![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ঢাকা শহরে একজন ‘হন্টন পীর’ আছেন। তাঁর একমাত্র কাজ সারাদিন হাঁটা। একা হাঁটেন না। ভক্তদের নিয়ে হাঁটেন। একজন বাবার মাথায় ছাতা ধরে থাকে। একজনের হাতে থাকে পানির বোতল। অন্য একজনের হাতে কলার কাদি। বাবা খুব সম্ভব কলার ভক্ত। আমি বেশ কয়েকবার দূর থেকে এই হন্টন বাবাকে লক্ষ করেছি। একবার মিনিট পাঁচেক বাবার আশেপাশেই ছিলাম। উদ্দেশ্য বাবার ঘটনাটা কী জানা। বাবার জনৈক ভক্ত আমাকে চিনে ফেলে অবাক হয়ে বলল, আপনি বাবার কাছে কী চান? আমি বললাম, গল্প চাই!
আমি আমার যৌবনে হন্টন পীরের মতো একজনকে পেয়েছিলাম। আমরা দলবেঁধে তার পেছনে হাঁটতাম। তিনি যদি কিছু বলতেন মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। গভীর রাতে নীলক্ষেত এলাকায় তিনি হাঁটতে হাঁটতে আবেগে অধীর হয়ে দুই হাত তুলে চিৎকার করতেন। ‘আমার বাংলাদেশ! আমার বাংলাদেশ!’ আমরা গম্ভীর মুগ্ধতায় তার আবেগ এবং উচ্ছ্বাস দেখতাম। তাঁর নাম আহমদ ছফা। আমাদের সবার ছফা ভাই।
ছফা ভাই ছিলেন আমার Mentor. এই ইংরেজি শব্দটির সঠিক বাংলা নেই। Mentor এমন গুরু যার প্রধান চেষ্টা শিষ্যকে পথ দেখিয়ে উঁচুতে তোলা। ছফা ভাই শুধু যে একা আমার Mentor ছিলেন তা না, অনেকেরই ছিলেন।
দেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে। শিশু রাষ্ট্র জন্মের যন্ত্রণায় তখনো ছটফট করছে। আর ছফা ভাই ছটফট করছেন আবেগে এবং উত্তেজনায়। কত অদ্ভুত অদ্ভুত পরিকল্পনা তার মাথায়। দেশকে শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীতে এভারেস্ট শিখরের কাছাকাছি নিয়ে যেতে হবে। দেশ মেধা এবং মননে পৃথিবীর সব রাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে। ইত্যাদি।
ছফা ভাই এমন একজন মানুষ যিনি তার উত্তেজনা নিমিষে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারেন। আমরাও ছফা ভাইয়ের মতোই উত্তেজিত হই। কল্পনায়। ভাসে ভবিষ্যতের অপূর্ব বাংলাদেশ।
ছফা ভাই সাপ্তাহিক একটা পত্রিকা বের করে ফেললেন। নিজেই সম্পাদক, মুদ্রাকর এবং প্রধান লেখক। তিনি আমাকে ডেকে বললেন, গল্প লেখা শুরু করে দাও। রোজ রাতে একটা করে গল্প লিখতে হবে। আমার পত্রিকায় নিয়মিত গল্প ছাপা হবে। ছফা ভাইয়ের কথা মানেই আদেশ। আমি রাত জেগে গল্প লিখে ফেললাম। আজ আর সেই গল্পের নাম মনে নেই। গল্প কী লিখেছিলাম তাও মনে নেই। ছফা ভাইয়ের পত্রিকাটার কথাও মনে নেই। দুই-তিন সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। ছফা ভাই তখন দারুণ অর্থকষ্টে। থাকার জায়গা নেই। ক্ষীণ সম্ভাবনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে সিট পাবেন। পাচ্ছেন না। একদিন আমি ছফা ভাইকে ভয়ে ভয়ে বললাম, হলে সিট পাওয়া পর্যন্ত আমাদের বাসায় কি থাকবেন?
