নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

টিএম একরাম

টিএম একরাম › বিস্তারিত পোস্টঃ

রায়-নন্দিনী : সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী

২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:৩৬

৫ম পর্ব...........
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
পরামর্শ


যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য আজ খুব সকাল সকাল কাছারি ভাঙ্গিয়া দিয়াছেন। প্রতাপাদিত্য মন্ত্রণা-গৃহে একখানি রৌপ্য-সিংহাসনে বসিয়াছেন। পার্শ্বে তাঁহার শ্যামাকান্ত ও অন্যতম সেনাপতি কালিদাস ঢালী মখ্মল-ম-িত উচ্চ রুদ্র চৌকির উপর উপবিষ্ট। দালানের দরজা বন্ধ। জানালাগুলি কেবল মুক্ত রহিয়াছে। দূরে ফটকের কাছে একজন পর্তুগীজ সিপাহী পাহারা দিতেছে।
তাহার উপর কড়া হুকুম, যেন রাজাদেশ ব্যতীত কাহাকেও প্রবেশ করিতে দেওয়া না হয়। প্রতাপাদিত্যের চরু মদ্যপানে রক্তবর্ণ। তাঁহার শরীর বেশ বলিষ্ঠ এবং অসুরের ন্যায় পেশীসম্পন্ন। চরুর দৃষ্টি অন্তর্ভেদী অথচ নির্মম। মুখম-লে বীরত্বের তেজ নাই; কেবল ক্রূরতা ও নিষ্ঠুরতা বিরাজমান। চেহারায় লাবণ্যের পরিবর্তে তীব্র কামুকতার চিহ্ন দেদীপ্যমান। তাঁহাকে দেখিলে যুগপৎ ভীতি এবং ঘৃণার উদ্রেক হয়। প্রতাপাদিত্যের বয়স ৫৫ বৎসর হইলেও তাঁহার ইন্দ্রিয়পরায়ণতার কিছুমাত্র হ্রাস হয় নাই। একজন কবিরাজ দিবারাত্র তাঁহাকে কামাগ্নি-সন্দীপন রস, কামেশ্বর মোদক, চন্দ্রোদয় মকরধ্বজ ইত্যাদি কামেন্দ্রিয় উত্তেজক ঔষধ সরবরাহ করিবার জন্য নিযুক্ত রহিয়াছে। সুন্দরী স্ত্রীলোকের অনুসন্ধানের জন্য একদল গোয়েন্দাও নিযুক্ত আছে। প্রতাপাদিত্য যেমন কামুক, তেমনি নিষ্ঠুর। বঙ্গের সরস কোমল ভূমিতে তাঁহার ন্যায় মহাপাষ-, নৃশংস ও নর-পিশাচ, অতীতে বিজয় সিংহ, রাজা কংস এবং উত্তর কালে দেবী সিংহ ও নবকৃষ্ণ ব্যতীত আর কেহ জন্মগ্রহণ করিয়াছে বলিয়া মনে হয় না।
প্রতাপাদিত্য কৰের নীরবতা ভঙ্গ করিয়া বলিলেন: “কমলাকান্ত! এতদিনে ত বসন্তখুড়োর নিপাত করতে সমর্থ হ’লাম। কিন্তু কেদার রায়ের কন্যা স্বর্ণময়ীকে নিয়ে এখনও ত কেউ ফিরল না!”
মন্ত্রী: মহারাজ! আপনি বসন্তপুরে গিয়েছিলেন বলে তত্ত্ব জানাবার সুবিধা হয়নি। স্বর্ণময়ীকে যারা লুঠতে গিয়েছিল, তারা অকৃতকার্য হয়ে ফিরে এসেছে।
প্রতাপ: কি! অকৃতকার্য হয়ে ফিরল!
মন্ত্রী: আজ্ঞে হাঁ, অকৃতকার্য হয়ে।
প্রতাপ: ডাকো তাদের।
মন্ত্রী তখন তাহাদিগকে ডাকিবার জন্য সিপাহীদের ব্যারাকে লোক পাঠাইলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে রামদাস, রাধাকান্ত, হরি, শিবা, মাধা প্রভৃতি আসিয়া মাটিতে লুটাইয়া প্রতাপকে দ-বৎ করিল। তৎপরে দাঁড়াইয়া কাঁপিতে লাগিল।
প্রতাপ: কেদার রায়ের কন্যা কোথায়?
রাধাকান্ত: মহারাজ! তাকে ঈসা খাঁ ছিনিয়ে নিয়েছে।
ক্রমশ..............
প্রতাপ: তোদের ঘাড়ে মাথা থাকতে?
রাধা: আমাদের অবশিষ্ট সকলেই মারা পড়েছে। আমাদের দোষ নেই। অপরাধ মার্জনা করুন।প্রতাপ ব্যাঘ্রের ন্যায় ভীষণ গর্জন করিয়া কহিলেন, “যা এখনই তোদের একেবারে মার্জনা করছি।” এই বলিয়া জলৱাদের সর্দারকে আদেশ করিলেন যে, “এদের গায়ে আলকাতরা মেখে আগুনে পোড়াও।”
বলা বাহুল্য, পাঁচটি প্রাণী অর্ধ ঘণ্টার মধ্যে এইরূপ নিষ্ঠুরভাবে ভস্মীভূত হইয়া পৃথিবী হইতে উড়িয়া গেল।
প্রতাপ ইহাদিগকে ভস্ম করিবার আদেশ দিলেন; কিন্তু নিজের পৈশাচিক কামানলে আহুতি দিবার জন্য স্বর্ণময়ীর চিন্তায় চঞ্চল ও উন্মত্ত হইয়া উঠিলেন। তাঁহার ব্যাকুলতা দেখিয়া শ্যামাকান্ত বলিলেন, “মহারাজ! ব্যস্ত হবেন না। আগামী আষাঢ়ের মহর্রম-উৎসব উপলক্ষে সৈন্য পাঠিয়ে স্বর্ণময়ীকে লুঠে আনবার জোগাড় করছি।”
সেনাপতি কালিদাস ঢালী বলিল, “এই পরামর্শই ঠিক। মহরম উপলক্ষে সাদুলৱাপুরে মহোৎসব হয়ে থাকে, নানাদেশ হতে লোক-সমাগম হয়। সেই সময় যাত্রীবেশে বহুসৈন্য প্রেরণ করতে পারব। একবার ধরে ‘ময়ূরপঙ্খী’তে তুলতে পারলেই হয়। একশ’ দাঁড়ের ময়ূরপঙ্খী কারও ধরবার সাধ্য হবে না।”প্রতাপ: কিন্তু কেদার রায় এৰণে খুব সাবধান হয়েছে। স্বর্ণময়ীকে রৰা করবার জন্য অবশ্যই উপযুক্ত রৰী রাখবে। সাদুলৱাপুরের মিত্রদের লোকজনের অভাব নাই।
শ্যামা: সেই যা’ একটু ভাবনা। প্রথমে একটা দাঙ্গা হবে।
প্রতাপ: সে কি দাঙ্গা? সে যে দস্থরমত যুদ্ধ বাঁধবে। এই ত চর-মুখে শুনলেম যে, সাদুলৱাপুরের মিত্র-বাড়ীতে স্বর্ণময়ীর রৰাকল্পে দুইশ’ সিপাহী কেদার রায় পাঠিয়েছেন।
কালিদাস: তা হোক। আমাদের মাহতাব খাঁ সেনাপতি সাহেব যদি যান, তা হলে আমরা দুইশত সিপাহী নিয়েও হাজার লোকের ভিতর হতে কেদার রায়ের কন্যাকে ছিনিয়ে আনতে পাবো।
প্রতাপ: (একটু হাসিয়া) কেন, তুমি একাকী সাহস পাও না কি?
