নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার ব্লগ আমার বাসার ড্রয়িং রুমের মত, আমি এখানে যেকোনো কিছু দিয়ে সাজাতে পারি আপনার পছন্দ না হলে বলতে পারেন আমার কোন আসবাবটির অবস্থান বা ডিজাইন আপনার পছন্দ হয় নি এবং কেন হয় নি। তবে তা অবশ্যই ভদ্র ভাষাতে। ভাষার ব্যবহার করতে জানা অনেক বড় একটি গুন

শেখ এম উদ্‌দীন

আমি বাংলাদেশি ....আমি বাঙালী....আমি মুসলিম....আমি বাংলার জন্য জীবন দিতে সর্বদা প্রস্তুত ।

শেখ এম উদ্‌দীন › বিস্তারিত পোস্টঃ

বকশিশ বনাম ঘুষের গল্প

০১ লা জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৩:১৩

[৩০/০৬/২০১৫ এ অনলাইন বাংলা নিউজ পট্রাল এ প্রকাশিত]

২০০৩ সালের ১৩ অক্টোবর আমাদের এইচ এস সি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়। কোন এক অজানা কারনে ওই বছর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) খুব দ্রুত তাদের ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত ভর্তি ফরম জমা দানের শেষ তারিখের মধ্যে আমাদের উপজেলা লেভেলের স্কুল গুলোতে ট্রান্সক্রিপ্ট পৌঁছিবে কিন্তু সেই ট্রান্সক্রিপ্ট আমার কাছে আসতে ওই তারিখ পেরিয়ে হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। তাই কলেজের প্রিন্সিপাল স্যারের ফরওয়ার্ডিং নিয়ে বোর্ড থেকে সরাসরি ট্রান্সক্রিপ্ট উঠানর সিদ্ধান্ত নিলাম।

ঢাকা থেকে রমজানের এক পড়ন্ত বিকালে লঞ্চে উঠে চাঁদের আলোতে নদীর অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে খুব ভোরে পৌঁছে গেলাম বরিশাল শহরে। ইতিপূর্বে ক্লাস সেভেনে পড়াকালীন বাবার সাথে একবার এসেছিলাম এই শহরে। আরেক বার এসেছিলাম ২০০২ সালে বন্ধু বিশ্বজিতের বোনের বিয়েতে ওর প্রক্সি দিতে। প্রতিবারেই বড় কেউ সাথে ছিল। কিন্তু এইবার এই অচেনা পরিসরে আমি সম্পূর্ণ একা। উপরন্তু শিক্ষা বোর্ডের মত বড় সরকারি অফিসে এটাই আমার প্রথম যাত্রা। মনে দুই রকমের ভয় কাজ করছিল প্রথমত বোর্ড অফিসে আমি ঠিক ভাবে চিনে যেতে পারব তো এবং দ্বিতীয়ত চিনে গেলেও আমি যে উদ্দেশ্যে যাচ্ছি তা পূরণ করে আজকের মধ্যেই ঢাকাতে ফিরে যেতে পারব কিনা। লঞ্চ হতে নেমে টার্মিনাল এর বাইরে আসতেই শুনলাম বেবিট্যাক্সির চালক “বোর্ড অফিস বোর্ড অফিস” বলে যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। আমি নির্ভয়ে তার বেবিট্যাক্সিতে উঠে বসলাম এবং নির্ভাবনাতে বোর্ড অফিসে পৌঁছে গেলাম।

বোর্ড অফিসে সকলেই মহাব্যাস্ত। অনেক কেই অনুরোধ করলাম আমার পূরণ কৃত ফরম গুলো একটু নিরীক্ষণ করে দেবার জন্য। কিন্তু সকলেই ব্যস্ততার অজুহাতে এড়িয়ে যাচ্ছিল। অনেকেই দেখলাম বসে ঈদের কেনাকাটা নিয়ে গল্প করছে কিন্তু আমার অনুরোধ রাখার সময় পাচ্ছে না। মনে কষ্ট নিয়ে রুমের এক কোনে দাঁড়িয়ে আল্লাহ্‌র কাছে ওনাদের কেউ একজনের মনে আমার কাজটির গুরুত্ব বুঝবার ক্ষমতা দেয়ার জন্য অনুরোধ করতে থাকলাম।

