![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিখে সুখ পাই তাই লিখে যাই।নিজের জন্যই লিখতে শুরু করেছি।হয়ত একদিন সবার জন্য লিখতে শুরু করবো।
সকাল সন্ধ্যার আসা যাওয়া আমার জীবন ডায়েরিটিকে কিছুটা পুরনো এবং অনেকটা সমৃদ্ধ করেছে।ডায়েরির পুরনো পাতা উল্টে যতই পিছনে সরে আসছি আমার অতীত আমাকে ততই আপন করে নিচ্ছে।কারণ এ এমন এক সৃষ্টি আমিই যার স্রষ্টা!
আমার অতীত বড়ই অম্লমধুর।হঠাৎ মনে হলো সংসারে আমি এক তুখোড় অভিনেতা।আসলে জীবনের নির্মম সত্য হলো আমরা সবাই এই মঞ্চনাটকে অংশ নিয়েছি।আমাদের যোগ্যতা অনুযায়ী পরিচালক আমাদের আপন চরিত্র বুঝিয়ে দিয়েছেন।ক্রমান্বয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে জীবন, ঘনিয়ে আসছে মৃত্যু।এভাবেই বয়ে যাচ্ছে জীবন জীবনের নিয়মে।৯০ এর শুরুতেই আমার জন্ম।সুখে দুঃখে পেরিয়ে এলাম জীবনের প্রথম কুড়ি।সুখ নিয়ে লেখার বিশেষ কিছু নেই।সুখের সাথি অনেক।কিন্তু আমার এই দেড় ভিঘত বুকে জমে আছে সাগরসম শোক।শোকের ভারে ভারাক্রান্ত এই আমি।আমার চোখে আর কত অশ্রু আছে যে শোক গুলো সব ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে যাবে! আত চোখের জ্বলে কি বুকের খত ধোওয়া যায়? আজ ইচ্ছে হলো শোক নিয়ে জীবন থেকে একটা কিছু লিখ।তারপর কার চোখে জ্বল আসে চেয়ে দেখি! ঐ বুঝি কেউ আসে আমার শোকে সান্তনা দিতে।তখন আমি অনেক ছোট। বাবা বন্দরনগরী চট্টগ্রামে এক বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন।সেই সুত্রে সপরিবারে আমাদের চট্টগ্রামেই থাকা হতো।বাবা মা আর দুই ভাইবোন নিয়েই ছিলো আমাদের ছোট্ট সুখের সংসার। এলাকায় বাবার বিশেষ প্রভাব ছিলো।ফলে অনেকেই আমাকে এট ওটা কিনে খাওয়াতো।আদরের এই পর্বটি বাবার বিশেষ ভালো লাগতো না।ধীরেধীরে তা বিরক্তির পার্যায়ে গিয়ে ঠেকলো।এদিকে আমার দশা হলো দশচক্রে ভগবান ভূত।পরিস্থিতি আমাকে বাধ্য করলো দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে নানুর বাড়ি চলে আসতে।ময়মনসিংহ জেলার শহরতলি গলগন্ডা থেকেই শুরু হলো আমার জীবনের দ্বিতীয় পর্ব।নানুর বাড়ি থেকে মাইল দশেক দূরে এক হোষ্টেলে উঠে ময়মনসিংহের বিদ্যাপাঠ শুরু করলাম।সত্যি বলছি, বাবা মা আর ছোট বোনটিকে নিয়ে বেশ ছিলাম আমি।স্বপ্নময় শৈশব বলতে আমরা ঠিক যেমনটি বুঝি।আমি আজো বুঝে উঠতে পারিনি এমন কী মহামানব হওয়ার ছিলো আমার; যা আমাকে আমার স্বপ্নময় শৈশব থেকে ছিনিয়ে নিয়ে হোষ্টেলের রুড় জীবনে ছুড়ে দিয়েছিল।এতবড় একটি ত্যাগের বিনিময়ে প্রাপ্তি প্রশ্নে অপ্রাপ্তিই শুধু চোখে পড়ে।
এক শনিবারের কথা মনে পড়ে!
