![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
একটা প্রজাপতির পিছু ধেয়ে নিলু সোজা রাস্তাটা ফেলে ঝোপ-ঝাড়ে ঢাকা অব্যবহৃত পথে চলে এলো। এতো সুন্দর রঙ ! ডানাগুলো থেকে নিজের ভিতরে যদি সব রঙ নিতে পারত!! নিলুর কিশোরী মনে এই ইচ্ছেটা ডানা মেলে... এভাবে হঠাৎ হঠাৎ-ই ইচ্ছেরা ওকে ব্যতিব্যস্ত রাখে।
গ্রামের স্কুলের নয়টি ক্লাস অনেক কষ্টে সে পার করেছে। কষ্ট বলতে পড়ালেখার কষ্ট। সে চায় নীলাকাশের নীচে সাদা মেঘের ভেলায় মেঘবালিকা হয়ে ঘুরে বেড়াতে... ঘাস ফড়িঙ্গের হঠাৎ ছিটকে উঠা দেখে অভিভূত হতে... খালের বুক চিরে যে ছোট্ট শাখাটি ওদের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে, তাঁর পাশের ঝোপ থেকে বৈচি না হয় ম্লান বেত ফল কোচর ভরে তুলে আনতে! খালের পানিতে ছাবি দিয়ে চিংড়ি মাছ ধরে নারিকেলের শলায় গেঁথে পুড়িয়ে খেতে। এসবই ওর বড্ড পছন্দ। না হলে এক স্কুল মাস্টারের মেয়ে হয়েও পড়ালেখায় কেন এত কষ্ট লাগবে ওর?
বাবার সাথে স্কুলে দেখা হয়... আর ভোর বেলায় জোর করে ওকে ঘুম থেকে তোলার সময়। সেই সময় বাবাকে মেরেই ফেলতে ইচ্ছে হয়... কিন্তু খালি পায়ে বাবার সাথে ঘাসের বুকের জমাট শিশিরকে অনুভব করার সময়ে... বাবার জন্য পৃথিবীর সব ভালোবাসা এসে ভীড় করে ওর কিশোরি মনে! ওনার হাত ধরে সে হেঁটে যায় অনেকদূর... ইস! যদি মাইলের পর মাইল বাবার সাথে এভাবে হেঁটে যেতে পারত!
মা কে পায় দিনের বাকি সময়টাতে। সারাক্ষন ওকে চোখে চোখে রাখায় ব্যস্ত একজন মহিলা। আর পদে পদে কমপ্লেইন, 'নিলু এটা করিস না... এভাবে না... কেন করেছিস বল... ধিঙ্গি হচ্ছিস, বুদ্ধি শুদ্ধি কবে হবে বলতো... ... ...।' তবে সব কিছুর সাথে তাঁর অদৃশ্য এক হাসিমুখ থেকেই যেত। এক মায়ের মুখ... পৃথিবীর সব মায়ের মুখ! আর ঘরে-বাইরের সব কাজ শেষ হলে রাতে ওকে নিয়ে বসতেন। মাথার চুলে তেল দিয়ে চিরুনী বোলানোর ঘুম ঘুম আবেশ এনে দেয়া সেই মুহুর্তগুলো! কত রাত ওভাবে লুটিয়ে পড়েছে মায়ের কোলে। পরম মমতায় মা ওভাবেই রেখেছেন দীর্ঘক্ষণ। ভোর বেলায় বাবার ডাকে উঠবার সময়েও মায়ের মমতার আদিগন্ত বিস্তৃত বেড়াজাল সে অনুভব করেছে।