এমন সময় একজন মহিলা সেকশন অফিসার আমাকে ডেকে উনার টেবিলের সামনে বসালেন এবং বললেন আমার হাতের কাজ শেষ করে তোমার ফরম গুলো আমি দেখে দিব। উনার হাতের কাজ শেষ হবার পরে আমার সমস্যার কথা উনাকে বুঝিয়ে বললাম। বিস্তারিত শুনে উনি আমাকে সকল কাজ হাতে হাতে করানোর পরামর্শ দিলেন কারন হিসেবে বললেন “কাল থেকে অফিস ঈদের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে আজকের মধ্যে যদি তুমি এটা হাতে না পাও তাহলে সাত দিনের মত দেরি হয়ে যাবে”। একথা বলে উনি নিরীক্ষণ শুরু করলেন। সামান্য কিছু ভুল শুধরানোর পরে ওনার কথা মত একটি স্লিপের মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকে নির্ধারিত ফী জমা দিলাম। উনি আমাকে বললেন এখন এই ফর্ম এবং টাকার রসিদ নিয়ে হাতে হাতে ওই রুমে দিয়ে এস। এই কথা বলে তিনি কি যেন চিন্তা করে বললেন তুমি আমার সাথে এসো। আমি উনাকে অনুসরণ করে ওই রুমে পৌঁছানোর পূর্বেই উনি আমার কাগজ স্বাক্ষর করিয়ে আনলেন এবং বললেন এবার সোজা পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের রুমে নিয়ে যাও এবং সেখান হতে একটা স্বাক্ষর হলেই এটা প্রিন্টিং সেকশনে চলে যাবে এবং আমি আশা করি আজকের মধ্যেই তুমি ঢাকা রওয়ানা হতে পারবে। আমি ওনাকে অশেষ ধন্যবাদ দিয়ে নিয়ন্ত্রকের রুমের উদ্দেশ্যে পা চালালাম।

নিয়ন্ত্রকের রুমের সামনে একজন পাঞ্জাবি পড়া শ্মশ্রুমণ্ডিত ভদ্রলোক আমাকে থামালেন এবং কি উদ্দেশ্যে এখানে এসেছি তা জানতে চাইলেন। আমি বিস্তারিত বলার পরে উনি বললেন “এক দিনে উঠানো তো অনেক কঠিন ব্যাপার, ফরম গুলো দেও দেখি কি করা যায়”। আমি ওনার হাতে সকল ফরম দেয়ার পরে উনি এগুলো নিয়ে চলে গেলেন। আমি মনে মনে আল্লাহ্‌কে ধন্যবাদ দিলাম যে আল্লাহ্‌ এখানেও এই ব্যাক্তির মত একজন ভালো মানুষের ব্যবস্থা করে দিলেন।

আমি ওই রুমের উল্টা দিকে খোলা ছাদে হাটা হাটি করতে লাগলাম। ৩০-৩৫ মিনিট পরে উনি এসে বললেন আপনার কাজ তো অনেক জটিল এই কাজ একদিনে করা অনেক কঠিন হবে। আপনি এক কাজ করেন আজ চলে যান ঈদের পরে এসে আমার সাথে যোগাযোগ করবেন আমি উঠিয়ে রাখব। আমি ওনাকে বাকৃবির ভর্তির বিজ্ঞপ্তি দেখিয়ে বললাম এখানে ফরম জমা দিতে হলে আমার এই কাগজ আজকেই তুলতে হবে। উনি কি যেন চিন্তা করে চলে গেলেন। ৫ মিনিট পরে আবার এসে বললেন “নাহ মনে হয় আজ আপনি আর এই কাগজ তুলতে পারবেন না, স্যারের টেবিলে অনেক কাজ জমা হয়ে আছে”। আমি উনাকে নিচের সেকশন অফিসারের কথা বলে বললাম উনি তো বলল আজকের মধ্যে সম্ভব। ভদ্রলোক এতে করে খুব ক্ষ্যাপে গেল এবং বলল “আমি স্যারের সাথেই থাকি সারাদিন আমি জানি না ওই দুই কলম পড়নেওয়ালি সেকশন অফিসার আমার চেয়ে বেশি জানে”?

