নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

প্রিয়দেশ...

আহসান কামরুল

পৃথিবীটা বদলাক যুক্তির চর্চার দ্বারা। বিশ্বাসের ভাইরাস ছড়ানো এ দেশটা বদলে যাক...।

আহসান কামরুল › বিস্তারিত পোস্টঃ

সাভারের অধরচন্দ্রের মাঠ বনাম আজকের ভূমিকম্প, দ্বিতীয়বার জীবন পাওয়ার অনুভূতি

২৫ শে এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১০:১৮

গতকাল ছিলো ২৪ এপ্রিল। সাভারের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে চোখের সামনে হাজারো মানুষের করুণ মৃত্যুর দুই বছরে গড়ানোর দিন। ঘটনাক্রমে আজ ২৫ এপ্রিল, ২০১৫ খ্রি.। আজ আমার বারবার মনে পড়ছে সাভারের অধরচন্দ্র বিদ্যালয়ের সেই মাঠের কথা। যেখানে কিছুক্ষণ আগের জীবিত, স্বপ্নের ফেরিওয়ালা মানুষদেরকে 'লাশ' হিসেবে রাখা হচ্ছে। ঘোষণা করা হচ্ছে, মৃতের সারিতে আরেকটি সংযোজনের কথা। স্বজনদের উপচে পড়া ভিড়। যাদের স্বপ্ন এখনো পরোপুরি নিভে যায়নি, তাদের স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দিতে সেদিন ছুটে গিয়েছিলাম আমার তখনকার অফিসের কলিগ, পরিচিতজনদের নিয়ে। রক্ত দেয়ার জন্য। নিজেদের রক্তের বিনিময়ে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম গ্রাম থেকে আসা পরিশ্রমী মানুষদর ছোট, ছোট স্বপ্নকে। প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলাম, মুনাফাখোরদের স্বচ্ছাচারিতার। জেগে ওঠেছিলো মানুষ। জনমতের চাপে গ্রেপ্তার হয়েছিলো রানা প্লাজার মালিক রানা। কিন্তু বিচারহীনতার এ দেশে রানা'রা এখন পার পেয়ে যাওয়ার পথে। আমরাও ভুলে যাচ্ছি হৃদয়ে ভূমিকম্প জাগানো সেই 'মৃত্যু'র কথা।





কিন্তু আজ অধরচন্দ্রের মাঠের কথা আবার মনে পড়ার কারন? কারন হলো, আজকের ভূমিকম্পের পর ঢাকা শহরের প্রায় সব জায়গা হতে পারতো অধরচন্দ্রের সেই মাঠ। যেখানে আপনার, আমার 'উদ্ধার করা মৃতদেহ' সারি দিয়ে রাখা হতো। ঘোষণাকারীর নজরে, নলেজে আসলে তখন আপনার, আমার সুন্দর নাম থাকতো না। তখন একটাই নাম, 'লাশ'। মাইকে ঘোষণা হতো, 'উদ্ধার কার্যক্রমে অগ্রগতি! লাশের মিছিলে বাড়লো আরেকটি মৃতদেহ। লাশের পরিচয় পাওয়া যায়নি, বা পকেটে থাকা আইডি/ভিজিটিং কার্ড থেকে লাশের পরিচয় পাওয়া গেছে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য, লাশ সনাক্ত করতে মৃতদেহ রাখা হলো মাঠের অমুক জায়গায়। আপনারা হুড়োহুরি করবেন না। সবাইকে দেখার সুযোগ দিন।' আপনার, আমার বেঁচে থাকা পাগলপ্রায় স্বজনরা দিনের পর দিন না খেয়ে থাকলেও তখন অনেক শক্তি ফিরে পেতেন। আশা একটাই, এই বুঝি পেলাম আমার বাছাধনের দেহটা। অন্তত: শেষবারের জন্য হলেও যদি তার মুখটা দেখতে পারি...।









