নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নীল আর হলুদের প্রতি দুর্বলতা বেশি আমার। ফেসবুকে আমার পোষ্ট পড়তে চাইলে সার্চ করুন, - হলদে হিমুর নীল কাব্য (নীল আদনান)

হলদে হিমুর নীল কাব্য

বুক ভরা ব্যাথা নিয়ে বেহায়ার মত হাঁসতে পারি ।

হলদে হিমুর নীল কাব্য › বিস্তারিত পোস্টঃ

:( → অবাধ্য সন্তান

২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৪১


[বাস্তব ঘটনা। পড়ার অনুরোধ রইলো]

--- আকরামঃ মাগো তুমি কোথায় চলে গেলে আমাকে একলা করে। মা তোমার সব না শুনা কথা আমার হৃদয়টাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। বাবা তোমায়ও খুব মনে পরছে। জানো বাবা তুমি থাকলে আজ খুব খুশি হতে আর নিজেকে গর্বিত বাবা ভেবে আমায় বুকে জড়িয়ে নিতে।

এইসব বলতে বলতে আকরাম হাউমাউ করে কাঁদতেছিল তার বাবা মায়ের কবরের পাশে রাতের অন্ধকারে। সাথে সহস্র হতাশার জাতনা নিয়ে আকাশের মিটিমিটি করে জ্বলা তারাগুলোও যেনো ছুটাছুটি করছে। আকরাম তাকিয়েই আছে বড় তারার পাণে। ছেলেবেলার কথা মনে পড়ছে। মা বলেছিল,,, মা মারা গেলে নাকি আকাশের তারা হয়ে যাবে!!

--- আকরামঃ আচ্ছা মা না হয় তারা হলো কিন্তু আমার বাবা কই? বাবা কোন তারাটি? মা শুকতারা কিন্তু বাবা কোন তারা? বাবা তোমার অভিমান কি এতই বেশি যার কারণে আকাশের তারা হয়েও দেখা দিচ্ছোনা। আর অবাধ্য হবোনা তোমার। প্লীজ লক্ষি বাবা একবার বলো তোমার ত্যাজ্য পুত্র নই আমি।

৩ মাস ২৬ দিন আগের কথা।

''কুমিল্লা চান্দিনা থানার‬ কোন এক ‪গ্রামের‬ কথা গল্পাকারে বলছি।''

রফিক সাহেব গ্রামের স্কুল মাস্টার। অল্প চাওয়াতে ওনার যেনো আকাশ সমান প্রাপ্তি। চারদিকে ওনার খুবি সম্মান। অনেক দূর দূরান্ত থেকে রফিক সাহেবের কাছে অন্য স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা প্রাইভেট পড়তে আসে। আর রহিমা বেগম ঘরে ঘরনির দায়িত্ব পালন করেন রফিক সাহেবের বাধ্যগত লক্ষি বউটি হয়ে। গ্রামের কেউ কোনদিন আঙুল তুলে খারাপ কিছু বলবার সাহস পায়নি। খুবি নম্র-ভদ্র শান্ত-সৃষ্ট মায়াবতী রহিমা বেগম। সংসারের সব কিছু একা হাতে সামলান। শাশুড়ি আছে কিন্তু শশুর নেই। মা মরা মেয়ে রহিমা বেগম শাশুড়ি পেয়ে মায়ের অভাব কুড়ে কুড়ে মজাচ্ছেন। শাশুড়ি নিজের সব দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন রহিমা বেগমের কাছে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন এবং সংসারের সকলকে খুব শাসন করতেন নামাজ না পড়লে রহিমা বেগম। হঠাৎ একদিন রহিমা বেগমের বমিবমি ভাব। সবাই এর থেকে বুঝতে পারলো ঘরে নতুন অতিথি আসছে। আর রফিক সাহেব খুশির সংবাদ শুনে বাড়ির সবাইকে মিষ্টি খাওয়ালেন। দিন শেষে রাত্রিবেলায় সবাই নতুন অতিথির নাম রাখার উদ্যোগ নিলো। কেউ বলে "রহিম" (পরম করুণাময়), কেউ বলে "আফুউ" (ক্ষমাকারী)। কিন্তু রফিক সাহেব ফেলফেল করে হেঁসে উঠলেন। বললেন,,,