হ্যাঁ, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শনি বয়ে এনেছিলো ওই শনিবার। সময়টা ছিলো ১৬ই অক্টোবর ১৯৯৯ ইং।হোষ্টেলের নিয়মানুসারে সকালের নাস্তা সেরে ঘুম দিলাম।আমার আজো মনে পড়ে সেদিন খুব সুন্দর একটি স্বপ্ন দেখেছিলাম। সে সময় ঢাকা চট্টগ্রাম রোডে নতুন নেমেছিল সুবর্না এক্সপ্রেস। স্বপ্নে সুবর্নাকেই বেছে নিলাম।বাতাসের বুকচিরে নিমিষেই চট্টগ্রাম গিয়ে পৌঁছুলাম। বাবা দৌড়ে এসে বুকে তুলে নিলো।কপালে চুমু খেলো।আলতো করে গাল টিপে দিলো! বাবার কাছে একটি শিশুর আর কিইবা চাওয়ার ছিলো!ছোট বেলায় বাবা আমার সাথে খেলতে বেরুতো।মনেহয় স্বপ্নেও আমাকে নিরাশ করতে চায়নি।বল নিয়ে আমি ছুটে চলেছি পিছে বাবা মিছে ভান করছে।হঠাৎ কোন অনাকাঙ্ক্ষিত আগাছায় পা আটকে পড়ে গেলাম।অমনি এক লাফে ঘুম থেকে উঠে বসলাম। তখনো আমার নাভিশ্বাস কমেনি।"তুমি বাড়ি যেতে চাইলে রেডি হয়ে নাও"।বলেই চলে গেলেন হেডস্যার।আমার তখন দম যায় যায় অবস্থা। সত্যি বলছি, এখন ঈদেও এতো আনন্দ হয়না সেদিন ওইটুকু কথায় অবুঝ হৃদয় যতটুকু দোলা খেয়েছিল।কোনরকম কাপড় পড়ে আমাকে নিতে আসা খালুর সাথে বেড়িয়ে পরলাম। তখন বন্ধুদের সবাই আমাকে ঈর্ষার দৃষ্টতে দেখছিল।তাদের চকচকে অসহায় চোখ গুলো আমাকে অন্যরকম আনন্দ দিচ্ছিলো।কিন্তু হায়, সময়ের সামান্য ব্যাবধানেই আমরা আমাদের নাবলা কথা গুলো বদলে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম।
নানুবাড়ি আসতেই সেজু খালামণি জড়িয়ে ধরে হাঁওমাঁও করে কান্না করে দিলো! ঘটনার আকস্মিকতায় বোধ হারা হয়ে গেলাম।"তোর আব্বুর জন্য দুওয়া করিস।তোর আব্বু অনেক অসুস্থ।এখন একদম কথা বলতে পারেনা।হয়তো মাদ্রাজে নিয়ে যাবে তোর আব্বুকে!" ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কথা গুলো বললো খালামণি। বাবাকে একটু কাছে পাওয়ার জন্য, বাবা বলে একটু ডাকতে পারার জন্য অবুঝ শিশুটির সেদিনের সান্ধ্য প্রার্থনাটি কেমন হয়ে ছিলো? পৃথিবির তাবৎ কথাসাহিত্যিকের কথায় কম পড়ে যাবে তবু ঘটনার প্রকৃত মর্ম উঠে আসবেনা!
শহরের মূলকেন্দ্রেই আমার দাদুবাড়ি।মাদ্রাজে নেওয়ার আগে আব্বুকে ওখানেই নিয়ে আসা হচ্ছে।মাগরিবের আযান শুরু হওয়ায় বাসা থেকে বের হচ্ছিলাম।আবারো ডেকে বসলো সেজু খালা।টের পেলাম আমার পা জোড়া যেন নড়ছেই না।আর কী শোনার বাকি আছে আমার? দুরুদুরু বুকে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। "আব্বু! তোর বাবাকে আল্লাহ্ এই পৃথিবী থেকে উঠিয়ে নিয়েছেন।তিনি আর আমাদের মাঝে নেই।" (ইন্নালিল্লাহি...)