কালি: সাহস পাব না কেন, মহারাজ! কিন্তু জানেন ত, সাবধানের মার নেই। খাঁ সাহেব আমার চেয়ে সাহসী এবং কৌশলী। বিশেষতঃ সিপাহীরা তাঁর কথায় বিশেষ উৎসাহিত হয়। তিনি সঙ্গে থাকলে কার্যসিদ্ধি অবশ্যম্ভাবী।
প্রতাপ: তবে তাঁকে ডাকান যাক।
কালি: আজ্ঞা হাঁ! তাঁর সঙ্গেও পরামর্শ করতে হচ্ছে।
প্রতাপাদিত্য তখনই সেনাপতি মাহতাব খাঁকে ডাকিবার জন্য লোক পাঠাইলেন। অর্ধ ঘণ্টার মধ্যে খাঁ সাহেব আসিয়া উপস্থিত হইলেন। খাঁ সাহেবের বয়স ত্রিশের উপরে নহে। দেখিতে অত্যন্ত রূপবান ও তেজস্বী। চরিত্র অতি পবিত্র, মূর্তি গম্ভীর অথচ মনোহর। তাঁহার চাল-চলনে ও কথা-বার্তায় এমন একটা আদব-কায়দা ও আত্মসম্মানের ভাব ছিল যে, সকলেই তাঁহাকে বিশেষ শ্রদ্ধা ও সম্মান করিত। প্রতাপাদিত্যের মত পাপিষ্ঠ প্রভুও তাঁহাকে দেখিয়া সম্ভ্রম করিতেন। প্রতাপ, খাঁ সাহেবের সহিত কদাপি কোনও কুপরামর্শ করিতে সাহসী হন নাই। তাঁহার সহিত হাসি-ঠাট্টা করিতে পর্যন্ত সাহস পাইতেন না। তাঁহাকে দেখিলেই যেন লোকে সভ্য-ভব্য হইয়া পড়িত। অথচ তিনি অত্যন্ত মিতভাষী ও সরল প্রকৃতির লোক ছিলেন। প্রতাপাদিত্যের আহ্বান বা নিজের বিশেষ গরজ ব্যতীত খাঁ সাহেব কদাপি দরবারে আসিতেন না। ফল কথা, প্রতাপ ও খাঁ সাহেবের মধ্যে প্রভু-ভৃত্যের ব্যবহার ছিল না। বিজাতির কাছে কেমন করিয়া আত্মসম্মান রৰা করিয়া চাকুরী করিতে হয়, খাঁ সাহেব তাহা ভালোরূপেই জানিতেন।
খাঁ সাহেব আসন গ্রহণ করিলে কালিদাস সমস্ত কথা সংৰেপে বুঝাইয়া বলিলেন। খাঁ সাহেব বলিলেন: “পাত্রী কি মহারাজের প্রতি আসক্তা?”
কালি: না, তাহলে কি আর এত গোলযোগ হয়? সেরূপ হলে ত অনায়াসেই কার্যসিদ্ধি হত। তা হলে আর আপনাকে ডাকবার আবশ্যক হত না।
খাঁ: তবে ত এ কার্য বড়ই কলঙ্কের।
কালি: কোন্ পৰে?
খাঁ: মহারাজের পৰে। তাকে জোর করে আনলে সে কি মহারাজকে শাদী করবে?
কালি: জোর করে শাদী করাব। শাদী না করে বাঁদী করে রাখব।
খাঁ: কাজটা বড়ই ঘৃণিত। এ কাপুরুষের কার্য।
প্রতাপের হৃদয় স্বর্ণময়ীর জন্য উন্মত্ত। সুতরাং খাঁ সাহেবের কথাগুলি তাঁহার কর্ণে বিষদগ্ধ শল্যের ন্যায় প্রবেশ করিল। আর কেহ হইলে হয়ত প্রতাপ তখনি মাথা কাটিবার আদেশ দিতেন। কিন্তু খাঁ সাহেব ৰমতাশালী বীরপুরুষ বলিয়াই তাহা হইল না। তবুও প্রতাপ বিরক্তি-ব্যঞ্জক স্বরে বলিলেন: “খাঁ সাহেব! আপনাকে ধর্মের উপদেশ দেবার জন্য ডাকা হয়নি।”
খাঁ: আমিও তা বলছি না। কিন্তু কিসের জন্য ডেকেছেন মহারাজ?
প্রতাপ: স্বর্ণময়ীকে এনে দিতে হবে।
খাঁ: কেমন করে?
প্রতাপ: লুঠ করে।
খাঁ: মহারাজ! মাফ করুন, এমন কার্য ধর্ম সইবে না।
প্রতাপ: আবার ধর্মের কথা?
খাঁ: তবে কি ধর্ম পরিত্যাগ করব?প্রতাপ: প্রভুর আজ্ঞা পালনই ধর্ম।
খাঁ: অধর্মজনক আজ্ঞাও কি?
প্রতাপ: আজ্ঞা পালন দিয়ে কথা, তাতে আবার ধর্মাধর্ম কি?
খাঁ: মহারাজ! তবে কি আপনি ধর্মাধর্ম মানেন না?
প্রতাপ: প্রতাপাদিত্য অমন ধর্মের মুখে পদাঘাত করে।
খাঁ: তওবা! তওবা!! এমন কথা বলবেন না, মহারাজ! সামান্য প্রভুত্ব পেয়ে আত্মহারা হবেন না। পরকাল আছে- বিচার আছে- জীবনের হিসাব-নিকাশ আছে- দীন-দুনিয়ার বাদশাহ খোদাতালা নিত্য জাগ্রত। তিনি সবই দেখছেন।
প্রতাপ: ওসব কোরান-কেতাবের কথা রেখে দিন। ওটা মুসলমানদেরই শ্রবণযোগ্য। আমি হিন্দু, ও-সব মানি না।
খাঁ: কেন, হিন্দুশাস্ত্রে কি কোরানের উপদেশ নেই?