আমি খুব বিনীত স্বরে বললাম, উনি আমাকে বলেছেন তাই বললাম আর আমি জীবনে এই প্রথম বোর্ড অফিসে এসেছি তাই এত কিছু আমার জানা নাই। উনি কিছুটা নরম হয়ে বললেন, কাজটা আমি করে দিতে পারি কিন্তু বিভিন্ন টেবিলে কিছু বকশিশ দিতে হবে। আমি এবার বুঝে গেলাম এই কাজ কেন এত কঠিন হয়ে গেল। আমি ওনাকে বললাম কি বললেন কাকা বুঝলাম না। উনি বললেন, দুদিন পরে ঈদ ঈদের সময় সকল কাজেই সবাই মোটা বকশিশ দেয়, বকশিশ না দিলে ছেলেমেয়েদের নতুন কাপড় বউয়ের শাড়ি এগুলো আমরা কিভাবে কিনব বলেন তো বাপু। আমি ওনাকে বললাম, আমি আবার বকশিশ দেই না কাকা ঘুষ দেই। ঘুষ দিলে কি আজকের মধ্যে কাজ হবে। উনি নিজের গালে মৃদু কশাঘাত করে আঁতকে উঠে বললেন, কি যা তা বলছেন রোজার দিন এর পরেও আমার মত একজন আল্লাহ্‌ ভক্ত লোক এই হারাম ঘুষ নিয়ে কাজ করবে? আমি সাবলীল ভাবে বললাম চাচা আমার কাছে আপনাকে দেয়ার মত ৫০০ টাকা আছে কিন্তু তা বকশিশ হিসেবে দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। ঘুষ চাইলেই কেবল মাত্র তা দিতে পারি। এতে উনি ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, জানেন ঘুষ দিতে চাওয়ার অপরাধে আপনাকে পুলিশে দেয়া যাবে। আমি বললাম, কাকা আপনি যে বকশিশ চাইলেন সেটার কোন অপরাধের মধ্যে পরে না? আর আমার যা বয়স তাতে পুলিশ আমার আগে আপনাকে থানাতে নিয়ে যাবে বলে আমার মনে হয়। এতে কিছুটা ভড়কে গিয়ে চাচা বললেন, তোমার সাথে এত কথা বলার সময় নাই আমি উপকার করতে চেয়েছি তা তোমার ভালো লাগে নাই। এই কাগজ ঈদের পরেই তুমি পাবা যাও এখান থেকে চলে যাও আমি নামাজে যাব।

উনি চলে যাবার পরে আমি সরাসরি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (যত টুকুন মনে পরে উনার নাম মনিরুজ্জামান ছিল বা ম দিয়ে কোন একটি নাম) স্যারের রুমে ঢুকে ওনাকে সব বলার পরে উনি আমার ফরম গুলো দেখতে চাইলেন। আমি ওনাকে বললাম আমার সকল কাগজপত্র ওই চাচা জমা নিয়েছেন। আমার কথা শুনে মনিরুজ্জামান স্যার আমাকে বসতে বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে।