'পোড়াকপালে'র জাতি আমরা! মরার পরেও এতো 'সুখ' ধরবে আপনার, আমার কপালে? যদি না ধরতো, তবে পড়ে থাকতাম হয়তোবা ভেঙ্গে পড়া কোনো বিশাল কংক্রিটের নিচে। সেখানে দিনের পর রাত আসতো। ভাবতাম, এই বুঝি কেউ আসছে, হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে উদ্ধার করার জন্য। কিন্তু না। আসে না, কেউ আসে না। রাত যে কখন আসতো টেরই পেতাম না। তখন চলতো শেষ মূহুর্তের লড়াই। বেঁচে থাকার জন্য। যেমন লড়াই করেছিলো রানা প্লাজা, আর তাজরিনের সেই মানুষগুলো। রাত পেরিয়ে কখন ভোর হতো হয়তো টের পেতাম না। এরই মধ্যে ক্লান্ত শরীর আবার সতেজ হয়ে ওঠতো মুয়াজ্জিনের সুললিত কণ্ঠে 'আস-সালাতু খাইরুম মিনান্নাওম...' ডাক শুনে। শুরু হতো আরেকটি ভোরের। আরেকটি নতুন দিন। নতুন আশায়, কারো বাড়ানো হাতের অপেক্ষায়। কিন্তু না, আসে না, কেউ আসে না। এর মধ্যে 'উদ্ধার কার্যক্রম' বন্ধ ঘোষণা করা হতো। আপনাকে, আমাকে উদ্ধার না করেই। 'উদ্ধার' বন্ধের মাইকের ঘোষণা কানে বাজতো। কিন্তু কিছুই করার থাকতো না। শত চিৎকার করলেও শুনতো না কেউ। রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হতো! আপনার, আমার জন্য রাষ্ট্রের কতো 'দরদ'!



দেশ, বিদেশের টিভি চ্যানেল, দৈনিক পত্রিকা, অনলাইন সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের লাইভ টেলিকাস্ট'র চলতো তুমুল প্রতিযোগিতা। চলতো লাশের সংখ্যা নিয়ে হিসাব, নিকাশ। বাড়ানো, বা কমিয়ে বলে 'রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল'র চেষ্টা। অধরচন্দ্রের মাঠের মতো তাদের দৌড়াদৌড়ি চলতো গাউসুল আযম মসজিদের মাঠের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। তারা কেউ কেউ চেষ্টা করতেন স্বজনদেরকে লাশ চেনানোর। যাতে অন্তত মৃতদেহটা পেতে পারে পরিবার। কোনো সাংবাদিক আবার চলে যেতেন 'ধ্বংসস্তুপের' ভেতর। নিজের জীবন বাজি রেখে। হয়তোবা সেই ১৮ তলায়! যেটা এসে ঠেকতো মাত্র তিন, বা চার তলায়। দেখানোর চেষ্টা করতেন, স্বপ্নভাঙ্গা মানুষদের শেষ পরিণতি! দেখাতেন অপরিকল্পিত নগরায়নের ফল। ক্ষমতাসীন দল, কর্তৃপক্ষ, ঢাকার সম্ভাব্য মেয়রদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতেন অপরিকল্পিত ঢাকার পরিণতি! হইচই হতো কিছুদিন। আবার ফিরে যেতো সবাই, যার যার কাজে। এভাবেই আস্তে, আস্তে ভুলে যেতো মনভোলা এ জাতি। এতেই সুযোগটা পেতো রাজনৈতিক দল, ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী। বিচার হতো না, ইমারত নির্মানে দায়িত্বশীলদের গাফলতির।



