![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অনেক ভেবে চিন্তে দেখলাম যে, কেউ আমার ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে কখনো প্রশ্ন করেনি, “আচ্ছা বৃষ্টি বলতে আপনি কি বোঝেন, এই জিনিসটা আসলে আপনার কাছে কি?”- কারণ হিসেবে বলা যায় চাকরীদাতা কোম্পানীর এম ডি অথবা পি এইচ ডির সম্ভাব্য সুপারভাইজার ছাড়া জীবনে কেউ আমার ইন্টারভিউ নেবার ব্যাপারে বিশেষ একটা ব্যাকুলতা প্রদর্শন করেনি । উপায়ন্তর না দেখে মনে হল এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জাতিকে অবহিত করার জন্য এখন নিজেরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করা উচিত।
যাই হোক, বৃষ্টি যে জীবন ভর আমার এই কঠিন হৃদয়ে কোমল একটা স্থান দখল করে রাখবে এই বিষয়টা অবচেতন থেকে সচেতন মস্তিষ্কে প্রবেশ করার কাহিনীটা বলা যাক। তখন আমি ক্লাস ফোর কি ফাইভে পড়ি, বার্ষিকের বাংলা দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষায় রচনা কমন পড়েনি। বাদবাকি প্রশ্ন উত্তর করা শেষে ভেবে চিন্তে কি মনে করে আমার প্রিয় ঋতু লেখা শুরু করলাম।
তখন বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল কিনা, এত বছর পরে আর অত খুটিনাটি মনে নেই। কিন্তু বানিয়ে বানিয়ে লেখা রচনায় বর্ষাকালে বৃষ্টির বর্ণনা লিখতে গিয়ে কি ভালোই না লেগেছিল। আমাদের আমলে (!) রচনার ভিতরে কবিতার কোটেশন দিলে নাম্বার বেশি পাওয়া যেত (এখন কি অবস্থা কে জানে?)। তো লেখা শেষ করে রিভিশন দিতে গিয়ে দেখলাম কবিতা ছাড়া রচনাটা কেমন খটখটে মনে হচ্ছে। একটু ভেবে চিন্তে দুই প্যারার মধ্যে চাপা চাপি করে জুড়ে দিলাম, “এ প্রসঙ্গে কবি বলেছেন,
ঝম ঝম করে ঝরা বৃষ্টি,
স্রষ্টার অপরূপ সৃষ্টি
ঝম ঝম করে ঝরা বৃষ্টি,
বাইরে চলে যায় আমার অবাক দৃষ্টি।
নিজের লেখা পড়ে মুগ্ধ বিস্ময়ে নিজেই হতবাক, চোখের কোণায় মনে হয় পানিও চলে আসলো দুই ফোঁটা। বলে রাখা ভাল, সেই আমলে এখনকার বাচ্চা কাচ্চাদের মতো আমরা রোবট রোবট ছিলাম না। দিনরাত ট্যাবলেট টিপে গেমও খেলতাম না। বুকের মধ্যে সত্যিকার আবেগের খরস্রোতা নদী নিয়ম করে দুইবেলা দাপা দাপি করত !
শীত প্রধান দেশ হওয়ায় আমার বরাবর মনে হয়েছে বৃষ্টির মত এমন চমৎকার একটা জিনিশ নিয়ে আমেরিকানদের উচ্ছাস আমাদের তুলনায় অনেক কম। অবশ্য আমরা গরমের দেশের লোকজন বৃষ্টি নিয়ে আহাউহু করলে তাকে খুব একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যায় কি? এই ভালবাসা (অথবা আহাউহু) খুব সম্ভবত আমাদের অবচেতন মনে জন্ম নেয় অনেক ছোটবেলায়। হয়তো সেই কোন ভুলে যাওয়া শৈশবে অসহ্য চিটচিটে গরমে ঝপ করে এক পশলা বৃষ্টি দেবদূতের মত আকাশ থেকে নেমে এসে নির্মম জীবন সহনীয় করে দিয়েছিল , ঠান্ডা বাতাসে নিশ্বাস নিয়ে খুব হাসি খুশি হয়ে উঠেছিল মুমূর্ষু ফুসফুস, হয়তো বৃষ্টির আক্রমণ থেকে তার টাক মাথা বাঁচাতে আমাদের স্কুলের গুরুগম্ভীর প্রধান শিক্ষক অনভ্যস্ত পদক্ষেপে ভোঁ দৌড় শুরু করেছিলেন, পিচ্ছিল কাদায় আছাড় খেয়ে ভ্যাবাচ্যাকা লুক দিয়েছিল আমাদের কোন জন্মের শত্রু, হয়তো সেই কোনকালে অসম্ভব প্রিয় কোন মুখ বৃষ্টিতে ভিজে অবিকল জল রং-এ আঁকা কোন ছবির মতন মনে হয়েছিল। স্মৃতিভারে জর্জর মস্তিষ্ক ভুলে গেছে বিচ্ছিন্ন জল কণার মত স্মৃতির ফোঁটাদের, রয়ে গেছে তাদের ছোঁয়ায় তৈরি হওয়া মস্তিষ্কে খুশির অনুরণনটুকু ।
