![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
শহীদুল জহিরকে সাহিত্যপ্রেমীরা চিনেন একজন লেখক হিসেবে। এর বাইরেও তাঁর একটা পরিচয় ছিল । তাঁর প্রশাসনিক নাম ‘’শহীদুল হক’’ । বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ১৯৮১ ব্যাচের কর্মকর্তা।
শহীদুল জহির তাঁর মৃত্যুর পর বেশ পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠেছেন ক্রমশ । আমি তাঁর কোন লেখাই সম্পূর্ণ পড়ে শেষ করতে পারে নাই। এটা একান্তই আমার ব্যর্থতা। তাই তাঁর সাহিত্য নিয়ে কথা বলা আমার জন্য শোভনীয় নয় ।
তিনি তাঁর সাবেক সহকর্মী সিরাজ উদ্দিন সাথীকে নিজের আক্ষেপ এর কথা বলেছেন এভাবে, ‘‘আমার ভুল হয়েছে এই সম্প্রদায়ে শরিক হওয়া। এখানে ওপরের আমলাদের আদেশ পালন ছাড়া নিজের বুদ্ধিতে কিছুই করার থাকে না জুনিয়রদের। এ যেন গোলামির ব্যবস্থা। চাকরের জীবন।”
১৯৮৪ সালের সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখ, বুলগেরিয়া প্রবাসী বন্ধু রশিদের কাছে চিঠি লিখেছেন শহীদুল জহির। ততদিনে আমলা হিসেবে প্রশাসনে তিন বছর পার করে ফেলেছেন।
তিনি লিখেছিলেন,
‘’আমলা হয়ে একটা ব্যাপার ক্রমে আমার উপলব্ধিতে স্পষ্ট হচ্ছে। এখান থেকে আমরা যখন চারদিকে তাকাই, ঘটনা অবলোকন করি তখন এর ভেতর নিজেকে খুঁজে পাই না। কোনো তাড়না মেটার সঙ্গে দেয়ালের বাইরের জীবনের যোগ আছে সেটা আমাদের তাড়িত করে না। অনেক কিছু হয়তো বুঝি বুদ্ধিমানের মতো, কিন্তু যে বোধ তাড়নার জন্ম দেয় না সে বোধ শুধু নিষ্ফলা নয়, সেটা অতি জড়।
আমাদের প্রকাশ অনেক কম। বলার কথা থাকে না। যে বলে অনেক, করে না কিছুই, সে প্রতারক। কিন্তু যারা বলে না কিছুই, করেও না কিছু তারা?
আমি একটা কথা তোকে বলতে পারি, তোরা বিদেশে বসে দেশ সম্পর্কে যেটুকু ভাবিস কিম্বা চেষ্টা করিস, এখানে এই দেশে বসে কেউ তা করে না। আমাদের দেশটা দারিদ্র্যের কোন ভয়াবহ স্তরে আছে এবং একে টেনে তুলতে হলে সত্যিকারভাবে কতটুকু উদ্যোগ প্রয়োজন সেটা না বোঝাটা কিংবা বুঝতে চেষ্টা না করাটা সবার জন্য মঙ্গলজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্যানসার রোগীর মতো। ডাক্তারের কাছে যেতেও যার ভয়।
জাতি হিসেবে আমরা মরে যাচ্ছি দ্রুত। এখানে শুধু দুটো জিনিস আছে এই মুহূর্তে। বিচ্ছিন্নভাবে অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই, সম্পদ লাভের প্রচেষ্টা এবং সেই তৎপরতায় ব্যর্থ হয়ে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেটা ঘটে, হতাশায় নিমজ্জিত হওয়া।
এই ব্যাপারটা অবশ্য আমাদের ভেতরেই, মধ্যবিত্ত আর কি, সীমাবদ্ধ। বাকি জনগোষ্ঠী স্বপ্ন দেখে না, তুই জানিস। এই জনগোষ্ঠীর কী যে অবস্থা দাঁড়াবে সেটা আমার চিন্তায় আসে না। প্রত্যেকটি গতকাল এদের জন্য আজকের তুলনায় ভালোয় দাঁড়াচ্ছে।
এভাবে আর কতদিন টিকবে। এদের জন্য দুঃখ বোধটাও এখন সত্যিকার অর্থে কুমিরের অশ্রুর সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে। তবু কেমন যেন খারাপ লাগে আমার। আমার জীবনে বিষাদের কারণসমূহের মধ্যে এটাও একটা।‘’
সময়টা ১৯৮২ আর চলছিল এরশাদের সামরিক শাসন। । যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে মাত্রই যোগ দিয়েছেন সিরাজ উদ্দিন সাথী। আর শহীদুল জহিরের সে সময় যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন শাখার সহকারী সচিব।