এই ভালবাসার নিগড়েই সে বড় হচ্ছিল... তিলে তিলে নিজের ভিতর থেকে আর একজনের জন্ম হচ্ছিল। একদিন নিজেই নিজেকে আবিষ্কার করে চমকে উঠে। বাবা-মা'র জন্য হৃদয়ের অলিন্দগুলোতে সকল ভালোবাসা জমে আছে। ভালোলাগাগুলো তাদেরকে ঘিরেই ডানা মেলেছে। হঠাৎ এই দুজনের বাইরেও অন্য 'একজন' কীভাবে যেন সেখানে ভাগ বসাতে এলো। হেলাল নামের এই যুবকটি ওদের পাশের গ্রামের। তবে পারিবারিকভাবেই এলাকার সবাই সবাইকে চিনে। এভাবেই ওর সাথে দেখা হতো... ওদের বাড়ি স্কুলে যাবার পথে পড়ে। যাওয়া আসার সময়গুলোতে দুজনের দেখা হতো। মৃদু খুনসুটি করত ... বান্ধবীদেরকে সাথে নিয়ে কান গরম হয়ে যাওয়া মেয়েলি কথাবার্তাও হতো মাঝে মাঝে ... সব হেলালকে ঘিরে। তবে ছোট ছোট দুষ্টুমির আড়ালে প্রলয়ংকারি ভালোবাসাকে ঘিরে এক কূটিল সর্বনাশের পথও যে প্রসস্ত হচ্ছিল...
সময়ের সাথে সাথে বাবা-মা সব জেনে যায়। স্কুল মাস্টার বাবার ঠান্ডা মাথার চিন্তা-ভাবনা এই কিশোরি মেয়ের এহেন বালিকাসুলভ প্রগলভতায় রুষ্ট হয়। মা তাঁর মমতাকে আড়াল করেন... কঠিন হতে বাধ্য হন। তবে এসবই ছিল মেয়ের ভালোর জন্য। কিন্ত সময় পানিকে অনেকদূর গড়িয়ে নিয়েছিল। হেলালের জন্য নিলুফারের ভালোবাসা সাময়িকভাবে বাবা-মাকেও ছাড়িয়ে গেছিলো। রমণীর মন যদি সহস্র সাধনার ধন হয়, তবে এক কিশোরির মন বিনা সাধনায় পাওয়া যায়। আর এই সুযোগটি-ই নিয়েছিল হেলাল। ঘরে বাইরে নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে অতিষ্ট নিলু একদিন হেলালের ভালবাসার টানে ওকে নিয়ে ঘর ছাড়ে।
আগে কক্ষনো নিলু ওদের গ্রাম ছেড়ে কোথায়ও যায়নি। জন্মের পর এই প্রথম বের হওয়া... নিজের ভালবাসার মানুষটির হাত ধরে পরম নির্ভরতায় চিরপরিচিত সেই মেঠো পথটি ধরে যাবার সময় কয়েকবার পিছু ফিরে চেয়েছিল। সেই মাঠ... ফড়িঙ বসার ঝোপ... প্রজাপতির রঙিন ডানা... বাঁশগাছের আড়াল... পুকুরপারের সেই উঁচু তালগাছ আর সেখানের বাবুইয়ের বাসাগুলো... এসব-ই ওকে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল। হয়তো এভাবে যেতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু একবার যে হাতকে সে শক্ত করে ধরেছে, সেই ভালবাসার হাতকে কীভাবে ছাড়ে?