--- রফিকঃ এখনো অতিথি আসার নাম নেই আর নাম রাখা নিয়ে হতভম্ব সব। আচ্ছা আমি বলছি,,, যদি ছেলে হয় তাইলে নাম রাখবো "আকরাম" (সর্বাধিক সম্মানিত) সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকার হবে আকরাম, তাতে তার কোন দৃষ্টান্ত নেই, যাবতীয় কল্যাণ নিজ অনুগ্রহে অবাধ্যদের ক্ষমা করে সুযোগ দিবে, ন্যায়নিষ্ঠাচার মানুষ হবে। আর যদি মেয়ে হয় তাইলে নাম রাখবো "ফাতেমা"।
--- রফিকের মাঃ হুম বাবজান ঠিকি বলেছো খুবি সুন্দর নাম। বউমা যাও খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। তোমার এখন থেকে বিশ্রামের প্রয়োজন।
--- রহিমাঃ জ্বী আম্মা।

সবাই খুব খুশি। মেয়ে কিংবা ছেলে হোক নামকরণও করা শেষ এবার অতিথি আগমনের প্রত্যাশায় সবাই অপেক্ষারত। আসলে শুধু গল্প কিংবা সিনেমায় নয় এটা বাস্তবিক ঘটনা যে প্রত্যেক পরিবার, স্বামী-স্ত্রী সকলেই নামকরণ নিয়ে অবুঝ বাচ্চাদের মতো আচরণ করে থাকে। প্রত্যেকের একটা স্বপ্ন থাকে। সন্তান জন্ম নিলে কেমন নামের ভিত্তিতে তাকে বড় করে তুলবেন ঠিক তেমনি রফিক সাহেবও করলেন। পুত্র জন্মালো আর সেদিনের কথামতোই নাম রাখা হলো "আকরাম" যেই নামের অর্থ (সর্বাধিক সম্মানিত)। কেননা রফিক সাহেব কখনো জেনে শুনে অন্যায়, খারাপ কাজ করেননি আর এতে তিনি অধিক সম্মানের অধিকার নিয়ে পুরু গ্রামে ছেয়ে আছেন। তাই তিনি তার ছেলেকেও তার মত গড়তে চান। পুত্রের যখন প্রায় আট বছর বয়স তখন অনেক আশা ভরা স্বপ্ন নিয়ে পুত্রকে স্কুলে ভর্তি করালেন। এক এক ধাপ ভালোই আগাচ্ছিলো। বৃত্তি পেলো ফাইভে। তখন আকরামকে মামার বাড়ি পাঠানো হয়। মামার বাড়ি পড়াশুনা করলে খুবই ভালো করবে কেননা প্রায় শহরের মতোই ‪#‎চান্দিনা‬। পুত্রকে বিদায়ের বেলায় রহিমা বেগম বলেছিলেন নামাজ পড়ার জন্যে সবসময়। সবার বাধ্যগত হয়ে চলার জন্যে বলেছিল। রফিক সাহেবও তাই বুঝালেন পুত্রকে। খুব আদরের সন্তান তাদের আর সাথে আছে অজস্র স্বপ্ন রফিক সাহেবের আকরামকে নিয়ে।

প্রায় ক্লাস সেভেন অবদি ভালোই যাচ্ছিলো কিন্তু এলাকার বাজে ছেলেদের সাথে খেলতে গিয়ে মিশতে হত খুব। এই বয়সটা প্রত্যেকেরি খেলাধুলার প্রতি অধিক নেশা থাকে। তেমনি এক দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা ঘটে গেলো আকরামের স্কুলের এক মাস্টারের সামনে। মাস্টার দেখলো আকরাম স্কুলের ছাদে উঠে কি যেনো খাচ্ছে। খাচ্ছে বলে নয়, কিন্তু খুবি নোংরা গন্ধের ছড়াছড়ি। মাস্টার তার বড় মাস্টার মানে হেডমাস্টারকে জানায়। আকরামকে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করলো,,,

