![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি ইয়াছির মিশুক এছাড়া পরিচয় দেয়ার মতো উল্লেখ যোগ্য কিছু নেই আমার। লেখালেখির অভিজ্ঞতা বলতে পরিক্ষার খাতায় প্রশ্নের উত্তর লেখার অভিজ্ঞতাটাই উল্লেখ যোগ্য। ভালোলাগে মানুষের হাসিমুখ দেখতে। মলিন, রুক্ষ, বেদনাময় পৃথিবীতে একটু হাসির উপলক্ষ তৈরি করার জন্য লেখার চেষ্টা করি। সফলতা নিয়ে কোন ভাবনা আসেনা তাই লেখতে দ্বিধা করিনা।
বাসে উঠে জানালার পাশে বসাটা আমার অভ্যাস হয়েগেছে। বাসের সামনে, পিছেনে যে দিকেই হোক জানালার পাশে সিট খালি পেলেই আমি সেখানে বসে পরি। বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনের মাঝে কবিতার ভাব এসে দৌড়ঝাঁপ করে। পকেট থেকে ছোট্ট নোটবুকটি বের করে কবিতা লেখা শুরু করি।
আমি কোনোদিনও ভালো কবিতা লিখতে পারিনা। যখন যা মনে আসে তাই লিখে ফেলি, স্বল্প জ্ঞানের ঝুলি থেকে এলোমেলো শব্দ এনে ছন্দ মেলানোর চেষ্টা করি। কখনো কাকতালীয় ভাবে ছন্দ মিলে যায় আবার কখনো ছন্দহীন ছন্দেই কবিতা লিখে যাই।
সেদিনও ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার সময় বাসের সামনের দিকে জানালার পাশের সিটে বসেছিলাম। ঢাকা শহরের রাস্তার পাশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বলতে তেমন কিছু নেই। রোড ডিভাইডারে লাগানো ছোট ছোট গাছ গুলো ধুলো-বালি আর গাড়ির ধোয়ায় এতোটাই বিবর্ণ হয়ে থাকে যে সেগুলো দেখলে চোখ জুড়ায় না বরং মনের মধ্যে সহানুভূতি জন্মে। শুধু বর্ষাকাল এলেই কেবল গাছ গুলো একটু সতেজ হয়ে উঠে।
রাস্তার পাশের ইট-পাথরের দালান কোঠা দেখতে দেখতে মাথায় কবিতার পোকা নড়েচড়ে উঠলো। পকেট থেকে ছোট নোটবুকটি বের করে লেখা শুরু করলাম -
.
"ইট পাথরের সুউচ্চ ভবনের কোটরে কোটরে
কত স্বপ্ন ফুল হয়ে ফোটে,
কত স্বপ্ন আবার চাপা পড়ে যায়
শুকনো শহরের নির্জীব ঝঞ্ঝটে।"
.
