নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

দেশ , মানুষ

জীবনের সব কিছু আললাহর সন্তুষ্টির জন্য

আল মাহদী ফোর্স

কোরান ও নবী পরিবারের আঃ অনুসারী।

আল মাহদী ফোর্স › বিস্তারিত পোস্টঃ

হাদীসে সাকালাইন ও এর সাথে সাংঘর্ষিক বলে দাবি করা হাদীসসমূহের পর্যালোচনা

২০ শে জানুয়ারি, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৩৪

হাদীসে সাকালাইন ও এর সাথে সাংঘর্ষিক বলে দাবি করা হাদীসসমূহের পর্যালোচনা
সংকলন : মো. আশিফুর রহমান

ভূমিকা
রাসূলুল্লাহ্্ (সা.) বলেন : ‘আমি তোমাদের মাঝে দু’টি মূল্যবান জিনিস রেখে যাচ্ছি : আল্লাহর কিতাব এবং আমার বংশধর (ইতরাত), আমার আহলে বাইত; নিশ্চয়ই এ দু’টি কখনই বিচ্ছিন্ন হবে না যতক্ষণ না হাউসের নিকট (হাউসে কাউসারের নিকট) আমার কাছে উপস্থিত হয় (কিয়ামত দিবসে)।’ নাসায়ী, আহমাদ, খাসায়িস, পৃ. ১১২, হাদীস ৭৮; ইবনে মাগাযিলী, মানাকিব, পৃ. ২৩০, হাদীস ২৮৩; আবু ইয়ালী, মুসনাদ, ২য় খ-, পৃ. ২৯৭, হাদীস ১০২১; ইবনে আবি আসিম, কিতাবুস সুন্নাহ, পৃ. ৬৩০, হাদীস ১৫৫৫; ইবনে হাম্বাল, মুসনাদ, ১৭তম খ-, পৃ. ২১১, হাদীস ১১১৩১; তাবারানী, সুলাইমান, ৫ম খ-, পৃ. ১৬৯, হাদীস ৯৮০ ও ৪৯৮১।
মহানবী (সা.) বলেন : ‘নিশ্চয়ই আমি দু’টি মূল্যবান ও ভারী বস্তু তোমাদের মধ্যে রেখে যাচ্ছি, যদি তোমরা সে দু’টিকে আঁকড়ে ধর কখনও বিভ্রান্ত হবে না, (তা হল) আল্লাহরকিতাব ও আমার বংশধর, নিকটাত্মীয় এবং এ দু’টি আমার সঙ্গে হাউজে কাউসারে মিলিত হওয়া পর্যন্ত পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না।’*
রাসূলুল্লাহ্্ (সা.)-এর এ হাদীসটি ‘হাদীসে সাকালাইন’ বা দু’টি মূল্যবান জিনিসের হাদীস নামে প্রসিদ্ধ। এ হাদীসের অনুসরণ থেকে দূরে সরে যাওয়ার ফলে গত চৌদ্দ শতাব্দী যাবৎ মুসলমানদের ওপর চরম বিপর্যয় নেমে আসে এবং এখনও তা অব্যাহত রয়েছে।
যদি পবিত্র কুরআনের শিক্ষার সাথে জনগণ কর্তৃক মেনে চলা জনপ্রিয় বিধিবিধান ও মূল্যবোধসমূহের তুলনা করা হয় তাহলে যে কারও কাছেই কুরআনের সাথে বিচ্ছিন্নতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। নিশ্চিতভাবেই কুরআনের বাণী ও চেতনার সাথে মুসলিম সমাজ কর্তৃক মেনে চলা বিধানের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে; বিগত কয়েক শতাব্দীতে পাশ্চাত্যের প্রভাবে প্রভাবিত হওয়া এবং মুসলিম দেশগুলোর শাসন কর্তৃত্ব অত্যাচারীদের হাতে চলে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত যে ব্যবধান কখনই এতটা ব্যাপক ছিল না।
কারও কাছে মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইতের বিচ্ছিন্নতা স্পষ্ট হয়ে যাবে যখন তারা ইতিহাসে অধ্যয়ন করবে যে, কীভাবে বনু উমাইয়্যা ও বনু আব্বাসের সময় মহানবীর পরিবারের ইমামগণকে জনগণ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল! এর ফলে পবিত্র কুরআনের সঠিক ব্যাখ্যাদাতা এবং এর সংরক্ষকদের-মহানবী (সা.)-এর ভাষ্যমতে যাঁদেরকে সময়ের স্রোত কিয়ামত পর্যন্ত কুরআন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না চরম নযরদারির মধ্যে রাখা হতো, তাঁদেরকে নির্বাসনে পাঠানো হতো, বন্দি করা হতো, বিষ প্রয়োগে ও অন্যান্যভাবে হত্যা করা হতো। আর মানুষকে তাঁদের দিকনির্দেশনা ও নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত করা হতো।
আহলে বাইতকে কোণঠাসা করার মাধ্যমে অত্যাচারী শাসকরা কুরআনকে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার এবং নিজেদের অনৈসলামিক শাসন ব্যবস্থাকে জায়েয করার হাতিয়ারে পরিণত করে। যে কুরআন নাযিল হয়েছিল মানুষের বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক জীবনকে সমুন্নত এবং পৃথিবীতে ঐশী ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য তা থেকে অত্যাচারী শাসকরা ইসলামকে একটি অবর্ণনীয় বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দেয়।
বর্তমানে আমেরিকা লক্ষ-কোটি ডলার দিয়ে প্রকৃত ইসলামের বিরুদ্ধে যেভাবে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এ কাজটিই অত্যাচারী উমাইয়্যা ও আব্বাসী শাসকরা তাদের সময়ে করেছিল। তারা ইসলামের প্রকৃত ব্যাখ্যাকারীদের সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল এবং ইসলামের অন্য একটি রূপ প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু তারা যত চেষ্টাই করুক না কেন, আহলে বাইত সম্পর্কিত রাসূলুল্লাহ্্ (সা.)-এর উক্তিকে মুছে ফেলতে পারেনি এবং কুরআনের সাথে আহলে বাইতের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের হাদীস ও অন্যান্য হাদীস গোপন করতে পারেনি।
বিগত চৌদ্দ শতাব্দী ধরে প্রতিটি যুগে অসংখ্য সুন্নী ও শিয়া হাদীস বিশারদ ও পন্ডিত কর্তৃক এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্্ (সা.)-এর সাহাবীদের সময় থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত প্রতিটি যুগে নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত বর্ণনাকারী এবং ইসলামের ইতিহাসের অনেক বড় ও নেতৃস্থানীয় পন্ডিত এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
এটি উল্লেখ করা খুবই প্রয়োজনীয় যে, হাদীসে সাকালাইন একটি মুতাওয়াতির হাদীস। সুন্নী উৎসসমূহের মধ্যে সিহাহ সিত্তাহসহ অন্যান্য গ্রন্থে এটি রাসূলুল্লাহ্্ (সা.)-এর নিকট থেকে শব্দগত কিছু পার্থক্যসহ বিভিন্ন উপলক্ষে বর্ণনা করা হয়েছে। এটি মানুষের জন্য একটি নিশ্চিত প্রমাণ, বিশেষ করে মাজহাব নির্বিশেষে সকল মুসলমানের জন্য। আর প্রত্যেক মুসলমানকে এ সম্পর্কে মহান আল্লাহর
কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এ সম্পর্কে কোন অজুহাতই গ্রহণযোগ্য হবে না।

তাওয়াতুরের অর্থ

আমরা জানি যে, মহানবী (সা.)-এর হাদীসসমূহ হাদীসের গ্রন্থাদিতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল বর্ণনাকারীদের ধারাবাহিকতা (সনদ) বজায় রেখে। হাদীসশাস্ত্রবিদগণ হাদীসের সনদের নির্ভরযোগ্যতা যাচাই এবং হাদীসের বিষয়বস্তুর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বিভিন্ন শর্ত নির্ধারণ করেছেন। তাঁরা হাদীসের বৈশিষ্ট্য, এর বর্ণনাকারীদের শক্তিশালী ও দুর্বল হওয়া এবং অন্যান্য কারণের ওপর নির্ভর করে এ বিষয়ে বিভিন্ন পরিভাষা তৈরি করেছেন। যেমন মুতাওয়াতির, খবরে ওয়াহেদ, সহীহ, হাসান, কাভী, যাইফ ইত্যাদি।
তাওয়াতুর অর্থ হল কোন একটি তথ্যের ক্ষেত্রে উৎসের প্রাচুর্য বা সংখ্যাধিক্যÑ যা কোন শ্রোতাকে সেই তথ্যের ব্যাপারে নিশ্চয়তা প্রদান করে। দূরবর্তী কোন দেশ বা শহর এবং ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব, যেমন সাইরাস বা নেপোলিয়ান এর অস্তিত্ব সম্পর্কিত কারও জ্ঞানের ক্ষেত্রে বলা যায় যে, এসব জ্ঞান তাওয়াতুর বর্ণনার ওপর ভিত্তিশীল। এভাবেই সমসাময়িক কোন বিষয়ের জ্ঞানও এ পর্যায়ভুক্ত যদি কোন ব্যক্তি তা নাও দেখে থাকে।
একটি মুতাওয়াতির হাদীস হল সেটিই যা অনেকগুলো ধারায় বর্ণিত হয়েছে এবং প্রতি যুগে এসব বর্ণনাকারীর কোনভাবেই একত্র হয়ে কোন হাদীস জাল করার ক্ষেত্রে সম্মত হওয়া সম্ভব নয়। যদিও কতিপয় হাদীসশাস্ত্রবিদ বর্ণনাকারীদের সংখ্যা নির্দিষ্ট করেছেন, যেমন পাঁচ, সাত অথবা দশ, কিন্তু সাধারণভাবে এ ক্ষেত্রে কোন সংখ্যাকে নির্দিষ্ট করা হয়নি এবং বর্ণনাকারীর যে সংখ্যা শ্রোতার কাছে নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠিত করতে পারে তা নির্ভর করে শ্রোতার অভিজ্ঞতার ওপর।
ইসলামী আইনশাস্ত্র কোন হাদীসের মুতাওয়াতির হওয়ার ক্ষেত্রে কতিপয় শর্ত নির্ধারণ করেছে। আল-গাযযালী তাঁর ‘আল-মুসতাসফা মিন ইল্ম আল-উসূল গ্রন্থে নিম্নলিখিত শর্ত উল্লেখ করেছেন যার কয়েকটি হল :
১. রাবী তাঁর জ্ঞানের (ইল্ম) ভিত্তিতে হাদীস বর্ণনা করবেন এবং তাঁর ধারণার (যান্ন) ওপর নির্ভর করবেন না।
২. তাঁদের জ্ঞান ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অর্জিত হবে হবে।
৩. বর্ণনাকারীদের সংখ্যা এ পরিমাণ হতে হবে যাতে নিশ্চয়তা অর্জিত হয়।
৪. হাদীস বর্ণনার ধারাবাহিকতায় সকল ক্ষেত্রে প্রথম দু’টি শর্ত পূরণ করতে হবে এবং প্রতি পর্যায়ে বর্ণনাকারীদের সংখ্যার ক্ষেত্রে তৃতীয় শর্তটি পূরণ করতে হবে।
‘মাআলিম আল-উসূল’ গ্রন্থের প্রণেতা শিয়া পন্ডিত আশ-শাইখ আল-হাসান ইবনে যাইন আল-দীন তাওয়াতুরের ক্ষেত্রে একই ধরনের শর্তের কথা উল্লেখ করেছেন। দেখা যাচ্ছে যে, এ ক্ষেত্রে বর্ণনাকারীর ন্যায়পরায়ণ হওয়ার শর্ত প্রয়োজন হয় না অথবা তাঁদের বিশ্বস্ত হওয়ারও প্রয়োজন নেই যখন তাওয়াতুরের শর্ত পূরণ হয়ে যায়; বরং আল- গায্্যালী সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, এমন ক্ষেত্রে এমনকি ফাসেক বর্ণনাকারীর নিকট থেকেও জ্ঞান অর্জিত হয়। ‘মাআলিম’ এর প্রণেতা মুতাওয়াতির বর্ণনার জন্য দু’টি শর্ত উল্লেখ করেছেন :
১. শ্রোতার এ ব্যাপারে পূর্বে কোন জ্ঞান থাকবে না। কারণ, এটি সম্ভব নয় যে, যে ব্যক্তি কোন একটি বিষয় জানে সে একই বিষয় আবারও জানবে।
২. শ্রোতা তার বিশ্বাসের ক্ষেত্রে কোনরূপ সন্দেহ বা আনুগত্য দ্বারা বাধাগ্রস্ত হবে না; তাহলে সেই তথ্য তার ওপর প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হবে।