--- হেডস্যারঃ তুমি ক্লাস ফাঁকি দিয়ে স্কুলের ছাদে কি করছিলে?
--- অন্য স্যারঃ স্যার কি যেনো খাচ্ছিলো অনেক বিশ্রী গন্ধ।
--- হেডস্যারঃ তুমি কি খাচ্ছিলে হুম?
--- আকরামঃ কিছুনা স্যার। আমার বিজ্ঞান ক্লাস করতে ভালো লাগেনা তাই ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
--- হেডস্যারঃ তোমার মতো ব্রিলিয়্যান্ট ছাত্র এইকথা বললে বাকি ছাত্ররা কি বলবে!! যাও ক্লাসে যাও..ওওও... [ধমকের স্বরে]

ছাদে দাঁড়িয়ে আকরাম গাজা খাচ্ছিলো। আকরাম প্রায়ই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বাইরের বন্ধুদের সাথে নেশায় মগ্ন হয়। স্কুলের পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশিত হয় আর আকরাম ৪ সাবজেক্ট ফেল করে। বিষয়টা খুঁতিয়ে দেখার জন্যে হেডস্যার অন্য স্যারদের বকাঝকা করেন। একজন ভালো ছাত্রের খারাপ রেজাল্ট কি করে!!! এদিকে রফিক সাহেব জানতে পেরে সোজা চান্দিনা চলে আসে। এসে খুব বুঝায়। যাই বলে তাতেই স্বায় দেয় আকরাম। যাবার সময় কিছু টাকাও দিয়ে যান রফিক সাহেব। আর সেই টাকা দিয়ে আকরাম নেশা করে। এছাড়া আকরাম কখনো কখনো মামার পকেট থেকে কখনো বা নানুর থেকে টাকা চুরি করতো। আসলে বাজে ছেলেদের সাথে মিশতে মিশতে আকরাম খুবি বাজে হয়ে গেছে। এভাবে প্রায়ই ক্লাসে কেউ কেউ গাজার প্যাকেট আর সিগারেট পেতো স্কুলবেগে। এইসব হেডস্যারকে দেখায় ক্লাসের ছাত্ররা। হেডস্যার রফিক সাহেবকে ডাকেন স্কুলে।

--- হেডস্যারঃ দেখুন রফিক সাহেব, আপনার ছেলে শেষ। আপনি শিক্ষক আমিও শিক্ষক তাই বলছি আপনি আপনার ছেলেকে নিয়ে যান। টি.সি দিয়ে দিচ্ছি।
--- রফিকঃ এমন করবেননা। আমি আমার ছেলেকে চিনি। কোথাও ভুল হচ্ছে আপনাদের।
--- হেডস্যারঃ ভুল না। প্রতিটা ছাত্রই আপনার ছেলে স্কুলবেগে এইসব পেয়েছে।
--- রফিকঃ ডাকুনতো তাকে।
--- হেডস্যারঃ আকরামকে ডেকে আসো মাসুদ।

ডাকার পর আকরাম আসলো। রফিক সাহেব নিজের ছেলের চেহারা দেখে বিশ্বাসী করতে পারছেননা। চোখের নিচে কালো দাগ তাছাড়া পুরু চেহারায় যেই কম বয়সী রেশ থাকার কথা ছিলো তা আর নেই। এতো পরিবর্তন তার ছেলের!! নিজেকে মানাতে পারছেনা। রফিক সাহেব আকরামকে কাছে ডাকলেন,,,

--- রফিকঃ আয় বাবা এদিকে আয়। কেন এমন করলি? কোন কিছুর কি কমতি ছিলো তর? আমাকে স্কুলে ডেকে আনালি পর্যন্ত। কি হইছে বাবা তর খুলে বলত...
--- আকরামঃ কই আব্বা কিছুনা। এমনি একটু শরীর খারাপ আরকি। আব্বা আমি বাড়িত যামু।
--- রফিকঃ বাড়িতে কেন? তুই এখানে পড়বিনা?
--- হেডস্যারঃ দেখুন রফিক সাহেব আপনি আপনার ছেলেকে সাথে করে নিয়ে যান।
--- রফিকঃ এভাবে বলছেন কেন? বাচ্চা ছেলে ভুল করেছে।
--- হেডস্যারঃ আপনিও একজন শিক্ষক। আপনি কি পারতেন এভাবে একজন নষ্ট ছেলেকে সুযোগ দিয়ে বাকি ভালো ছাত্রদের খারাপ করতে?? টি.সি দিচ্ছি নিয়ে যান।