আজ এতদিন পর কলম হাতে নিয়ে একটি কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, সেদিন শিশুটির বয়স হঠাৎ করেই বেড়ে গিয়েছিল। তার ধারণার চেয়েও অনেক বেশি! "তুমি না বলেছিলে আব্বু অসুস্থ?" প্রশ্নের মাধ্যমে উদগত কান্না গোপনের প্রাণপণ প্রচেষ্টা! "তোকে যে আমরা বলতে পারিনারে আব্বু!" কোত্থেকে যেন নানু এসে জড়িয়ে ধরলো।আর পারিনি আমি।সত্যি আর ধরে রাখতে পারিনি নিজেকে।ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলাম মুহূর্তেই।সুন্দর এই পৃথিবীতে সহসাই অসহায় হয়ে পড়লাম আমি।আমার মনে হলো পৃথিবী আমাকে করুণার দৃষ্টিতে দেখছে।এভাবেই সেদিন শিশুটির বয়স বেড়ে গিয়েছিল লোক চক্ষুর অন্তরালে।সদ্য এতিম শিশুটি সেদিন কতটুকু কান্না করেছে কে তার হিসাব রেখেছে? আজো চোখের জ্বলে ঝাপসা হয়ে এলো দৃষ্টিসীমার সবকিছু! কিন্তু কে তার খোঁজ নিয়েছে? কিছু কিছু কষ্ট নির্জনেই কাছে আসে, কাঁদিয়ে যায় নিরবে।রাত এগারোটায় বাবার মৃতদেহ দাদুবাড়ি নিয়ে আসা হলো। আমি তখন অতিশোকে পাথর।যতদূর মনে পড়ে বাবার সামনে আমার চোখে জ্বল আসেনি।রাতে বাবার কপাল টিপে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়াটা ছিলো আমার অন্যতম একটি সখের কাজ।তাই শেষবারের মত আলতো করে বাবার কপাল টিপে দিলাম।কপালে চুমু খেলাম।এভাবেই ফিরে এসেছিলো আমার সকালে দেখা স্বপ্ন।এমন সময় ভেতরবাড়ি থেকে করুণ আহাজারি শুনতে পেলাম।আমি বুঝে নিলাম ইনিই আমার সদ্যবিধবা মা।ধীরপায়ে ভেতরবাড়িতে এলাম।প্রকৃতির কাছে হেরে যাওয়া বিধবা মার সেকি করুণ আকুতি! যন্ত্রের মত লক্ষ করলাম মার প্রাণবায়ুও যায় যায় করছে।হঠাৎ ছোট বোনটিকে খুঁজে পেলাম।নির্বাক দুটি চোখ মার দিকে মেলে আছে।রাত বারোটায় জানাযা।সবাই একে একে শেষ দেখা দেখে নিলো।শুধু আমার হতভাগিনী মা'ই বঞ্চিতা রইলো।সদ্য বিধবার সেকি মর্মপীড়া! এতো শোক কেন আসে আমাদের জীবনে? এই শোক সইতে পারেনি আম্মুর শরীর।কোনভাবেই আম্মুর জ্ঞান থাকছিলনা।অবশেষে আম্মুকে না দেখিয়েই নিয়ে যেতে হলো আব্বুকে।সাড়ে বাড়টার দিকে আব্বুর দ্বিতীয় জানাযা অনুষ্ঠিত হলো! ওইতো আব্বুকে গোর গুহায় রাখা হয়েছে। সবাই মাটি দিচ্ছে মুঠো মুঠো।আমি দাঁড়িয়ে আছি আবগশূণ্য যন্ত্রমানব হয়ে।"আব্বুর কবরে মাটি দিবেনা বাবা"? কে বললো কে জানে! কিন্তু পরক্ষণেই আমার শরীর কাঁপিয়ে কান্না পেলো।দু'মুঠো মাটি দিয়েই একটু নির্জনে সরে এলাম।ছোট বোনটির কথা মনে পড়লো।ওর বয়স আর কত হবে তখন? মুখ ভার করে বাবার কাছে নিত্যনতুন বায়না ধরা শিখেছে কেবল।পৃথিবির আর কোন শক্তি নেই যে বাবাকে ফিরিয়ে আনে আমার ছোট বোনটির কাছে।সেসময় অনেকেই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো, আর করুণার দৃষ্টিতে তাকাতো।অমনি আমার চোখ ফেটে জ্বল চলে আসতো! এভাবেই আমি আদরের ভাতিজা ভাগিনা থেকে করুণার পাত্রে পরিণত হয়েছিলাম। ছোট বোনটির জন্য খুব কষ্ট হয়।বাবার আদর সে পায়নি বললেই চলে।বাবা বিয়োগে তার মনেও কত কষ্ট জমে আছে জানিনা।আমার আর কিইবা আছে যে তাকে বাবার আদর দিবো? আমি শুধু বলবো আমি আমার এই বোনটির জন্য সব করতে পারি।তাঁকে প্রাণাধিক ভালবাসি।
দেখতে দেখতেই পেরিয়ে গেলো পনেরোটি বছর।ফিরে তাকালে মনেহয় এইতো সেদিন! অতীত বুঝি এভাবেই কথা বলে।কষ্টের বুঝা অনেক ভারি, তবুও বয়ে বেড়াতে হয় জীবনতরী।আমি জানি কষ্টে কত কষ্ট।তাই শোকার্তের পাশে দাঁড়াতে ভালবাসি।
আজকের এইদিনে খুব জানতে ইচ্ছে করছে, তুমি কেমন আছ বাবা? কী সুখ তুমি পাউ একা একা ওখানে? তুমি ঘুমুবার সময় কেউ তুমার মাথা টিপে দেয়তো? হয়তো তুমি ভালই আছ।কিন্তু আমি? কতদিন আব্বু আব্বু বলে ডাকতে পারিনা বলতে পার? বাবা তুমি ভালো আছতো?
©somewhere in net ltd.