![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি তন্ময়। ব্লগে আনাগোনা করি ২০০৫ সাল থেকে। সামু আমারে বহুবার ব্যান করছে আর আইডি খাইছে ২৭ টা । আমি সামু ছাড়ি নাই।
শহরের কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে বিয়ে অনুষ্ঠিত হলেও সেগুলোকে বিয়েবাড়ি বলা যায় না। কারণ তা না বরের বাড়ি, না কনের বাড়ি। তা বাণিজ্যিক ও নিরপেক্ষ একটা ভেনু। আবার আলোকা বাতি সজ্জিত পাচ ছয় তলা বিল্ডিংয়ের ছাদে ব্যান্ড সঙ্গীত বাজিয়ে যতোই নৈশভোজ চলুক, তাও বিয়েবাড়ি নয়। কেননা সে অ্যাপার্টমেন্টের দশ বারোটি ফ্যাটে বিয়ের আয়োজন বহির্ভূত অন্যান্য পরিবারগুলো থাকে। তাই বিয়েবাড়ির আনন্দ ও চাঞ্চল্য শুধু বিয়ে সংশ্লিষ্ট ফ্যাটেই দেখা যায়। সুতরাং শুভ বিয়ে অনুষ্ঠানরত সবুজ-শ্যামল গ্রামবাংলার বাড়িগুলোই বিয়েবাড়ি। তেমনি একটি আদি ও অকৃত্রিম বিয়েবাড়িতে ছিলাম নিমন্ত্রিত। আমার বড় ভায়রার প্রথম মেয়ে তানজিনার শুভ বিয়ে ছিল সেটি।
যথানিয়মে বিয়ের আগের দিন বিকেলে হাজির হলাম বিয়েবাড়িতে। সন্ধ্যায় মেহেদি, উপটন, চন্দনসহ গায়েহলুদ অনুষ্ঠান। চলছে ফটোসেশন। মুরব্বিরা একে একে কনের গায়ে হলুদ মাখাছেন, মিষ্টি খাইয়ে দিচ্ছেন।
হঠাৎ শুনলাম কনের বাবা, মানে আমার বড় ভায়রার ব্লাড পেশার বেড়ে গেছে। গিয়ে দেখি তার মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। কাছারিতে তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। গত কয়েকদিনের প্রস্তুতিমূলক ছোটাছুটিতে বেচারা গলদঘর্ম। টেনশনে ঘুম নেই। বড় মেয়ের বিয়ে বলে কথা, সোফাসেট, ডাইনিং টেবিল, শোকেস, ড্রেসিং টেবিল, বক্স খাট, আলমারি, সনি ২১ ইঞ্চি ফাট রঙিন টিভি, স্যামসাং ফ্রিজ ইত্যাদি যৌতুক হিসেবে দেয়া হলো।
যৌতুককে বলা হলো প্রীতি উপহার। যৌতুক নিয়ে কৌতুক আর কি!
হাড়ি-পাতিল থেকে বটি, দা, কুলা, লেপ, তোশক, বালিশ থেকে গ্যাসের চুলা -সব কিছু দিয়ে মেয়ের নতুন সংসার সাজিয়ে দেয়া হলো। আমার বড় ভায়রা, মানে কনের বাবাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দেয়া হলো। তিনি নাগেরদীঘি মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল। তাই এ বাড়িতে নাচ-গানের প্রশ্নই ওঠে না। তবু তিনি ঘুমিয়ে আছেন জেনে সুযোগটা লুফে নিল অন্দর মহলের মেয়েরা। ক্যাসেট রেকর্ডার আনা হলো পাশের বাড়ি থেকে। মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়লো বিয়ের আমেজ, হলদি বাটো মেন্দি বাটো, বাটো ফুলের মৌ...