রফিক সাহেব আর কিছু না বলেই মাথা নেতিয়ে চলে আসল আর সাথে আকরামকেও। বাড়িতে এনে কোন কথা না বলে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে ইচ্ছামত মেরেছিলো। পুরু বাড়িতে রহিমা বেগমের কান্নার স্বর জানান দিচ্ছে আমার আকরামকে আর মেরোনা।

সন্ধ্যাবেলায় রফিক সাহেব আকরামকে নিয়ে পড়ার টেবিলে। ভালোমতো বুঝাচ্ছে...

--- রফিকঃ বাবারে এইসব আর করিসনা। এবার মন দিয়ে পড়াশুনা কর। আমায় না হয় অসম্মান করলি কিন্তু তর মাকেও অসম্মান করিসনা।

রহিমা আকরামকে নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছে আর বুঝাচ্ছে। বুঝানোর পর কয়েকমাস ভালোই কাটছিল তারপরও রফিক সাহেবের আর রহিমা বেগমের দৃষ্টির অগোচরে চলছিলো নেশা। স্কুল জীবন শেষ করে আকরাম এখন কলেজে।

কলেজে এসে শুরু হলো আরেক নতুন কাহিনী। আকরাম প্রেমে পরলো। কিন্তু মেয়েতো রাজি নয়। কোন মেয়েই জেনে শুনে খারাপ ছেলেকে ভালোবাসতে চায়না। মেয়েটি তার গ্রামেরি মেয়ে। অনেকভাবে বুঝানোর পর রাজি হলো। কিন্তু আকরামের একটা প্রেমে তৃপ্তি আসেনা। এইরকম অনেক মেয়ের সাথেই ভণিতা করে প্রেম করে। বাবার কাছে বায়না ধরে বাইক আর দামি ফোন কিনে দিতে। সব বন্ধুদের বাইক আছে দামি ফোন খালি আমার নেই। রফিক সাহেব ছেলের এই ইচ্ছেকেও প্রাধান্য দিয়ে বাইক, ফোন কিনে দেয়। শুরু হয় আরো খারাপ কাজ। আবার মাঝেমাঝে এলাকায় গরু চুরি হত কখনো বা নিজেরি ঘর থেকে টাকা চুরি করতো কিন্তু কেউ জানতোনা। একসময় বড় রকমের মেয়েলী ফাঁদে জড়িয়ে পরে। অন্য গ্রামের মেয়ে প্রেগন্যান্ট যার একমাত্র দায়ী আকরাম। সবার মাঝে বিষয়টি ছড়াছড়ি হয়ে যায়। এলাকার চেয়ারম্যান আর অন্যান্য এলাকার মুরব্বী নিয়ে বসে এর সমাধান দেয়। সমাধান একটাই খুঁজে বের করে, অতঃপর বিয়ে। বেশ ধুমধাম করে বিয়ে হয়নি। আর যাদের দাওয়াত করা হয়েছিল অনেকেই আসেনি। কেননা তারা আর রফিক সাহেবকে সম্মানের স্থানে বসাতে পারবেনা।