কিছু সংখ্যক সহীহ বর্ণনা

হাদীসে সাকালাইন একটি মুতাওয়াতির হাদীস যা কেবল সুন্নী উৎসসমূহেই অনেক সূত্রে মুতাওয়াতিরভাবে বর্ণিত হয়েছে। আমরা যদি এর সাথে তাওয়াতুরভাবে আহলে বাইতের সূত্রের বর্ণনাগুলো যোগ করি তাহলে এর মোট বর্ণনাকারীর সংখ্যা একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ হয়ে যাবে।
হাদীসটি বেশ কয়েকটি সহীহ সূত্রেও বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ এসব বর্ণনার ধারাবাহিকতায় বর্ণনাকারীরা সকলেই বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য (সিকাহ্্) বলে গণ্য। এসবের মধ্য থেকে মুসলিম ও হাকিম নিশাবুরী কর্তৃক সংকলিত চারটি সহীহ সূত্র নিচে উল্লেখ করা হল :
(মুসলিম বলেন , যুহাইর ইবনে র্হাব এবং সূজা ইবনে মাখলাদ আমার কাছে উলাইয়াহ্্ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, (যুহাইর বলেন), ইসমাঈল ইবনে ইবরাহীম আমাদের কাছে বর্ণনা করেন আবু হাইয়্যান থেকে, তিনি ইয়াযীদ ইবনে হাইয়্যান থেকে যে, ‘হুসাইন ইবনে সাবরাহ্্, উমার ইবনে মুসলিম এবং আমি যায়েদ ইবনে আরকামকে দেখতে গিয়েছিলাম। যখন আমরা তাঁর নিকট বসলাম তখন হুসাইন তাঁকে বললেন, ‘হে যায়েদ! আপনি তো অনেক কল্যাণ লাভ করেছেন। আপনি আল্লাহ্্র রাসূল (সা.)-কে দেখেছেন, তাঁর কথা শুনেছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর সাথে থেকে লড়াই করেছেন এবং তাঁর পেছনে নামায পড়েছেন। নিশ্চয়ই, হে যায়েদ! আপনি অনেক কল্যাণ লাভ করেছেন। রাসূলুল্লাহ্্ (সা.)-এর নিকট থেকে যা শুনেছেন তা আমাদের নিকট বর্ণনা করুন।’
যায়েদ বললেন : ‘হে আমার ভাতিজা! আল্লাহ্্র কসম। আমি বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছে গেছি, আমার আয়ুষ্কাল অনেক হয়েছে। তাই কিছু কিছু কথা যা রাসূলুল্লাহ্্ (সা.)-এর নিকট থেকে শুনে মনে রেখেছিলাম, তা ভুলে গেছি। সুতরাং আমি তোমাদের নিকট যা বর্ণনা করি তা সাদরে গ্রহণ কর এবং আমি যা বর্ণনা করি না তার জন্য আমাকে বাধ্য কর না।’ অতঃপর তিনি বললেন : ‘একদিন রাসূলুল্লাহ্্ (সা.) মক্কা ও মদীনার মাঝখানে অবস্থিত ‘খুম’ নামক জলাশয়ের নিকট আমাদের সামনে ভাষণ দিচ্ছিলেন। তিনি আল্লাহর প্রশংসা করলেন এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন এবং উপদেশ দিলেন। অতঃপর তিনি বললেন : হে লোকসকল! আমি তো মানুষই। অচিরেই আমার প্রভুর তরফ থেকে দূত এসে যাবে, আর আমি তাঁর ডাকে (মৃত্যুর আহ্বানে) সাড়া দিব। আমি তোমাদের মাঝে দু’টি ভারী (মূল্যবান) বস্তু (সাকালাইন) রেখে যাচ্ছি। (এ দু’টির) প্রথমটি হলো আল্লাহর কিতাব (কুরআন) যা হেদায়াত ও নূরে পরিপূর্ণ। অতএব, তোমরা আল্লাহ্্র কিতাবকে ধারণ কর এবং মজবুত করে আঁকড়ে ধর। তারপর তিনি আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে (আমাদের) উদ্বুদ্ধ করলেন ও উৎসাহ প্রদান করলেন। অতঃপর বললেন : আর (দ্বিতীয়ত) আমার আহলে বাইত (পরিবার)। আমার আহলে বাইত সম্পর্কে আমি তোমাদেরকে আল্লাহ্র কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। আমার আহলে বাইত সম্পর্কে আমি তোমাদেরকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। আমার আহলে বাইত সম্পর্কে আমি তোমাদেরকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি।...’
[সহীহ মুসলিম, ৭ম খ-, ফাযায়েলে সাহাবা অধ্যায় (মাকতাবাত ওয়া মাতবা‘আতÑ মুহাম্মাদ আলী সুবাইহ ওয়া আউলাদুহু : কায়রো), পৃ. ১২২-১২৩]
একই সূত্রে আহমাদ ইবনে হাম্বাল হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এ হাদীসটিও সহীহ সূত্রে বর্ণিত এ কারণে যে, বর্ণনাকারীরা সকলেই মুসলিমেরও বর্ণনাকারী। (মুসনাদে আহমাদ, ৩২তম খ-, পৃ.৫৬, হাদীস ১৯২৬৬)
আলবানী তাঁর সহীহ সুনানুত তিরমিজীর গবেষণা গ্রন্থের টীকা (৩য় খ-, পৃ.৪৭৬ ও ৫৪৩), সিলসিলাতুল আহাদিসুস সাহিহা (৪র্থ খ-, পৃ.৩৫৬-৩৫৭) ও সাহিহু আল জামেয়ুস সাগীর (১ম খ-, পৃ.৪৮২) গ্রন্থে হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। শুয়াইব ‘আরনাউত সুনানুত তিরমিযী’ (৬ষ্ঠ খ-, প্র.২৩৭) ও ‘মুশুকিলুল আসার’ (তাহাভী রচিত) গ্রন্থের শারহে (৫ম খ-, পৃ. ১৮-১৯) এবং কাসতালানী তাঁর ‘আল মাতালিবুল আলীয়া’ গ্রন্থেও (১৬তম খ-, পৃ.১৪২) হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
(হাকিম বলেন, বাগদাদে আমাদের কাছে আবুল হুসাইন মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ ইবনে তামিম আল-হানযালী বর্ণনা করেন, তিনি আবু কাল্লাবাহ আবদুল মালিক ইবনে মুহাম্মাদ আল রাক্কাশী থেকে, তিনি ইয়াহইয়া ইবনে হাম্মাদ থেকে; আমার কাছে আরও বর্ণনা করেছেন আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনে বালাওয়াইহ এবং আবু বকর আহমাদ ইবনে জাফর আল-বাযযায, তাঁরা উভয়েই আবদুল্লাহ্্ ইবনে আহমাদ ইবনে হাম্বাল থেকে, তিনি তাঁর পিতা থেকে, তিনি ইয়াহইয়া ইবনে হাম্মাদ থেকে; এবং আমাদের কাছে আরও বর্ণনা করেছেন বুখারার ফকীহ আবু নাসর আহমাদ ইবনে সুহাইল থেকে, তিনি সালিহ ইবনে মুহাম্মাদ থেকে যিনি বাগদাদের হাফিয, তিনি খালাফ ইবনে সালিম আল-মাখরামী থেকে, তিনি ইয়াহইয়া ইবনে হাম্মাদ থেকে; এবং ইয়াহইয়া ইবনে হাম্মাদ বর্ণনা করেছেন আবু উয়াইনাহ থেকে, তিনি সুলাইমান আল-আমাশ থেকে, তিনি হাবিব ইবনে আবি সাবিত থেকে, তিনি আবু আল-তুফাইল থেকে, তিনি যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) থেকে, যিনি বলেন : ‘রাসূলুল্লাহ্্ (সা.) যখন তাঁর বিদায় হজ্ব থেকে প্রত্যাবর্তন করছিলেন তখন গাদীরে খুমে অবতরণ করলেন এবং গাছগুলোর নিচে সমবেত হওয়ার আদেশ দিলেন। সেগুলোর নিচে পরিষ্কার করা হল। তারপর তিনি বললেন : ‘আমি (মৃত্যুর) আহ্বানে সাড়া দিতে যাচ্ছি। নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মাঝে দু’টি মূল্যবান জিনিস রেখে গেলাম, যার একটি অপরটি অপেক্ষা বৃহৎ। মহান আল্লাহ্্র কিতাব এবং আমার ইতরাত (আহলে বাইত)। তাই লক্ষ্য রেখ, আমার পরে এ দুয়ের সাথে তোমরা কেমন আচরণ কর; নিশ্চয়ই হাউসে আমার কাছে ফিরে আসা পর্যন্ত তারা একে অপর থেকে কখনই বিচ্ছিন্ন হবে না।’ তারপর তিনি বলেন : ‘নিশ্চয়ই সর্বশক্তিমান ও মহিমান্বিত আল্লাহ্্ আমার অভিভাবক (মাওলা) এবং আমি প্রত্যেক মুমিনের অভিভাবক।’ তারপর তিনি আলী (রা.)-এর হাত ধরলেন এবং বললেন : ‘আমি যার অভিভাবক, এ (আলী) তার অভিভাবক। হে আল্লাহ্্! যে তাকে ভালবাসে, তুমি তাকে ভালবাস এবং যে তার সাথে শত্রুতা করে তুমি তার শত্রু হও।’
(হাকিম আরও যুক্ত করেন ‘এ হাদীসটি শাইখাইন (বুখারী ও মুসলিম) কর্তৃক সহীহ হওয়ার শর্তের ভিত্তিতে সহীহ, যদিও তাঁরা এ হাদীসটি পুরোপুরি বর্ণনা করেননি।’
(হাকিম বলেন প্রথম হাদীসটি (উপরোল্লিখিত) নিচের হাদীস দ্বারা সমর্থিত যা বর্ণিত হয়েছে সালামাহ ইবনে কুহাইল থেকে, তিন আবু আল-তুফাইল থেকে। আর এটিও বুখারী ও মুসলিমের দৃষ্টিকোণ থেকে সহীহ। আমাদের কাছে আবু বকর ইবনে ইসহাক এবং দালায ইবনে আহমাদ ইবনে সিজ্জী বর্ণনা করেন, তাঁরা উভয়েই মুহাম্মাদ ইবনে আইউব থেকে, তিনি আল-আযরাক ইবনে আলী থেকে, তিনি হাসান ইবনে ইবরাহীম আল-কিরমানী থেকে, তিনি মুহাম্মাদ ইবনে সালামাহ্্ ইবনে কুহাইল থেকে, তিনি তাঁর পিতা থেকে, তিনি আবু আল-তুফাইল থেকে, তিনি ইবনে ওয়াসিলা থেকে, যিনি যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.)-কে বলতে শুনেছেন : ‘রাসূলুল্লাহ্্ (সা.) মক্কা ও মদীনার মধ্যে পাঁচটি গাছঘেরা ছায়াময় একটি স্থানে অবতরণ করেন। লোকেরা গাছের নিচে পরিষ্কার করে। রাসূলুল্লাহ্্ (সা.) সন্ধ্যার নামায আদায় করেন। নামাযের পর তিনি লোকদের উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি মহান আল্লাহ্্র প্রশংসা করেন, উপদেশ দেন এবং স্মরণ করিয়ে দেন এবং আল্লাহ্্ তাঁকে যা বলতে আদশে করেছেন তা বলেন। তারপর তিনি বলেন : ‘হে লোকসকল! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মাঝে দু’টি মূল্যবান বিষয় (আমরাইন) রেখে যাচ্ছি, যদি তোমরা সে দু’টিকে অনুসরণ কর, তোমরা কখনই বিপথগামী হবে না। এ দু’টি হলো : আল্লাহ্্র কিতাব এবং আমার আহলে বাইত, আমার ইতরাত।’ তারপর তিনি তিনবার বলেন : ‘তোমরা কি জান যে, মুমিনদের নিজেদের অপেক্ষা আমি তাদের ওপর অধিক অধিকার রাখি?’ জনগণ বলে : ‘হ্যাঁ।’ তারপর রাসূলুল্লাহ্্ (সা.) বলেন : ‘আমি যার অভিভাবক, আলীও তার অভিভাবক।’
[আল-ইমাম আল-হাফিয আবু আবদুল্লাহ্্ আল-হাকিম আন-নিশাবুরি, আল-মুসতাদরাক আলাস সাহীহাইন (দারুল মারিফাহ লি আল-তিবাহ ওয়া আন-নাশ্্র, বৈরুত), ৩য় খ-, পৃ. ১০৯-১১০]
(আল-হাকিম বলেন আমাদের কাছে রাইয়ের ফকীহ আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনে হুসাইন ইবনে মুসলিম বর্ণনা করেছেন, তিনি ইয়াহইয়া ইবনে আল-মুগীরাহ আল-সাদী থেকে, তিনি জারীর ইবনে আবদুল হামিদ থেকে, তিনি আল-হাসান ইবনে আবদুল্লাহ্্ আন-নাখায়ী থেকে, তিনি মুসলিম ইবনে সুবাইহ থেকে, তিনি যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) থেকে, যিনি বলেন : ‘রাসূলুল্লাহ্্ (সা.) বলেন : নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মাঝে দু’টি মূল্যবান জিনিস রেখে যাচ্ছি : আল্লাহ্্্র কিতাব এবং আমার আহলে বাইত। নিশ্চয়ই এ দু’টি আমার কাছে হাউসের পাশে ফিরে আসা পর্যন্ত কখনই বিচ্ছিন্ন হবে না।’
(আল-হাকিম বলেন ‘এ হাদীসটি শাইখাইনের (বুখারী ও মুসলিমের) সনদ গ্রহণের শর্তে সহীহ, যদিও তাঁরা এটি লিপিবদ্ধ করেননি।’ (আল-হাকিম, প্রাগুক্ত, ৩য় খ-, পৃ. ১৪৮)
এগুলো হলো যায়েদ ইবনে আরকাম কর্তৃক চারটি পৃথক সূত্রে বর্ণিত হাদীস। তাঁদের নির্ভরযোগ্যতা হাদীসশাস্ত্রের দু’জন বিখ্যাত ইমাম কর্তৃক নিশ্চিত করা হয়েছে।