প্রতাপাদিত্য বড়ই জ্বলিয়া গেলেন। তাঁহার ধৈর্যের বন্ধন ছিন্ন হইয়া গেল। রাগিয়া বলিলেন: “ও-সব শাস্ত্র দুনিয়ায় ঢালো। আমার শাস্ত্র স্বর্ণময়ী, আমার ধর্ম স্বর্ণময়ী। আমি তাকেই চাই। যেমন করেই হোক তাকে এনে দিতে হবে।”
খাঁ: মহারাজ! আমি মুসলমান, আমি বীরপুরুষ। তস্করের ন্যায় লুঠে আনতে পারব না। ওটা দস্যুর কার্য। স্ত্রীলোকের প্রতি অত্যাচার কাপুরুষের পৰেই শোভা পায়।
প্রতাপ: কিন্তু আমার অনুরোধে তা একবারের জন্য করতেই হবে।
খাঁ: মহারাজ, অনুগতকে মাফ করবেন।প্রতাপ: খাঁ সাহেব! মার্জনা করবার সময় থাকলে, কখনই আপনাকে আহ্বান করতাম না। যেমন করেই হোক স্বর্ণময়ীকে আনতেই হবে। বীরপুরুষকে উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য অনেক সময় দস্যু-তস্কর সাজতে হয়। তাতে কলঙ্ক নেই। খাঁ সাহেব! আপনি ত সামান্য সেনাপতি, অত বড় অবতার রাৰসবিধ্বংসী রামচন্দ্র স্বার্থসিদ্ধির জন্য নিরপরাধ বালীকে তস্করের ন্যায় হত্যা করেছিলেন। তস্য ভ্রাতা লক্ষ্মণ, ইন্দ্রজিৎকে ছদ্মবেশে কাপুরুষের মত বধ করেছিলেন। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির দ্রোণাচার্যকে পরাস্ত করার জন্য “অশ্বত্থামা হত ইতি গজ”রূপ মিথ্যা কথা বলতে কুণ্ঠিত হননি। পুরাণে এরূপ রাশি রাশি দৃষ্টান্ত আছে। স্বর্ণময়ীকে নিয়ে আসতে পারলে আমার প্রাণের দুহিতা অরুণাবতীকে আপনার হস্তেই সমর্পণ করব। আপনি আমার শ্রেষ্ঠ জামাতা হবেন।
খাঁ: মহারাজ! যোড় হস্তে মার্জনা প্রার্থনা করি। সমস্ত পৃথিবীর রাজত্ব পেলেও এবং স্বর্গের অপ্সরীরা চরণ-সেবা করলেও মাহতাব খাঁর দ্বারা এ-কাজ সম্পন্ন হওয়ার নহে। অন্য যে পারে করুক।
প্রতাপ: কি! এত বড় আস্পর্ধা? আমি বলছি তোমাকে এ-কাজ করতেই হবে।
খাঁ: মহারাজ! কখনই নয়। আপনার চাকুরি পরিত্যাগ করলাম।
প্রতাপ: সাবধান! ও জিহ্বা এখনই অগ্নিতে দগ্ধ করব, কার সাধ্য নিজ ইচ্ছায় আমার চাকুরী পরিত্যাগ করে! তোমার মত খাঁকে শিৰা দিতে প্রতাপের এক নিমেষ সময়ের আবশ্যক।
খাঁ: মহারাজ! আমি আর আপনার ভৃত্য নহি। সুতরাং বিবেচনা করে কথা বলবেন।প্রতাপাদিত্য এবার জ্বলিয়া উঠিলেন, পা হইতে পাদুকা খুলিয়া মাহতাব খাঁর দিকে সজোরে নিৰেপ করিলেন। মাহতাব খাঁ শূন্য-পথেই পাদুকা লুফিয়া লইয়া “কমবখ্ত বেতমিজ শয়তান” বলিয়া প্রতাপাদিত্যের মুখে বিষম জোরে কয়েক ঘা বসাইয়া দিয়া গৃহ হইতে দ্র্বত বহির্গত হইয়া গেলেন। মাহতাব খাঁ পাদুকা-প্রহারে প্রতাপাদিত্যের নাক-মুখ হইতে দরদর ধারায় রক্ত ছুটিল। সকলে ৰিপ্ত কুকুরের ন্যায় হাঁ হাঁ করিয়া খাঁ সাহেবের দিকে রুখিয়া উঠিল। প্রতাপাদিত্য “ছের উতার লাও, ছের উতার লাও” বলিয়া ক্রোধে গর্জিতে লাগিলেন। সেনাপতি সাহেব তখন ভীষণ গর্জনে আকাশ কাঁপাইয়া “কিছি কা মর্ণেকা এরাদা হ্যায় তো, আও” বলিয়া কোষ হইতে ঝন্ ঝন্ শব্দে তরবারি আকর্ষণ করতঃ ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। খাঁ সাহেবের প্রদীপ্ত জ্বালাময়ী করালী-মূর্তি ও অগ্নি-জিহ্ব তরবারি দর্শনে সকলের বৰের স্পন্দন পর্যন্ত যেন থামিয়া গেল। মাহতাব খাঁ ধীর-মন্তুর গতিতে কৃপাণ-পাণি অবস্থায় ফিরিয়া কাহাকেও কিছু না বলিয়া সেই মুহূর্তেই যশোর ত্যাগ করিলেন।

সপ্তম পরিচ্ছেদ
মনোহরপুরে
মাহতাব খাঁ রাগে ও ঘৃণায় যশোর নগর হইতে নৌকা ছাড়িলেন। তাঁহার মনে হইতেছিল যত শীঘ্র যশোরের এলাকার বাহিরে যাইতে পারেন, ততই মঙ্গল। যশোরের বায়ুম-ল যেন তাঁহার কাছে বিষাক্ত বলিয়া ক্রোধ হইতেছিল। বিশেষতঃ প্রতাপাদিত্যের লোকজন আসিয়া অনায়াসেই তাঁহাকে আবদ্ধ করিতে পারে। তিনি বীরপুরুষ হইলেও একাকী কি করিতে পারেন! তাঁহাকে ধরিতে পারিলে প্রতাপাদিত্য যে হাত-পা বাঁধিয়া জ্বলন্ত চিতায় দগ্ধ করিবেন, সে-বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। সুতরাং তিনি মালৱাদিগকে খুব দ্র্বত নৌকা বাহিতে আদেশ করিলেন। খাঁ সাহেব যে প্রতাপাদিত্যের রাজ্য ত্যাগ করিয়া যাইতেছেন, মাঝি-মালৱারা অবশ্য তাহা জানিত না। তাহাদের জানিবার কথাও ছিল না। তাহারা জানিলে অবশ্য আসিত না। কারণ এইরূপ কার্যে প্রতাপাদিত্য যে তাহাদের শরীরের চর্ম ছাড়াইয়া তাহাতে লবণ মাখিয়া দিবেন, তাহা তাহারা বেশ জাতিন। সেনাপতি কোন দরকারবশতঃ মনোহরপুরে যাইতেছেন বলিয়া মাঝিরা বিশ্বাস করিতেছিল।
