![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সংখ্যালঘু নির্যাতনের পেছনে কারণ কি কেবল একটি?
বাংলাদেশে হঠাৎ সংখ্যালঘু নির্যাতন আবার প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুদের ঘরবাড়ি ভাঙ্গা, মন্দির ধ্বংস হওয়ার পর ঠাকুরগাঁও, নাটোরে একই ঘটনা ঘটেছে এবং তা নেত্রকোনা, সিরাজগঞ্জ এবং ঝালকাঠি পর্যন্ত গড়িয়েছে। আরও কোথাও ছড়িয়েছে কিনা এখন পর্যন্ত তা আমার জানা নেই। ইসলাম ধর্মের অবমাননার অজুহাতে ইতোপূর্বে চলেছে ব্লগার হত্যা, বিদেশী নাগরিক হত্যা, ‘আইএসের’ সাইনবোর্ডের আড়ালে রেস্টুরেন্টে, ঈদগাহে হামলা ইত্যাদি। এই হামলার কোনো সাম্প্রদায়িক চরিত্র ছিল না। হিন্দু, মুসলমান, খ্রীস্টান সকলের ওপরেই হামলা হয়েছে। বর্তমানের হামলার চরিত্র সাম্প্রদায়িক। বেছে বেছে হিন্দু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা হচ্ছে, তাদের মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর হচ্ছে।
স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে পারে, আগের সন্ত্রাসী তৎপরতার যেমন লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক অরাজকতা সৃষ্টি করা এবং তার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের উচ্ছেদ সাধন, বর্তমানের সাম্প্রদায়িক অশান্তি সৃষ্টির লক্ষ্যও বুঝি অভিন্ন। আগের সন্ত্রাসের পেছনে যেমন জামায়াতের এবং বিএনপির মদদ ছিল, বর্তমানের সাম্প্রদায়িক অশান্তি সৃষ্টির পেছনেও বুঝি তারাই কলকাঠি নাড়ছে। উদ্দেশ্য একই, সম্মুখ সমরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে না পেয়ে পেছন থেকে ছুরি মারার চেষ্টা। তাতে দেশের অকল্যাণ হয় হোক।
আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক জাতীয় সম্মেলনের আশাতীত সাফল্যের পর হতাশ এবং অসংগঠিত বিএনপি ও জামায়াত যে এই ধরনের একটা নাশকতামূলক কাজের ছক কাটতে পারে সে সন্দেহ আমার মনেও জাগেনি, তা নয়। কিন্তু ফেসবুকে একটি হিন্দু ছেলের নামে হঠাৎ কাবা শরিফের অবমাননামূলক মন্তব্য বের হওয়া এবং তা নিয়ে জমিয়ত নামের দু’টি ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতিবাদ সভা আহ্বান এবং সঙ্গে সঙ্গে নাসিরনগরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ধরন দেখে মনে হয়েছে এর পেছনে আরও কারণ থাকতে পারে। বিএনপি-জামায়াতসহ উগ্র মৌলবাদী সংগঠনগুলো পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারে। কিন্তু পানিঘোলা করার জন্য আরও গোপন হাত আছে।
আমার প্রয়াত সাংবাদিক বন্ধু এবিএম মূসা একবার লিখেছিলেন, বাংলাদেশে সাংবাদিকতা অনেক উন্নত হয়েছে। কিন্তু ইনভেস্টিগেটিং সাংবাদিকতা খুব উন্নত হয়নি। কথাটা আমার কাছেও সঠিক মনে হয়। বাংলাদেশে সন্ত্রাস, দুর্নীতি থেকে শুরু করে বড় ধরনের হত্যা, অপহরণ পর্যন্ত সকল কাজেই আমরা প্রথমেই পুলিশের ব্যর্থতার উপর দোষ চাপাই। পুলিশের ব্যর্থতা তো আছেই। কিন্তু দেশে সন্ত্রাস, দুর্নীতি যেভাবে বেড়ে চলেছে, তার মূল সন্ধানে ও উচ্ছেদে ইনভেস্টিগেস্টিং সাংবাদিকতারও একটা বড় গুরুত্ব রয়েছে। আমেরিকায় ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির মূল সন্ধান এবং প্রেসিডেন্ট নিক্সনের তাতে সংশ্লিষ্টতা মার্কিন পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা দ্বারা হয়নি, হয়েছে ‘ওয়াশিংটন পোস্টের’ ইনভেস্টিগেটিং সাংবাদিকতার ফলে।
বাংলাদেশে সাগর-রুনি হত্যা থেকে ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া বা নারায়ণগঞ্জের সাত হত্যাকা- সম্পর্কে ইনভেস্টিগেটিং সাংবাদিকতা এবং সেই অনুসন্ধানের ফল প্রকাশের সাহস ও নির্ভীকতা কোথায়? সাংবাদিকতা যদি রাজনৈতিক ক্ষমতার চাপের কাছে মাথা নিচু করে তাহলে সেই ক্ষমতার অধস্তন পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগও কি করতে পারে না?
