ মানুষ আল্লাহ’র পক্ষ থেকে সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় গ্রহণ করা না করার ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বাধীন। মানুষ ইচ্ছা করলে সত্যকেও গ্রহণ করতে পারে আবার ইচ্ছা করলে সে মিথ্যাও গ্রহণ করতে পারে এ ব্যাপারে সে স্বাধীন। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন,
“যে নিজেকে শুদ্ধ করে সেই সফলকাম হয় এবং যে নিজেকে কলুষিত করে সে ব্যার্থ মনোরথ হয়।” -সূরা শামস্ ৯১/৯-১০
উল্লেখিত আয়াতদ্বয় থেকে বুঝা যায় যে, সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় গ্রহণ করা না করার ব্যাপারে মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীন।
উল্লেখিত আলোচনা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, মানুষের ৩টি শক্তি রয়েছে যথা- দেহ শক্তি, ইন্দ্রিয় শক্তি, ইচ্ছা শক্তি এর কারণে মানুষ একটি ব্যাতীক্রমধর্মী প্রাণী। এই তিনটি শক্তির কারণে আজকে মানুষ পৃথিবীতে সকল সৃষ্টির উপরে আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। ইয়া বিশাল-বিশাল প্রাণীগুলো, বিষাক্ত সাপগুলো, হিংস্র বাঘ, সিংহ, হায়েনা এমনকি সমুদ্রের মাঝে বিচরণ করে যাবতীয় প্রাণীগুলোর উপরেও প্রাধান্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে।
মিথ্যাকে গ্রহণ করার এবং সত্যকে
প্রত্যাখান করার একটি গল্প
মহান আল্লাহ বলেন-
“সে চিন্তা ভাবনা করল এবং সিদ্ধান্ত নিল, ধ্বংস হোক সে, কিভাবে সিদ্ধান্ত নিল! আবারও সে ধ্বংস হোক, সে কিভাবে সিদ্ধান্ত নিল! তারপর সে তাকাল। তারপর ভ্রঁ“ কুচকালো আর মুখ বাঁকালো। তারপর সে পেছনে ফিরল আর অহংকার করল। তারপর বলল, “এতো যাদু ছাড়া কিছু নয়। এতো পূর্ব থেকে চলে আসছে। এটাতো মানুষের কথা। শিঘ্রই আমি তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করব।” -সূরা মুদ্দাছছির ৭৪ ঃ ১৮-২৬।
এই আয়াতগুলো নাযিল হয়েছিল ওয়ালিদ বিন মুগীরাহ সম্পর্কে। এই ব্যক্তিটি মক্কার কাফির প্রধানদের একজন। মক্কার অন্যান্য কাফিররা তার থেকে মুহাম্মাদ (দ.) সম্পর্কে মতামত চাচ্ছিল যখন হজ্জের সময় নিকটবর্তী। কারণ হজ্জের সময় আরবের বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন মক্কায় আসে। তখন যেন মুহাম্মাদ (দ.) তাদের কাছে ইসলামের প্রচার করতে না পারে। এই পরিস্থিতিতে আরবের মুশরিকরা কি করবে সে বিষয়ে একেকজন একেক পরিকল্পনা ওয়ালিদ বিন মুগীরাহকে শুনাচ্ছিল। মতামতগুলো হচ্ছে-
কয়েক জন বলল, ‘তিনি গণক’।
ওয়ালীদ বিন মুগীরাহ বলল, ‘না'। আল্লাহর শপথ তিনি গণক নন। আমরা অনেক গণক দেখেছি। ইনি তো গণকদের মতো গুনগুন করে গান গায় না। ছন্দাকারে কবিতা আবৃত্তি করেন না কিংবা কবিতা রচনাও করেন না।’
অন্যরা বলল, ‘তাহলে আমরা তাকে একজন পাগল বলব।’
ওয়ালীদ বিন মুগীরাহ বলল, ‘না তিনি তো পাগল নন’ আমরা পাগল দেখছি এবং তার রকম সম্পর্কে জানি। এ লোকের মধ্যে পাগলদের মতো দম বন্ধ করে থাকা, অস্বাভাবিক কোন কাজকর্ম করা অসংলগ্ন কথাবার্তা বলা কিংবা অনূরূপ কোন কিছুইতো দেখি না।’
অন্যেরা বলল, ‘তাহলে আমরা বলব যে, তিনি একজন কবি।’
ওয়ালীদ বিন মুগীরাহ বলল, ‘তার মধ্যে কবির কোন বৈশিষ্ট্য নেই যে, তাকে কবি বলা হবে। আমাদের যুদ্ধাকৃত ছন্দ রযম, হাজয, কারীয়া, কামবুয, মাবসুত ইত্যাদি সর্বপ্রকার কাব্যরীতি সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। যাহোক তাঁর কথা-বার্তাকে কিছুতেই কাব্য বলা যেতে পারে না।’
অন্যরা বলল, ‘তাহলে আমরা তাঁকে যাদুকর বলব।’
ওয়ালীদ বিন মুগীরাহ বলল, ‘এ ব্যক্তিকে যাদুকরও বলা যেতে পারে না। আমরা যাদুকর এবং যাদু সংক্রান্ত নানা ফন্দি-ফিকির দেখেছি। তারা সত্য-মিথ্যা কত কথা বলে। কত অঙ্গ-ভঙ্গি করে, কত যে ঝাড়-ফুঁক করে এবং গিরা দেয় তার ইয়ত্তা থাকে না। কিন্তু এ ব্যক্তিতো যাদুকরদের মতো সত্য-মিথ্যা কথা বলা, ঝাড়-ফুঁক কিংবা গিরা দেয়া কোন কিছুই করে না।’
অন্যেরা তখন বলল, ‘আমরা তাহলে আর কি বলব?’