হাদীসে সাকালাইন

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রতিটি যুগে বিপুল সংখ্যক বর্ণনাকারী ও নেতৃস্থানীয় আলেম হাদীসে সাকালাইন বর্ণনা করেছেন। এগুলো বিভিন্ন তাফসীর, হাদীস ও ইতিহাস গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। আমরা এখানে সেখান থেকে কয়েকটি মাত্র তুলে ধরব। তার মধ্যে সাহাবী বর্ণনাকারীদের বিষয়টি বিশদভাবে তুলে ধরা হলো।

সাহাবী বর্ণনাকারী

রাসূলুল্লাহ্্ (সা.)-এর সাহাবীদের মধ্য থেকে ত্রিশেরও অধিক সাহাবী হাদীসে সাকালাইন বর্ণনা করেছেন। তাঁদের নামের পাশাপাশি যেসব লেখক তাঁদের গ্রন্থে হাদীসটি লিপিবদ্ধ করেছেন তা নিচে দেওয়া হল :
১. হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) (শাহাদাত ৪০ হি./ ৬৬১ খ্রি.)
ক. আবু বকর আহমাদ ইবনে আবদুল খালিক আল-বাযযায
খ. আবু জাফর মুহাম্মাদ ইবনে জারীর আত-তাবারী
গ. শাম্্স আল-দীন আল-শাখাভী
ঘ. জালালুদ্দীন আস-সুয়ূতি
ঙ. নুরুল দীন আশ-শামহুদী
চ. আল-মুত্তাকী আল-হিন্দী
ছ. আহমাদ ইবনে আল ফাযল ইবনে মুহাম্মাদ বা কাসীর আল-মাক্কী
জ. সুলায়মান ইবনে ইবরাহীম আল-কুন্দুজী
২. ইমাম হাসান ইবনে আলী (৩-৫০ হি./ ৬২৪-৬৭০ খ্রি.)
ক. আল-কুন্দুজী
৩. সালমান আল-ফারসি (মৃ. ৩৬ হি./ ৬৫৬ খ্রি.)
ক. আল কুন্দুজী
৪. জুন্দাব ইবনে জুনাদাহ, আবু যার আল-গিফারী (মৃ. ৩২ হি./ ৬৫০ খ্রি.)
ক. মুহাম্মাদ ইবনে ঈসা আত-তিরমিযী
খ. ইবনে উকদাহ
গ. ইবনে কাসীর
ঘ. সাখাভী
ঙ. সামহুদী
৫. আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (৩ হিজরি-পূর্ব-৬৮/ ৬১৯-৬৮৭ খ্রি.)
ক. সুলায়মান ইবনে ইবরাহীম আল-কুন্দুজী
৬. সা’দ ইবনে মালিক, আবু সাইদ আল-খুদরী (১০ হিজরি-পূর্ব-৭৪/ ৬১৩-৬৯৩ খ্রি.)
ক. মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক আল-মাদানী
খ. আবদুর রহমান আল-মাসউদী
গ. ইবনে সা’দ আল-যুহরী
ঘ. আহমাদ ইবনে হাম্বাল
ঙ. আবু জাফর আত-তাবারী
চ. আবুল কাসিম আল-তাবারানী
ছ. আবু তাহির আল-যাহাবী
ঞ. ইবনে আবদুল বার
ট. ফাখ্্র আল-দীন রাযী
ঠ. ইবনে কাসীর আল-দিমাশকী
ঢ. জালালুদ্দীন আস-সুয়ূতি
ণ. শিহাব আল-দীন আল-কাসতালানী
ত. আলী আল-কারী আল-হিন্দী
থ. মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল বাকী আল-যারকানী
দ. সুলায়মান ইবনে ইবরাহীম আল-কুন্দুজী এবং অন্যান্য
৭. জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্্ আল-আনসারী (১৬ হিজরি-পূর্ব-৭৮/ ৬০৭-৬৯৭ খ্রি.)
ক. আল-তিরমিযী
খ. আন-নাসায়ী
গ. আল-খাতীব আল-বাগদাদী
ঘ. আবু বকর আল-বাগাভী
ঙ. ইবনে কাসীর দামিশকী
চ. জালালুদ্দীন আস-সুয়ূতি
ছ. নুরুল দীন আল-সামহুদী
জ. আলী আল-কারী আল-হিন্দী
ঝ. আল-মির্যা হাসান আলী মুহাদ্দিস আল-লাখনাভী
ঞ. আল-শাইখ সুলায়মান আল-কুন্দুজী
ট. আল-সিদ্দীক হাসান খান আল-কনৌওযী
৮. আবু হাইসাম মালিক ইবনে তাইহান (মৃ. ২০ হি./ ৬৪১ খ্রি.)
ক. শাম্স আল-দীন আশ-শাওকানী
খ. নুরু আল-দীন আশ শামহুদী
গ. সুলায়মান আল-কুন্দুজী
৯. ইবরাহীম আবু রাফে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অন্যতম খাদেম (মৃ. ৪০ হি./ ৬৬১ খ্রি.)
ক. ইবনে উকদাহ
খ. আল শাওকানী
গ. আল শামহুদী
ঘ. আল কুন্দুজী
১০. হুযায়ফা ইবনে ইয়ামান (মৃ. ৩৬ হি./ ৬৫৬ খ্রি.)
ক. শেখ সুলায়মান ইবনে ইবরাহীম আল কুন্দুজী
১১. হুযায়ফাহ ইবনে উসাইদ আল গিফারী
ক. আবু ঈসা আল তিরমিযী
খ. আল হাকিম
গ. আবুল কাসিম তাবারানী
ঘ. আবু নাঈম ইসফাহানী
ঙ. আবুল কাসিম ইবনে আসির
চ. ইবনে কাসির দামিশকী
ছ. শাম্্স আল দীন শাখাভী
১২. খুযায়মা ইবনে সাবিত যু শাহাদাতাইন (মৃ. ৩৭ হি./ ৬৫৭ খ্রি.)
ক. আবুল আব্বাস আল উকদা
খ. শাম্স আল দীন আল সাখাভী
গ. নূর আল দীন আল সামহুদী
ঘ. আহমাদ ইবনে ফযল ইবনে বা কাসির
ঙ. আল শেখ সুলায়মান আল কুন্দুজী
১৩. যায়েদ ইবনে সাবিত (মৃ. ৪৫ হি./ ৬৬৫ খ্রি.)
ক. মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক
খ. আহমাদ ইবনে হাম্বল
গ. আবু জাফর তাবারী
ঘ. আবুল কাসিম আত তাবারানী
ঙ. আবু আবদুল্লাহ আল গাঞ্জী শাফেয়ী
চ. জালালুদ্দীন সুয়ূতী
ছ. আলী আল কারী আল হিন্দী
জ. সুলায়মান ইবনে ইবরাহীম আল কুন্দুজী
১৪. আবু হুরায়রা, আবদুর রহমান ইবনে সাখ্্র (মৃ. ৫৯ হি./ ৬৭৯ খ্রি.)
ক. আবু বকর আল বায্যায
খ. শাম্স আল দীন আল সাখাভী
গ. জালালুদ্দীন সুয়ূতী
ঘ. নূরুদ্দীন আল সামহুদী
১৫. আবদুল্লাহ ইবনে হান্্তাব
ক. আবুল কাসিম তাবারানী
খ. আলী ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আসির
গ. জালালুদ্দীন সুয়ূতী
১৬. যুবায়ের ইবনে মুতঈম (মৃ. ৫৯ হি./ ৬৭৯ খ্রি.)
ক. আবু নাঈম ইসফাহানী
খ. শেখ সুলায়মান আল কুন্দুজী
১৭. বাররা ইবনে আযীব (মৃ. ৭১ হি./ ৬৯০ খ্রি.)
ক. আবু নাঈম ইসফাহানী
১৮. আনাস ইবনে মালিক (মৃ. ৯৩ হি./ ৭১২ খ্রি.)
ক. আবু নুয়াইম আল ইসফাহানী
১৯. তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ আত তায়মী (মৃ. ৩৬ হি./ ৬৫৬ খ্রি.)
ক. শেখ সুলায়মান আল কুন্দুজী
২০. আবদুর রহমান ইবনে আউফ (মৃ. ৩২ হি./ ৬৫২ খ্রি.)
ক. আল কুন্দুজী
২১. সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (মৃ. ৫৫ হি./ ৬৭৫ খ্রি.)
ক. আল কুন্দুজী
২২. আম্্র ইবনুল আস (মৃ. ৫০ হি./ ৬৬৪)
ক. আল মুওয়াফ্ফাক ইবনে আহমাদ আল খারাযমী
২৩. সাহল ইবনে সা’দ আল আনসারী (মৃ. ৯১ হি./ ৭১০ খ্রি.)
খ. শাম্স আল দীন আস সাখাভী
গ. নূরুদ্দীন আস সামহুদী
ঘ. সুলায়মান কুন্দুজী
২৪. আদী ইবনে হাতেম (মৃ. ৬৮ হি./ ৬৮৭ খ্রি.)
২৫. উকবাহ ইবনে আমীর (মৃ. ৫৮ হি./ ৬৭৮ খ্রি.)
২৬. আবু আইউব আনসারী, খালিদ ইবনে যায়েদ (মৃ. ৫২ হি./ ৬৭২ খ্রি.)
২৭. আবু সুরাইহ আল খুযায়ী, খুওয়াইলিদ ইবনে আম্র (মৃ. ৬৮ হি./ ৬৮৭ খ্রি.)
২৮. আবু কুদামাহ, আল আনসারী (শহীদ ৩৭ হি./ খ্রি. ৬৫৭)
২৯. আবু লায়লা আল আনসারী (শহীদ ৩৭ হি./ খ্রি. ৬৫৭ খ্রি.)
৩০. উমায়রাহ আল আসলামী
(২৪-৩০ নং পর্যন্ত সাহাবীদের বর্ণনা নিচের গ্রন্থাবলীতে এসেছে)
ক. ইবনে উকদা
খ. আল সাখাভী
গ. আল সামহুদী
ঘ. আল কুন্দুজী
৩১. আম্র ইবনে লায়লা ইবনে দামরাহ
ক. ইবনে হাজার আল আসকালানী
খ. শাম্স আল দনি আল সাখাভী
গ. নূর আল দীন আল সামহুদী
ঘ. আল কুন্দুজী
৩২. যায়েদ ইবনে আরকাম (মৃ. ৬৮ হি./ ৬৮৭ খ্রি.)
ক. আন নাসাঈ
খ. আল হাকিম
গ. আল তাবারানী
ঘ. আলী আল মুত্তাকী আল হিন্দী
ঙ. আল সামহুদী
৩৩. আবদুল্লাহ ইবনে উমর (মৃ. ৭৩ হি./ ৬৯২ খ্রি.)
৩৪. ফাতিমা যাহরা (আ.) (শাহাদাত ১১ হি./ ৬৩২ খ্রি.)
ক. শেখ সুলায়মান আল কুন্দুজী
৩৫. উম্মে সালামাহ, হিন্দ বিনতে সুহাইল (মৃ. ৬২ হি./ ৬৮১ খ্রি.)
ক. ইবনে উকদাহ
খ. আবুল হাসান আলী ইবনে উমর আল দারেকুতনী
গ. আস সাখাভী
ঘ. আস সামহুদী
৩৬. উম্মে হানী, ফাখতাব বিনতে আবি তালিব (মৃ. ৪০ হি./ ৬৬১ খ্রি.)
ক. ইবনে উকদাহ
খ. আস সাখাভী
গ. আস সামহুদী
তাবেয়ী বর্ণনাকারী
বিপুল সংখ্যক তাবেয়ী উপরিউক্ত সাহাবীদের একজন অথবা বহুজনের নিকট থেকে শুনে হাদীসে সাকালাইন বর্ণনা করেছেন। তাঁদের মধ্য থেকে মাত্র কয়েকজনের নাম নিচে উল্লেখ করা হলো :
৩৭. আবু তুফাইল আমীর ইবনে ওয়াসিলাহ আল লাইসী (মৃ. ১০০ হি./ ৭১৮ খ্রি.)
৩৮. আতিয়াহ ইবনে সা’দ আল আউফি
৪১. হাবিব ইবনে আবি সাবিত
৪২. আলী ইবনে রাবিআ
৪৩. আল কাসিম ইবনে হাসান
৪৬. ইয়াহইয়া ইবনে যুদাহ
৪৮. আল আসবাগ ইবনে নুবাতাহ
৪৯. আবদুল্লাহ ইবনে আবি রাফি
৫১. আবদুর রহমান ইবনে আবি সাঈদ আল খুদরী
৫৪. আল হাসান ইবনে হাসান ইবনে আবি তালিব
৫৫. যায়নুল আবেদীন, আলী ইবনুল হুসাইন (আ.)
৫৬. ইয়াযীদ ইবনে হাইয়্যান
হাদীসে সাকালাইনের অর্থ
অনেক হাদীস থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে, গাদীরে খুমে একটি ভাষণের মধ্যেই মহানবী (সা.) হাদীসে সাকালাইন ও হাদীসে গাদীরের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এসব হাদীসের কয়েকটি মুত্তাকী আল-হিন্দী তাঁর ‘কানজুল উম্মাল’ গ্রন্থে (১ম খ-, পৃ. ১৬৭), ইবনে কাসির তাঁর ‘তারীখ’ গ্রন্থে (৫ম খ-, পৃ. ২০৯), আস সাখাভী তাঁর ‘আল-ইসতিজলাব’ গ্রন্থে, আল সামহুদী তাঁর ‘জাওয়াহির আল ইকদাইন’ গ্রন্থে এবং ইবনে হাজার তাঁর ‘সাওয়ায়েক’ গ্রন্থে তাবারানী ও অন্যদের থেকে লিপিবদ্ধ করেছেন।