মেয়েরা গলা মেলাচ্ছে। শিগগিরই জড়তা কেটে গেল সবার। মাশফি, নাফিসা ও লাবীব চমৎকার সব গান গেয়ে সবাইকে মুগ্ধ করলো।
তেহারি খেয়ে ঘুমানোর জন্য বিছানা খুজছি। কিন্তু সব বিছানাই মহিলা ও শিশুদের দখলে।
সেজভায়রা আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে চাপাস্বরে বললেন, আলীভাই (আমার মেজভায়রা) তার রাবণের গুষ্ঠি নিয়ে কর্নারের রুম দখল করেছে। ওই রুমটায় এটাচড বাথরুম আছে। তিনি কি ভিআইপি নাকি? আপনি, আমি কম বেতনের চাকরি করি বলে কি আমাদের দাম নেই? আমাদের বলা হয়েছে মাটিতে ফোরিং করে শুতে। নিকুচি করি এ বিয়ের। ভোরেই আমি কেটে পড়বো।
তাকে বোঝালাম, ভাইজান, তারা আগে এলে আগে পাইবেন ভিত্তিতে এ রুমটা পেয়েছেন। আপনার এবং আমার পরিবার এসেছে দেরিতে। তাছাড়া বিছানা বা চৌকিতে ঘুমালে আপনি হবেন চৌকিদার আর মাটি বা জমিতে ঘুমালে আপনি হবেন জমিদার। তাই জমিতে ঘুমানোই ভালো।
রাখুন আপনার রসিকতা। বিয়ে অনুষ্ঠানের পর আমি এ অপমানের এসপার-ওসপার করে ছাড়বো।
রাতে স্বপ্নে দেখলাম বিশাল এক বাটি ভরা গরুর মাংস সাবাড় করছি। আমার সামনের চেয়ারেই ডাক্তার বসেছেন। তিনি আমাকে সতর্ক করছেন, ভাই, আপনি হার্টের রোগী। গরুর মাংস খাবেন না। এটা বিষতুল্য। এতে আছে কোলেস্টেরল।
তবু গোগ্রাসে গিলছি। গরুর মাংস খেলেই শরীরটা গরম হয়ে যায়। এই যেমন এখন পিঠের নিচে গরম লাগছে। ঘুম ভেঙে গেল। হায়! কোথায় বিফ? এ যে দেখছি পাশে শুয়ে থাকা বিচ্ছু ছোড়াটার উষ্ণ হিসু। পিঠ ভিজে সয়লাব।
বড় ভায়রা শাহজাহানভাইয়ের বাড়িটা বিশাল। ছয়টা বড় রুমে আমরা প্রায় শখানেক মানুষ ঘুমিয়েছি।
পরদিন শুনলাম আমার একমাত্র শ্যালিকা শারমিনের মোবাইল ফোন চুরি গেছে। এদিকে শারমিনের কান্না, হই চই। সন্দেহের তালিকায় কাজের বুয়াদের নয়জনের মধ্যে আটজনই রয়েছে। বুড়ি চেমনআরা সন্দেহের ঊর্ধ্বে।
বুয়ারা একযোগে হুমকি দিল, এ বাড়িতে কামই করুম না। আমরা কি চুন্নি নাকি?
দুপুরের প্রীতিভোজ পক্ষ হওয়ার দশা। শাহজাহানভাই চাল পড়া দিয়ে বললেন, মোবাইল ফোন যে চুরি করেছে সে এ দোয়া পড়া চাল খেলে রক্তবমি করবে।
আট বুয়া চাল চিবালো। সে কি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। কিন্তু কেউ রক্তবমি করলো না।
অবশ্য চেমনআরা বললো, আমি বুড়ি মানুষ, দাত নেই। আমি চাইলেও চাবাইতে পারুম না।
অবশেষে সব বুয়ার ব্যাগ-পুটলি তল্লাশি করা হলো এবং বুড়ি চেমনআরার পান সুপারি রাখার বাক্সে মোবাইল পাওয়া গেল!
বুড়ির সরল স্বীকারোক্তি, নাতিন জামাইরে দেওনের লাই মোবাইলটা চুরি করছি।
বর প- আসবে জুম্মার পর। বাবুর্চিরা মহা ব্যস্ত। দুটি গরু জবাই করে রান্না করা হয়েছে। বার্ড ফু-র ভয়ে ব্রয়লার মুরগি কেনা হয়নি। দেশি মুরগির রোস্ট, খাসির মাংসের কোর্মা, সবজি কারি, কালিয়া, রেজালা, নাগেরদীঘি থেকে টানা জাল দিয়ে ধরা বড় রুই-কাতলা মাছ ভাজা, শামি কাবাব এবং ঐতিহ্যবাহী মোষের দই। এলাহি কা-।
রান্না হয়েছে অপূর্ব সুস্বাদু। তাই নিন্দুকের ফন্দি, হলো সিন্দুকবন্দি। এ দুর্মূল্যের বাজারে এতো ব্যয়বহুল আয়োজনে সবাই বিস্মিত।
আমার শাশুড়ি এ ব্যাপারে সবার চেয়ে উচ্চকণ্ঠ। তিনি বললেন, শাহজাহান, নিজেকে তুমি কি ভাবো? বাদশাহ শাহজাহান? এটা মোঘল আমল নয়। দেশে এখন নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে। এখন জরুরি অবস্থা। মনে রাখবে, তোমার আরো তিন মেয়ে আছে। তাই তোমার মিতব্যয়ী হওয়া আরো জরুরি।