আমার মা তখন বাবর রোডে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের স্ত্রী হিসাবে একটা বাড়ির দোতলাটা বরাদ্দ পেয়েছেন। সেখানে না আছে পানির ব্যবস্থা, না আছে কিছু। ছফা ভাই আমাদের সঙ্গে থাকতে রাজি হলেন। আমরা তাঁকে সবচেয়ে বড় কামরাটা ছেড়ে দিলাম। মা তার নিজের সন্তানদের যে মমতায় দেখেন, একই। মমতা ছফা ভাইয়ের দিকেও প্রসারিত করলেন।
ছফা ভাই বাইরে-বাইরেই থাকতেন, রাতে এসে শুধু ঘুমাতেন। বেশির ভাগ সময় বাইরে থেকে খেয়ে আসতেন। অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে যাওয়া পরিবারটির ওপর বাড়তি চাপ হয়তো দিতে চান নি।
প্রতিদিন বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ছফা ভাই কিছু সময় মা’র সঙ্গে কাটাতেন। গত রাতে যেসব স্বপ্ন দেখেছেন তা মাকে বলতেন। মার দায়িত্ব স্বপ্ন ব্যাখ্যা করা। আমার ধারণা, ছফা ভাই স্বপ্নগুলি বলতেন বানিয়ে বানিয়ে। স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে মাকে খুশি করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। আমার এরকম ধারণা হওয়ার কারণ হলো, ছফা ভাইয়ের স্বপ্নগুলিতে ডিটেলের কাজ খুব বেশি থাকত। স্বপ্নে এত ডিটেল থাকে না। একটা স্বপ্ন বললেই পাঠক বুঝতে পারবেন
কাকিমা, কাল রাতে স্বপ্নে দেখলাম দুটা কাক। একটা বড় একটা ছোট। ছোট কাকটার একটা নখ নেই। তার স্বভাব চড়ুই পাখির মতো। তিড়িং বিড়িং করে সে শুধু লাফায়। বড়টা শান্ত স্বভাবের। সে একটু পর পর হাই তোলার মতো করে। তাদেরকে ধান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা কেউ ধান খাচ্ছে না। ধানগুলি ঠোঁটে করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিচ্ছে। এখন কাকিমা, বলুন, স্বপ্নটার অর্থ কী? আমি বিরাট চিন্তায় আছি।
বলতে ভুলে গেছি, আমার প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকে কিন্তু এর মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। ব্যবস্থা করে দিয়েছেন ছফা ভাই। খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানির খান সাহেবকে পাঠিয়ে এই কাজটা করা। তখন তিনি লেখক শিবির নামক সংগঠনের প্রধান। তিনি লেখক শিবির থেকে নন্দিত নরকে উপন্যাসকে বছরের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসাবে পুরস্কারও দিয়ে দিয়েছেন। আমি অতি তরুণ ঔপন্যাসিক। আমার ওপর ছফা ভাইয়ের অনেক আশা। তার ধারণী, আমি অনেকদূর যাব। তিনি চেষ্টা করছেন আমার অনেকদূর যাত্রার পথ যেন সুগম হয়।
ছফা ভাই ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে সিট পেলেন। তিনি উঠে এলেন হোস্টেলে। আমি থাকি মুহসীন হলে। নিয়ম করে আমি এবং আমার বন্ধু আনিস সাবেত প্রতি রাতে তাঁর কাছে যাই। গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা হয়। আড্ডা মানে ছফা ভাই কথা বলেন, আমরা দুজন শুনি। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে কথা। তিনি মহাকবি গ্যাটের রচনার বাংলা অনুবাদে হাত দিয়েছেন। অনুবাদ পড়ে শোনান।
একবার তাঁর ঘরে গিয়ে দেখি, তিনি বিশাল এক বাদ্যযন্ত্র কিনেছেন। সেকেন্ডহ্যান্ড জিনিস। দেখতে নিচু আলমারির মতো। ছফা ভাই জানালেন, প্রতি রাতেই তাঁর মাথায় নানা ধরনের সুর আসছে। সুর ধরে রাখার জন্যই এই বাদ্যযন্ত্র।
আমি বললাম, ছফা ভাই! আপনি বাজাতে পারেন?
ছফা ভাই বললেন, অবশ্যই পারি।
তিনি বাদ্যযন্ত্রটার রিড টিপতে লাগলেন। বিচিত্র শব্দ হচ্ছে। তিনি পায়ে তাল দিচ্ছেন এবং মাথা নাড়ছেন।
এই সময় তিনি গান লিখতে শুরু করলেন। গান লিখে সঙ্গে সঙ্গে সুর দিয়ে দেন। আমি এবং আনিস সাবেত অবাক হয়ে সেই সঙ্গীত শুনি।