কতিপয় হাদীসে ‘খালিফাতাইন’ (উত্তরাধিকারী বা প্রতিনিধি) শব্দটি সাকালাইন শব্দের পরিবর্তে উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন আহমাদ ইবনে হাম্বাল তাঁর মুসনাদে (৫ম খ-, পৃ. ১৮১) উল্লেখ করেছেন। আবার তাবারানী, ইবনে আবি আসিম, আবু বকর ইবনে আবি শায়বাহ, আল-যারকানী এবং অন্যরাও উল্লেখ করেছেন। এই শব্দ ইমাম আলী (আ.) এবং আহলে বাইতের নেতৃত্ব ও খেলাফতের বিষয়টিকে সন্দেহাতীতভাবে প্রকাশ করে।
এ হাদীসের কতিপয় বর্ণনা, যেমন কুন্দুজী তাঁর ইয়া নাবি আল-মাওয়াদ্দাহতে হাসান ইবনে আলী (আ.) থেকে যে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন তাতে নবী (সা.)-এর বাণী রয়েছে যা ইমামতের চিরস্থায়িত্বের বিষয়টিতে গুরুত্ব আরোপ করেছে :
‘হে আল্লাহ্্! তুমি দুনিয়াকে সৃষ্টির ওপর তোমার হুজ্জাত থেকে খালি রেখ না যাতে তোমার হুজ্জাত বাতিল হয়ে যায় অথবা তুমি তাদের পথনির্দেশ দেওয়ার পর তোমার বন্ধুরা বিপথে যেতে না পারে। তারা (আল্লাহ্্্র হুজ্জাত) সংখ্যায় অল্প, কিন্তু সর্বশক্তিমান ও মহিমান্বিত আল্লাহ্্র নৈকট্যশীল। নিশ্চয়ই আমি প্রশংসিত ও মহান আল্লাহ্্র কাছে প্রার্থনা করেছিলাম পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত আমার বংশধরদের মধ্যে এবং আমার বংশধরদের বংশধরদের মধ্যে এবং আমার বীজের মধ্যে এবং আমার বীজের বীজের মধ্যে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দেওয়ার। আর আমার প্রার্থনা কবুল হয়েছে।’
এটি নাহজুল বালাগায় বর্ণিত (হিকাম : ১৪৭) আলী (আ.) কর্তৃক তাঁর শিষ্য কুমাইল ইবনে যিয়াদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ :
...হ্যাঁ, পৃথিবী কখনও এমন লোকশূন্য হয়ে যায় না যারা গোপনে বা প্রকাশ্যে আল্লাহর ওপর রক্ষা করে এবং তারা সব সময় শংকিত থাকে যে, আল্লাহর গুপ্ত ওজর ও প্রমাণ যেন অপ্রমাণিত না হয়। তাদের সংখ্যা কত, আর তারা কোথায়? আল্লাহর কসম, তাদের সংখ্যা কম, কিন্তু আল্লাহ্্র নিকট তাদের সম্মান অনেক বেশি। তাদের মাধ্যমে আল্লাহ্্ তাঁর ওজর ও প্রমাণ রক্ষা করেন যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তাদের মতো অপর কাউকে বিশ্বাস না করে এবং তাদের মতো অন্য কারও হৃদয়ে আস্থার বীজ বপন না করে।
জ্ঞান তাদেরকে সত্যিকার বোধগম্যতার দিকে চালিত করে এবং এ কারণে তারা দৃঢ় প্রত্যয়সম্পন্ন আত্মার সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করে। অন্যেরা যেটাকে কঠিন বলে মনে করে তা তারা সহজ বলে মনে করে। অজ্ঞরা যা বিস্ময়কর মনে করে, তারা তা সাদরে গ্রহণ করে। তারা এ পৃথিবীতে দেহ নিয়ে বসবাস করে, কিন্তু তাদের আত্মা অনেক ঊর্ধ্বে অবস্থান করে। আল্লাহর জমিনে তারা আল্লাহর প্রতিনিধি এবং তাঁর দীনের প্রতি আহ্বানকারী। আহা! তাদেরকে দেখার জন্য আমার আকুল আগ্রহ!
হযরত আলীর এ বক্তব্য অনেক হাদীসবেত্তা ও ঐতিহাসিক তাঁদের গ্রন্থাবলীতে উল্লেখ করেছেন। যেমন ইবনে আব্দ রাব্বিহ তাঁর ‘আল ইকদুল ফারীদ’ গ্রন্থে (১ম খ-, পৃ. ২৬৫, ২৯৩); ইয়াকুবী তাঁর ‘তারিখ’ গ্রন্থে (২য় খ-, পৃ. ৪০০); আল হাররানী তাঁর ‘তুহাফুল উকূল’ গ্রন্থে (পৃ. ১৬৯); আল খাতীব আল বাগদাদী তাঁর ‘তারীখে বাগদাদ’ গ্রন্থে (৬ষ্ঠ খ-, পৃ. ৩৮৯); আল রাযী তাঁর ‘তাফসীরে কাবীর’ গ্রন্থে (২য় খ-, পৃ. ১৯২); ইবনে আবদুল বার তাঁর ‘আল মুখতাসার’ গ্রন্থে (পৃ. ২৯) এ রেওয়ায়াতটি বর্ণনা করেছেন।
হাদীসে সাকালাইনের সাথে সাংঘর্ষিক বলে মনে হওয়া কতিপয় হাদীস
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শাহ আবদুল আযীয দেহলভী একটি গ্রন্থে (তোহফায়ে ইসনা আশারা) হাদীসে সাকালাইনের সাথে সাংঘর্ষিক কয়েকটি হাদীস উপস্থাপন করে হাদীসে সাকালাইনের ঘোষিত আহলে বাইতের নেতৃত্বের বিষয়টিকে অস্বীকার করেছেন। আমরা এখানে সেই হাদীসগুলো উল্লেখ করে এগুলোর অসারতা প্রমাণ করব।
প্রথম হাদীস
শাহ আবদুল আযীয তাঁর তুহ্্ফা গ্রন্থে বলেন, যদি হাদীসে সাকালাইন গ্রহণ করা হয়েও থাকে, তবু তা রাসূলুল্লাহ্্ (সা.)-এর অপর কয়েকটি হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক। এসব হাদীসের মধ্য থেকে তিনি নিম্নেল্লিখিত হাদীসটিকে সহীহ বলে দাবি করেন :
‘আমার সুন্নাহ অনুসরণ কর এবং আমার পর সঠিক পথপ্রাপ্ত উত্তরাধিকারীদের (খোলাফায়ে রাশেদীনের) অনুসরণ কর, তা আঁকড়ে ধর এবং এর ওপর প্রতিষ্ঠিত থাক।’
সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন (আবাকাত আল আনওয়ার গ্রন্থের প্রণেতা) বলেন যে, এমন হাদীস সহীহ নয়।
প্রথমত, তিনি বলেন, এ হাদীসটি কেবল সুন্নীদের দ্বারা বর্ণনাকৃত। অন্যদিকে হাদীসে সাকালাইন সুন্নীদের পাশাপাশি আহলে বাইতের মাযহাবের আলেমগণও বর্ণনা করেছেন।
দ্বিতীয়ত শাহ আবদুল আযীয এখানে তাঁর স্বঘোষিত নীতি ওপর বহাল থাকেননি যে, আহলে বাইতের মতবাদের বিপক্ষে তাঁর যুক্তি তাদের দ্বারা গ্রহণীয় লেখনীর ওপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হবে।
তৃতীয়ত হাদীসটি মুসলিম ও বুখারী লিপিবদ্ধ করেননিÑ হাদীসের ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাত যাঁদেরকে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মনে করে থাকে।
চতুর্থত, উপরিউক্ত হাদীসের সহীহ হওয়ার দাবিটি মিথ্যা। কারণ, সুন্নী আলেমগণের দ্বারাই এ হাদীসের সনদকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে।
এ হাদীসের ওপর পর্যালোচনা
এ হাদীসটি আবু দাউদ, তিরমিযী এবং ইবনে মাজাহ কর্তৃক লিপিবদ্ধ হয়েছে।
আবু দাউদের রাবীদের সম্পর্কিত আলোচনা :
আল-আরবাদ ইবনে সারিআহÑ তিনি এ হাদীসের অন্যতম রাবী (বর্ণনাকারী)। তিনি নির্ভরযোগ্য নন। কারণ, তিনি নিজের সম্বন্ধেই এমন উক্তি করেছেন যে, ‘আমি ইসলামের এক-চতুর্থাংশ।’
হাজার ইবনে হাজার আল কিলাইÑ সিরিয়ার একটি শহরে বসবাস করত যে শহরের অধিবাসীরা আলী (আ.)-এর প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণ করত। ইবনে হাজার তাঁর তাহযীব আত তাহযীবে তাঁর অবস্থা অজ্ঞাত বলে উল্লেখ করেছেন। (৩য় খ-, পৃ. ১১৮)
খালিদ ইবনে মাদান ইবনে আবি কারিব আল কিতাবীÑ সে ছিল ইসলামের ইতিহাসের কুখ্যাত শাসক ইয়াযীদ ইবনে মু‘আবিয়ার পুলিশ বাহিনীর প্রধান।
সাওর ইবনে ইয়াযীদÑ ইবনে হাজার উল্লেখ করেছেন যে, সে আলী (আ.)-কে ঘৃণা করত। কারণ, তিনি এক যুদ্ধে তার পিতাকে হত্যা করেছিলেন। আবদুল্লাহ্্ ইবনে মুবারক তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকতেন এবং তাঁকে একজন গোঁড়া মনে করতেন।
পরবর্তী রাবী হলো আল ওয়ালিদ ইবনে মুসলিম। আবু মুসহার কর্তৃক জালকরণের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে, যা মিযানুল ইতিদালে যাহাবী উল্লেখ করেছেন (৪র্থ খ-, পৃ. ৩৪৭) ।
অন্যদিকে তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ যেসব রাবী থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন, যেমন আবু আসিম, হাসান ইবনে আলী আল-খাল্লাল, বুহাইর ইবনে সা’দ, বাকীয়াহ ইবনে আল-ওয়ালীদ, ইয়াহইয়া ইবনে আবি আল-মুতী, আবদুল্লাহ্্ ইবনে আলা’, মু‘আবিয়া ইবনে সালিহ, ইসমাঈল ইবনে বিশ্্র ইবনে মানসূর এবং আবুল মালিক ইবনে আল-সাব্বাহÑ তাঁরা সকলেই দুর্বল রাবী। আহলে সুন্নাতের রেজালশাস্ত্রবিদগণ তাঁদের সকলকেই দুর্বল রাবী হিসাবে অভিহিত করেছেন।
উপরন্তু যদি এ হাদীসটি সহীহ বলে ধরেও নিই, তবু তা হাদীসে সাকালাইনের বিপক্ষে কোন গুরুত্ব রাখে না। কারণ, হাদীসে সাকালাইন রাসূলুল্লাহ্্ (সা.)-এর বিপুল সংখ্যক সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে, অন্যদিকে সুন্নী পন্ডিতদের বিপুল সংখ্যক তাঁদের হাদীস গ্রন্থে এ হাদীসটি উল্লেখ করেননি। যদি এ হাদীসটি সত্যিই নির্ভরযোগ্য হয়ে থাকে, তবে ‘সঠিক পথপ্রাপ্ত উত্তরাধিকারী’ শব্দগুলো আহলে বাইতের বারো ইমামের ওপর আরোপ করা যায়Ñ যা রাসূলুল্লাহ্্ (সা.)-এর আরেকটি প্রসিদ্ধ হাদীস দ্বারা সমর্থিত হতে পারে। আর সেই হাদীসটি হল ‘আমার পরে বারো জন খলীফা বা ইমাম আসবে।’