আর এদিকে রফিক সাহেবের কাছে কোন ছাত্র ছাত্রী পড়তেই আসেনা। সবাই বলে কয়ে বেড়ায় এলাকায়, যে কিনা নিজের সন্তানকে মানুষ করতে পারেনা সে কি করে আমার এবং অন্যের ছেলে মেয়েদের শিক্ষা দিবে। এই সমস্ত বলে রফিক সাহেবকে খুব অসম্মান করতো এলাকার লোকজন। একসময় রফিক সাহেব খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। আর এদিকে আকরাম কোন কাজ না করে কখনো বউয়ের, মায়ের গয়না চুরি করে বেচে দেয়। একদিন মধ্যরাতে রফিক সাহেব আর রহিমা বেগম ঘুমাচ্ছিলো। চুপিচুপি ঘরে ঢুকে আকরাম, আর রফিক সাহেবের সারা বছরের জমানো টাকা এক নিমিষে কেড়ে নেয়। যদিও এই টাকা শুধু আকরামের জন্যেই জমিয়েছিল কিন্তু আকরাম এমনি নেশার ঘোর যে কিনা তার প্রিয় বাবার টাকা এভাবে চুরি করল!! টাকা নিয়ে যাবার পথে দরজার নিচের কাঠে উস্টা খেয়ে এলিয়ে পড়ে যায়। সাথে সাথে রফিক সাহেব এবং রহিমা বেগম জেগে উঠে আর আলো জ্বালিয়ে দেখে আকরাম পড়ে আছে আর হাতে অনেকগুলো টাকা। জিজ্ঞেস করাতে আকরাম উত্তরে জানায়,,,

--- আকরামঃ আ..আআমার টাকা আমি নিছি তাতে তদের কি হুমমম? [নেশার ঘোরে]
--- রহিমাঃ ছিঃ এতো অধঃপতন হয়েছে তর? আজ নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসী হতোনা। যা বেড়িয়ে যা এই ঘর থেকে। ,,,হুঁ,,,হুঁ,,,হুঁ,,, [কান্নার স্বরে]
--- আকরামঃ চুপ কর বুড়ি। তর ঘর নাম লেখা আছে নাকি? [নেশার ঘোরে]

থাপ্পড় মারলো রফিক সাহেব। এক পাহাড় সমান দুঃখ নিয়ে বলল,,,

--- রফিকঃ এখুনি এই ঘর ছেড়ে এই বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে যা। আর কোনদিন আসবিনা।
--- আকরামঃ কি বল আব্বা!! আমার টাকাইতো আমি চুরি করছি। তুমি বল এই টাকা আমার নয়? নাকি তোমার অন্য বউ অন্য ছেলে আছে?

রফিক সাহেব কোন উত্তর না দিয়ে সমানে থাপ্পড় মারতে মারতে খাটে বসে পড়লেন। রহিমা বেগম বললেন,,,

--- রহিমাঃ ওগো একটু শান্ত হও। ছেলে নেশার ঘোরে কি না কি বলছে তাতে ভেঙ্গে পড়োনা।
--- আকরামঃ এই বুড়ি চুপ থাক।

বলেই নিজের মাকে লাথি মেরে ফেলে দিল। রফিক সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। আর বললেন,,,

--- রফিকঃ হারামি এখনো আমি বেঁচে আছি। তুই এতো খারাপ হইলি ক্যামনে? তর কি ছেলেবেলার কথা একটুও মনে পড়েনা? তকে বড় করে তুলতে আমরা কত কিছুকে বিসর্জন দিয়েছি।
--- আকরামঃ উফ আব্বা ঘ্যান ঘ্যান করোনাতো। প্রতিটি বাবা মা এরকমি বলে আর করে সন্তানের জন্যে।
--- রফিকঃ তর নামের মানে কি জানিস?
--- আকরামঃ সে যাই হোক ছাড়োতো আব্বা। টাকাগুলা নিয়া গেলাম।
--- রফিকঃ তর নামের মানে (সর্বাধিক সসম্মানিত)। একটি টাকাও না। টাকা গুলো দে বলছি দে...

বাবা ছেলে খুবি জোড়াজোড়ি করছে। এক পর্যায়ে আকরাম তার বাবাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে টাকাগুলো নিয়ে যায়। আর এদিকে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কান্না করছে। কেমন ছেলে তাদের হয়েছে।

প্রতিটি বাবা মা চায় তার সন্তান সুশিক্ষায় বড় হোক। কোন জন্মে পাপ করেছিলেন রফিক সাহেব এবং রহিমা বেগম যারা কিনা নিজের সন্তানের থেকে দারুণ কষ্ট ভোগ করছে। একটা কথা কখনো বেশি আশা করা ঠিক নয়। শুধু বাবা মায়ের দিক থেকে নয়। পৃথিবীর সব ক্ষেত্রেই বড় আশা করা ঠিক নয়। আশাহত মানুষগুলোর যেই পরিণতি শুধু তারাই বুঝেন যারা খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন।