মাহতাব খাঁ মনোহরপুরে পঁহুছিতেই প্রায় সন্ধ্যা হইল। মনোহরপুরে প্রতাপাদিত্যের একখানা বাড়ী ও একটি কাছারি ছিল। এতদ্ব্যতীত সেখানে গোলা ও হাটবাজার দস্থরমত ছিল। কাছারিতে ১০ জন তবকী অর্থাৎ বন্দুকধারী, ২৫ জন লাঠিয়াল, একজন জমাদার, একজন নায়েব এবং অন্যান্য কর্মচারী ১০/১২ জন ছিল। প্রতাপাদিত্যের স্ত্রীর সংখ্যা চলিশেরও উপর ছিল। এতদ্ব্যতীত উপপত্নীও যথেষ্ট ছিল। মনোহরপুরে চতুর্থ রাণী দুর্গাবতী বাস করিতেছেন। তিনি পূর্বে যশোরের প্রাসাদের অধিবাসিনী ছিলেন। কিন্তু ক্রমে সন্তানাদি হওয়ায় তাঁহার যৌবনে ভাটা ধরিলে প্রতাপাদিত্যের মন-মধুকর যখন দুর্গাবতীকে কিঞ্চিৎ নীরস বলিয়া মনে করিল, তখন মনোহরপুরের রুদ্র বাটীতে তাঁহাকে সরাইবার ব্যবসা হইল। তদ্ব্যতীত প্রতাপাদিত্য আরও একটি কারণে দুর্গাবতীকে নির্বাসিত করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। দুর্গাবতী অত্যন্ত মুখরা ছিলেন, একবার রাগিয়া গেলে তাঁহার জিহ্বার বাক্যানলে সকলকেই দগ্ধ হইতে হইত। তাঁহার জিহ্বা সর্বতোভাবে নিঃশঙ্ক ও নিঃসঙ্কোচ ছিল। তাঁহার তীব্র সমালোচনা এবং বিদ্রূপ-বাণে প্রাসাদবাসিনী অন্যান্য রাণীরা অস্থির থাকিতেন। তিনি প্রতাপাদিত্যকেও অতি সামান্যই গ্রাহ্য করিতেন। দুর্গাবতী তাঁহার পরবর্তী রাণীদিগকে আপনার ক্রীতদাসী অপেৰাও তাচ্ছিল্য করিতেন। প্রতাপাদিত্য অবশেষে এই দারুণ সঙ্কট হইতে মুক্ত হইবার জন্য তাঁহাকে মনোহরপুরে নির্বাসিত করিয়াছিলেন।
দুর্গাবতী মনোহরপুরে আসিয়া প্রাসাদের নিত্য ব্যভিচার, অত্যাচার ও হত্যা-দূষিত বিষাক্ত বায়ু হইতে হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিয়াছিলেন। প্রতাপাদিত্য বৎসরের কোনও সময় এদিকে আসিলে দুর্গাবতীর মন্দিরে অবশ্যই পদধূলি পড়িত। নতুবা তাঁহাকে একপ্রকার বৈধব্য জীবনই কাটাইতে হইত। এই দুর্গাবতীর সময়েই মাহতাব খাঁ যশোরের রাজপুরীতে প্রবেশ এবং নিজের বীরত্ব ও বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়া প্রধান সেনাপতির পদ লাভ করেন। সে আজ দশ বৎসরের কথা। যশোরের অন্তঃপুরে তখন দুর্গাবতীর একাধিপত্য। দুর্গাবতীর যৌবনের সুবর্ণ-শৃঙ্খলে প্রতাপাদিত্য তখন দুশ্ছেদ্যভাবে পোষা কুকুরের ন্যায় বাঁধা ছিলেন। দুর্গাবতী মুখরা ও আধিপত্যপ্রিয়া হইলেও অত্যন্ত বদান্যা ও উদার-প্রকৃতি ছিলেন। লোকের গুণানুকীর্তনে সর্বদাই তাঁহাকে মুক্তকণ্ঠ দেখা যাইত। প্রতাপের কুৎসিৎ ব্যবহারই পরে তাঁহাকে মুখরা করিয়া তুলিয়াছিল। মাহতাব খাঁ রাণীর সৌভাগ্যের দিনে রাণীর হস্ত ও মুখ হইতে অনেক আর্থিক পুরস্কার ও বাচনিক প্রশংসা পাইয়াছিলেন বলিয়া রাণীকে তিনি মাতৃবৎ শ্রদ্ধা করিতেন। রাণীও মাহতাবকে পুত্রবৎ স্নেহের চৰে দেখিতেন। রাণীর মনোহরপুর নির্বাসনে এবং তাঁহার আধিপত্য চ্যুতিতে সর্বাপেৰা যদি কেহ দুঃখিত হইয়া থাকেন, তবে সে মাহতাব খাঁ। রাণীর একটি কন্যা এবং একটি পুত্র। কন্যার বয়স অষ্টাদশ বৎসর, নাম অরুণাবতী। পুত্র শিশু, পঞ্চ বৎসর মাত্র বয়ঃক্রম। নাম অরুণকুমার। অরুণাবতী পূর্ণ যুবতী। ভাদ্রের ভরা গাঙ্গ, কূলে কূলে রূপ উছলিয়া পড়িতেছে। বৰে বৰে প্রেমের তরঙ্গ আকুল উচ্ছ্বাসে আবর্ত সৃষ্টি করিয়াছে। চোখে মুখে প্রেমের বিদ্যুদ্দীপ্তি স্ফুরিত হইতেছে। প্রাণের পিপাসা বাড়িতে বাড়িতে এখন যেন উহা বিশ্ব-বিমোষিণী মূর্তি পরিগ্রহ করিতেছে। সুপক্ক আঙ্গুর বা রসাল আম্র যেমন বৃৰ-পক্ক হইলে ফাট্ ফাট্ হইয়া পড়ে, অরুণাবতীও তেমনি রসবতী হইয়া ফাট্ ফাট্ প্রায়। তাহার হৃষ্ট-পুষ্ট সবল ও সুডৌল দেহে যৌবন পূর্ণ প্রতাপে রাজত্ব বিস্তার করিয়াছে। তাহাকে দেখিলেই মন হয় যে, রমণী বহু কষ্টে বহু সাধনায় যৌবনের প্রতাপ ও প্রভাকে আয়ত্ত রাখিতে সমর্থ হইয়াছে। যেন চন্দ্রমার সুবর্ণ কৌমুদীজাল বিস্নাত ভাদ্রের সফেনতোয়া স্রোতস্বিতী কূলে কূলে পূর্ণ হইয়া ফুলিয়া ফাঁপিয়া হেলিয়া দুলিয়া আবর্ত রচিয়া কল্ কল্ ছল্ ছল্ করিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে। এত বয়স এবং এত রূপের গৌরব থাকা সত্ত্বেও অরুণাবতীর বিবাহ হয় নাই। বিবাহ না হবিার কারণ পাত্র না জোটা। পাত্র না জুটিবার কারণ প্রতাপাদিত্যের