![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বুক ভরা ব্যাথা নিয়ে বেহায়ার মত হাঁসতে পারি ।
অপারেশন থিয়েটারের দরজার উপরে টিম টিম করে একটা লাল লাইট জ্বলছে। আমি দরজার সামনে বসে আছি। অস্থিরতা বেড়েই চলছে আমার। কারণ, ভেতরের অপারেশন টেবিলের উপরে ছুরি-কাঁচির নিচে যে আমার পরীটা শুয়ে আছে..!!
আমার ছোট্ট পরী, আমার ক্বলিজার টুকরা, আমার রাজকন্যা, আমার মেয়ে আঁভা।
আমার ফ্যামিলিতে আমরা তিনজন। বাবা, মা আর আমি। বাবা ছিলেন একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান সরকারি চাকরিজীবী। খুব বেশি বেতন ছিলোনা বাবার। তবে যা বেতন পেতেন, তাতে আমাদের চলে যেত। আমাদের কারোরই কখনো চাহিদার আধিক্য ছিলোনা। এজন্য দারীদ্রতা কখনো আমাদের নাগাল পায়নি। স্বচ্ছল ছিলো আমাদের পরিবার। হঠাৎ করেই বাবা একদিন চলে গেলেন। অন্যায়ের কাছে কখনো মাথা নত না করার শিক্ষা দেওয়া মানুষটা সেই অন্যায়ের কাছেই হেরে গেলেন। বাবার সই ছাড়া একটা ফাইল আঁটকে গিয়েছিল। ফাইলের মধ্যে এমন কিছু ছিলো, যেটা বাবার বিবেককে সই করতে বাধা দিয়েছিল। ফাইলের মালিক টাকা পয়সা, ভয়-ভীতি কোনকিছু দিয়েই বাবাকে রাজি করাতে পারেনাই সই করাতে। একদিন অফিস থেকে ফেরার সময় বাবাকে ছুরি মেরে দিয়ে গেলো ওরা। বাঁচাতে পারিনাই বাবাকে। চলে গেলেন আমাদেরকে ছেড়ে। যাবার আগে বলে গেলেন_ কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করোনা, সত্য থেকে পিছপা হবানা, সৎ ভাবে জীবন যাপন করবা। বাবার সেই মূল্যবান শিক্ষা এখনও বুকে ধারন করে আছি। তারপর মা সংসারের হাল ধরলেন। শিক্ষিতা ছিলেন, টিউশনি করাতেন বাসায়। অবসরে সেলাই মেশিনের কাজ করতেন। এভাবেই চলছিল আমাদের।
ঢাবি থেকে অ্যাকাউন্টিংয়ে অনার্স কমপ্লিট করলাম। মাস্টার্স কমপ্লিট করার আগেই চাকুরী হয়ে গেল। মায়ের কাছে প্রাইভেট পড়তে আসা এক মেয়েকে মা পছন্দ করেছিলেন আমার জন্য। হুট করেই তার সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেলো। মেয়েটার নাম নীলিমা। মায়াবী চেহারা, নরম মনের একটা মেয়ে ও। মায়ের সাথে খুব ভাব হয়ে গেল। যেনো মা-মেয়ে। মা ওকে খুবি ভালোবাসতো। আমাদের দিনগুলো বেশ সুখেই কেটে যাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন মা বললেন তার বুকে ব্যাথা করছে। হসপিটালে নিয়ে চেকআপ করা অবস্থাতেই চলে গেলেন তিনি। মারাত্মক একটা স্ট্রোক করেছিলেন। আমি হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার সব শক্তি যেনো শেষ হয়ে গেছে। নীলিমার চিৎকারে আমার সম্বতি ফিরে পেলাম। নার্স সাদা চাদর দিয়ে মায়ের দেহটা ঢেকে দিল। নীলিমা মাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদছিলো। আমি যেনো ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম। নীলিমাকে আস্তে করে উঠালাম। মা মরা মেয়েটা শাশুড়িকে মায়ের মতই আপন করে নিয়েছিল। মেনে নিতে পারছেনা মায়ের এভাবে হুট করেই চলে যাওয়াটা। তিনদিন পর্যন্ত ভালোমত কিছুই খেলোনা। আস্তে আস্তে সব কিছুই স্বাভাবিক হয়ে গেল। সব কিছু আগের মতই চলতে লাগলো। কিন্তু ঘরটা কেমন যেন শূন্য হয়ে গেছে। নীলিমাকে