ওয়ালীদ বিন মুগীরাহ বলল, ‘আল্লাহর শপথ তাঁর কথাবার্তা বড়ই মিষ্টি মধুর, তার ভিত-শিকড় বড়ই শক্ত এবং শাখা-প্রশাখা বড়ই মনোমুদ্ধকর। তোমরা তাঁর সম্পর্কে যাই বল না কেন, যারা তাঁর সংস্পর্শে কিছুক্ষণ থাকবেন তারা তোমাদের কথাবার্তাকে অবশ্যই মিথ্যা মনে করবেন। তারপর কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে পুনরায় সে বলল, ‘তাঁর সম্পর্কে যদি কিছু বলতেই হয় তাহলে খুব জোর যাদুকর বলতে পারো। তাঁর জন্য এটা কিছুটা উপযোগী বলে মনে হতে পারে। তিনি এমন সব কথা উত্থাপন করেছেন যা যাদু বলেই মনে হয়। তিনি পিতা-পুত্রের মধ্যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে, ভাই-ভাইয়ের মধ্যে, গোত্রে-গোত্রে, আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে দিয়েছেন।’
শেষ পর্যন্ত তারা তাঁকে যাদুকর বলার সিদ্ধান্তে একমত হয়ে সভা শেষ করল। -ইবনে হিশাম, ই.ফা.বা. ১ম খন্ড, অধ্যায়-রসূলুল্লাহ্ (দ.) এর বিরুদ্ধে ওয়ালিদ ইবনে মুগীরা চক্রান্ত ও কুরআনের ব্যপারে তার ভূমিকা, পৃষ্ঠা-২৪২, দ্বিতীয় সংস্করণ, জানুয়ারী, ২০০৮ইং।
এই ঘটনা থেকে বুঝা যায় যে, ওয়ালীদ বিন মুগীরাহ সত্য বুঝেও তা প্রত্যাখ্যান করেছে এবং সত্যকে ধ্বংস করতে চেয়েছে। তাই মহান আল্লাহ তাকে জাহান্নামী ঘোষনা করেছেন।
এখন কোন ব্যক্তি যদি সত্য বুঝার পর তা মেনে না নেয় এবং সেই সত্যকে মিথ্যা প্রমাণ করার চেষ্টা করে তাহলে সেই ব্যক্তি ওয়ালীদ বিন মুগীরাহ’র মত কাজ করার কারণে জাহান্নামী হবে।
কুরআন এবং হাদিসে আল্লাহ জাহান্নামী হবার তিনটি কারণ উল্লেখ করেছেন। এই সম্পর্কে আল্লাহ বলেন-
“ক্রোধে আক্রোশে জাহান্নাম ফেটে পড়ার উপক্রম হবে। যখন কোন দলকে তাতে ফেলা হবে তখন তার রক্ষীরা তাদের জিজ্ঞাসা করবে তোমাদের কাছে কি কোন সতর্ককারী আসেনি? তারা বলবে, হ্যাঁ, অবশ্যই আমাদের কাছে সতর্ককারী এসেছিল কিন্তু আমরা তাদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিলাম আর আমরা বলেছিলাম আল্লাহ কিছুই নাজিল করেননি।” -সূরা মূলক ৬৭ ঃ ৮-৯
দুই আয়াত থেকে জানা গেল যে, জাহান্নামী হবার কারণ হচ্ছে, সতর্ককারী আসার পর তারা তাকে মিথ্যাবাদী মনে করেছিল। তাই এখন যদি কোন ব্যক্তিকে কুরআন এবং হাদিস দ্বারা সর্তক করার পরও কথাটিকে মিথ্যা মনে করে তাহলে সে উপরের আয়াত দুটির আলোকে জাহান্নামী।
আল্লাহ আরও বলেন-
“তারা বলবে আমরা যদি শুনতাম অথবা বিবেক খাটাতাম তাহলে জাহান্নামী হতাম না।” -সূরা মূলক ৬৭ ঃ ১০
আয়াতটি থেকে বুঝা গেল যারা কুরআন ও হাদিসের কথা শুনতে চায় না এবং কুরআন ও হাদিসের কথা চিন্তা ভাবনা করে না তারাই জাহান্নামী।
উপরে তিন শ্রেণীর জাহান্নামীদের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। এই জাহান্নামীদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন-
“যে ব্যক্তি সত্য প্রকাশের পরও রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথ ছেড়ে ভিন্ন পথ ধরে। সে যে দিকে যেতে চায় আমি তাকে সেদিকেই ফিরিয়ে দিব। অতঃপর তাকে জাহান্নাম উপহার দিব। কত খারাপ সেই জায়গা।” -সূরা নিসা ৪/ ১১৫
কতিপয় মানুষ যেভাবে সত্য-মিথ্যা বুঝতে চায়
(১) অন্যের বুঝ দিয়ে বুঝতে চাওয়া, (২) অধিকাংশের ধারণা, (৩) বাপ-দাদা বা পূর্ব পুরুষের ধারণার ভিত্তিতে, (৪) কিছু মানুষ সত্য-মিথ্যাকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে সত্যকে গ্রহণ করে
(১) অন্যের বুঝ দিয়ে বুঝতে চাওয়া ঃ
আমি অনেক মানুষকে দেখেছি যারা সত্য-মিথ্যা বুঝতে অন্যের বুঝের দ্বারস্থ হন এই যেমন- বড় আলিম, পীর, দরবেশ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জর্জ-ব্যারিষ্টার উচ্চপদস্থ কোন কর্মকর্তা ইত্যাদি। তারা যেভাবে বুঝেছেন ঠিক সেভাবেই বুঝ নেয়া। আমি বলি আপনার বিবেক, বুদ্ধি যতক্ষণ পর্যন্ত সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে না পারবে আর আপনি যদি এভাবে বুঝতে থাকেন যে, উনি বড় আলিম, শায়খ মুরুব্বি, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার, জজ-ব্যারিষ্টার পীর, দরবেশ উনার বুঝটাই সঠিক তাহলে আমি বলছি আপনি নিজে না বুঝলে আপনি শেষ বিচারের দিন আল্লাহকে বুঝাতে পারবেন? তাহলে আল্লাহ্ আপনাকে মানুষ বানিয়ে যে ৩টি শক্তি যথা দেহ শক্তি, ইন্দ্রিয় শক্তি, ইচ্ছা শক্তি দান করেছেন তার হিসাব কি দিয়ে দিবেন? ঐগুলি আল্লাহ্ তায়ালা আপনাকে তাহলে কেন দিলেন? এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন,
“যেদিন অগ্নিতে তাদের মুখমণ্ডল ওলট-পালট করা হবে; সেদিন তারা বলবে, হায়। আমরা যদি আল্লাহ্’র আনুগত্য করতাম ও রসূলের আনুগত্য করতাম। তারা আরও বলবে, হে আমাদের রব, আমরা আমাদের নেতা ও আকাবিরদের কথা মেনেছিলাম, অতঃপর তারা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল। হে আমাদের রব! তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং তাদেরকে মহা গজব দান করুন।” -সূরা আহযাব, ৩৩/৬৬-৬৮