আর এ চিন্তার মাঝে তখন চোখের সামনে ভেসে ওঠতো মায়ের আহাজারির সেই করুণ চিত্র। ভাই হারানো বোনের বিলাপের সেই ছবি। প্রেয়সী'র ঠোটের মিশ্র অনুভুতিতে শিহরিত হতো দুই ঠোট। তার অভিমানি, আর সবার সামনে স্মার্ট হলেও আমার সঙ্গে তার 'বোকা, বোকা কথা' মনে পড়তো তখন। আল্লাহর ওপর ভরসাই থাকতো তখন একমাত্র অবলম্বন। এমন সময় হয়তো পাশের কোনো এক 'পোড়াকপাল'র গোঙ্গানির আওয়াজ ভেসে আসতো কানে। তার ওপরে পড়ে থাকা কংক্রিট সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা হতো নিজের সাধ্যমতো। তখনি সৃষ্টিকর্তা উদ্ধারকারী কোনো 'ফেরেশতা'কে পাঠাতেন, আমাকে উদ্ধার করার জন্য। তিনি হয়তোবা সইতে পারতেন না আমার মা, বোন, আর প্রেয়সীর চোখের জল।









'উদ্ধারকারী' দল আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতেন হাসপাতালে। রক্ত লাগবে, অনেক রক্ত। ডাক্তার ঘোষণা করতেন, এক্ষুণি লাগবে রক্ত। স্রষ্টার সেরা সৃষ্টির কোনো একজন ডাক্তারকে বলতেন, 'কোন গ্রুপের রক্ত লাগবে। আমারটা নেন।' ডাক্তার বলতেন, 'বি পজেটিভ'। সেখানেও হুড়োহুড়ি। সবাই 'বি পজেটিভ'। রানা প্লাজায় দেয়া সেই রক্ত ফিরিয়ে দেয়ার প্রতিযোগিতা। জনতার এ পজেটিভ মানসিকতার কারনেই টিকে আছে বাংলাদেশ। আল্লাহ টিকিয়ে রেখেছেন আমাদের প্রিয় এ মাতৃভূমিকে। এ গল্পের মতো করে ধ্বংস করেননি এ দেশকে। গল্পের এ অবস্থার মতো এমন করুণ অবস্থায় স্রষ্টা ফেলেননি আমাকে, বা আপনাকে। তবে একেবারে কমও হয়নি 'অভিজ্ঞতা'! ভূমিকম্পের সময় কর্মস্থল রাজধানীর একটি ১৮ তলা ভবন থেকে নামার সময়। আমাদের মানসিকতা যদি হতো রাজনৈতিক দল, কর্তৃপক্ষ আর আমলাদের মতো, তবে হয়তো তিনি এ জনপদকে ধ্বংস করে দিতেন এ গল্পের মতো। তাই ঢাকা শহরকে নিয়ে নতুন করে ভাবার এখনি সময়। ভাবুন। আন্দোলন করে 'দায়ত্বশীল'দেরকে ভাবাতে বাধ্য করুন। নয়তো আপনার মাথার ওপরেও কংক্রিট ধসে পড়বে ওপরের গল্পের মতো।



(বি.দ্র: এ লেখায় ব্যবহৃত সব ছবি সাভারের রানা প্লাজার করুণ ট্রাজেডির। অনলাইন থেকে নেয়া হয়েছে ছবিগুলো। আজ শনিবার ভূমিকম্পের সময় আমার কর্মস্থল রাজধানীর একটি বহুতল ভবনের ১৮ তলা থেকে নামতে গিয়ে মানুষের আর্তনাদ, চিৎকার, আর স্বপ্নের ফেরিওয়ালাদের স্বপ্নভাঙ্গার ভয় দেখেছি। অবশ্য, এ লেখার সুযোগ পাবো তখন একবারও বিষয়টি মাথায় আসেনি। সৃষ্টিকর্তার অপার মেহেরবানীতে মনে হয় আজ আবার 'দ্বিতীয়বার জীবন পেলাম'।)



আহসান কামরুল

২৫.০৪.২০১৫ খ্রি.

ঢাকা

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.