৫-৭ মিনিট পরে আমার কাগজ গুলো হাতে তিনি রুমে ঢুকলেন। ওনার চেহারা দেখে আমি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। তিনি আমার কাগজ গুলো আমার সামনে দিয়ে বললেন দেখ তো এগুলো কিনা? আমি দেখে উনাকে সম্মতি জানাতে উনি কাগজ নিতে নিতে বলে উঠলেন “ওই চোরটা তোমার কাগজ ওর টেবিলে তালা দিয়ে নামাজের নামে বের হয়ে গেছে। এই কথা বলে কাগজে স্বাক্ষর করে উনি আমাকে ইশারা করলেন ওনার সাথে যেতে। আমি ওনাকে অনুসরণ করে একটি রুমের সামনে এসে দাঁড়ালাম। উনি ভিতরে ঢুকে কিছু নির্দেশনা দিয়ে চলে যাওয়ার সময় মাথাতে হাত রেখে বললেন, কিছু মনে কর না বাবা এই সকল মেকী বকধার্মিকে দেশটা পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে, এরা ইসলামের লেবাস পরে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ১০-১৫ মিনিট এই বারান্দাতে অপেক্ষা কর তোমার কাগজ ওরা তৈরি করে এনে দিবে। আর হ্যাঁ এই যে আমি রুম থেকে বের হয়ে তোমার কাজ করে দিলাম এর দুটি প্রতিদান তোমাকে দিতে হবে”। আমি প্রশ্ন করলাম কি স্যার? উনি বললেন “এক নম্বর হল ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে তোমাকে চান্স পেতে হবে, আর দুই নম্বর হল পড়াশুনা করে বড় কোন চাকুরী নিয়ে এই সকল বকশিশ কাম ঘুষ খোরদের থেকে আমাদের এই দেশটিকে রক্ষা করতে হবে।

উনার প্রথম কথাটি রেখে ছিলাম কিন্তু বৃহৎ পরিসরে দ্বিতীয় কথাটি আজও রাখতে পারি নি। তবে ক্ষুদ্র পরিসরে হয়ত কিছু করেছি এবং আল্লাহ্‌ যদি তৌফিক দেন তাহলে বৃহৎ পরিসরেও পালন করার অদম্য ইচ্ছা মনের মধ্যে সযত্নে লালন করছি।

আসুন, এই রমজানে শপথ নিই- বকশিশ নামক ঘুষসহ যেকোনো দুর্নীতি কে আমরা শক্ত হাতে দমন করব এবং পোশাক নির্ভর ধার্মিক না হয়ে কাজে কর্মে ধার্মিক হব”।
২০০৩ সালের ১৩ অক্টোবর আমাদের এইচ এস সি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়। কোন এক অজানা কারনে ওই বছর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) খুব দ্রুত তাদের ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত ভর্তি ফরম জমা দানের শেষ তারিখের মধ্যে আমাদের উপজেলা লেভেলের স্কুল গুলোতে ট্রান্সক্রিপ্ট পৌঁছিবে কিন্তু সেই ট্রান্সক্রিপ্ট আমার কাছে আসতে ওই তারিখ পেরিয়ে হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। তাই কলেজের প্রিন্সিপাল স্যারের ফরওয়ার্ডিং নিয়ে বোর্ড থেকে সরাসরি ট্রান্সক্রিপ্ট উঠানর সিদ্ধান্ত নিলাম।