উল্লেখিত আয়াতে আল্লাহু আযীযুল জাব্বার বলছেন যে, কুরআন ও হাদিসের আনুগত্য বাদ দিয়ে নেতা ও আকাবিরদের (মন্ত্রী-মিনিষ্টার, নেতা, বড় আলিম, পীর, দরবেশ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জর্জ-ব্যারিষ্টার উচ্চপদস্থ কোন কর্মকর্তা) অনুসরণ করলে আগুন দ্বারা মুখমণ্ডল ওলট-পালট করা হবে এবং শাস্তি দ্বিগুন করা হবে আর মহা গজব আপতিত হবে।
অতএব আয়াতটি দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, অন্যের বুঝ দিয়ে বুঝলে মুক্তি নেই। তাছাড়া আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা আলিমদের অনেক মর্যাদা দিয়েছেন কিন্তু তাদের অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন,
“তোমাদের রব্ব-এর পক্ষ থেকে যা কিছু অবতীর্ন হয়েছে তোমরা তার অনুসরণ কর আর নাযিলকৃত বিষয় ছাড়া অন্যকোন “আউলিয়ার” অনুসরণ করোনা।” -সূরা আ’রাফ, ৭/৩
উল্লেখিত আয়াতে “আউলিয়াদের” অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। আর “আউলিয়া” শব্দের অর্থ হল অভিভাবকবৃন্দ, ওলীগণ, বন্ধুগণ” -আল-কুরআনের অভিধান, বা.ই.সে. মার্চ ২০০৫ইং, পৃষ্ঠা # ১২৩। তাছাড়া “তাফসীরে ইবনে আব্বাস”-এ সূরা আ’রাফ, ৭/৩নং আয়াতে উল্লেখিত “আউলিয়া” শব্দের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, “আরবাবাম মিনাল আস্বনাম”। আর আরবী-টু-আরবী (আর-রায়েদ, ফেব্র“য়ারী ২০০৩ইং, পৃষ্ঠা # ৫৫৫) ডিকশনারীতে “আস্বনাম” শব্দের অর্থ করা হয়েছে “তামসালু ইয়ু’বাদু মিং দূনিল্লাহি” “আল্লাহ্ ছাড়া যার ইবাদাত করা হয়।” অর্থাৎ “রবুবিয়্যাতের (বিধানদানের) প্রতিক বা প্রতিমূর্তি যারা” অর্থাৎ শারী’আহ্’র মূর্তপ্রতিক শাসক বা জ্ঞানী স¤প্রদায়গণ বা আলিমগণ। তাহলে অভিধানের আলোকে এবং সাহাবীদের বিশ্বাসের আলোকে এটাই প্রতিয়মান হয় যে, নাযিলকৃত বিষয় তথা কুরআন ও হাদিস বাদ দিয়ে “নাবীদের ওয়ারিশ আলিম স¤প্রদায়গণের অনুসরণ করা যাবে না- । এ ব্যাপারে একটি হাদিসও উল্লেখ করা যেতে পারে,
“আদী বিন হাতিম (রা.) হতে বর্ণিত যে, তিনি নাবী (দ.) কে এ আয়াত পড়তে শুনলেন-
“...তারা তাদের ধর্মীয় পণ্ডিতদেরকে ও পীর-দরবেশদের রব বানিয়ে নিয়েছে...।” -সূরা তাওবা ৯/৩১
(আদী বললেন) আমি তাঁকে (দ.) বললাম, আমরা তো তাদের ইবাদাত করি না। নাবী (দ.) বললেন; আল্লাহ যা হালাল করেছেন তারা কি তা হারাম করে না? অতঃপর তোমরা তা হারাম বলে মেনে নাও। অপর দিকে আল্লাহ যা হারাম করেছেন তারা তা হালাল করে না? অতঃপর তোমরা তা হালাল বলে মেনে নাও। (আদী বললেন) অতঃপর আমি বললাম- হ্যাঁ। নাবী (দ.) বললেন ঃ এটাই তাদের ইবাদাত। অর্থাৎ এভাবেই তারা তাদেরকে রব হিসেবে গ্রহণ করেছে।” -তিরমিযি, হাসান, কিতাবুত তাফসীর, হাদিস # ৩০৯৫।
এই হাদিসটি বলছে যে, ইহুদি-খৃষ্টানদের আলিমগণ আল্লাহ্’র হারামকে হালাল করে এবং হালালকে হারাম করে রব-এর আসনে বসেছিল। তাহলে এই হাদিসটি থেকে বুঝা যায় যে, নাযিলকৃত বিষয় তথা কুরআন ও হাদিস বাদ দিয়ে আলিমদের অনুসরণ করলে আলিমদেরকে রব বানানো হবে। তাই আলিমদের অনুসরণ না করার ব্যাপারে আমাদেরকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
(২) অধিকাংশের ধারণার ভিত্তিতে বুঝতে চাওয়া ঃ
আমার দেখায় বহু মানুষ দেখেছি যাদের সত্য-মিথ্যা, ভাল-মন্দ বুঝার কৌশল হচ্ছে- অধিকাংশ লোকের মতামত বা তাদের সিদ্ধান্ত। এমন অনেককেই আমি দেখেছি যারা বলে যে, দশজন যেখানে আল্লাহও না’কি সেখানে (নাউযু বিল্লাহ্)। অর্থাৎ অধিকাংশ লোক যে পক্ষে আল্লাহ্ও না’কি সেই পক্ষের (নাউযুবিল্লাহ্)। অর্থাৎ যেই দলে লোকের সংখ্যা বেশি সেই দলই সত্যের উপর রয়েছে আর যেই দলের লোকের সংখ্যা কম সেই দলই মিথ্যার উপর রয়েছে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন,
“(ইবলিস্) বলল; দেখুনতো, এ’না সে ব্যক্তি, যাকে আপনি আমার চাইতেও উচ্চ মর্যাদা দিয়েছেন। যদি আপনি আমাকে কেয়ামত দিবস পর্যন্ত সময় দেন, তবে আমি তার সন্তানদের অধিকাংশকেই আমার করায়ত্ত্বে নিয়ে নেব অল্প সংখ্যক ব্যতীত।” -সূরা বানী ইসরাঈল, ১৭/৬২
তাহলে উল্লেখিত আয়াতটি থেকে বুঝা যায় যে, আদাম (আ.) এর সন্তানদের অধিকাংশই থাকবে শয়তানের করায়ত্ত্বে আর অল্প সংখ্যক থাকবে শয়তানের ক্ষমতার বাহিরে। তাছাড়া “অধিকাংশ লোকের ধারণাটা” হলো একটি কুফুরী ধারণা। এ সম্পর্কে মহান সুবহানাহু ওয়াতায়ালা বলেন,
“আর যদি আপনি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের কথা মেনে নেন, তবে তারা আপনাকে আল্লাহ্’র পথ থেকে পথভ্রষ্ট করে দেবে। তারা শুধূ অলীক কল্পনার অনুসরণ করে এবং সম্পূর্ণ অনুমান ভিত্তিক কথাবার্তা বলে থাকে।” -সূরা আল-আন’আম, ৬/১১৬