শাহ আবদুল আযীয কর্তৃক উত্থাপিত আরেকটি প্রশ্নের জবাব দান

আবদুল আযীয বলেছেন, যদি হাদীসে সাকালাইন পূর্বোক্ত হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক নাও হয়, তবুও ‘ইতরাত’ শব্দ সাধারণভাবে রাসূলুল্লাহ্্ (সা.)-এর গোত্র বনি হাশিমের সকল আত্মীয় অথবা হযরত ফাতিমার সকল বংশধরের ওপর আরোপ করা যায়। তাহলে এটি বলা অবান্তর যে, তাঁদের সকলেই হলেন ইমাম।
সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন এ সন্দেহ সম্পর্কে নানা অভিধান রচয়িতার অর্থ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন, যেমন জাওহারী, ইবনে আসির, ইবনে মানযুর, আল ফিরূযাবাদী এবং অন্যরা। তাঁদের মতে ‘ইতরাত’ বলতে বুঝায় কারও নিকটতম আত্মীয় (আখাস আকরাবীন), সন্তানাদি (ওয়ালাদ) এবং বংশধর (যুররিয়াহ্্)।
উপরন্তু তিনি উল্লেখ করেন, হাদীসে সাকালাইন তাঁদের জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রাধান্যের পাশাপাশি তাঁদের পাপ ও ভুল থেকে মুক্ত থাকার বিষয়টিও নির্দেশ করে। এমন বর্ণনা নিঃসন্দেহে কেবল বারো ইমামের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, আলী (আ.) যাঁদেরকে রাসূলুল্লাহ্্ (সা.)-এর ‘ইতরাত’ বলে পরিচিত করিয়েছেন এবং কুরআনের ব্যাপারে তাঁদেরকে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ বলে উল্লেখ করেছেন।
দ্বিতীয় হাদীস
শাহ আবদুল আযীয কর্তৃক উত্থাপিত দ্বিতীয় হাদীসটি হলো :
‘ধর্মের বিষয়াদি তোমরা এই হুমায়রার (আয়েশা) নিকট থেকে গ্রহণ কর।’
তিনি এ হাদীসটিকে সহীহ বলে দাবি করেছেন।
সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন বলেন যে, সুন্নী প-িতগণই এ হাদীসকে জাল ও বানোয়াট বলে গণ্য করেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন :
১. আল-মিযযী এবং যাহাবী (আল-তাকরীর ওয়াল তাহবীর ফি র্শ্হা আল-তাহরীর, ৩য় খ-, পৃ. ৯৯)।
২. ইবনুল কাইয়্যেম জাওযীয়াহ, যেসব হাদীস ‘হে হুমায়রা’ এবং ‘আল-হুমায়রা’ শব্দযোগে এসেছে সেসব হাদীসকে তিনি জাল বলে গণ্য করেছেন।
৩. ইবনে কাসির, (আল-দুরুর আল-মুনতাশিরাহ ফি আল-আহাদীস আল-মুশতাহিরাহ্্, পৃ. ৭৯)।
৪. ইবনে হাজার আল-আসকালানী, (আল-তাকরীর ওয়া আল-তাহবীর, ৩য় খ-, পৃ. ৯৯)।
৫. তাঁদের পাশাপাশি ইবনুল মুলাক্কিন, আস সুবকি, ইবনে আমির আল-হাজ, আল-সাখাভী, আল-সুয়ূতী, আল-শায়বানী, আল-শেখ আলী আল-কারী, আল-যারকানী, আবদুল আলী আল-শাওকানী এবং অন্যরাও এ হাদীসটি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
তৃতীয় হাদীস
শাহ আবদুল আযীয আরেকটি হাদীসকে হাদীসে সাকালাইনের সাথে সাংঘর্ষিক হিসাবে এনেছেন। আর তা হলো :
‘আম্মারের নিকট থেকে পথনির্দেশনা চাও।’
সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন বলেন যে, এমন হাদীস কখনই হাদীসে সাকালাইনের বিপরীতে উত্থাপন করা যায় না। কারণ, হযরত আম্মার নিজেই হযরত আলী (আ.)-এর একনিষ্ঠ শিয়া (অনুসারী) ছিলেন এবং মহানবী (সা.) তাঁকে হযরত আলীকে মেনে চলা ও তাঁর আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছিলেন এভাবে :
‘হে আম্মার! আলী তোমাকে সত্যপথ হতে বিচ্যুত করবে না। হে আম্মার! আলীর আনুগত্য আমার আনুগত্য, আর আমার আনুগত্যই হল সর্বশক্তিমান ও প্রশংসিত আল্লাহর আনুগত্য।’
এ হাদীসটি বেশ কয়েকটি সুন্নী হাদীস গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন ফারায়েদুস সিমতাইন, ১ম খ-, পৃ. ১৭৮; আল মাওয়াদ্দাহ্্ ফিল কুরবা; আল খারাযমীর মানাকিব, পৃ. ৫৭ ও ১২৪; ইয়া নাবি আল-মাওয়াদ্দাহ, পৃ. ১২৮ ও ২৫০; মিফতাহ্্ আন-নাযা এবং কানজুল উম্মাল, ১২তম খ-, পৃ. ২১২।
উপরন্তু এ বিষয়টি অদ্ভুত যে, শাহ আবদুল আযীয এ হাদীসকে হাদীসে সাকালাইনের বিপরীতে উপস্থাপন করেছেন, যেখানে ঐতিহাসিক ইয়াকুবী তাঁর তারিখে (২য় খ-, পৃ. ১১৪) এবং মাসউদী তাঁর মুরুযুয যাহাব (২য় খ-, পৃ. ৩৪২) গ্রন্থে আম্মারকে তাঁদের মধ্যে গণ্য করেছেন যাঁরা প্রথম খলীফার আনুগত্য করা থেকে দূরে ছিলেন। হযরত উমর তাঁর খেলাফতকালে আম্মারের দিকনির্দেশনা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং কর্কশ কণ্ঠে তাঁর সাথে কথা বলেছিলেন যখন তিনি ওযূর জন্য পানি না পেলে নামায ছেড়ে না দিয়ে তায়াম্মুম করার মাধ্যমে পবিত্র হবার বিষয়টি তাঁর কাছে উপস্থাপন করেছিলেন। এ ঘটনাটি নি¤েœর হাদীস গ্রন্থগুলোতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে : মুসনাদে আহমাদ, ৪র্থ খ-, পৃ. ২৬৫; সহীহ মুসলিম, ১ম খ-, পৃ. ১১০; আবু দাউদ, নাসাঈ, তাবারী, আল-আঈনী, ইবনে আসির এবং আল-শায়বানীও এ ঘটনা উল্লেখ করেছেন।
হযরত উসমান তাঁর খেলাফতকালে আম্মারকে ততক্ষণ প্রহার করেন যতক্ষণ না আম্মার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এবং মারা যাওয়ার উপক্রম হয়। এ ঘটনাটি তখন ঘটে যখন তিনি হযরত উসমানের শাসনামলের বিভিন্ন অনিয়ম সম্পর্কে মুসলমানদের প্রতিবাদলিপি তাঁর কাছে হস্তান্তর করেন। এ ঘটনাটি নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলোতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে : ইবনে কুতাইবার আল-ইমামাহ্্ ওয়াল সিয়াসাহ্্, ১ম খ-, পৃ. ৩২; ইবনে আবদ রাব্বিহের আল-ইকদুল ফারীদ, ২য় খ-, পৃ. ১৯২; মাসউদীর মুরুযুয যাহাব, ২য় খ-, পৃ. ৩৩৮; ইবনে আবদুল বারের আল-ইসতিয়াব, ৩য় খ-, পৃ. ১৩৬; ইয়াকুবীর তারিখ, ২য় খ-, পৃ. ১৬০।
যদিও রাসূলুল্লাহ্্ (সা.) হযরত আম্মার সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলেছিলেন, যেমন ‘আম্মারের শত্রু আল্লাহর শত্রু’, তারপরও রাসূলের কতিপয় সাহাবী কর্তৃক তিনি প্রতিরোধের মুখে পড়েন, তাঁরা তাঁকে ঘৃণা করতেন এবং তাঁর সাথে খারাপ আচরণ করতেন, যেমন আবদুর রহমান ইবনে আওফ, সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস, মুগীরাহ ইবনে শোবা, আবু মূসা আশআরী, আবু মাসউদ আল-আনসারী এবং অন্যরা। আম্মার দৃঢ়ভাবে আলীর পক্ষে এবং আলীর বিরোধিতাকারীদের বিপক্ষে দাঁড়ান। যেমন তিনি তালহা, যুবায়েরের বিপক্ষে জামাল যুদ্ধে এবং মু‘আবিয়ার বিপক্ষে সিফ্্ফীন যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। পরিশেষে তিনি মু‘আবিয়ার সৈন্যদের দ্বারা নিহত হন এবং রাসূলুল্লাহ্্ (সা.)-এর ভবিষদ্বাণীর সত্যতা প্রকাশিত হয় যে, ‘আম্মার একদল বিদ্রোহী (আল-ফিআত আল-বাগিয়াহ) কর্তৃক নিহত হবে।’