সারারাত আর কিছু বললেননা রফিক সাহেব। সকাল হলো... এক বাড়ি ভর্তি মানুষের সামনে ছেলেকে বলল,,,

--- রফিকঃ তকে আমি ত্যাজ্য পুত্র করলাম। আজ থেকে তর সাথে আমাদের আর কোন যোগাযোগ থাকবেনা। কি দিয়েছিস বিনিময়ে তর মায়ের ১০ মাস ১০ দিন গর্ভে থাকার বিনিময়ে। আমার প্রতিটা সম্মানে যে আঘাত হেনেছিলি তুই... আমি রাস্তায় বের হলে সবাই বলে নিজের সন্তানকে মানুষ করতে পারেনি আবার অন্যের সন্তানকে মানুষ করতে আসছে। ,,,হুঁ,,,হুঁ,,,হুঁ,,,, [কান্নার স্বরে]
--- আকরামঃ আমার কাছে এখন টাকা আছে। আচ্ছা গেলামগা। একদিন ঠিকি খুঁজবে। বউকে রেখে গেলাম আব্বা।
--- রহিমাঃ বাবারে এইদিন দেখার জন্যে আজও বেঁচে আছি?
--- আকরামঃ উফ আবারো ঘ্যান ঘ্যান!!
--- রফিকঃ বেড়িয়ে যা বেয়াদব।

সাড়া বাড়ি জুড়ে কান্নার রেশ পরে গেলো আকরামের এমন কথা শুনে। এমন পাষণ্ড ছেলে জন্ম দেয়ার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো। পাড়ার লোকের ছিঃ ছিঃ করে বলে কয়ে বেড়ালো...

প্রায় অনেক মাস কেটে গেলো। এরি মাঝে গ্রামে অনেক কিছু চুরি হয়। কিন্তু কে এই চোর তার খুঁজ কেউই পায়না। গ্রামের ট্রান্সমিটার, গরু এবং বেশ গহীনিয়ান জায়গায় গাজা এবং অন্যান্য নেশার সামগ্রী খুঁজে পায় এলাকার মানুষ। কেউ কেউ বলে এইগুলা মাস্টারের ছেলের কাজ। অনেক অকথ্য ভাষায় বকাঝকা করে। আর এদিকে রফিক সাহেব লজ্জায় বাড়ি থেকে বেরুতে পারেনা। আবার কেউ বলে, এতো আদরের ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করেছে মাস্টার, আমার মনে হয়না মাস্টারেএ ছেলে এইসব করবে। রহিমা বেগম প্যারালাইজড হয়ে ঘরে পড়ে আছেন আর এদিকে রফিক সাহেব খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। আর এদিকে ছেলের বউও কোথায় চলে গেছে জানেননা। হয়ত তার আপন নীড়ে... খুঁজও নেননা রফিক সাহেব। এলাকার মানুষের অকথ্যকথন শুনে কোথাও বেরুতে ইচ্ছে করেনা আবার কেনইবা খুঁজবে!! চলে গেছে ভালোই হয়েছে। মেয়েটা এখানে থাকলে কি খেতো??

একদিন গ্রামে গরু চুরি করার সময় এলাকার লোকের কাছে ধরা পড়ে আকরাম। সবাই আকরামকে ধরে নিয়ে আসে রফিক সাহেবের বাড়িতে। সবাই ডাকছে,,,

--- এলাকার লোকঃ ওই মাস্টার বের হ। দেখ তর ছেলেরে ধরছি গরু চুরির জন্যে। আমাদের প্রতিটা চুরির জন্যে দায়ি তর ছেলে। ওই সবাই মার চোরের বাচ্চা চোরেরে।
--- রফিকঃ আপনারা যা ইচ্ছে করুন কিন্তু আমার বাড়িতে নয়। আমি এমন ছেলে জন্ম দেইনি। তাছাড়া সে আমার পুত্র নয়। ত্যাজ্যপুত্র করে দিছি।