দেখতাম, মাঝে মাঝেই মায়ের ব্যবহৃত এটা ওটা জিনিস নাড়াচাড়া করতো আর ডুকরে কেঁদে উঠতো। আস্তে করে বুকের মধ্যে টেনে নিতাম। আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আরো জোড়ে কেঁদে উঠতো। বেলা গড়িয়ে রাত হল, দিন গড়িয়ে মাস গেল, মাস পেরিয়ে বছর। বাসায় নতুন অতিথির আগমনের সময় এসেছে। সবকিছু গোছগাছ চলছে। এর মধ্যেই একদিন নতুন অতিথির আগমন। নীলিমার সিজার করতে হয়েছিল। ওটিতে ঢুকার আগে আমার হাত দুটো শক্ত করে ধরে বলল, আমার খুব ভয় করতেছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম, কিচ্ছু হবেনা তোমার বোকা মেয়ে। ভয় পেওনা। সুস্থ্য থাকবে তুমি। হঠাৎ বলে বসলো, আমাকে কথা দাও, যদি আমার কিছু হয়ে যায়, তাহলে তুমি আরেকটা বিয়ে করবে..!! অন্তত আমার সন্তানের জন্য হলেও..!! ওকে বললাম, বাজে বকোনাতো..!! কিচ্ছু হবেনা। ওর কপালে একটা ভালোবাসার চুম্বন এঁকে দিয়ে ওকে ওটিতে পাঠালাম। প্রচন্ড অস্থিরতা কাজ করছে আমার মধ্যে। কারণ ওর অবস্থা খুব ক্রিটিক্যাল। ডাক্তারও ভয় পাচ্ছেন। হঠাৎ ওটির দরজা খুলে গেল। ছুটে গেলাম ভেতরে। ডাক্তার বললেন...
--- মেয়ে হয়েছে। বাচ্চা ভালো আছে কিন্তু....!!! (ডাক্তার)
--- কিন্তু কি ডাক্তার..?? (নীল)
--- আই অ্যাম স্যরি.... (ডাক্তার)
আস্তে আস্তে নীলিমার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ছোট্ট পরীটা তার মায়ের সাথে শুয়ে আছে। দুইজনকেই কি অপরূপ লাগছে। নীলিমার চোখ বন্ধ। দেখে মনে হচ্ছে ঘুমুচ্ছে। কিন্তু নাহ, আমার নীলিমানেই। চলে গেছে। দশ মাস গর্ভে ধারন করা সন্তানটাকেও এক নজর দেখতে পারলোনা..!!! তার আগেই চলে গেলো..!! প্রচন্ড অভিমান হচ্ছে ওর উপর। বাবা গেল, মা গেল, নীলিমাও চলে গেল এভাবে..!!! শেষবারের মত আমার লক্ষী বউটাকে টেনে নিলাম বুকের মধ্যে। চিৎকার দিয়ে কেঁদেছিলাম সেদিন। আমার ছোট্ট পরীটাও কেঁদেছিল সেদিন। আল্লাহর কাছে অভিযোগ করেছিলাম, কি দোষ করেছে আমার ছোট্ট পরীটা.? কেন তার মাকে তার কাছ থেকে কেড়ে নিলে..??
আমি আর বিয়ে করিনি। ছোট্ট পরীটাকে নিয়েই আছি। মেয়ের নাম রেখেছি আঁভা। ও এখন বড় হয়েছে। পাঁচ বছর বয়স ওর। অনেক বড় হয়ে গেছে। আমাকে শাসন করে। ওর সামনে সিগারেট খাওয়া বারন আমার। চায়ে চিনি বেশি খাওয়া বারন। প্রতিদিন বাসায় ফেরার সময় ওর জন্য চকলেট নিয়ে আসতে হবে, এটা নিয়ম। এখন ওই আমার সবকিছু। আমার রাজকন্যা। একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখলাম রাজকন্যাটা ফ্লোরে পড়ে আছে। দ্রুত হসপিটালে নিয়ে গেলাম। ওর কিডনি ড্যামেজ হয়ে গেছে। রিকভার হওয়ার সময় শেষ। চেইঞ্জ করতে হবে। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। ওকে হসপিটালে ভর্তি করলাম। মাথায় এখন কিছু ধরছেনা আমার। হাঁসি খুশি আনন্দ উচ্ছলে মেতে থাকা মেয়েটা কেমন যেন চুপ হয়ে গেছে। দিন দিন কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে। ওর মাথার কাছে বসে আছি। আমার চোখ থেকে দু-ফোঁটা পানি ওর মুখের উপরে পড়লো কিডনি পাওয়া যায়নি কোথাও। আমার সাথেও ম্যাচিং করে নাই। "বাবা"... ডাক দিলো আঁভা।
--- বাবা..?? (আঁভা)
জিজ্ঞেস করলাম...