নিদারুণ নৃশংস পৈশাচিক ব্যবহার। কথাটা একটু খুলিয়াই বলিতেছি। ইতঃপূর্বে প্রতাপ তাঁহার জ্যেষ্ঠা কন্যা শ্রীমতী বিভাবতীর বিবাহ বাকলা চন্দ্রদ্বীপাধিপতি রামচন্দ্র রায়ের সহিত সম্পন্ন করিয়াছিলেন। এই রামচন্দ্র রায়ের রাজ্য অধিকার করিবার জন্য প্রতাপের নিদ্রাকর্ষণ হইত না। কিন্তু রামচন্দ্র রায় জীবিত থাকিতে বিনাযুদ্ধে রাজ্য অধিকার করা অসম্ভব। যুদ্ধ করিলে প্রতাপই জিতিবেন, তাহারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? রামচন্দ্র রায় বারভুঁইয়ার এক ভুঁইয়া ছিলেন। বিশেষতঃ তাঁহারই পল্টনে পর্তুগীজ ও ওলন্দাজ একদল উৎকৃষ্ট গোলন্দাজ সেনা ছিল। তাহাদের তোপের জন্য প্রতাপাদিত্য ভীত ছিলেন। অগত্যা প্রতাপাদিত্য, জামাতাকে কোন পর্ব উপলক্ষে বিশেষ সমাদর ও ধূম-ধামের সহিত একদানিমন্ত্রণ করিলেন। রামচন্দ্র রায় শ্বশুরের নিমন্ত্রণ পাইয়া পরমাহ্লাদে যশোরের রাজপুরীতে আগমন করিলেন। প্রতাপাদিত্য গভীর নিশীথকালে জামাতা রামচন্দ্র রায়কে উপাংশু-বধ করিবার জন্য সমস্ত বন্দোবস্ত করিয়া রাখিলেন। নরাধম পাষ- একবারের জন্যও উদ্ভিন্ন-যৌবনা কন্যার ভবিষ্যৎ পর্যন্ত চিন্তা করিলেন না। কন্যা সেই নিদারুণ লোমহর্ষণ ঘটনার আভাস পাইয়া স্বামীকে সমস্ত নিবেদন করিল। রামচন্দ্র রায় রাত্রিযোগে কৌশলক্রমে প্রতাপাদিত্যের পুরী হইতে প্রাণ লইয়া কোনওরূপে পলায়ন করিলেন। এই ঘটনার পরে কোনও রাজা কি জমিদার প্রতাপাদিত্যের সহিত বৈবাহিক সম্বন্ধে আবদ্ধ হইতে চাহিতেন না। এ-দিকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কেহই সাহস করিয়া সুন্দরবনের ভীষণ ব্যাঘ্রের ন্যায় নররক্ত-লোলুপ প্রতাপের কন্যা বিবাহের প্রস্তাব করিবারও সাহস করিত না। প্রতাপও গর্ব-অহঙ্কারে রাজা ব্যতীত আর কাহাকেও কন্যা সমপ্রদানের কল্পনাও করিতেন না। কিন্তু এদিকে কন্যার দেহে যখন যৌবন-জোয়ার খরতর বেগে বহিতে লাগিল, তখন প্রতাপাদিত্য নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাহতাব খাঁর ঘরে অরুণাবতীকে সমর্পণের বাসনা করিলেন। কারণ মাহতাব খাঁ অপেৰা উচ্চদরের পাত্র আর জুটিতেছিল না। কিন্তু মাহতাব খাঁকে সাধিয়া কন্যা দান করিতে প্রতাপের ইচ্ছা ছিল না। কোনও ঘটনা উপলৰ করিয়াই তাঁহাকে কন্যাদানের সংকল্প করিলেন। ঘটনাও জুটিয়া উঠিল। পাঠকগণ পূর্বেই তাহা অবগত হইয়াছেন। কিন্তু প্রতাপের দুর্ভাগ্যবশতঃ খাঁ সাহেব স্বর্ণময়ী-হরণে সম্মত হইলেন না।
সে যাহা হউক, মাহতাব খাঁ প্রতাপাদিত্যের রাজ্য হইতে চিরবিদায় লইবার পূর্বে পথে মনোহরপুরে অবতরণ করিয়া মাতৃতুল্য রাণী দুর্গাবতীর আশীর্বাদ লইয়া চিরচিদায় গ্রহণ করাই সঙ্গত মনে করিলেন। অরুণাবতীকে তিনি ভালোবাসিতেন, কিন্তু সে ভালোবাসায় প্রেমের নেশা প্রবেশ করে নাই। খাঁ সাহেব ঘাটে নৌকা লাগাইয়া অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন। প্রহরী তাঁহাকে চিনিত ও জানিত। রাণী দুর্গাবতী মাহতাব খাঁকে দেখিয়া আনন্দে পরম পুলকিত হইলেন। অতি শীঘ্র সমাদরে বসাইয়া অরুণাবতীকে জলযোগের যোগাড় করিতে বলিলেন। মাহতাব খাঁ জলযোগের আয়োজন দেখিয়া রাণীকে বলিলেন, ‘মা! আমার আর জলযোগের সময় নেই। আমাকে এখনই মহারাজের এলাকা ছেড়ে পালাতে হবে। যদি বেঁচে থাকি এবং খোদার মর্জী সুদিন পাই, তখন আবার শ্রীচরণে উপস্থিত হব।’ এই বলিয়া রাজার সমস্ত ব্যবহার দুঃখার্ত চিত্তে বর্ণনা করিলেন। শুনিয়া রাণীর চরু হইতে জলধারা বহিতে লাগিল। ঘটনা শুনিয়া এবং প্রতাপের ক্রোধের কথা ভাবিয়া দুর্গাবতীর প্রাণ যেন শুকাইয়া গেল। রাণী সত্য সত্যই মাহতাব খাঁকে পুত্রের ন্যায় ভালোবাসিতেন। তারপর অরুণাবতীর বিবাহের আশাভরসাও যে মাহতাব খাঁর সঙ্গে সঙ্গে শূন্যে মিশাইবে, ইহা ভাবিয়া রাণীর মুখ শুকাইয়া গেল। বুকের পঞ্জর যেন ধ্বসিয়া যাইতে লাগিল! রাণী ক্রন্দনের উচ্ছ্বাস রোধ করিতে পারিলেন না। এদিকে মাহতাব খাঁর সম্মুখেও কাঁদিতে পারিতেছিলেন না। এরূপ অনেকেই থাকে, যারা অতীব তীব্র সন্তাপেও লোকের সম্মুখে কাঁদিতে পারে না। রাণীও সেই প্রকৃতির ছিলেন। তিনি উঠিয়া অন্য ঘরে গেলেন। সেই নির্জন গৃহে যাইয়া তাঁহার রুদ্ধপ্রাণের উচ্ছ্বাস একেবারে গুমরিয়া উঠিল। রাণী কাঁদিতে লাগিলেন। বাস্তবিক