আয়াতটিতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা বলছেন যে, অধিকাংশ লোকের কথামত যদি আমরা চলি তাহলে আমরা পথভ্রষ্ট হয়ে যাবো। কিন্তু আমরা যদি আল্লাহ্ ও তাঁর রসুলের ওয়াহী মোতাবেক চলি তাহলে সঠিক পথ পেতে পারি।
অতএব, উল্লেখিত আলোচনা থেকে এটাই প্রতিয়মান হয় যে, অধিকাংশ লোকের ধারণার ভিত্তিতে সত্য-মিথ্যা যাচাই-বাছাই করা যায় না। সত্য-মিথ্যা মূলত ইসলাম তথা কুরআন এবং হাদিসের অনুগামী। তাই আমাদেরকে সত্য-মিথ্যার যে চেতনাবোধ আল্লাহ্ দিয়েছেন তাকে কার্যকর করার জন্য আল্লাহ্’র সাহায্য ও কুরআন এবং হাদিসের অনুসরণ করতে হবে।
(৩) বাপ-দাদা বা পূর্ব পুরুষের ধারণার ভিত্তিতে ঃ
আমাদের দেশের কতিপয় মানুষ আছে তাদেরকে যখন বলা হয় কুরআন এবং হাদিসে এরকম আছে আপনারা তার উল্টোটা কেন করছেন? তখন তারা বলে যে, এ ব্যাপারে আমাদের বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষ থেকে এরকম করে আসছি। আবার অনেকে বলেন যে, “কুরআন আর হাদিসে নেই কিন্তু মুরুব্বিরা বলেছেন তাই করতে হয়”। আবার অনেকে বলেন “কুরআন-হাদিসে না থাকলেও মুরুব্বিরা বলেছেন তাই করতে হয়।” এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন,
“আর যখন তাদেরকে কেউ বলে যে, সে হুকুমেরই অনুসরণ কর যা আল্লাহ্ নাযিল করেছেন, তখন তারা বলে কখনো না, আমরা তো সে বিষয়েরই অনুসরণ করব। যাতে আমরা আমাদের বাপ-দাদাদেরকে দেখেছি। যদিও তাদের বাপ-দাদারা কিছুই জানতো না, জানতো না সরল পথও।” -সূরা বাক্বারাহ্, ২/১৭০
উল্লেখিত আয়াতটি থেকে বুঝা যায় যে, সত্যের মোকাবেলায় বাপ-দাদা বা পুর্বপুরুষদের অনুসরণ করার পরিণতি হচ্ছে জাহান্নাম।
(৪) কিছু মানুষ সত্য-মিথ্যাকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে সত্যকে গ্রহণ করে ঃ
মহান আল্লাহ্ বলেন,
“যারা মনোনিবেশ সহকারে কথা শুনে, অতঃপর যা উত্তম, তার অনুসরণ করে। তাদেরকেই আল্লাহ্ সৎপথ প্রদর্শন করেন এবং তারাই বুদ্ধিমান।” -সূরা যুমার, ৩৯/১৮
এই আয়াতটিতে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা বলছেন যে, যারা মনোনিবেশ সহকারে কথা শুনে তারপর নিজের বিবেক বুদ্ধি খাটিয়ে বিভিন্ন জ্ঞানীদের সাথে আলোচনা করে, পকেটের টাকা খরচ করে এবং কষ্ট স্বীকার করে বা বিভিন্নভাবে যাচাই বাছাই করে যেটা উত্তম সেটা গ্রহণ করে তাদেরকেই আল্লাহ্ সৎপথ প্রদর্শন করেন এবং তারাই বুদ্ধিমান। কারণ সত্য আর মিথ্যা নিয়ে গবেষণা করাই হলো বুদ্ধিমানের কাজ। আর বুদ্ধিমানেরা কখনো এই কথা বলেন না যে, অমুকে বুঝলেই আমি বুঝবো!
মহান আল্লাহ্ বলেন,
“...জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস কর যদি তোমাদের কোন বিষয় সম্পর্কে জানা না থাকে দালিল, প্রমাণসহকারে এবং আপনার কাছে স্মরণিকা অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি লোকদের সামনে ঐসব বিষয় বিবৃত করেন, যেগুলো তাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে, যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে।” -সূরা নাহল, ১৬/৪৩-৪৪
এই আয়াতটিতে আল্লাহ্ বারি তায়ালা সত্য সন্ধানীদের পথকে খুলে দিয়েছেন। যেন সত্য সন্ধানী মানুষেরা দালিল-প্রমাণ পেয়ে চিন্তা-ভাবনা করে। অর্থাৎ জ্ঞানীদের অন্ধভাবে মানতে বলেননি। বলেছেন, জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস কর দালিল, প্রমাণসহকারে যদি তোমাদের কোন বিষয় সম্পর্কে জানা না থাকে। আল্লাহ্ বারি তায়ালা বলছেন যে, তোমার নিজের কাছে যতক্ষণ পর্যন্ত না সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত জ্ঞানীদের কাছ থেকে দালিল-প্রমাণসহকারে জেনে নাও।
মহান আল্লাহ্ বলেন,
“এই কিতাব সত্য সন্ধানীদের জন্য পথ নির্দেশ।” -সূরা বাক্বারাহ্, ২/২
অর্থাৎ উল্লেখিত আয়াতে কারীমার মধ্যে আল্লাহ্ বারি তায়ালা বলছেন যে, যারা সত্যকে সত্য বলে মানতে চায় আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলে মানতে চায় বা যারা সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করে নিজেদের জীবনকে সাজায় যদিও বা এই সত্য-মিথ্যা তাদের নিজেদের বিরুদ্ধে যায় এবং সমূহক্ষতির সম্ভাবনা থাকে তারপরেও তারা সত্য-মিথ্যাকে পার্থক্য করে চলতে চায় তাদের জন্য এই কিতাব পথ নির্দেশ হিসেবে কাজ করে। কুরআনুম মাজীদ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন,
“...যা মানুষের জন্য পথনির্দেশ এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী।...” -সূরা বাক্বারাহ্, ২/১৮৫
কুরআন সুন্নাহ্’র আলোকে তাক্বলীদ
তাক্বলীদ = হার পড়ানো, গলায় পড়নো, গলায় ঝুলানো, অর্পণ করা (পশুকে চালানোর জন্য) গলায় দড়ি বাঁধা -মু'জামুল ওয়াফী, প্রকাশকাল # মে ২০১২ইং, রিয়াদ প্রকাশনী, পৃষ্ঠা # ৮০০।