ব্যাস এতোটুকুই, তারপর মাথার ভিতরে থাকা কবিতার পোকাটি আবার হারিয়ে গেলো। অনেক চেষ্টা করেও আর দুটি লাইন বাড়াতে পারলাম না।
আমার এমনিহয়, হঠাৎ হঠাৎ কবিতার জোয়ার আসে সবকিছু ভাসিয়ে দিয়ে আবার হঠাৎ ভাটির টান দেয়। আগে যখন এমন হতো, একটু কবিতা লেখার পর ছন্দ হারিয়ে যেতো তখন খুব খারাপ লাগতো। এখন আর খারাপ লাগে না। আমি জানি সময় হলে কবিতার পোকাটি আবার হাজির হবে কিছুটা ছন্দ নিয়ে।
এতোক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। নোটবুকটি খোলাই ছিলো পায়ের উপরে। হঠাৎ মনেহলো কেউ আমার নোটবুকের দিকে চেয়ে আছে। হ্যাঁ তাইতো, পাশের সিটে বসা মেয়েটি এতক্ষণ আমার কবিতা পড়ছিল।
আমার পাশের সিটে তো একটা মাঝ বয়সী ভদ্রলোক বসেছিল। লোকটি যে কখন নেমে গেছে আর এই মেয়েটি যে কখন বসেছে খেয়ালই করিনি।
মেয়েটির দিকে তাকালাম, গায়ে সরকারি মহিলা কলেজের ড্রেস। সম্ভবত দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ে।
স্কুল শেষ করে কলেজে উঠার পর একাদশ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের মাঝে বড় হওয়ার ভাব চলে আসে। তখন তাদের আচরণ হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের মত। তারপর যখন ধিরে ধিরে লেখাপড়ার চাপ বাড়তে থাকে, একাদশ থেকে দ্বাদশ শ্রেণী তে উঠে, লেখাপড়ার চাপে তখন তাদের হাব ভাব হয়েযায় কিন্ডার গার্টেন পড়ুয়া বাচ্চাদের মত।
তার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে নোটবুকটি বন্ধ করে ফেললাম, মেয়েটিও একটু হাসলো, বাঁকা ঠোঁট আর কুঁচকানো চোখের হাসি। "এখন আর নোটবুক বন্ধ করে লাভকি? আমিতো আপনার কবিতা পড়েই ফেলেছি " তার হাসিতে এ কথাই প্রকাশ পাচ্ছিল।
আমি আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম।
কিছুক্ষণ পর আরো কিছু ছন্দ এসে মনের জানালায় উকি মারলো। আবারো লেখা শুরু করলাম-
.
আকাশ ছোঁয়া অট্টালিকার ভারে
আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন গুলো ঝিমিয়ে পড়ে,
বেদনার বটবৃক্ষ শাখা-প্রশাখা ছড়ায়
কত মানুষের অন্তরে অন্তরে।
.
এটুকু লেখার পরে আবার পাশের সিটে বসা মেয়েটার দিকে তাকালাম এবারও কি সে আমার কবিতা পড়ছে তা দেখার জন্য। কিন্তু মেয়েটিকে আর দেখতে পেলাম না, পাশের সিটে তখন এক ভুড়ি ওয়াল ভদ্রলোক বসে পান চিবাচ্ছিল।
খেয়াল করলাম ইতিমধ্যে সরকারি মহিলা কলেজ পেড়িয়ে এসেছি। মেয়াটি নিশ্চয়ই কলেজের সামনে নেমে গেছে।
আমার দৃষ্টি চলে গেলো জানালা দিয়ে দালান কোঠা পেড়িয়ে উন্মুক্ত আকাশে। এলোমেলো ভাবনা ভাবতে ভাবতে চলে এলাম গন্তব্যে।
.
মেয়েটির সাথে আবার দেখা হয়েছিল দু' দিন পরে। আমি সেদিন বেশ কয়েক সিট পিছনে বাসেছিলাম। জানালা দিয়া বাইরে তাকিয়ে ছিলাম, ভাবনার গালিচায় বসে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম স্বপ্নের দেশে।
স্বপ্ন ভাঙলো এক মিষ্টি কন্ঠ শুনে। "কেমন আছেন? " - এক মায়াবি কণ্ঠস্বর!
বসন্তে কোকিলের মিষ্টি সুর যেমন শীতে ঝিমিয়ে পরা প্রকৃতিকে জাগিয়ে তুলে এই কন্ঠস্বরও তেমন আমাকে জাগিয়ে তুললো।
পাশে তাকিয়ে দেখি সেই মেয়েটি।
- হ্যাঁ, ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
- ভালো আছি। আপনার কবিতাটা কি লেখা শেষ হয়েছে?
- শেষ হয়েছে কিনা জানিনা। যতটুকু মাথায় এসেছিল ততটুকু লেখা হয়েছে।
-আমাকে দেখানো যাবে?