রাণী যুগপৎ পুত্র-শোক ও কন্যা-শোকে অভিভূত হইয়া পড়িলেন। এদিকে অরুণাবতী নানা প্রকার মিষ্টান্ন এবং ফলমূলে স্বর্ণথালা ও রৌপ্যবাটি সাজাইয়া মাহতাব খাঁর সম্মুখে উপস্থিত করিল। মাহতাব খাঁ প্রায় দুই বৎসর পরে অরুণাবতীকে দেখিলেন। দেখিয়া একেবারে বিস্মিত এবং স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। খাঁ সাহেব যেন সহসা এক স্বপ্নাতীত রাজ্যে উপনীত হইলেন; তিনি দেখিলেন, অরুণাবতীর সর্বাঙ্গ আশাতীতরূপে পরিপুষ্ট। সমস্ত শরীরে যৌবন উথলিয়া পড়িতেছে। কৃতজ্ঞতার ডাগর আঁখিতটে শত শত বিদ্যুৎ ক্রীড়া করিতেছে। দেহলতিকা, জ্যোৎস্নাফুল্ল রজনীগন্ধার ন্যায় ফুটিয়া গরুভরে বৃন্তের উপর ঈষৎ হেলিত অবস্থায় যেন দন্ডায়মানা। অরুণাবতী যদিও পূর্বে শত শতবার মাহতাব খাঁকে দেখিয়াছে, তাঁহার ক্রোড়ে উঠিয়াছে, তাঁহার সহিত কতদিন নদীতটে ভ্রমণ করিয়াছে, কিন্তু আজ সে মাহতাব খাঁকে যেমন অপূরু সুন্দর সুঠাম রমণীয় কান্তি লোভনীয় পুরুষরূপে দেখিতেছে, পূর্বে সে কখনও তেমনটি দেখে নাই। মাহতাব খাঁই যে তাহার প্রেম-দেবতা হইবেন, তাহার পাণিতেই যে পাণি মিশাইতে হইবে, অরুণাবতী তাহা নানা সূত্রেই বেশ ভাল করিয়া শুনিয়াছিল এবং সেই সূত্রে অরুণাবতীর হৃদয় মাহতাব খাঁর অনুরাগে পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছিল। অরুণাবতী যখন সেই পরিপূর্ণ প্রেমের দৃষ্টিতে মাহতাব খাঁকে দেখিতেছিল- তখন খাঁ সাহেব যে তাহার চক্ষে অদ্বিতীয় পুরুষত্ব বলিয়া প্রতিভাত হইবনে, তাহাতে আর আশ্চর্য কি? প্রেম যখন অসুন্দরকে সুন্দর করে- মরুকে উদ্যানে পরিণত করে- অগ্নিকে তুষার,- নীরসকে সরস এবং অপবিত্রকে পবিত্র করে, তখন স্বাভাবিক সুন্দর খাঁ সাহেব যে অপার্থিব সুন্দর বলিয়া অরুণাবতীর চক্ষে প্রতিভাত হইবেন, তাহাতে আর সন্দেহ কি? ঊষার দৃষ্টি যেমন আকাশকে অরুণিমাজালে বিভূষিত করে- বসন্ত যেমন বিগতশ্রী উদ্যানকে স্বর্গীয় শ্রীমন্ডিত ফুল্লফুলদলে বিশোভিত করে, রজনী যেমন আঁধার আকাশে তারকামালা ফুটাইয়া অপার্থিব সৌন্দর্য প্রদর্শন করে- প্রেমও তেমনি প্রেমাস্পদকে অলৌকিক সৌন্দর্য, অসাধারণ গুণ এবং অপার্থিব মহিমায় বিভূষিত, বিমন্ডিত এবং বিশোভিত করে। মাহতাব খাঁ খাইতে খাইতে এক একবার অরুণাবতীর দিকে চাহিতেছেন, অরুণাবতী তাহার ত্রিভুবন-মোহিনী দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরাইতেছে। লজ্জা-রাগে তাহার বদনম-ল আরক্ত হইয়া যাইতেছে। আবার মাহতাব খাঁ নত আঁখিতে আহারে রত হওয়া মাত্রই, অরুণাবতীর চঞ্চল ও পিপাসাতুর আঁখি তাহার মুখে দৃষ্টি স্থাপন করিতেছে। আবার আঁখিতে আঁখি পড়া মাত্রই দৃষ্টি অন্য বিষয়ে পতিত হইতেছে এবং হৃদয় ফুলিতেছে, শরীর শিহরিত হইতেছে যে, বোধ হয় উভয়ের হৃদয় দুইটি শরীর ভেদ করিয়া এই মুহূর্তেই বাহির হইয়া আসিবে। সেনাপতি নিজের সঙ্কটজনক অবস্থা ভাবিয়া বীরের মত আত্মসংযম করিবার চেষ্টা করিলেন। অতি সামান্য নাশ্তা করিয়াই হাত ধুইতে উদ্যত হইলে, অরুণাবতী লজ্জার বাঁধ ভাঙ্গিয়া রুদ্ধকণ্ঠে বলিল, ‘সে কি!’ এই বলিয়া মাহতাব খাঁর হস্ত ধারণ করিয়া বলিল, ‘সব খেতে হবে।’ যুবতীর স্নেহমাখা সুকোমল করস্পর্শে মাহতাব খাঁর সর্বাঙ্গে যেন কি এক অপার্থিব পুলক-প্রবাহ প্রবাহিত হইল। সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত এবং হৃদয়ের প্রত্যেক বিন্দু সুধাধারায় সিক্ত হইল। মাহতাব খাঁ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে ছলছল নেত্রে তাঁহার বিপদের কথা বর্ণনা করিলেন। শুনিয়া যুবতীর বুক অতি বিষম বেগে স্পন্দিত হইয়া থামিয়া গেল। যুবতী বাকশূন্য স্পন্দনহীন মৃন্ময়ী প্রতিমার ন্যায় দন্ডায়মানা। অরুণাবতীর দুই চক্ষে অশ্র্বর ঝরণা ছুটিল। প্রতাব-কুমারীর ইচ্ছা হইতেছিল যে, সে একবার ছিন্ন লতিকার ন্যায় মাহতাব খাঁর চরণমূলে পতিত হইয়া দুই হস্তে তাঁহাকে আলিঙ্গন করিয়া প্রাণ ভরিয়া ক্রন্দন করে। কিন্তু লজ্জা আসিয়া তাহাতে বাদ সাধিল। যুবতী অবশেষে থর্ থর্ করিয়া কাঁপিতে লাগিল। পাছে বা পড়িয়া যায় এই ভাবিয়া মাহতাব খাঁ দ্র্বত উঠিয়া তাহাকে ধরিলেন। প্রিয়তমের উভয় বাহুস্পর্শে যুবতীর শরীরের প্রতি অণুপরমাণুতে যে প্রেমের তীব্র উচ্ছ্বাস হইল, তাহাতে যুবতী ক্ষণকালের জন্য আত্মসম্বরণে অসমর্থ হইয়া বিহ্বলা হইয়া পড়িল। মাহতাব খাঁ তাহাকে মূর্ছিত মনে করিয়া তাহার মস্তক নিজ ক্রোড়ে স্থাপনপূরুক পাখা দ্বারা বাতাস করিতে লাগিলেন। খাঁ সাহেব মহাবিপদ গণিয়া দুর্গাবতীকে ব্যস্তকণ্ঠে ৩/৪ বার ‘রাণী মা! রাণী মা!’ বলিয়া আহ্বান করিতেই রাণী অঞ্চলে চরু মুছিয়া ত্বরিতপদে তথায় উপস্থিত হইলেন। চোখে-মুখে কয়েকবার শীতল জলের ঝাপ্টা দিলে অরুণাবতীর চেতনা হইল। সে আপনাকে তদবস্থায় দেখিয়া লজ্জায় সমস্ত বদনম-ল আরক্ত করিয়া অবগুণ্ঠন টানিয়া দূরে সরিয়া বসিল। রাণী সমস্তই বুঝিতে পারিলেন। ইহা যে মূর্ছা নহে, নিদারুণ সকাম প্রেমাবেশ, তাহা বুঝিয়া কন্যার মানসিক অবস্থার শোচনীয়তা স্মরণে নিতান্তই ক্লিষ্ট ও ব্যথিত হইলেন। তিনি ভাবিলেন, পরস্পরের চুম্বনেই এ-ঘটনা ঘটিয়াছে।
রাত্রি অধিক হয় দেখিয়া মাহতাব খাঁ দুর্গাবতীর নিকট নিতান্ত বিনীত ও কাতরভাবে বিদায় প্রার্থনা করিলেন। রাণী কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকিয়া দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, ‘বাবা! আশীর্বাদ করি নিরাপদ, দীর্ঘজীবন লাভ কর। এ রাক্ষসের রাজ্য ছেড়ে যাওয়াই ভাল। কিন্তু বাবা! আমার অরুণাবতীর কি উপায় হবে?’ রাণী আর কিছু বলিতে পারিলেন না, কাঁদিতে লাগিলেন। মাহতাব খাঁর প্রাণেও অসীম বেদনা। সে স্থান ত্যাগ করিতে তাঁহার পা যেন অগ্রসর হইতেছিল না। তাঁহার হৃদয় ও চরু সমস্তই অরুণাবতীতে ডুবিয়া মজিয়া গিয়াছিল। বহু কষ্টে ধৈর্য ধারণ করিয়া স্থান পরিত্যাগে উদ্যত হইয়াছিলেন। কিন্তু রাণীর কথায় হৃদয় যেন সেখানেই বসিয়া পড়িল। মনে হইল, অরুণাবতীকে ছাড়িয়া কিছুতেই যাইব না, যা হইবার তা হউক। আবার ভাবিলেন, এখানে থাকিবই বা কোথায়? আমার জন্য অরুণাবতীও শেষে কি প্রতাপের রোষানলে দগ্ধ হইবে। মাহতাব খাঁ বজ্রাহতের ন্যায় বহুক্ষণ পর্যন্ত নীরবে দাঁড়াইয়া থাকিলেন। তিনি এমন দুরুলতা জীবনে কখনও উপলব্ধি করেন নাই। আজ তিনি দেখিলেন, হৃদয় প্রেম-সুরায় উন্মত্ত হইয়া পড়িলে তাহাকে প্রশান্ত করা ভীষণ অসম যুদ্ধে জয়লাভ করা অপেক্ষাও শত কঠিন।
‘অরুণাবতীর কি উপায় হবে?’ এ প্রশ্নের উত্তর কি দিবেন? তাহা কিছুই ঠিক করিতে পারিতেছিলেন না। এইরূপে প্রায় অর্ধ ঘণ্টা অতীত হইল, এমন সময় দূর আকাশের কোণে গুড় গুড় করিয়া মেঘ ডাকায় মাহতাব খাঁর চট্কা ভাঙ্গিল। বহু কষ্টে ও যত্নে হৃদয় বাঁধিয়া তিনি বলিলেন, ‘মা! আমি জীবনে কখনও অরুণাবতীকে ভুলব না। সুদিন হলে অরুণাকে বিয়ে করব। অরুণ ব্যতীত কা’কেও বিয়ে করব না। মা! আমি এখন পথের কাঙ্গাল। সঙ্গে পঞ্চাশটি মাত্র টাকা আছে। ভাগ্য আমাকে কোথায় নিয়ে ফেলবে জানি না। মা! আমি বাল্যকালেই পিতৃমাতৃহীন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন। তিনি এখন এলাহাবাদের বাদশাহী দুর্গের অধ্যক্ষ। আমি দশ বৎসর চাকুরী করে যে অর্থ সঞ্চিত করেছি, তা সবই মহারাজের নিকট গচ্ছিত। সে বিপুল অর্থ পেলে আমি অবশিষ্ট জীবন সুখে কাটাতে পারতাম। কিন্তু ঘটনা যা ঘটেছে, তাতে অতি শীঘ্র রাজ্য ছাড়তে না পারলে প্রাণ পর্যন্ত হারাতে হবে। হয়ত এতক্ষণ আমাকে ধরবার জন্য রণতরী অর্ধপথে এসে উপস্থিত হয়েছে।’
রাণী মাহতাব খাঁর অর্থাভাবে নিতান্ত দুঃখিত হইয়া তাড়াতাড়ি একশত মোহরের একটি মোড়ক এবং নিজের হস্তের একটি হীরকাঙ্গুরী উন্মোচনপূরুক মাহতাব খাঁর করে অর্পণ করিয়া কহিলেন, ‘বৎস! আর বিলম্ব করো না। সত্বর প্রস্থান কর। পরমেশ্বর তোমার মঙ্গল করুন, তাঁর হস্তে তোমাকে সমর্পণ করলাম। বড় বিপদ! সত্বর প্রস্থান কর।’ রাণীকে অভিবাদনপূরুক আশীর্বাদ গ্রহণ করিয়া মাহতাব খাঁ দ্র্বতপদে প্রস্থান করিলেন। ঘাটে যাইয়া তাড়াতাড়ি নৌকা খুলিয়া দিলে মাল্লারা দ্র্বত দাঁড় ফেলিতে লাগিল।
‘বাবা! আমার অরুণাবতীর কি হবে?’ রাণী দুর্গাবতীর এ কথায় অরুণাবতীর শোকসিন্ধু উথলিয়া উঠিল। সে নিজের হৃদয়কে বহু প্রবোধিত করিল কিন্তু কিছুতেই তাহা প্রবোধিত হইল না। সে স্পষ্ট বুঝিল, তাহার মন ঘড়ির ন্যায় টক্ টক্ করিয়া তাহাকে বলিল, ‘মাহতাব খাঁ আর এ রাজ্যে ফিরিবে না, ফিরিতে পারে না। তোমার কপাল চিরদিনের জন্য পুড়ে গেল।’