শারী’আহ্’র বিষয়ে ওয়াহী ছাড়া অন্য কারোর
তাক্বলীদ করা শিরক্ এবং কুফর
তাক্বলীদ অর্থ মূলত ঝুঝানো হয় যে, কোন আলিমকে নিজের সাথে বেঁধে নেওয়া। অর্থাৎ ঐ আলিম শারী’আহ্’র বিষয়ে যা বলবেন তিনি তাই মেনে নিবেন নির্দিধায়। এভাবে কারো অনুসরণ করা মূলত শিরক্ এবং কুফর। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন-
“যখন তাদেরকে বলা হয় তোমরা ঐ বিষয়ের অনুসরণ কর যা আল্লাহ্ নাযিল করেছেন। তখন তারা বলে বরং আমরা তারই উপর চলবো যার উপর আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছি। যদিও তাদেও বাপ-দাদারা কিছুই বুঝতো না এবং সঠিক পথে চলতো না, তবুও। এই কাফিরদের তুলনা সেই ব্যক্তির মত যে এমন কিছুকে ডাকে যা হাঁক-ডাক ছাড়া আর কিছুই শোনেনা। বধির, মূক ও অন্ধ কাজেই তারা বুঝবে না। -সূরা বাক্বারাহ্, ২/১৭০-১৭১
এই আয়াতটি থেকে বুঝা যায়, যারা আল্লাহ্’র নাযিলকৃত বিষয় বাদ দিয়ে নিজেদের বাপ-দাদাদেও অনুসরণ করে অর্থাৎ বাপ-দাদাদের তাক্বলীদ করে তাদেরকে আল্লাহ্ কাফির বলেছেন। ঠিক এই কাফিরদের মতই বর্তমানে যারা মাযহাবের অনুসারী তারা চার মাযহাবের যে কোন একটির অনুসরণ করে তাদের বাপ-দাদাদের মাযহাব অনুযায়ী। অর্থাৎ বাবা যদি হানাফী হয় তাহলে ছেলেও হানাফী হয় এবং বাবা যদি শাফিঈ হয় তাহলে ছেলেও শাফিঈ হয়। যে কারণে এইভাবে মাযহাবের অনুসরণ করা শিরক্-কুফর হয়ে গিয়েছে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ আরো বলেন,
“তারা তাদের পণ্ডিত ও দরবেশদেরকে রব বানিয়ে নিয়েছে...।” -সূরা তাওবাহ্, ৯/৩১
এই আয়াতের তাফসীওে রসূলুল্লাহ্ (দ.) আদী বিন হাতিম (রা) কে বলেছেন,
“তোমাদের আলিমগণ যদি আল্লাহ্ যা হালাল করেছেন তা যদি হারাম করত তোমরা কি হারাম বলে মেনে নিতে না এবং তোমাদের আলিমগণ যদি আল্লাহ্ যা হারাম করেছেন তা যদি হালাল করত তোমরা কি হালাল বলে মেনে নিতে না? হ্যাঁ মেনে নিতাম। তখন রসূলুল্লাহ্ (দ.) বললেন ঐভাবেই তোমরা তোমাদের আলিমগণের ইবাদাত করেছ। -তিরমিযী, হাসান, অধ্যায় ঃ কিতাবুত তাফসীর, অনুচ্ছেদ ঃ সূরা তাওহবাহ ৩১ নং আয়াত, হাদিস # ৩০৯৫।
এই হাদিসের ব্যাখ্যা থেকে বুঝা যায় আলিমগণকে অন্ধভাবে মেনে নিলে তা আল্লাহ্’র ইবাদাত না হয়ে আলিমগণের ইবাদত হয়ে যাবে। অর্থাৎ অন্ধভাবে আলিগণের তাক্বলীদ করলে তা আলিমগণের ইবাদাত হবে। যে কারণে শারী’আহ্’র বিষয়ে ওয়াহী ছাড়া কারো তাক্বলীদ করলে তা শিরক এবং কুফর হবে।
সংশয়মূলক প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন (১) ঃ
মহান আল্লাহ্ বলেন,
“আর ্যদি লোকেরা এই বিষয়টি রসূল ও ঊলুল আমরের কাছে পেশ করতো তবে যাদের সিদ্ধন্ত নেবার যোগ্যতা আছে তারা বিষয়টি উদ্ঘাটন করত (সমাধান দিতে পারত)।” -সূরা নিসা, ৪/৮৩
এই আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, যে সকল লোকদের সিদ্ধান্ত নেবার যোগ্যতা নেই তাদেও উচিৎ ঐ সকল লোকদের তাক্বলীদ করা যারা গবেষণা ও সুক্ষ্ম বিচার করতে পারে।
উত্তর ঃ
এই ব্যাখ্যাটি সঠিক নয় তাছাড়া প্রশ্নকারী আয়াতে প্রথম অংশটি উল্লেখ করেননি। আয়াতটি লক্ষ্য করুন-
“যখন তাদের নিকট নিরাপত্তা কিংবা ভয়ের কোন সংবা আসে তখন তারা তা রটিয়ে দেয়। যদি তারা তা রসূলের কিংবা তাদের মধ্যে ্যারা ঊলিল আমর রয়েছেন তাদের কাছে পেশ করত তবে তাদের মধ্যে সুক্ষ্ম বিচারকারী প্রকৃত তথ্য জেনে নিতে পারত...।” -সূরা নিসা, ৪/৮৩
আয়াতটির প্রতি গভীরভাবে লক্ষ্য করুন কিছু লোক রয়েছে যারা কোন খবর পেলেই তা রটিয়ে দেয়। তাদেরকে তা না রটিয়ে রসূলুল্লাহ্ (দ.) বা ঊলিল আমরের নিকট থেকে যাচাই করার কথা বলা হয়েছে। যেহেতু এই আয়াতে মহান আল্লাহ্ যাচাই করতে বলেছেন তাহলে কোনোভাবেই আয়াতটি তাক্বলীদ করার প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় না। বরং আয়াতটি তাক্বলীদ করা যাবে না এই শিক্ষাই দিয়েছে।
প্রশ্ন (২) ঃ
মহান আল্লাহ্ বলেন,
“যে আমার অভিমূখী হয় তার পথ অনুসরণ করবে।” -সূরা লুকমান, ৩১/১৫
এই আয়াত থেকে বুঝা যায় আল্লাহ্ ওয়ালাদের তাক্বলীদ (অন্ধ অনুসরণ) করতে হবে।
উত্তর ঃ
এই ব্যাখ্যাটি মারাত্মক বিভ্রান্তিকর। কারণ প্রশ্নকারী আয়াতের প্রথম অংশটি উল্লেখ করেননি। আয়াতটি লক্ষ্য করুন-
“তোমার পিতা-মাতা যদি তোমাকে জোর করে আমার সাথে শিরক করার জন্য যার জ্ঞান তোমার নেই। তবে তুমি তাদের কথা মানবে না। কিন্তু পৃথিবীতে তাদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস করবে। যে আমার অভিমূখী হয় তার পথ অনুসরণ করবে...।” -সূরা লুকমান, ৩১/১৫