ঢাকা থেকে রমজানের এক পড়ন্ত বিকালে লঞ্চে উঠে চাঁদের আলোতে নদীর অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে খুব ভোরে পৌঁছে গেলাম বরিশাল শহরে। ইতিপূর্বে ক্লাস সেভেনে পড়াকালীন বাবার সাথে একবার এসেছিলাম এই শহরে। আরেক বার এসেছিলাম ২০০২ সালে বন্ধু বিশ্বজিতের বোনের বিয়েতে ওর প্রক্সি দিতে। প্রতিবারেই বড় কেউ সাথে ছিল। কিন্তু এইবার এই অচেনা পরিসরে আমি সম্পূর্ণ একা। উপরন্তু শিক্ষা বোর্ডের মত বড় সরকারি অফিসে এটাই আমার প্রথম যাত্রা। মনে দুই রকমের ভয় কাজ করছিল প্রথমত বোর্ড অফিসে আমি ঠিক ভাবে চিনে যেতে পারব তো এবং দ্বিতীয়ত চিনে গেলেও আমি যে উদ্দেশ্যে যাচ্ছি তা পূরণ করে আজকের মধ্যেই ঢাকাতে ফিরে যেতে পারব কিনা। লঞ্চ হতে নেমে টার্মিনাল এর বাইরে আসতেই শুনলাম বেবিট্যাক্সির চালক “বোর্ড অফিস বোর্ড অফিস” বলে যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। আমি নির্ভয়ে তার বেবিট্যাক্সিতে উঠে বসলাম এবং নির্ভাবনাতে বোর্ড অফিসে পৌঁছে গেলাম।

বোর্ড অফিসে সকলেই মহাব্যাস্ত। অনেক কেই অনুরোধ করলাম আমার পূরণ কৃত ফরম গুলো একটু নিরীক্ষণ করে দেবার জন্য। কিন্তু সকলেই ব্যস্ততার অজুহাতে এড়িয়ে যাচ্ছিল। অনেকেই দেখলাম বসে ঈদের কেনাকাটা নিয়ে গল্প করছে কিন্তু আমার অনুরোধ রাখার সময় পাচ্ছে না। মনে কষ্ট নিয়ে রুমের এক কোনে দাঁড়িয়ে আল্লাহ্‌র কাছে ওনাদের কেউ একজনের মনে আমার কাজটির গুরুত্ব বুঝবার ক্ষমতা দেয়ার জন্য অনুরোধ করতে থাকলাম।

এমন সময় একজন মহিলা সেকশন অফিসার আমাকে ডেকে উনার টেবিলের সামনে বসালেন এবং বললেন আমার হাতের কাজ শেষ করে তোমার ফরম গুলো আমি দেখে দিব। উনার হাতের কাজ শেষ হবার পরে আমার সমস্যার কথা উনাকে বুঝিয়ে বললাম। বিস্তারিত শুনে উনি আমাকে সকল কাজ হাতে হাতে করানোর পরামর্শ দিলেন কারন হিসেবে বললেন “কাল থেকে অফিস ঈদের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে আজকের মধ্যে যদি তুমি এটা হাতে না পাও তাহলে সাত দিনের মত দেরি হয়ে যাবে”। একথা বলে উনি নিরীক্ষণ শুরু করলেন। সামান্য কিছু ভুল শুধরানোর পরে ওনার কথা মত একটি স্লিপের মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকে নির্ধারিত ফী জমা দিলাম। উনি আমাকে বললেন এখন এই ফর্ম এবং টাকার রসিদ নিয়ে হাতে হাতে ওই রুমে দিয়ে এস। এই কথা বলে তিনি কি যেন চিন্তা করে বললেন তুমি আমার সাথে এসো। আমি উনাকে অনুসরণ করে ওই রুমে পৌঁছানোর পূর্বেই উনি আমার কাগজ স্বাক্ষর করিয়ে আনলেন এবং বললেন এবার সোজা পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের রুমে নিয়ে যাও এবং সেখান হতে একটা স্বাক্ষর হলেই এটা প্রিন্টিং সেকশনে চলে যাবে এবং আমি আশা করি আজকের মধ্যেই তুমি ঢাকা রওয়ানা হতে পারবে। আমি ওনাকে অশেষ ধন্যবাদ দিয়ে নিয়ন্ত্রকের রুমের উদ্দেশ্যে পা চালালাম।