চতুর্থ হাদীস

সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন আরও কয়েকটি হাদীসের ওপর আলোচনা করেন যা আবদুল আযীয কর্তৃক উত্থাপিত হয়েছে। যেমন :
‘ইবনে উম্মে আব্্দ (আবদুল্লাহ্্ ইবনে মাসউদ) এর সিদ্ধান্তের ওপর কর্ম সম্পাদন কর।’ অথবা ‘ইবনে উম্মে আব্্দ এর অভিমতই তোমাদের জন্য আমার অভিমত।’
এ দু’টি হাদীসই দুর্বল (যাইফ) এবং খবরে আহাদ, যেখানে হাদীসে সাকালাইন হলো মুতাওয়াতির। মুসলিম ও বুখারী উভয়েই যেহেতু এটি তাঁদের গ্রন্থে উল্লেখ করেননি, তাই বলা যায় তাঁরা এগুলোর সনদকে দুর্বল মনে করেছেন।
উপরন্তু যদি এগুলো সত্য বলে ধরে নেয়া হয় তুবও সেগুলো হাদীসে সাকালাইনের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। কারণ, এগুলো কেবল ইবনে মাসউদের প্রতিভাকে বর্ণনা করে, অন্যদিকে হাদীসে সাকালাইন আহলে বাইতের শ্রেষ্ঠত্ব ও তাঁদের নেতৃত্বের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে।
উপরন্তু শাহ আবদুল আযীযের ক্ষেত্রে এখানে দ্বিমুখিতা লক্ষ্যণীয় যে, তিনি এ হাদীসগুলোকে উপস্থাপন করেছেন, অথচ ইবনে মাসউদের কর্মকা-কে স্বীকৃতি দেওয়ার পরিবর্তে হযরত উমর তাঁকে ফতোয়া দিতে নিষেধ করেছিলেন, রাসূলুল্লাহ্্ (সা.)-এর হাদীস বর্ণনা করতে নিষেধ করেছিলেন এবং তাঁর মদীনা ত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। এ অবস্থা হযরত উমরের ইন্তেকাল পর্যন্ত বহাল ছিল। হযরত উসমান আরও এক ধাপ অগ্রসর হয়েছিলেন এবং ইবনে মাসউদকে এতটা নির্দয়ভাবে প্রহার করেছিলেন যে, তাঁর পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে গিয়েছিল।

পঞ্চম হাদীস

শাহ আবদুল আযীয আরেকটি হাদীস উল্লেখ করেছেন :
‘মু‘আয ইবনে জাবাল হারাম ও হালাল সম্পর্কে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী।’
সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন বলেন যে, এটি কেবল সুন্নীদের দ্বারাই বর্ণিত হয়েছে। মুসলিম ও বুখারী এ হাদীসকে পরিহার করেছেন। সুন্নী প-িতদের মধ্যে ইবনে তাইমিয়াহ, ইবনে আবদুল হাদী, যাহাবী, মানাভী প্রমুখ এ হাদীসকে দুর্বল মনে করেছেন বা ভিত্তিহীন বলেছেন।
এ হাদীসের রাবীদের মধ্যে মুহাম্মাদ ইবনে আবদুর রহমান আল-বাইলামানী, তাঁর পিতা, যায়েদ আল-আম্মি, সালিম ইবনে সালিম হাদীস ও রিযালশাস্ত্রের আলেমগণ কর্তৃক অবিশ্বস্ত বলে বিবেচিত হয়েছেন। যেমন : বুখারী, নাসাঈ, আল-মাকদিসী, দারে কুতনী, ইবনে হাজার, আল-যাহাবী, ইবনুল জাওযী এবং অন্যরা অবিশ্বস্ত বলেছেন।
উপরন্তু তাবাকাতে ইবনে সা’দ (৩য় খ-, পৃ. ৫৮৫) এবং ইবনে আবদুল বারের আল-ইস্তিআবে (৩য় খ-, পৃ. ১৪০৪) এমন কিছু ঘটনা বর্ণিত হয়েছে যাতে বোঝা যায় যে, উপরিউক্ত হাদীসে তাঁর জন্য যে যোগ্যতা দাবি করা হয় তিনি সে রকম যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন না।

ষষ্ঠ হাদীস

শাহ আবদুল আযীয রাসূলুল্লাহ্্ (সা.) কর্তৃক বর্ণিত অপর একটি হাদীস এনেছেন যেটার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রাধিকারের দাবি করেছেন যা তাওয়াতুরের কাছাকাছি :
‘আমার পরে যারা আসবে তাদের অনুসরণ কর, আবু বকর ও উমর।’
হামিদ হুসাইন বলেন, শুরার দাবি সমর্থনযোগ্য নয় এবং অনেক সুন্নী আলেম এ হাদীসের ত্রুটি পেয়েছেন এবং একে ভিত্তিহীন বলে গণ্য করেছেন। যেমন : আবু হাতিম আল-রাযী, আল-বাযযায এবং ইবনে হায্ম (ফাত্্হ আল-কাদির ফি র্শ্হা আল-জামি আস-সাগীর, ২য় খ-, পৃ. ৫২); তিরমিযী, (সহীহ, ৫ম খ-, পৃ. ৬৭২); উকাইলী, (আদ-দুআফা); নাক্কাস, (মিযানুল ইতিদাল, ১ম খ-, পৃ. ১৪২); দারে কুতনী, (লিসান আল মিযানে, ৫ম খ-, পৃ. ২৩৭); ইবরী আল-ফারগানী, (র্শ্হা আল মিনহাজ); যাহাবী, (মিযানুল ইতিদাল, ১ম খ-, পৃ. ১০৫); ইবনে হাজার আল-আসকালানী, (লিসানুল মিযান, ১ম খ-, পৃ. ১৮৮ ও ২৭২, ৫ম খ-, পৃ. ২৩৭); এবং শায়খুল ইসলাম আল-হারাভী, (আল-দুররুন নাদিদ, পৃ. ৯৭)
ইবরাহীম ইবনে ইসমাঈল, ইসমাঈল ইবনে ইয়াহইয়া, ইয়াহইয়া ইবনে সালামাহ্্ ইবনে কুহাইল এবং আবু আল-জারাÑ যাঁরা এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন তাঁদেরকে আবু যুরাহ, আবু হাতিম, ইবনে নুমাইর, দারে কুতনী, বুখারী, নাসাঈ, ইবনে মুঈন, ইবনে হিব্বান, তিরমিযী এবং অন্য অনেকেই অবিশ্বস্ত বলে গণ্য করেছেন।
উপরিউক্ত হাদীসগুলো শাহ আবদুল আযীয উত্থাপন করেছেন এ বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে, যদি হাদীসে সাকালাইনকে আহলে বাইতের ইমামদের ইমামতের নির্দেশক হিসাবে গণ্য করা হয় তবে এসব হাদীসও হুমায়রা, আম্মার, ইবনে মাসউদ, মুয়াজ ইবনে জাবাল, হযরত আবু বকর এবং হযরত উমরের ইমামতের বিষয়টি নির্দেশ করছে। সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন বলেন যে, এমন উপসংহারে আমরা তখনই পৌঁছব যখন উপস্থাপিত হাদীসগুলো নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু আবাকাতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যে, এ হাদীসগুলো দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য যেগুলো কোনভাবেই হাদীসে সাকালাইনের মোকাবেলায় দাঁড়াতে পারে নাÑ যা মুতাওয়াতির হাদীস এবং শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে বিপুল সংখ্যক রাবী ও প-িত কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে।
সপ্তম হাদীস
শাহ আবদুল আযীয তাঁর যুক্তির সপক্ষে মহানবী (সা.)-এর আরেকটি হাদীস বর্ণনা করেছেন যা ‘হাদীসে নুজুম’ নামে পরিচিত। হাদীসটি হলো :
‘নিশ্চয়ই আমার সাহাবীরা আকাশের নক্ষত্রতুল্য (নুজুম); তাদের যাকেই তোমরা অনুসরণ করবে, তুমি সঠিক পথে পরিচালিত হবে। আমার সাহাবীদের মধ্যে মতপার্থক্য তোমাদের জন্য রহমত।’
সুন্নী আলেমদের মধ্যে যাঁরা এ হাদীসকে অনির্ভরযোগ্য গণ্য করেছেন তাঁরা হলেন :
১. আহমাদ ইবনে হাম্বাল (আল-তাকরীর ওয়া আত-তাহবীর, ৩য় খ-, পৃ. ৯৯):
২. আল-মিযযী (আল-জামী বায়ান আল-ইল্ম, ২য় খ-, পৃ. ৮৯-৯০);
৩. আল-বাযযায (জামী বায়ান আল-ইল্্ম, ২য় খ-, পৃ. ৯০);
৪. ইবনে আল কাত্্তান, (আল-কামিল);
৫. দারে কুতনী (লিসান আল-মিযান, ২য় খ-, পৃ. ১৩৭);
৬. ইবনে হায্ম, (বাহার আল-মুহিত, ৫ম খ-, পৃ. ৫২৮);
৭. আল-বায়হাকী, আল-হাফিয আল-ইরাকী (তাখরীয আহাদীস আল-মিনহাজ);
৮. ইবনে আবদুল বার (জামী বায়ান আল-ইল্্ম, ২য় খ-, পৃ. ৯০-৯১);
৯. ইবনে আসাকির (ফায়যুল কাদীর, ৪র্থ খ-, পৃ. ৭৬);
১০. ইবনুল জাওযী, (আল-ইলাল আল-মুতানাহিয়াহ ফি আল-আহাদীস আল-ওয়াহিয়াহ্্);
১১. ইবনে দাহিয়াহ্্ (তালিক তাখরীয আহাদীস আল-মিনহাজ);
১২. আবু হাইয়ান আল-আন্দালুসী (আল-দুর আল-লাকিত মিন আল-বাহ্্র আল-মুহিত, ৫ম খ-, পৃ. ৫২৭-৫২৮);
১৩. আল-যাহাবী (মিযানুল ইতিদাল, ১ম খ-, পৃ. ৪১৩, ২য় খ-, পৃ. ১০২ ও ৬০৫);
১৪. ইবনুল কাইয়্যেম আল-জাওযীয়াহ্্ (ইলাম আল-মুকিন, ২য় খ-, পৃ. ২২৩)
১৫. যাইন আল-দীন আল-ইরাকী (তাখরীয আহাদীস আল-মিনহাজ);
১৬. ইবনে হাজার আল-আসকালানী (তালখীস আল-খাবীর, ৪র্থ খ-, পৃ. ১৯০-১৯১)