আয়াতটির প্রতি গভীভাবে লক্ষ্য করুন, বলা হয়েছে পিতা-মাতা আল্লাহ্’র সাথে শিরক করতে বললে তাদের কথা মান্য করা যাবে না। বরং যারা আল্লাহ্’র পথে চলে তাদের কথা মানতে হবে। অর্থাৎ যারা আল্লাহ্’র সাথে শিরক বা কুফরীমূলক কথা বলে না। তাদের কথা মানতে হবে। এখন কার কথা শিরক বা কুফরী তা বুঝবেন কি করে? এটা বুঝতে হলে কুরআন বা হাদিসের দালিলসহকারে ্যারা কথা বলে তারাই মূলতঃ আল্লাহ’র পথে রয়েছেন। যদি বিনা দালিলে কারো কথা মানা হয় অর্থাৎ তাক্বলীদ করা হয় তাহলে আপনি কিভাবে বুঝবেন তার বক্তব্য কি শিরক-কুফর হয়েছে না’কি সঠিক হয়েছে? এটা বুঝতে হলে অবশ্যই তাদের কথা যাচাই করে নিতে হবে। তাহলেই বুঝা যাবে কে আল্লাহ্’র পথে রয়েছে। তা’না হলে বুঝা সম্ভব নয়। অতএব, আয়াতটি কোনভাবেই তাক্বলীদের পক্ষে কথা বলেনি। বরং তাক্বলীদ না করা কথাই বুঝিয়েছে।
প্রশ্ন (৩) ঃ
হুযাইফা (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
“নাবী (দ.) বলেছেন, তোমরা আমার পরে আবু বাকার ও ওমারের অনুসরণ করবে।” -তিরমিযী, সহীহ্ লি-গইরিহী, অধ্যায় ঃ ৪৬, রসূলুল্লাহ্ (দ.) এবং তাঁর সাহাবাগণের মর্যাদা, অনুচ্ছেদ ঃ ১৬, আবু বাকার ও ওমার (রা.)গণের গুণাবলী, হাদিস # ৩৬৬২, ৩৬৬৩।
এই হাদিস থেকে বুঝা ্যায় কুরআন ও সুন্নাহ্ ছাড়াও কোন ব্যক্তির তাক্বলীদ (অন্ধ অনুসরণ) করা যায়। অতএব, বুঝা গেল যে, আবু হানীফা, শাফিই, মালিকি ও হাম্বলী মাযহাবের তাক্বলীদ করলে দোষণীয় হবে না।
উত্তর ঃ
এই বিভ্রান্তিমূলক ব্যাখ্যা থেকে আল্লাহ্’র আশ্রয় চাচ্ছি। যদি এই হাদিস দিয়ে তাক্বলীদ বুঝে থাকেন তাহলে আবু বাকার ও ওমারের নামে মাযহাব না করে অন্যদের নামে করলেন কেন? এটাকি রসূলুল্লাহ্ (দ.) এর আদেশ অমান্য হয়ে গেল না? এটাই কি আপনাদের রসূলুল্লাহ্ (দ.) এর আনুগত্যের নমুনা! আসলে তাক্বলীদ আপনাদের মাথা নষ্ট করে দিয়েছে। যে কারণে সব সময়ই খুজতে থাকেন কিভাবে তাক্বলীদের দালিল দেয়া যায়। এই হাদিসটি বুঝতে নিুোক্ত হাদিসটি লক্ষ্য করুন-
“ইবনু আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা যিনার অপরাধে জনৈকা পাগলীকে ধরে এনে ওমার (রা.) এর নিকট হাজির করা হয়। তিনি এ ব্যাপারে লোকদের সঙ্গে পরামর্শ করে তাকে পাথর মেরে হত্যার নির্দেশ দেন। এই সময় আলী (রা.) তাঁর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তিনি প্রশ্ন করলেন এর কি হয়েছে? উপস্থিত লোকেরা বলল সে অমুক গোত্রের পাগল মহিলা। সে যিনা করেছে। ওমার (রা.) তাকে পাথর মেরে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি বললেন, তাকে নিয়ে ফিরে যাও। অতপর, তিনি (আলী (রা.) ওমার (রা.) এর নিকট এসে বললেন, হে আমিরুল মু’মিনীন আপনি কি জানেন না ৩ ধরণের লোকের উপর থেকে ক্বলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। (১) পাগল যতক্ষণ না সে সুস্থ হয়, (২) ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ না ্জাগ্রত হয, (৩) অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু যতক্ষণ না সে প্রাপ্ত বয়স্ক হয়। ওমার (রা.) বললেন, হ্যাঁ আলী (রা.) বললে তাহলে তাকে পাথর মারা হবে কেন? তিনি বললেন কোন কারণ নেই। আলী (রা.) বললেন তবে তাকে ছেড়ে দিন। বর্ণনাকারী বললেন, ওমার (রা.) তাকে ছেড়ে দিলেন এবং আল্লাহু আকবার ধ্বনি উচ্চারণ করলেন। -আবু দাউদ, সহীহ, অধ্যায় ঃ ৩৩, কিতাবুল হুদুদ, অনুচ্ছেদ ঃ ১৬, পাগল চুরি বা হাদ্দযোগ্য অপরাধ করলে, হাদিস # ৪৩৯১।
এই হাদিসটির প্রতি গভীরভাবে লক্ষ্য করুন। আলী (রা.) যখন ওমার (রা.) এর ভুল ধরলেন তখন কিন্তু ওমার (রা.) বলেননি যে, রসূলুল্লাহ্ (দ.) আমার আনুগত্য করতে বলেছেন তারপরেও তুমি আমার ভুল ধরেছ কেন? বরং ওমার (রা.) তাঁর ভুল স্বীকার করে ভুলটি শোধরে নেয়েছেন। তাহলে বুঝা গেল যে, ওমার (রা.) এর অনুসরণও কুরআন এবং হাদিসের আলোকে হতে হবে তাক্বলীদের আলোকে নয়। এ বিষয়টি আরো ভালভাবে বুঝতে নিুোক্ত হাদিসটি লক্ষ্য করুন-
“সালিম বিন আব্দুল্লাহ্ শামের এক লোক থেকে শুনেছেন সে আব্দুল্লাহ্ ইবনু ওমার (রা.) কে প্রশ্ন করেছিলেন তামাত্তু হাজ্জ জায়েজ না’কি নাজায়েয? তিনি বললেন জায়েয। প্রশ্নকারী বললেন, আপনা পিতাতো (ওমার রা.) এটা নিষেধ করেছেন। আব্দুল্লাহ্ ইবনু ওমার (রা.) বললে আমাকে বল আমার আব্বা নিষেধ করেছেন আর রসূলুল্লাহ (দ.) করেছেন এখন আমার আব্বার নির্দেশ মানব না’কি রসূলুল্লাহ্ (দ.) এর নির্দেশ মানবো? প্রশ্নকারী বললেন, বরং রসূলুল্লাহ্ (দ.) এর হুকম-ই মানতে হবে। ইবনু ওমার (রা.) বললেন, আসল বিষয় হলো রসূলুল্লাহ্ (দ.) তামাত্তু হাজ্জ করেছেন।” -তিরমিযী, সহীহ, অধ্যায় ঃ ৭, কিতাবুল হাজ্জ, অনুচ্ছেদ ঃ ১৩, তালবিয়া পাঠ করা, হাদিস # ৮২৪।
এই হাদিস থেকে আরো বুঝা গেল যে, সাহাবায়েকিরামগণ ওমার (রা.) এর তাক্বলীদ করতেন না। তাহলে কি সাহাবায়েকিরামগণ রসূলুল্লাহ্ (দ.) এর আদেশ লংঘণ করেছিলেন? (নাউযুবিল্লাহ্) মোটেই নয়। তাহলে রসূলুল্লাহ্ (দ.) আবু বাকার ও ওর্মা (রা.) এর অনুসরণ করতে বলতে কি বুঝিয়েছেন? মূলতঃ রসূলুল্লাহ্ (দ.) বুঝিয়েছেন তাঁর (দ.) পরে আবু বাকার এবং ওমারকে খালীফাহ্ বানানো হয়। এভাবে বুঝ নিলেই হাদিস বুঝা সহজ হবে।