নর্থ ক্যারোলাইনার রলে শহরে আইভি কমন্স ড্রাইভে অধমের ওয়ান বেডরুমের কুড়েঘর (!)। এই বাসার একটা মজার ব্যাপার আছে। রান্নার চুলার ওপরের এগজস্ট লাইনের মুখটা বাসার ছাদে ওপেন করা। বৃষ্টির পানি যাতে সেই পথে ঢুকে লোকজনের ইলেকট্রিক চুলা আর বাসার বারোটা না বাজায়, এজন্য তার মুখে একটু গ্যাপ রেখে পাতলা স্টিলের পাত দেয়া। ভিতরে বাতাস, উপরে পাতলা পর্দা, বলতে গেলে এক রকমের বাদ্যযন্ত্র। তাই বাইরে যখন বৃষ্টি পড়ে, তখন আমার কিচেন কাম ড্রইং এ এসে দাঁড়ালে টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার সেই চিরাচরিত শব্দের কাছাকাছি এক ধরণের শব্দ (অনেকটা ঠ্যাপ ঠ্যাপ টাইপের) শোনা যায়। যত ঝামেলার মধ্যেই শব্দটা শুনিনা কেন , কোন এক অদ্ভুত কারণে সঙ্গে সঙ্গে মনটা ভাল হয়ে যায়। হতে পারে আধুনিক দালানে বাস করতে এসে প্রকৃতির সঙ্গে যে মহামূল্যবান ইন্দ্রিয়ের সম্পর্ক হারিয়ে ফেলেছি, তার এক রকমের পরিপূরক খুঁজে পেয়ে জীনের গভীরে বাস করা প্রাচীন গুহাবাসী পূর্বপুরুষ খুশির হাসি হাসে।
গত টার্মে কোনদিন যেন স্কুল (আসলে ইউনিভার্সিটি- সবাই এখানে স্কুল বলে) থেকে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরছি। এক্সপেরিমেন্টের অ্যানালাইসিসে উল্টা পাল্টা রেজাল্টে বিমর্ষ মন। হঠাত করে আচমকা মেঘের গর্জন শুরু হল। ‘ফল কালার’ প্রদর্শন করে করে ক্লান্ত ওক আর ম্যাপল পাতারা সব সদলবলে ঝরে পড়েছে। দমকা বাতাসে সেই শুকনো পাতাদের দল এক সঙ্গে মহা উত্তেজনায় ওড়াউড়ি শুরু করে দিল। বাসার সামনে দাঁড়ানো আমার বুড়ো চায়নীজ প্রতিবেশি চোখ গোল গোল করে দেখল চশমা পড়া এক মোটাসোটা ইন্ডিয়ান ছোকড়া (‘শ্যামলা’ রঙ দেখলেই অপনাকে সবাই ইন্ডিয়ান বলে ধরে নেবে- কিছু করার নাই) আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। তখন আসলে আমি প্রাণপণে ঝড়ো বাতাসে ওড়াউড়ি করতে থাকা একটা কবিতাকে ধরার চেষ্টা করছি। কবিতাটা এরকম (মাথায় রাখতে হবে একজন দুঃখী গ্রাজুয়েট স্টূডেন্ট লিখছে এই কবিতা),
ট্রপোস্ফিয়ার জেনেছে আমার মন,
মেঘে মেঘে তাই চিৎকার গর্জন।
কি যেন বলেও বোঝাতে পারেনি ঠিক,
তাই বুনো রোষে ঘিরে নিয়ে চারিদিক,
কত কথা বলে যাবে জান্তব স্বরে -
মনের বিষাদ, মেঘের বিষাদ-
উড়ে চলে যাবে লন্ড ভন্ড ঝড়ে।
ইতোমধ্যে আমার বৃষ্টি বিষয়ক কাব্য প্রতিভার যে স্ফূরণ ঘটেছে, সেই কথা তো বলতে ভুলেই গেছি। সেসব খাতা হারিয়েও গেছে আজ বহুদিন হয়ে গেল। এরকম কোন এক খাতায় লেখা বিশাল এক কবিতায় আমার পছন্দের কিছু লাইন ছিল এরকম,
বিশ্ব সংসারে ঈশ্বর নিঃসঙ্গ দর্শক
আমাদের প্রত্যেকের জীবন একেকটি বৃষ্টি ফোঁটা
সুদূর কোন অতীতে নিজের বানানো এই থিওরীটা আমার এখনও খুব প্রিয়।বৃষ্টির প্রত্যেকটা ফোঁটার মতই পৃথিবী ভর্তি সব মানুষের জীবন এক অর্থে একই রকম , আবার অন্য অর্থে অনেক আলাদা। মেঘের মধ্য থেকে যাত্রা শুরু করে বৃষ্টি বিন্দুদের রোমাঞ্চকর ভ্রমণ শেষ হয় পৃথিবীকে স্পর্শ করার মাধ্যমে। গন্তব্যে কি তাদের আদৌ কিছু যায় আসে? মনে তো হয় এই যাত্রাপথেই তাদের আনন্দ।
পাঠক এ পর্যন্ত পড়ে চেঁচিয়ে উঠতে পারেন, “তুচ্ছ বৃষ্টি নিয়ে অনেক ফেনিয়েছেন , এবেলা মাফ করেন”। কিন্তু মাফ চাইলেই আর পাওয়া যায়রে ভাই? বৃষ্টির মত এমন সাদামাটা জিনিসকে দার্শনিক মাইক্রোস্কোপের নিচে নিয়ে পরীক্ষা করার কোন দরকার আছে কিনা জানিনা। তবু আমাদের দেশের শতকরা আশি শতাংশ (মন গড়া পরিসংখ্যান) মানুষের কেন বৃষ্টির কথা শুনলেই মন উদাস হয়ে যায় আর ভুনা খিচুড়ি খেতে ইচ্ছা করে সে বিষয়ে জোর গবেষণা শুরু হওয়া দরকার বলে আমি মনে করি। নাহলে বৃষ্টি প্রধান দেশের বেচারা অসহায় মানুষগুলি খেয়ে খেয়ে অসহ্য রকমের মোটাসোটা হয়ে গেলে তার দায়িত্ব কে নেবে?