১৭. ইবনে আল-হুমাম (আল-তাহরীর ওয়া আত-তাহরীর, ৩য় খ-, পৃ. ৯৯);
১৮. ইবনে আমীর আল-হাজ (আল-তাকরীর ওয়া আত-তাহরীর, ৩য় খ-, পৃ. ৯৯);
১৯. আল-সাখাভী (আল-মাকাসিদ আল-হাসানাহ্্, পৃ. ২৬-২৭);
২০. ইবনে আবি শারীফ (ফায়যুল কাদীর, ৪র্থ খ-, পৃ. ৭৬);
২১. আল-সুয়ূতী (ইতমাম আল-দিরায়াহ্্ এবং আল-জামি আস-সাগীর, ৪র্থ খ-, পৃ. ৭৬);
২২. আল-মুত্তাকী আল-হিন্দী (কানজুল উম্মাল, ৪র্থ খ-, পৃ. ১৩৩);
২৩. আল-কারী (আল-মিরকাত, ৫ম খ-, পৃ. ৫২৩);
২৪. আল-মানাভী (আল-তাইসির ফি র্শ্হা আল-জামি আস-সাগীর, ২য় খ-, পৃ. ৪৮ এবং ফায়যুল কাদীর, ৪র্থ খ-, পৃ. ৭৬);
২৫. আল-কাফাযী [নাসীম আর রিয়াদ (আশ শিফার ব্যাখ্যাগ্রন্থ), ৪র্থ খ-, পৃ. ৩২৩-৩২৪];
২৬. আল-সিন্দী (দিরাসাত আল-লাবিব ফি আল-উসওয়াত আল-হাসানাহ্্ আল-হাবীব, পৃ. ২৪০);
২৭. আল-কাযী মুহিব্বুল্লাহ্্ আল-বিহারী (মুসাল্লিম আল-সুবুত বি র্শ্হা আবদুল আলী, ২য় খ-, পৃ. ৫১০);
২৮. নিযাম আল-দীন সাহালাভী [আল-সুবহ আল-সাদিক (মানার এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ)];
২৯. আল-মাওলাভী আবদুল আলী [ফাওয়াতিহ আর-রাহমাত (র্শ্হা মুসাল্লিম আস-সুবুত), ২য় খ-, পৃ. ৫১০];
৩০. আল-শাওকানী (ইরশাদ আল-ফুহুল, পৃ. ৮৩);
৩১. ওয়ালিউল্লাহ্্ ইবনে হাবীবুল্লাহ্্ আল-লাখনাভী (র্শ্হা মুসাল্লিম আস-সুবুত);
৩২. সিদ্দীক হাসান খান আল-কনৌজী (হুসুল আল-মামুল, পৃ. ৫৬৮)।
৩৩. নাসির উদ্দিন আলবানী (যঈফ ও মওযু হাদীস)
নি¤œলিখিত কারণেও এ হাদীসটি অগ্রহণযোগ্য :
১. হাদীসটি কেবল এটিই ইঙ্গিত করে না যে, প্রত্যেক সাহাবীই ন্যায়নিষ্ঠ; বরং প্রত্যেকেই উম্মতের যোগ্য নেতা ও পথপ্রদর্শক। এটি সর্বসম্মতভাবে মিথ্যা। কারণ, তাঁরা নিজেরাই পথনির্দেশনার মুখাপেক্ষী ছিলেন।
২. ইতিহাসের বর্ণনা মতে তাঁদের একটি দল বিভিন্ন গুরুতর পাপের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। যেমন হত্যাকা- এবং মিথ্যা সাক্ষ্যদান ইত্যাদি। আর তাই এটি যুক্তিসংগত নয় যে, মহানবী (সা.) এমন ব্যক্তিদের উম্মাহ্্র পথনির্দেশক ও নেতা মনোনীত করবেন।
৩. পবিত্র কুরআনে অনেক আয়াত রয়েছে, বিশেষ করে সূরা বাকারা, সূরা আহযাব, সূরা জুমুআহ এবং সূরা মুনাফিকুন, যেগুলো সাহাবীদের এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যকের মন্দ চরিত্রের ওপর আলোকপাত করেছে এবং এটি মনে করা অযৌক্তিক যে, মহানবী (সা.) এমন ব্যক্তিদের উম্মতের পথনির্দেশক ও নেতা বলে ঘোষণা করবেন।
৪. মাযহাব নির্বিশেষে বিভিন্ন সূত্রে মহানবী (সা.)-এর অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে যেগুলো সাহাবীদেরকে একটি দল হিসাবে গণ্য করেছে। উপরিউক্ত হাদীস সেসব নির্ভরযোগ্য হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে।১
৫. সুন্নী সূত্রে অনেক হাদীস রয়েছে যা উম্মাহকে সাহাবীদের অনুসরণ করা থেকে নিষেধ করে। যাইন আল-ফাতা ফি তাফসীরে সূরা হাল আতা’য় আসিমী কর্তৃক লিপিবদ্ধ হয়েছে যে, মহানবী (সা.) বলেছেন :
‘আমার পরে আমার সাহাবীদের দ্বারা বেদআত তৈরি করা হবে (যেমন তাদের মধ্যে যে ফিতনা হবে)। আল্লাহ্্ তাদের পূর্বেকার (উত্তম) আমলের কারণে তাদের ক্ষমা করে দেবেন, কিন্তু যদি লোকজন আমার পরে তাদের অনুসরণ করে, তবে আল্লাহ্্ তাদের জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন।’
৬. মহানবী (সা.)-এর সাহাবীদের মধ্যে কেউ কেউ এমন সব কথা বলেছেন যাতে বোঝা যায় যে, উম্মতের নেতা ও পথপ্রদর্শক হওয়ার মতো যোগ্যতা তাঁদের ছিল না। হযরত আবু বকর ও হযরত উমর তাঁদের নিজেদের সম্পর্কে এমন অনেক বিবৃতি দিয়েছেন যা প্রকাশ করে যে, পথপ্রদর্শক হিসাবে কুরআনের মতো নির্দ্বিধায় অনুসরণ করার মতো যোগ্যতা তাঁদের ছিল না।২
হাদীসে নুজুম গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সমস্যা সম্পর্কে সচেতন থাকার ফলে শাহ আবদুল আযীয স্বীকার করেছেন যে, কিছু সংখ্যক সাহাবী ইজতিহাদের ক্ষেত্রে ভুল করেছেন। কারণ, তা কুরআন ও সুন্নাহ্্র স্পষ্ট নির্দেশের (নাস) বিপরীত। তারপরও তিনি স্বীকার করেছেন যে, যেসব ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট নির্দেশ পাওয়া যায় না সেসব ক্ষেত্রে সাহাবীদের ইজতিহাদের অনুসরণ করা যাবে।
সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন এর জবাব দিয়েছেন এভাবে :
প্রথমত যে ব্যক্তির ফতোয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে ভুল করার ব্যাপারটি নিশ্চিত সে আইনসঙ্গতভাবে পথপ্রদর্শক হতে পারে না।
দ্বিতীয়ত যেখানে কুরআন ও হাদীসের স্পষ্ট নির্দেশ সত্ত্বেও সাহাবীদের ভুল করার সম্ভাবনা রয়েছে, তাহলে যেখানে স্পষ্ট নির্দেশনা নেই সেক্ষেত্রে ভুল করার সম্ভাবনা আরও অনেক বেশি।
তৃতীয়ত যেখানে সঠিক পথপ্রদর্শক রয়েছেনÑ যাঁর পথনির্দেশনা এবং যাঁর পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার বিষয়টি আল্লাহ্্ কর্তৃক নিশ্চিত করা হয়েছে, সেখানে যার ভুল করার সম্ভাবনা রয়েছে তার অনুসরণ করার কোন অনুমতি নেই। আয়াতে তাতহীর (সূরা আহযাব : ৩৩) এবং হাদীসে সাকালাইনসহ অনেক আয়াত ও হাদীস আহলে বাইতের ইমামদের নিষ্পাপ হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেছে।
চতুর্থত সাহাবীরা শরীয়তের অনেক বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য করেছেনÑ যেগুলোর ক্ষেত্রে স্পষ্ট নির্দেশনা নেই। এমন পরিস্থিতিতে তাঁদের সকলকে পথনির্দেশনার জন্য নক্ষত্রতুল্য বিবেচনা করা সম্পূর্ণরূপে ভুল।
পঞ্চমত সাহাবীরা নিজেরাই একে অপরের ভুল ধরেছেন। কখনও কখনও পরিমিতিবোধ লুপ্ত হয়েছে; একে অপরকে মিথ্যাবাদী, অজ্ঞ, এমনকি কাফের পর্যন্ত বলেছেনÑ যেগুলো আহলে সুন্নাতের গ্রন্থাদিতে লিপিবদ্ধ রয়েছে। নিশ্চয়ই বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন কোন ব্যক্তি তাঁদের প্রত্যেককে মুসলিম উম্মাহ্্র সঠিক পথপ্রদর্শক হিসাবে গ্রহণ করবে না।
ষষ্ঠত সাহাবীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যাঁরা কিয়াসের অনুশীলন করতেন যে বিষয়ে উম্মতের বিপুল সংখ্যক আইনজ্ঞ দোষারোপ করেছেন।
সপ্তমত তাঁদের মধ্যে অনেকেই আছেন, এমনকি প্রথম তিন খলীফাও, যাঁরা শরীয়তের নানা বিধান জানার জন্য অন্যদের শরণাপন্ন হতেন। এটি মনে করা অযৌক্তিক যে, মহানবী (সা.) মতবাদগত ও আইনগত বিষয়ে অজ্ঞ ব্যক্তিদের উম্মতের কর্তৃপক্ষ নিযুক্ত করবেন। তাঁদের মধ্যে এমনও ছিলেন যাঁরা কুরআনের কিছু শব্দের অর্থও বুঝতেন না। যেমন হযরত উমর ‘কালালাহ্্’ শব্দের অর্থ বুঝতেন না যেটা তাবারী তাঁর তাফসীরে (৪র্থ খ-, পৃ. ২৮৩-২৮৪) উল্লেখ করেছেন। হযরত উমরের নিজের কথাই এখানে উল্লেখ করা হয়েছে।
অষ্টমত তাঁদের কেউ কেউ সুদের লেনদেনের সাথে জড়িত ছিলেন৩, কেউ মদ বিক্রির সাথে জড়িত ছিলেন৪ অথবা জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও ফতোয়া দিতেন, এমনকি মহানবী (সা.)-এর স্পষ্ট হাদীসের বিপরীতে। কেউ কেউ মহানবী (সা.)-এর সুন্নাতের বিপরীতে বেদআত সৃষ্টির দোষে দুষ্ট।