এদিকে রহিমা বেগম খুব খুব কাঁদছে। ছেলের এমন পরিণতি শুনে রহিমা বেগম হাউমাউ করেই কাঁদছে...
আর অনেক মানুষ বলছে চোর ছেলে জন্ম দিয়ে বড় কথা বলছে।

--- এলাকার লোকঃ মাস্টার হালারে পিটামু নি..?
রফিক সাহেব এমন কথা শুনার পরে চোখ বন্ধ করে ভিতরে ভিতরে কাঁদছে আর আল্লাহকে বলতে লাগলো,,,

--- রফিকঃ হে আল্লাহ আমায় তুমি নিয়ে যাও আর বাঁচতে ইচ্ছে করছেনা।

সবাই যে যেভাবে পারছে লাথি ঘুষি লাঠি বাশ দিয়ে সমানে মারতে থাকলো আকরামকে আর চিল্লানী দিয়ে বলছে,,,

--- আকরামঃ আব্বা আমাকে বাচাও ও আব্বা আমাকে বাচাও।

রফিক সাহেব ত্যাজ্যপুত্র করে দিলেও ছেলের এমন দুর্দশা দেখে কাঁদতে লাগলো। আকরাম বাবার পায়ে পরে একটা সুযোগ চাইছিলো কিন্তু এলাকার মানুষজন এতো নিষ্ঠুরভাবে মারছিলো যার কারণে কিছুই করা হয়ে উঠেনি। তারপর সবাই আকরামের মাথার চুল কেটে ন্যাড়া করে দিল, আর জুতার মালা গলায় পড়িয়ে তিন, চার গ্রাম ঘুরালো।

রফিক সাহেব ঘরে প্রবেশ করলেন। দেখতে পেলেন তার বউটি নরম চাহনিতে তাকিয়ে আছে আকরামের ছবির দিকে। চোখের জলে গড়াগড়ি খাচ্ছে সাড়া মুখ। রফিক সাহেব ডাকলেন,,,

--- রফিকঃ জানো রহিমা আজ আমাদের আদরের ছেলে মুখ উজ্জ্বল করেছে। আমাদের এবং তার সম্মান তিন, চার গ্রাম জুড়ে বিলিয়েছে। স্বপ্নেরা হাতছানি দিয়ে ডাকছে আব্বা ও আব্বা আমাকে বাঁচাও। আর একটা সুযোগ দাও আব্বা। জানো আমার কাছে না উপায় নেই আজ। এত্ত উঁচু মাথা নিয়ে বেরুতে পারবোনা। তাই না ফেরা দেশের জন্যে রওনা দিলাম। আচ্ছা তুমি যাবে রহিমা!! এখানে থেকেই বা কি করবে? রহিমা,,, ওই রহিমা,,, রহিমা..আআআ..?? কথা বলোনা কেন?

একটু সামনে এগিয়েই রফিক সাহেব রহিমা বেগমের শরীরে ধাক্কা দিলেন। ধাক্কা দেয়া মাত্রই এলিয়ে পড়লেন রহিমা বেগম। আর বুঝবার বাকি নেই রফিক সাহেবের। রহিমা বেগম আর নেই পৃথিবীতে। শুধু নিথর দেহখানিয়ে পড়ে আছে। রফিক সাহেব খুব জুড়ে কাঁদলেন রহিমা বেগমকে জড়িয়ে ধরে। আর ততক্ষণাৎ রফিক সাহেব ফ্যানে একটা কাপড় পেঁচিয়ে গলায় ফাঁসি দিয়ে পৃথিবী ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুর সাথে তার অজস্র স্বপ্নগুলো রুমে ঘুরাঘুরি করছে।

বেলা অবেলা, দিন পেরিয়ে রাত শেষ হলো। দরজা এখনো অবদি মেলেনি মাস্টার সাহেব। দুটি নিথর দেহ বন্ধ ঘরে তাদের স্বপ্নগুলো নিয়ে ঝুলছে আর এলিয়ে পড়ছে। গ্রামের কেউ একজন এসে দরজা খুলে। খুলেই যা দেখলো তা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিলো। আবার কেউবা বলল,,,

--- কিছু ফালতু লোকঃ মরছেরে মরছে চোরের বাপে মরছে...