অরুণাবতী গৃহে আসিয়া বাত্যাহত লতিকার ন্যায় উত্তপ্ত সৈকত-নিৰিপ্ত শফরীর ন্যায় বিছানায় পড়িয়া ছট্ফট্ করিয়া কাঁদিতে লাগিল। সে মাহতাব খাঁকে যতই ভুলিতে চেষ্টা করিল, ততই তাহার পক্ষে মাহতাব খাঁর বিরহ অসহ্য হইতে অসহ্যতর, অসহ্যতম হইয়া উঠিল। মুহূর্তের মধ্যে অরুণাবতী উন্মাদিনীর ন্যায় তাহার গহনার হস্তিদন্ত নির্মিত রুদ্র পেটিকা লইয়া সকলের অজ্ঞাতসারে বাটীর পশ্চাৎভাগের খিড়কী-দ্বার উদ্ঘাটনপূরুক প্রেমাস্পদের উদ্দেশে ধাবিত হইল।
নৌকা তখন ঘাট ছাড়িয়া কয়েক রশি দূরে চলিয়া গিয়াছে। অন্ধকারের মধ্যে শুধু বাতি দেখা যাইতেছে। নদী তীর নির্জন। অরুণাবতী বহুদিন নদীতটে পরিভ্রমণ করিয়াছে। সে তাহার গন্তব্যপথে রুদ্ধশ্বাসে দ্র্বত ধাবিত হইল এবং অল্প সময়ের মধ্যে নৌকার নিকটবর্তী হইয়া নৌকা কূলে ভিড়াইতে বলিল। মাহতাব খাঁ বিস্মিত ও স্তম্ভিত হইয়া অরুণাবতীকে গৃহে ফিরিবার জন্য পুনঃ পুনঃ বিনীত অনুরোধ করিতে লাগিলেন। মাঝিরা নৌকা কূলে ভিড়াইতেছিল, কিন্তু মাহতাব খাঁর নিষেধে পুনরায় ছাড়িয়া দিবার উপক্রম করিল। অরুণাবতী তখন জলে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া সাঁতরাইয়া নৌকা ধরিতে অগ্রসর হইল। মাহতাব খাঁ আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। জলে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া অরুণাবতীকে মুহূর্ত মধ্যে কিসতীতে টানিয়া তুলিলেন। বলা বাহুল্য, অরুণাবতী জলে পড়ায় কোন কষ্ট পায় নাই। কারণ, প্রত্যহ সে নদীর জলে স্নান করিত বলিয়া ভাল সাঁতার জানিত। উভয়ের সিক্ত বস্ত্র পরিবর্তন করা আবশ্যক হইল। অরুণাবতীর বস্ত্র লইয়া মাহতাব খাঁকে বিপদে পড়িতে হইল। অরুণাবতী আসিবার কালে কেবল গহনার বাক্সই আনিয়াছিল। অতিরিক্ত কাপড় আনিবার বিষয় চিন্তাও করে নাই। মাহতাব খাঁও ধুতি পরিতেন না। সুতরাং সিক্ত শাড়ী পরিবর্তন করিয়া অরুণা কি পরিবে, তাহাই চিন্তার বিষয় হইল। এদিকে অরুণাবতী পশ্চাৎ দ্বার দিয়া নির্গত হইবা মাত্রই দ্বারের শব্দে রাণী গৃহ হইতে বহির্গত হন। তিনি বাহির হইয়াই তরল আঁধারে বেশ দেখিলেন যে, অরুণাবতী গহনার বাক্স হস্তে নৌকার উদ্দেশে ধাবিত হইয়াছে। কিন্তু কন্যাকে পলায়ন করিতে দেখিয়া কিছুমাত্র দুঃখিত না হইয়া বরং কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হইলেন। কারণ তিনি কন্যার ভীষণ প্রেমোন্মাদের লক্ষণ দেখিয়া তাঁহার জীবন সম্বন্ধে আকুল হইয়া পড়িয়াছিলেন। রাণী তাড়াতাড়ি গৃহে ফিরিয়া নিজের কিছু গহনা, দুইশত মোহর এবং কয়েকখানি কাপড় লইয়া অরুণাবতীর পশ্চাতে ছুটিলেন। তিনি পৌঁছিতে পৌঁছিতেই মাহতাব খাঁ সুন্দরীকে জল হইতে নৌকায় তুলিলেন এবং অরুণার বস্ত্র পরিবর্তনের মহাসমস্যায় পতিত হইয়া অবশেষে বাক্স হইতে নিজের অপ্রশস্ত রেশমী পাগড়ী বাহির করিয়া তাহাকে পরিধানের জন্য দিতেছিলেন, ঠিক এমন সময়েই রাণী তট হইতে আহ্বান করিলেন। দুর্গাবতীর আহ্বানে অরুণার ভয় হইল, পাছে বা তাহাকে ছিনাইয়া বাটি লইয়া যায়। অরুণা বলিল, ‘মা! নৌকা আর লাগাব না, আমি যখন ভেসেছি, তখন ভাসতে দাও।’ রাণী অরুণার প্রাণের ব্যথা বুঝিয়া বলিলেন, ‘মা, তুই কলঙ্কিনী নস্। তুই-ই প্রকৃত সতী। মা! আমি তোর গমনে বাধা দিব না। আমি গমনের সুবিধা করে দিবার জন্যই এসেছি। কাপড় ও টাকা এনেছি, নিয়া যা।’
নৌকা কূলে লাগিল। রাণী মোহর, গহনা ও কাপড় দিয়া আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন: ‘আজ আমি তোমাদেরকে অকূলে ভাসালাম, কিন্তু বিধাতা শীঘ্রই তোমাদেরকে কূল দিবেন।’ রাণী এই বলিয়া নৌকা ছাড়িয়া দিতে বলিলেন। রাণী বাড়ী ফিরিতে ফিরিতে এক একবার সাশ্র্বনেত্রে পশ্চাৎ ফিরিয়া নৌকা দেখিতে লাগিলেন। শেষে আর নৌকা দেখা গেল না। কেবল প্রদীপের আলো দেখা যাইতে লাগিল। অবশেষে নৌকা বাঁক ফিরিলে তাহাও অন্তর্হিত হইল। রাণী নিঃশব্দে বাটি ফিরিলেন। প্রাঙ্গণে পদার্পণ করিয়া বুঝিলেন- বাড়ী যেন শূন্য শূন্য বোধ হইতেছে। প্রকৃতি যেন উদাস প্রাণে দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিতেছে। রাণী রুদ্ধশ্বাসে গৃহে প্রবেশ করতঃ বিছানায় পড়িয়া কাঁদিতে লাগিলেন।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.