‘কিতাবুল্লাহ ও আমার সুন্নাহ’ সংক্রান্ত হাদীসের ওপর আলোচনা

পথভ্রষ্টতা থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যাপারে সমাজে বহুল প্রচলিত যে হাদীস বিদ্যমান তা হচ্ছে রাসূলুল্লাহ্্ (সা.)-এর এই হাদীস :
‘আমি তোমাদের নিকট দু’টি বস্তু ছেড়ে যাচ্ছি। তোমরা যতক্ষণ তা ধরে থাকবে পথভ্রষ্ট হবে না। তা হলো আল্লাহ্্র কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাহ।’
‘মহান আল্লাহ্র কিতাব ও আমার সুন্নাহ আঁকড়ে ধর’Ñ এ হাদীসটি অনির্ভরযোগ্য এবং এর কোন সহীহ সনদ নেই। কারণ, এ রেওয়ায়াতটি আহলে সুন্নাতের মাত্র আটজন আলেম কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যেগুলোর সবকটির সনদ দুর্বল এবং ত্রুটিযুক্ত। নিচে এ হাদীসটি নিয়ে আলোচনা করা হলো :
১. মালেক ইবনে আনাস বলেছেন : আমার কাছে সংবাদ পৌঁছেছে যে, দু’টি জিনিস আমি তোমাদের মধ্যে রেখে যাচ্ছি যেগুলো দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরলে তোমরা কখনও গোমরাহ হবে না : মহান আল্লাহর কিতাব (আল-কুরআন) এবং তাঁর নবীর সুন্নাহ। (মুয়াত্তা ইমাম মালিক, সুয়ূতীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ, ২য় খ-, পৃ. ২০৮; ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত মুয়াত্তা ইমাম মালিক (র.), ২য় খ-, তাকদীর অধ্যায়, রেওয়ায়াত ৩, পৃ. ৬১৭)
তিনি এ হাদীসটি সনদ ছাড়াই মুরসাল রূপে বর্ণনা করেছেন।
২. ইবনে হিশাম এ রেওয়ায়াতটি মহানবী (সা.)-এর বিদায় হজ্জের ভাষণে বর্ণনা করেছেন। তবে তিনিও সনদবিহীনভাবে বর্ণনা করেছেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম, ৪র্থ খ-, পৃ. ৬০৩)
৩. হাকিম নিশাবুরী এ হাদীসটি দু’টি সনদসহ বর্ণনা করেছেন যার একটি ইবনে আব্বাস এবং অপরটি আবু হুরাইরা পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। (মুসতাদরাকে হাকিম, ১ম খ-, পৃ. ৯৩)
হাকিম কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটির প্রথম সনদে ইসমাঈল ইবনে আবি উওয়াইস বিদ্যমান যাঁকে এক বিরাট সংখ্যক রিজালশাস্ত্রবিদ যাঈফ (দুর্বল) বলেছেন। ইবনে মুঈন বলেন : তিনি এবং তাঁর পিতা যাঈফ। নাসাঈ বলেছেন : তিনি যাঈফ। ইবনে আদী বলেছেন : তিনি তাঁর মামার কাছ থেকে বেশ কিছু গারীব (অদ্ভুত) হাদীস বর্ণনা করেছে যেগুলো কেউই গ্রহণ করেননি। ইবনে হায্ম তাঁর নিজের সনদ সহকারে সাইফ ইবনে মুহাম্মাদ থেকে বর্ণনা করেছেন : ইসমাঈল ইবনে আবি উওয়াইস হাদীস জা’ল করতেন...। (তাহযীবুত তাহযীব, ১ম খ-, পৃ. ২৭১)
আর দ্বিতীয় সনদে সালেহ ইবনে মূসা তালহী কুফী বিদ্যমান যাঁকে বহু সুন্নী রিজালশাস্ত্রবিদ যাঈফ বলেছেন। ইবনে মুঈন বলেন : তিনি কিছুই নন (অর্থাৎ তাঁর কোন মূল্যই নেই)। বুখারী বলেছেন : তিনি হাদীস প্রত্যাখ্যানকারী। নাসাঈ বলেছেন : তিনি যাঈফ। ইবনে আদী বলেছেন : জুমহুর আলেমগণ তাঁকে গ্রহণ করেন না। আকীলী বলেছেন : তাঁর কোন হাদীসই গ্রহণযোগ্য নয়।’ (তাহযীবুত তাহযীব, ৪র্থ খ-, পৃ. ৩৫৪)
৪. আবু বকর বাইহাকী এ হাদীসটি দু’টি সনদ সহকারে বর্ণনা করেছেন যার একটি ইবনে আব্বাস এবং অন্যটি আবু হুরাইরা পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। (আস-সুনানুল কুবরা, ১০ম খ-, পৃ. ১১৪)। এ সনদটিও হাকিম নিশাবুরীর সনদসমূহের মতো প্রথম সনদে ইবনে আবি উওয়াইস এবং দ্বিতীয়টিতে সালেহ ইবনে মূসা আছে যাঁদের উভয়কেই যঈফ বলে গণ্য করা হয়েছে।
৫. ইবনে আবদুল বার আল কুরতুবীও এ হাদীসটি দু’টি সূত্রে রেওয়ায়াত করেছেন। (ইবনে আবদুল বার প্রণীত আত তামহীদ)। এর প্রথম সনদ হচ্ছে ঐ সূত্র যা হাকিম আবু হুরাইরা থেকে বর্ণনা করেছেন এবং এর মধ্যে সালেহ বিন মূসা বিদ্যমান যাঁকে অনেক রিজালশাস্ত্রবিদ যাঈফ প্রতিপন্ন করেছেন।
আর এর দ্বিতীয় সনদে কাসীর বিন আবদুল্লাহ বিদ্যমান যাঁকে একদল রিজালবিদ যাঈফ প্রতিপন্ন করেছেন। আহমাদ ইবনে হাম্বাল তাঁকে হাদীস অমান্যকারী ও প্রত্যাখ্যানকারী বলে বিবেচনা করতেন এবং তাঁর কোন মূল্যই দিতেন না। নাসাঈ তাঁকে সিকাহ (বিশ্বস্ত) বলে বিবেচনা করেননি। ইবনে আদী বলেছেন : তাঁর বর্ণনাকৃত রেওয়ায়াতসমূহ অনুসরণযোগ্য নয়। আলী ইবনে মাদানীও তাঁকে যাঈফ প্রতিপন্ন করেছেন। ইবনে আবদুল বার বলেছেন : তাঁর যঈফ হওয়ার ব্যাপারে রিজালশাস্ত্রবিদগণের ইজমা (ঐকমত্য) রয়েছে। এ ছাড়াও তিনি তাঁর পিতা ও দাদা থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইবনে হিব্বান বলেছেন : তাঁর দাদার সূত্রে তাঁর পিতা থেকে যেসব রেওয়ায়াত তিনি বর্ণনা করেছেন সেগুলো আসলে একটি জাল পা-ুলিপির সাথে জড়িত যা গ্রন্থ হিসাবে বর্ণনা করা সঠিক নয়। (আল-ইলমা ফী যাবতির রেওয়ায়াহ ওয়া তাকঈদিস সিমা’, পৃ. ৮-৯)
৬. কাযী আইয়ায এ হাদীসটি নিজ সূত্রে আবু সাঈদ খুদরীর মাধ্যমে মহানবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু (এ সনদের) এর বেশ কতিপয় রাবী যঈফ বলে গণ্য হয়েছে যে, তাঁদের মধ্যে শুআইব ইবনে ইবরাহীম ইবনে সাইফ ইবনে উমরের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। বিশেষ করে সাইফ ইবনে উমরের যাঈফ হওয়ার ব্যাপারে রিজালশাস্ত্রবিদগণের ইজমা রয়েছে। (তাহযীবুত তাহযীব, ৪র্থ খ-, পৃ. ২৫৯)
৭. সুয়ূতীও উপরিউক্ত হাদীসটি হাকিম নিশাবুরীর ঐ একই সনদ সহকারে বর্ণনা করেছেন যা ইতোমধ্যে বর্ণিত হয়েছে। (মানাভী প্রণীত ফাইযুল কাদীর, ৩য় খ-, পৃ. ২৪০)
৮. মুত্তাকী হিন্দীও ‘কানযুল উম্মাল’ গ্রন্থে কিতাব ও সুন্নাহ দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা’ শিরোনামে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ের অবতারণা করেছেন। একই শিরোনামের অধীনে হাকিম ও বাইহাকীর মতো অন্যান্য হাদীসবেত্তার রেওয়ায়াতসমূহ উল্লেখ করেছেন এবং আল-ইবানাহ থেকেও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তবে তিনি বলেছেন : এ হাদীসটি অত্যন্ত গরীব।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এমন একটি হাদীসকে ‘হাদীসে সাকালাইন’ এর মতো মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত হাদীসের বিপরীতে উপস্থাপনের কোন অবকাশই নেই।
টীকা
১. বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে (কিতাব আল-রুকুক) নিচের এই মুতাওয়াতির হাদীসটি হযরত আনাস ইবনে মালিক থেকে বর্ণনা করেছেন :
বুখারী মুসলিম ইবনে ইবরাহীম থেকে বর্ণনা করেন, যিনি উহাইব থেকে, তিনি আবদুল আযীয থেকে, তিনি আনাস থেকে বর্ণনা করেন যে, মহানবী (সা.) বলেন : ‘আমার কাছে হাউসের (হাউসে কাওসার) নিকট আমার সাহাবীদের একটি দলকে আনা হবে এবং আমি তাদের চিনতে পারব; তাদেরকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি বলব, (হে আল্লাহ্্! তারা কি) আমার সাহাবী (নয়)? (আল্লাহ্্) বলবেন, ‘তুমি জান না, তোমার পরে তারা কী করেছিল!’
অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে (১৪৪২ নং) মহানবী (সা.)-কে বলা হবে : ‘তোমার জানা নেই যে, তোমার পর তারা কী করেছিল! তারা পতনশীল আচরণে (র্শ্িেকর অবস্থায়) ফিরে গিয়েছিল।’
বুখারী একই রকম হাদীস আর-রুকুক অধ্যায়ে হুযায়ফাহ (১৪৩৫ নং), আবদুল্লাহ্্ (১৪৩৫ নং), সাহল ইবনে সা’দ (১৪৪২ নং), আবু সাইদ আল-খুদরী (১৪৪২ নং), ইবনে আব্বাস (১৪৪২ নং), আবু হুরায়রাহ (১৪৪৩ নং) এবং আসমা বিনতে আবি বকর (১৪৪৯ নং) থেকে বর্ণনা করেছেন এবং তাফসীর ও বাদাউল খাল্্ক অধ্যায়েও বর্ণনা করেছেন। একই হাদীস কিছু শব্দগত পার্থক্যসহ মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাযাহ, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল তাঁদের গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। ইমাম মালিক তাঁর মুয়াত্তায় (কিতাব আল-তাহারাত অধ্যায়ে, হাদীস নং ২৮) কয়েকজন সাহাবী থেকে বর্ণনা করেছেন।
ইমাম মালিক তাঁর মুয়াত্তায় কিতাব আল জিহাদ এ ৩২ নং হাদীস হিসাবে নি¤েœর হাদীসটি এনেছেন :
মহানবী (সা.) ওহুদের শহীদদের উদ্দেশে বলেন : ‘আমি তাদের ব্যাপারে সাক্ষী।’ তখন আবু বকর বলেন : ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ্্! আমরা কি তাদের ভাই নই? আমরা তাদের মতো ইসলাম গ্রহণ করেছি এবং তাদের মতো জিহাদ করেছি।’ মহানবী (সা.) জবাব দেন : ‘হ্যাঁ, কিন্তু আমি জানি না যে, আমার পরে তোমরা কী করবে...।’
উদাহরণস্বরূপ দেখুন, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের প-িত মাহমুদ আবু রিয়াহ প্রণীত আদওয়া আলাল সুন্নাত আল মুহাম্মাদীয়াহ, পৃ. ৩৩৯-৩৬৩, এবং আল্লামা হিল্লী কর্তৃক প্রণীত নাহজ আল হাক্্ক ওয়া কাশ্্ফ আস সিদ্্ক, পৃ. ২৬২-৩৭৫; এ দু’টি গ্রন্থ পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াত ও রাসূলুল্লাহ্্ (সা.)-এর অনেক হাদীস আলোচনা করেছেন যেগুলো পথপ্রদর্শক হিসাবে রাসূলের প্রত্যেক সাহাবীর নক্ষত্রতুল্য হওয়ার সম্ভাবনার ব্যাপারটিকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করে।
২. ইবনে সা’দ তাঁর তাবাকাত গ্রন্থে (লেইডেন, ১৩২২) ২য় খ-ের ১২৯ পৃষ্ঠায় খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর হযরত আবু বকরের একটি ভাষণ উল্লেখ করেছেন, যেখানে তিনি বলেছেন : ‘আমি একজন মানুষ মাত্র এবং আমি তোমাদের চেয়ে উত্তম নই। সুতরাং আমার আনুগত্য কর যখন আমি সোজা পথে চলি এবং আমাকে সংশোধন কর যখন আমাকে ভুল পথে দেখ। তোমাদের জানা উচিত যে, (কখনও) আমি শয়তান দ্বারা প্রভাবিত হই। সুতরাং যখন তোমরা আমাকে ক্রোধান্বিত দেখ, তখন আমার থেকে দূরে থেক।’ একই রকম বক্তব্য তাঁর থেকে লিপিবদ্ধ করেছেন :
ক. তাবারী তাঁর তারিখে, (কায়রো, ১৩৫৭), ২য় খ-, পৃ. ৪৪০;
খ. ইবনে কুতায়বা তাঁর আল-ইমামাহ্্ ওয়াস সিয়াসাহ্্ (মাকতাবাতুল ফুতুহ আল-আদাবিয়্যাহ, ১৩১), পৃ. ৬;
গ. আল হায়সামী, মাজমাউল যাওয়ায়েদ (১৩৫২), ৫ম খ-, পৃ. ১৮৩;
ঘ. আল-মুত্তাকী, কানজুল উম্মাল (হায়দারাবাদ, ১৩১২) ২য় খ-, পৃ. ১৩৬ এবং অন্যরা।
দ্বিতীয় খলীফা উমর প্রায়ই বলতেন, ‘প্রত্যেকেরই (শরীয়ত সম্পর্কে) উমরের চেয়ে বেশি জ্ঞান রয়েছে (কুল্লু আহাদিন আ’লামু মিন উমার) এবং ‘সকল লোকের (শরীয়ত সম্পর্কে) উমরের চেয়ে বেশি বুঝ আছে’ (কুল্লু আহাদিন আফকাহু মিন উমার)। এর জন্য দেখুন :
ক. আল-বায়হাকী, সুনান (হায়দারাবাদ, ১৩৪৪), ৭ম খ-, পৃ. ২৩৩;
খ. আল-সুয়ূতী, আল-দুররুল মানসূর (আল মাতবাআতুল মাইমানিয়্যাহ্্, ১৩১৪), সূরা ৪, আয়াত ২০ এবং সূরা ৩৪, আয়াত ১৩ এর তাফসীর;
গ. আল-জামাখশারী, আল-কাশশাফ (মিসর, ১৩৫৪), সূরা ৪, আয়াত ২০ এবং সূরা ৩৪, আয়াত ১৩ এর তাফসীর;
ঘ. আল-মুত্তাকী, কানজুল উম্মাল, ৮ম খ-, পৃ. ২৯৮;
ঙ. আল-হায়সামী, মাজমাউল যাওয়ায়েদ, ৪র্থ খ-, পৃ. ২৬৩।
৩. হযরত আয়েশা কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীসে যায়েদ ইবনে আরকাম এবং একজন মহিলার লেনদেনের বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে। এ হাদীসটি উল্লেখ করা হয়েছে :
ক. আবদুর রাযযাক, আল মুসান্নাফ;
খ. ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল, তাঁর মুসনাদে;
গ. আল-জাসসাস, আহকামুল কুরআনে;
ঘ. আল-সারাখশী, মাবসুত;
ঙ. আল-দাবুসী, তাসীস আন-নাযার, এবং অনেক সুন্নী আইনজ্ঞ, হাদীসশাস্ত্রবিদ এবং তাফসীরকারই তাঁদের গ্রন্থাদিতে এটি উল্লেখ করেছেন।
৪. বুখারী, মুসলিম, দারিমী, ইবনে আবি শায়বাহ, নাসাঈ, ইবনে আসির, গাযযালী, মুত্তাকী, ইবনে খালদূন এবং আবু হিলাল আল-আসকারী কতিপয় হাদীস উল্লেখ করেছেন যেখানে কতিপয় সাহাবী কর্তৃক মদ বিক্রির বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে।

(প্রবন্ধটির প্রধান অংশ সংকলিত হয়েছে প্রখ্যাত ভারতীয় আলেম সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন লক্ষৌভী রচিত ‘আবাকাত আল আনওয়ার’ থেকে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.