হেলাল ওকে নিয়ে নদীর পাড়ে এক ঘিঞ্জি এলাকায় এলো। নিলু তখনো বুঝতে পারেনি, সে কোথায় এসেছে। হেলাল ওকে বলেছে যে এখানে ওর এক খালা থাকেন। সেখানে এক রাত থেকেই ওরা ঢাকা চলে যাবে। সরল বিশ্বাসে কিশোরি তা মেনে নিয়েছিল। হেলালের খালাকে দেখে নিলুর ভালো লাগল না। আরো কিছু মেয়েকে দেখতে পেল। সবাই কেমন মেকী রঙে রঙিন হয়ে ঘোরাফেরা করছে। একটা অশনিসংকেত ওর কচি বুকে টের পেলেও তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। একটা ছোট রুমে ওদের থাকার ব্যবস্থা করলেন হেলালের 'খালা'।
সেই রাতের কথা নিলুর আজীবন মনে থাকবে।
সেই রাত! এক কিশোরির নারী হয়ে ওঠার রাত! একজন নিলুর 'নীলায়' পরিণত হবার রাত।
হেলালের হাত ধরে ঘুমিয়ে ছিল সে। তবে কখন যে ভালবাসার মানুষটি সন্তর্পনে ওর পাশ থেকে সরে যায়... তাঁর যায়গায় অন্য একজন আসে... রাত্রীর অন্ধকার সেই কালো মানুষটির কদাকার চেহারা আর বিকৃত কামনার কদর্যতা নিলুর কাছ থেকে আড়াল করতে পারল না। হৃদয়ে ভালোবাসা নিয়ে প্রিয় মানুষটির সাথে মিলনের আকাঙ্ক্ষায় অপেক্ষারত এক কিশোরী মুহুর্তে একজন নারীতে পরিণত হয়... একজন দুই নাম্বার... একজন সেবাদাসী। আর ভালবাসার ফল্গুধারায় আজীবন সিক্ত হতে চেয়েছিল যে... সে অবাক বিষ্ময়ে অনুভব করে ভালবাসার পনের শ' সেকেন্ড!
এরপর রাতের পর রাত কেটেছে নীলা হয়ে... হেলাল নামের এক সময়ের প্রিয় মানুষটি ওকে বিক্রী করে চলে গেলো একটি পতিতালয়ে। একটি দমবদ্ধ ছোট কুঠরীতে। সেখানে এক রঙিন প্রজাপতি তাঁর ডানা হারিয়ে প্রতি রাতে মথেদের দ্বারা ধর্ষিত হতে থাকে। তবে প্রতিবার সে একটি সবুজ ঘাসের উপত্যকায় নিজেকে কল্পনা করে... সেখানে তাঁর হাত ধরে থাকে তাঁর ভালবাসার মানুষটি!
স্মৃতিসৌধের সামনে দাঁড়িয়ে এগুলোই ভাবছিল নীলা। হ্যা এখন আমরা তাঁর একটি নাম পেয়েছি। নীলা! সমাজের কাছে সে এখন নীলার মতই... অনেকের সহ্য হয় না এমন এক পাথর। চোখে পানির দাগ রয়ে গেছে গালে। সাথের ব্যাগ থেকে ছোট আয়না বের করে নিজেকে রমনীয় করার চেষ্টা করে। একটা গাড়ি এসে থামে পাশে। সেখান থেকে গ্লাস উঠিয়ে ওপাশ থেকে একজন ওর দিকে তাকায়। চোখে ইশারা করে... অপলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তাঁকে সম্পুর্ণ উপেক্ষা করে। বিপরীত দিকে চলে যায়। আজ সে নীলা হবে না। কিছুটা সময় নিলু হয়ে দেখবে কেমন লাগে। পিছন থেকে সেই গাড়ির ভদ্রলোকটির তীর্যক কথা শুনে একটু থামে। সে বলে চলেছে, ' কত ঢং করছিস, তোদের মতো ...দের জন্যই তো দেশের আজ এই অবস্থা। সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে...'। কেন জানি নিলু থেকে মুহুর্তে নীলা হয়ে সেই মানুষটির সামনে ফিরে আসে। দুহাত কোমরে রেখে বলে, ' আমাদের জন্য সব ধ্বংস হচ্ছে , না? তো তুই কি করছিস এখানে? আরে আমরা তো পেটের জন্য এইগুলা করছি। আর তোদের মত ভদ্রলোকেদের বউরা গিয়ে দেখ, শুধু শুধু তোরই বিছানায় অন্য কারো সাথে... তুই যেমন আমার কাছে এসেছিস, টাকা দিয়ে ক্ষুধা মিটাবি, ওরা বিনা টাকায় অতৃপ্তি মিটাচ্ছে গিয়ে দেখ।'