প্রশ্ন (৪) ঃ
সাহাবাদের জামানায় ব্যক্তি তাক্বলীদের উদাহরণও রয়েছে। ইকরিমা বর্ণনা করেন মাদীনাবাসী ইবনু আব্বাস (রা.) কে ঐ মহিলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল যার ফরয তাওয়াফের পরে হায়েয আসে (সে’কি তাওয়াফে বিদায়ের জন্য পাক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে? না’কি তাওয়াফ বাতিল হয়ে যাবে।) ইবনু আব্বাস (রা.) বললেন সে চলে যেতে পারবে। মাদীনাবাসী বললেন আমরা আপনার কথার প্রেক্ষিতে যায়েদ বিন সাবিত (রা.) এর বিপরীত আ’মাল করব না।” -বুখারী, অধ্যায় ঃ ২৫, কিতাবুল হাজ্জ, অনুচ্ছেদ ঃ ১৪৫, তাওয়াফে যিয়ারতের পর কোন স্ত্রী লোকের ঋতু আসলে, হাদিস # ১৭৫৮।
এই হাদিস থেকে বুঝা যায় মাদীনাবাসীগণ যায়েদ বিন সাবিত (রা.) এর তাক্বলীদ করত এবং তাঁর কথার বিরোধী কারও কথার আ’মাল করতে চাইত না। অতএব, এই হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় ইসলামে তাক্বলীদ বৈধ।
উত্তর ঃ
এই ব্যাখ্যাটি চরমভাবে আপত্তিকর। কারণ, প্রশ্নকারী হাদিসের শেষের অংশ উল্লেখ করেননি। হাদিসের শেষের অংশটি লক্ষ্য করুন। “ইবনু আব্বাস (রা.) বললেন, তোমরা মাদীনায় ফিরে গিয়ে জিজ্ঞেস করে নিবে (অর্থাৎ যাচাই কওে নিবে)। তারা মাদীয়নায় এসে জিজ্ঞেস করলেন যাদের কাছে তারা জিজ্ঞেস করেছিলেন, উম্মে সুলাইম (রা.)ও ছিলেন। -বুখারী, অধ্যায় ঃ ২৫, কিতাবুল হাজ্জ, অনুচ্ছেদ ঃ ১৪৫, তাওয়াফে যিয়ারতের পর কোন স্ত্রী লোকের ঋতু আসলে, হাদিস # ১৭৫৮।
ঘাদিসের শেষের অংশ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় ইবনু আব্বাস (রা.) তাদের যায়েদ বিন সাবিতের কথা অন্ধভাবে না মেনে মদীয়নায় গিয়ে যাচাই করতে বলেছেন এবং মাদীনাবাসীও যাচাই করেছেন। এ থেকেই বুঝা যায় ইবনু আব্বাস তাদের তাক্বলীদ না করে তাহক্বীক বা যাচাই করা শিক্ষা দিয়েছেন। তাছাড়া মাদীনাবাসী যদি যা্েয়দ (রা.) এর তাক্বলীদ করতো তাহলে ইবনু আব্বাস (রা.) কে জিজ্ঞেস করলেন কেন? মোটেই তারা যায়েদ বিন সাবিত (রা.) এর তাক্বলীদ করত না। যে কারণে, যায়েদ (রা.) এর শিক্ষা সঠিক না ভুল তা যাচাই করার জন্যই তারা ইবনু আব্বাস (রা.) কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। এই হাদিসটি কোনভাবেই তাক্বলীদ করা প্রমাণ করে না। বরং তাক্বলীদ না করাই প্রমাণিত হয়।
প্রশ্ন (৫) ঃ
কোন হাদিস সহীহ, বা যঈফ নির্ণয় করতে ইমামগণ থেকে মতামত গ্রহণ করতে হয়। কোন রাবী বিশ্বস্ত বা অবিশ্বস্ত যা কি’না ইমামগণের তাক্বলীদ বুঝায়। যে তাক্বলীদ আমরা সকলেই করে থাকি। এ থেকেই বুঝা যায় ইসলামে তাক্বলীদ রয়েছে।
উত্তর ঃ
এই ব্যাখ্যাটি সঠিক নয়। কারণ, হাদিসের ইমামগণের থেকে আমরা শারী’আহ’র বিধান নেই না। বরং হাদিসের রাবীগণ কে ভাল বা খারাপ তা গ্রহণ করি। এই বিষয়টি মোটেই ইমামগণের তাক্বলীদ নয়। যেমন- মা আয়েশা’র বিষয়ে রসূলুল্লাহ্ (দ.) কাজের মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। বর্ণনাটি লক্ষ্য করুন-
“...(মা আয়েশা বলেন) রসূলুল্লাহ্ (দ.) আমার ঘরে এসে আমার কাজের মেয়েকে আমার বিষয়ে প্রশ্ন করলেন। সে বলল আল্লাহ্’র ক্বসম আমি তাঁর মধ্যে কোন দোষ দেখিনি। তবে এতটুকু যে, সে ঘুমিয়ে পড়তো আর বকরী এসে তার পেশা আটা খেয়ে যেত...। -তিরমিযী, সহীহ্, অধ্যায় ঃ ২৫, কিতাবুত তাফসীর, অনুচ্ছেদ ঃ ২৫, সূরা নূর, হাদিস # ৩১৮০।
এই হাদিসটি গভীরভাবে লক্ষ্য করুন,
“রসূলুল্লাহ্ (দ) মা আয়েশা সম্পর্কে জানার জন্য কাজের মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছেন। এখন কি রসূলুল্লাহ (দ.) কাজের মেয়ের তাক্বলীদ করেছেন? নিশ্চয়্ই এতবড় বেয়দাবী কথা আপনারা বলবেন না! তাহলে বুঝা গেল কোন মানুষ সম্পর্কে জানার জন্য কারো কথা মান্য্ করলে তাক্বলীদ হয় না। ঠিক তেমনি হাদিসের রাবী সম্পর্কে ইমামগণ থেকে জেনে নিলে তা তাক্বলীদ হয় না। আশা করি উত্তরটি পেয়েছেন।
সংশয়মূলক প্রশ্নের উত্তর
প্রশ্ন (১) ঃ
ভাই আপনি বললেন, আল্লাহ্ আলিমদের অনেক মর্যাদা দিয়েছেন কিন্তু তাঁদেরকে অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। অথচ আল্লাহ্ তায়ালা বলছেন,
“হে ঈমানদারগণ তোমরা আল্লাহ্’র আনুগত্য কর এবং আনুগত্য কর রসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যাঁরা উলিল আমর (আলিম) রয়েছেন তাঁদের...” -সূরা নিসা, ৪/৫৯।
তাহলে আয়াতটিতে আল্লাহ্ উলিল আমর (আলিমদের)-এর আনুগত্য করতে বলে ঐ আয়াতটি তথা সূরা আ’রাফ, ৭/৩নং আয়াতটিকে পরস্পর বিরোধী আয়াত নাযিল করেছেন (নাউযুবিল্লাহ্)?
তাহলে কি এই কুরআন সুরা নিসা’র ৪/৮২ নং আয়াতের আলোকে মহান আল্লাহ্ তায়ালার পক্ষ থেকে আসেনি?