হঠাৎ একদিন শুনি ছফা ভাই দেশে নেই। গাদ্দাফির নিমন্ত্রণে লিবিয়া চলে গেছেন। লিবিয়ায় বেশ কিছুদিন কাটিয়ে দেশে ফিরলেন। তাঁর মাথায় রঙিন গোল টুপি। আমাদের জানালেন, গাদ্দাফি নিজের হাতে তার মাথায় এই টুপি পরিয়ে দিয়েছেন। তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে গাদ্দাফির গ্রিন বুক অনুবাদের। ছফা ভাইয়ের অনেক কথাই কল্পনারাজ্যের। তবে এই কথাটা হয়তো ঠিক। ছফা ভাইয়ের হাতে টাকাপয়সার নড়াচাড়া দেখা গেল। তিনি একটা প্রেস কিনে ফেললেন। কিছুদিনের মধ্যেই সেই প্রেস উঠেও গেল। ছফা ভাই কাঁধে একটা টিয়া পাখি নিয়ে ঘুরতে লাগলেন। তিনি নাকি টিয়া পাখির অনেক কথা বুঝতে পারেন।
একটা পর্যায়ে আমার ক্ষীণ সন্দেহ হওয়া শুরু হলো যে, তিনি যে জগতে বাস করেন তা সম্পূর্ণই তাঁর নিজের। বাস্তব জগৎ থেকে অনেকটা দূরের। তাঁর রিয়েলিটি এবং আমাদের রিয়েলিটি এক নয়।
কারো যখন মোহভঙ্গ হয় তখন অতি দ্রুতই হয়। আমি তার বলয় থেকে সরে গেলাম। আনিস সাবেত পিএইচডি করার জন্য আমেরিকা চলে গেলেন। ছফা ভাই তার জন্য নতুন বলয় তৈরি করলেন। তিনি শূন্যস্থান পছন্দ করেন না।
ছফা ভাইকে নিয়ে আমার অসংখ্য স্মৃতি আছে। তার ওপর দুশ’ পাতার একটা বই আমি অবশ্যই লিখতে পারি। এখানে একটি স্মৃতি উল্লেখ করছি। ১৯৮৫ বা ৮৬ সালের কথা। এতদিন লেখালেখির জগতে থেকেও ছফা ভাই বাংলা একাডেমী পুরস্কার পান নি। আমি পেয়েছি অথচ ছফা ভাই পান নি, খুবই লজ্জিত বোধ করি। কীভাবে কীভাবে আমি তখন বাংলা একাডেমীর কাউন্সিলারদের একজন। পুরস্কার কমিটিতে আছি। আমি জোরালোভাবে ছফা ভাইয়ের পুরস্কারের ব্যাপারটা বললাম। যথারীতি তা নাকচও হয়ে গেল। আমি ছফা ভাইয়ের জন্য সুপারিশ করেছি—এই খবর ছফা ভাইয়ের কানে পৌঁছল। তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি তার বাসায় উপস্থিত হলাম। তিনি বললেন, হুমায়ুন, আপনার এত বড় স্পর্ধা যে আপনি আমার জন্য সুপারিশ করেন!
আমি চেয়ারে বসেছিলাম। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে ক্ষমা প্রার্থনা করলাম।
ছফা ভাই বললেন, আমি বসতে না বলা পর্যন্ত এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন।
আমি বললাম, জি আচ্ছা।
আপনি আর কখনোই আমার বাসায় আসবেন না।
আমি বললাম, জি আচ্ছা।
ছফা ভাইয়ের সঙ্গে এটাই সম্ভবত আমার শেষ দেখা। ভুল বললাম, আনিস সাবেত ক্যান্সারে মারা যাওয়ার সংবাদ দিতে আমি আরো একবার তাঁর কাছে গিয়েছিলাম। তিনি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকার পর ‘আনিসরে’ ‘আনিসরে’ বলে চিৎকার করে কাঁদলেন।
কান্না বন্ধ হবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর নিজের ভুবনে ঢুকে গেলেন। চলে গেলেন রিয়েলিটির বাইরে। আনিস সাবেত ট্রাস্টি বোর্ড করতে হবে। সেই ট্রাস্টি দুস্থ লেখকদের বৃত্তি দেবে। দরিদ্র লেখকদের বই প্রকাশনার দায়িত্ব নেবে। ট্রাস্ট ফান্ড একটা আধুনিক স্কুল করবে টোকাইদের জন্য।
তিনি কাগজ-কলম নিয়ে বসে গেলেন ট্রাস্টি বোর্ডের পরিচালক কারা কারা থাকবেন তাদের নাম লেখার জন্য। ট্রাস্টি বোর্ডের নীতিমালাও লিখতে হবে। তাঁকে দারুণ উত্তেজিত মনে হলো। তিনি লিখছেন, আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছি অন্যভুবনের মানুষটিকে।
আমাকে নিয়ে ছফা ভাইয়ের অনেক স্বপ্ন ছিল। আমি তাঁর কোনোটাই পূরণ করতে পারি নি। এত মেধা আমার ছিল না। প্রতিটি মানুষের আলাদা আলাদা বৃত্ত থাকে। কেউ সেই বৃত্তের বাইরে যেতে পারে না। আমিও পারি নি। ছফা ভাই নিজেও পারেন নি। তাকে বন্দি থাকতে হয়েছে নিজের বৃত্তেই।
বই : বলপয়েন্ট
– হুমায়ূন আহমেদ।।
শুভ জন্মদিন কিংবদন্তি আহমদ ছফা।।
২| ৩০ শে জুন, ২০২৫ রাত ৯:০৮
সৈয়দ কুতুব বলেছেন: আহমেদ ছফা জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক স্যারের ছাত্র ছিলেন। চট্টগ্রামের গর্ব। সিরাজ শিকদারের বোন শামীম শিকদারকে বিয়ে করতে না পেরে আজীবন অবিবাহিত থেকে গেলেন ।
৩০ শে জুন, ২০২৫ রাত ৯:২২
আজব লিংকন বলেছেন: সিরাজ শিকদার মানে সর্বহারা পার্টির ?
এটা জানা ছিল না ভাই।
©somewhere in net ltd.
১|
৩০ শে জুন, ২০২৫ রাত ৯:০০
ওমর খাইয়াম বলেছেন:
মনেপ্রানে বাংগালী ছিলেন।