বিষয়টি ছিল একটি ঘুষের ঘটনার বিভাগীয় তদন্ত। অভিযোগটা এসেছিল প্রধান সামরিক শাসকের কার্যালয় থেকে। পাবনায় কর্মরত আনোয়ারুজ্জামান নামের একজন মোটর ভ্যাহিকল ইন্সপেক্টর ফিটনেস ইস্যু করার কাজে গাড়ির মালিকের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন। ঘুষের সেই অর্থ উদ্ধার করা হয়েছে অফিসের দেয়ালে টাঙানো তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে।
আনোয়ারুজ্জামানের বিরুদ্ধে করা সেই বিভাগীয় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছিল উন্নয়ন শাখার সহকারী সচিব শহীদুল হককে।
সিরাজ উদ্দিন সাথী লিখেছেন, ‘খবর পেয়েই ইন্সপেক্টর আনোয়ারুজ্জামান ছুটে এলেন পাবনা থেকে। দীর্ঘদেহী শ্মশ্রুমণ্ডিত পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোক। চেহারা দেখে কেউ বলবেন না যে এই ভদ্রলোক ঘুষ খেতে পারেন। সহি চেহারার ধার্মিক মুসলমানের চেহারা ও বেশভূষা তাঁর। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। কপালের অগ্রভাগে এর দাগ স্পষ্ট। মন্ত্রণালয়ে এসে তিনি বিভিন্নজনের কক্ষে যাচ্ছেন। কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। দুচোখ বেয়ে তাঁর অশ্রু ঝরছে। আর কেঁদে কেঁদে বলছেন, “আমি এই কর্ম করিনি। আমাকে তারা ফাঁসিয়েছে।” এরপর বিধি মোতাবেক তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো মন্ত্রণালয়ের আদেশে। সেই সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হলো। আদেশের অনুলিপি দেওয়া হলো সিএমএলএ অফিসের অবগতির জন্য।’
তদন্ত করে শহীদুল জহির একটা রিপোর্ট লিখেছিলেন,
‘‘ঘুষের লেনদেন হয় দুই পক্ষের মধ্যে। এক হাতে তালি নয়, দুই হাতের। সমাজের স্বার্থান্বেষী মানুষেরা অনেক ক্ষেত্রে অবৈধ সুবিধা নেওয়ার জন্য উদ্যোগী হয়ে ঘুষ প্রদান সংস্কৃতির বিকাশ ঘটায় ও তা লালন করে। তারা সীমিত আয়ের গরিব সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রলুব্ধ করে অবৈধ বাড়তি আয়ের পথে পা বাড়াতে। অবশ্য দু–চারজন খারাপ কর্মকর্তাও অনেক সময় লোকজনকে ঘুষ প্রদানে বাধ্য করতে নানা কায়দা কৌশল গ্রহণ করে। আর এই দুই পক্ষের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে ঘুষ দুর্নীতির দুষ্ট র্যাকেট বা চক্র।’’
যাঁরা পরিকল্পনা করে তাঁকে টাকা দিয়েছেন, সেই ব্যবসায়ীও সমভাবে দোষী। আনোয়ারুজ্জামানের শাস্তির বিধান করা যেতে পারে কর্তৃপক্ষীয় সিদ্ধান্তে, আর ঘুষদাতা ব্যবসায়ীর শাস্তি হতে পারে দেশে প্রচলিত ফৌজদারি আইনে।’
এই রিপোর্ট পড়ে সিরাজ উদ্দিন সাথী মুগ্ধ হয়েছিলন। নিয়ম অনুযায়ী এই রিপোর্ট তখনকার উপসচিব মোহাম্মদ সাদেকের কাছে নিয়ে যান । উপসচিবের কথা শুনে তাঁর মুগ্ধতার রেশ কেটে গিয়েছিল। উপসচিব ক্ষ্যাপা কণ্ঠে বলেছিলেন,
‘‘এসব কী লিখেছে শহীদ! তাকে তো ভালো অফিসার বলেই জানতাম আমি, কিন্তু সে তো একটা উজবুক! এটা কি কোনো তদন্ত রিপোর্ট হলো? তাকে তাত্ত্বিক আলোচনা করতে বলেছে কে? তাকে পণ্ডিতের মতো সমাজ বিশ্লেষণ করতে বলেছে কে? তার কাজ হলো বিধি অনুসরণ করে অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী কি নির্দোষ, তা নির্দিষ্ট করা। দেশ–জাতি নিয়ে বড় বড় কথা বলা নয়। আপনি তাকে আমার সঙ্গে কথা বলতে বলুন।’’
পরে শহীদুল জহির উপসচিব সাহেবের দেখা করলে তাঁকে নতুন করে রিপোর্ট লিখতে বলেন। তবে শহীদুল জহির রাজি হন নি। বলেছিলেন, আমি যা উপলব্ধি করেছি তাই লিখেছি।
পরে সিরাজ উদ্দিন সাথীকে শহীদুল জহির বলেছিলেন,