উত্তর ঃ
ভাই কুরআন আল্লাহ্’র পক্ষ থেকেই এসেছে আর এতে কোন সাংঘর্ষিকতাও নেই। আসলে ভাই আপনি প্রথম অংশটি পড়েছেন! দ্বিতীয় অংশটি পড়েননি। আর দ্বিতীয় অংশটিতেই আপনার পশ্নে সমাধান রয়েছে। আলিমদের অনুসরণ করার ব্যাপারে কুরআন ও হাদিসে কোন কিছু উল্লেখ নেই, বরং না করার ব্যাপারেই আছে। আর সুরা নিসা’র ৪/৫৯ নং আয়াতে আলিমদের অনুসরণ করতে বলেননি। আল্লাহ্ বলেছেন,
“হে ঈমানদারগণ তোমরা আল্লাহ্’র আনুগত্য কর এবং আনুগত্য কর রসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যাঁরা উলিল আমর আলিম রয়েছেন তাঁদেরও। আর যদি কোন একটি বিষয়ে মতবিরোধ হয় তাহলে তোমরা সেটি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও...” -সূরা নিসা, ৪/৫৯।
তাহলে আয়াতটি বলছে যে, উলিল আমর (আলিম)গণ যদি আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের আনুগত্যের নির্দেশ দেয় তাহলে যেন আমরা তাঁর উলিল আমরের (আলিমদের) সেই নির্দেশের আনুগত্য করি।
তাহলে এখন আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে হবে আপনার বোধগম্যতার জন্য। আচ্ছা বলুনতো কোনো উলিল আমর (আলিম) যদি আপনাকে আল্লাহ্ এবং তাঁর রসূলের আনুগত্যের নির্দেশ দেয় আর আপনি যদি সেই উলিল আমরের (আলিমের) নির্দেশের আনুগত্য করেন তাহলে কি সেটা উলিল আমরের তথা সেই আলিমের আনুগত্য করা হবে? নিশ্চয়ই না। বরং সেটা আল্লাহ এবং তাঁর রসূলেরই আনুগত্য করা হবে।
তাহলে উল্লেখিত আয়াতটি বুঝতে আপনি একটু ভুল করেছেন। আয়াতটির দ্বিতীয় অংশটিতেই এর সমাধান দিয়ে দিয়েছেন। আর সূরা আ’রাফ ৭/৩নং আয়াতে আল্লাহ্ কিন্তু নাযিলকৃত বিষয় বাদ দিয়ে কোনো আওলিয়ার অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। এটা বলেননি যে কোনো উলিল আমর তথা আলিম যদি আল্লাহ্ এবং তাঁর রসূলের আনুগত্যের নির্দেশ দেন তাহলে তোমরা সেই নির্দেশটা মেনো না।
প্রশ্ন (২) ঃ
আমি ঈশ্বরের ইচ্ছায় নাস্তিক, আপনি তাঁর বিরোধীতা করার কে?
উত্তর ঃ
আমি তাঁর (আল্লাহ্’র) বিরোধীতা করছি না। আমি বিরোধীতা করছি আপনার। কারণ নাস্তিকতা আপনি নিজেই বাছাই করে গ্রহণ করেছেন। দেখুন, আল্লাহ্ আপনাকে সত্য-মিথ্যা বুঝার জন্য তিনটি উপদান দিয়েছেন- (১) সর্বোত্তম দেহ (২) ভাল ও মন্দের চেতনাবোধ (৪) ঐচ্ছিকতা।
আল্লাহ্ আপনাকে যেমন নাস্তিকতাটা চাপিয়ে দেননি ঠিক তেমনিভাবে তিনি আমাকে মু’মিন হওয়াটাও চাপিয়ে দেননি। আপনি পছন্দ করেছেন নাস্তিকতা আর আমি পছন্দ করেছি ঈমান। তাই আমরা একজন নাস্তিক এবং আরেকজন মু’মিন। এতে কোনো সন্দেহ-সংশয় নেই যে, সত্য সঠিক পথ বা সহজ সরল পথ আল্লাহ্’র ইচ্ছাতেই পেয়ে থাকি। তবে আল্লাহ্’র পক্ষ থেকে সত্যপথ বা সঠিক পথ পাওয়ার জন্য ঐচ্ছিকতাটা মূলত আমরা মানুষের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিয়েছেন।”
“যে ব্যক্তি সত্য প্রকাশের পরও রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথ ছেড়ে ভিন্ন পথ ধরে। সে যে দিকে যেতে চায় আমি তাকে সেদিকেই ফিরিয়ে দিব। অতঃপর তাকে জাহান্নাম উপহার দিব। কত খারাপ সেই জায়গা।” -সূরা নিসা ৪/ ১১৫
আয়াতটি বলছে সত্যপথ প্রকাশের পর কেউ যদি রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মু’মিনদের পথ ছেড়ে ভিন্নপথ ধরে সে যে দিকে যেতে চাইবে তাকে সে দিকেই ফিরিয়ে দেয়া হবে। অর্থাৎ সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় আমরা যেটাই গ্রহণ করব তিনি সেটাই আমাদেরকে দিবেন।
মহান আল্লাহ্ তায়ালা আরও বলেন,
“বলুন; সত্য তোমাদের রব-এর পক্ষ থেকে আগত। অতএব, যার ইচ্ছা, বিশ্বাস স্থাপন করুক এবং যার ইচ্ছা অমান্য করুক...” -সূরা কাহ্ফ, ১৮/২৯
উল্লেখিত সূরা নিসা ৪/ ১১৫নং আয়াত এবং সূরা কাহ্ফ, ১৮/২৯নং আয়াত দু’টি দ্বারা প্রতিয়মান হয় যে, সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ গ্রহণ করা না করা সম্পূর্ণ মানুষের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। তবে হ্যাঁ সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ যে যেটাই গ্রহণ করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে সেটাই দান করবেন।
তাছাড়া আল্লাহ্ যদি চাপিয়ে দেয়ার নীতি গ্রহণ করতেন তাহলে এই পৃথিবী কোনো কাফিরকেই রেহাই দিতেন না, এমনকি আপনিও না। এসম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন,
“যদি আল্লাহ্ লোকদেরকে তাদের অন্যায় কাজের কারণে পাকড়াও করতেন, তবে ভৃপৃষ্ঠে চলমান কোন কিছুকেই ছাড়তেন না। কিন্তু তিনি প্রতিশ্র“ত সময় পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দেন। অতঃপর নির্ধারিত সময়ে যখন তাদের মৃত্যু এসে যাবে, তখন এক মূহুর্তও বিলম্বিত কিংবা তরান্বিত করতে পারবে না।” -সূরা নাহল, ১৬/৬১
আয়াতটি বলছে যে, আজকে যারা শিরক-বিদ’আত, কুফুরী ও নাস্তিকতার পথ বেছে নিয়েছে তারা যেন এটা না ভাবে যে, তাদেরকে পাকড়াও করা হবে না। তাদেরকে কিছু না বলার কারণ হলো “আল্লাহ্ প্রতিশ্র“ত সময় পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দিয়ে রেখেছেন। এ কারণেই আল্লাহ্ তাদের এখন কিছু বলছেন না। তবে হ্যাঁ অচিরেই সেই প্রতিশ্র“ত সময় যখন চলে আসবে তখন টের পাবে “কত ধানে কত চাল, চান্দু এবার যাইবা কই।”
©somewhere in net ltd.