নিয়ন্ত্রকের রুমের সামনে একজন পাঞ্জাবি পড়া শ্মশ্রুমণ্ডিত ভদ্রলোক আমাকে থামালেন এবং কি উদ্দেশ্যে এখানে এসেছি তা জানতে চাইলেন। আমি বিস্তারিত বলার পরে উনি বললেন “এক দিনে উঠানো তো অনেক কঠিন ব্যাপার, ফরম গুলো দেও দেখি কি করা যায়”। আমি ওনার হাতে সকল ফরম দেয়ার পরে উনি এগুলো নিয়ে চলে গেলেন। আমি মনে মনে আল্লাহ্‌কে ধন্যবাদ দিলাম যে আল্লাহ্‌ এখানেও এই ব্যাক্তির মত একজন ভালো মানুষের ব্যবস্থা করে দিলেন।

আমি ওই রুমের উল্টা দিকে খোলা ছাদে হাটা হাটি করতে লাগলাম। ৩০-৩৫ মিনিট পরে উনি এসে বললেন আপনার কাজ তো অনেক জটিল এই কাজ একদিনে করা অনেক কঠিন হবে। আপনি এক কাজ করেন আজ চলে যান ঈদের পরে এসে আমার সাথে যোগাযোগ করবেন আমি উঠিয়ে রাখব। আমি ওনাকে বাকৃবির ভর্তির বিজ্ঞপ্তি দেখিয়ে বললাম এখানে ফরম জমা দিতে হলে আমার এই কাগজ আজকেই তুলতে হবে। উনি কি যেন চিন্তা করে চলে গেলেন। ৫ মিনিট পরে আবার এসে বললেন “নাহ মনে হয় আজ আপনি আর এই কাগজ তুলতে পারবেন না, স্যারের টেবিলে অনেক কাজ জমা হয়ে আছে”। আমি উনাকে নিচের সেকশন অফিসারের কথা বলে বললাম উনি তো বলল আজকের মধ্যে সম্ভব। ভদ্রলোক এতে করে খুব ক্ষ্যাপে গেল এবং বলল “আমি স্যারের সাথেই থাকি সারাদিন আমি জানি না ওই দুই কলম পড়নেওয়ালি সেকশন অফিসার আমার চেয়ে বেশি জানে”?

আমি খুব বিনীত স্বরে বললাম, উনি আমাকে বলেছেন তাই বললাম আর আমি জীবনে এই প্রথম বোর্ড অফিসে এসেছি তাই এত কিছু আমার জানা নাই। উনি কিছুটা নরম হয়ে বললেন, কাজটা আমি করে দিতে পারি কিন্তু বিভিন্ন টেবিলে কিছু বকশিশ দিতে হবে। আমি এবার বুঝে গেলাম এই কাজ কেন এত কঠিন হয়ে গেল। আমি ওনাকে বললাম কি বললেন কাকা বুঝলাম না। উনি বললেন, দুদিন পরে ঈদ ঈদের সময় সকল কাজেই সবাই মোটা বকশিশ দেয়, বকশিশ না দিলে ছেলেমেয়েদের নতুন কাপড় বউয়ের শাড়ি এগুলো আমরা কিভাবে কিনব বলেন তো বাপু। আমি ওনাকে বললাম, আমি আবার বকশিশ দেই না কাকা ঘুষ দেই। ঘুষ দিলে কি আজকের মধ্যে কাজ হবে। উনি নিজের গালে মৃদু কশাঘাত করে আঁতকে উঠে বললেন, কি যা তা বলছেন রোজার দিন এর পরেও আমার মত একজন আল্লাহ্‌ ভক্ত লোক এই হারাম ঘুষ নিয়ে কাজ করবে? আমি সাবলীল ভাবে বললাম চাচা আমার কাছে আপনাকে দেয়ার মত ৫০০ টাকা আছে কিন্তু তা বকশিশ হিসেবে দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। ঘুষ চাইলেই কেবল মাত্র তা দিতে পারি। এতে উনি ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, জানেন ঘুষ দিতে চাওয়ার অপরাধে আপনাকে পুলিশে দেয়া যাবে। আমি বললাম, কাকা আপনি যে বকশিশ চাইলেন সেটার কোন অপরাধের মধ্যে পরে না? আর আমার যা বয়স তাতে পুলিশ আমার আগে আপনাকে থানাতে নিয়ে যাবে বলে আমার মনে হয়। এতে কিছুটা ভড়কে গিয়ে চাচা বললেন, তোমার সাথে এত কথা বলার সময় নাই আমি উপকার করতে চেয়েছি তা তোমার ভালো লাগে নাই। এই কাগজ ঈদের পরেই তুমি পাবা যাও এখান থেকে চলে যাও আমি নামাজে যাব।