সবাই মাস্টার সাহেবের লাশ নামিয়ে আর বউ রহিমা বেগমের লাশ একত্রিত করে মুখ ঢেকে রেখেছে। এই করুণ দৃশ্য দেখার জন্যে দূর বহুদূর থেকে অনেকেই ছুটে এসেছে। কিন্তু কারোর চোখে একফোঁটা চোখের জল নেই। সবার যে এই সৎ মানুষটির উপর খুব ঘৃণা। আকরাম যা করলো তার মা বাবার জন্যে একফোঁটা জলও খরচ করার মতো কেউই নেই। সবাই খালি এই কথাই বলছে, "অনেক ভালা মানুষ আসিলো মানুষটা" আবার কেউ বলে "ছেলে চোর তাতেই প্রমাণিত হয় যে মাস্টার নিশ্চই কোন আকাম করেছিল যার কারণে ছেলেটা এতো বদমাশ হইছে"। লাশগুলোর হাহাকার হয়ত কেউ জানেনা। কিন্তু মানুষগুলি খুব ভালো ছিলো।

আকরাম জানতে পেরে দৌড়ে ছুটে চলে আসে এই কথা শুনে। এসে অনেক ধিক্কার দিয়ে কান্না করে। কি করল জীবনটাকে। নেশায় নিজেকে শোপে দিয়ে আজ সমাজ আর বাবা মায়ের মন থেকেও বিদায় নিতে হলো।
অনেকে আকরামকে দেখে মারতে এসেছিল কেউবা বাধা দিয়ে বলে ছেলেটার মা বাবা মরছে তাই ছাইড়া দে আইজ।

কবর দেয়া শেষে সবাই বলে,,,

--- চেয়ারম্যানঃ তুমি এই গ্রামে আর আসবানা। এই না তিন লাখ টাকা। এগুলো দিয়ে পারলে আরো জোয়া গাজা খেয়ো। তোমাদের বাড়ি আজ থেকে আমার।

আকরাম জোড় গলায় কিছুই বলার সাহস পায়না। তাই তিন লাখ টাকা নিয়ে ঢাকায় চলে আসে। ঢাকায় এসে সে জগন্নাথ ভার্সিটি থেকে পড়াশুনা শেষ করে খুব বড় একটা চাকরি করছে। আর এমন একজনকে বিয়ে করেছে যেই মেয়ের কিনা কষ্টের অন্ত নেই। মেয়েটারর ফিজিক্যাল রিলেশন সম্পর্ক হয় বয়ফ্রেন্ডের সাথে কিন্তু বয়ফ্রেন্ড চিট করে। মেয়েটা প্রেগন্যান্ট। মেয়েটা মরতে যাচ্ছিলো আর আকরাম বাধা দিয়ে তাকে নতুন জীবন দেয় আর সাথে অজস্র স্বপ্নের আনাগোনা।

আকরাম প্রতিদিন রাতেই বালিশ ভেজায় কান্নার জলে। তারার পাণে তাকিয়ে বলে মা শুকতারা কিন্তু বাবা তুমি কোন তারাটা?? একবার দেখা দাওনা ওমা। আমিযে আর আগের সেই নেই অনেক বদলে গেছি আর তোমার গর্বিত সন্তান হয়েছি কিন্তু আগে বুঝিনি।

[সময় থাকতে বদলে যান আপু এবং ভাইয়ারা। পরে যদিও হাঁসবেন কিন্তু অবুঝ মনটি কাঁদবে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর জন্যে।]
--
--
Written By: হলদে হিমুর নীল কাব্য (নীল আদনান)

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:৪৪

রেজওয়ানা আলী তনিমা বলেছেন: জীবনের গল্প। সময় হারিয়ে গেলে পরে আফসোস ছাড়া আর কিছু থাকে না হাতে। ধন্যবাদ।

২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৫২

হলদে হিমুর নীল কাব্য বলেছেন: এই জন্যেই বলেছেন,
ভাবিয়া করিও কাজ,
করিয়া ভাবিওনা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.