নোটবুকটা এগিয়ে দিলাম। মেয়েটি মৃদু স্বরে পড়তে শুরু করলো -
.
ইট পাথরের সুউচ্চ ভবনের কোটরে কোটরে
কত স্বপ্ন ফুল হয়ে ফোটে,
কত স্বপ্ন আবার চাপা পড়ে যায়
শুকনো শহরের নির্জীব ঝঞ্ঝটে।
.
আকাশ ছোঁয়া অট্টালিকার ভারে
আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন গুলো ঝিমিয়ে পড়ে,
বেদনার বটবৃক্ষ শাখা-প্রশাখা ছড়ায়
কত মানুষের অন্তরে অন্তরে।
.
এই নিষ্প্রাণ শহরে কত প্রাণের ছড়াছড়ি
চারিদিকে কত লোক!
এতো মানুষের ভিড়ে কোনো এক অবসরে
দেখেছিলাম তোমার দুটি চোখ।
.
ভাঙা দেয়ালের চির থেকে উকি দেয় সবুজ ঘাস
আমরাও তেমনি মরে মরে বাচি,
তবুও এই কঠিন শহরের কোনো এক প্রান্তে
তুমিও আছো, আমিও আছি।
.
কবিতা পড়া শেষ করে মেয়েটি বলল "বাহ, গ্রামের প্রকৃতি নিয়ে অনেক কবিতা পড়েছি কিন্তু শহর নিয়েও যে এতো ভালো কবিতা হতে পারে ভাবতে পারিনি।
আমি কিছু বলতে পারলাম না, শুধু একটু হাসলাম।
বারবার মেয়েটির চোখের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু সাহস পাচ্ছিলাম না। মায়াবী চোখ, বিড়ালের চোখের মতো। দেখলেই ভালোলাগে, তবুও দেখার সাহস পাচ্ছিলাম না।
মহিলা কলেজের কাছাকাছি চলে এসেছি। প্রতিদিনের যানজটে জড়ানো দীর্ঘ পথটাকে আজ খুব ছোট মনে হচ্ছে। মেয়েটি বললো "এবার আমার নামতে হবে। "
জিজ্ঞেস করলাম "তোমার নাম কি?"
"অনামিকা " মেয়েটি জবাব দিলো। আমি তার চোখের দিকে তাকালাম। অবাক করা সৌন্দর্য তার চোখে। মেয়েটি যেনো কিছু চাইছে। হয়তো আমার মতো সেও আরও কিছু কথা শুনতে চাইছিল।
'অনামিকা' নামটি মাথার মধ্যে খেলা করতে লাগলো।
পরে আমি 'অনামিকা' নাম নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলাম। ভেবেছিলাম তাকে উপহার দিবো। কিন্তু তারপর অনামিকার সাথে আমার আর দেখা হয়নি। কোনদিন হবে কিনা তাও জানিনা।
এই ব্যস্ত শহরে প্রতিদিন কত মানুষের সাথে দেখা হয়, কথা হয়, পরিচয় হয় আবার কত মানুষ হারিয়েও যায় কিন্তু সেই দুটি চোখ আজও অস্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠে মনের ক্যানভাসে।
তখন গুনগুন করে নিজের লেখা কবিতার লাইন গুলো আবৃত্তি করি -
.
এই নিষ্প্রাণ শহরে কত প্রাণের ছড়াছড়ি
চারিদিকে কত লোক!
এতো মানুষের ভিড়ে কোনো এক অবসরে
দেখেছিলাম তোমার দুটি চোখ।
.
ভাঙা দেয়ালের চির থেকে উকি দেয় সবুজ ঘাস
আমরাও তেমনি মরে মরে বাচি,
তবুও এই কঠিন শহরের কোনো এক প্রান্তে
তুমিও আছো, আমিও আছি।
হ্যাঁ, তুমিও আছো, আমিও আছি।
.....
..........
©somewhere in net ltd.