--- কিরে আম্মু, খুব কষ্ট হচ্ছে, তাইনা..?? (নীল)
বললো...
--- আমার জন্য নয় বাবা, তোমার জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তোমাকে এখন কে দেখবে, কে শাসন করবে..?? (আঁভা)
ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলাম। চিৎকার করে কান্না করছি দুই বাপ বেটি।
--- বাবা, আমাকে প্রমিস করো, তুমি আর সিগারেট খাবানা..!! (আঁভ)
প্রমিস করলাম...
--- না পরী, আমি আর সিগারেট খাবোনা.. (নীল)
--- বাবা, আমি মারা গেলে কি আকাশের চাঁদ হয়ে যাবো..?? (আঁভ)
--- হ্যাঁ, মা। তখন আমি তোমার সাথে কথা বলবো। (নীল)
--- আচ্ছা বাবা, সেখানে কি আমি মাকে খুঁজে পাবো..?? (আঁভা)
--- হ্যাঁ মা, খুঁজে পাবা... (নীল)
--- কিন্তু আমি মাকে তো কখনো দেখিনাই বাবা..!! (আঁভা)
--- যেই তারাটাকে দেখবা বড়, বেশি উজ্জল, সেটাই তোমার মা। (নীল)
--- বাবা, তুমি কি আমাকে ভুলে যাবা..?? (আঁভা)
কি জবাব দিব আমি..?? ওকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। চিৎকার করে আল্লাহ্কে অভিযোগ করলাম, কোন অপরাধের শাস্তি দিচ্ছো তুমি আমাকে..?? কেন সবাইকে আমার কাছ থেকে এক এক করে কেড়ে নিচ্ছো..?? কেন..?? কেন...??? আমার আঁভাকে কেড়ে নিওনা আমার কাছ থেকে। ও ছাড়া যে আমার আর কেউ নাই খোদা..!!! প্লীজ ওকে নিয়ে যেওনা...
ওটিতে যাওয়ার আগে আমার পরীটা আমাকে কথা দিয়ে গেছে, আমাকে ছেড়ে যাবেনা। কোথাও যাবেনা ও আমাকে ছেড়ে...
এক জায়গায় খোঁজ পেয়েছিলাম কিডনির। কিন্তু এক্সচেঞ্জ। পরে আমার একটা কিডনি দিয়ে সেখান থেকে সেটা নিয়ে এসেছি। সেটাই এখন আঁভাকে দেয়া হচ্ছে। অপারেশন থিয়েটারের দরজার উপরে টিম টিম করে একটা লাল লাইট জ্বলছে। আমি দরজার সামনে বসে আছি। অস্থিরতা বেড়েই চলছে আমার। কারণ, ভেতরের অপারেশন টেবিলের উপরে ছুরি-কাঁচির নিচে যে আমার পরীটা শুয়ে আছে..!! আমার ছোট্ট পরী, আমার ক্বলিজার টুকরা, আমার রাজকন্যা, আমার মেয়ে আঁভা। ডাক্তার কে দেখছি হাঁসি মুখে বের হয়ে আসছে। এসে বলল...
--- কনগ্রাচুলেশন্স। অপারেশন সফল হয়েছে। (ডাক্তার)
--- ধন্যবাদ ডাক্তার অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। আমি কি আমার মেয়েকে দেখতে পারি..?? (নীল)
আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে উঠল। কথা রেখেছে আমার আঁভা। যায়নি সে আমাকে ছেড়ে। ফিরে এসেছে আমার কোলে। আমার ছোট্ট পরী, আমার রাজকন্যা...
--- বাবা এখন থেকে আবার সব কথা শুনবাতো..?? (আঁভা)
--- হ্যাঁ সোনা শুনবো। আর কোথাও হারাতে দেবোনা তোমায়। (নীল)
এই বলেই ওকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদলাম আর আল্লাহর কাছে আমার সমস্ত অভিযোগ তুলে নিলাম আর অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম।
--
--
Written By: হলদে হিমুর নীল কাব্য (নীল আদনান)
২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১:০৪
হলদে হিমুর নীল কাব্য বলেছেন: ধন্যবাদ
©somewhere in net ltd.
১|
২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ২:০৩
রিপি বলেছেন: ভাল লিখেছেন। গল্পটা পড়ে মন খারাপ ভাল দুটোই হয়েছে। শুভেচ্ছা আপনাকে।