গাড়ির ভদ্রলোকটি প্রচণ্ড ক্রোধে গাড়ি থেকে বের হয়। সে ভুলে যায় সে কি করছে। আশেপাশের কয়েকজন মজা দেখছে... দাঁত বের করে একে অপরের শরীরে আঙ্গুলের গুতা দিয়ে নীলা আর ভদ্রলোকটির দিকে ইশারা করছে। সেই মানুষটি ভুলে গেছে সে কোথায় এবং কার সাথে ঝগড়া করছে। একটা হাত প্রচণ্ড জিঘাংসায় নীলার গালের ওপর আছড়ে পড়ে। একবারই... থাপ্পরের শব্দে অন্য শব্দ চাপা পড়ে যায়। একজন নীলা স্মৃতিসৌধের এই যায়গা থেকে স্লো-মোশনে অতীতে ফিরে যায়... যুবতী থেকে কিশোরি... পতিতালয়ের দুঃসহ সেই দিনগুলোতে... সেখানের প্রথম রাত... হেলালের হাত ধরে গ্রামের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে ফেলা দীর্ঘশ্বাস... বাবার হাত ধরে ঘাসের বুকে বিচরণ... মাথার চুলে তেল দেবার সময়ে আদরে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়া... ফড়িঙ আর প্রজাপতির পিছু ধেয়ে ঝোপের ভিতরে প্রবেশ করা... সরু খালের পাড়ের বৈচি ফল আর বেত ফল কোঁচড় ভর্তি করে বাড়ি ফেরা... ... এখান থেকে আবার উল্টো ভাবে ধাপে ধাপে এই স্মৃতিসৌধে ব্যথায় গালে হাত দিয়ে ঘাড় একপাশে কাত হয়ে তীব্র দৃষ্টিতে সেই লোকটির দিকে তাকিয়ে থাকা! সব কিছু মুহুর্তের ভিতরে ঘটে যায়। নিজের পায়ের স্যান্ডেল খুলে লোকটির গালে প্রচণ্ড এক আঘাত করে নীলা। এরপর একদম সহজ ভঙ্গীতে স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে জয় রেস্তোরাঁর দিকে রওয়ানা হয়।
রাস্তা পেরিয়ে রেস্তোরাঁর সামনে কিছু মানুষের উপস্থিতি লক্ষ্য করে। সেদিকে এগিয়ে যায়। কয়েকজন ওর দিকে তাকায়। এদের ভিতর থেকেই হয়তো কেউ একজন ওর ভালবাসার মানুষ রয়েছে। যে ওকে নিয়ে যাবে নির্দিষ্ট কোনো যায়গায়। কেটে যাবে ভালবাসার পনের শ' সেকেন্ড... একজন নীলা তখন একজন নীলুতে অবগাহন করবে।
আমাদের আশেপাশে এরকম নীলুদের নীলা হয়ে উঠা আমরা কখনো কি অনুভব করি?
আমাদের কি কিছুই করনীয় নাই?
শুধু ঘৃনায় নাক কুঁচকে ওদের থেকে ফিরে তাকানো-ই কি সভ্যতা?
অথবা কিছু মুহুর্তে মানুষ থেকে পশুমানবে রুপান্তরেই কি আমাদের সফলতা?
আমি জানি না... তবে জানতে চাইছি, আমার কি করনীয়??
১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ সকাল ৮:১১
আল মামুন খান বলেছেন: আমার ব্লগে স্বাগতম!
ভালোলাগা রেখে গেলেন, অনেক ধন্যবাদ।
শুভ সকাল।
©somewhere in net ltd.
১|
১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৫:৫৭
সুদীপ্ত সরদার বলেছেন: অনেক ভালো হইছে