‘‘এখানে ঘুষ দুর্নীতি নির্মূলে কেউ কাজ করতে চায় না। কেউ গোড়ায় যেতে চায় না। মূল কারণ খুঁজে বের করতে চায় না। কেবল লোকদেখানো আইওয়াশ করে দায়িত্ব শেষ করতে চায়। আর তা করতে গিয়ে দুর্বল ঘুষখোরকে শিকার বানায়, তাকে নিয়ে হম্বিতম্বি করে বোঝানো হয় যে দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর কর্মসূচি চলছে। আসলে সবাই মিলে দুর্নীতি লালন করছে পরস্পরের সুবিধার জন্য।
টীকা
১। শহীদুল জহির এর চিঠি । পাঠক সমাবেশ
২। শহীদুল জহির যখন ঘুষের তদন্তকারী আমলা (প্রথম আলো) লেখক- শওকত হোসেন । যিনি সিরাজ উদ্দিন সাথী রচিত "
‘আমলাতন্ত্রের অন্দরমহলে বত্রিশ বছর’ নামের গ্রন্থটি'র সহায়তায় উক্ত কলামটি লিখেছেন।
১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৪:৫০
ডার্ক ম্যান বলেছেন: আমার মনে হয়, আমলারা এখন আরও বেশি ডেসপারেট হয়ে গেছেন।
২| ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ সকাল ১০:৫৩
নিবর্হণ নির্ঘোষ বলেছেন: আমলাতন্ত্রের জটিলতা নিয়ে আকবর আলী খানের একটা দারুণ বই আছে , ঘ্রিশাম ল সিন্ড্রোম এন্ড বেয়ন্ড । এই বইতে তিনি আমলাতান্ত্রিকতার প্রসার কেবল সরকারি চাকরি না বেসরকারিতেও আছে । এখন আমি এটা দেখতে পাচ্ছি । এইদেশে আসলে সততা বলে কিছুই নেই আপনি যদি সততার দিকে যান তো দেখতে পাবেন যে আপনার চাকরি তো গেছে গেছে আপনার অস্তিত্বও নেই হয়ে যেতে পারে এই সমাজ থেকে ।
আমাদের দেশে এক সময় শহীদুল জহিরের মত মানুষ জন্মাতো বটে এখন আর জন্মায় না এখন আমরা সরকারি চাকরিতে যাই যতটা না সম্মানের জন্য তার চেয়ে বেশি সেলারি স্ক্যালের বাইরে বিশাল অংকের কামাইয়ের জন্য । আমাদের দেশে সঠিক গবেষণা নেই । যদি থাকতো তবে দেখতে পেতেন এই দেশের মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতির পেছনে আছে বিশাল অংকে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন ও দূর্নীতি !!
ধন্যবাদ আপনাকে এই দারুণ লিখাটি দেবার জন্য !!
১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৪:৫২
ডার্ক ম্যান বলেছেন: আমাদের দেশে এখন প্রশাসনে যাওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে পাওয়ার এক্সারসাইজ করা।
৩| ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ৮:৪১
নীলসাধু বলেছেন: আসলে সবাই মিলে দুর্নীতি লালন করছে করছে পরস্পরের সুবিধার জন্যে।
এটাই সত্য।
১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ৯:৫১
ডার্ক ম্যান বলেছেন: কিন্তু এই সত্যটা স্বীকার করতে আমরা কেউ রাজি না।
৪| ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ৯:৪৭
রাজীব নুর বলেছেন: শহিদুল জহিরের একটা ছবি দেন। দেখি।
১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ৯:৫৩
ডার্ক ম্যান বলেছেন:
৫| ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৫:১২
সোনালি কাবিন বলেছেন: ++
আপনার পোস্টের মাধ্যমে উনার কথা জানা হলো।
১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ৯:১১
ডার্ক ম্যান বলেছেন: মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১|
১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ সকাল ১০:৫২
অপু তানভীর বলেছেন: শহীদুল জহির আমাদের দেশের অন্যতম সেটা একজন কথা সাহিত্যিক । তার লেখার যে ধারণ সে হিসাবে তার আরো জনপ্রিয়তা পাওয়া দরকার ছিল অথচ বেঁচে থাকতে তার কিছুই পান নি । মৃত্যুর পরে লোকজন তাকে যা একটু চেনে এখন ।
আমার কাছে তার পুরো সাহিত্য সমগ্র রয়েছে । যদিও এখনও পড়ে শেষ করতে পারি নি ।
আর আমলা নিয়ে অবস্থা আগে যেমন ছিল এখনও তেমনই আছে । বিন্দু মাত্র পরিবর্তন আসে নি ।