উনি চলে যাবার পরে আমি সরাসরি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (যত টুকুন মনে পরে উনার নাম মনিরুজ্জামান ছিল বা ম দিয়ে কোন একটি নাম) স্যারের রুমে ঢুকে ওনাকে সব বলার পরে উনি আমার ফরম গুলো দেখতে চাইলেন। আমি ওনাকে বললাম আমার সকল কাগজপত্র ওই চাচা জমা নিয়েছেন। আমার কথা শুনে মনিরুজ্জামান স্যার আমাকে বসতে বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে।

৫-৭ মিনিট পরে আমার কাগজ গুলো হাতে তিনি রুমে ঢুকলেন। ওনার চেহারা দেখে আমি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। তিনি আমার কাগজ গুলো আমার সামনে দিয়ে বললেন দেখ তো এগুলো কিনা? আমি দেখে উনাকে সম্মতি জানাতে উনি কাগজ নিতে নিতে বলে উঠলেন “ওই চোরটা তোমার কাগজ ওর টেবিলে তালা দিয়ে নামাজের নামে বের হয়ে গেছে। এই কথা বলে কাগজে স্বাক্ষর করে উনি আমাকে ইশারা করলেন ওনার সাথে যেতে। আমি ওনাকে অনুসরণ করে একটি রুমের সামনে এসে দাঁড়ালাম। উনি ভিতরে ঢুকে কিছু নির্দেশনা দিয়ে চলে যাওয়ার সময় মাথাতে হাত রেখে বললেন, কিছু মনে কর না বাবা এই সকল মেকী বকধার্মিকে দেশটা পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে, এরা ইসলামের লেবাস পরে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ১০-১৫ মিনিট এই বারান্দাতে অপেক্ষা কর তোমার কাগজ ওরা তৈরি করে এনে দিবে। আর হ্যাঁ এই যে আমি রুম থেকে বের হয়ে তোমার কাজ করে দিলাম এর দুটি প্রতিদান তোমাকে দিতে হবে”। আমি প্রশ্ন করলাম কি স্যার? উনি বললেন “এক নম্বর হল ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে তোমাকে চান্স পেতে হবে, আর দুই নম্বর হল পড়াশুনা করে বড় কোন চাকুরী নিয়ে এই সকল বকশিশ কাম ঘুষ খোরদের থেকে আমাদের এই দেশটিকে রক্ষা করতে হবে।

উনার প্রথম কথাটি রেখে ছিলাম কিন্তু বৃহৎ পরিসরে দ্বিতীয় কথাটি আজও রাখতে পারি নি। তবে ক্ষুদ্র পরিসরে হয়ত কিছু করেছি এবং আল্লাহ্‌ যদি তৌফিক দেন তাহলে বৃহৎ পরিসরেও পালন করার অদম্য ইচ্ছা মনের মধ্যে সযত্নে লালন করছি।

আসুন, এই রমজানে শপথ নিই- বকশিশ নামক ঘুষসহ যেকোনো দুর্নীতি কে আমরা শক্ত হাতে দমন করব এবং পোশাক নির্ভর ধার্মিক না হয়ে কাজে কর্মে ধার্মিক হব”।


বকশিশ বনাম ঘুষের গল্প

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.