বৃষ্টির সময় পুরুষ সোনাব্যাং তার সম্ভাব্য সংগীকে আকৃষ্ট করার জন্য ত্বারস্বরে ডাকাডাকি শুরু করে দেয়। অতি বদখত (এবং নির্লজ্জ) সেই সংগীত। কিন্তু ব্যাঙ এর ডাক, বৃষ্টি, লেবু ফুলের গন্ধ এসব একসাথে এক জায়গায় জড় হলে স্পেস টাইমের সব নিয়ম ভঙ্গ করে যে এক স্থবির মহাকাব্য (নাকি সিঙ্গুলারিটি ?) জন্ম নেয় সে কথা আমাদের দেশের এমনকি চরম গাড়লতম মানুষটিও মাথা নেড়ে স্বীকার করে নেবে বলে আমার বিশ্বাস।
প্রায় অন্ধ পতংগ যেমন জানেনা কেন আলোর প্রতি তার দুর্নিবার আকর্ষণ, তেমনি আমাদের অযৌক্তিক মন বন্ধ জানালার এপাশে আমাদের ফেলে রেখে যখন রিমঝিম বৃষ্টির তালে খামোখাই বাইরের রাস্তায় উদ্দাম নৃত্য জুড়ে দেয়, তখন সেও কি জানে বৃষ্টির কারণে তৈরি হওয়া এই অযৌক্তিক খুশির উৎস?
বৃষ্টি বিষয়ক এই অযথা বকবক শেষ করবো, বৃষ্টি নিয়ে আমার নিজের লেখা প্রিয় একটা কবিতা দিয়ে, ( ইয়ে, কবিতাটা বুঝতে হলে পানিচক্র সম্পর্কে হালকা ধারণা থাকলে সুবিধা হয়) -
যে জল কণারা জানে পৃথিবীর ঘ্রাণ,
সে জল কণারা এসেছে আবার ফিরে।
শরীরে তাদের গত জন্মের মায়া,
এসেছে তারা বিষন্ন এক আকাশের বুক চিড়ে।
এ জল কণারা ছুঁয়ে দিলে চরাচর,
ক্লান্ত পৃথিবী শ্বাস নেবে থেমে ধীরে ।
মিটে যাবে সব নশ্বর যত জীবনের চাওয়া পাওয়া
ভুলে যাবে ভাষা, মেঘ কণাদের ভীড়ে।
যে জল কণারা পবিত্র আর খাঁটি,
মাটির গহিনে মিলাতে যাদের অযথা করেনা ভয়,
তাদের জীবন ছুঁতে বড় সাধ হয়-
মৃত্যুর পর পরমানন্দে যারা প্রবাহিত হয়।
(অনেক আগের একটা লেখা । আমার ফেসবুক নোটে প্রকাশিত শনিবার, মার্চ ১০, ২০১৮। অনেকদিন পর আজকে কি মনে করে মনে হল ব্লগেও থাকুক)
২| ২৫ শে জুন, ২০২০ বিকাল ৩:২৩
নেওয়াজ আলি বলেছেন: নান্দনিক প্রকাশ।
৩| ২৫ শে জুন, ২০২০ বিকাল ৫:০৯
বিজন রয় বলেছেন: অনেক ভাল লেগেছে।
বিশেষ করে শেষের কবিতা।
শুভকামনা রইল।
©somewhere in net ltd.
১|
২৫ শে জুন, ২০২০ দুপুর ২:১০
রাজীব নুর বলেছেন: বৃষ্টি বিলাস!