কে শোনে কার কথা? শাহজাহানভাইয়ের মন বড়। তিনি এক হাজার মানুষ খাওয়ালেন।
এ যুগের মেয়েরা ওড়নাটাকে মাফলার হিসেবে ব্যবহার করতেই বেশি পছন্দ করে। কি যে করি, লাজে মরি ভাবটা তাদের নেই। স্বর্ণ, মাটি, কাঠ ও পাথরের নান্দনিক অলঙ্কার তাদের ব্যক্তিত্বে যোগ করেছে বাড়তি অহঙ্কার। তারা বিদেশি প্রসাধনী মেখে দামি শাড়ি ও শর্ট কামিজ পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে বাড়িময়।
যুবতীদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে একটা গ্রুপকে সক্রিয় দেখা গেল। রোমান্টিক সব গান গাইছে কোরাস করে।
এ চক্রটিই বিয়ের গেইটে বরের প্রবেশ পথে বাধা হয়ে দাড়িয়েছিল। তিন হাজার টাকায় রফা হয়েছিল আবার মঞ্চে বরের নাগড়া জুতা চুরি করে তারাই আরো পাচশ টাকা খসিয়েছে।
তানজিনার কাজিন রাসেল হলো এ দলের নেতা। কেউ বা এমপিথ্রি বাজাচ্ছে আর ব্রেক ডান্স নাচছে। রাসেলের মোবাইল ফোনটা অতি আধুনিক। এতে ইন্টারনেট, ব্লু টুথ, এমপিফোর, ভিডিও ক্যামেরা সবই আছে। তাই তার ফুটানিটা অন্য সবার চেয়ে বেশি ছিল।
মধ্যাহ্নভোজের পর হই চই শুনে অন্দর মহলে ছুটলাম। দেখি সুদর্শন গ্রুপ লিডার রাসেলকে তার কলার চেপে ধরে অবিরাম থাপ্পর দিচ্ছেন বড় ভাই (আমার বড় সম্বন্ধী)।
তিনি চেচিয়ে বলছেন, হারামজাদা লুইচ্চা! মোবাইল ফোন সেটে মেয়েদের ছবি তুলে তাদের ব্ল্যাকমেইল করছিস, থ্রেট দিচ্ছিস। থাবড়ায়ে তোর বত্রিশ দাত ফেলে দেবো। এতো বড় দামড়া। অথচ দুই দুইবার ডিগ্রি পরীক্ষায় ফেল করছোস। তোর নাম রাসেল না হয়ে রাসকেল রাখা উচিত। বদমাশ কোথাকার।
মিরানভাইয়ের বেধড়ক মার খেয়ে রাসেল বাহিনী দৌড়ে পালালো। তিনি রাসেলের মোবাইল ফোন আটক করে ভিডিও ফোল্ডার থেকে সব মেয়ের ছবি ডিলিট করলেন।
কন্যা সম্প্রদান পর্বে নববধূর বিলাপ করে কান্না-ই ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু তানজিনাকে দেখা গেল পরম নির্ভরতায় স্বামী কাদেরের হাত ধরে হাসিমুখে গরুর গাড়িতে উঠতে। গ্রামের বাড়িতে প্রাইভেট কার বেমানান। তাই একটি গরুর গাড়িকে ফুল ও রঙে সাজিয়ে বরযাত্রা শুরু হলো। ক্যাসেটে ফুল ভলিউমে বাজিয়ে দেয়া হলো সেই গান, ধুত্তোর ধুত্তোর ধুত্তোর ধু- শানাই বাজিয়ে,
যাবো তোমায় শ্বশুড়বাড়ি নিয়ে....
কন্যা বিদায়ের পর আরেক চমক। আমার মামি-শাশুড়িকে দেখা গেল গোপন বৈঠকে ফিশফিশ করতে। ব্যাপার কি জানতে আমার বৌকে জিজ্ঞাসা করলাম। সে বললো, আমার মামাতো ভাই শাকিলের জন্য সুন্দরী পাত্রীর সন্ধান পাওয়া গেছে। মামানি (মামি) এক বছর ধরে পাত্রী খুজছেন। কিন্তু শাকিলের পাশে মানানসই মেয়ে পাওয়া যাচ্ছিল না। আজ তিনি এ বিয়েবাড়িতে আবিষ্কার করেছেন সম্ভাব্য পুত্রবধূকে।
বললাম কে, কে সেই মেয়ে?
পতিপ্রাণা স্ত্রী রহিমা ওরফে শাহজাদী তুহিন আক্তার বললো, ওই যে আকাশি রঙের থ্রি পিস পরা লম্বা মেয়েটি। চিটাগাং ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ইকনমিকসে অনার্স পাস। ফ্যামিলিও খুব ভালো।
হেসে বললাম, তার মানে এক বিয়েবাড়িতে একটি বিয়ে শেষ হওয়ার পর আরেকটি বিয়ের সূত্রপাত হলো!
©somewhere in net ltd.