আমার ধারণা, বর্তমান হাসিনা সরকারের আমলে দেশের পুলিশ বাহিনী অনেক দক্ষ হয়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে অনেক সৎ তরুণ অফিসারও আছেন, যারা কর্মঠ এবং দেশপ্রেমিক। সাম্প্রতিক সন্ত্রাস দমনেও তারা সাফল্য দেখিয়েছেন। পুলিশের মধ্যে এখনো ঔপনিবেশিক আমলের দোষত্রুটি, দুর্নীতি অবশ্যই রয়েছে।
সাম্প্রদায়িকমনা লোকজনও আছে। তা থেকে তাদের মুক্ত করা দরকার। কিন্তু সব চাইতে আগে দরকার, ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক প্রভাব থেকে তাদের মুক্ত করে একটি নিরপেক্ষ বাহিনী হিসেবে পুনর্গঠন করা। তাহলে দেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতা উচ্ছেদেও তারা সন্ত্রাস দমনের মতো সাফল্য দেখাতে পারবে।
অশুভ সাম্প্রদায়িকতা দমনে পুলিশের ব্যর্থত তো আছেই। কিন্তু এই ব্যর্থতা শুধু তাদের নয়, আমাদের রাজনৈতিক প্রশাসনেরও। আমার নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনের সময় আমি একাধিক উপজেলা থেকে একই ধরনের অভিযোগ শুনেছি। একটি উপজেলায় আওয়ামী লীগের যে প্রার্থী ছিলেন, তিনি এলাকার জনপ্রিয় ব্যক্তি নন। হিন্দু ভোটদাতাদের মধ্যেও তার সমর্থন ছিলো না। তিনি তাদের ওপর খাপ্পা হন। নির্বাচিত হয়েই তিনি হিন্দুদের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণে তৎপর হন। এ কাজে তাকে সাহায্য জোগাতে এগিয়ে আসে স্থানীয় জামায়াতীরা। কী একটা তুচ্ছ ধর্মীয় অজুহাত তুলে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার শুরু হয়। তাদের জমিজমা গ্রাস করা শুরু হয়। তাতে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয় বিএনপি ও জামায়াত। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয় আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অনেক দলেরই একশ্রেণীর কর্মী ও নেতা।
বিএনপি ও জামায়াত সরকারের আমলে নির্বাচনে তাদের প্রার্থীরা ভোট না পেলে সংখ্যালঘুদের ওপর এই ধরনের অত্যাচার চালানো হতো। ২০০১ সালে নির্বাচনের পর হিন্দুরা সকলেই আওয়ামী লীগকে ভোট দেয় এই ধুয়া তুলে পাইকারি হিন্দু নির্যাতনের বীভৎসতা তো আমাদের স্মরণ থেকে এখনও মুছে যায়নি। পূর্ণিমা শীলদের গণধর্ষণের কাহিনী তো আমাদের স্মৃতিতে এখনও জ্বলজ্বল করছে। বর্তমানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় এই দলের মধ্যেও বহু বর্ণচোরা জামায়াতী ছাড়াও সাম্প্রদায়িকমনা ব্যক্তি ঢুকেছে। বহু এলাকায় তারা স্থানীয় নেতা এবং মাতবর এবং নিজেদের ক্ষমতা ও প্রভাবের স্বার্থে জামায়াত ও শিবিরের নেতা-কর্মীদের আশ্রয় প্রশ্রয় দান করে। পুলিশ কোনো দুষ্কৃতিকে ধরলে তারা ছাড়িয়ে নেয়। এই ধরনের অনেক অভিযোগ কি আসলেই সত্য নয়?
আমার এই ধারণাটি সঠিক কিনা তা বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের পর আরও ভালভাবে বোঝা যাবে। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগ সরকারের করণীয় শুধু কঠোর হাতে সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধ করা নয়, এই নির্যাতনের হোতা এবং তার কারণগুলো অনুসন্ধান করে তারও মূলোচ্ছেদের ব্যবস্থা করা। আওয়ামী লীগের ভেতরেও সাম্প্রদায়িকতার বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছে, তা মহীরুহ হয়ে ওঠার আগেই তার মূলোচ্ছেদ প্রয়োজন। আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব পারবেন কি এই দুরূহ কাজটিতে হাত দিতে?
ক্যাটেগরি: মানবতা
©somewhere in net ltd.